সিংহমশাইয়ের গান গাওয়ার শখ-টা ইদানিং বড় বেড়েছে।
কয়েকদিন আগেও এত বাড়াবাড়ি ছিলো না। অন্য আর পাঁচজনের মতন, সিংহমশাইও মনে ফুর্তি এলে একটু আধটু গুনগুন করতেন, তবে ওই পর্যন্তই। কিন্তু সব গণ্ডগোল করে দিলো বোকা গাধাটা।
মিষ্টি ভোরের আলো সেদিন। মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। খুশিমনে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে সিংহমশাই গুনগুন করে গান গাইছিলেন। উল্টোদিক থেকে মর্নিং ওয়াকে আসছিলো গাধাটা। হঠাৎ কি মনে হলো, ওকে ডেকে সিংহমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, “কি রে, শুনলি? কেমন গাইছি?” গাধা শুনে একগাল হেসে বললো, “ভালোই গাইছেন রাজামশাই, তবে আমার মতন ভালো নয়!”
সেদিন সকালে সিংহমশাই গাধার মাংসে ব্রেকফাস্ট সারলেন। আর তাতেই হলো গণ্ডগোল।
কে না জানে সাত-সকালে খালি-পেটে গাধা খেলে বায়ুরোগ প্রবল হয়ে ওঠে? পুষ্টি-টুষ্টি নিয়ে যারা গবেষণা করে সেই সব সিংহ পণ্ডিতেরা তো এসব কতকাল আগে সবাইকে জানিয়ে রেখেছে।
ফল যা হবার তা হলো।
ভোর হলেই সিংহমশাই এখন বাড়ির পাশের টিলার উপর চড়ে বসে গলা সাধা শুরু করেন। সারাদিন ধরে তাঁর গলা সাধা চলে, খালি খাবার সময়টুকু বাদে।
সিংহ মশাইয়ের এই রকম ভাবগতিক দেখে সিংহী খুব চিন্তিত। গত কয়েকদিন ধরে হয় তিনি নিজেই শিকার করছেন, নয়তো জোর করে সিংহমশাইকে শিকারে পাঠাচ্ছেন।
কানাঘুষোয় সিংহী খবর পেয়েছেন সিংহমশাই আজকাল শিকার ধরে তাদের মারার আগে গান শোনাচ্ছেন। খরগোশ, হরিণ-এর মতন যাদের তাঁরা ধরে খান, তারা তো বটেই, অন্য সব প্রজারাও নাকি বেদম চটে গেছে। মারবি মার, তাই বলে গান শুনিয়ে মারবি? জঙ্গলে বেশ একটা বিদ্রোহের আবহাওয়া।
খবরটা পেয়ে চিন্তায় সিংহীর কয়েক রাত ভালো ঘুম হয় নি। সীমানার ঠিক ওপারে কিছু বদমাস চিতাবাঘ এসেছে কয়েকদিন হলো। তাদের সব নজর নাকি এখন সিংহমশাইয়ের রাজ্যের দিকে। অথচ যার রাজ্য তার-ই কোনো হুঁশ নেই। এরকম অবস্থায় একবার যদি রটে যায় রাজামশাই পাগল হয়ে গেছেন তাহলে আর দেখতে হবে না।
সিংহীর সমস্যার কথা শুনে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী লেডি হায়না তাঁকে শেয়াল-ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বললেন।
শেয়াল-ডাক্তার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, অর্থাৎ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বয়স বেশি নয়, তবে অল্প বয়সেই বেশ নাম করেছেন। বিশেষ করে পাশের জঙ্গলের একটা ভীতু বাঘকে মানুষখেকো করে তোলবার পর থেকে জঙ্গল জুড়ে শেয়াল-ডাক্তারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।
গোপনে শেয়াল-ডাক্তারের সাথে দেখা করলেন সিংহী।
সব শুনে শেয়াল-ডাক্তার হাসলেন। বাঁ হাত দিয়ে স্টেথোস্কোপে মৃদু টোকা মারতে মারতে বললেন, “গান-গাওয়ার রোগ তো? কোনো ব্যাপার না, ও রোগ আমি সারিয়ে দেবো, তবে রোগীর সাথে আমাকে দেখা করতে হবে আর ভাব জমাতে হবে। পনের দিন লাগবে, টোটাল পনের লাখ টাকা ট্রিটমেন্ট কস্ট।”
ঢোঁক গিললেন সিংহী -- “পনেরো লাখ?”
