• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • এক আশ্রয়ভিখারির বিষণ্ন উচ্চারণ : সিদ্ধার্থ সেন


    আশ্রয় এক আশ্চর্য ঠাট্টা দেবাশিস চন্দ; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৮; আদম - কলকাতা; প্রচ্ছদ : যোগেন চৌধুরী, পৃষ্ঠাঃ ৮০

    পাঁচ ফর্মার কবিতার বই, নামটিতে পাঠকের চোখ আটকে যায়: ‘আশ্রয় এক আশ্চর্য ঠাট্টা’। একটুখানি আশ্রয়ের খোঁজে আতুর মানুষের কথা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। দিন-রাত্রি, আলো-অন্ধকার, অনাদর-বিপন্নতা, বৃষ্টি-রোদ্দুর সবকিছু ছুঁয়ে-ছেনে কবি দেবাশিস চন্দ তাঁর বিষণ্ণতার ক্যানভাসে শব্দের আঁচড় টেনেছেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল ১৯৯১ সালে; নাম ‘কার্নিসে বিষণ্ন মেঘ’। সেই বিষণ্ন মেঘদল এসে জমাট বেঁধেছে এই কাব্যের আকাশেও। দেবাশিস শুধু কবি নন, তিনি লেখক, সাংবাদিক, সম্পাদক। শিল্পকলা বিষয়েও তাঁর আগ্রহের কথা আমাদের অবিদিত নয়। নানা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ থাকলেও তার কেন্দ্রাতিগ আকর্ষণ কবিতার প্রতি। প্রেম আর প্রতিবাদ দুইয়ের প্রতিই তাঁর আকর্ষণ।

    কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কবিতায় সেই অমোঘ পংক্তিটির জন্ম দিয়েছিলেন ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী’— এই নেতিবাদী শূন্যতার দর্শনই হয়তো বা প্রতিটি মানুষের ভবিতব্য। আমাদের প্রিয় এক কবির সেই আন্তরিক আহ্বান মনে পড়তে পারে ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে তুমি একটু তাহার পাশে দাঁড়াও’। এই কাব্যেও আশ্রয়ভিখারি মানুষ নিয়ত আশ্রয়সন্ধানে তৎপর হলেও অন্তিমে সে অনুভব করেছে ‘বিষাদ রাত্রির মৌন অন্ধকারে তুমি একা’। বুকের নীচে লুকিয়ে-থাকা মায়াময় ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো প্রতিটি মানুষের গোপন সত্তাকে খুঁজে বার করবার প্রক্রিয়াটি এই কবির অজানা নয়। তাই নিজের গভীরে ডুব দিতে হয়, গোপন কুয়া থেকে জিনিস তুলে নিয়ে আসার মতো জলে মুখের ছায়া দেখে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। তাই এই কবির হাতেই এক আশ্চর্য পংক্তির জন্ম হয়েছিল: ‘...নিজেরই/গভীরে গিয়ে নিজেকেই দেখা বারবার’ — এই আত্মকে দর্শন করার, আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা কবিতাগুলিকে স্পর্শ করেছে। উৎসর্গ পত্রে লেখা হয়েছে সংক্ষিপ্ত একটি বাক্য ‘সকল গৃহ হারালো যার’ — সেই অনিকেত মানুষ তার জীবনবৃত্তান্তের খন্ড-বিচ্ছিন্ন মুহূর্তগুলি তুলে ধরেছে পাঠকবর্গের সামনে।

