“কেকটা কোথায় রেখেছিস পলু?” উপরের ব্যালকনি থেকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল সুকন্যা।
নিচের বারান্দা থেকে মাথাটা একটু বাড়িয়ে উপরের দিকে মুখ করে পলু অর্থাৎ পৌলোমী বলল, “বিকাশের ঘরে টেবিলের উপর রাখা আছে, একটু দেখে নে।”
“উফ্ বাবা, এই পা নিয়ে আর উপর-নীচ করতে পারি না,” বলতে বলতে ভারী শরীরটা নিয়ে সুকন্যা হেলে-দুলে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।
“এত বলি চল সকালে আমার সঙ্গে হাঁটতে, নয়তো ব্যায়াম কর, যোগা কর, ওজন কমা— তা তুই তো কথা শুনবি না… এখন উঃ আঃ করলে হবে?” পাশ কাটিয়ে উলটো দিকে যেতে যেতে সুদীপ্তর সরস টিপ্পনি।
“তুই চুপ কর! কে আমার গুরুঠাকুর এলেন রে উপদেশ দিতে!” সিঁড়ির রেলিং ধরে এক-পা এক-পা করে নামতে নামতে সুকন্যা চেঁচিয়ে উঠল।
“তাহলে আর উঃ আঃ করছিস কেন? ক্যাটওয়াক করতে করতে নেমে যা…,” বলেই হাসতে হাসতে সুদীপ্ত গিয়ে ঢুকল নিজের ঘরে।
ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বিকাশের ঘর থেকে কেকটি নিয়ে সুকন্যা এসে ঢুকল ডাইনিং হল-এ, সেখানে তখন বিকাশ, অনুপম, বিপাশা আর রূপকথা মহাব্যস্ত ফুল-পাতা, বেলুন আর রঙিন কাগজ নিয়ে। দুপুরের আগেই পুরো ঘরটি সাজিয়ে ফেলতে হবে বিকেলের পার্টির জন্য, তারপর আবার নিজেদের তৈরি হতে হবে। কেকটি টেবিলের উপর রেখে, চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সুকন্যা বলল, “তোরা সবাই এখানে যে, তাহলে রান্নাঘর কি পলু একাই সামলাচ্ছে না কি?”
“ওখানে সুদীপ্ত গেছে তো পলুকে সাহায্য করতে, তন্ময় আর শ্রীপর্ণাও এখুনি বাজার থেকে চলে আসবে। ওরাও তো একটা একটা পদ রান্না করবে বলে গেছে,” কাগজ কাটতে কাটতেই জবাব দিল রূপকথা অর্থাৎ রুপু।
“সুদীপ্তকে তো উপরে ওর নিজের ঘরে যেতে দেখলাম, সঙ্গে আমাকে কত উপদেশ দিয়ে গেল। আর তোরাও পারিস! সকাল থেকে উঠে লেগে পড়েছে ঘর সাজাতে… চা-ও তো মনে হয় কেউ খাসনি?” ঘুরে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল সুকন্যা, “একা পলু কত করবে?”
পেছন থেকে অনুপম চেঁচিয়ে উঠল, “আমার জন্য এক কাপ পাঠাস।”
“আমারও…,” বিকাশও চিৎকার করল।
রান্নাঘরে এসে সুকন্যা দেখল, পৌলোমী একাই দশভূজা হয়ে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে, আর সন্ধ্যা তাকে হাতে হাতে সাহায্য করছে। একটা প্লাস্টিকের টুল টেনে নিয়ে বসতে বসতে সুকন্যা বলল, “তুই কি একাই সব রান্না করার পরিকল্পনা করেছিস না কি? এতজনের রান্না! এরপর কিন্তু শরীর খারাপ করবে…”
“আরে না না, তন্ময় আর শ্রীপর্ণা আজ চাটনি আর চিংড়ির মালাইকারিটা করবে বলে গেছে। আমি শুধু ডাল, এঁচোড়ের ডালনা, চিকেন আর পায়েসটা করব,” খুন্তি নাড়তে নাড়তেই পৌলোমী বলতে লাগল, “আর এতজন কোথায়? এই তো মোটে তেরো-চোদ্দো জন লোক। আমরা ন’জন, সন্ধ্যা, ঝর্ণা, রেনুকা, শিবু আর ডাক্তারবাবুকে আসতে বলা হয়েছে, এর কত বেশি লোকের রান্না আগে করেছি, এখন এটুকুই যেন কত চাপ মনে হয়।”
“বয়সটাও তো দেখতে হবে না কি! সবসময় কি একইরকম থাকে…”
“সে যাই হোক, আজ আমি রান্না করবই। বছরে এই একটা দিন সন্ধ্যার ছুটি। কী সন্ধ্যা তাই তো?”