শেয়াল-ডাক্তার হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, “তা এটুকু তো লাগবেই!”
সিংহী আবার ঢোঁক গিললেন, বললেন, “টাকা নাহয় দিলাম, কিন্তু কি করে আপনার কাছে ওকে নিয়ে আসি বলুন তো? ও পাগল তো কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যাবে না!”
সিংহীকে আশ্বস্ত করলেন শেয়াল-ডাক্তার। বললেন, “না, না, ওভাবে হবে না। আপনাদের বাড়িতে আমাকে নেমন্তন্ন করুন, কিন্তু আমি যে ডাক্তার খবরদার সিংহমশাইকে এ কথা বলবেন না। আমি একজন গান বিশেষজ্ঞ এই বলে আমার পরিচয় দিলেই চলবে।”
-- শুধু এই! কোনো ওষুধ লাগবে না?
-- লাগবে। নিউরনগুলোর এলাইনমেন্ট ঠিক করার জন্য দুটো ওষুধ দিচ্ছি নিয়ে যান, চুপি চুপি ওনার খাবারে মিশিয়ে দেবেন। তবে আসল অসুখ তো মনে, তাই এই কদিন সিংহমশাইকে ভালো ভালো জিনিস খাওয়ান, এ রোগে মনটা প্রসন্ন থাকা খুব জরুরি। হ্যাঁ, এক লাখ টাকা এডভান্স, উঁহুঁ, উঁহুঁ, চেকে নয়, ক্যাশে!”
মানিব্যাগ থেকে কড়কড়ে পঞ্চাশখানা দুহাজার টাকার নোট বের করে শেয়ালকে দিলেন সিংহী।
ঠিক হলো আগামীকাল পূর্ণিমার রাত্রে শেয়াল-ডাক্তার তাঁদের বাড়িতে ডিনারে আসবেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যে সিংহের সাথে আড্ডা জমিয়ে ফেললো শেয়াল-ডাক্তার। সিংহ মুগ্ধ। একটা লোক গান নিয়ে এত জানে, এত তার পড়াশুনো! এই রকম সমঝদার লোকের কাছে গান গাইতে পেলে যে কোনো শিল্পী জান দিয়ে দেবে।
মন দিয়ে সিংহের গান শুনলো শেয়াল, তাল ঠুকলো সামনের দু পা দিয়ে আর থেকে থেকেই ঠিক সমের মুখে বলে চললো, “অসাধারণ! অসাধারণ!! কেয়াবাত!”
তারপর থেকে রোজ সন্ধ্যাবেলা শেয়াল-ডাক্তার সিংহের বাড়ি আসে, শুধু মন দিয়ে গানই শোনে না, ক্রমাগত তারিফ করে যায়। আসর-শেষে পেট পুরে ডিনার করে আর যাবার আগে চুপিচুপি সিংহীর থেকে পঞ্চাশখানা দু’হাজার টাকার নোট নিয়ে যায়।
পাঁচদিন পরে সিংহী অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলেন।
হাসলেন শেয়াল-ডাক্তার -- “নিউরোটিকো মিউসিকাইটিস কি এত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়? আরো কিছুদিন লাগবে। বেশি তাড়াতাড়ি করতে গেলে রোগী হিংস্র হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, আগামীকাল ডিনারে হরিণের মাংসের মালাই-টিক্কা করুন।”
দিন দশেক কাটার পরে ডিনারে বসে বিশাল বড় একটা মাংসের টুকরো চিবোতে চিবোতে, শেয়াল-ডাক্তার সিংহকে বললেন, “স্যার, এমনি ভাবে টিলায় বসে গান গেয়ে সময় কাটাচ্ছেন, পৃথিবীর বাকি সবাই তো শুনতেও পাচ্ছে না, জানতেও পাচ্ছে না! যখনই এসব ভাবি, আমার খুব দুঃখ হয়। আপনার কি মনে হয় না আপনার গান পৃথিবীর সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত?”
আনন্দে সিংহমশাইয়ের গায়ে কাঁটা দিলো, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ইচ্ছে তো আছে অনেক, কিন্তু কিভাবে যে করবো তাই ভাবি!”
-- ও সব আপনি কিচ্ছু ভাববেন না স্যার, সব ব্যবস্থা আমি করবো। আপনি শুধু একবার 'হ্যাঁ’ বলে দিন!