    মানুষ যদি তার স্বভূমি থেকে চ্যুত হয় তাহলে সে বাধ্য হয় বিপন্ন পর্যটনে বেরিয়ে পড়তে। সে ভূমি তার বাস্তু ভিটে হতে পারে, আবার ভালোবাসার একান্ত কেন্দ্রটিও হতে পারে। মনটি তখন অনুভব করে ‘বইছে হাওয়া প্রেমহীন মেঘের ভিতর’। সে আরও জানে ‘আমাদের জীবনে যাপন বলে কিছু নেই, মৃত্যুর চৌকাঠে পা’ — সে ডাক যখন আসবে তখন ‘ব্যপ্ত বেলাভূমি’, ‘জেগে থাকা লাইটহাউস’ আরও প্রিয় ‘খেলাঘর’-কে ফেলে রেখে চলে যেতে হবে। কিন্তু বাইরে মুছে গেলেও মানুষ স্মৃতির ঘরের বাসিন্দা হয়ে যায়। ‘ঠাকুমা’ কবিতায় দেখি তাই কবির এমন অনুভূতি: ‘অতএব তুমি যেখানেই যাও.../ আজও যাবে না কোথাও, থেকে যাবে এখানে, এই ঘরে, / পুকুরপাড়ে, উঠোনের তুলসীতলায়, সকাল-সন্ধের সিঁড়ি ভাঙায়’। বেঁচে থাকতে যে মানুষের কোনো খোঁজ নেয় না কেউ মৃত্যুর পরে সেই মানুষটিরই শ্রাদ্ধ-শান্তিকে ঘিরে তৈরি হয় ‘মৃ্ত্যু-উৎসব’-এর আমেজ। কবি লক্ষ্য করেন: ‘লোকটা চলে যাওয়ার পর তোমরা আজ এখানে/ মেতেছ মৃত্যু উৎসবে, মন্ত্রপাঠে, স্বজন-ভোজনে /তোমাদের চকচকে মুখে নেই কোনো শোকের ছায়া’। বস্তুত জীবনে ‘আশ্রয় এক আশ্চর্য ঠাট্টা’ — এই বইয়ের অনেক কবিতাকেই জড়িয়ে আছে গাঢ় এক নস্টালজিয়া — সেদিক থেকে মনে হয় এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাই কোনো এক মানুষের আত্মজীবনীর অংশ। অনিবার্য কারণে, বুকের মধ্যে তীব্র এক বিচ্ছেদ যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ বাস্তুচ্যুত হলে তার মনের কথাটি কবির কলমে সৎ এক উচ্চারণে উঠে আসে: ‘দুয়ার ছেড়ে বেরিয়ে এলে তুমি শেষবারের মতো / যে দুয়ারে ছিল মায়াময় সুনীতি, অবাধ প্রশ্রয় / ঘর বলে তোমার আর কিছু রইল না’। আর তখন সেই বিবাগী মানুষটির মনে হয় ‘আশ্রয় এক আশ্চর্য ঠাট্টা, সঙ্গী ধ্রুবতারা’। এই ধ্বস্ত বিপন্ন সময়ে নীরবে ভেঙে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলি, বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে ফ্ল্যাট, পাড়ার পরিবেশ যাচ্ছে বদলিয়ে, কতো আত্মজনের, পরিজনের স্বেদ-রক্ত জল করা পরিশ্রম আবেগের মৃত্যু ঘটছে নিয়ত নীরবে, কিন্তু আত্মীয়-পরিজনেরা ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে; সংবেদনশীল মানুষটির ভাবনায় এই গোপন ব্যথা চাড়িয়ে ওঠে: ‘লোভের উত্তাপে তোমাকে ছেড়ে গেছে সবাই / আত্মজনেরা মগ্ন সান্ধ্য মৌতাতে, উদ্ধত বহুতলে’।

    শীতের বড়দিনে এখন বাঙালির জীবনে অনিবার্য উপস্থিতি ঘটে সান্তা ক্লজ-এর। সেই বুড়ো সান্তাকে নিয়ে তিনটি কবিতা আছে এই বইয়ে। গত শতকে আন্তর্জালহীন জীবনে বাঙালি শীতের চোঙা পিঠে, পুলিপিঠের আস্বাদময় জীবনে কতটুকু স্মরণ করত তাঁকে? বাঙালি শিশুর স্বপ্নে সেই শীতবুড়োর উপহারে ইচ্ছেপূরণের মোজা ভরে উঠত না, ‘ছিল না লাল বেলুন, টুপি, কেক-পেস্ট্রি, বার্গার, পাস্তা, চকোলেট’ পরিবর্তে ছিল ‘ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, রাতগভীরে শেওড়া গাছ থেকে / নেমে আসা ভূত-পেতনি, দত্যিদানো, পিঠেপুলি, পাঁচ পয়সার বিস্কুট’। অনুকরণপ্রিয় বাঙালি কোথায় যেন নিজের সংস্কৃতি থেকে বহুদূরে সরতে সরতে আত্মধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। মোবাইল-ইন্টারনেট-হোয়াটস অ্যাপ — নানা মোহের ঘেরাটোপে বন্দী মানুষকে দেখে কবি শুনতে পান ‘জলপ্রপাতের মতো কেবলই ভাঙার গান’ যা ‘কোলাহল কন্টকিত আবর্জনায় চাপা পড়ে সুন্দর’।