“অন্যদিনও কি তুমি আমাকে একা ছাড়ো? প্রতিদিনই তো কিছু না কিছু করছই…,” সবজি কাটতে কাটতেই মাথাটি একটু তুলে হেসে বলল সন্ধ্যা।
“কিন্তু তুই আবার নীচে নেমে এলি কেন? উপর-নীচ করে এরপর তো ব্যথায় কষ্ট পাবি।”
“তোরা সবাই নীচে কাজকর্ম করছিস, হইচই করছিস, আমার উপরে একা একা ভালো লাগছে না।”
“ভালো করেছিস… এসেছিস যখন চিকেনটা ম্যারিনেট করে রাখ তো।”
“দাঁড়া আগে চা-টা বানাই, ও-ঘর থেকেও সব হাঁক-ডাক করছে।”
“ভালো কথা মনে করেছিস, আমার সময় হয়নি, সন্ধ্যাকেও সবজি কাটতে বসিয়ে দিয়েছি; কারও আর চা খাওয়া হয়নি আজ। মনেও নেই, আনন্দে তো সব মশগুল হয়ে আছে।”
“ও-ঘরে তো সব এমন তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে দশ-বারো বছরের বাচ্চা! চেয়ার-টেবিল থেকে পড়ে হাত-পা ভাঙলে আর এই বুড়ো হাড় জোড়া লাগবে?” পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল দু’বান্ধবীই।
আজ ১ বৈশাখ, 'অবসর'-এর জন্মদিন। তাই এত হাঁকডাক, হইচই, এত আনন্দ, এত উচ্ছ্বাস, পুরো 'অবসর' জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে একটি উৎসবের আবহ। আসলে ‘অবসর' একটি বাংলো-বাড়ি। দ্বিতল বাংলো বাড়িটিতে উপর-নীচ মিলিয়ে আছে মোট দশটি ঘর, উপরে সাতটি ও নীচে তিনটি। নীচের তিনটি ঘরের একটি গেস্টরুম ও বাকি দু’টির একটি বিকাশ ও একটি অনুপমের, বাকিরা সবাই উপরের ঘরগুলিতে। এর পাশাপাশি রান্নাঘর, খাবার ও সংলগ্ন বসার ঘর ও একটি গ্যারেজ ঘরও আছে নীচে। রান্না-বান্নার জন্য আছে সন্ধ্যা, ঘর ধোয়া-মোছা বাসন মাজার জন্য ঝর্ণা ও রেণুকা, বাগানে গাছে সার-জল দেওয়া ও কাটাই- ছাঁটাইয়ের জন্য আছে শিবেন অর্থাৎ শিবু। এছাড়া ডাঃ অরুণাভ মিশ্র মাসে একবার করে আসেন প্রত্যেকের রুটিন চেক-আপ করতে, যদি কোনো পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন হয় তবে একটি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির সঙ্গে যোগাযোগ করা আছে, তারা এসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়।
রূপকথা আর বিকাশ ছাড়া প্রত্যেকে স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকেই পরস্পরের বন্ধু। পরবর্তীকালে পড়াশোনা, কাজকর্ম, বিয়েশাদি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেলেও পরস্পরের প্রতি কোথাও একটি সূক্ষ্ম টান থেকে গেছিল। মাঝে মাঝে ফোনে যোগাযোগ ও কদাচিৎ দেখাসাক্ষাতে প্রায়ই অবসরকালীন বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা উঠে আসত। হাসি-ঠাট্টার মধ্যে দিয়েই একসময় প্রত্যেকে একই স্বপ্ন লালন করতে শুরু করে যে, সংসার ও পরিবারের প্রতি সব দায়-দায়িত্ব মিটিয়ে দিয়ে, যে যার সাধ্যমতো অবসরকালীন জমা পুঁজি বা নিজস্ব সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তুলবে 'অবসর’। বাকি জীবনটি তারা একসাথে বাঁচবে— নিজেদের জন্য আর পরস্পরের জন্য।
