পুকুরপাড় দিয়ে চলাচলের রাস্তার পাশে লাইন করে লাগানো ছিল নানারকম ফুলগাছ, যেমন--চাঁপা, কৃষ্ণচূড়া, ম্যাগনোলিয়া। চাঁপাফুল যখন ফুটত তার গন্ধে চারিদিক আমোদিত হয়ে যেত। এই পুকুরটি যাঁর ছিল, তিনি অত্যন্ত সুরুচিপূর্ণ, শৌখিন মানুষ ছিলেন। তাঁর বাড়িঘর, ঠাকুর আঙিনা, দুর্গামণ্ডপ সবই ছিল অতি সুন্দর। তিনি গ্রামসম্পর্কে ছিলেন আমাদের মামা। আমার মায়ের এক মাসির বিয়ে হয়েছিল আমাদের ওই উত্তর পাড়ায়।
বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছলাম শানপুকুর পাড়ের কৃষ্ণচূড়ার ছায়ান্ধকার তলায়। ঝরাপাতার ঘন আস্তরণের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে বাড়ি পৌঁছলাম। বাড়ি পৌঁছেই মনের পুলকে এঘর-ওঘর করতে লাগলাম। খুঁজতে লাগলাম ফেলে যাওয়া খেলার জিনিসগুলি। ছোটবেলার খেলার পালকি, পুতুলের চিহ্ন এখনও পড়ে আছে ঘরের খাটের তলায়, মাকড়সার জাল আর ধুলোয় আবৃত হয়ে। বাড়ির পিছনে জামগাছে টাঙানো বেওয়ারিশ দোলনাটাকে কালবৈশাখি ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে অন্য গাছের মগডালে আটকে দিয়েছে। ঘুরে ঘুরে সব দেখছি আর খালি বিষণ্ণ মনে একটাই ভাব উঠছিল, আমার এইসব প্রিয় জিনিসগুলি সব আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেল। এদের ফেলে আমি আজ দূরের বাসিন্দা।
পরদিন আমার আসার খবর পেয়ে সঙ্গীসাথিদের মধ্যে যে দু-একজন তখনও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়নি, তারা তাদের বাড়ির চৌহদ্দির আনাচকানাচ থেকে দেখছে আমাকে আর ছোটদের দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠাচ্ছে দেখা করার জন্যে। কারণ তাদের তো বিয়ে হয়নি এখনও। তাই তাদের যখন তখন বাড়ির বাইরে যাওয়া বা এ-পাড়া ও-পাড়া করা চলবে না। আমি তৈরি হলাম দেখা করতে যাবার জন্য। এখন তো আমার আর কোন অসুবিধা বা বাধানিষেধ নাই। বিবাহিত আমি এখন সমাজের ছাড়পত্র প্রাপ্ত, শাখা সিঁদুরের প্রতীক চিহ্ন এনে দিয়েছে সেই ছাড়পত্র। বাপের বাড়ির দেশে এখন আমার যত্র-তত্র ঘুরে বেড়ানোর কোন বাধানিষেধ নেই।
সকালবেলায় খাওয়াদাওয়া শেষে বের হলাম পাড়ার সাথিদের সাথে দেখা করতে। ছোটবেলা থেকে আমার একটি অভ্যেস ছিল কোনও পোড়ো বাড়ি, পুরোনো দিনের জিনিসপত্র দেখলে দাঁড়িয়ে সেগুলো দেখা। পুরনো বইপত্র দেখলে ঘাঁটতে ইচ্ছে করতো, উলটেপালটে দেখতাম। পুরনো দিনের ঘটনা শুনতাম মন দিয়ে। বহু পুরনো কোন কিছু দেখলেই কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবতাম, কেমন ছিল তখনকার দিনের মানুষজন, কেমনই বা ছিল তাদের পূর্ব ইতিহাস। কেমনই বা ছিল তাদের চালচলন, সামাজিকতা, নৈতিকতা, আচার অনুষ্ঠান। বর্তমান সময়েও টেলিভিশান বা খবরের কাগজে কোন আবিষ্কারের কাহিনী পড়লে বা পুরনো চিত্র দেখলে সে-বিষয় নিয়ে ভাবতে আমার খুব ভাল লাগে।