    এই সচেতনতা, সংবেদনশীলতা তাঁকে শুধু নিজস্ব ব্যক্তিগত অনুভবের যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে না, করে সমকাল-দেশ-সমাজ সম্পর্কেও। লেখায় বাঙালি ও বাংলা ভাষাচর্চায় মুষ্টিমেয় আবেগার্ত মানুষের হৃদ্‌স্পন্দন ১৯শে মে শিলচর শহরে ঘটে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষা দিবসের দিনটিকে নিয়ে, কবির সংবেদী কলম লেখে এক ভবিষ্যতের স্বপ্নের ছবি: ‘ওই দেখো রেল স্টেশনের ওপারে ভাঙা টিনের চালের ঘরে / অ আ ক খ মকসো করছে মেয়েটি, জন্ম নিচ্ছে হাজার হাজার কমলা ভট্টাচার্য, / ওই দেখো টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসছে একটি শিশু / ভাষা শহিদ স্মারকের দিকে, হাতে বাংলা ভাষার জয়পতাকা’। দু-দুটি ভাষা আন্দোলন কবির মনে এই প্রশ্ন জাগায়: ‘গুলি আর বেয়নটে রোখা যায় মুখের ভাষা বুকের রুধির?’

    কোনো আরোপিত সচেতনতা নয়, সংবেদী সচেতনতায় দেবাশিসের কবিমন সমকাল-সমাজকে দেখে। ‘সীমানা তো এক অলীক দম্ভ’ — ‘মৃত্যুদিন’ — ‘স্বজনহারা’ — ‘আলোহীন ভূখণ্ডে’ — ‘গৈরিক তরবারি’ — ‘রাত্রিত্রাস’ — ‘হাওয়া ১’ — ‘হাওয়া ২’ — ‘গৈরিক গর্জন’ — ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি কবিতায় পাঠক তা আবিষ্কার করেন। সীমানার পরিসরে প্রতিটি কবিতার পংক্তি উদ্ধার সম্ভব নয়, দু-একটি কবিতার দিকে তাকানো যেতে পারে: (১) ‘.....হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি, স্বজন-সহমর্মিতায় / অস্থির হাওয়া, বন্দুক, তরোয়াল-আস্ফালন পাল্টে যাক গোলাপ-স্পন্দনে’ (‘সীমানা তো এক অলীক দম্ভ’)। (২) ‘জনগণের বুদবুদে ভরে ওঠে মাঠঘাট, ঝরে পড়ে সব মুকুল,/ ধর্মের নামে বাজে দামামা, ঝলসায় গৈরিক তরবারি’ (‘মৃত্যুদিন’), (৩) ‘হাওয়া এসে বলে যায় পাল্টে যাচ্ছে চারপাশ, / সতর্ক থেকো, কখন কোথায় ঝলসে উঠবে ছুরি, /গুপ্তঘাতকেরা ঘোরে, হাতে স্বপ্ন ভাঙার নোটিস,/ সর্বনাশের অন্ধ খেলায় মেতেছে নির্বাক স্বদেশ’। (‘হাওয়া-১’)।