বন্ধুদের মধ্যে ডিভোর্সী ও নিঃসন্তান অনুপম একটি রাস্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বিকাশেরও একই কাহিনি, এদের কোনো পিছুটান ছিল না। পি.ডব্লিউ.ডি. ইঞ্জিনিয়ার সুদীপ্তর সঙ্গে তার স্ত্রীর কোনোদিনই বনিবনা হয়নি, কিন্তু সে নিজের দায়িত্বকে কখনও অস্বীকার করেনি। ঠিক ছিল ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে এবং অবসর গ্রহণের পর সে বাড়িটি স্ত্রীর নামে লিখে কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়ে এখানে চলে আসবে। সরকারি অফিসের বড়বাবু তন্ময় ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে স্ত্রীকে ছেলের দায়িত্বে রেখে সংসার থেকে ছুটি নেবে। অন্যদিকে ডাক বিভাগের কর্মী অবিবাহিতা রূপকথা সারাজীবন ভাইয়ের সংসারে থাকলেও ভাইপোর সংসারের বোঝা হতে আপত্তি ছিল। ছেলে উপযুক্ত হয়ে উঠলে ব্যবসার দায়িত্ব ছেলের হাতে দিয়ে দিতে পারলে ডিভোর্সী শ্রীপর্ণা ঝাড়া হাত-পা। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে অসুস্থ ও পঙ্গু স্বামীর সেবা করে, গানের স্কুল চালিয়ে সংসার টেনে পৌলোমী ক্লান্ত, সে অপেক্ষা করছিল মেয়ের বিয়ে হওয়ার। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া গৃহবধূ বিপাশা দীর্ঘকাল সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বীতশ্রদ্ধ, শেষ জীবন সেও বন্ধুদের সঙ্গেই কাটাতে চেয়েছিল। আর বাংলার অধ্যাপিকা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান অবিবাহিতা সুকন্যা বন্ধুদের কথায় হাতে স্বর্গ পেয়েছিল, ভবিষ্যৎ জীবন একা কাটাতে হবে না এই আনন্দেই সে ছিল আত্মহারা।
কিন্তু কাজটি এত সহজ নয়। তারা জানত পরিবার, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ— বাধা আসবে চারপাশ থেকে। এতজন নারী-পুরুষ, তারা যে-বয়সেরই হোক না কেন, শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্কের ভিত্তিতে একসঙ্গে থাকবে, এটি সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু। কিন্তু সব বাধাকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের লক্ষে অবিচল থেকে 'অবসর’-এর বাস্তব রূপ দিতে এরা ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে প্রথম সুযোগেই রূপকথা আর বিকাশও জুটেছিল এদের পরিকল্পনায়।
বেলা প্রায় সোয়া ন’টা বাজে, তন্ময় আর শ্রীপর্ণা হৈ-হৈ করতে করতে বড়ো বড়ো গলদা চিংড়ি, নারিকেল, কালাকাঁদ ও টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে এসে হাজির। বাজারের থলেটি সন্ধ্যার হাতে দিয়েই হাত-মুখ ধুয়ে সোজা চলে গেল খাবার টেবিলে, সেখানে বাকিরা অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। চা-প্রাতরাশ, টুকটাক গল্প খুনশুটিতে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার লেগে পড়ল যে যার কাজে।
“পলু পায়েস হয়ে গেছে? সুগার ফ্রি দিয়েছিস তো, না চিনি দিয়ে দিলি? তোর যা ভুলো মন…,” বিপাশার হঠাৎ মনে পড়াতে ছুটে রান্নাঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল।
“না না, আমার মনে আছে, সুকন্যা, তন্ময় আর অনুপমের চিনি খাওয়া বারণ। তাই আমি আলাদা করে না করে সবটাই সুগার ফ্রি দিয়ে করেছি। সবারই তো বয়স বাড়ছে, একটু নিয়ন্ত্রণ ভালো…”
“ভালো করেছিস, মেয়ে আজকাল খুব বুদ্ধিমতী হয়েছে…,” হাসতে হাসতে বলল বিপাশা।
হেসে ফেলল পৌলোমীও, সঙ্গে হাতের কাজ সারতে সারতেই বলল, “রূপকথা কী করছে রে?”