দেশের বাড়িতে আমাদের পাড়ায় দু’তিনটি বাড়ির পরেই ছিল একটি পোড়ো বাড়ি। এককালে খুব জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটিতে একটি বিরাট পরিবার ছিল। একবার মহামারির সময়ে অকালমৃত্যুর করাল গ্রাসে পরিবারের সবাই বিনষ্ট হয়ে যায়, বর্তমানে শুধু বাড়িটিই রয়ে গেছে পোড়ো বাড়ি হয়ে। বাড়িটির পুবের ভিটেতে কাঠ আর টিনের তৈরি ভগ্নপ্রায় একখানা ঘর তখনও ছিল। তবে এই বন্ধ ঘরে ছিল অসংখ্য চামচিকের বাসা। অন্য তিনদিকের তিনটি ঘর ক্ষয়ে যাওয়া ভিটে ঘাসে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সারা বাড়ি ছোট বড় নানারকম আগাছার জঙ্গলে ঢাকা পড়েছিল। এককালে রান্নাঘরের পাশে নিত্য ব্যবহারের পাতকুয়োটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার ফলে ক্রমশ আবর্জনা জমে ভরাট হয়ে গিয়েছিল। সেখানে নানারকম গাছপালার জন্ম হয়েছিল।
পাতকুয়োর কাছেই ছিল একটি বহু বছরের পুরোনো কাঁঠাল গাছ। কোন এক কালবৈশাখীর দাপটে বুড়ো গাছের কাণ্ডটি মাঝামাঝি জায়গায় ভেঙে উপরের অংশটা নীচে পড়েছিল। ভেঙে পড়া গাছের গোড়ার অংশটা পড়েই ছিল। ক্রমে উইপোকার কারিগরি দক্ষতায় একটি বেশ বড় সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল সেই গাছের মোটা গোড়াটিতে। একজন মানুষ অনায়াসে সেখানে ঢুকতে পারত।
আমার ভয়ডর চিরকালই একটু কম ছিল। আমি পাড়ার বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে গিয়েছিলাম এই পোড়ো বাড়ির উঠোনে। বাড়ির কোনাকুনি চলা সরু রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম সেই বাড়ি আর ভাবছিলাম কেন এমন হল! ছেলেবেলা থেকে মা-জেঠিমার মুখে শোনা একটি শোকাবহ ঘটনার চিহ্ন বহন করে দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়ি আর এই কাঁঠাল গাছের সুড়ঙ্গর মতো অংশটা।
বর্তমানে আমার সাতষষ্টি বছর বয়স। পুরনো অভ্যাসটি এখনও আছে। পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটির পূর্বদিকের দেউলপাড়ার বাসভবনের কাছেই এমনি একটি, কোন এককালের প্রাসাদোপম বাড়ির ধ্বংসস্তূপ আছে। প্রাতঃভ্রমণকালে আমার নজরে আসে। আমি প্রায়ই ঐ রাস্তায় ঘুরতে যেতাম এবং বাড়িটির সামনের রাস্তায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম আর ভাবতাম, এই বাড়িটিও এককালে প্রাণবন্ত ছিল, মানুষের আশ্রয় ছিল। সেই পরিত্যক্ত বাড়ির অতীত জানতে ইচ্ছে করে, কিন্তু জানার কোন উপায় নেই।
এই খণ্ডহরের বাইরের দিকে অর্থাৎ বর্তমান সর্বজনীন রাস্তার পাশটিতে আছে একটি পূজামণ্ডপের ধ্বংসস্তূপ, মাটির উপর ভেসে আছে বহু পুরনো দিনের পাতলা পাতলা ইটের গাঁথনি, যার অনেকটাই মাটির নীচে। অনেকখানি উঁচুতে বিশাল এলাকা নিয়ে পাতলা ইটের পুরোনো দিনের কারিগরিতে নির্মিত দীর্ঘ একসারি ঘর। দুটিমাত্র দরজা তাতে, খুপরি খুপরি চারটি জানলা, ভিত থেকে অনেক উঁচুতে। জানলাগুলির কাঠ উইয়ে খেয়ে শেষ করেছে, এখন ধুলোমাটি জমে সে জানলাপথ বন্ধ। সময়ের জীর্ণতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনের অংশের দেওয়াল ফুঁড়ে উপরে উঠে গেছে বিরাট এক বট।
আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম আর ভাবতাম। বটের বিস্তারিত শিকড় খণ্ডহরের ভাঙা অংশগুলোকে মায়ের মত আঁকড়ে ধরে রেখে যেন অতীতের চিহ্নটুকুকে বাঁচিয়ে রেখেছে পরম মমতায়। গ্রামবাসীদের মধ্যে ধর্মপ্রাণা বৃদ্ধাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও এই খণ্ডহরের পাশের পূজামণ্ডপের ভাঙা বেদির সামনে প্রতি সন্ধ্যায় একটি জ্বলন্ত ধূপকাঠি এবং কলার খোলায় করে প্রদীপ জ্বেলে রেখে যায়।
