• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • ত্রিযামা প্রেম : সূর্যনাথ ভট্টাচার্য


    মনশ্চক্ষে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ছোকরাকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অল্প অল্প শীতের বাতাস। অনির্দেশ্য আগ্রহ নিয়ে ছেলেটি তার গৃহকোণে বসে বিমূঢ় বিস্ময়ে খাতাখানার ওপর ঝুঁকে একমনে পড়তে শুরু করেছে—

    জানি কেহ বিশ্বাস করিবে না, জানি অনামিকার কথা কেহ শুনিতে চাহিবে না। তবু আমি বলিয়া যাইব। রমণী তাহার মোহিনী মায়ায় পুরুষকে জড়াইবে এ আর বেশী কথা কী? কিন্তু এ কোনও প্রেমপীড়িত হতভাগ্যের মোহমুগ্ধ প্রলাপাচার নহে। অনামিকার সুদন্তের দ্যুতি, নয়নের জ্যোতি ও সুবিমল প্রীতি যে লাভ করে নাই সে মুক্তপুরুষ হইতে পারে কিন্তু দুর্ভাগা সন্দেহ নাই। অবিশ্বাসী যাহাই বলুন, আমার এ কাহিনীতে বলিয়া যাইব কেন—।

    যুবকটি আমার অপরিচিত। এখন সে কোথায় আছে তাও জানি না। এটুকু জানি, বর্তমানে সে এক অপ্রত্যাশিত দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন। আর তার এ অবস্থার জন্যে পরোক্ষে আমিই দায়ী বটে। কিন্তু অনন্যোপায় ছিলাম আমি। যা করেছি প্রাণের দায়ে করতে হয়েছে। তার কোনও অনিষ্টসাধনের ইচ্ছে আমার ছিল না। ঘটনাচক্রেই সে আমার শিকার হয়েছে। তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও আমার কোনও আপত্তি ছিল না। ঐ অবস্থায় আবার আমি একই কাজ করব। এখন দূর থেকে অজানা বন্ধুকে সহানুভূতি জানাতে পারি কিন্তু কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নই। কেননা বোতাম-ছেঁড়া ওয়েস্টকোট পরা লোকটাও তো আমার প্রতি করুণা দেখায়নি।

    শুরু থেকেই বলি। সেদিন সাহিত্যসভায় খানিক অপদস্থ হয়েই বেরিয়ে এসে কাছের একটা পার্কে বসেছিলাম। গল্পপাঠের আসরে একটা ভৌতিক গল্পের প্রতিযোগিতা ছিল। তাতে আমার গল্পটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিবেচিত হয়েছে। দুঃখ শুধু সে জন্য নয়। খেলায় হারজিৎ আছে। দৌড়ে একজন প্রথম হবে আর একজন সবার শেষে পৌঁছবে। কিন্তু সবশেষে ফিতে ছোঁয়া প্রতিযোগীকে সান্ত্বনা দেবার নাম করে অপদস্থ করা হয় কি?

    সেদিন আমার গল্প পড়া শেষ হলে দেখলাম সবাই বেশ গুম হয়ে গেছেন। শেষে শৈবাল একটু গলা ঝেড়ে বলল, গল্পে ভয়ের বাতাবরণটা ঠিক খোলেনি মনে হল। তাই না শিশিরদা?

    শিশির গুপ্ত নামকরা লেখক। ভুতের গল্পে আবার তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি। তিনি শৈবালকে সমর্থন করে বললেন, আর গল্পের শেষটাও যেন কেমন গুলিয়ে গেছে।

    —চরিত্রগুলোও ঠিকমত এস্ট্যাব্লিশড হয়নি। পরম বোদ্ধার মত প্রভাতের মন্তব্য। প্রভাতও উদীয়মান গল্পকার, বড় বড় পত্রিকায় তার গল্প ছাপা হয়েছে। কিন্তু আমার মতে সে অতি ওঁচা লেখক।

    —এমনকি ভূতের চরিত্রটাও। নিখিল বয়সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে অর্বাচীন, সেও ফুট কাটল।

    —প্লটটাও বহুব্যবহৃত, কোনও নতুনত্ব নেই। বিভুদা কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিলেন। গল্পের আইডিয়াটা সত্যিই অনেক পুরনো এক শিশুপত্রিকার থেকে ঝেড়েছিলাম। তাকে অবশ্য অনেক কারুকার্য করে বাড়িয়ে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কেউ বুঝতে পারবে না।

    বিভুদার কথায় আমি জানলা দিয়ে আকাশ দেখছিলাম, শুনতে পেলাম আমাদের সভাপতি মিহিরদা বলছেন, কিছু মনে কোর না ফেলু, তোমার এ গল্পটা আমাদের পুজো স্যুভেনিরেও রাখতে পারব না। তবে ভালোই চেষ্টা করেছ। শুধু খোল-নলচে পালটে আর একবার লিখে ফেল্লেই হবে। নাতনির স্কুলের পত্রিকায় ঠিক নিয়ে নেবে। এ কী, উঠলে নাকি—?

    না উঠে আর কী করব? আমার লেখার আদ্যশ্রাদ্ধ চলবে আর আমাকে বসে বসে তাই দেখতে হবে? মিহিরদার নাতনি ক্লাস ফাইভে পড়ে। আর পুজোর স্যুভেনিরে পাড়ার যত রদ্দি লেখা ছাপান হয়, সে সব কি আর জানি না? বললাম, হ্যাঁ মিহিরদা, একটা নতুন গল্পের আইডিয়া মাথায় ঘুরঘুর করছে। এখনই না লিখে ফেললে—।

    আমার কথা শুনে হঠাৎ সবাই এমন খুকখুক করে কাশতে লাগল কেন কে জানে। অন্য কেউ শুনলে মনে করত নির্ঘাত হাসি চাপতে চাইছে। আমি অবশ্য অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে পড়লাম।

    পার্কে বসে ভাবছিলাম, না হয় ভূতের গল্প লিখতে পারি না। তাই বলে অত বিশ্লেষণ করে শোনাবার কী আছে, অ্যাঁ? আর ছাপবে না তো ছাপবে না। কালিন্দী বিদ্যাপীঠের ক্লাশ ফাইভের পত্রিকাতে দেবার কথাটা বলবার কি খুব দরকার ছিল? তাছাড়া আমার একটা পোশাকি নামও তো আছে— প্রবীণ। মিহিরদা সেটাই ব্যবহার করে থাকেন। আজ ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে হেয় করতেই যে ঐ অখদ্দে ডাকনামে ডাকা, তা কি আর বুঝি না? কিন্তু নাম ফেলু হলেই কেউ ফেল করে না। আসলে ভূতের গল্পে ভয়টা ফুটিয়ে তোলার জন্যে লেখকের ভয় পাবার অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। তা ছোট থেকেই আমার ভয়ডর একটু কম। সেটা তো কোনও খারাপ কথা নয়। তাই গল্পে বানিয়ে বানিয়ে সে সব ফুটিয়ে তুলতে পারি না। তোমরা ভীতুর ডিম সব আচ্ছা করে ভয় ফুটিয়ে তোল গিয়ে, আমার দরকার নেই।

    নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। খেয়াল করিনি, আমি যে বেঞ্চটায় বসেছিলাম তার উল্টোদিকে আর একজন এসে বসেছে। বয়স্ক, টাকমাথা— কানের ওপরের চুল লম্বা করে মাথার অন্যদিকে নিয়ে টাক ঢাকবার চেষ্টা। গায়ে একটা ধূসর রঙের ওয়েস্টকোট। তার আবার ওপরের বোতামটা ছেঁড়া। সেখানে একটা সুতো ঝুলছে। লোকটা কীরকম সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে এদিকওদিক দেখছে।

    ভদ্রলোকের হাতে একটা ডায়রি ধরা ছিল। মানে ব্রাউন রঙের মলাট বাঁধান খাতা একখানা। মনে হল বেশ পুরনো, কিন্তু মজবুত বাঁধাই। হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক তড়িঘড়ি উঠে পড়লেন। খাতাটা যে পাশে পড়ে রইল বোধহয় খেয়াল করেননি। উঠে পড়ে আর না দাঁড়িয়ে হনহন করে পার্কের গেটের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, অ মশাই, আপনার ডায়রি পড়ে রইল যে।

    ভদ্রলোক যেন শুনতেই পাননি এমন ভাবে হেঁটে চললেন। আমি খাতাটা তুলে নিয়ে তাঁকে ধরবার জন্যে পেছন পেছন খানিক গিয়ে ডাকলাম, আরে অ মশাই, শুনছেন? আপনার খাতাটা যে—?