    শিল্পকলা-ছবি-ভাস্কর্যের বিষয়ে আগ্রহী দেবাশিস নিয়মিত বাংলা, ইংরেজি ভাষায় শিল্পকলার নানা দিক নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন। দু’জন চিত্রশিল্পী নিয়ে তাঁর লেখা দুটি বই আছে — ‘হুসেন’ ও ‘নীরদ মজুমদার’। শিল্পীবন্ধুদের নিয়ে তিনটি কবিতা আছে এই কাব্যগ্রন্থে যাঁদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়, ভালোবাসা তাঁর কাছে ঠাট্টা বলে মনে হয়নি। বড়ো আন্তরিক উচ্চারণে এই কবিতাগুলিতে আছে বন্ধুত্বের স্পর্শ। শিল্পী প্রকাশ কর্মকারকে উৎসর্গিত কবিতা ‘ক্ষয়, যাকে বলে প্রকৃতি’ কবিতায় কবি চমৎকার একটি ভাষাচিত্র নির্মাণ করেছেন: ‘দড়ির এ-প্রান্তে ভালোবাসা, ও-প্রান্তে রোদ্দুর’। বাস্তবিক জীবনরশির একপ্রান্তে ভালোবাসা, অন্য প্রান্তে রোদ্দুর। এই রোদ্দুর আর ভালোবাসাকেই আশ্রয়ের আধারে ধরতে চেয়েছেন কবি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসফল হয়েছেন। কয়েকজন প্রিয়বন্ধুর চিরকালীন প্রস্থানে বিচ্ছেদব্যথায় আতুর কবিমন অনুভব করে ‘যাওয়ার জায়গাগুলো ক্রমশ আসছে কমে, বাতি নিভছে শহর কলকাতার রঙিন দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসছে’। স্মৃতির ঘরের সেইসব বাসিন্দা বন্ধুরা তাদের স্বভাবচরিত্র, সংলাপসহ জীবন্ত হয়ে ওঠেন কাব্যের শরীরে। তাই পরিচিত অনেক ছবি ফিরে এসে ভিড় করে কবিতার ক্যানভাসে। মনে হয় ‘নিশি জমায়েতগুলো কেমন যেন পানসে। নেই তর্কের তুফান, নেই রক্ত টগবগ, /নেই প্রকাশদার ফুটবল নাচ, এগিয়ে দেওয়া কাগজে চটজলদি ড্রইং’ কিংবা ঘোড়া আঁকতে আঁকতে যাঁর নাম ঘোড়া দাস সেই সুনীল দাসের দরাজ গলার ডাকের অভাবে মনে হয় ‘রং ফুরিয়ে আসছে কলকাতা-ক্যানভাসের, কলকাতা তবে বুড়িয়ে গেল?’

    আবার এই বইয়ের প্রচ্ছদ যে শিল্পীর তুলিতে নন্দিত হয়েছে সেই যোগেন চৌধুরীর আঁকা ‘বুদ্ধিজীবী’ নামের ছবিতে আঁকা চালকুমড়োকে দেখে কবির মনে হয় জীবনানন্দীয় চালকুমড়োটির প্রতীকটিকে, তাঁর নির্ভীক কলম লেখে: ‘বুদ্ধিজীবীরা আজ অনেকেই গিরগিটি, আপনার ছবির চালকুমড়োর মতো নিরেট একেক জন।‘ এই সাহস তাঁর আছে বলেই প্রতিবাদী কিছু কবিতায় সমসময়ের সমাজে রক্তপাতের ব্যথাতুর চিহ্নকে তিনি আঁকতে দ্বিধাবোধ করেন না। তাই ‘ভারতবর্ষ’ নামের ছোট্টো একটি কবিতায় মেলে এমন উচ্চারণ: ‘এক পা এগোলে অন্ধকার, /এক পা পিছোলে অন্ধকার’। সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ-এর নারকীয় হত্যার প্রতি যাবতীয় ঘৃণা, ধিক্কার উগরে দেয় তাঁর কলম, হত্যা করে ধর্মের জিগিরে মানুষকে চিরকালীন ভয়ে ভীত রাখা যায় না। তাই অবিনাশী সত্তা জেগে আছে দেশ জুড়ে, সংঘবদ্ধ হয় প্রতিবাদ। কবির কলমে জন্ম নেয় অপূর্ব পংক্তি: ‘গৌরী কি কখনো যায় ভাসানে, সে তো থাকে ঘরে ঘরে’।