যাক সে-কথা। এখন ফিরে যাই বাংলাদেশে আমার বাপের বাড়ির পাড়ায়, যেখানে ছেড়ে এসেছিলাম পাড়া বেড়ানোর কথা।
আগেকার দিনে আমাদের গ্রামদেশে একএকম ছোট ছোট বাঘের আধিক্য ছিল। সেই বাঘকে দেশ-গাঁয়ে চলতি ভাষায় বলত ‘অ্যাখা বাঘ’। এদের গায়ে বেশি ডোরা ছিল না, তবে চাউনি ছিল অনেকটা বাঘের মত, আকৃতিতেও ছিল ছোট আকারের বাঘের মত। বাবার কাছে শুনেছি এই ‘বাঘাইল্যা’রা মিশ্র প্রজাতির জন্তু। লোকালয়ের কাছেই ছোটো ছোটো ঝোপের মধ্যে থাকত, অনেক সময় ঘরের পিছন দিয়ে, ঝোপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আনাগোনা করত। এরা সচরাচর কোনো ক্ষতি করত না, আমরাও এদের ভয় পেতাম না। তবে বাঘের মত দেখতে বলেই সাবধান হতে হত। কারণ এরা মাংসাশী ছিল, তাই সুযোগ পেলে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মাঝেমাঝে যে আক্রমণ করত না, সেটা বলা যায় না। দেশ-গাঁয়ে তখনকার দিনে নানাজাতের বন্যপ্রাণী ছিল, এরা তেমনই এক প্রজাতি।
সে-সব দিনে গ্রামে এখনকার মত টয়লেট ছিল না। বাংলা নামটা ইচ্ছে করেই লিখলাম না। ঝোপ-জঙ্গলের ঘেরার মাঝখানে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে তৈরি হত সেই ‘বাংলা টয়লেট’। মাটি খুঁড়ে বড় গর্ত করে, তার ওপর দুটি খেজুর গাছের মোটা মোটা লম্বা গুঁড়ি পেতে পা-দানি তৈরি করা হত। সেখানে ওঠার জন্য পাশে ও সামনে শক্ত বাঁশ পোঁতা থাকত, সেটা ধরেই বসতে হত, নামাওঠা করতে হত। আব্রুর জন্য চারপাশে কলাপাতার বাসনার বেড়া দেওয়া হত, তাছাড়া ঝোপঝাড়ের আড়াল তো ছিলই।
এখানে অনেক সময়ই ‘বাঘাইল্যা’দের খাপ পেতে বসে থাকতে দেখা যেত। ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য যে ব্যবস্থা হত, নিচু জায়গাতে ছোট গর্ত করে, সেখানে কোন আব্রু থাকত না। সেখানেই এরা বেশি আসত, বসে থাকত, সামনের পা-দুটো সামনে ছড়িয়ে, লেজটা পিছনে মাটিতে ছড়িয়ে বসত। মাঝে মাঝে লেজটা দিয়ে মাটিতে ঝাপটা দিত আর একদৃষ্টে চেয়ে থাকত বাচ্চাটির দিকে। আমরা এদের চোখের দিকে তাকাতাম না। শুনেছিলেম বাঘের চোখে চোখ পড়লে নাকি মানুষ আর নড়তে পারে না, আর সেই মুহূর্তে বাঘ তাকে আক্রমণ করে ধরে নিয়ে যায়।
অনেক সময় অসতর্ক মুহূর্তে এরা ছোটো বাচ্চার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখে নিয়ে পালাত। একবার আমার সঙ্গেই এ-রকম হতে যাচ্ছিল, আমি তখন দু-বছরের শিশু, আমার মেজদি চীৎকার করে লাঠি নিয়ে তেড়ে না গেলে হয়ত আমাকে তুলে নিয়ে যেত। পরে অবশ্য প্রকৃতির ডাকে মাঠে যাওয়ার এহেন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল সময়ের দাবীতে।
বড়দের কাছে শুনতাম, বর্ষার রাতে অনবরত বর্ষণে চতুর্দিক প্লাবিত হলে জঙ্গলের বড় বাঘ নাকি লোকালয়ে ঢুকে আসতো, বাড়িঘরের কাছাকাছি কোনো উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিত। বাঘের গায়ের গন্ধে তাঁরা টের পেতেন বাঘ ঢুকেছে গাঁয়ে। আমি আর দিদি কত বর্ষার রাতে জেগে শুয়ে বাঘের গন্ধ পাবার জন্য ঘন ঘন শ্বাস নিতাম, কিন্তু পেতাম না। বাঘের গন্ধ কেমন তা চেনার বয়সই হয়ত হয়নি তখনো।