    কে কার শোনে? ভদ্রলোক একবার পেছনে দেখেও যেন আরও দ্রুত সাঁৎ করে পার্কের গেট পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

    কী আশ্চর্য! আমার ভয়ে পালাল নাকি? আমি মারতাম না ধরতাম? ওঁরই ফেলে যাওয়া মাল ফেরত দিতে চাইছিলাম। কিন্তু মনে হল উনি যেন কী একটা ভয় পেয়ে দৌড় দিলেন। কেন রে বাবা! কৌতূহল হল। খাতাটার মলাট খুলে দেখলাম কোনও নাম ঠিকানা লেখা নেই। অর্থাৎ ফেরত দেবার কোনও উপায় নেই। ডায়রি নয়, প্লেন বাঁধান খাতা। ভেতরের পাতাতেও দেখি অজস্র সংখ্যার আঁকিবুঁকি। মাঝে মাঝে কয়েক পাতায় ক্ষুদি ক্ষুদি অক্ষরে বেশ কিছুটা করে লেখা। ভাষাটা বাংলাই, কিন্তু সন্ধ্যের আবছা অন্ধকারে কিছু পড়া গেল না। তাছাড়া আরও সব হাবিজাবি ছবি আর কাটাকুটিতে প্রায় ভরা সেই খাতা।

    বাড়ীতে নিয়ে এলাম। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নেওয়া আমার রুটিন। তারপর লিখতে বসি। সেদিন হরিদা'কে বললাম, এখনই খাবার দিয়ে দাও হরিদা। কাজ আছে।

    খাওয়া সেরে বিছানায় লেপের তলায় ঢুকলাম খাতাখানা নিয়ে। পড়ে দেখতে হবে কী পাওয়া যায়। অন্যলোকের গুপ্তকথা হতে পারে। কিন্তু আমি তো ফেরত দিতেই গিয়েছিলাম, সেই নিল না তো এখন এটা আমারই সম্পত্তি। দেখা যাক কী আছে।

    অনেকগুলো পাতা পালটে প্রথম যেখানে লেখা পেলাম, তাতে বিস্তর কাটাকুটি। কালিটাও কেমন ঝাপ্সা মত। আরও কয়েক পাতা পালটে চললাম। শেষে এক জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল। বেশ ঝরঝরে লেখা। পড়তে শুরু করলাম—

    বসন্তের বাতাস, অসহায় যৌবন ও একগুচ্ছ বৌদিদি একযোগে ষড়যন্ত্র করিলে এ হতভাগ্য আর কী করিতে পারে? চোপর দিন সহস্রচক্ষুর পাহারা, নববধূই বা কী করে? লোকাচারের মেঘ প্রেমজ্যোৎস্নাকে গ্রাস করিলে মধুমল্লিকা কি আর ফুটিতে পারে?

    কবি বলিবেন, তাহাকে দেখিবার প্রয়োজনই বা কী? অক্ষিনক্ষত্রের মাঝেই অহরহ সে যখন অবস্থান করিতেছে, তুচ্ছ বাহিরের দর্শন না পাইলেও খুব বেশী ক্ষতিবৃদ্ধি হয় কি? হয়ত হয় না। শুধু প্রতীক্ষার দুঃসহ পলগুলি পার করিতে করিতে মাধবীলতা ঝরিয়া যায়। নিঃসঙ্গ রাত্রির প্রহরগুলি প্রলম্বিত হইতে হইতে অসহ্য হইয়া পড়ে। আর মলয়ানিলের দীর্ঘশ্বাস গণিতে গণিতে জীবনের সকল সরসতা শুষ্ক হইতে থাকে। তবু কূলহারা ডিঙ্গিনৌকাখানা অশান্ত প্লাবনের পারে দারুচিনি দ্বীপের সন্ধান পায় না।

    কবিবরের অবশ্যই বয়স হইয়াছে, গৃহিণীর তাড়নায় শয্যার পরিবর্তে তাঁহাকে অক্ষিমাঝে বসাইয়া নিষ্কৃতি পাইয়াছেন। কিন্তু তরুণ বয়সের কথা কি তাঁহার মনে নাই?

    কাব্য ছাড়িয়া কিছুকাল গদ্য পড়িয়া কাটাইলাম। কিন্তু সামান্য গল্প-উপন্যাসও আর ভাল লাগিতেছিল না, অবশেষে মোহমুদ্গর পাঠ শুরু করিয়াছিলাম। মনে হইল, কুসুমাসব যখন ভাগ্যে নাই তখন আমার মুদ্গরই ভাল। কিন্তু শুধুমাত্র সদ্গ্রন্থ পাঠ করিয়াই বাসনাগ্নি নির্বাপণ সম্ভব হইলে মদনদেবের অস্তিত্বসংকট ঘটিত। তাহাতে এ জগতে প্রেমকাহিনীগুলা সব যে মিথ্যা হইয়া যায়।

    সহ্যশক্তির সীমায় উপস্থিত হইয়া দেহমন যখন হিংস্র হইবার উপক্রম করিতেছে, তখন একদিন বিধাতা সদয় হইলেন। কৃষ্ণপক্ষের অবসানে দ্বিতীয়ার চাঁদের মত মাত্র একটি রাত্রির জন্য তাহাকে পাইবার অনুমতি পাওয়া গেল।

    তাহার নামটি এখানে বলিব না। যে নাম অহর্নিশ আমার অব্যক্ত জিহ্বার জপমন্ত্র হইয়াছে, সর্বসমক্ষে তাহাকে উদ্ঘাটিত করিয়া উপহাসের পাত্র হইতে চাহি না। মুক্তার বুকে শুক্তির মত সে নাম আমার অন্তরেই ধ্বনিত হইতে থাকুক, বহির্বিশ্বে সে না হয় অনামিকা হইয়াই রহিল।

    সেদিন রাত্রি মদালস, অজুহাতের অবসান ও বৌদিদিদের দুষ্টবুদ্ধি অবশেষে ক্লান্ত হইয়াছিল। পত্রপুষ্পে সজ্জিত শয্যায় অনঙ্গমোহিনী অনামিকাকে একাকী রাখিয়া সর্বাপেক্ষা চপলা বৌদিদিটি আমাকে কক্ষে ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন, নাও এবার রূপসাগরে ডুব দাও। আবার দেখো, সকালে ভাসিয়া উঠিতে ভুলিও না যেন।

    আর এক রঙ্গিণী বক্রস্বরে মন্তব্য করিলেন, ও পক্ষ মুণ্ডটি আস্ত রাখিলে তবে না ভাসিয়া ওঠা।

    তৃতীয় এক রসিকার কণ্ঠে শুনা গেল, এ পক্ষের মুণ্ডহারা হইবার আগ্রহ দেখিয়া ও পক্ষকে আর দোষ দিই কেন ভাই?

    রমণীকুল সমবেত কলহাস্যে গড়াইয়া পড়িল। তাহাদের আর কোনরূপ দুরভিসন্ধির সুযোগ না দিয়া এবার দুয়ার বন্ধ করিলাম। বাহির হইতে বড় বৌঠান স্বর তুলিয়া জানাইলেন, আরশির কাছে দুধ-বাদামের শরবৎ রাখা আছে, খাইয়া লইও। গায়ে জোর পাইবে।

    কথাটির মধ্যেকার অশ্লীল ইঙ্গিত আমার মত মূর্খের কাছেও গোপন রহিল না। মনে মনেই বলিলাম, কূটবুদ্ধিতে ভরা এই মুণ্ডগুলা দাদারা চিবাইয়া খায় না কেন কে জানে। বাহিরে ললনাকুলের কোলাহল ক্রমে মিলাইয়া গেল।

    শয্যার দিকে ফিরিয়া সত্যই আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। দুগ্ধফেননিভ শয্যার মাঝে লাল চেলিতে মোড়া অপরূপ নারীমূর্তিটি যে আমারই প্রতীক্ষায় বিরাজমান, এই কথাটি ভাবিয়া নিজেকে বড় ভাগ্যবান বলিয়া মনে হইল। অচ্ছাভ ওড়নার নীচে দুই আয়তনয়নের দীর্ঘ অক্ষিপল্লবগুলি আমার হৃদয়ে ঝড় তুলিল। মনে হইল, অবনত এ নয়নের দৃষ্টি একবার উত্তোলিত হইলে বুঝি উন্মাদ হইয়া যাইব।

    ধীর পদক্ষেপে শয্যার দিকে অগ্রসর হইয়া অনামিকার মুখাবরণী তুলিতে গেলাম। অনামিকা একটু সরিয়া গিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, না... না।

    —কেন নয় অনামিকা? আজও কি আমার কাছে ধরা দিবে না?