“কাগজ কাটছিল তো! কেন, কোনো দরকার আছে?”
“হ্যাঁ, একটু পাঠিয়ে দিস তো, পুডিং বানাবে বলছিল। আমার প্রায় হয়ে এল, একটা উনুন ফাঁকাই পড়ে আছে, এখন চাইলে বানিয়ে ফেলতে পারবে।”
“আচ্ছা, আমি গিয়ে বলছি…”
দুপুর দেড়টার মধ্যে যে যার কাজ শেষ করে স্নান, খাওয়াদাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিতে নিজের নিজের ঘরে চলে গেল। রোদ পড়ে এলে বিকেল বেলা সবাই সেজেগুজে এক এক করে এসে বসল সুন্দর করে সাজানো খাবার ও সংলগ্ন বসার ঘরে। চকচকে রঙিন টুপি পরে, বাঁশি বাজিয়ে, বেলুন ফাটিয়ে, অভ্র মেখে ও কেক কেটে বাচ্চাদের মতো মেতে উঠল 'অবসর’-এর জন্মদিন পালনে। এরপর সন্ধ্যেবেলা শ্যাম্পেনের বোতল খুলে শুরু হল পানাহারের আসর, ঠাণ্ডা পানীয় থেকে শুরু করে বিয়ার, রাম, স্কচ, হুইস্কি— যার যা পছন্দ সমস্ত পানীয়ই ছিল মজুদ। ততক্ষণে ডাঃ অরুণাভও চলে এসেছেন। শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে সীমিত পরিমাণে পান ও টুকটাক খাওয়াদাওয়া চলতে থাকল, সঙ্গে চলল নির্ভেজাল আড্ডা, গল্প, গান ও কবিতা পাঠ। সন্ধ্যা, ঝর্ণা, রেনুকা, শিবু তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে চলে গেছে নিজের নিজের বাড়িতে, আবার পরদিন সকালে তারা চলে আসবে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝে নিতে। ক্রমে রাত বাড়তে থাকলে, সবাই চলে এল খাবার টেবিলে। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ডাক্তারবাবুকেও বিদায় জানিয়ে আজকের দিনটি সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে আর অনাবিল আনন্দে ভাসতে ভাসতে যে যার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
কিন্তু পুরো দলটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পায়ে পায়ে রূপকথা চলে এল বাগানের বকুল গাছটির তলায়, বসে পড়ল বাঁধানো বেদিতে। প্রতিদিন শোয়ার আগে অন্তত একটি সিগারেট খাওয়া সুদীপ্তর অনেকদিনের অভ্যেস, ডাক্তারের অনেক নিষেধ সত্ত্বেও এই বদভ্যেস ছাড়তে পারেনি, সেইজন্য বেশ কিছুক্ষণ পর সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ চোখ পড়ল বাগানের বকুল গাছটির তলায়, আলো-আঁধারির জন্য একটু অস্পষ্ট হলেও ভালো করে তাকিয়ে চিনতে পারল রূপকথাকে, “ওখানে কী করছে রূপকথা একা একা এত রাতে?” ভাবতে না ভাবতেই তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সেও চলে এল বাগানে, চুপচাপ দাঁড়াল বকুল গাছের তলায়, ঠিক রূপকথার পিছনে, তখনও জ্বলন্ত সিগারেটটি হাতে ধরা।
আকস্মিকভাবে একটি কটু গন্ধ নাকে যেতেই সচকিত হয়ে উঠল রূপকথা, একটু ধাতস্থ হতে মনে হল, “এ তো সিগারেটের গন্ধ নয়, একটা পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে যেন!”