সিংহমশাই একগাল হেসে ফেলে বললেন, “এমন প্রস্তাবে না কি করা সম্ভব!”
শেয়াল তখন বললো, “ভেরি গুড! তাহলে কাল আমি টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসবো, আপনার যত গান আছে সব টেপ করবো। সেই টেপ আমাকে নিয়ে যেতে হবে টেলিভিশন স্টুডিওতে। চ্যানেলের মালিক জব্বর খান সাহেব নিজেও মস্ত গায়ক, আমার পরিচিত। আপনার গান যদি ওনার পছন্দ হয় -- পছন্দ হবেই -- আমি আপনাকে খবর দেব।”
বিপুল উৎসাহে তিন দিন ধরে গান টেপ করা হলো সিংহর। টেপ নিয়ে চলে গেলো শেয়াল।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা শেয়াল এসে বললো, “জানেন, জব্বর খান সাহেব আপনার গান শুনে আমাকে ঘুঁষি পাকিয়ে তেড়ে এসেছেন। বলেন, এত বড় একটা ট্যালেন্টকে তুই কিনা আমার থেকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলি, তুই ক্রিমিনাল! যা যেখান থেকে পারিস ওনাকে এখনই আমার কাছে নিয়ে আয়!”
শেয়াল আরো বললো, “তা আমি বাপু খান সাহেবকে বলে দিয়েছি, যে কোনো দিনও না, যে কোনো রাগও না, আপনি আগামী কাল অমাবস্যার রাতে সিংহেন্দ্রমধ্যম রাগ গেয়ে আপনার ইনিংস শুরু করবেন। এখন আসি, খুব ভালো করে প্র্যাকটিস করুন, আগামী কাল রাত্রে ডিনারের পরে আমরা যাবো খান সাহেবের বাড়ি।”
আনন্দের চোটে সিংহমশাই লক্ষ্য করলেন না যে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় শেয়াল যেন মুখ টিপে টিপে হাসছে।
অমাবস্যার রাত্রে দু’জনে মিলে রওনা হলো জব্বর খানের বাড়ি।
অনেক অনেক পথ হেঁটে, অনেক চড়াই, উৎরাই বেয়ে ওরা দুজনে একটা ছোট্ট গুহার সামনে এসে দাঁড়ালো। গভীর রাতে চারিদিক শুনশান, কোনোখানে কোনো আওয়াজ নেই, জনপ্রাণী নেই। সিংহেন্দ্রমধ্যম রাগের একেবারে আদর্শ পরিবেশ।
সিংহমশাই এতক্ষন ধরে গুনগুন করে প্র্যাকটিস করে গেছেন আর শেয়ালকে অন্ততঃ পঞ্চাশ বার জিজ্ঞাসা করেছেন তাঁর গান জব্বর খানের পছন্দ হবে কিনা। শেয়াল হেসে এক জবাব দিয়ে গেছে, “আপনার গান না পছন্দ করে উপায় আছে?”
সিংহমশাইয়ের নজর শুধু গানের উপরই ছিলো। কোথায় যাচ্ছেন, সামনে কি আছে কিচ্ছু খেয়াল করেন নি। এবার তাকিয়ে দেখেন গুহার ঠিক মাঝখানে একটা খাট আর তাতে একটা তানপুরা রাখা রয়েছে। শেয়াল বললো, “বসে পড়ুন, স্যার, খান সাহেব বোধ হয় খাওয়ার পরে একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন। আমি ওনাকে ডেকে আনছি।
সিংহমশাই খাটের উপর বসে তানপুরাটা হাতে নিলেন। আর অমনি ঘড়ঘড় করে একটা বিকট শব্দ হলো আর গুহার দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। গুহাটা আসলে একটা খাঁচার মতন!
অবাক হয়ে সিংহ বললো, “এ কি? দরজা বন্ধ হয়ে গেলো কেন? খান-সাহেব কই?”
শেয়াল মধুর হাসি হেসে গুহার দরজায় একটা মস্ত তালা লাগাতে লাগাতে বললো, “ভ্যানিশ!”
-- মানে?
-- মানে ভ্যানিশ! জব্বর খানের গল্প না বানালে আপনাকে কি আর খাঁচায় পোৱা যেত স্যার? তাই তো জব্বর একটা নাম বানালাম!
-- খাঁচা! এসব কি ইয়ার্কি হচ্ছে? খোল! খোল বলছি! কার সাথে বদ-রসিকতা করছিস খেয়াল আছে?
-- তা আছে বৈকি, স্যার! তবে রসিকতা যখন শুরু করেই ফেলেছি, মাঝপথে থেমে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
সিংহমশাই দরজার দিকে তেড়ে গেলেন শেয়ালকে কামড়াবেন বলে, কিন্তু শেয়াল তার আগেই তালা লাগানো শেষ করে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে ফেলেছে। সেখান থেকে সে খুব নরম গলায় সিংহকে বললো, “খামোখাই রেগে যাচ্ছেন, স্যার! অনেক গান শুনেছি আপনার। কি যে কষ্ট হয়েছে বলে বোঝাতে পারবো না! যা ভাউয়া ব্যাঙের মতন গলা আপনার! যাক, এবার আমার পালা। ভয় পাবেন না স্যার, আর কিচ্ছু করবো না, খালি গান শোনাবো আপনাকে!”
সিংহমশাই প্রাণপণে গুহার দরজাটা ঝাঁকিয়ে সেটা ভাঙবার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু পারলেন না। দরজাটা লোহার মস্ত মোটা মোটা শিক দিয়ে বানানো। একটা কেন, পঞ্চাশটা সিংহ এক হয়ে চেষ্টা করলেও সে দরজা ভাঙা সম্ভব নয়।
সিংহকে দরজাটা কামড়াতে দেখে শেয়াল হাঁ-হাঁ করে উঠলো, “ও কি করছেন স্যার, ফোকলা হয়ে যাবেন শেষে! আর কিছু না, শুধু গান তো, লক্ষ্মী ছেলের মতন চুপচাপ বসে শুনুন এখন!”
কোথা থেকে কি একটা রিমোট জোগাড় করে তার বোতাম টিপলো শেয়াল। বিশাল, বীভৎস ভলিউমে লুকোনো কোনো একটা টেপ রেকর্ডার থেকে গান চালু হয়ে গেলো, টেপ রেকর্ডারটা অন্তত পঞ্চাশটা মাইকের সামনে রাখা! বন্ধ গুহার দেওয়ালের বিভিন্ন দিকে সেই শব্দের আবার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। এক মিনিট শুনলেই কানের পোকা নড়ে যাবে এমনি আওয়াজ!
টেপ রেকর্ডারে সিংহেন্দ্রমধ্যম রাগ বাজছে। সিংহমশাইয়ের নিজের গলায় গাওয়া!
তিন দিন বাদে লোকের মুখে খবর পেয়ে সিংহী এসে তালা ভেঙে খাঁচার দরজা খুললেন।
সিংহমশাই অজ্ঞান হয়ে খাঁচার একধারে পড়েছিলেন, সিংহী এসে চোখেমুখে জলের ছিটে দেবার পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, উঠেই বললেন, “সিংহী, আমি শেয়াল খাবো, শেয়ালের মাংসের ঝাল-চচ্চড়ি!”
সিংহী অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে সিংহমশাইকে বাড়ি নিয়ে গেলেন!
আশ্চর্য শেয়াল-ডাক্তারের চিকিৎসা। সিংহমশাইয়ের গান গাওয়ার নেশা পুরোপুরি ছেড়ে গেছে। গান শুনলেই সিংহমশাই এখন কেমন যেন শিউরে ওঠেন।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই যে সিংহমশাইকে এখন কবিতা লেখার নেশাতে পেয়েছে। সকাল থেকে সারাদিন সিংহমশাই টিলার উপরে বসে একের পর এক কবিতা লিখে যান। সব কবিতারই বিষয় এক: শেয়ালের মাংসের ঝাল-চচ্চড়ি।
হ্যাঁ, শেয়াল-ডাক্তারের মাংসের ঝাল-চচ্চড়ি আর খাওয়া হয় নি সিংহমশাইয়ের কারণ শেয়াল-ডাক্তার সেদিনের পর থেকে উধাও। সেই দুঃখ ভুলতে সিংহমশাই এখন রোজ শুধু মানুষ ডাক্তারের মাংসের ঝাল-চচ্চড়ি খাচ্ছেন।
এবারে তোমরা বুঝলে তো, ডাক্তার হবার কত জ্বালা?