    সে কোনও উত্তর না দিয়া পালঙ্ক হইতে নামিয়া গেল। মস্ত আয়নাখানার সম্মুখে আমার দিকে পিছন করিয়া দাঁড়াইল। আয়নাতেও তাহার সেই লাজনত অবয়বের স্থির প্রতিচ্ছবি।

    আমার তখন বড় করুণ অবস্থা। কামনার অগ্নিপ্রবাহে দুই কানে উত্তপ্ত বাতাসের অনুভব। অনামিকার নিকটবর্তী হইতেই তাহার দেহনির্গত আতরের সৌরভে বাতায়ন পথে ভাসিয়া আসা হাস্নাহানার সুবাস মিশিয়া আমাকে পাগল করিয়া দিল। পিছন হইতে তাহার ওড়না সরাইয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিতে গেলাম। তখনই সে আমার দিকে ঘুরিয়া পূর্ণদৃষ্টিতে চাহিল।

    শুভানাল্লাহ্‌! যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই হইল। সে দৃষ্টিতে আমার সর্বনাশের অন্তিম ঠিকানাই লিখা ছিল। আমার সমগ্র সত্তা সে অক্ষিপারাবারে ডুবিয়া গেল। আমার চারিপাশের পরিচিত চরাচর, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড যেন সেই অতলান্ত গভীরতার তল খুঁজিয়া লইতে অসমর্থ হইল। আজ বুঝিলাম, যুগে যুগে কোন সর্বনাশা কুহকে পুরুষ আত্মাহুতি দিয়াছে। সব গোলমাল হইয়া গেল, উন্মত্তের মত অনামিকার অধরোষ্ঠে নিজেকে সমর্পণ করিবার জন্য ধাবিত হইলাম।

    তখন দেখি, একহাতে সে আমার ও তাহার অধরোষ্ঠের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করিয়াছে। চক্ষে তাহার ব্রীড়ার পরিবর্তে দেখিলাম নিলাজ ছলনার হাসি। পুরুষকে বশ করিয়া ফেলিবার পর বিজয়িনী নারীর এ আবহমান কালের লীলাবিলাস। গরবিনী যেন বলিতে চাহে, আর তোমার নহে ওগো বীর, এখন আমি যাহা বলিব তাহাই হইবে।

    তাহাই হউক। আমি আর কিছু চাহি না, শুধু তোমার আসঙ্গানলে আমাকে প্রবিষ্ট হইতে দাও। এ অসহনীয় ব্যবধান আর সহ্য হয় না। অধৈর্য হইয়া বলিলাম, কেন অনামিকা, আর কেন? দোহাই তোমার, আমাকে তোমার আগুনে পুড়িয়া মরিতে আর বাধা দিও না।

    —তুমি যাহা চাও, সকলই দিতে পারি। আগে দেখিয়া লও এ তোমার চলিবে কিনা। আমার কিন্তু গজদন্ত আছে।

    অনামিকা এবার দশনপংক্তি নিষ্কাশিত করিয়া হাসিয়া উঠিল। দেখিলাম মুক্তার মত সুসজ্জিত রত্নরাজির মাঝে শ্বদন্তদুটি একটু বাহিরের দিকে উঠিয়া আছে। সূচিমুখ দুটি অল্প দীর্ঘ হইয়া নামিয়াছে। কিন্তু তাহাতে কোনও ক্ষতি হয় নাই। বরং সে ত্রুটিবিভঙ্গ ওই অনিন্দ্য মুখমণ্ডলে হিংস্র কামনার এক নিষিদ্ধ গৌরব অর্পণ করিয়াছে।

    আমি বলিলাম, তুমি অনন্যা অনামিকা। আমার দেখা হইয়াছে। তোমার গজদাঁত দুটি সোনা দিয়া বাঁধাইয়া রাখিব।

    —ভেবে দেখ, গজদন্তী কন্যা কিন্তু অলক্ষণা। কেউ পছন্দ করে না।

    আমি তখন পছন্দ-অপছন্দের পারে। হাসিয়া বলিলাম, হোক। মরিতেই আসিয়াছি, তোমার হাতেই মরিব। আগে একটি চুম্বন দিয়া ধন্য কর। তারপর তোমার ঐ গজদন্ত আমার কণ্ঠে বসাইয়া দিও।

    লোভ্য রমণীর তুষ্টিবিধানে ব্যগ্র পুরুষকে কত না অতিশয়োক্তি করিতে হয়। আমার কথায় সলজ্জ হাস্যে অনামিকা বলিল, ছি ছি, কী যে বল না। কিন্তু আগে এটা খাইয়া লও।

    দুধ-বাদামের গ্লাসটি বাড়াইয়া ধরিয়াছে অনামিকা। সম্মত কামিনী তাহার পুরুষটিকে প্রস্তুত হইতে বলিতেছে! আমার বুকের রক্ত ছলকিয়া উঠিল। আর দেরী নাই। সাগ্রহে সে গ্লাস তাহার হাত থেকে লইয়া ঢাকনা খুলিলাম।

    তখনই কে যেন হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। কামরায় আর কেহ নাই। অর্থাৎ অনামিকাই হাসিতেছে। কিন্তু মনে হইল নিস্তব্ধ চরাচরের প্রতিটা অপ্রাণীও বুঝি খলখল করিয়া তাহার অনুসঙ্গে মাতিয়াছে। চাহিয়া দেখি, অনামিকার উন্নত শ্বদন্তের শুভ্রতায় লালিমার ছাপ!

    সহসা দৃষ্টি গেল হাতে ধরা শরবতের গ্লাসে। শাদা দুধ নহে, লাল রক্তে ভরিয়া সে গ্লাস উপছিয়া পড়িতেছে—!

    'আঁক' করে একটা শব্দ করে খাতাটা বন্ধ করে দিতে হল। উফ্‌, ভেবেছিলাম প্রেমের গল্প। কিন্তু গল্পের শেষে একেবারে প্রেমের পিণ্ডি চটকে গেল। প্রেমিকার হাতে গ্লাস ভর্তি রক্ত— বাপ রে!

    চোখটা যেন আপনা থেকেই চলে গেল টেবিলে রাখা কাঁসার গ্লাসটায়। হরিদা কখন এসে জল রেখে গেছে খেয়াল করিনি। রোজই দেয়। কিন্তু আজ মনে হল, গ্লাসে জলই তো? উঠে গিয়ে ঢাকা খুলে আর দেখতে ইচ্ছে হল না। গা-টা কেমন যেন শিরশির করছে।

    লেখাটা বেশ চলছিল। ভাষাটা পুরনো, কিন্তু মন্দ লাগছিল না। বেশ একটা ভিন্টেজ ক্লাসিকের ছাপ আছে। হঠাৎ শেষে ঐ অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স না হলে—। কিন্তু শেষ কি? আরও তো ছিল মনে হয়। রাত্রির নিস্তব্ধ প্রহর। ঘড়িটার টিকটিক শব্দ। খাতাটা খুলে আরও খানিকটা পড়ে দেখব কিনা ভাবছি, আচমকা লোডশেডিং হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই বাইরে থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপ্টা মাথার কাছের বন্ধ জানলাটা দড়াম করে খুলে দিল। আর সেই সঙ্গে চোখে কিছু না দেখলেও শুনলাম টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা খন-খন করে মাটিতে উলটে পড়ল।

    ভাগ্যিস ঘর অন্ধকার ছিল! মাটিতে কী ছড়িয়ে পড়েছে তা আর দেখা গেল না। কিছু দেখবার প্রবৃত্তিও ছিল না। কোনরকমে হাত বাড়িয়ে টেবিলে খতাটা রেখে দিয়েই সাঁৎ করে লেপের মধ্যে ঢুকে গিয়ে মাথা পর্যন্ত চাপা দিয়ে নিয়েছি। পাছে আলো এসে যায় আর মেঝেতে চোখ পড়ে যায়! আর যদি দেখি মেঝে জুড়ে—!