চেতনার গভীরে প্রথম ধাক্কাটা লাগতেই নিমেষের মধ্যে লাফিয়ে উঠল চেয়ার ছেড়ে, ফিরে এল স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে, “কোথায় 'অবসর’? কোথায় বকুল গাছের তলা?” সম্বিৎ ফিরতে মনে পড়ল, “সর্বনাশ! রান্নাঘরে ওভেনে তরকারি চাপিয়ে এসেছিলাম, নিশ্চয়ই পুড়ে গেছে!” ছুটে গিয়ে গ্যাস অফ করে দিল, “ইস্, পুরো রান্নাটা জ্বলে-পুড়ে শেষ, আর কিছু করার নেই!” বিরক্ত হয়ে উঠল নিজের উপরই, “মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য এসে বসেছিলাম খাবার ঘরের টেবিলে ফ্যানের হাওয়া খেতে, এর মধ্যেই কখন চোখটা লেগে গেছে বুঝতেই পারিনি!” বিষণ্ণ হয়ে গেল মন, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ঘণ্টার কাঁটা প্রায় ন'য়ের ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে, রাত যথেষ্ট হয়েছে, নতুন করে আবার রান্নার তোড়জোড় করার আর ইচ্ছেও নেই, মানসিকতাও নেই। ফ্রিজ থেকে দুধের বাটিটি বের করে গরম করে নিল, দুধ মেখে ভাত খেয়ে মুখ-হাত ধুয়ে সোজা চলে গেল বিছানায়। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে তলিয়ে গেল ঘুমের অতল গহ্বরে।
ক্রি ই ই ই ইং… ক্রি ই ই ই ইং… ক্রি ই ই ই ইং… ক্রি ই ই ই ইং…
মোবাইলের অ্যালার্মে ঘুমটা ভাঙতেই ঘড়িতে দেখল সোয়া চারটে বাজে, বাইরে হালকা অন্ধকার। উঠে পড়ল রূপকথা, বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আধঘণ্টার মধ্যে একেবারে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে নিল, ততক্ষণে বাইরেটাও অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রতিদিন মর্নিং ওয়াক করা তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস, ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে লিফটের পরিবর্তে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলা থেকে নেমে পা রাখল 'সমুদ্র নীল' অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তায়। পাঁচ মিনিট হেঁটে ডান দিকে বাঁক নিয়ে ঢুকে গেল পার্কের গেট দিয়ে। চারপাশ দিয়ে দু’চক্কর ঘুরে এসে বসল উত্তর দিকের বকুল গাছটির বাঁধানো বেদিতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুদীপ্তকে দেখল গেট দিয়ে ঢুকতে, কাছে এসে বলল, “আর কেউ আসেনি আজ?”
“না…”
“তুই একটু বস, আমি কয়েক পাক দিয়ে আসি…”
“আজ তোর এত দেরি?”
“হ্যাঁ রে, কখন যে অ্যালার্ম অফ করে ঘুমিয়ে গেছি, বুঝতেই পারিনি। টের পেতেই ছুটতে ছুটতে আসছি…,” বলেই দ্রুত পার্কের চারপাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কয়েক চক্কর দিয়ে মিনিট কুড়ি পর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বসে পড়ল বাঁধানো বেদিতে, চারিদিকে একবার দেখে নিয়ে বলল, “এখনও কেউ এল না! বাকিরা না এলেও অনুপম তো প্রতিদিন আসে, আজ কী হল ওর, শরীর খারাপ না কি? ফেরার সময় খোঁজ নিতে হবে…”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, এত দেরি তো কেউ করে না…”
“তোকে আজ এত বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন? আসা থেকে দেখছি এখানে ঠাঁয় বসে আছিস… কী হয়েছে রূপকথা? মন খারাপ?”
“না না, মন খারাপ হবে কেন? কিছু হয়নি আমার…”
“আমি তোকে বুঝতে পারি রূপকথা, তোর মন খারাপ হলে গতি হারিয়ে ফেলে তোর কথা, আর তখনই এমন দু-একটা শব্দে জবাব আসে। নিজের কাছে নিজে একা হতে তুই এসে বসিস এই বকুল গাছের তলায়…”
একটু চোখ তুলে তাকিয়েই চোখটি নামিয়ে নিল রূপকথা, “না রে, ঠিক মন খারাপ না… পুরোনো দিনগুলোর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। কাল আমি আবার ওই স্বপ্নটা দেখেছি, ঠিক যেন স্বপ্ন নয়, সব সত্যি… চোখের সামনে দিয়ে সিনেমার মতো চলে গেল, তাও আবার আধো তন্দ্রা অবস্থায়।”
“কোনটা?”
“আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ‘অবসর'… কত পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা… কেন বাস্তবে রূপ দিতে পারলাম না! এতই কি অবাস্তব ছিল?”
“হয়তো… ঠিক জানি না, সব স্বপ্নের তো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এটাও হয়তো তেমনই একটা…”
“কিন্তু আমি ভুলতে পারি না রে, বার বার মনে পড়ে…”
“দেখ আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা পরিবার, আলাদা আলাদা পরিবেশ থেকে এসেছি। প্রত্যেকের প্রকৃতি আলাদা, চিন্তাভাবনা আলাদা, পারিবারিক বাধ্যবাধকতা আছে, পিছুটান আছে। আমি ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছি, তুই ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিস, অনুপম বিকাশ বা সুকন্যারও পিছুটান ছিল না। কিন্তু একবার ভাব তো, পৌলোমী কী করে তার অসুস্থ-পঙ্গু স্বামীকে ছেড়ে আসত? শ্রীপর্ণা, বিপাশা বা তন্ময় এদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। হয়তো একসাথে এতজন থাকলে খুব তাড়াতাড়ি ঠোকাঠুকি লেগে যেত, সম্পর্কগুলোতে দূরত্ব চলে আসত, তার চেয়ে এই ভালো না! সবাই না পারলেও আমরা পাঁচজন শুধু একই কমপ্লেক্সে না একই অ্যাপার্টমেন্টে আছি, ইচ্ছে করলে দেখা করতে পারি, আড্ডা দিতে পারি। বাকিরা কাছাকাছি না থাকলেও যোগাযোগ তো নষ্ট হয়ে যায়নি, বরং আরও গাঢ় হয়েছে। দূরে থেকেও মনের সুতোয় বাঁধা আছি আমরা…”
“তা ঠিক, তখন হঠাৎ করে সুকন্যা একসঙ্গে ফ্ল্যাট কেনার আইডিয়াটা দিয়েছিল বলে এটা সম্ভব হয়েছে। এখানে না এলে আমাদের অনেককেই বিশেষত আমাকে তো বটেই, কোনো-না-কোনো বৃদ্ধাশ্রমে অবশ্যই যেতে হত, ভাইপোর সংসারের বোঝা আর আমি হতে পারতাম না। নিজের সম্মান রক্ষার্থেই আমাকে সরতে হত, অন্তত এখানে স্বাধীনভাবে তো আছি…”
“কী হত তা জানি না! তবে সংসারের নামে সারাজীবন যে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছি, তা থেকে মুক্তি পেয়েছি। হয়তো একা হাত পুড়িয়ে খেতে হয়, কখনও কখনও একা ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গতাও গ্রাস করে। তবে নিজেকে নিয়ে এবং তোদের সঙ্গে ভালো আছি আমি…”
“আমিও, বাবার বানানো বাড়ি হলেও সারাজীবন থেকেছি ভাইয়ের সংসারে, মুখে কেউ কিছু না বললেও নিজেকে মনে হত অযাচিত। প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারিনি, চোখ ফেটে জল এলেও তাকে গাল বেয়ে গড়াতে দিইনি, গিলতে হয়েছে নিজের কান্নাকে…”
“কিন্তু একটা কথা বল, তুই বিয়ে করলি না কেন?”
“ভাই স্কুলে পড়ত, বাবা-মাকে পর পর হারালাম। সব দায়িত্ব এসে পড়ল আমার কাঁধে, ভাইকে মানুষ করে তোলা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা তখন আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। কোনদিক দিয়ে সময় বয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। যখন নিজের দিকে তাকানোর সময় পেলাম, ততদিনে চুলে দেখা দিয়েছে দু-একটি রুপোলি রেখা, আর ইচ্ছে করেনি। যাকগে আমার কথা ছাড়, তোর কথা বল…”
“আমার তো ছিল একটা সংসার, তুই তো জানিস, আর পাঁচজনের মতো বাবা-মায়ের পছন্দে নির্দিষ্ট বয়সেই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু আমার জীবনসঙ্গিনী কখনো সঙ্গই দিল না আমাকে। সংসারের চাকা সচল রাখতে একটা টাকা উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই থেকে গেলাম। ভালোবাসার স্বপ্ন ক্রমেই চলে গেল দূর থেকে আরও দূরে…”
“চাকরি, পরিবার, দায়দায়িত্ব— সব মিলিয়ে নিজেদের ভালো লাগা, না লাগাকে কখনও গুরুত্বই দিলাম না। আমারও যে হাসতে, গল্প করতে, আড্ডা দিতে, ঘুরতে-ফিরতে, এমনকী এই বকুল গাছের তলায় এসে বসতে ভালো লাগে— বুঝিনি কখনও…”
“ঠিক, সারাজীবন সমস্ত দায়িত্বকে বোঝার মতো টেনেছি, ক্লান্ত লাগত খুব। তবে 'অবসর’-কে বাস্তব রূপ দিতে না পারলেও একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকার দরুণ ইচ্ছেমতো দেখা করে আড্ডা দিয়ে মন হালকা তো করতে পারি, পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে পারি, পরস্পরের খোঁজখবর নিতে পারি, সেটাই-বা কম কী?”
“ঠিকই বলেছিস, আর কত দুঃখকষ্ট ভোগ করতাম! এখন তো আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেছি, হাতে টিকিট নিয়ে বসে বসে শুধু অপেক্ষা, কার ট্রেন কখন আসবে…”
“ওভাবে ভাবিস না, যা চলে গেছে তা হয়তো আর ফিরবে না! কিন্তু বাকি যে-কটা দিন আছে তাতে চেষ্টা করব, না বাঁচা পুরো জীবনটাই বেঁচে নিতে, আর কোনো আফশোস না রাখতে…”
“সত্যিই, সম্ভব হবে কি সেটা?” দু-চোখ মেলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল রূপকথা সুদীপ্তর দিকে।
একটু ভেবে নিয়ে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে নিজের লোলচর্ম হাতটি সুদীপ্ত রাখল একইরকম আর একটি হাতে, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমরাই সম্ভব করব তাকে…”
ধীরে ধীরে রূপকথা তার মাথাটি রাখল সুদীপ্তর কাঁধে, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা জল…