।। ১ ।।
“হে মহাজ্ঞানী, আপনার গণনায় কোনও ভুল হয়নি তো? আমায় মার্জনা করবেন, কিন্তু সামান্যতম বিচ্যুতি হলেও তো এ ঘটনা এড়ানো সম্ভব!”
বিকেলের ঢিমে রোদ স্নেফেরুর সোনার মুকুটে ঠিকরে পড়েছে, প্রতাপান্বিত ফারাওকে বড়ই বিষণ্ণ লাগছে আজ৷ একদৃষ্টে নীলনদের স্থির জলের দিকে তাকিয়ে মুখ খুললেন ইমহোতেপ — “হে আমার ঈশ্বর, গণনায় ভুল হলে আমার চেয়ে আনন্দিত আর কেউ হবে না৷ কিন্তু এ শত সহস্র বৎসরের পর্যবেক্ষণের ফল — বহু যত্নে গোপনে সংরক্ষিত আছে হেলিওপোলিস—এ৷ আজ পর্যন্ত কেউই তা জানতে পারেনি৷ কিন্তু আমার মনে হয়েছে আপনাকে জানানো দরকার — কারণ আপনিই পারেন আমাদের পরিকল্পনা সার্থক করতে৷” স্নেফেরুর চোখ পড়ন্ত সূর্যের দিকে —
“জ্ঞানী ইমহোতেপ, আপনার দূরদৃষ্টির জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়৷ প্রাণের অধিক প্রিয় মিশর—বাসীকে রক্ষা করাই আমাদের এখন প্রধান কর্তব্য৷ আপনিই পথনির্দেশক, দয়া করে আমায় পথ দেখান৷”
“এস্থানে এত স্বল্পসময়ে বিশদে আলোচনা সম্ভব নয়, হে ওসিরিস পুত্র৷ কাল প্রভাতে সূর্যোদয়ের পূর্বে যদি হেলিওপোলিস—এ আপনার পদধূলি পড়ে তাহলে পুরো পরিকল্পনা বোঝাতে সুবিধা হয়৷” অনুনয়ের সুরে বলে ওঠেন ইমহোতেপ৷
“আপনার অনুরোধ রক্ষা করা আমার কর্তব্য, হে পুরোহিত শ্রেষ্ঠ৷ কাল ঊষালগ্নে আপনি অবশ্যই আমার সাক্ষাৎ পাবেন৷”
বলে আর দাঁড়ালেন না স্নেফেরু — ধীর পায়ে নীলনদের পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করলেন৷ বৎসর শুরুর চিহ্ন দেখা দিয়েছে, জল দ্রুত বাড়ছে৷ এই বন্যাই নতুন বছরের আগমন বার্তা নিয়ে আসে — কোনও বারই এর ব্যতিক্রম হয়না৷ নদের দুধার আবার উর্বর হয়ে উঠবে, ধরিত্রী হবে শস্যশ্যামলা৷ কিন্তু কতদিন? হালকা এক দীর্ঘশ্বাস তাঁর অজান্তেই যেন বেরিয়ে আসে৷
।। ২ ।।
বাওভেল জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন — হঠাৎই এরোপ্লেনটা গোঁত্তা খেয়ে অনেকখানি নীচে নেমে এল৷ আসলে কায়রোর পথে যাওয়ার সময় প্রায় সমস্ত বিমানই এটা করে৷ গিজার বিখ্যাত পিরামিডগুলি যাত্রীদের একবার দেখার সুযোগ করে দেওয়া আর কি! অদ্যাবধি, মানুষের বানানো সবচেয়ে প্রাচীন, নিখুঁত ও অবিশ্বাস্য রকম সুন্দর স্থাপত্য — যা কালের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার বছর৷ বাওভেল আসলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, তবে বেশ কয়েক বছর হল সব ছেড়ে পিরামিডের নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন৷ ইতিমধ্যে বিখ্যাত জার্নাল ডিসকাশনস ইন ইজিপ্টোলজি—তে তাঁর লেখা বেরিয়েছে, প্রশংসার চেয়ে সমালোচনাই অবশ্য হয়েছে বেশি৷ তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলেন৷ কারণ বহুদিনের প্রচলিত বিশ্বাসের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি, ইজিপ্টোলজিস্ট প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব ব্রেসটেড—এর তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন৷ তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সেযুগের মিশরীয়রা সূর্য বা গ্রহ নয় — সুদূর নক্ষত্রের উপাসনা করতেন৷ তাঁরা নিজেদের সাহুর (কালপুরুষ) দেশের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করতেন৷ সেই ওরিয়নেই ফারাওদের জন্ম আর সেখানেই মৃত্যুর পর মুক্তি৷ কিন্তু ব্রেসটেড—কে কেউ চটাতে সাহস পেল না, সবাই রে রে করে তেড়ে এলো তাঁর দিকে — ছুঁড়ে দিল বিদ্রূপের বাণ৷
বিষণ্ণ হেসে আবার একবার নীচের দিকে তাকালেন বাওভেল৷ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন — সবচেয়ে বড়টা খুফুর, এরপর তাঁর পুত্র খাফরা, আর সবচেয়ে শেষের ছোটটি নেমেকুরার৷ চতুর্থ বংশের তিন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফারাও৷ চোখ সরাতে গিয়েও পারলেন না বাওভেল — নাহ, কারণটা ঠিক পিরামিডের সৌন্দর্য নয়৷ গিজায় তাঁর বহুবার আসা, কিন্তু ব্যাপারটা আগে কেন সেভাবে খেয়াল হয়নি! ওপর থেকে বোঝা যাচ্ছে পিরামিড তিনটি এক সরলরেখায় নেই৷ খুফুর থেকে খাফরার পিরামিডটি একটু যেন পূর্বদিকে সরে গেছে৷ আর নেমেকুরার পিরামিডটি অনেকটাই পূর্বদিকে সরে গেছে৷ আশ্চর্য তো! এক সরলরেখায় থাকলে তো দেখতে অনেক ভালো লাগতো! যে জাতির জ্যামিতির সূক্ষ্ম ধারণাগুলি ছিল নখদর্পণে, তারা এতবড় ভুল করবে! তাহলে কি জায়গার অভাব ছিল? নাঃ, প্রচুর ফাঁকা জায়গা পড়ে রয়েছে৷ আর, নেমেকুরাই বা অতো ছোট পিরামিড বানাতে রাজি হলেন কেন? প্রভাব প্রতিপত্তিতে তিনি বাকিদের চেয়ে তো কোন অংশেই কম ছিলেন না! তার ওপর তিনি পেয়েছেন প্রচুর দক্ষ শ্রমিক, যারা দু—দুটি পিরামিড বানিয়ে ফেলেছেন ততদিনে৷ তাঁর অভিজ্ঞ চোখ বলছে এটা প্ল্যানড৷ একটি নিখুঁত ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান৷ নাঃ, আজই একবার এডওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলে গিজায় মাপজোকের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে৷ উত্তেজনায় ছটফট করছিলেন বাওভেল৷
।। ৩ ।।
এডওয়ার্ড একদৃষ্টে চেয়েছিলেন বিশাল পাথরটার দিকে — আইটেম নাম্বার ৪৯৮, ব্রিটিশ মিউজিয়াম৷ কুচকুচে কালো গ্রানাইট পাথর — লম্বায় ১.৩ মিটার, চওড়ায় ১.৫ মিটার৷ পাথরের শুরুতেই লেখা, ২৫তম বংশের ফারাও সাবাকা (৭১০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) এক অতি প্রাচীন পুঁথির কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে লিপিবদ্ধ করেছেন — কারণ সেই পুঁথি এক পোকার আক্রমণে নষ্ট হতে বসেছে৷ এই সাবাকা লিপি বহুবার পড়েছেন এডওয়ার্ড, কিন্তু এক—জায়গায় এসে প্রতিবারই হোঁচট খেয়েছেন৷
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডক্টর এডওয়ার্ড, পিরামিড বিষয়ে তিনি যেন এক চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া৷ বহু ছাত্রছাত্রী এবং অধ্যাপক তাঁর পরামর্শ নিতে প্রায়ই এখানে আসেন৷ সেভাবেই ১৯৮৯—এর এক শীতের সকালে হাজির হয়েছিল এক প্রবাসী মিশরীয় তরুণ৷ নাম বাওভেল, বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখদুটি৷ যদিও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনো, কিন্তু বর্তমানে নেশার মত পড়ে রয়েছে পিরামিডের পেছনে৷ তাঁর এক অক্সফোর্ডের বন্ধুর জার্নাল, ডিসকাশনস ইন ইজিপ্টোলজি—তে নিজের লেখা প্রকাশ করতে সাহায্য চাইছিল বাওভেল৷ লেখাটি প্রাচীন মিশরীয়দের রা বা সূর্যের উপাসনাকারীদের বদলে সাহু বা কালপুরুষের উপাসনাকারী বলা হয়েছে৷ প্রবল বিরোধিতা অবশ্যম্ভাবী, তাও তিনি বন্ধুকে ছাপাবার অনুরোধ করেন৷ আর এর কারণ বাওভেলের অসাধারণ সব যুক্তি৷
এই সব নিয়েই আজ কথা হচ্ছিল মিউজিয়ামে তাঁর নিজের অফিসে —
— বাওভেল, তুমি কখনও পিরামিডলিপির কথা শুনেছ?
জানতে চান এডওয়ার্ড৷
— নাতো! কোনও পিরামিডের দেওয়ালে কিছু লেখা আছে বলে তো শুনিনি!
বেশ অবাকই হলেন বাওভেল!
—আসলে সাধারণত পিরামিডের দেওয়ালে কোনও হেয়রোগ্লিফিকস লিপির দেখা পাওয়া যায়না৷ কিন্তু ১৮৮২ সাল নাগাদ, ফ্রান্সের সার্ভিসেস দ্য অ্যান্টিকস-এর ডিরেক্টর মাসপেরো খুঁজে পান সাকারায় ফারাও উনাস-এর পিরামিডটি৷ পিরামিডের ভিতরের মসৃণ চুনাপাথরে নীল রঙের ওপর সোনালী রঙে লেখা ছিল প্রায় চার হাজারের ওপর লাইন৷
এডওয়ার্ডের এই কথায় চমকে ওঠেন বাওভেল৷
—উনাস মানে তো পঞ্চম বংশের শেষ ফারাও, মানে প্রায় ২২০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ৷ অর্থাৎ ৪২০০ বছর আগেকার কথা৷ কিন্তু তাহলে গিজার পরে তৈরি এই পিরামিড!
—কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কোনও প্রাচীন পুঁথির কিছু বিশেষ পাতা এখানে লিখে রাখা হয়েছে — কারণ তা সম্ভবতঃ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল৷ আসল পুঁথিটি ফারাও মেনা-এরও (৩৩০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) আগের, মানে কম করেও ৫৫০০ বছরের পুরানো৷ বেশ কিছু রহস্যময় জটিল ফর্মুলার উল্লেখ রয়েছে এই লিপিতে৷ অদ্ভুতভাবে এই দেওয়াললিপি নিয়ে বিশেষ হইচই হয়নি৷
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন বাওভেল৷
—হয়তো কেউ ঠিক বুঝতেই পারেনি৷
—কতকটা তাই৷ আমার হাতে এসেছিল এই দেওয়াললিপির অনুবাদ, যা ১৯৬৯ সালে করেছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ হেয়রোগ্লিফিকস বিশারদ মিঃ ফলকনার৷ কিন্তু কিছু জিনিস আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়৷
—কি জিনিস? সাগ্রহে জানতে চান বাওভেল৷
—আমি এখনই বলে তোমার চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করতে চাইনা বাওভেল৷ তুমি কি একবার সাকারার পিরামিড-এ যেতে পারবে? ফটো তুলে আনতে পারবে সে দেওয়াললিপির?
তরুণ বাওভেলকে এক প্রকার অনুরোধই করে বসেন এডওয়ার্ড৷
—আমার এমনিই যাওয়ার কথা সামনের সপ্তাহে৷ আমি ফিরে এসেই আপনার সাথে যোগাযোগ করব৷
বাওভেল বিদায় নিতেই এডওয়ার্ড পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন পাথরটার দিকে৷ আবারও মন দিয়ে পড়লেন সেই জায়গাটা৷ অজান্তেই যেন শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল৷ তবে কি...নাঃ, আগে বাওভেল বরং ছবি নিয়ে ফিরে আসুক৷
।। ৪ ।।
হোটেলে ফিরেই দ্রুত তৈরি হয়ে নিলেন বাওভেল, দুপুরের মধ্যেই সাকারায় পৌঁছতে হবে৷ উনাসের পিরামিডলিপির ছবি তুলতে হলে দিনের আলো থাকা খুব জরুরী৷ মিশরের প্রতিটি পিরামিডের ঢোকার মুখ উত্তর দিক দিয়ে — এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না৷ মাথা নিচু করে ঢুকেই অবাক বিস্ময়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাওভেল৷ অপূর্ব সুন্দর সোনার জলে লেখা — কিছু পৌরাণিক কাহিনী, কিছু মরণোত্তর কার্যকলাপের বিবরণী, আর কিছু অদ্ভুত ম্যাজিক ফর্মুলা৷ ম্লান হাসলেন বাওভেল৷ অতি প্রাচীন জনজাতি-গুলির এই এক অদ্ভুত রহস্য — সমস্ত লেখার দ্বৈত অর্থ থাকবেই৷ পড়লে মনে হয়, এ সব অবিশ্বাস্য পৌরাণিক গল্প — অথচ তার মধ্যেই লুকানো থাকেকোনও গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা৷ দেওয়ালের একদম ওপর থেকেই হেয়রোগ্লিফিকস লিপির শুরু, ঘাড় তুলে পড়তে লাগলেন বাওভেল৷
“কি অপরূপ এ দৃশ্য...মাতা আইসিস (সাইরাস নক্ষত্র) বলে ওঠেন আমার পিতা মৃত রাজাকে... যিনি ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে ওপরে উঠে আসছেন... নক্ষত্র হয়ে স্থান করে নিতে চলেছেন নক্ষত্রমণ্ডলীতে...
হে ওসিরিস (ওরিয়ন বা কালপুরুষ)... আপনি আকাশেই মিলিত হলেন আমার মাতার সাথে — আর জন্ম হল আমার .... আমি আপনার পুত্র..আপনার রক্ষাকর্তা...
হে ওসিরিস ও আইসিস...আমি আপনাদেরই যোগ্য পুত্র...এক ‘প্রভাতী তারা’...আমি আপনাদের আদেশ পালন করে নেমে আসব দুয়াত (স্বর্গ, যেখানে পিতার অবস্থান) থেকে রুস্তাও-তে (পবিত্র মিশর)...
আর আমার আগমনের সাথেই শুরু হবে এক নতুন যুগের....ঠিক যেভাবে আমি একসময় পবিত্র ‘প্রথম যুগ’-এর সৃষ্টি করেছিলাম..... হে পরম পিতা ওসিরিস...”
মিশরীয় ফারাওদের এই পুনর্জন্মতত্ত্ব বাওভেল আগেই জানতেন৷ কিন্তু এই “প্রভাতী তারা”টি কি? আগে কোথাও তো এর উল্লেখ চোখে পড়েনি৷ সেই সময় কি শুক্র গ্রহ এই ওরিয়নের কাছাকাছি ছিল? নাহ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ দেরি না করে দ্রুত দেওয়াল লিপির ছবি তুলতে শুরু করলেন বাওভেল৷
সাকারার কাজ শেষ করেই গিজার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন বাওভেল৷ গিজা অনেকটা মালভূমির মত — উঁচু এবং সমতল৷ প্রথমের সবচেয়ে বড় পিরামিডটি স্নেফেরু পুত্র খুফুর৷ এর পরেরটা আকৃতিতে একটু ছোট, খুফুর যোগ্য পুত্র খাফরার৷ আজ ট্যুরিস্ট বেশ কম, একটি ছোট দল দূরে ঘোরাঘুরি করছে৷ তাদের উচ্চস্বরে কথোপকথন ভালোই শোনা যাচ্ছে৷ বিরক্ত হলেন বাওভেল, এ পরিবেশের সঙ্গে এসব একেবারেই বেমানান৷ নজর ঘোরাতেই ইসমাইলকে দেখতে পেলেন৷ গিজার প্রধান রক্ষী, তবে অর্থের বিনিময়ে পারলে গোটা পিরামিডটাই বেচে দেন আরকি৷ এখানে একটু বখশিশ দিলে সব কিছুরই অনুমতি পাওয়া যায় — দারিদ্রের চাপে সততা কোথায় যেন হারিয়ে যায়৷
ইসমাইলকে নিয়ে মাপজোকের কাজ শুরু করে দিলেন বাওভেল৷ মিশরীয়দের জ্যামিতিক জ্ঞান অবাক করে দেওয়ার মত — প্রতিটি পিরামিডের চারটি বাহু একেবারে নিখুঁতভাবে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিক নির্দেশ করছে৷ খুফুর পিরামিডটি থেকে কোনাকুনি সরলরেখা বরাবর এগোলেই বোঝা গেল সেটি খাফরার পিরামিডটি যুক্ত করছে না৷ খাফরার পিরামিডটি সামান্য পূর্বদিকে অবস্থিত৷ কিন্তু নেমেকুরার পিরামিডটি অনেকটাই পূর্বদিকে সরে গেছে৷ খাতায় সব মাপজোক লিখে নিলেন বাওভেল৷ ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন — মাটিতেই বসে পড়লেন একসময়৷ নীলনদের দিক থেকে সন্ধের মিষ্টি হাওয়া বইতে শুরু করেছে৷ আপনা থেকেই যেন চোখ বুজে এলো৷
ঘুম ভাঙলো একদল শেয়ালের চিৎকারে৷ ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে চোখ রাখলেন বাওভেল, রাত সাড়ে দশটা৷ এদিকে দূষণ বেশ কম — নক্ষত্রখচিত আকাশ ঝলমল করছে৷ হ্যাঁ, ঐতো কালপুরুষ৷ তার কোমর-বন্ধনী রচনা করেছে তিন উজ্জ্বল নক্ষত্র৷বেল্টের দিকে তাকতেই যেন মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল তাঁর৷ আরে! এ যেন সাক্ষাৎ গিজার তিনটি পিরামিড৷ আকৃতি ও কোনাকুনি অবস্থানে কোনও তফাৎ নেই৷ তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন বাওভেল, পাগলের মত চিৎকার করে নাচতে শুরু করে দিলেন৷ তবে কি, আকাশের ওরিয়ন বেল্টটি পৃথিবীতে স্থাপন করে কোনও বার্তা দিতে চেয়েছিল সে যুগের মিশরীয়রা? কোথায় পাবেন সে উত্তর তিনি? নাঃ, এডওয়ার্ডকে এখন আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না৷ সমস্ত তথ্য তাঁকে যত শীঘ্র সম্ভব পাঠিয়ে দিতে হবে৷ তারপর বরং সাক্ষাতেই সব কথা হবে৷
রাতে হোটেলের বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিল না বাওভেলের৷ নেমেকুরা একটি অত ছোট পিরামিড বানাতে কেন রাজি হলেন, তা এখন পরিষ্কার৷ তাঁর যে আর কোনও উপায় ছিল না৷ কিন্তু এ কার প্ল্যান? কি ছিল তাঁর উদ্দেশ্য?
।। ৫ ।।
স্নেফেরু যখন হেলিওপোলিস-এ পৌঁছলেন, তখন সময়টা খুব ভোর না বলে শেষ রাত বলাই বোধহয় উপযুক্ত৷ ঠিক এভাবে আগে কোনও দিন তিনি আসেননি৷ হেলিওপোলিস এক প্রাচীন মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, অনেক পণ্ডিত মানুষের বাস এখানে৷ তাঁরা শুধু পুরোহিতই নন — একাধারে চিকিৎসক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও স্থাপত্যবিদ৷ কত যুগ ধরে তাঁরা গবেষণা করে আসছেন, আর তা গোপনে লিপিবদ্ধ করে রাখছেন নানা পুঁথিতে৷ শুধু এখানকার পুরোহিতদেরই অধিকার আছে সে সব অমূল্য পুঁথি পড়ার৷ এ-সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার রক্ষা করার দায়িত্বও শুধু তাঁদেরই৷ প্রধান পুরোহিত ইমহোতেপ-এর অসাধারণ জ্ঞানের পরিচয় আগে বহুবার পেয়েছেন স্নেফেরু৷
ফারাওকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন ইমহোতেপ, সাদর আমন্ত্রণ জানান তাঁকে —
“হে ঈশ্বর, হেলিওপোলিস-এ আপনাকে স্বাগত৷ প্রভাত আসন্ন, তাই আমাদের সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না৷ আমার অনুরোধ আপনি এটির মধ্য দিয়ে একবার সাহুর (কালপুরুষ) কোমর-বন্ধনীর প্রথম নক্ষত্রটির দিকে দেখুন৷”
সরু এবং লম্বা কাঠের জিনিষটার দিকে একবার তাকালেন স্নেফেরু — অনেকটা বাঁশির মত দেখতে৷ একচোখ বন্ধ করে ইমহোতেপের কথামত দুয়াতের দিকে চোখ রাখলেন ফারাও, যেখানে রয়েছেন তাঁর স্বর্গীয় পিতা৷ বেশ খানিকক্ষণ ধরে সাহুর কোমর বন্ধনী নিরীক্ষণ করলেন —
“একটি ছোট আলোক বিন্দুও রয়েছে সেখানে৷ আপনি কি কাল সন্ধ্যায় এটির কথাই বলছিলেন?” চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করেন স্নেফেরু৷
“হে সর্বশক্তিমান, আপনার অনুমান নির্ভুল৷ এটিই সেই মহাজাগতিক বস্তু যা প্রতি সহস্র বৎসর পর ঠিক ঐ স্থানেই উদিত হয়, একদম প্রভাতের শুরুতে৷ কিন্তু প্রতিবারই আরও উজ্জ্বল হয়ে — কারণ এগিয়ে আসে আমাদের দিকে, শত শত যোজন৷ এটি এভাবেই দেখা যাবে প্রায় দশ বৎসর, আর তারপর হারিয়ে যাবে তার নিজের কক্ষপথে৷ হে ফারাও, আকৃতিতে এটি বিশাল৷ আমাদের গণনা মতে, এই উজ্জ্বল গ্রহাণুটি আর মাত্র পাঁচবার দেখা যাবে৷ আর পঞ্চমবারই...হবে...তার... অন্তিম...আগমন৷”
ইমহোতেপ খানিক থেমে থেমে বললেন এই ভয়ঙ্কর শেষ বাক্যটি৷
আস্তে কিন্তু দৃঢ়ভাবে জানতে চান স্নেফেরু —
“আবারও জানতে চাইছি, হে জ্ঞানী ইমহোতেপ, আপনি নিশ্চিত যে এই বিশাল বস্তুটি ঠিক পাঁচ সহস্র বৎসর পরে আঘাত হানবে এই পবিত্র মিশরের বুকে? ধ্বংস হয়ে যাবে সমস্ত কিছু? কোনও ভুল হয়নি আপনাদের?”
নীচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন ইমহোতেপ৷ তারপর ফারাওকে তাঁর সাথে আসতে ইঙ্গিত করলেন —
“এটি নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন, হে সর্বেশ্বর?”
এতো পবিত্র বেন-বেন৷ অবাক হলেন স্নেফেরু৷
সামনেই দাঁড়ানো কালো বিশাল বস্তুটি — যা মিশর-বাসী পুজো করে আসছে আজ বহুদিন৷ কারণ, তারা বিশ্বাস করে এটি স্বর্গের থেকে এসেছে — কারও স্পর্শ তাকে অপবিত্র করে নি৷ কিন্তু হঠাৎ বেন-বেনের কথা কেন তুলছেন ইমহোতেপ?
“এই সেই আগুনে ফিনিক্স পাখি, যা আমার আপনার জন্মের বহু আগে পৃথিবীতে উড়ে আসে৷ এটি আসলে এক বিশাল মহাজাগতিক বস্তু, যার মূল উপাদান হল বেজা (লোহা)৷ আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এ কৃষ্ণ ধাতু মানুষের অত্যন্ত কাজের৷”
এই আসলে সেই আগুনে পাখি? বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে স্নেফেরু৷
উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকেন ইমহোতেপ —
“ভেবে দেখুন ওসিরিস পুত্র, এই বেন-বেন যখন ‘প্রথম যুগ’-এ আমাদের পবিত্র রুস্তাও-তে নেমে এসেছিলো, চতুর্দিক কেঁপে উঠেছিলো তার গর্জনে৷ ধোঁয়ার আচ্ছাদনে ঢেকে গিয়েছিল এ দেশ — স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দাউদাউ করে জ্বলছিল তার অসীম তেজে৷ আর এই গ্রহাণু তার লক্ষ লক্ষ গুণ বড়৷ এর আঘাত মানবজাতির পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব৷”
“হে পরম শক্তিমান রা (সূর্য), তুমি পথ দেখাও আমাদের৷” কাতর কণ্ঠে বলে ওঠেন স্নেফেরু৷ পূর্বে ধীর গতিতে উদিত হচ্ছেন সূর্যদেব৷ তাঁর নরম কমলা আলোয় স্নেফেরুর চোখের জল যেন রক্ত হয়ে ঝরতে লাগল৷
“ভেঙে পড়লে চলবে না, হে মিশর অধিপতি৷” গমগম করে ওঠে ইমহোতেপের গলা —
“এ ধ্বংসের বার্তা জানাতে হবে ভবিষ্যতের প্রজন্মকে৷ বলতে হবে সাবধান, মৃত্যু আসন্ন৷ হ্যাঁ ফারাও, আমরা তাদের সাবধান করে দিয়ে যাব — যাতে তারা বাঁচার পথ খুঁজে নিতে পারে৷”
চোখ তোলেন অসহায় স্নেফেরু —
“কিন্তু কিভাবে? আজ থেকে পাঁচ সহস্র বৎসর পরে যে মহাজাগতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে তা কিভাবে আমরা পৃথিবীবাসীকে জানাব? কিভাবে?”
।। ৬ ।।
১৯৯০ এর জানুয়ারি — বেশ ঠান্ডা পড়েছে ইংল্যান্ডে৷ ডক্টর ও’ব্রায়েন কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজখানা উল্টে-পাল্টে দেখছিলেন৷ অক্সফোর্ডে এক কনফারেন্সে তাঁর যোগ দিতে আসা৷ আজই ভাবছিলেন ফিরে যাবেন, কিন্তু এডওয়ার্ডের বিশেষ অনুরোধে ওনার বাড়িতে এসে উঠতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন৷ মুশকিল হল, প্রয়োজনটা এডওয়ার্ড পরিষ্কার করে কিছুতেই বলছেন না৷ হঠাৎ তাঁর গলা পেলেন ও’ব্রায়েন৷
“অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী৷ পরিচয় করিয়ে দিই, এই ছেলেটি হলো বাওভেল– পিরামিড নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা করছে৷ আর বাওভেল, ইনি হলেন ডক্টর জন ও’ব্রায়েন, প্রোফেসর অফ অ্যাস্ট্রোনমি, ইউনিভার্সিটি অফ সিডনী৷”
প্রাথমিক আলাপচারিতার পর আসল কথায় এলেন বাওভেল —
“ডক্টর জন, আমি কিছুদিন আগেই মিশর থেকে ফিরেছি৷ যদিও এবার আমার উদ্দেশ্য ছিল উনাসের পিরামিড-লিপি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা, কিন্তু গিজার পিরামিডের এক অদ্ভুত জ্যামিতিক বিচ্যুতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ যদি দক্ষিণপশ্চিম দিক বরাবর একটি লাইন টেনে গিজার পিরামিড তিনটি কোনাকুনি যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়, তবে দেখা যাবে তারা এক লাইনে অবস্থান করছে না৷ মাঝের খাফরার পিরামিডটি সামান্য পূর্বে এবং শেষের নেমেকুরারটি অনেকখানি পূর্বে সরে এসেছে৷”
একটু দম নিয়ে নেন বাওভেল —
“আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, হয়ত মাপজোকের ভুলে বা অন্য কোনও অজানা কারণে এই ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু যখন আমরা দেখি, গিজার প্রতিটি পিরামিড জ্যামিতিক ভাবে শুধু নিখুঁতই নয়, অত্যন্ত যত্নসহকারে বানানো — তখন এসব যুক্তি ধোপে টেকে না৷ এর একটাই মানে হয় — এই পুরো ব্যাপারটা সম্পূর্ণ প্ল্যান করেই করা হয়েছে৷ কিন্তু কি সেই মাস্টার প্ল্যান?
কিছুটা কাকতালীয় ভাবে, সে রাতে আমি খুফুর পিরামিডের কাছেই ঘুমিয়ে পড়ি৷ আসলে সারাদিনের জার্নির একটা ধকল তো ছিলই৷ হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই চোখ পড়ে আকাশের কালপুরুষের কোমর-বন্ধনীর দিকে৷ অবিশ্বাস্য মনে হলেও, গিজার পিরামিড তিনটি যেন ধরিত্রীতে নক্ষত্র তিনটির সাক্ষাৎ প্রতিবিম্ব৷ শুধু অবস্থানগতই নয়, আকৃতিগত ভাবেও তারা ভীষণভাবে এক৷ কিন্তু আমাদের তা প্রমাণ করতে হবে, নাহলে কেউই এসব মানবে না৷ এডওয়ার্ডই তখন আপনার সাহায্য নেবার কথা বলেন — কারণ আমাদের নিখুঁত ভাবে আকাশের তারাদের অবস্থানের সঙ্গে পিরামিডের অবস্থান মিলিয়ে দেখতে হবে৷ আপনার মত কোন জ্যোতির্বিজ্ঞানীই পারেন এ ধাঁধার সমাধান করতে৷”
“খুব ইন্টারেস্টিং৷” এতক্ষণে যেন কথা বলার সুযোগ পেলেন ডক্টর জন৷
“ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তবে তো দারুণ ব্যাপার৷ কিন্তু অঙ্কটা একটু জটিল৷ দিগন্তের সঙ্গে যে কৌণিক অবস্থানে আজ এই নক্ষত্রদের দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার বছর আগে তা একেবারেই অন্য ছিল৷ বা এককথায়, পিরামিড যুগে রাতের আকাশ এরকম দেখতে ছিলো না৷ আমাদের মাথায় রাখতে হবে এক জটিল হিসেব — প্রেসিশন৷”
‘প্রেসিশন?’ প্রায় একসাথেই বলে উঠলেন এডওয়ার্ড ও বাওভেল৷
“হুঁ, সহজভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছি৷” বলে খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে পড়লেন জন— “আমরা সবাই জানি পৃথিবী আসলে একটু হেলে আছে, ঠিকভাবে বলতে গেলে পৃথিবীর অ্যাক্সিস ভার্টিকালি ২৩.৫ ডিগ্রী হেলে আছে৷ এবার এই অ্যাক্সিসটি উত্তরে ও দক্ষিণে খানিকটা বাড়িয়ে দাও৷ তারপর দুহাতে দুইপ্রান্ত ধরো, একইসঙ্গে ওপরেরটিকে ঠেলো পেছনে ও নীচেরটিকে সামনে টানো৷ মনে রাখতে হবে ঐ ২৩.৫ ডিগ্রীর কোন পরিবর্তন যেন না হয়৷ এইভাবে ওপরে ও নীচে দুটি বৃত্তের সৃষ্টি হবে — এবং পৃথিবীর অ্যাক্সিস প্রায় ২৬০০০ বছরে একবার বৃত্তটি সম্পূর্ণ করে৷ এর ফলে আকাশের নক্ষত্রগুলিকেও দিগন্তের একই কৌণিক অবস্থানে সবসময় দেখা যায় না৷”
“আপনি কি বলতে চান, আজ আমরা কোনও নক্ষত্রকে সন্ধেবেলা আকাশের যে কোণে উদিত হতে দেখি, ঠিক ২৬০০০ বছর পর আবার তাই দেখতে পাব?” বোঝার চেষ্টা করেন বাওভেল৷ “একদম তাই৷” খুশি হন জন —
“শুধু তাই না — একটি নক্ষত্রের কৌণিক অবস্থান যদি আজ সবচেয়ে কম হয়, ধরো ১০ ডিগ্রী, তাহলে প্রায় ১৩০০০ বছর পর তা আকাশে সর্বোচ্চ কোণে উদিত হবে, ধরো ৪০ ডিগ্রী৷ আবার ১৩০০০ বছর ধরে তা নামতে নামতে ১০ ডিগ্রী হবে৷ এভাবেই আকাশে নক্ষত্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়ে চলে — ২৬০০০ বছর ধরে৷”
“এখনও পর্যন্ত যা ধারণা, ফারাও খুফু ২৩০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দেরও আগে মিশরের অধিপতি ছিলেন৷ কিন্তু সেই সময়ের নক্ষত্রের অবস্থান জানা কি সম্ভব?” চিন্তিত দেখায় এডওয়ার্ডকে৷
“সমাধানের উপায় আছে৷” ডক্টর জন বলতে থাকেন—
“খাতায় কলমে এ অঙ্ক কষা খুব মুশকিল৷ তবে স্কাইগ্লোব সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমরা যে কোনও সময়ের রাতের আকাশ দেখতে পারি৷”
স্কাইগ্লোবে ২৩০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে নক্ষত্রের অবস্থান দেখা শুরু হল৷ কিন্তু ২৬০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত পিছিয়েও কালপুরুষের কোমর-বন্ধনীর সঙ্গে গিজার পিরামিডের অবস্থান মিলল না৷ হাল না ছেড়ে আরও পিছিয়ে যেতে লাগলেন ডক্টর জন৷ ১০৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ৷ অবিশ্বাস্য! মনে হল পৃথিবীতে যেন কালপুরুষের কোমর-বন্ধনীর একটি প্রতিবিম্বের সৃষ্টি হয়েছে! শুধু তাই নয় — আকাশগঙ্গার সঙ্গে কালপুরুষের কোমরের তিনটি তারার আপেক্ষিক অবস্থান যেন হুবহু মিলে যাচ্ছে নীল নদের সঙ্গে গিজার তিন পিরামিডের৷ সাইরাস নক্ষত্র তখন দিগন্তের সবচেয়ে কাছে৷
“এতো অবিশ্বাস্য! তাহলে গিজার পিরামিড কি ১০৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নির্মিত?” বিহ্বল হয়ে পড়েন বাওভেল৷
।। ৭ ।।
খানিকক্ষণ যেন সবাই এক ঘোরের মধ্যে ছিল, বিশেষ কথাবার্তা বলার মত অবস্থা কারও প্রায় ছিল না৷ দুপুরে খাওয়ার টেবিলে প্রথম মুখ খুললেন এডওয়ার্ড —
“আমার মনে হয়, প্রাচীন মিশরীয়রা একটি বিশেষ সময়কে ধরে রাখতে চেয়েছিল, এবং অবশ্যই কোনও বিশেষ কারণে৷ কেন জানিনা, মনের মধ্যে একটা জিনিস খচখচ করছে — এই ‘প্রভাতী তারা’র সঙ্গে কি এর কোনও সম্পর্ক আছে? আচ্ছা ডক্টর জন, কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলীতে এমন কোনও তারা কি আদৌ ছিল? আজ নাহলেও, বহু হাজার বছর আগে?”
জন কিছু মনে করার চেষ্টা করেন —
“আপনি নিশ্চই ডোগনদের কথা জানেন৷ এরাও অতি প্রাচীন জাতি, এবং মিশরীয়দের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত৷ এদের পুরোহিতরা নানা প্রাচীন তথ্য আজও গোপনে সংরক্ষণ করে চলেছেন৷ ডোগনদের নানা পুঁথিপত্র নিয়ে গবেষণা করছিলেন লেয়ার্ড বলে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক৷ তিনিও আমার কাছে এই ‘প্রভাতী তারা’র কথা জানতে চান — যা নাকি এই কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলীতে দেখা যেত বহু পূর্বে৷ এক ডোগন পুরোহিত তাঁকে এই তথ্য দিয়েছিলেন৷
অতি সম্প্রতি জানা গেছে, কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলীর সাইরাস নক্ষত্রটির একটি জোড়া আছে — এর নাম সাইরাস-বি৷ এটি একটি বামন নক্ষত্র৷ আজ কেন, খালি চোখে সাইরাস-বি দেখতে পাওয়া দশ হাজার বছর আগেও ছিল অসম্ভব৷ এছাড়া তো আর কোনও....”
“তাহলে কি ধূমকেতু?” জনকে শেষ না করতে দিয়ে বলে ওঠেন বাওভেল৷
“নাহ, এক ধূমকেতুর জন্য ফারাওরা এত অর্থব্যয় করে গিজার পিরামিড বানাবেন বলে তো মনে হয়না৷ কিন্তু, ডোগনরাও যখন এর উল্লেখ করেছে তখন গুরুত্ব দিতেই হবে৷” চোখ বুজে ভাবতে ভাবতে বললেন এডওয়ার্ড৷
রাত্রে জন থেকে গেলেন সেদিন৷ নিচের ঘরে শুয়েছিলেন বাওভেল, কিছুতেই যেন ঘুম আসছিল না৷ একটা ধাঁধা এবং কিছু সূত্র — কিন্তু সূত্রগুলো জোড়া যাচ্ছে না৷ কখন চোখ লেগে এসেছিল কে জানে, হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করলেন৷ চোখ খুলেই দেখেন এডওয়ার্ড পাগলের মত তাঁকে জাগানোর চেষ্টা করছেন৷ বিড়বিড় করে মাথা নেড়ে শুধু বলছেন — আন-লাকি থার্টিন....আন-লাকি থার্টিন৷ জনও দৌড়ে এসেছেন ততক্ষণে — এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলেন এডওয়ার্ডের দিকে৷ জলটা খেয়ে একটু ধাতস্থ হলেন এডওয়ার্ড —
“আমি বুঝতে পেরেছি....হ্যাঁ...হ্যাঁ...আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি৷ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা ‘সাবাকা লিপি’র কথা তোমায় এখন বলি বাওভেল, যা এক অতি প্রাচীন পুঁথির নকল৷ সেখানে লেখা আছে —”
“হে মাতা আইসিস (সাইরাস নক্ষত্র)...আমি ‘প্রভাতী তারা’....আপনার সন্তান... আমি বারংবার ফিরে আসব....আপনার পথ অনুসরণ করব...আর অপেক্ষা করব আপনার অন্তিম আদেশের...আপনার চলার পথ যখন শেষ হবে....আপনি আদেশ করবেন...আমি পাখি হয়ে নেমে আসব এই রুস্তাও-এ....আমার আগমনেই সৃষ্টি হবে এক নতুন যুগের...হে প্রিয় মাতা...ঠিক যেমন আমি এসেছিলুম ‘প্রথম যুগ’-এ....যখন এই রুস্তাও সৃষ্টি করেছিলেন তোমার প্রিয় স্বামী রাজা ওসিরিস...”
“কিছু বুঝতে পারলে বাওভেল?” যেন ফিসফিস করে ওঠেন এডওয়ার্ড —
“মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, তাদের সভ্যতা বহু প্রাচীন — এবং তখন ছিল মানুষরূপী দেবতাদের রাজত্ব৷ সেই হল প্রথম যুগ, যখন আগুনে ফিনিক্স পাখি নেমে এসেছিল পৃথিবীতে — ১০৪৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে৷ সেই প্রথম যুগকে তারা ধরে রেখেছে এই পিরামিডের মাধ্যমে — মহাকাশের কালপুরুষকে রচনা করা হয়েছে এই মর্ত্যে৷ কেন? কারণ তবেই তো বোঝানো সম্ভব আবার সে ফিনিক্স আসবে কবে!”
“কিন্তু ফিনিক্স তো গল্পকথা!” ডক্টর জন বলে ওঠেন৷
“এটাই তো সমস্যা জন, সেযুগের সমস্ত ঘটনারই দুটো করে অর্থ থাকত৷ আমি নিশ্চিত, এই ফিনিক্স পাখি হল একটি উল্কা৷ ফিনিক্স মা পাখি মরে গিয়ে ডিমের সৃষ্টি হয়, আর তা থেকেই মুহূর্তের মধ্যে জন্ম নেয় সন্তান — আরেক আগুন পাখি৷ এই উল্কাটি আসলে কোনও ধাতু দিয়ে গঠিত৷ যখন সেটি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে, ঝাঁটার মত আগুনের হল্কায় তাকে দেখতে লাগছে এক আগুনে পাখির মত৷ এবার ধাতু গলতে শুরু করে৷ ফলে আস্তে আস্তে সেটি একটি গোলাকার বলের আকার ধারণ করে — ফিনিক্স পাখি ডিমে পরিণত হয়৷ আরও যখন নীচে নেমে আসে, বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষণে তা অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে গলে ঝরতে থাকে৷ আবার আগুনের ঝাঁটার সৃষ্টি হয় — জন্ম নেয় নতুন ফিনিক্স৷”
“কিন্তু আবার সে আসবে কবে? প্রাচীন মিশরীয়দের প্রেসিশন-এর ধারণা ছিলো — তাঁরা ব্যাপারটা ভালই জানতেন৷ ভালো করে ভেবে দেখ — ‘প্রভাতী তারা’ সাইরাসের সঙ্গে চলেছে, যখন সে নক্ষত্র তার যাত্রা শেষ করবে তখনই ফিনিক্স নীচে নামবে৷ সাইরাস সবচেয়ে নীচে ছিল ১০৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, তার চলার শুরু৷ আর থামবে যখন সে সবচেয়ে উঁচুতে থাকবে — মানে প্রায় ১৩০০০ বছর পর৷”
“তার মানে তো ২৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ, কিন্তু নির্ভুল প্রমাণ চাই৷” এবার বলে উঠলেন জন৷
“রাইট মাই ফ্রেন্ড৷ আর সেই প্রমাণ আছে বাওভেলের কাছে৷” এডওয়ার্ডের কথায় অবাক হয়ে যান বাওভেল৷
“উনাসের পিরামিড-লিপির ছবি তুলে এনেছিলে তুমি — সেখানেও এই এক কথার উল্লেখ আছে৷ সন্ধেবেলা আমি ঐ অদ্ভুত ফর্মুলাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলুম৷ বেশিরভাগই অবশ্য বুঝতে পারিনি, কিন্তু একটা ছবি পরিষ্কার এখন আমার কাছে৷ ভেবে দেখো একদম শেষের ফর্মুলাটি — কালপুরুষের কোমর-বন্ধনী ও নিচে একটি পাখি৷ এরকম ছবি আছে তেরো বার৷ প্রতিবার পাখিটি আকৃতিতে বড় হচ্ছে আর একদম শেষেরটিতে আছে পাখিটির সাথে একটি ডিম৷”
“আহ, ফিনিক্স অপেক্ষা করছে ১৩০০০ বছর ধরে — প্রতিটি ছবি হাজার বছর৷” বলেই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন বাওভেল৷
এডওয়ার্ড বলে চলেন —
“শুধু তাই নয়, ‘প্রভাতী তারা’ প্রতি হাজার বছর পর উদয় হয় ঠিক কালপুরুষের কোমরের বেল্টের নীচে৷ প্রতিবারই তা এগিয়ে আসে পৃথিবীর দিকে, আর তাই ফিনিক্সও বড় হয়ে চলে৷ হিসেব মত তাহলে এটিকে শেষ দেখা গেছে প্রায় ১৫০০ - ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ৷ আর তারপর সে আসবে আবার ২৫০০ - ২৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ৷ এবং সেই শেষ..”
ঘরে যেন পিন পড়লেও শোনা যাবে এমনই নিস্তব্ধতা৷
“মনে হচ্ছে ‘প্রভাতী তারা’র কক্ষপথ হেলিকাল — খুঁজে পাওয়া দুষ্কর৷ তবে আমি ফিরে গিয়েই একাজে লাগব৷”
ডক্টর জনের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এডওয়ার্ড—
“‘সাবাকা লিপি’ পড়ে আমি এরকম কিছুরই আশঙ্কা করেছিলুম৷ তাই বাওভেলকে পাঠিয়েছিলুম ‘পিরামিড-লিপি’র খোঁজে৷ কিন্তু আমি জানিনা, এরপর ঠিক কি করণীয় আমাদের৷”
।। ৮ ।।
কাত হয়ে শুয়েছিলেন স্নেফেরু — চোখ বন্ধ, তবে বোঝা যায় এক গভীর চিন্তায় মগ্ন৷ শরীরটাও কয়েকদিন ধরে যেন ভাল যাচ্ছে না৷ চোখ তুলে আকাশের দিকে একবার তাকান মিশর অধিপতি৷ সাদা তুলোর মত এক টুকরো মেঘ যেন কোথাও থেকে খবর পেয়ে হাজির হয়েছে — স্তব্ধ হয়ে দেখছে তাঁদের এই অবিস্মরণীয় কীর্তি৷ গর্ব অনুভব করেন ফারাও৷ হয়তো এবার সে উড়ে যাবে সুদূর পশ্চিমের দেশে, গল্প করে শোনাবে তার এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা৷
সেদিনের কথা মনে পড়ে স্নেফেরুর৷ মহাজ্ঞানী ইমহোতেপের অনুরোধ ছিল, সাহুর দেহের প্রতিটি নক্ষত্র যেন রচিত হয় এ ধরিত্রীতে — সৃষ্টি করা হয় যেন তার এক নিখুঁত প্রতিবিম্ব৷ এই পার্থিব নক্ষত্রগুলি ঘোষণা করবে না কোনও ফারাও-এর গুণগান, তারা আসলে এক গোপন সংকেত৷ নীল নদকে আকাশগঙ্গা রূপে কল্পনা করে তাঁরা এ পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি করতে চলেছেন সেই "প্রথম যুগ"-এর পবিত্র দুয়াত৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বুঝতে পারে — বিপদ আসবে কোথা থেকে এবং কবে! কিন্তু যদি দেরি হয়ে যায়? যদি তারা আদৌ না বুঝতে পারে এ ভয়ঙ্করের সংকেত? নাঃ, আর ভাবতে পারছেন না স্নেফেরু৷
— হে পিতা, আপনি একটু বিশ্রাম নিতে পারতেন৷ আপনার শরীর ভালো নেই৷
— জানি পুত্র৷ কিন্তু পরে যদি আর সময় না পাই — আমার যে কিছু বলার আছে তোমায়!
— আদেশ করুন পিতা৷
— পুত্র, হেলিওপোলিস-এর পণ্ডিতগণ জানিয়েছেন — আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পরে ঘটতে চলেছে এক মহাজাগতিক ঘটনা৷ তাঁরা গণনা করে দেখেছেন, এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আছড়ে পড়বে এই পবিত্র ভূমিতে৷ আর তার ফল হবে ভয়াবহ৷ আশঙ্কা, এই সমগ্র অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে!
— এতো মর্মান্তিক ঘটনা পিতা! তাহলে উপায়?
— আমাদের কর্তব্য ভবিষ্যতের মিশরবাসীকে সাবধান করে যাওয়া৷ এই বিপদের কথা তাদের জানিয়ে যেতে হবে৷
— মার্জনা করবেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না৷
— হে প্রিয় পুত্র, বিপদ আসবে সাহুর দেশ থেকে – সাহুর কোমর-বন্ধনীর কাছেই বর্তমানে অবস্থান করছে সেই মহাজাগতিক বস্তুটি৷ পরম জ্ঞানী ইমহোতেপ ঠিক করেছেন, আমরা “প্রথম যুগ”-এর দুয়াত রচনা করব এই পৃথিবীর বুকে — আর জানিয়ে যাব ভবিষ্যতের পৃথিবীবাসীকে, কবে সে আঘাত আসতে চলেছে৷ হে পুত্র, গিজা মালভূমিতে সাহুর কোমর-বন্ধনীর নক্ষত্র তিনটির প্রতিবিম্ব গড়ে তুলতে হবে আমাদের — আমি সে দায়িত্ব তোমায় দিতে চাই৷
—আপনি যা আদেশ করবেন পিতা৷
— তবে শোন মন দিয়ে৷ সে পিরামিডের গর্ভে সৃষ্টি করা হবে এক গোপন কক্ষ, যেখানে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রাখা হবে ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী৷ হেলিওপোলিস-এ রাখা আছে প্রবাদপ্রতিম থতের সমাধির গোপন কক্ষের নকশা৷ কিন্তু ভবিষ্যতদ্রষ্টা জেফাস জানিয়েছেন, সে গোপন নকশা পাওয়ার অধিকার রয়েছে একমাত্র তোমার পৌত্রের৷ তাই ভবিষ্যতে সেই নির্মাণ করবে গোপন কক্ষটি৷
— আপনি নিশ্চিন্ত হন পিতা৷ আমরা একাজ সম্পন্ন করবই!
— আহ, শান্তি পেলাম পুত্র৷ আমি তোমার ওপর ভরসা করতে পারি৷
খুফু বিদায় নিলে ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লেন স্নেফেরু৷ তাঁর প্রিয় পুত্রের হাতে সবচেয়ে বড় কাজ সঁপে দিয়ে তিনি আজ বড় নিশ্চিন্ত৷ হায় রে ভবিষ্যতের পৃথিবী! সেকি মনে রাখবে তাঁদের কথা? তাঁদের এই আশ্চর্য সৃষ্টি কি বিস্ময়ের উদ্রেক করবে তার মনে? কোনও দিন সেকি প্রশ্ন করবে, কেন তাঁরা সৃষ্টি করলেন এই অপরূপ মানমন্দির? দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন স্নেফেরু৷ দিন গোনা শুরু হয়ে গেছে, সমগ্র সৃষ্টি তার অন্তিম দিনের প্রতীক্ষা করছে৷ হাওয়া কি ভারি হয়ে আসছে — তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন? চোখ বুজে আসছে৷ আর চোখ খোলার প্রয়োজন মনে করলেন না ফারাও স্নেফেরু৷
।। ৯ ।।
১৯শে অক্টোবর, ২০০২রুডল্ফের আগ্রহ রোবটিক্স নিয়ে, অনেকদিন ধরেই একটি ক্যামেরা লাগানো রোবটের মাধ্যমে গিজার পিরামিডের ভেতরে অনুসন্ধান করার ইচ্ছে ছিল তাঁর৷ মিউনিখে রুডল্ফের উপায়ুত-২ রোবটের কথা জানতে পেরেছিলেন বাওভেল৷ তখনই তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন এই অভিযানের ফলাফল জানাতে৷ নাহ, রুডল্ফ কথা রেখেছেন৷প্রিয় বাওভেল,
আশা করি আপনার শরীর ও স্বাস্থ্য ভালোই আছে৷ সময়াভাবে চিঠি লেখা আর হয়ে ওঠে নি, আমি ক্ষমাপ্রার্থী৷ গত সপ্তাহেই আমি কায়রো থেকে ফিরেছি৷আপনি জানেন যে গিজার পিরামিডের রহস্যভেদ করার জন্য আমরা এবার উপায়ুত-২ রোবটটি ব্যবহার করেছিলাম৷ রোবটটির তোলা ভিডিও ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবির সিডি পাঠালাম৷ আপনার কথাই সত্যি — খুফুর পিরামিডের রাজার কক্ষের ‘হাওয়া নল’-টি আসলে একটি প্রাচীন আকাশ পর্যবেক্ষণ যন্ত্র৷ এটি ভূমির সাথে ঠিক ৪৫ ডিগ্রী কোণে অবস্থান করছে এবং কালপুরুষের দিকে তাক করা আছে৷
আপনি যদি এবার রাণীর কক্ষের ওপরে দক্ষিণ দিকের নলটি দেখেন, প্রায় ৬৫ মিটার ওপরে এটি বন্ধ হয়ে গেছে৷ সামনেই দেখতে পাবেন এক পাথরের দেওয়াল, যার গায়ে দুটি তামার (সম্ভবতঃ) পাত লাগানো আছে৷ এই পাথরের দেওয়ালটি মাটির থেকে প্রায় দুই ইঞ্চি ওপরে ঝুলছে — আসলে এটি একটি স্লাইডিং ডোর৷ এর পেছনের অন্ধকার থেকে এক গোপন কক্ষের অস্তিত্ব বোঝা যায়৷
উপায়ুত-২ তার সূক্ষ্ম ক্যামেরায় তুলে এনেছে সেই গোপন কক্ষের ছবি৷ একটি বিশাল পাথর দেখা যাচ্ছে, অনেকটা শিষ-ওলা পেন্সিলের মত৷ আর দেওয়ালে আছে কিছু অদ্ভুত ফর্মুলা ও পাখির ছবি৷ এসবই আপনাকে আমি পাঠালাম৷
ভালো থাকবেন৷ কোন অসুবিধা হলে অবশ্যই ফোন করবেন — আমি আপাততঃ মিউনিখেই আছি৷
রুডল্ফ গ্যানটেনব্রিঙ্ক
মিউনিখ
চিঠিটা পড়ে আর দেরি করলেন না বাওভেল, ফোন করে সোজা চলে এলেন এডওয়ার্ডের অফিসে৷ সেখান থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় যোগাযোগ করা হল ডক্টর জনের সাথে৷ জন স্কাইগ্লোব দেখে জানিয়ে দিলেন, রাজার কক্ষের পর্যবেক্ষণ নলটি নিখুঁত ভাবে আল-নিটক এর দিকে তাক করেছিল ২৪৫০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে৷ আল-নিটক হল কালপুরুষের কোমর বন্ধনীর সবচেয়ে প্রথম তারাটি — এটি ভূমির সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রী কোণেই তখন অবস্থান করছিল৷
“তাহলে এটা বোঝা গেল, খুফুর পিরামিড মোটামুটি ২৪৫০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে বানানো হয়৷ ইতিহাসও সেরকমই বলে৷” বাওভেলের দিকে তাকিয়ে বললেন এডওয়ার্ড৷
“হুঁ, এ ব্যাপারটা প্রায় মিলেই যাচ্ছে৷ কিন্তু উপায়ুত-২ যে গোপন কক্ষের ছবি তুলেছে, তার কোনও ব্যাখ্যা আছে?” সিডিটি বার করে এডওয়ার্ডের হাতে দিলেন বাওভেল৷
কম্পিউটারে সিডিটি ঢুকিয়ে দেখতে শুরু করলেন দুজনে৷ গোপন কক্ষের কাছে রোবটটি আসতেই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে দেওয়ালের হেয়রোগ্লিফিকস লিপি পড়তে শুরু করলেন এডওয়ার্ড —
“হে মাতা আইসিস (সাইরাস নক্ষত্র)….আমি আপনার পথের শেষে অপেক্ষা করছি…আমি ‘প্রভাতী তারা’...বহু পথ অতিক্রম করে এসেছি...আকাশ পথে (আপনার) চলা শেষ হলেই আমার শেষ যাত্রার শুরু...পাখি হয়ে (আমি) নেমে আসব রুস্তাও-এ.....আমার স্পর্শে পুরনো সব ধুয়ে মুছে যাবে...এক নতুন যুগের হবে সৃষ্টি...আমি রচনা করব আবার সেই ‘প্রথম যুগ’...”
হায়, ধ্বংসের ভবিষ্যত-বাণী বড়ই স্পষ্ট করে লিখে গেছেন তাঁরা৷ হঠাৎ বিশাল লম্বা এবং কালো এক ভারী বস্তু নজরে এলো, ঠিক যেন শীষ-ওলা একটি পেন্সিল৷ ওজন কম করেও ৫০০ কিলো তো হবেই৷
“আহ, বেন-বেন৷ কতদিন ধরে আমরা খুঁজে চলেছি৷” বিস্মিত গলায় বলে চলেন এডওয়ার্ড —
“এই সেই ফিনিক্স পাখি বাওভেল, আমি নিশ্চিত এই মহাজাগতিক বস্তুটি লোহার৷ এটিই আগুনে পাখি হয়ে নেমে এসেছিল মিশরের বুকে, মাঝ আকাশে গলে গিয়ে গোলাকার আকৃতি ধারণ করে৷ মানে, ফিনিক্স পাখি ডিমে পরিণত হয়৷ কিন্তু আরও নীচে প্রচণ্ড গতি ও মধ্যাকর্ষণের কারণে সেই গলন্ত ধাতু লম্বাকৃতি হয়৷ বা বলতে পারো নতুন ফিনিক্সের জন্ম হয়৷ যখন মাটিতে আছড়ে পড়ে তখন বস্তুটির মুখ ধাক্কায় এরকম পিরামিডের আকৃতি পায়৷ এবার পরিষ্কার, মিশরীয়দের এই পিরামিডের আইডিয়াটা এলো কোথা থেকে!”
“আর এই ছবিগুলোর মানে আমরা এতদিনে জেনে গেছি, নয় কি?” আঙুল দিয়ে গোপন কক্ষের দেওয়ালে আঁকা ১৩টি পাখির ছবি দেখান এডওয়ার্ড৷
দুজনেই কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে এলেন৷ দুচোখ ভরে দেখতে থাকলেন রাতের আকাশ৷ হ্যাঁ, ঐ তো কালপুরুষ৷ তাঁরা ভাগ্যবান, জানা নেই সেদিন কেউ থাকবে কিনা এ পৃথিবীতে — যারা আকাশের এই অপরূপ শোভা উপভোগ করতে পারবে৷
[২০১০ সালে ডক্টর এডওয়ার্ড, বাওভেল ও ডক্টর জনের গবেষণার ফল প্রকাশ করে দ্য আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার ইন ইজিপ্ট (ARCE) —দ্য মর্নিং স্টার, ইয়েস দ্য এন্ড ইজ নিয়ার৷ আর্টিকেলটি তখন বিদেশে ঝড় তোলে, এবং অনেকেই সন্দেহ করেন এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে৷ তবে গোপন খবরে প্রকাশ, নাসা এই তথ্য সুপার কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে মহাজাগতিক বস্তুটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে৷ কক্ষপথ অনুযায়ী এটি ২৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর মিশরে আঘাত করতে পারে, সম্ভাবনা শতকরা ৯৯.৯৯৪৭৩২ শতাংশ৷ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে নাসা একটি ৪ সদস্যের বিশেষ দল গঠন করেছে, যেটি ২ বছর ধরে গ্রহাণুটিকে পর্যবেক্ষণ করবে৷ বিশদ জানতে আমাদের হয়ত আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে৷]