    বাইরে শুনতে পাচ্ছি হাওয়ার শাঁ-শাঁ শব্দ। একটা হাল্কা হাসির আওয়াজও কি তাতে মিশে আছে? মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। এরপর যতক্ষণ সম্বিত ছিল ঠকঠক করে একটা কাঁপুনির বোধ হচ্ছিল। সেটা কিন্তু শীতের জন্যে নয়।

    ***

    সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল, দেখি ঝকঝকে শীতের সকাল। বাইরে ঝলমলে রোদ। জানলা দিয়ে পূবালী রোদের একফালি এসে ঘরের মেঝেয় লুটোচ্ছে। গ্লাসটা এক পাশে পড়ে আছে। না, তাতে জলই ছিল। মেঝেতে অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ।

    টেবিলের কোণে খাতাখানা রাখা। যেমন রাতে রেখেছিলাম। নিরীহ, শান্তশিষ্ট। তাতে যে কোনওরকম রহস্য আছে মনেই হয় না। তার মানে অযথা ভয় পেয়েছিলাম। একেই তাহলে ভয় পাওয়া বলে। এখন দিনের আলোয় আর সেই বিভীষিকা নেই। কিন্তু রাত্রে বেশ নাকাল হতে হয়েছে। হুঁহ্‌, এই তবে ভয়। অকারণ।

    হরিদা-কে ডেকে বললাম, ঘরটা মুছে নিও হরিদা। আর ঐ যে খাতাখানা দেখছ, ওটাকে আজ বাইরে কোথাও ফেলে দিও।

    খাতাটা আর পড়ে দেখবার ইচ্ছে ছিল না। হরিদা মাথা হেলিয়ে চলে গেল। আমিও সকালের কাজকম্ম সেরে কলেজে বেরিয়ে গেছি। তারপর সারাদিনের অন্যান্য কাজে আগের রাত্রির কথা একরকম ভুল হয়ে গেছে।

    ফিরতে একটু দেরী হয়েছিল। সন্ধ্যের পরে ঘরে ঢুকেই কিন্তু দেখলাম খাতাখানা যথাস্থানেই বিরাজ করছে। একটা বিতৃষ্ণার স্বাদ আবার ফিরে এল। কিন্তু সেই সঙ্গে এক অমোঘ কৌতূহলও যেন খাতাটার প্রতি আকৃষ্ট করল। হরিদাকে ডেকে জিজ্ঞেস করায় তৎক্ষণাৎ জিবখানা এক হাত বার করে সজোরে মাথার পশ্চাদ্দেশ চুলকোতে লাগল। জানা গেল, খাওয়াদাওয়ার পর গিয়ে হরিদা ওটিকে বাইরে কোথাও ফেলে আসবে ভেবে রেখেছিল। তারপর হাতের সব কাজ সারবার ফাঁকে একদম ভুলে মেরে দিয়েছে। অবশ্য তক্ষুনি সে ত্রুটি সংশোধন করে নিতে চেয়েছিল হরিদা, আমিই মানা করলাম। কেন করলাম জানি না। আসলে গতরাত্রের স্মৃতিটা ফিকে হয়ে গিয়েছিল। মনে হল গল্পের শেষটা জানা হয়নি। এখনও যখন আছে, তাহলে আরও খানিকটা পড়েই না হয় বিদেয় করা যাবে। বলা যায় না, নতুন কোনও গল্পের প্লট পেয়ে যেতে পারি। মিহিরদাকে তাহলে এক হাত দেখে নেওয়া যাবে।

    রাতের খাওয়া সেরে হরিদাকে বললাম, ঠাণ্ডা পড়ে গেছে হরিদা, রাতে আর জল লাগে না। দরকার হলে এই জাগ থেকে খেয়ে যাব। আজ থেকে আর আমার ঘরে জলের গেলাস রাখতে হবে না।

    বিছানায় একটা ছোট টর্চ নিয়ে শুলাম। লেপের মধ্যে খাতাটা খুলে কিন্তু বেশ অবাক হতে হল। গত কালকের সেই লেখাটা আর কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। খাতাটায় মোটামুটি শ'তিনেক পাতা আছে। যেখানে কাল পড়ছিলাম সেখানে সে গল্প নেই! তারপর শুরু থেকে শেষ অবধি একটা একটা করে প্রায় সব পাতাগুলো উলটে গেলাম। উঁহু, সে লেখার কোনও চিহ্ন নেই! না তার শুরু না শেষ।

    কী হল? এটা সেই খাতাই তো? দেখে তো তাই মনে হয়। সেই একই হাতের লেখা। কোনও পাতা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে, এমন নয়। মলাটটাও একই রকম লাগল। টেবিলে যেমন রেখে গেছিলাম তেমনই ছিল। হরিদা ছাড়া আমার এই ঘরে আর কেউ আসে না। আর হরিদাকে অবিশ্বাস করা যায় না। তাহলে কালকের পড়া পাতাগুলো কোথায় উধাও হয়ে গেল!

    কাল যা পড়েছিলাম মনে করার চেষ্টা করলাম। দিব্যি মনে আছে। সেই বিশুদ্ধ প্রাচীন ভাষা। সেই প্রেমপীড়িত হতভাগ্যের অনুনয়। আর তারপরেই গজদন্তী সুন্দরীর হাতে—! একটু গা ছমছম করল। একবার ভাবলাম, খাতাটায় নিশ্চই কিছু গণ্ডগোল আছে। পড়ে কাজ নেই। কিন্তু অন্য আর এক দিকে ওতে আর কী আছে তা জানবারও এক উদগ্র বাসনার উদয় হয়েছে। মনে খটকা রয়েই গেল, কিন্তু খাতাটা ছাড়া গেল না। ইতিমধ্যে আনমনে পাতা ওলটাবার ফাঁকে এক জায়গায় 'অনামিকা'র উল্লেখ দেখে সেখানেই আবার চোখ আটকে গেল—

    বউদিদিগণ সমবেত ভাবে বলিলেন, অনামিকা নষ্ট হইয়াছে। উহাকে ভুলিয়া যাও।

    ইঁহারা বুঝিতেছেন না, কেহ বুঝিতেছে না, অনামিকাকে ভুলিয়া যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে। যদি তাঁহারা বলিতেন, বাতাস দূষিত হইয়াছে অতএব শ্বাস-প্রশ্বাস পরিত্যাগ কর, তাহাও চেষ্টা করিতাম। কিন্তু অনামিকা বিনা আমার অস্তিত্ব মিথ্যা। তাহার বিহনে আমার পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হইয়াছিল। চন্দ্র-সূর্য উঠিত না। ঋতুচক্রের পরিবর্তন হইত না। বর্ষার রিমঝিম, শরতের জ্যোৎস্না ও বসন্তের কুহুধ্বনি একই রকম ব্যঙ্গ করিয়া সতত জানাইত তুমি একটি ঝুনা দাড়িম্ব। রস নাই, কষটুকু রহিয়া গিয়াছে।

    আমারই আত্মীয় আমার প্রতি এত নির্দয় কীভাবে হইতে পারে জানি না। তাঁহারা কি জানেন না, অনামিকাকে হারাইয়া আমার কী দশা হইয়াছিল? অনামিকা নষ্ট হইয়াছে ইহাতে তাহার কোনও দোষ নাই। যাহারা তাহাকে নষ্ট করিয়াছে, তাহারা নিপাত যাউক। কিন্তু আমি অনামিকাকে পরিত্যাগ করিতে পারিব না।

    আজ এতদিন পর প্রখর গ্রীষ্মে তৃষ্ণার্ত চাতকের কাছে ফটিক জলের মত অনামিকার পত্র আসিয়াছে। সে লিখিয়াছে—

    প্রিয়তম, ইহ জীবনে আর তোমাকে মুখ দেখাইবার উপায় রহিল না। দুর্বৃত্তরা আমার শুচিতা কাড়িয়াছে। কোন মুখে আর সে কথা বলি? শুধু তাহাই নহে। ইহারা আমার এরূপ অবস্থা করিয়াছে যে আমি স্বচক্ষে আর তোমাকে কোনদিন দেখিতে পাইব না। স্বকর্ণে আর তোমার মধুসন্দেশ শুনিবার জো রহিল না। তোমার অঙ্গের সৌরভ আর আমার নাসিকায় আসিবে না। এ জীবনে আর আমার অধরোষ্ঠে তোমার প্রেমময় মুখচুম্বন অঙ্কিত হইবে না। আমার তো মাথা কাটা গিয়াছে, তাহাতেই মরমে মরিয়া আছি। তবু এ মৃতশরীরে প্রাণসঞ্চার করিতে একবার কি দেখা দিবে না প্রাণেশ্বর?