    এই কাব্যের বেশির ভাগ কবিতাতেই শব্দানুষঙ্গ আবর্তিত হয়েছে আত্মকে ঘিরে — এই লিরিকধর্মিতা, অনুভবের নিবিড় উচ্চারণ পাঠককে ডেকে নিয়েছে কবিতার কাছাকাছি। প্রায় সাড়ে চার পাতা জুড়ে আছে ‘উদ্বাস্তু’ নামের একটি কবিতা যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে একটি মানুষের জীবনের নানা পর্বের নানা স্মৃতি, সুখ-দু:খ-বিচ্ছেদ-আনন্দ-আঘাতে জর্জরিত মানবজীবন, আশেপাশের স্বার্থপর আত্মজনের কথা যাদের ঘৃণা ‘খুনি বুলেটের মতো’ ধেয়ে আসে; যে-সমস্ত মানুষের ‘চোখেমুখে লোভের চোঁয়া ঢেকুর, পকেটে স্বার্থের অস্ত্র ঝলসায়’। অথচ বুকের নীচে লুকিয়ে-থাকা সেই বসতবাটি জেগে থাকে, যার ভিত আঁকড়ে বটগাছের মতো জীবন থাকতে চায় — সেই জীবনকেই উপড়ে ফেলে দেয় পিয়জনদের হাত অথচ ভাবলেশহীন তাদের মুখ। আত্মযন্ত্রনায় ঠাকুমার চিতার আগুনের মতো পুড়তে পুড়তে কবিমন উপলব্ধি করে ‘শিকড় থেকে উপড়ে ফেলার খেলা কী বীভৎস! উদ্বাস্তুর দিকভ্রষ্ট দৌড়’। বাহ্যপৃথিবীতেই মানুষ শুধু উদ্বাস্তু হয় না, অন্তরের পৃথিবীতে আমরা অনেক মানুষই ভালোবাসার ভিটেমাটি থেকে চ্যুত হয়ে পড়ি, হয়ে পড়ি শরণার্থী, আশ্রয়ভিখারি।

    কবিতাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে, চর্চা করতে করতে দেবাশিস একটি নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। ‘ছবি আঁকিয়েদের কবিতা’ গ্রন্থের সম্পাদক জানেন কীভাবে কবিতার মধ্যে ছবিকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। ভাবনার অভিনবত্ব, ভাষাভাষির স্বাতন্ত্র্য তাঁকে দিয়ে লেখায় ‘ন্যায়-অন্যায়’ –এর মতো কবিতা। ‘কাঠের পাপোশ’- ‘বৃক্ষ-স্থাপত্য’- ‘অমলতাসের সবুজ গন্ধ’- ‘বিষণ্ন কুলুঙ্গি’ ইত্যাদি কবিতা সেই বিশ্বাসকে আরও গাঢ়তর করে।

    তথাকথিত ছন্দোবদ্ধ কলাবৃত্ত বা দলবৃত্তের সাক্ষাৎ মিললো না এই কাব্যে যদিও সেই শর্ত আরোপও কেউ করছে না কবির উপর। কবিতার জন্মরহস্য দেবাশিসের যে অজানা নয় তার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন দেবাশিস এই কাব্যের নির্মাণে — এই সত্য স্বীকারে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। শিল্পের হাতছানি তিনি নিয়ত দেখেন তাই আমরা বরং প্রতীক্ষা করি তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের। তা অসম্ভব নয় কেননা তিনি জানেন ‘ঘরের বাইরে কত ঘর, ডাকটিকিট, মাটির অমোঘ টান / ওপার থেকে আবার এপার, নতুন চলা, ছড়ানো নুড়িপাথর’।

    আরও অনেক না-বলা কথায় এপার-ওপার জুড়ে হোক অনুভূতির সাঁকো, দেবাশিসের হাতটি ধরে আমরা তা পার হয়ে চলতে থাকবো এই আশা রাখি।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments