• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • তৃতীয় পক্ষ : সাগরিকা দাস


    নেক দ্বিধা অতিক্রম করে কলিং বেলের সুইচটায় যখন হাত ছোঁয়াল দিব্য, ওর আঙুলগুলো তখন তিরতির করে কাঁপতে শুরু করেছে। এভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া সম্পূর্ণ অচেনা কোনো মানুষের সাথে দেখা করতে আসা ওর জীবনে এই প্রথম। কেমন মানুষ এই সেঁজুতি রায় কে জানে! ও নিজেই বা কি বলবে, যদি জিজ্ঞেস করে কি প্রয়োজন? ভাবতে ভাবতেই সামনের দরজাটায় খুট করে শব্দ হলো। সামান্য একটু ফাঁক দিয়ে একটা চোখ সমেত মুখের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে মেয়েটার।

    —কাকে চাই?

    —মিস…না মানে মিসেস সেঁজুতি রায় …

    —কে আপনি? কোথা থেকে আসছেন?

    কথা না বলে দিব্য নিজের কার্ডটা বের করে মেয়েটার হাতে এগিয়ে দিল।

    —এক মিনিট …দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। হয়তো কাউকে ডাকতে গেল। দিব্য একবার ভাবলো ফিরে যাবে। কিন্তু এতোগুলো বছরের জমে থাকা রাগ-অভিমান, অনেকগুলো প্রশ্ন ওকে আজ এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।

    সবকিছুর সমাধান রয়েছে ঐ একটামাত্র দরজার ওপারে। এই ঠিকানাটা জোগাড় করতে এমনিতেই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ওকে। এসব মনে পড়তেই ও এই মুহূর্তে স্হির করল, সত্যিটা না জেনে এখান থেকে একপাও নড়বে না ও। প্রতিটা মুহূর্ত দীর্ঘতর মনে হচ্ছে। হাতের তালু ঘামছে ওর।

    আবার খুট করে শব্দ হলো দরজায়। এবার পুরো দরজাটা খুলে ওকে ভেতরে ডাকলো মেয়েটা। ছিমছাম সাজানো ড্রয়িং রুম, দেওয়াল জোড়া ফ্লোরাল ওয়াল আর্ট। মাঝে গোটাকতক পেন্টিং, ঘরের একপাশে নরম গদিআঁটা সোফাসেট, সেন্টার টেবিলে ক্রিস্টালের চেসবোর্ড, সারা ঘর জুড়ে জুঁই ফুলের গন্ধ… ঘরটায় চোখ বোলাতে বোলাতে নিজেদের বাড়ির ভেতরের এলোমেলো ছবিটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওদের বাড়িতে ঢুকলে যে-কেউ টের পাবে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্পষ্ট প্রাচুর্যের ছাপ। কিন্তু সবকিছুই কেমন অগোছালো, দায়সারা ভাবে পড়ে আছে।

    আর হবে নাই বা কেন? জ্ঞান হওয়া ইস্তক দিব্য দেখে আসছে ওর বাবা-মায়ের মধ্যে একটা চাপা অশান্তির আগুন জ্বলছে। এমনিতে চিৎকার-চেঁচামেচি যে খুব একটা হতো তা নয় বরং প্রয়োজন ছাড়া দুজনের মধ্যে কথাবার্তাই বিশেষ হতো না কখনো। কেমন একটা শীতল চাদরে মোড়া ছিল ওদের সম্পর্কটা। শুধু গভীর রাতে কোনো কোনো দিন ওর ঘুম ভেঙ্গে যেত মায়ের গলায় হিসহিসে আওয়াজে। খুব চাপা স্বরে মা তখন বাবার প্রতি রাশি রাশি ঘৃণা উগরে দিত। বাবা কখনো সখনো নিজের সপক্ষে কিছু বলার চেষ্টা করত। কোনো কোনো সময় চুপ করে শুনত শুধু। মায়ের গলাটাও কিছুক্ষণ পরে কান্নায় জড়িয়ে আসত। ওদের সমস্যাটা যে কী তা ঐ আধা ঘুমন্ত, পাঁচ-ছ বছরের একটা বাচ্চা ছেলের বোধের অতীত ছিল।

    দিব্যর বাবা-মা দুজনেই ভারতীয় রেলওয়েজের কর্মী ছিল। যদিও ব্রাঞ্চ আর ডিপার্টমেন্ট আলাদা। দিনের যেটুকু সময় বাবা-মায়ের সাথে ওর দেখা হত দুজনেই হাসিমুখে ওর সমস্ত খবরাখবর নিত। রাতে ফেরার সময় মাঝে-মাঝেই এটা সেটা নিয়েও আসত ওর জন্য। মালতী মাসী সারাদিন ওর সবদিক খেয়াল রাখত। তবুও কোথায় যেন একটা বড়সড় গোলমাল ও অনুভব করত। ওর স্কুলের বন্ধুদের বাবা-মায়েদের কয়েকজনকে দেখেছে দিব্য। ওরা কত হাসিখুশি থাকে সবসময়। দিব্যর বাবা-মাও কেন যে অমন হাসিখুশি থাকেনা! একটু আধটু মজা হয় শুধু যখন কোন জায়গায় ঘুরতে যায় ওরা। তিনজনে তখন আনন্দ করে একসাথে। কিন্তু সেও তো বছরে এক-দুবার কয়েকদিনের জন্য। বছরের বাকি সময়টা সেই একঘেয়ে জীবন। ওদের বাড়িতে সবকিছুই যেন নিয়মে বাঁধা, বড্ড যান্ত্রিক। জন্মাবধি দেখে আসা ঐ নিষ্প্রাণ পরিবেশের বাড়িটার সাথে দিব্যও একসময় নিজের মতো করে মানিয়ে নিয়েছিল। প্রত্যেকবছর গরমের ছুটিতে দিব্য মালদায় দিদার বাড়িতে গিয়ে থাকত। গাছভর্তি আম, লিচু, পুকুরের মাছ, মামাতো ভাই-বোনদের সাথে হাসি-মজায় কখন যে ছুটিটা ফুরিয়ে যেত! কলকাতায় ফেরার সময় ওর ভীষণ কান্না পেত। কখনো বাবা, কখনো বা মা একাই যেত ওকে আনতে।

    বিষয়টা দিব্যর কাছে পরিষ্কার হয়েছিল আরো কয়েকবছর পরে। দিব্যর তখন ক্লাস টেন। দাদুর চোখ অপারেশনের জন্য বাবা দাদু-ঠাকুমাকে দিনকয়েক ওদের বাড়িতে এনে রেখেছিল। দিব্য শুনেছিল বাবার আসল বাড়ি মুর্শিদাবাদের গদাইপুর নামের একটা গ্রামে। ওখানে নাকি তিনশ বছরের পুরনো একটা দুর্গাপুজো হয়। ঠাকুরের একটা নামও আছে--পেটকাটি। কি অদ্ভুত নাম! তবে স্হানীয় লোকজন পেটকাটিকে খুব জাগ্রত বলে মানে। পুজোর কদিন নাকি সেখানে বেশ ভিড় হয়, মেলা বসে। খুব ছোটবেলায় একবার ওরা নাকি সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব কথা ওর আর বিশেষ মনে নেই। এখন দাদু-ঠাকুমা বা কাকা-কাকিমারা কখনো সখনো কলকাতায় ওদের বাড়িতে এলে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। বাবা অবশ্য মাঝে মাঝে সেখানে যায়, ওদের খোঁজখবর নিয়ে আসে। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে দাদু-ঠাকুমাও এখানে বেশিদিন থাকতে পারেনা। শহরের হাওয়ায় ওদের দমবন্ধ হয়ে আসে।

    দাদুর চোখ অপারেশনের পরদিন সকালে বাবা অফিস চলে গেল। মা অবশ্য বাড়িতেই ছিল। ওদের আসার উপলক্ষ্যে মা এ-কদিন ছুটি নিয়েছিল। সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। দিব্যরও তাই স্কুল যাওয়া নেই। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে দিব্য নিজের ঘরে বসে অঙ্ক করছিল। হঠাৎই পাশের ঘর থেকে চাপা গলায় কান্নার আওয়াজ ওর কানে এল। কৌতূহল চাপতে না পেরে দুটো ঘরের মাঝের দেওয়াল লাগোয়া জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল দিব্য। জানালাটার ওপাশে ঝোপঝাড়ে ভর্তি একফালি খোলা জায়গা। ফলে পাশের ঘরে কেউ কথা বললে এখান থেকে বেশ স্পষ্ট শোনা যায়। দিব্য শুনতে পেল কান্না ভেজা গলায় ওর মা কল্যাণী কথা বলছে।

    —আপনারা তো বলেই খালাস মা… মানিয়ে নাও… মানিয়ে নাও… কি পরিমাণ মানসিক কষ্ট আমাকে সহ্য করতে হয় সেটা বুঝতে পারেন?

    —বুঝি বৌমা, বুঝি। কিন্তু কি করবা বলো দিনি? মা হইয়ে আমার মাথা নীচু হইয়ে যায় ওর কীর্তিতে। তোমাগো বিয়ার দুই বৎসর পর প্রত্থম যখন ঘটনাটা শুনছিলাম বিশ্বাস যায় নাই। আমাগো ছাওয়াল এতো বড় বিশ্বাসঘাতক হইব! তোমার দেওরগুলানরে তো দ্যাখছ এতোদিন ধইরা। গেরামের কোন মেয়ে-বৌয়ের দিকে চোখ তুইল্যা তাকায় না পর্যন্ত। লজ্জার মাথা খেইয়ে সোজাসুজি অরে তো জিগাইছিলামও। অর তো সেই এককথা--আমি কুন অন্যায় কাজ করি নাই মা। এরপরে তো আর একখান কথাও মুখ থেইক্যা বাইর হইল না। তুমি তো সবই জানো। লায়েক ছাওয়াল, বিয়ে-থা করসে, অরে তো আর চড়-চাপাটি দেওঅন যায় না।

    দিব্য বুঝতে পারল এটা ঠাম্মার গলা। মানুষটা সেই কোন ছেলেবেলায় পূর্ব বাংলা ছেড়ে এদেশে চলে এসেছিল, ভাষাটা আজও ছাড়তে পারেনি। কিন্তু ওদের কথাগুলোর তো মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ও আরো একটু সরে এলো জানলার দিকে।

    — কিন্তু আমি কি দোষ করেছিলাম বলুন তো মা? নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম। বাপের বাড়িতে গিয়েও এসব কথা বলতে আমার রুচিতে বাধে। আর আপনার ছেলে সেই সুযোগটাকেই দিনের পর দিন কাজে লাগিয়েছে। ...মাঝে মাঝে মনে হয় যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই… নিতান্ত বাবুনটার কথা ভেবে…

    দিব্যর মনে হলো মায়ের গলায় কান্নার রেশটা এখন আর নেই। বরং কিছুটা বিরক্তি আর হতাশা মিশে আছে সেখানে।

    —ওসব উল্টাপাল্টা কথা একদম ভাববা না বৌমা। তুমি তো আমাগো মতো পরজীবী নও। নিজের ট্যাকার জোরে বাঁচবা। দাদুভাইরে মানুষ করবা।

    কথাগুলো বলার সময় ঠাম্মার গলায় অদ্ভুত একটা জোর এসে গেছিল। তারপরই একটু নীচু স্বরে আবার বলল--এহনো যে অগো যোগাযোগ আছে তুমি ঠিক জানো?

    —জানব না কেন? অস্বীকার তো কোনদিন করে নি। ...আচ্ছা মা, একটা সত্যি কথা বলবেন? আপনারা কি আগে থেকে সত্যিই কিছু জানতেন না?

    —এ তুমি কেমন কথা কইলে মা? দাদুভাই হওনের আগে তুমি কিছু টের পাইছিলে? চাকরি পাওনের পর থিক্কাই তো বড় খোকা কলকাতায় থাকে। আমাগো সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ তো অই অবরে-সবরে।

    —বাবুন হওয়ার আগে ওদের যোগাযোগটা মনে হয় হয়নি।

    —তাইলে?

    —আমাকে তো বলেছিল মালদা থেকে ফেরার পথে একদিন বাসে দেখা হয়েছিল, ওরা একই গ্রামে থাকতো নাকি। সত্যি মিথ্যে তো জানিনা তাই আপনাকে…

    —একই গেরাম নয়। তবে সাকিন যা কইসিল আমাগো গেরাম থিকা খুব একটা দূরও নয়। তোমার সাথে একবার নাকি তার আলাপ কইরে দেছিল?

    — হুম... বাবুন তখন বছর দুই-আড়াই হবে। এক রবিবার সন্ধেবেলা আমরা বেরিয়েছিলাম কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা করতে। গড়িয়াহাট মোড়ে হঠাৎই সেদিন দেখা হয়ে গেছিল। সত্যি বলতে কি তার আগে ঐ মহিলা সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহও তৈরি হয়নি। আপনার ছেলে আমাকে বলেছিল একা মানুষ, কলকাতায় চাকরি করতে এসে অসুবিধেয় পড়েছে তাই পূর্ব-পরিচিত হিসেবে ও একটু-আধটু সাহায্য করে। কিন্তু মহিলাকে দেখার পর অন্য রকমই মনে হয়েছিল। যথেষ্ট শক্ত ধরনের মহিলা এবং সবচেয়ে বড় কথা--মহিলা একাও ছিল না।

    —হ শুনসি সেকথা। পরে কইসে। কিন্তু দু-এক কথার পরেই তো মুখে কুলুপ আঁটে। পষ্ট কইরা কিসুই তো কয় না।

    —আমাকে ওর সম্বন্ধে যা যা বলেছে সেগুলো পাগলেও বিশ্বাস করবে না মা।

    —কি কইসে?

    এই সময় হঠাৎ দাদুর গলা পেয়ে দুজনেই চুপ করে গেল।

    কথাগুলো শুনে দিব্যর মনের ভেতর কালবৈশাখী বয়ে যাচ্ছিল। মা আর ঠাম্মা এসব কি বলছিল! ওর বাবার অন্য মহিলার সঙ্গে… আর ভাবতে পারছিল না ও। দুহাতে মুখ ঢেকে পড়ার টেবিলে বসে পড়ল দিব্য।

    অন্য কেউ হলে এতো তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিতে পারত কিনা সন্দেহ আছে। পরীক্ষার খাতাতেও হয়ত তার ছাপ পড়ত। কিন্তু দিব্যর ক্ষেত্রে উল্টোটাই হলো। ঘটনাটা শোনার পর থেকেই মায়ের জন্য ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। এতোদিন ধরে দেখে আসা মায়ের নির্লিপ্ত ব্যবহারেরও একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল ও। ওর মনে পড়ল মা ঠাম্মাকে বলছিল মায়ের অন্য কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে শুধু ওর জন্য পারেনা। তার মানে মা ওকে খুব ভালবাসে। কিন্তু সেটা সহজ ভাবে প্রকাশ করতে পারে না। এটা মনে হতেই দিব্যর মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। আচ্ছা, মা তো চাকরি করে। এতোদিন ওকে নিয়ে আলাদা তো থাকতে পারতো। তাহলে? মা বলছিল নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। তাহলে কি বাবাকে এখনো মা ভালোবাসে? কিন্তু বাবা তো অন্য কাউকে… বাবাকে এখন খুব খারাপ মানুষ বলে মনে হচ্ছে দিব্যর। শুধুমাত্র বাবার জন্যই ওর মা অন্য বন্ধুদের মায়েদের মতো সবসময় হাসিখুশি থাকতে পারে না। ওদের পরিবারটায় কোন আনন্দ নেই। ও মনে মনে স্হির করল বড় হয়ে চাকরি পেলেই ও মাকে নিয়ে এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এমন একটা সহজ সমাধানের পথ পেয়ে ওর বেশ ভালো লাগলো। সেই সময়ের পর থেকেই কখন যেন ওর আর ওর বাবার মাঝে লক্ষ যোজনের একটা মানসিক দুরত্ব দিব্য তৈরি করে ফেলেছিল।

    পুরনো কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে এই মুহূর্তে দিব্যর নিজেরই খুব অদ্ভুত লাগল। আসলে ওরা তিনজন প্রাণী ওবাড়িতে এতোদিনে বোধহয় পরস্পরের কাছে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আর সেই অভ্যাসেই ধাক্কাটা লেগেছিল গত পরশু। দিব্যর সেদিন ছিল অফ ডে। বিকেলের পরে বেরিয়েছিল ওর বান্ধবী সুদেষ্ণার সঙ্গে। সুদেষ্ণা একটা কলেজে পড়ায়। একটা মুভি দেখে ডিনার সেরে ও যখন বাড়ি ফিরল তখন প্রায় রাত এগারোটা বাজে। গেটের চাবি খুলে ভেতরে ঢুকতেই ও চমকে গিয়েছিল। ডাইনিং স্পেসে কল্যাণী জেগে বসে। চোখমুখে টেনশনের ছাপ স্পষ্ট। এমনিতে ওদের তিনজনের কাছেই বাড়ির চাবির একটা করে সেট থাকে। অন্যদিন দিব্যর ফিরতে দেরি হলে ও একাই খাবার নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ে। দিব্য নিজেই এই ব্যবস্থাটা চালু করেছে। কল্যাণীকে সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয় তাই রাতে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না। সেদিন ঐ ভাবে মাকে বসে থাকতে দেখে দিব্যও খুব ঘাবড়ে গেছিল। কি হয়েছে? জিজ্ঞাসা করতে ফ্যাকাশে মুখে কোনোমতে কল্যাণী যা বলল তার সারসংক্ষেপ করে দিব্য বুঝল ওর মা সেদিন বাড়ি ফিরেছে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। বাবা তখন বাড়িতে ছিল না। গত দুমাস হলো বাবা রিটায়ার করেছে। তারপর থেকে সকাল-বিকেল হাঁটতে যাওয়া আর বাজার-দোকান ছাড়া বাড়ির বাইরে বিশেষ বেরোয় না। আজও মা প্রথমে সেরকমই কিছু ভেবেছিল। কিন্তু সাড়ে নটাও বেজে গেছে দেখে বাবার মোবাইলে কল করেছিল। আউট অফ রিচ। তারপর থেকে বহুবার চেষ্টা করেছে মা। প্রত্যেক বার একই কথা শুনতে হয়েছে।

    সেই মুহূর্তে মাকে দেখে দিব্যর খুব অবাক লাগছিল। যে মানুষটার বিরুদ্ধে একদিন ঠাম্মার কাছে একরাশ রাগ আর অভিযোগ ব্যক্ত করেছিল মা, আজ সেই মানুষটার জন্যই কি সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা করছে। ও ঠান্ডা মাথায় কিছুক্ষণ ভেবে দেখল। কলকাতার আশেপাশে ওদের কোন আত্মীয় স্বজন থাকে না। এতো রাতে বাবা নিশ্চয়ই পরিচিত কোন বন্ধু বা কলিগের বাড়ি যাবে না। আত্মীয়দের কারো বাড়িতে গেলেও এতক্ষণে পৌঁছেছে কি? হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে ও জিজ্ঞাসা করল--মালতী মাসী আজ রাতের রান্না করে গেছে? মালতী মাসী এখন আর সারাদিন থাকে না। দুবেলা এসে রান্নার কাজটুকু করে দিয়ে যায়। তবে বছরে দু-একদিন শরীর খারাপ ছাড়া কামাই করে না কোনোদিন।

    কল্যাণী অবাক চোখে ছেলের দিকে চেয়ে বলল--এই সময় তোর খাবার কথা মনে হচ্ছে বাবুন? দিব্যর কিঞ্চিৎ বিরক্ত লাগে। যত বয়স বাড়ছে ওর মার বোধবুদ্ধি যেন ততই কমে যাচ্ছে। ও তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল—যা জিজ্ঞাসা করছি বলো, বাবা কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সেটা জানা দরকার।

    কল্যাণীর কাছে এবার বোধহয় ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। ও তড়বড় করে বলে উঠলো--হ্যাঁ রে বাবুন, এটা ঠিক বলেছিস। মালতী তো আজ বিকেলের রান্না করেনি দেখলাম। তার মানে তোর বাবা সাতটার আগেই বেরিয়েছে। মালতী নিশ্চয়ই এসে ফিরে গেছে।

    দিব্য নিজে বেরিয়েছিল পাঁচটা নাগাদ। ও হিসেব করে দেখল এই সময়ের মধ্যে গদাইপুর বা মালদার বাড়িতে বাবার পক্ষে পৌঁছোনো সম্ভব নয়। তাছাড়া এতো রাতে গ্রামের ভেতর কোনো গাড়িও যাবে না। অর্থাৎ সকালের আগে কোথাও খবর নেওয়ার সুযোগ নেই। সমস্যাটা কল্যাণীকে বুঝিয়ে বলতে কল্যাণীও মাথা নেড়ে সায় দিল।

    পরদিন সকালে আত্মীয় স্বজন, চেনা পরিচিত সকলের কাছে খবর নিয়েও যখন কোন খোঁজ পাওয়া গেল না দিব্য তখন থানায় খবর দেওয়াটাই মনস্হ করল। ওর বাবার ফোন তখনও আউট অফ রিচ শোনাচ্ছে। কল্যাণীকে সেকথা বলতে সে কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ারে বসে রইলো, দৃষ্টি মাটির দিকে। তারপর খুব নীচু স্বরে বলল--থানা-পুলিশ করার আগে একবার সেখানে খবর নে না বাবুন। যদি সেখানেই গিয়ে থাকে তাহলে পুলিশ, বাইরের লোক…

    --সেখানে মানে? …বলেই দিব্যর খেয়াল হলো মা ঠিক কোন জায়গার কথা বলছে। এতক্ষণ দিব্য সহজ ভাবে কথা বলছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সমস্ত জগতের লজ্জা যেন ওকে ঘিরে ধরলো। এতোদিন বিষয়টা ওরা সবাই হয়তো জানতো তবু কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম পর্দার আড়াল ছিল। আজ এই মুহূর্ত থেকে সেই আড়ালটাও ঘুচে গেল। এখন ওর আর কল্যাণীর মাঝখানে এক নগ্ন সত্য তার প্রকটতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও কোনোরকমে জিজ্ঞাসা করল--তুমি জানো ঠিকানাটা? মেঝের উপর দৃষ্টি রেখেই নিঃশব্দে দুদিকে মাথা নাড়ল কল্যাণী।

    শুধুমাত্র নামটুকু সম্বল করে কলকাতা শহরে একটা মানুষের ঠিকানা খুঁজতে চাওয়া চূড়ান্ত বোকামি। নিরুপায় হয়ে দিব্য আবার কল্যাণীকেই জিজ্ঞাসা করল--ওদিককার কোন ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে?

    —সেসব তো তোর বাবার মোবাইলে…

    —বাবার কোন ফোন বুক বা ডায়রি-টায়রি কিছু...

    কল্যাণী আবার দুদিকে মাথা নাড়ল। হতাশ চোখে দিব্য বলল--তাহলে থানায় যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি মা?

    —শুনেছিলাম বাগবাজারের দিকে একটা স্কুলে সে পড়াত। খুব ক্ষীণ শোনাল কল্যাণীর গলাটা।

    —কোন স্কুল?

    —কিন্তু সে তো অনেকদিন আগে। এখন আর কি…

    —আঃ মা! স্কুলের নামটা জানলে বলো। এখনো পড়ায় কি পড়ায় না সেসব পরে দেখছি।

    এতক্ষণ যা হয়নি এই ছোট্ট ধমকটুকুর পরে সেটাই হলো। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কল্যাণী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে দিব্যর খারাপ লাগছিল। ও উঠে গিয়ে মায়ের পাশে বসে পিঠে হাত রাখল। ওর স্পর্শ পেয়ে কান্না জড়ানো গলায় কল্যাণী বলল--আমার মাথা কাজ করছে না বাবুন। এই বয়সে এসে শেষে…আমি লোকের কাছে মুখ দেখাব কি করে বলতো!

    —তুমি যেটা ধারণা করেছ সেটাই যে হয়েছে তা ভাবছ কেন? বাবা তো ওখানে নাও যেতে পারে।

    —তাহলে ও কোথায় গেল?... এবার কল্যাণীর গলাটা ভীষণ ভয়ার্ত শোনাল। দিব্য বুঝল মাকে শান্ত করতে গিয়ে ও আরো বড় গোলমাল করে ফেলছে। ও তাড়াতাড়ি দুহাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। সেই ছোটবেলার পরে শেষ কবে যে মায়ের এতো কাছে ও এসেছে মনে পড়ে না। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে ওর মনে হল গত কয়েক ঘন্টায় মা বড্ড একা হয়ে পড়েছে। সেই শক্ত আবরণটা কখন যে খসে পড়েছে! এখন মা ওর ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে। দিব্য নরম স্বরে বলল--প্লিজ মা, এখনই অতো চিন্তা কোরো না। আগে আমরা খোঁজ তো শুরু করি। দেখবে বাবা হয়তো কাছেপিঠেই কোথাও গেছে। কাল-পরশুর মধ্যেই হয়ত ফিরে আসবে।

    —সে তুই যেখানে খুশি খোঁজ কর বাবুন। কিন্তু সবচেয়ে আগে সেখানে খোঁজ নে। একটু চেষ্টা করে দেখ না যদি স্কুল থেকে ঠিকানাটা দেয়। এবার মায়ের গলায় আকুতির সুর ফুটে উঠেছে। দিব্যর মনে হল ওর মার সত্যিই এখন মাথার ঠিক নেই। একটু আগেই যাকে প্রতিপক্ষ ভাবছিল এখন তার কাছে বাবা নেই ভেবে আরো অস্হির হয়ে পড়ছে। মুখে বলল--তুমি একটু চুপ করে এখানে বসো। আমি একটা ফোন করে নিই। ভেবোনা... সব ঠিক হয়ে যাবে।

    মাকে সান্ত্বনা দিতে কথাগুলো বলল ঠিকই কিন্তু দিব্য নিজেই কি আর নিশ্চিন্ত হতে পারছে! দিব্যর মনে পড়ল, ডাক্তারি পড়ার সময় ওদের সাথে দু-তিনজন পড়তো যারা উত্তর কলকাতার দিকে থাকত। ওদের মধ্যে পার্থ বসু নামে একটা ছেলে ছিল। ওর ছোটবোনের স্কুল ছিল বাগবাজারের দিকে। পার্থর কাছেই শুনেছিল তখন। কল্যাণীর থেকে ঐ মহিলার নাম আর স্কুলের নামটা জেনে নিয়ে ও পার্থকেই ফোন করল। এই সাতসকালে দিব্য একজন বয়স্ক স্কুলটিচারের খোঁজ করছে শুনে স্বভাবতই পার্থ একটু অবাক হয়েছে। কিন্তু দিব্য যখন বলল “তোর সঙ্গে দেখা হলে সব বলব ভাই। এখন একটু তাড়া আছে।” তখন আর প্রশ্ন না করে ওর বোন রিয়াকে ডেকে সরাসরি কথা বলিয়ে দিয়েছিল। পার্থর বোন যদিও ঐ স্কুলের ছাত্রী ছিল না কিন্তু পাশাপাশি স্কুল হওয়ায় ভদ্রমহিলাকে চিনতো বলে জানাল। শিক্ষিকা হিসেবে ছাত্রীদের কাছে মহিলা নাকি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। স্কুলের কাছেই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সেই ঠিকানাটাও বলে দিল রিয়া। তবে এখনও উনি ঐ বাড়িতেই থাকেন কিনা সেটা রিয়া জানেনা।

    ফোনটা ছাড়ার পরেই কল্যাণী জানতে চাইল--ঠিকানাটা পেলি বাবুন?

    —হুম... একজনের কথা তো রিয়া বলল। কিন্তু ইনিই তিনি কিনা তা তো বুঝতে পারছি না।

    —ঐ স্কুলে পড়াতো তো?

    —হ্যাঁ তাই তো বলল। স্কুলের কাছেই বাড়িভাড়া নিয়ে একাই থাকতেন।

    —একা থাকে? কিন্তু ওর তো একটা ছেলে আছে।

    দিব্য মনে মনে এবার জোর একটা ধাক্কা খেল। এই ছেলের কথাটা তো ও জানতো না! তবে কি ছেলেটা ওর বাবারই? পরক্ষণেই নিজেকে নিজে ধিক্কার দিল ও। নিজের মনেই দুদিকে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো। নিজের বাবার সম্পর্কে এ কি সব আজেবাজে কথা ভাবছে ও!

    দিব্য আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। ওর এই বাড়িতে আসার পরে প্রায় পনের মিনিট কেটে গেছে। কাজের মেয়েটাও সেই যে গেছে তারপর থেকে আর পাত্তা নেই। বাড়ির লোকজন কেউ নেই নাকি? একটু জোরে কাউকে ডাকবে কিনা ও ভাবছিল সেই সময়ই একজন প্রৌঢ় মহিলা এঘরে এসে ঢুকলো। সাদা চুড়িদারের ওপরে পেস্তা-সবুজ রঙের পাঞ্জাবি গায়ে। লম্বাটে গড়নের মাঝারি চেহারা, কাঁচাপাকা চুলগুলো বয়েজকাট করা। গমরঙা মুখের চামড়ায় প্রসাধনের ছিটেফোঁটা নেই। কিন্তু সবমিলিয়ে ভদ্রমহিলা যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। একবার মুখের দিকে তাকালে চট করে চোখ ফেরানো মুশকিল। ঘরে ঢুকে দিব্যকে দেখেই মহিলা বললেন--একি! তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বোসো.. বোসো। লক্ষ্মীইইই….দাদাকে একগ্লাস জল দাও।

    দিব্য বুঝল, যে মেয়েটা ওকে দরজা খুলে দিয়েছিল সম্ভবত তার উদ্দেশ্যেই পরের কথাটা বলা। ও বলল--ঠিক আছে। ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।

    লক্ষ্মী নামের মেয়েটা তখনই একগ্লাস ঠান্ডা জল আর একটা প্লেটে কিছু মিষ্টি এনে সামনের টেবিলে রাখল।

    মহিলা এবার ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল--তারপর বলো।

    দিব্যর মনে পড়ল ভদ্রমহিলা ঘরে ঢোকার পর থেকেই ওর সঙ্গে পরিচিত মানুষের মতোই ব্যবহার করছেন। অথচ দিব্যকে ওঁর চেনার কথাই নয়। তার মানে ও সঠিক ঠিকানায় পৌঁছেছে। আর মহিলার ওকে চিনতে পারার পেছনে নিশ্চয়ই বাবার হাত আছে। এটা ভাবতেই ওর চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে উঠল। দিব্য গম্ভীর গলায় বলল--আপনি আমাকে চিনতে যখন পেরেছেন তখন বাকিটাও নিশ্চয়ই জানেন।

    --বাকিটা মানে? তুমি এখানে কেন এসেছ? সেটা না বললে কি করে জানবো! আর তোমাকে তো সেই ছোট্ট থেকে চিনি তার সঙ্গে আজকে তোমার এখানে আসার কি সম্পর্ক?

    --অর্থাৎ আপনি স্বীকার করছেন আপনার সঙ্গে আমার বাবার একটা সম্পর্ক আছে।

    --যাব্বাবা, অস্বীকার করব কেন? আর তুমি এতো রেগে রেগে কথা বলছ কেন? আমার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে এসেছ নাকি? মৃদু হাসি মহিলার ঠোঁটে।

    --লড়তে যেমন আসিনি তেমনি খোশগল্প করতেও আসিনি। বাবাকে একটু ডেকে দিন। আমার দুটো কথা বলার আছে। বলেই চলে যাব।

    --মানে? আমি সরিৎদাকে কি করে ডাকবো? বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টতই অবাক হয়েছেন মহিলা। দিব্য এবার একটু নড়েচড়ে বসল। ও এবার নীচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল--বাবা এখানে আসেনি?

    --কই না তো! এখানে আসবে বলেছিল তোমাকে?

    --না। আমাকে কিছু বলেনি। আসলে গতকাল সন্ধের দিকে বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। তারপর থেকে মোবাইল আউট অফ রিচ। এখনও…

    --সে কি! মহিলা প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি-টাড়ি কোথাও…

    --সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। কোথাও যায়নি। তাই ভাবলাম আপনার এখানে যদি…

    --আমার এখানে আসবে একথা তোমার মনে হল কেন? ও বুঝেছি। তোমার মা তোমাকে পাঠিয়েছে, না?

    দিব্য কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। শুনতে পেল মহিলা নিজের মনেই বিড়বিড় করছেন--চিরটাকাল একইরকম রয়ে গেল। তারপর একটু ইতস্তত জিজ্ঞাসা করলেন--ইয়ে, বাড়িতে কোন ঝগড়া-ঝামেলা কিছু?

    --না না।

    --দেখো বাবুন, আমার মনে হয় আমাদের একবার থানায় ইনফর্ম করা দরকার। ঈশ্বর না করুন যদি খারাপ কিছু…

    মহিলার মুখে বাবুন নামটা শুনে দিব্য একটু চমকে উঠল। পরিবারের বাইরের কেউ আজ পর্যন্ত ওকে ঐ নামে ডাকেনি। আরও একটা ব্যাপার দিব্য লক্ষ্য করল, উনি বললেন “আমাদের থানায় ইনফর্ম করা দরকার”। অর্থাৎ উনি নিজেকেও ওর সঙ্গে জড়িয়ে নিলেন। ওঁর এতোটা অন্তরঙ্গতা দিব্যর ভালো লাগছিল না। অথচ ও কিছুতেই মুখ ফুটে সেটা বলতেও পারছে না। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী।

    দিব্যকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার একটু নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন--তুমি কি এর মধ্যে থানায় ইনফর্ম করেছ?

    —না করিনি। তবে এবার মনে হচ্ছে সেটাই করতে হবে। ঠিক আছে, আমি এখন উঠি।

    —তুমি বরং দুমিনিট বসো। আমি তৈরি হয়ে নি।

    —না… মানে... আপনি আবার কষ্ট করে… দিব্য মহিলাকে এড়াতে চাইছিল।

    —তোমাদের লোকাল থানায় আমার চেনা-জানা একজন অফিসার আছেন। এই কবছর যে এই শহরে বাস করছি তার কিছু তো অ্যাডভান্টেজ আছে, কি বল! আর কষ্টের কথা যদি বল… সরিৎদা আমার জন্য যা করেছে এক জীবনে তার ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।

    এটুকু শুনেই দিব্য সরাসরি মহিলার মুখের দিকে তাকালো। ওর মধ্যে জমে থাকা কৌতূহল আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।

    দিব্যর অবাক হওয়াটা সেঁজুতিরও চোখে পড়ল। সেঁজুতি বলল--অবাক হচ্ছো?

    —না... মানে… এখন ঠিক কি বলা উচিত দিব্য ভেবে পাচ্ছিল না।

    —আমার তোমাকে কিছু কথা বলার আছে বাবুন। ইনফ্যাক্ট কথাগুলো তোমার মাকে বললে বেশি ভালো হত। কিন্তু সে উপায় যখন নেই তখন... দৃঢ় স্বরে কথাগুলো বলল সেঁজুতি।

    দিব্য এবারও চুপ করেই রইলো। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সেঁজুতি বলল--আমি বুঝতে পারি আমাকে নিয়ে তোমাদের ফ্যামিলিতে একটা সমস্যা আছে। যদিও সরিৎদা এ-নিয়ে আমাকে কিছু বলতে চায় না। আত্মসম্মানবোধটা প্রখর তো! তবুও মাঝে মাঝে অশান্তির আঁচটুকু আমি টের পেয়েছি। আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের জীবনে কোন সমস্যা হোক।

    —কিন্তু এই কথাগুলো এতোদিন পরে কেন বলছেন? আপনার যদি এটাই মনে হয় তাহলে তো…

    দিব্যর কথা শেষ হওয়ার আগেই সেঁজুতি বলে উঠলো--ঠিকই। অনেকদিন আগেই আমি তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করে কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরিৎদা সেটা চাননি। ওঁর মনে হয়েছিল তোমার মা ওঁর কথাতেই যখন বিশ্বাস করতে পারছেন না তখন আমার সঙ্গে দেখা হওয়াতেও বিশেষ লাভ হবে না। উল্টে আমাকে হয়তো অপমানিত হতে হবে। আর উনি সেটা চাননি। আর আমার কাছে তোমার বাবা নেক্সট টু গড, ওঁর কথা অমান্য করার সাধ্য আমার নেই। এতোবড় কথাটা কেন বললাম সেটা বুঝতে গেলে আমার জীবনের পুরনো কিছু কথা তোমাকে জানতে হবে। হয়তো তোমার শুনতে ভালো লাগবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো কথাগুলো তোমার জানাটা খুব দরকার।

    অনেকগুলো প্রশ্ন দিব্যর মনেও এতক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু মুখ ফুটে সেসব জিজ্ঞাসা করতে ওর ভদ্রতায় বাঁধছিল। এখন সেঁজুতি নিজেই কিছু বলতে চাইছে দেখে ও মনে মনে স্বস্তি পেল। মুখে বলল--বেশ তো বলুন। কিন্তু একটু সংক্ষেপে। বুঝতেই পারছেন বাবার খোঁজটা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কতটা চিন্তায় আছি।

    --জানি বাবুন। এই মুহূর্তে এসব কথা বলতে আমারও যে ইচ্ছে করছে তা নয়। কিন্তু আজ না বললে ভবিষ্যতে আর কোনোদিনই হয়ত বলার সুযোগ পাব না।

    এইসময় দিব্যর মাথার পেছনের জানলাটায় একটা ছায়া এসে পড়ল। ও পেছন ফিরে দেখল একটা ছেলে জানলাটায় মুখ চেপে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারাটা বেশ বড়োসড়ো, দেখে তো ত্রিশ-বত্রিশ বছরের বলে মনে হচ্ছে। তবে চোখ মুখ ঠিক স্বাভাবিক নয়। সেদিকে একঝলক তাকিয়ে সেঁজুতি ছেলেটাকে নরম গলায় বলল--টাবলু, ইনি তোমার একটা দাদা। আমি ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই তারপর তোমার কাছে আসছি। তুমি এখন ঘরে গিয়ে মাসীর কাছে খাবারটা খেয়ে নাও, কেমন! তারপর একটু জোরে ডাক দিল - বিনীতা… টাবলুকে ঘরে নিয়ে যাও।

    ডাক শুনে একজন মাঝবয়সী মহিলা এসে ছেলেটার হাত ধরে টানতে লাগলো। যদিও ঘরে যেতে ছেলেটার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আছে বলে মনে হচ্ছে না। জানলার দিক থেকে মুখ ফেরাতেই সেঁজুতি বলল--আমার ছেলে।

    —উনি কি …

    —হুম… অটিস্টিক।

    দিব্যর এবার একটু খারাপ লাগছিল মহিলার জন্য। ওঁর সহজভাবে বলা কথাটার মধ্যেও একটা গভীর দুঃখের ছায়া রয়েছে। আগের কথার রেশ টেনে সেঁজুতি নিজেই আবার বলতে শুরু করল-- তোমাদের দেশের বাড়িতে কখনো গেছ তুমি?

    —হুম, দু-চারবার গেছি। তবে অনেকদিন আগে।

    —তোমাদের দেশের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে আমাদের গ্রামটা ছিল। জায়গাটার নাম কানুপুর। আমরা ছিলাম চার ভাই আর দুই বোন। আমি ছিলাম সব্বার ছোট। বাবা বহরমপুর পোস্ট অফিসের কেরানি ছিলেন। সারা সপ্তাহ ওখানকার একটা মেসে থাকতেন। শনি-রবিবার করে বাড়ি ফিরতেন। গ্রামে আমাদের কিছু জমিজমাও ছিল। সবমিলিয়ে সংসারে অভাব না থাকলেও প্রাচুর্যও ছিল না। ফলতঃ দাদা-দিদিদের ছোট হয়ে যাওয়া জামা-কাপড়েই বেশিরভাগ সময় আমার প্রয়োজনটুকু মিটতো। আমার কিন্তু দিদির ফ্রকের থেকে দাদাদের শার্ট-প্যান্ট পরতে বেশি ভালো লাগত। বড্ড দুরন্ত আর ডানপিটে ছিলাম বলে গ্রামের সবাই ভালোও বাসত। ধমক-ধামকও মাঝে মাঝে কপালে জুটত তবে সেসব নেহাতই মামুলি। ছোট থেকেই পড়াশোনার উপর আমার ঝোঁক ছিল অন্য ভাইবোনদের থেকে বেশি। সেটা লক্ষ্য করেই বাবা আমাকে বহরমপুরের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন ক্লাস ফাইভে। তারপর থেকে আমিও বাবার সঙ্গে বহরমপুরেই থাকতে শুরু করলাম। মেস ছেড়ে একটা এককামরার ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন বাবা। বছরখানেকের মধ্যে স্কুলেও সবার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেল। কিন্তু কারো সাথেই বন্ধুত্ব হলো না। আসলে ওরা যে ধরনের মেয়েলি খেলায়, গল্পে মেতে থাকত আমি তার সঙ্গে কিছুতেই নিজেকে মেলাতে পারতাম না। স্কুল ছুটির পরে বারাক স্কোয়ারে গিয়ে ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখতাম। কিছুদিন পরে ওদেরই কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে গেল। তারপর থেকে স্কুল ছুটির পরে আমরা একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। কখনো বারাক স্কোয়ারে, কখনো লালদীঘিতে। ওদের সঙ্গে যখন আমি মিশতাম তখন খুব সাবলীলভাবে আড্ডা দিতাম। কিন্তু মেয়েদের মাঝখানে নিজেকে গুটিয়ে নিতাম।

    —আমি বোধহয় বুঝতে পারছি আপনার মানসিক গঠনটা। নারী শরীরের আড়ালে আপনার মনটা পুরুষের। আ কেস অব ট্রান্সজেন্ডার।

    —ঠিক তাই। তুমি আজকালকার ছেলে। তায় আবার ডাক্তার। তুমি তো বুঝবেই। কিন্তু আমার আশেপাশে যারা ছিল তখন, তারা কিন্তু কেউ বোঝেনি। এমনকি আমার নিজের মাও না। কলেজে পড়ার সময় আলাপ হল সুতপার সঙ্গে। আমাদের বাড়িওয়ালার ভাগ্নি। কাশিমবাজারে বাড়ি। মামাবাড়িতে থেকে কলেজে পড়তে এসেছে। ছিপছিপে চেহারা, দুধে আলতা গায়ের রং, অসামান্য সুন্দর মুখশ্রী। বিশেষত ওর চোখদুটো। ঝড় শুরু হল বুকের ভেতর। তার আগেও যে দু-একটা ক্রাশ যে ছিল না তা নয়। তবে সেসব ক্ষেত্রে কাউকেই আর সাহস করে বলে উঠতে পারিনি। এবার আর চেপে রাখতে পারলাম না। প্রথমদিকে তো সুতপা ভাবলো আমি ওর সঙ্গে ইয়ার্কি করছি। ও বেশ হেসে হেসে আমার সঙ্গে মজা করছিল। পরে যখন বুঝতে পারল সত্যিটা, তখন আমাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করল। পাগল-টাগল ভাবছিল হয়ত। আমি কিন্তু আশা ছাড়িনি। পড়াশোনার মাঝেই ওকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। অবশেষে একদিন ও বুঝতে পারল আমি ওর ব্যাপারে কতোটা সিরিয়াস। আমাদের অন্তরঙ্গতা বাড়ল। শনি-রবিবার করে বাবা গ্রামে গেলেও আমি তখন পড়ার দোহাই দিয়ে বহরমপুরেই থেকে যেতে লাগলাম। তাছাড়া হাতখরচ চালাতে আমি তখন বেশ কয়েকটা টিউশনিও করতাম। সেগুলোর জন্যও আমাকে ওখানে থাকতেই হতো। বাবাও সেজন্য জোর করতেন না। সেই সময় রাতগুলো সুতপা আমার সঙ্গে থাকতে আসত। এভাবেই কলেজ জীবন শেষ হতে চলল। বাড়িতেও বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছিল। বাড়ির দিক থেকে বিয়ের জন্য চাপটা অনেকদিন আগে থেকেই আসছিল। কিন্তু বাবা এতোদিন মত দিচ্ছিলেন না। আসলে আমার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার দেখে বাবা বোধহয় কোন বড় স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু ওঁর রিটায়ারমেন্টের সময়টা এগিয়ে আসতেই মনের জোরটুকু হারিয়ে ফেললেন। ফাইনাল পরীক্ষার পরে বাড়ি ফিরে মাকে সবকথা খুলে বললাম। ভেবেছিলাম মা হয়ত বুঝবে। বাস্তবে হলো ঠিক উল্টোটা। কথাগুলো শুনতে শুনতে মায়ের মুখটা পাথরের মতো হয়ে গেল।

    এই পর্যন্ত বলে সেঁজুতি একটু থামল। সামনের টেবিলে রাখা গ্লাসটা থেকে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেল।

    —তারপর?... দিব্য আর কৌতুহল চাপতে পারছিল না।

    —বলছি। পরদিন থেকে আমার ওপর শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। রাতারাতি সারা গ্রামের লোক জেনে গেল আমাকে নাকি ভূতে ধরেছে। ওঝা এল, গুনিন এল। ঝাড়ফুঁক, তন্ত্র-মন্ত্র কিছুই বাদ গেল না।

    —সেকি! আঁৎকে উঠল দিব্য।

    —তোমার শুনে অদ্ভুত লাগছে না? ম্লান হাসল সেঁজুতি। --আসলে কি জানো, এখন আমাদের নিয়ে চারদিকে কথা হয়, কাগজে লেখালেখি হয়, সরকারি স্বীকৃতি পাচ্ছি। তবুও তো কতো লোক এখনও বাঁকা চোখে আমাদের দেখে। আর তখন তো এসব কিছুই ছিল না। থার্ড জেন্ডার বলতে লোকে কেবল হিজড়েদেরই বুঝত। কিন্তু তাই বলে মানুষগুলো যে ছিল না তা তো নয়। অনেকেই ছিল, যারা হয়ত সমাজের চাপে পড়ে নিজেদের মনের কথা সারাজীবন লুকিয়ে রাখত। আর আমার মতো যারা তা পারত না তাদের কপালে ঐ ভূতে ধরার মতো আজগুবি কিছু গল্প জুটতো। আর তাই তোমার মা যখন তোমার বাবার মুখে আমার সম্পর্কে সমস্ত কথা শুনে একবর্ণও বিশ্বাস করতে পারেন নি, আমি এতটুকুও অবাক হইনি। তোমার মায়ের উপর রাগ করতেও পারিনি। নিজের মা-ই যেখানে আমাকে বুঝতে পারল না তখন অন্য কারো কাছে কি আর আশা করব?

    —কিন্তু বাবা তো বুঝতে ভুল করেননি।

    —সেই জন্যই তো উনি সবার থেকে আলাদা। জানো, আমি একবার সরিৎদাকে সেকথা জিজ্ঞাসাও করেছিলাম। শুনে উনি বলেছিলেন, “আমি একজন মানুষের দিকে, তার প্রয়োজনে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি সেঁজুতি। তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ গুলো একান্ত ভাবেই তার নিজস্ব ব্যাপার। আশাকরি আমার ক্ষেত্রেও তোমার কাছ থেকে তেমন ব্যবহারই পাব”। বলো তো এমন মানুষকে কি শ্রদ্ধা না করে পারা যায়?

    গলার স্বর ভারী হয়ে এল সেঁজুতির। প্রসঙ্গ পাল্টাতে দিব্য তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করল- আপনার বাড়ির লোক যখন ওঝা ডাকল তখন প্রতিবাদ করেননি?

    —হুম… করেছিলাম …প্রতিবাদ করতে গেলেই শুনতে হচ্ছিল ভূত নাকি আমার মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠছে। অতএব আরো জোরে ঝাঁটাপেটা পড়ছিল গায়ে। সকাল থেকেই না খাওয়া, তারপর এসব আজগুবি জিনিস, সঙ্গে মারধোর... কত আর নেওয়া যায়! সন্ধের দিকে প্রায়ই অচেতন হয়ে পড়তাম। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে কানে আসত মায়ের কান্নাভেজা গলা। এতো লোক থাকতে আমাকেই কেন ভূতে ধরলো তাই নিয়ে ভগবানের কাছে আক্ষেপ করছে। পরপর কয়েকদিন ঐসব ঝাড়ফুঁক চলার পরেও যখন কোন পরিবর্তন হলো না তখন সাংঘাতিক নিদানটা এলো বাড়ির ভেতর থেকে। বাবার অনুপস্থিতিতে কাকা-জ্যাঠারাই তখন বাড়ির অভিভাবক। তারা নিদান হাঁকলেন--ওসব ভূত-টূত কিছু না। আমার মতো হাড়বজ্জাত মেয়ের, শহর থেকে শিখে আসা অসভ্যতা বন্ধ করার সহজ উপায় হলো পুরুষ-সঙ্গ করা। তার ব্যবস্হাও করেছিলেন সুচারুভাবে। মাকেও সবাই দুচার কথা শোনাতে লাগল মেয়েকে বিদ্বান তৈরি করতে চেয়ে তিনি কতো বড়ো ভুল করেছেন! তুমি হয়ত ভাবছো এসব সাতকাহন তোমায় কেন শোনাচ্ছি! উপায় নেই বাবুন। এই নোংরা অধ্যায়টা না জানলে পরের কথাগুলো তোমার কাছে মূল্যহীন মনে হবে।

    শেষের দিকের কথাগুলো শুনে অবাক চোখে দিব্য তাকিয়েছিল মহিলার দিকে। এখন চট করে চোখ নামিয়ে নিল। দিব্যর মনে হলো কথাগুলো ভদ্রমহিলা নিজেকেই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এসব একান্ত ব্যক্তিগত কথা বলতে ওঁর নিজেরই হয়ত অস্বস্তি হচ্ছে।

    সেঁজুতি আবার বলতে শুরু করল--সেইদিন থেকে আমার জীবনের রাতগুলো হয়ে উঠল ভয়াবহ। জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো দাদারা, কাকারা এমনকি নিজের দাদারাও... ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সেঁজুতি। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল--যাদের কোলে-পিঠে উঠেছি ছোটবেলায়, যাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে বড়ো হয়েছি তারাই শেষে আমার চিকিৎসার নাম করে রাতের পর রাত…যতক্ষণ শক্তিতে কুলোতো লড়াই চালাতাম তারপর একটা সময় পরে হাল ছেড়ে দিতে হতো। অদ্ভুতভাবে বৌদি-কাকিমারাও পুরো ব্যাপারটায় কেমন নীরব সমর্থন জানাচ্ছিল। আর আমার মা কেমন নিস্পৃহ হয়ে গেছিল।

    শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই দিব্যর চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎই ও বলে ফেলল--নিজের বাড়ির লোকেরা? না .. মানে..এই ধরনের কিছু কিছু ঘটনা উত্তর আর পশ্চিম ভারতের কয়েকটা রাজ্যে ঘটেছে বলে মাঝে মাঝে কাগজে পড়ি কিন্তু তা-বলে আমাদের রাজ্যে! তাও কলকাতা থেকে মাত্র দু-আড়াইশ কিলোমিটার দূরে!

    —মানুষের মানসিকতা কি আর ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে তৈরি হয় বাবুন? আর আজ যেটা তোমার কাছে সহজ বলে মনে হচ্ছে তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর আগে সেটা মেনে নেওয়া অত সহজ কিন্তু ছিল না।

    যাইহাক, একদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম--আর সহ্য করব না। আজ যে করেই হোক পালাব। অসুস্থতার অজুহাতে আমাকে সারাদিন একটা ঘরে আটকে রাখত ওরা। শুধু স্নান-খাওয়া আর কলতলায় মানে টয়লেটে যাওয়ার দরকার হলে দরজা খুলে দিত। সেদিন ছিল শনিবার। শেষ বিকেলের দিকে বাবা বাড়ি ফিরতেই কাকা-জ্যাঠা-দাদারা মিলে বাবার সামনে এসে বসলো। বুঝলাম আমাকে নিয়েই এখন আলোচনা চলবে। বাড়ির মেয়েরাও আলোচনা সভার আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জানলা দিয়ে সবটাই দেখতে পাচ্ছিলাম। বাবার মুখটা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমাকে কলেজে পড়ানোর জন্য সবাই মিলে বাবাকে দোষ দিচ্ছিল। উঠোনের অন্য দিকে তখনও ভাইপো-ভাইঝিগুলো খেলছিল। ওদেরই একজনকে ইশারা করে ডেকে দরজাটা খুলে দিতে বললাম। বাচ্চা মানুষ, খেলার চেয়ে জরুরি কাজ আর ওদের আর কিছু নেই। কোনোমতে আগলটা খুলেই ছুট লাগাল। আমিও সেই সুযোগে বাড়ির পেছনের দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে পডলাম। রাস্তা বলতে অন্ধকার ধূ ধূ প্রান্তর, উঁচু-নিচু মাটির ঢিবি। তার মধ্যে দিয়েই পড়ি-মরি দৌড়।

    —অন্ধকার কেন? পাওয়ার ছিল না গ্রামে?

    —এখন কি অবস্থা জানি না। তখন তো ছিল না। আর শুধু পাওয়ার কেন! কতো কিছুই যে ছিলনা। ভাগ্যিস ছিল না। এখনকার মতো রাস্তায় এতো বাস, মোবাইল ফোন এসব থাকলে সেদিন আমি হয়তো আর বেঁচে ফিরতে পারতাম না। ম্লান হাসল সেঁজুতি।

    কি ভাবে যে সেদিন মেনরোডে উঠেছিলাম জানিনা। বরাতজোরে সামনেই একটা বাস দেখতে পেয়ে উঠে পড়লাম। বাসটা বহরমপুরেই ফিরছিল।

    —সঙ্গে টাকাপয়সা কিছু….

    —কিচ্ছু ছিল না। গ্রামের দিকে গরীব-গুর্বো চাষীদের কাছ থেকে অনেকসময়ই বাস কন্ডাক্টররা পয়সা চাইত না। আমার তখন সাজপোশাকের যা ছিরি ছিল তাতে আমাকেও অমনই কিছু ভেবেছিল হয়ত।

    যাইহোক, কপালজোরে নির্বিঘ্নেই বহরমপুর পৌঁছে গেলাম। আগে গেলাম আমাদের ভাড়াবাড়িতে। বাড়িওয়ালার কাছে যে চাবিটা থাকত সেটা চেয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। একটু পরিচ্ছন্ন হয়ে সামান্য কিছু জামাকাপড়, আর আমার সব সার্টিফিকেট, অ্যাডমিট কার্ড গুলো একটা ছোট ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। তোষকের নিচে কিছু জমানো টাকা ছিল। সেগুলোও সঙ্গে নিলাম। ছুটলাম সুতপার কাছে। ভেবেছিলাম দুজনে মিলে কলকাতায় চলে আসব। কিন্তু আমার পরিকল্পনা শুনে সুতপা খুব রেগে গেল। আমাকে বলল--তোর কি মাথা খারাপ? তোর কথায় দু-চারদিন আমরা একসঙ্গে সময় কাটিয়েছি, একটু ঘনিষ্ঠ হয়েছি বলেই সারাজীবন তোর সঙ্গে থাকতে হবে নাকি? লোকে তো আমাকেও এরপর পাগল ভাববে। আর তাছাড়া আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চাই। স্বামী-সংসার-সন্তান…তুই পারবি এগুলো আমাকে দিতে? বরং এসব পাগলামি ছেড়ে বাড়ি যা। একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে কর।

    হঠাৎ করে মনে হলো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেছে। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। লালদীঘির পাড়ে বসে ভাবছিলাম জলে ঝাঁপ দেবো কিনা। পারলাম না। একটা অজানা ভয় এসে চেপে ধরল। উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে আবারও একটা বাসে চেপে বসলাম। টিকিট কাটতে গিয়ে বুঝলাম বাসটা কলকাতা যাবে। এবার একটু চিন্তা হলো। এ শহরে কাউকেই তো চিনি না। কোথাও যাবো? কি করে চলবে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়ল সামনের সিটে। এক ভদ্রলোক, মুখটা চেনা চেনা লাগছিল, ভালো করে খেয়াল করতে বুঝলাম ভুল করিনি। ওটা সরিৎদা। তোমার বাবা আমাদের থেকে বছর চারেকের বড় ছিলেন। বারাক স্কোয়ারে আমরা যখন ফুটবল খেলা দেখতে যেতাম তখন ওঁর খেলা দেখতাম। উনি তো কৃষ্ণনাথ স্কুলে পড়তেন। কলেজও ওখানেই। সপ্তাহান্তে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসার পথেও মাঝে মাঝে একই বাস ধরতাম আমরা। সেই সূত্রেই সামান্য পরিচয় ছিল।

    কিন্তু সেসব তো অনেক দিন আগের কথা। এখন আদৌ উনি আমাকে চিনতে পারবেন কিনা সেটাই ভাবছিলাম। সাতপাঁচ ভেবে কিছু উপায় না পেয়ে শেষে নিজেই ডেকে পরিচয় করলাম। চিনতে পারলেন। উচ্ছ্বাস বা কৌতূহল কোনোটাই দেখালেন না। কিন্তু অচেনা মানুষের মতো মুখ ফিরিয়েও নিলেন না। এক বাস অচেনা লোকের মাঝে ওঁকেই তখন পরম আত্মীয় বলে মনে হচ্ছিল। পথে আসতে আসতে ওঁকে জানালাম আমার একটা কাজের খুব প্রয়োজন। উনি যখন কলকাতার বাসিন্দা তখন একটা যা হোক কাজের খোঁজ যদি দিতে পারেন। উনি কি বুঝলেন জানিনা, আমাকে ছোট ছোট প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। আমার তখন যা মানসিক অবস্থা খুব বেশিক্ষণ সবকথা চেপে রাখতে পারলাম না। কথাগুলো বলে ফেলার পর অবশ্য আফশোস হচ্ছিল। তোমার বাবা তখন একদম চুপ করে গেছেন। ভাবছিলাম এবার হয়তো আবার একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়তে হবে। লোকটা কেমন মানুষ কিছুই তো জানিনা। শুধু ভালো ফুটবল খেলতে দেখেছি…এতো কথা না বললেই ভালো হতো।

    কিন্তু উনি যখন মুখ খুললেন তখন আমার হতবাক অবস্থা। ওঁর কথায় আমাকে নিয়ে কোন কটাক্ষ নেই, এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা নেই, বরং আমার সমস্যার বাস্তবিক সমাধানের পথ বাতলাচ্ছেন। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম এমন একজন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য।

    পরদিন সকালে তোমাদের পাইকপাড়ার বাড়িতেই আমাকে নিয়ে এলেন।

    —পাইকপাড়ার বাড়ি? মানে সেই ভাড়াবাড়ি? সে তো শুনেছি বহুদিন আগে ছিল। আমি তখন খুব ছোট।

    —হ্যাঁ তো। আমি যেদিন তোমাদের পাইকপাড়ার বাড়িতে গেলাম তার দিনদুয়েক আগেই তুমি জন্মেছ। সরিৎদা তোমাকে আর তোমার মাকে দেখতেই তো মালদা গিয়েছিলেন। সেদিন রাতে সেখান থেকেই ফিরছিলেন। পথে আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। তোমাদের গোলপার্কের বাড়ি যখন হলো তুমি তখন দুবছরের।

    দিব্যর মনে পড়ল মা অনেকদিন আগে ঠাম্মাকে এমনই কিছু বলেছিল। মানে মহিলার কথাগুলো মিথ্যে নয়। বাকিটুকুও শোনার অপেক্ষায় ও সেঁজুতির দিকে তাকাল। মুখের কথার চেয়েও চোখের ভাষায় মাঝে মাঝে বেশি কাজ হয়। সেঁজুতির ক্ষেত্রেও তাই হলো। ও আবার বলতে শুরু করল-- দু-তিনদিন তোমাদের বাড়িতেই থাকতে হলো। সকালে চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম। তারপর সারাদিন অফিস-পাড়ার বিভিন্ন অফিসে অফিসে ঘুরতাম কাজের খোঁজে। বিকেলের দিকে ঢুঁ মারতাম গার্লস হোস্টেলগুলোতে। এছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যবস্থার কথা মাথায় আসেনি তখন। এভাবেই একদিন হেদোর কাছে একটা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হলো। একটা ছোট্ট অফিসে টেলিফোন অপারেটরের কাজও জুটলো। মাইনে সামান্যই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাস কয়েক চলল। তারপর শুরু হলো নতুন বিপত্তি। পেটটা কেমন ফুলে উঠছিল দিন দিন। শরীরে কেমন যেন ভারিক্কি ভাব। হস্টেলে আমার যে রুমমেট ছিল সেই প্রথম সন্দেহ করল। কিছু মেয়েলি প্রশ্ন করছিল। উত্তর দিতে আরো অস্বস্তি হচ্ছিল। তাছাড়া যে শরীরটা আমি পছন্দই করি না তার ব্যাপারে বিশদ খোঁজখবর, যত্ন-আত্তিই বা করব কেন? ঠিক কমাস যে পিরিয়ড বন্ধ ছিল তার হিসেবও তাই ছিল না। ডাক্তারের কাছে গেলাম। কিছু টেস্ট করার পর বলল চারমাস চলছে। অপারেশনের রাস্তা আছে। আমার মনটা খচখচ করছিল। একটা প্রাণকে মেরে ফেলব? ভাবলেই নিজেকে কেমন খুনি বলে মনে হচ্ছিল। অথচ প্রেগন্যান্সিটা মেনে নিতেও পারছিলাম না। কয়েকটা দিন নিজের মনের সঙ্গেই এক দুঃসহ যুদ্ধে কাটল। শেষে ঠিক করলাম বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসব। আমার রুমমেটটির কল্যাণে ততদিনে হস্টেলের প্রায় সকলেই জেনে গেছে আমার খবরটা। আপত্তিটা এল হস্টেল সুপারের কাছ থেকে। একজন অবিবাহিত প্রেগন্যান্ট মেয়েকে হস্টেলে রাখতে উনি রাজি নন। অন্য মেয়েরাও নাকি এব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। পনের দিন সময় চেয়ে নিয়ে সুপারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

    কলকাতায় আসার ঠিক সাড়ে চার মাস পরে আমি জীবনে দ্বিতীয়বারের জন্য আশ্রয় হারালাম। আগেরবার যখন বাড়ি ছেড়েছিলাম তখন মনে জেদ ছিল। বাঁচার তাগিদ ছিল। এবার বড্ড অসহায় লাগছিল। একটা অপছন্দের শরীর, তাতে কাঁটার মতো বিঁধে থাকা আরো একটা প্রাণ, প্রায়-শূন্য একটা পার্স আর কয়েকটা জামাকাপড়, এই তখন আমার সম্বল। দু-একটা বাড়িতে ঘরভাড়ার জন্য খোঁজ করতে গেলাম। শুরুতেই ঘাড়ধাক্কা খেলাম। একলা মহিলাকে কেউ ঘরভাড়া দিতে রাজি নয়। খুব আশ্চর্য লাগছিল। একা পুরুষে সমস্যা নেই একা মহিলা হলেই…হুঃ…

    দিব্য দেখল সেঁজুতির ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি। সেটা ব্যঙ্গের না কষ্টের তা আলাদা করে বোঝা মুশকিল। ওর বাবার জন্য টেনশনটা ভেতর ভেতর টের পাচ্ছিল দিব্য। এই পরিস্থিতিতে মা বাড়িতে একা রয়েছে। যদিও মালতী মাসীকে ও বলে এসেছিল মায়ের কাছে থাকতে তবুও চিন্তা তো একটা রয়েই গেছে।

    কিন্তু এই মুহূর্তে সেঁজুতির জীবনের গল্পের টানটাও ও উপেক্ষা করতে পারছে না। এতো কথা তো দিব্য কোনোদিন জানতেই পারত না, আজ এখানে না এলে। নিজের অজান্তেই ও একবার রিস্টওয়াচটায় চোখ বুলিয়ে নিল।

    সেঁজুতি সেদিকে লক্ষ্যও করল না। ওকে আজ যেন কথায় পেয়েছে। সারাজীবন জমিয়ে রাখা লক্ষ লক্ষ কথারা আজ শব্দের ফোয়ারা ছোটাচ্ছে। ও বলে চলেছে--এখানে আসার পর প্রথম কদিন তোমার বাবা যেভাবে আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাতেই সারাজীবনের জন্য আমি ওঁর কাছে মনে মনে কৃতজ্ঞ ছিলাম। সেই কৃতজ্ঞতার বোঝা উনি আরো ভারি করে তুললেন এই ঘটনার পরে। কোথাও জায়গা খুঁজে না পেয়ে শেষে একদিন অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে ওঁর অফিসে গেলাম। উনি তখন ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে বসতেন। আমার তখনকার অফিসটা তার কাছেই ছিল। সব শুনে উনি সেদিন অফিস ছুটির পরে আমাকে সঙ্গে নিয়ে পাইকপাড়ায় এলেন। ওঁর পরিচিত একজন ছিল এদিকে। লোকটা একমাসের ঘরভাড়া পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ঘর খুঁজে দিত।

    —বাড়িভাড়ার দালাল?

    —হ্যাঁ…তাই। কিন্তু ঐ লোকটাই তখন আমার ভরসা। হাজার টালবাহানার পরে অবশেষে একটা এককামরার ঘর পাওয়া গেল শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। ভাড়া সাতশো টাকা… আমার একমাসের মাইনে। শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এবার এগিয়ে এলেন সরিৎদা। পরের দুবছর আমার ঘরভাড়া সহ যাবতীয় খরচ নিয়মিত জোগান দিয়ে গেলেন। বাধা দেওয়ার মতো সামর্থ্য তখন আমার ছিল না। মনে মনে সবসময় সংকুচিত হয়ে থাকতাম। আর তাই ঐ সময়ে নিজেকেও ধীরে ধীরে তৈরি করছিলাম। দুবছর পরে একটা চাকরি পেলাম দক্ষিণ কলকাতার একটা কলেজে। নন-টিচিং স্টাফ। ভদ্রস্থ মাইনেতে টাকা-পয়সার সমস্যাটা মিটলো। তারও কয়েকবছর পরে স্কুলের চাকরিটা হয়ে যেতে আরও সুবিধে হলো। কিন্তু সমস্যা ছাড়া কি আর আমাদের জীবন চলে? বছর তিনেক বয়স থেকেই একটু আধটু সন্দেহ হচ্ছিল…আরও দুবছর পর স্পষ্ট বোঝা গেল টাবলু অটিষ্টিক। অতএব আমার আবার একটা যুদ্ধ শুরু হল। এ যুদ্ধেও আমার একমাত্র সহমর্মী ছিলেন সরিৎদা। প্রথমদিকে টাবলুর স্পিচ থেরাপি, বিহেভিয়ারাল থেরাপি, নিয়মিত চেক আপ, আমার স্কুল সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। মাঝে মাঝে একটা একঘেয়েমি, অসহায়তা…কেমন যেন শূন্য লাগত চারপাশটা।

    —আপনার জীবনে এতো কিছু ঘটে গেল, আপনার বাড়ির কারো সঙ্গে এরমধ্যে যোগাযোগ হয়নি?.. মানে ওরা কেউ আপনার খোঁজ খবর করেননি?

    —করেছে হয়ত! হয়ত বা করেওনি… তবে আমার সঙ্গে কারো কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।

    —অদ্ভুত! যাদের জন্য আপনার লাইফটা পুরো ঘেঁটে গেল তারা কোনোদিন সেটা জানতেও পারলেন না?

    ম্লান হেসে সেঁজুতি বলল--এমন কতো অদ্ভুত আমাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে পড়ে যে বাবুন! তবে সরিৎদা কিন্তু নিয়মিত আমাদের খোঁজ নিতেন। আমাকে মনের জোর বাড়াতে বলতেন। বদলে আমিই বরং ওঁর জন্য কিছু করতে পারিনি। তোমাদের বাড়িতে যে একটা অশান্তির বাতাবরণ ছিল সেটা মাঝে মাঝে বুঝতে পারতাম। কখনো সখনো সরিৎদা দু-একটা টুকরো টুকরো কথা বলে ফেলতেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিতেন। আমার তখন মনে হতো ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার অনুপ্রবেশ হয়তো উনি পছন্দ করছেন না। আমিও তাই নিজেকে এসবের থেকে দূরেই রাখতাম। কিন্তু আরও কয়েক বছর পরে... সেবার ওদের দুজনের মধ্যে মনোমালিন্যের মাত্রাটা হয়ত বাড়াবাড়ি রকমের হয়েছিল … ততদিনে সরিৎদার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আরো একটু সহজ, সাবলীল হয়েছে। …একদিন কথায় কথায় তোমার বাবা অনেক কথাই বলে ফেললেন। বুঝলাম সমস্যাটা মূলত আমাকে নিয়েই। তখনই তোমার মায়ের সঙ্গে আমি দেখা করে আমার সবকথা বলতে চেয়েছিলাম। তোমার বাবা রাজি হননি। ওঁর হয়ত আত্মাভিমানে লেগেছিল। সত্যি বলতে কি আমি সেসময় একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। আমার কারণে শেষপর্যন্ত যদি সরিৎদার সংসার ভাঙে? মানে তোমার মা যদি তেমন কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন… ঐরকম মানসিক অবস্থায় যেকোনো মেয়ের পক্ষে… তারপর তোমাদের বাড়ির লোকজন! তারাও তো আসবেন…লোক জানাজানি হওয়া মানেই হাওয়ার চেয়েও জোরে বিকৃত কিছু গল্প লোকের মুখে মুখে ছড়াবে। বিশেষত আমাদের গ্রামে। নিজের জন্য ভাবিনা। কিন্তু সরিৎদার এতোবড় ক্ষতি….

    —ডিভোর্সের কথা বলছেন তো? আমারও কিন্তু এতক্ষণ সেটাই মনে হচ্ছিল। মা তো স্বাবলম্বী ছিল। চাইলে তেমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই পারত।

    —উঁহু… ব্যাপারটা অতোটা সহজ নয় বোধহয়। আসলে কি জানো বাবুন…আমাদের মনের গতিপ্রকৃতি সবসময় যে সরলরেখা ধরে চলাচল করে তা তো নয়। মনের ভেতরে আরো কতোগুলো মন যে লুকিয়ে থাকে তার খবর হয়ত আমরা নিজেরাও রাখিনা।

    এইসময় দিব্যর ফোনটা সুরেলা শব্দে বেজে উঠতেই সেঁজুতি চুপ করে গেল। কথা সেরে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দিব্য উঠে দাঁড়ালো। সেঁজুতিকে বলল--আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা বলা…এগুলোর সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল। মাকে আমি সবকিছু অবশ্যই বুঝিয়ে বলব। আমি আন্তরিক ভাবে, খুব শিগগিরই, আপনাকে আমাদের বাড়িতে স্বাগত জানাতে চাই। বাবার পরিচিত মানুষ হিসেবে নয়, আমাদের পারিবারিক বন্ধু হিসেবে। কিন্তু এখন আমাকে উঠতে হবে।

    সেঁজুতি এগিয়ে এসে দিব্যর হাত ধরে বলল--আমি জানি তুমি ঠিক পারবে। আজ আর তোমাকে আটকাব না। ভেবে দেখলাম আমার থানায় যাওয়াটা ঠিক হবে না। তাতে হয়ত অহেতুক জটিলতা বাড়বে। সরিৎদার কোনো খবর পেলে জানিও।

    অফিস টাইমের যানজট কাটিয়ে বাগবাজার থেকে গোলপার্ক পৌঁছতে পাক্কা দেড় ঘন্টা লাগল দিব্যর। সেঁজুতির বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকেই দিব্যর মনে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে চলেছে। বাবার সম্পর্কে আজন্ম লালিত একটা ধারণা হঠাৎ ভুল বলে প্রমাণিত হওয়াতে দিব্যর মনে যেমন একটা খুশির নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে তেমনি আজ বাবার জন্য খুব কষ্টও হচ্ছে ওর। একটা মানুষ সারাজীবন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল শুধুমাত্র তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া একটা ভুল ধারণার জন্য! তার জন্য বাবার নিজের জেদ আর অভিমানও তো কম দায়ী নয়! এই মুহূর্তে ওর খুব ইচ্ছে করছে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, বাবাকে একবার ছুঁয়ে দিতে। সেই পাঁচ বছরের ছেলেটা আবার একটু একটু করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ওর ভেতরে।

    থানায় মিসিং ডায়রি করে দিব্য যখন বাড়ি ঢুকল তখন দুপুর প্রায় দুটো বাজে। দরজা দিয়ে দিব্যকে ঢুকতে দেখেই বাচ্চা মেয়ের মতো ওর দিকে ছুটে এলো কল্যাণী। দিব্য সেদিকে একঝলক তাকিয়েই মনে মনে চমকে উঠল। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কল্যাণীর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। হাঁটাচলার মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাসী, দৃপ্ত ভাবটা আর নেই। একমাথা চুল উস্কোখুস্কো হয়ে আছে। চোখের নীচে কেউ যেন একদলা কালি লেপে দিয়েছে। দিব্য চট করে সিদ্ধান্ত নিল, কল্যাণীকে এখনই কিছু বলাটা ঠিক হবে না।

    —এতক্ষণ কোথায় ছিলিস বাবুন? কতোবার ফোন করছি… ফোনটা ধরছিলিস না কেন?... দেখা পেলি? একটানা এতোগুলো প্রশ্ন শুনেও দিব্য ধীরে সুস্থে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বলল--ঘরে চলো। বলছি সব। মালতী মাসীকে একগ্লাস জল দিতে বলো না!

    উৎকন্ঠায় কল্যাণীর যা অবস্থা হয়েছে তাতে অবশ্য বেশিক্ষণ সবকথা চেপে রাখা দিব্যর পক্ষে সম্ভবও হল না। সেঁজুতির বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে আর জেনেছে সবটাই একটু একটু করে কল্যাণীকে বলল দিব্য। সবটুকু চুপচাপ শোনার পর খুব আস্তে আস্তে কল্যাণী বলল--যতবার ওর কথা উঠতো ততবারই তোর বাবা ওর সম্পর্কে এই কথাগুলোই আমাকে বলতো। বিশ্বাস কর বাবুন, আমি তখন এতোকিছু বুঝতে পারিনি। এমনটাও যে হয় সেটাই তো জানতাম না। আজকাল এই ধরনের মানুষদের নিয়ে কাগজে যখন খবর পড়ি তখন ভাবি, কি জানি আমিই হয়ত ভুল বুঝেছিলাম। ইদানিং তাই ওকে নিয়ে আমি তোর বাবার সঙ্গে কোনো কথাও বলতাম না। ভুলে যেতে চেয়েছিলাম সেই অশান্তি, ঝগড়া, কথাকাটাকাটি সবকিছু। ভুল যারই হোক, এক ছাদের নিচে এতোগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়ে … বয়সও তো হচ্ছে দুজনের... কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এমন ভাবে কল্যাণী দিব্যর দিকে তাকিয়ে বলল--মানুষটা তাহলে কোথায় গেল বাবুন? আমি এখন কোথায় খুঁজব তাকে?

    দিব্য বুঝতে পারল উদ্বেগ-আশঙ্কায় কল্যাণীর ভেতরটা অস্হির হয়ে আছে। কথা গুলোও তাই এমন অসংলগ্ন শোনাচ্ছে। ও কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। দু-তিন মিনিটের নীরবতার মধ্যেই থানা থেকে ফোনটা এল।

    গতকাল সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে একটা অ্যাকসিডেন্টের খবর রয়েছে। দুটো বাসের রেষারেষির সময় ধাক্কা লেগে অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে। কয়েকজন বাসযাত্রী ছাড়াও দুজন পথচারী সিরিয়াসলি ইনজ্যুয়র্ড অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তার পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। লোকটার কাছে কোনো পরিচয়পত্র ছিল না। একটা মোবাইল ছিল কিন্তু সেটা দুর্ঘটনার সময় আছড়ে পড়ে ভেঙে গেছে। মিসিং ডায়রি করার সময় দিব্য ওর বাবার যে ছবিটা থানায় দিয়েছিল, তার সঙ্গে এই ভদ্রলোকের চেহারার নাকি বেশ কিছু মিল পাওয়া গেছে।

    খবরটা কল্যাণীকে বলতেই কল্যাণী অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গেল। বোধহীন চোখে শূন্যে দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ বসে রইল। ধীরে ধীরে ওর ঠোঁটের দুপাশ বেঁকেচুরে যেতে শুরু করল। আর চোখ দুটো দিয়ে টপটপ করে অবিরাম ধারাস্রোত নেমে এলো। দিব্যর মনে হলো হাসপাতালে পৌঁছনোটা এখন বেশি জরুরি। এদিকে কল্যাণীর যা অবস্থা তাতে… ও চট করে ফোনটা বের করে একটা সদ্য পরিচিত নম্বরে ডায়াল করল। তারপর কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়েই হাসপাতালের দিকে রওনা দিল।

    হাসপাতালে পৌঁছে পেশেন্ট আইডেন্টিফিকেশন আর আনুষঙ্গিক কাগুজে নিয়মের পর্ব মিটলে কল্যাণীকে করিডোরে বসিয়ে রেখে দিব্য ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গেল। বাবার শারীরিক অবস্থা এখন ঠিক কিরকম সেটা জানতে গেলে এখানকার ডাক্তারের সঙ্গে ওর কথা বলাটা জরুরি।

    কিছুক্ষণ পরে ডাক্তারের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে ও যখন করিডোরে ফিরলো তখন কল্যাণীকে করিডোরের কোথাও খুঁজে পেল না। দিব্য বাইরে বেরিয়ে হাসপাতাল চত্বরের আশপাশটুকুও দেখে এলো। সেখানেও কল্যাণী নেই। ও কল্যাণীর মোবাইলে চেষ্টা করল। ফোনটা বেজে বেজে চুপ করে গেল। এবার দিব্যর বেশ চিন্তা হচ্ছে। এটুকু সময়ের মধ্যে কল্যাণী কোথায় যেতে পারে! ফোনটাও ধরছে না… হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়াতে ও দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে হাসপাতালের তিনতলায় উঠতে লাগলো।

    দিব্য যখন তিনতলায় পৌঁছল, কল্যাণী তখনও ঝাপসা কাচের দেওয়ালের ওপারের আবছায়াতে চোখ রেখে খুঁজে চলেছে ওর চল্লিশ বছরের পুরনো জীবনসঙ্গীকে। কল্যাণীর পাশে ওরই মতন আইসিইউয়ের ভেতরে দৃষ্টি মেলে, দুটো বলিষ্ঠ হাতে কল্যাণীর কাঁধ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেঁজুতি। দিব্য দূর থেকে নিঃশব্দে দেখল আইসিইউয়ের সামনে দুজন বিপরীত তীরবর্তী মানুষ কেমন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটাই মানুষের জন্য। যার সুস্থ হয়ে ওঠাটা এই মুহূর্তে ওদের সবার জন্যই বোধহয় খুব জরুরি। দিব্য যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে শুরু করল। ওর মনের মধ্যে ডাক্তারসত্তাকে ছাপিয়ে সেই ছোট্ট ছেলেটা আবার একটু একটু করে জেগে উঠছে। দিব্য মনে মনে বলল--তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো বাবা। তোমার কাছে আমার অনেক ভুল জমা হয়ে গেছে। সেগুলো সঅঅব শুধরে নিতে হবে যে!




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)