    অনামিকার কাতরোক্তিতে আমার হৃদয় মুচড়াইয়া উঠিল। পত্রের প্রতিটা অক্ষর আমার পঞ্জরাস্থিতে এক একটা শলা চালাইয়া দিল। শব্দগুলি উত্তপ্ত সীসার মত কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়া মস্তিস্কে বিস্ফোরণ ঘটাইল। অন্তরাত্মা চীৎকার করিয়া প্রতিজ্ঞা করিল, আমি আসিব অনামিকা। তুমি যে অবস্থাতে যেমনই আছ, আমার তাহাতেই চলিবে। জগতের বাধা তুচ্ছ করিয়া আমি পুনরায় তোমাকে আমার হৃদয়ে স্থাপনা করিব।

    অনামিকার পত্রের বক্তব্য ছিল প্রবল ব্যঞ্জনাময়। সে কথা তখন বুঝি নাই, বুঝিলাম অনেক পরে।

    কলিকাতার হাড়কাটা গলির একটি ঠিকানা হইতে পত্র আসিয়াছিল। সকল বাধা অগ্রাহ্য করিয়া রেল, ষ্টীমার, বাস ও ছ্যাকড়া গাড়ীযোগে অবশেষে হাড়কাটা গলিতে আসিয়া পৌঁছাইলাম। উক্ত নম্বরের ভবন কিন্তু পাওয়া গেল না। তাহার ঠিক আগের নম্বরটিই গলির শেষ বাড়ী। তাহার পাশে একটি পতিত জমিতে একটি ত্রিতল বাড়ীর ভগ্নাবশেষ আছে বটে কিন্তু কেহ সেখানে বাস করে এরূপ বোধ হইল না।

    তবে কি পত্রে ঠিকানা ভুল লেখা ছিল? অনামিকা কি আমার সঙ্গে ছলনা করিল? উদ্ভ্রান্তের মত গলিটার এমাথা-ওমাথা করিতে করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। তখন ঐ পোড়ো বাড়ীটার সম্মুখে আসিয়া দেখি দ্বিতলের একটি কক্ষে আলো জ্বলিতেছে। তবে কি এই ভগ্ন গৃহই এখন অনামিকার আবাস?

    ঊর্ধ্বশ্বাসে ভাঙ্গা সোপান বাহিয়া উপরে আসিলাম। আলোকিত কক্ষটিতে প্রবেশ করিয়া দেখি একটা ভাঙ্গা তক্তাপোষে বাহুবন্ধনে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা ডুবাইয়া অনামিকা বসিয়া আছে। একটি লাল চেলিতে ঢাকা তার সম্পূর্ণ অবয়ব।

    আমি বলিলাম, অনামিকা আমি আসিয়াছি।

    অনামিকা মাথা তুলিল না। ঐ ভাবেই প্রবল আপত্তি জানাইয়া বলিল, না না তুমি কাছে আসিও না। আমার অবস্থা তুমি চোখে দেখিতে পারিবে না।

    —পারিব অনামিকা, আমি অস্থির হইয়া বলি, তোমার ঐ কমললোচন তুলিয়া একবার আমায় দেখ। আমি সব ভুলিয়া যাইব। তোমার সহিত যাহা হইয়াছে কিছু মনে রাখিব না। ইহজগতে কে কী বলিবে তাহাতে আমার কিছু আসে যায় না। তুমি শুধু আমার বাহুমধ্যে আসিয়া ধরা দাও।

    —বাহুমধ্যে তো দূর, তোমার সঙ্গে দৃষ্টি মিলাইবার শক্তি আমার নাই। কাতর স্বরে অনামিকা বলিল, আমাকে কাছে আসিতে বলিও না। আমি জানি সে তুমি সহ্য করিতে পারিবে না।

    আমার প্রাণ আকুলিবিকুলি করিতেছিল। পাষণ্ড দুর্বৃত্তেরা কি অনামিকার শুধু সতীত্ব হরণ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই? তাহার অপরূপ মুখমণ্ডলেও কি রাখিয়া গিয়াছে পাপের চিহ্ন? শুনিয়াছি সুন্দরীদের প্রতি প্রতিহিংসা বশে অনেক নরাধম অ্যাসিড নিক্ষেপ করিয়া কুৎসিত করিয়া দেয়! অনামিকার সহিত এমনই দুর্ঘটনা কিছু ঘটে নাই তো?

    মন শক্ত করিয়া বলিলাম, আমার পানে মুখ তুলিয়া দেখ অনামিকা। অসঙ্কোচে আমাকে বল সব কথা। আমি সকলই সহ্য করিয়া লইব। দুর্বৃত্তেরা কি তোমার মুখে কোনও আঘাত করিয়াছে?

    অনামিকা শিরঃসঞ্চালনে হাঁ বলিল। আমি শিহরিত হইয়া বলিলাম, আমাকে দেখাও অনামিকা তোমার অনিন্দ্য মুখমণ্ডল কতদূর ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। আমি বিলাতি চিকিৎসা করাইব। যে ভাবেই হউক তোমার পূর্ব সৌন্দর্য ফিরাইয়া আনিব। তুমি দয়া করিয়া মুখের আবরণ সরাও, আমাকে দেখিতে দাও।

    অনামিকা শরীর দুলাইয়া না না বলিতে লাগিল। আমি অধৈর্য হইয়া বলিলাম, দেখাইবি না যদি তাহলে এতদূর হইতে ডাকাইয়া আনিলি কেন রাক্ষসী? তোর প্রাণে কি দয়ামায়া নাই?

    আমার বাক্য শুনিয়া তাহার কী মনে হইল জানি না। একবার 'কী বলিলে, রাক্ষসী' বলিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। তাহার পর লাল চেলিখানা সরাইয়া সটান তক্তাপোষ হইতে নামিয়া দাঁড়াইল। খিলখিল করিয়া হাসির মাঝে অনামিকার কণ্ঠস্বর হাওয়ায় ভাসিতে লাগিল, দেখ মেজোবাবু, আমার এই মুখটা ভাল করিয়া দেখিয়া লও। দেখো কোন চিকিৎসায় তুমি ইহার উপচার করিবে।

    পৈশাচিক অট্টহাস্য কক্ষে ছড়াইয়া পড়িল। আর এ আমি কী দেখিতেছি! একটি নারীমূর্তি আমার দিকে আগাইয়া আসিতেছে। সম্পূর্ণ নগ্ন। পদযুগল, নিতম্ব, নাভি ও বক্ষের অতুল ঐশ্বর্য লইয়া সে যেন কোনও নিপুন শিল্পীর হাতে গড়া এক জীবন্ত ভাস্কর্য! অপরূপ, ত্রুটিহীন প্রত্যঙ্গগুলির সন্নিবেশে সেই অনুপমার গ্রীবার কাছে আসিয়া শুধু সব শেষ হইয়া গিয়াছে। অনামিকা কোথা দিয়া হাসিতেছে জানি না, স্কন্ধোপরি তাহার মুণ্ডটাই আর নাই!

    ছিন্নমুণ্ড নগ্নিকা শনৈ শনৈ আমার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল।—

    আবার ঝপ করে খাতাটা বন্ধ করে দিতে হল। আর আগে পড়তে সাহস হল না। খুলে রাখলে হয়ত খাতার পাতা থেকে সে স্কন্ধকাটা মূর্তি বেরিয়ে আসতে পারে! মনে হল দুই মলাটের মধ্যেই তাকে বন্ধ রাখা সমীচীন। সন্তর্পণে তাকে টেবিলে পাচার করা গেল।

    আজ অবশ্য বেমওকা লোডশেডিং আর হল না। বেডসুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে লেপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু খালি মনে হতে লাগল, বন্ধ দরজার বাইরে কেউ এসেছে। একটা কন্দকাটা পেত্নী অন্ধকারে বোধহয় তার মাথাটা খুঁজছে। দরজায় ছিটকিনি লাগাই না। যে কোনও সময়ে সে দরজা দিয়ে এ ঘরে ঢুকে পড়তে পারে! হয়ত ঢুকেই পড়েছে। লেপের মধ্যেও আমার হাত-পা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। অথচ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আর বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর গুরগুরুনি।

    এ ভাবে কি ঘুম আসে? এই নিদারুণ অবস্থার একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। লেপ থেকে বেরিয়ে একবার আলো জ্বেলে ঘরটা দেখে নিলে হত। ওরে ব্বাবা! ও আমি পারব না। তার চেয়ে— কিন্তু ওটা কী—!

    অবচেতনায় কখন যে লেপটা থেকে চোখ বার করে ছোট্ট টর্চটা জ্বেলে ফেলেছিলাম মনেই নেই। দেখলাম সে টর্চের আলো দেওয়ালের যেখানে একটা অচ্ছাভ বলয় তৈরি করেছে, সেখানে একটা অস্পষ্ট অবয়ব। দুদিকে হাতদুটো আছে, কিন্তু তার মাথাটা নেই!

    টর্চটা হাত থেকে পড়ে গেল। আর সত্যিই গলা দিয়ে একটা 'আঁ—' করে আওয়াজ বেরিয়ে গেল। লেপের মধ্যে ডুবে গিয়েও বুঝলাম ঠকঠক করে কাঁপছি। তারপর সব কেমন গুলিয়ে গেল।

    ***

    সকালে ঘুম ভাঙতেও দেখি কেমন একটা ক্লান্তির অনুভব। রাত্রি অবসানেও যেন শরীর তেমন চাঙ্গা হয়নি। সকালের কোনও দোষ নেই, সেই ঝলমলে রোদ উঠেছে। হরিদা এসে জানলা দরজা খুলে দিয়ে গেছে। মেঝেতে যথারীতি জানলা দিয়ে আসা রোদের নকশা। আলোকিত ঘরে আমি একদৃষ্টে দেওয়ালের দিকে চেয়ে আছি।

    দেওয়ালের গায়ে স্ট্যান্ড থেকে হ্যাঙ্গারে আমার কোটটা টাঙ্গানো আছে। হাত দুটো বডি'র দু'পাশে ঝুলছে, গোল গলাটা ফাঁকা। মুণ্ড নেই। এই আমার রাতে দেখা স্কন্ধকাটা!

    রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়ে প্রাণটা যেতে বসেছিল। এই জন্যে মা বলে, রাতে ওসব বিভীষিকার বই পড়তে নেই। রাম নাম করে শুতে হয়। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, টেবিলের ওপর খাতাটা যেমন তেমনি রাখা আছে। দিনের বেলা দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। কিন্তু নির্ঘাত হতভাগা প্রেমিকপ্রবরের কিছু অবাঞ্ছিত ইতিহাস জড়িত আছে ওর সঙ্গে। কী যে রহস্য কে জানে। কিন্তু নিকুচি করেছে রহস্যের, চুলোয় যাক গপ্প। আজ ও আপদ বিদেয় করতেই হবে। আর হরিদাকে দিয়ে নয়, যা করবার নিজেই করব।

    খাতাটা নিয়েই সেদিন কলেজে বেরোলাম। বাড়ী থেকে বেরিয়েই একটা খালি জমি আছে। তার ধারে ওটা ফেলে গিয়ে বাস ধরলাম।

    সেদিন রাতে কিন্তু আবার সেই খাতাখানা কোলে নিয়ে লেপ মুড়ে বসেছি। না, তাকে বিদায় করা যায়নি। সন্ধেবেলা বাড়ী ফিরে টেবিলের ওপর যথাস্থানে আবার তাকে দেখেই মাথায় টিং করে বিপদসঙ্কেত পেয়েছি। হরিদার কাছ থেকে জানা গেল, আমার প্রতিবেশী অনুকূলবাবু সেটি ফেরত দিয়ে গেছেন। আমি জানতাম না, সকাল বেলা আমার পেছনেই আসছিলেন তিনি। আমার হাত থেকে বইটি পড়ে যেতে দেখতে পেয়েছিলেন। দরকারী খাতা ভুল করে পড়ে গেছে ভেবে তিনি সেটি হরিদা'কে ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন।

    আপাতদৃষ্টিতে প্রতিবেশীর নিঃস্বার্থ পরোপকার ছাড়া আর কিছুই মনে করা যায় না। অনুকূলবাবু নিতান্তই ভালমানুষ, প্রায়শই আমার অপাঠ্য লেখাগুলোরও নিরতিশয় প্রশংসা করে থাকেন। তাঁর কোনও দুরভিসন্ধি থাকবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হল এই অকলুষ বন্ধুকৃত্যটির পেছনে কোনও আজানা শক্তির প্রেরণা আছে। অনুকূলবাবু নিমিত্ত মাত্র।

    আগের দু'রাত্রির তিক্ত অভিজ্ঞতা বেশ মনে আছে। অবশ্য সবই ছিল নেহাতই ইহজাগতিক সংঘটন। কিন্তু সে আধিদৈবিক অভিঘাতের ধকল খুব সুখকর ছিল না। তবু খাতাখানার অমোঘ আকর্ষণ অবজ্ঞাও করা গেল না। জানি না এবার কোনও বিভীষিকায় দেখা দেবে বিদেহিনী প্রেয়সী। কোন অনাগত আতঙ্কে পরিসমাপ্ত হবে প্রেমমুগ্ধ প্রেমিকের সেই অপার্থিব অভিসার। কী যে আছে তার শেষে? জানি না, জানতে চাইও না। কিন্তু এ যেন প্রেতলোকের আহ্বান। পরলোকের বিধৃতি অতিক্রম করে সে যেন আমার চেতনা আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। নিদারুণ ভয় নিয়েও এখন এগিয়ে যেতে হবে ভয়ঙ্করের দিকে।

    দেখে নিলাম, হরিদা জলের গেলাস রাখেনি। দেওয়ালে ঝোলানো কোটটাকেও উলটো করে টাঙ্গিয়ে দিলাম। তারপর খাতাটা নিয়ে ঢুকলাম বিছানায়। টর্চটাও আর নিলাম না। ঠিক করেছি, সেরকম কিছু হলে সিধা লেপের মধ্যে ঢুকে যাব, আর কোনও দিক দেখব না।

    কোনও সন্দেহ নেই, এ সেই খাতাটাই। সেই মলাট, ভেতরে সেই হাবিজাবি লেখা। পাতা উলটে খুঁজে দেখলাম কাল যেখানে শেষ করেছিলাম সে জায়গাটা পাওয়া যায় কিনা। যদিও জানতাম পাব না। কিন্তু আর এক নতুন পরিচ্ছেদে পেয়ে গেলাম অনামিকার উপস্থিতি। সেখান থেকেই পড়তে শুরু করলাম—

    গতকল্য অনামিকার সম্মতি পাইলাম। পাষাণী দীর্ঘকাল বিরহানলে দগ্ধ করিয়া অবশেষে আমাকে দয়া করিল। হতভাগ্যের তাহাকে একটিবার চোখের দেখা দেখিবার প্রার্থনা সে মঞ্জুর করিয়াছে।

    অনামিকা এখন আমার স্বপনচারিণী। ইহজগতে তাহাকে বোধহয় চিরদিনের জন্য হারাইয়াছি। কতকাল তাহার সঙ্গে দেখা হয় নাই। লোকে বলে সে মরিয়াছে। আমি বিশ্বাস করি না। শয়নে-স্বপনে আমি তাহার সহিত কথা কই। যত্রতত্র আমি তাহার অঙ্গের সুবাস পাই, বহুবার একান্তে তাহার উপস্থিতি অনুভব করিয়াছি। বৌদিদি বলে, তোমাকে পেত্নীতে ধরিয়াছে। একটা স্বস্ত্যয়ন করাইয়া লও। পেত্নী ঘাড় হইতে নামুক। তারপর আর একটি বিবাহ কর।

    আমি অসহায়, ইহাদের বাক্যবাণ আমাকে সহ্য করিতে হয়। পুরুষ হইয়া নারীর নির্যাতন মুখ বুজিয়া সহন করিয়া যাই। বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া ইহাদের আমার অন্তঃস্থলের অবস্থা দেখাইতে ইচ্ছা করে। যদি তাহা পারিতাম, নির্মম নারীজাতি বুঝিত পুরুষের ঐকান্তিক প্রেম কী বস্তু। দাদারা মুখে তাহাদের 'প্রাণেশ্বরী' 'হৃদয়েশ্বরী' বলিয়া ভুলাইয়া রাখে কিন্তু সন্তানোৎপাদন ভিন্ন পত্নীকে আর কী দিয়াছে? অনামিকা ও আমার স্বর্গীয় প্রেম ইহজগতে কাহারও বোধগম্য হইবে না।

    কিন্তু অনামিকাও যে আমার সহিত ছলনা করিতেছে। সে আর আমার কাছে আসে না। আসিলে আমিও তাহাকে দেখাইয়া সবাইকে বলিতে পারি, দেখ অনামিকা মরে নাই— সে এখনও তাহার হৃদয়ের সমগ্র বৈভব লইয়া আমাকে কামনা করে। তোমরা অন্ধ, তাহা দেখিতে পাও না। তোমাদের বধির কর্ণকুহরে অনামিকার নূপুরধ্বনি প্রবিষ্ট হয় না।

    অনামিকা কিন্তু স্বপ্নে অহরহই আসিতে থাকে। সে স্বপ্ন নিদ্রার ঘোরে দেখা কিছু অলীক দৃশ্য নহে। সামান্য স্বপ্নের স্মৃতি স্থায়ী হয় না। স্বপ্নে যখন অনামিকাকে দেখি, তাহা বাস্তব অপেক্ষা বাস্তবতর। তাহার নয়নের প্রতিটি পক্ষ্মপাত আমি স্পষ্ট দেখিতে পাই, প্রতিটি দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ আমার হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। স্বপ্নবাস্তবের সেই ছবিগুলি লইয়াই কাল কাটাইতেছিলাম।

    অনামিকার দেখা পাইলেই তাহাকে বলিতাম, একবার চর্মচক্ষে দেখা দাও। সকলে দেখুক তোমার অস্তিত্ব শধুই ভগ্নহৃদয়ের ভ্রমিত কল্পনা নহে। সকলে জানুক, প্রেতিনী নহে, প্রেয়সী আমার জীবননদীর কাণ্ডারি হইয়া আসিয়াছে।

    অনামিকা বলে, মিথ্যা আমার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছ। আমি যেখানে আছি, সেখান হইতে তোমার কাছে আসা বড় দুরূহ।

    —তবে আমাকে বল অনামিকা তুমি কোথায় আছ। পাতালপুরী হইতেও তোমাকে খুঁজিয়া লইব হে প্রিয়তমা।

    —সে তুমি পারিবে না, অনামিকার কণ্ঠে হতাশা ঝরিয়া পড়ে, তাহার পূর্বে তোমাকে দশ-মঞ্জিল হইতে ঝাঁপাইতে হইবে নয়ত বিষ খাইতে হইবে।

    অনামিকা কি আমাকে মৃত্যুবরণ করিতে বলিতেছে? সে তো অতি তুচ্ছ কথা। কিন্তু আমার বিষয়বুদ্ধি লুপ্ত হয় নাই। তাই ভাবিলাম, মরণের পরপারে গিয়াও যদি আনামিকাকে না পাই? বেঘোরে মরাটা তো তাহা হইলে নিষ্ফল হইবে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়। সরাসরি তাহাকে জিজ্ঞাসা করি, লোকে বলে তুমি মরিয়া গিয়াছ অনামিকা। ইহা কি সত্যি?

    এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয় না অনামিকা। শুধু ছলছল আঁখিতে সকরুণ দৃষ্টি মেলিয়া ধরে। আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করি, তোমার যদি সত্যই মৃত্যু হইয়া থাকে তাহা হইলে আমাকে বল অনামিকা। আমিও এইক্ষণে মৃত্যুবরণ করিয়া মরণের পারে তোমার সহিত মিলিত হই।

    —না না প্রিয়তম, শিহরিত হইয়া অনামিকা বলে।— দয়া করিয়া মরিবার কথা বলিও না। এই তো আমি তোমার কাছে আসি। তোমাকে দেখিতে পাই। দোহাই তোমার, আমার এইটুকু সুখ থেকে আমাকে বঞ্চিত কোর না।

    সে যদি মরিয়াই গিয়াছে, তাহা হইলে আমাকে মরিতে দিতে চাহে না কেন? আমি জানি অনামিকা মরে নাই। একদিন সকল চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করিয়া তন্বঙ্গী অনামিকা স্থুলশরীরেই আমার নিকট আসিবে। আমি সেই দিনটির জন্য নিয়ত চাহিয়া থাকি। তাহার কথার উত্তরে নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলি, কিন্তু এ আসা কেমন আসা অনামিকা? শুধু দর্শনে যে হৃদয়ভার লাঘব হয় না। শুধু শ্রবণে যে মর্মব্যথা দূর হয় না। স্পর্শ দিয়া আমাকে আরোগ্য কর অনামিকা। তোমার অধরসুধার সিঞ্চনে হোক আমার তৃষিত হৃদয়ের উপচার।

    কী যেন ভাবিয়া অনামিকা বলে, তবে অপেক্ষা কর। মলয় যেদিন দারুকচম্পার সঙ্গে প্রিয়াশ্রীর সৌরভ মিশাইবে, চন্দ্রহীন বিভাবরীর নীরব সঙ্গীতে নিশিবান্ধুলি জাগিয়া উঠিবে আর চাতকের ওষ্ঠে স্ফটিকজল ফেলিবে মধ্যনিশীথের আকাশ— সেইদিন আমি আসিব তোমার কাছে।

    এ সব কথা বৌদিদিরা শুনিতে পায় না। পাইলে বুঝিত অনামিকার প্রেমের গভীরতা। প্রেতিনীর পক্ষে এমন গূঢ়ভাষণ কি সম্ভব? অবশ্য মূঢ় রমণীগণ তবুও বিশ্বাস করিত কিনা জানিনা। তবে আমি জানিতাম, অনামিকা আসিবে।

    গতকল্য অনামিকাকে পাইয়া পুনরায় ইনাইয়া-বিনাইয়া সেই আবেদন নিবেদনই শুরু করিব ভাবিতেছিলাম। তাহার পূর্বেই সে বলিল, সময় হইয়াছে ওগো স্বামী। আমি আসিব।

    আমি সোৎসাহে বলিলাম, আমার কাছে? তবে কি কাঠচাঁপা আর পিয়াবাহারের সৌরভ মিশিল? রাতকুসুমের তন্দ্রা কি তবে টুটিল? চাতক শীতল হল ফটিক জলে?

    —সে সব কিছু নহে, অনামিকা বলিল, একটা অন্য ব্যবস্থা হইয়াছে। কিন্তু এক শর্ত আছে।

    কী সে ব্যবস্থা, জানিবার ধৈর্য আমার ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। অনামিকা আসিবে ইহাই যথেষ্ট। কিন্তু শর্ত! সাগ্রহে বলিলাম, কখন আসিবে অনামিকা? কী শর্ত? আমাকে কী করিতে হইবে বল। যাহা বলিবে তাহাই করিব।

    —তোমাকে কিছুই করিতে হইবে না। শুধু জানিয়া রাখ, ইহাই আমাদের অন্তিম অভিসার!

    অন্তরাত্মা একবার 'না না' বলিয়া ব্যাকুল হইতে চাহিল। কিন্তু অনেক কষ্টে সে আবেগ সম্বরণ করিলাম। অনামিকা আসিবার অঙ্গীকার করিয়াছে, কোনও মতেই তাহাকে অস্বীকার করা চলিবে না। ভাবিলাম, একবার আসুক তো রমণী। অন্তিম কিনা সে পরে দেখা যাইবে। আর কোথায় বা যাইবে? পালাইবার পথ রাখিলে তো। উদ্দাম প্রেমজালে আচ্ছন্ন করিয়া তাহাকে চিরদিনের জন্য বাঁধিয়া ফেলিব না? হায়, তখন কি জানিতাম এ অন্তিম শব্দের কী মর্মান্তিক অর্থ!

    আজ সেই রাত্রি! অনামিকার প্রতীক্ষাতেই জাগিয়া আছি। সে আসিবে। আজ আর স্বপনে নহে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অতিবাস্তবতায় আজ সে আবির্ভূতা হবে। তাই নিদ্রাদেবীকে আজকের মত ছুটি দিয়াছি।

    মধ্যরাত্রি পার হইয়াছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। দালানে রাখা বিশাল ঘড়িটায় টিকটিক শব্দ বড় স্পষ্ট শুনা যাইতেছে। সময় পার হইতেছে, কিন্তু ঘড়িটা বোধহয় আজ শুধু আমার হৃৎস্পন্দন গণনা করিবার ভার লইয়াছে। উদ্যানের পুষ্করিণীতে ছলাৎ করিয়া একবার মৃদু শব্দ হইল। আবার সব চুপচাপ। ঘড়িটা একভাবে চলিতেছে।

    এবার যেন শুনিতে পাইলাম, তাহারই ছন্দে আর এক ক্ষীণ শব্দ আমার কক্ষের দিকেই আসিতেছে। ক্ষীণ, বড় ক্ষীণ সে শব্দ। কিন্তু ক্রমে তা স্পষ্ট হইল। রমণীর নূপুরনিক্বণ! ছম্‌— ছম্‌— ছম্‌— ছম্‌—। অনামিকা আসিতেছে! আমার অধীর হৃদয় উদ্বেল হইয়া জানাইল, অনামিকা অবশেষে আসিয়াছে—! দুয়ারের অপর প্রান্তে আসিয়া সে শব্দ থামিল। আমি উন্মত্তের মত গিয়া দরজা খুলিলাম। তখনই হা—হা—হা—হা— করিয়া কে যেন অট্টহাস্য করিয়া উঠিল।

    হ্যাঁ, অনামিকা আসিয়াছে। সে হাসিতেছে। তাহার সম্পূর্ণ দশনপঙক্তি নিষ্কাশন করিয়া অনামিকা হাসিতেছে। সুদন্তীর দশনাবৃত করিবার কোনও উপায় নাই। দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াইয়া আছে স্বর্ণালঙ্কারশোভিত এক আপাদমস্তক নরকঙ্কাল—!

    ইক্‌! আপাত-প্রেম কাহিনীর অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সে আবার একবার শিউরে উঠে খাতা বন্ধ করে দিতে হল। বার বার তিনবার। গা শিরশির করছে। মেরুদণ্ডে ঘাম জমেছে মনে হল। লেপটা মাথার ওপর টেনে নিয়ে স্থির হয়ে আছি। নড়াচড়া করতেও ভয় লাগছে।

    কোথাও কোনও শব্দ নেই। কিন্তু ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিল, দরজার বাইরে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। দরজায় ছিটকিনি লাগান নেই। তবু সে ভেতরে আসেনি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে যেন অপেক্ষা করছে কখন আমি গিয়ে দরজা খুলি।

    কে এসেছে? অনামিকা! কেমন তার চেহারা? রক্তাক্ত ছিন্নমস্তার রূপ নাকি অস্থিসর্বস্ব কঙ্কালময় সে অবয়ব! আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তবু সে শুকনো গলা দিয়ে একটা চাপা গোঙানির মত আওয়াজ কেঁপে কেঁপে বেরোচ্ছে। বুঝতে পারছি রক্তশূন্য ঠোঁটদুটো আমার অসাড় হয়ে গেছে। আমি লেপটাকে শরীরের সঙ্গে আঁকড়ে ধরলাম। যদিও জানি অনর্গল দরজার পাল্লা একবার সরে গেলে সে প্রতিরোধ কোনও কাজে আসবে না।

    —ঠক্‌— ঠক্‌— ঠক্‌—

    দরজায় করাঘাতের শব্দ! অনামিকা— অনামিকা এসেছে! কোনও বায়বীয় অলীক অস্তিত্বে নয়। খটখটে কঙ্কালরূপে এসে দাঁড়িয়েছে দরজার বাইরে। কাঠের ওপর অস্থিসার আঙ্গুলের আঘাতে আবারও বেজে উঠল সেই অপার্থিব শব্দ— ঠক— ঠক— ঠক—!

    এক মুহূর্ত এই চিন্তাটা মস্তিষ্ক স্পর্শ করে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

    ***

    ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। শরীরে একটা ধূসর অবসন্নতা। হাত-পা কুঁকড়ে শক্ত হয়ে আছে। মানুষ মরে গেলে এমনই বোধ হয় হয়ত। কিন্তু না, দেখলাম এ যাত্রা বেঁচেই আছি। তবে ফাঁড়া কানের খুব পাশ দিয়েই গেছে। অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম নিশ্চই, তারপর যখন জ্ঞান ফিরেছে, অবসাদের সুষুপ্তি নেমে এসেছে। সেইভাবেই রাত কাবার হয়েছে।

    সচেতন হয়ে প্রথমেই যে চিন্তাটা মনে এল তা হল, সকাল হচ্ছে। দিনের আলোয় তো ভূতপ্রেত থাকে না। আশা করি দরজার বাইরে আর কেউ নেই। লেপ থেকে মুখ বার করে পিটপিট করে বন্ধ দরজাটা দেখছিলাম। হরিদা এসে ঢুকল। সকাল সকাল সারা বাড়ী ধুপধুনো দেয় হরিদা। ধুনুচি হাতে ঘরে ঢুকে জানলা খুলে ঘরের কোণায় কোণায় ধুনোর ধোঁয়া দিতে লাগল।

    এ কাজটা আমার ঘুমের মধ্যেই করে থাকে হরিদা। আজ অনেকটা আগে ঘুম ভেঙ্গেছে, তাই দেখা হয়ে গেল। তাকে দেখে বেশ ভাল লাগল, মনে হল এখন দিনের আলোয় ভূত দেখবার মত শক্তিও সঞ্চয় হয়েছে। হরিদা'কে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে কি তুমি আমার ঘরে এসেছিলে হরিদা। দরজায় নক করেছ?

    হরিদা একটু অবাক হয়ে বলল, কই না তো। কেন বল তো?

    —না কিছু না। বলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। গায়ে পুলওভারটা চাপাতে চাপাতে বললাম, একটু বেরোব হরিদা। আসছি এখনই। তুমি চানের জল গরম করে রাখ।

    ঠিক করেই নিয়েছিলাম, পত্রপাঠ আপদ বিদায় না করলে চলবে না। আগের দু'রাতে রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়েছিল। কিন্তু কালকের দরজায় শব্দের কোনও ব্যখ্যা নেই। ও খাতা আর এক রাত থাকলে মুশকিল হয়ে যাবে। টেবিল থেকে সেটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যেখানে সেখানে কাছাকাছি ফেলা চলবে না। কে জানে আবার যদি অনুকূলবাবু দেখে ফেলেন। আর তিনি না দেখলেও পাড়ায় পরোপকারীর অভাব নেই।

    একটা বাসে চড়ে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলাম। কাছাকাছি একটা পার্ক দেখে নেমেছি। নামতে গিয়ে হ্যান্ডেলে আটকে পুলওভারের ওপরের বোতামটা ছিঁড়ে পড়ে গেল। সুতোটা ঝুলছে। যাক গে, এখনি তো ফিরে যাব।

    পার্কে ঢুকে দেখি এই শীতের সকালেও বেশ কিছু স্বাস্থ্যসন্ধানী ছুটোছুটি করছেন। একটু কম লোকজন দেখে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। দেখি অন্যদিকে আর এক ছোকরা উদাস মুখে বসে আছে। মনে হল ব্যর্থ প্রেমিক কিংবা আমারই মত কোনও বিক্ষুব্ধ লেখক। সম্পাদক প্রত্যাখ্যাত হয়ে পার্কে বসে দম নিচ্ছে।

    খনিকক্ষণ বসেও দেখি তার যাবার কোনও লক্ষণ নেই। আমার আবার বেশী দেরী করার উপায় নেই, কলেজের তাড়া আছে। এদিকওদিক দেখে আস্তে করে খাতাটা বেঞ্চে রেখে উঠে পড়লাম।

    পার্কের গেটের কাছে পৌঁছেছি কি পেছন থেকে আওয়াজ পেলাম, ও মশাই আপনার বই পড়ে রইল যে—।

    আড়চোখে দেখে নিলাম, ঐ ছোকরাই খাতাটা নিয়ে আমাকে ডাকছে। এ একদিকে ভালোই হল। হস্তান্তর না হলে ও পাপ বিদেয় হবে না বুঝেছি। তাই ওকে কিছুতেই পরিচয় দেওয়া চলবে না। আমি যেন শুনতেই পাইনি এমন ভাব করে গতি বাড়িয়ে দিলাম। পার্কের বাইরে এসেও শুনতে পেলাম সে বলছে, আরে ও দাদা, এটা তো নিয়ে যান—।

    আমি ভ্রূক্ষেপ না করে উলটোদিকের একটা বাস আসছিল, তাতেই উঠে পড়লাম।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)