মাঝেমধ্যে গ্রামে ঢুকে আসা বাঘের উৎপাত বন্ধ করার জন্য বাঘকে বন্দি করে ভয় দেখানোর দরকার ছিল। তাই বড়রা মিলে তৈরি করেছিলেন বাঘবন্দি করার খাঁচা। স্বল্প মোটা বাঁশের ছয়সাত ফুট দীর্ঘ টুকরো জুড়ে বানানো হত চারকোনা খাঁচা। সেই বেড়ার বাঁধন দেওয়া হত বেত দিয়ে। খাঁচার সামনের দিকটা খোলা থাকতো, দরজাটি খাঁচার ওপরদিকে বিশেষ কায়দায় আটকানো থাকত। খাঁচার ভিতরে রাখা ‘টোপ’টির লোভে বাঘ যেই গুটি গুটি পায়ে শিকারটি নিতে ভিতরে ঢুকত, সঙ্গে সঙ্গেই ওপরে আটকানো দরজাটি সশব্দে নীচে নেমে আসত। বাঘ বন্দি হয়ে পড়ত। এরপর লোকজন এসে বাইরে থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেই বাঘকে মেরে ফেলত। এই ব্যবস্থার ফলে বর্ষাকালে লোকালয়ে বাঘ ঢুকে আসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বন্দি হওয়ার ভয়ে এরা সচরাচর লোকালয়ে ঢুকে আসার সাহস পেত না।
এদিকে দইয়ের ভাঁড়গুলি পাখপাখালির খাদ্য হল। তারা মনের আনন্দে দইয়ের ভাঁড় নষ্ট করছে আর ভিতর থেকে দইওয়ালা হুস হুস করে সেগুলোকে তাড়াবার চেষ্টা করছে। একে তো খাঁচায় আটকে পড়েছে, কীভাবে বেরোবে সেই চিন্তা তার ওপরে এতটাকা লোকসান। লোকটি লোকজনকে ডাকার চেষ্টা করলেও কোন ফল হল না। কারণ বনের মধ্যে রাখা বাঘের খাঁচার কাছে শুধু শুধু কেউই আসে না। সে তো বিষম চিন্তায় কাঁদোকাঁদো, প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কাছেপিঠে কেউ নেই যে তাঁকে উদ্ধার করে।
এমন সময় আমার বাবা স্কুল থেকে ফিরছিলেন জঙ্গলের পাশের রাস্তা ধরে। সেটাই ছিল গ্রামে ঢোকার রাস্তা। বাবা তাকে দেখতে পেয়ে জানা কৌশলে বাইরে থেকে দরজাটি খুলে তাকে উদ্ধার করলেন। খাঁচা থেকে বেরিয়ে যেন তাঁর পুনর্জন্ম হল, সে বাবার পায়ে পড়ে গেল আর মুখে বলতে লাগল, ‘কত্তা আমায় বাঁচালেন, আমার জীবনখান ফিরাইয়া দিলেন। আস্ত দইয়ের ভাণ্ড একটা লইয়া যান।’
বাবার হাতে একভাণ্ড দই ধরিয়ে দিয়ে, বাঁকটি কাঁধে নিয়ে লোকটি দৌড় লাগাল। তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে আসছে, বনপথ অন্ধকার হয়ে যাবে। যে সময়ের কথা সে সময়ে গ্রামদেশে বাঘের উৎপাত খানিক বেড়েছিল, কারণ বন কেটে বসতি বাড়ছিল, বনে ওদের জায়গা আর খাবার দুইই কমে আসছিল, তাই লোকালয়ে ঢুকে আসছিল শিকারের আশায়। পরে গ্রামের সম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রাইফেল এসেছিল যা দিয়ে বাঘের আক্রমণ আর ডাকাতের আক্রমণ প্রতিহত করা যেত। এর ফলে বাঘের আক্রমণ কমে আসছিল।
তবে একবার দেশে বাঘের আক্রমণ নিয়ে এক বিরাট কাণ্ড ঘটেছিল সেকথা বেশ মনে আছে। একবার এক বিশাল বাঘ, মনে হয় দক্ষিণের সুন্দরবনের ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার হবে, হানা দিল গ্রামে। রোজ রাতে গ্রামের বাড়িঘরের চারপাশে ঘোরে, মাঝেমাঝে গোয়াল থেকে গরু ধরে নিয়ে যায়। বিশাল চেহারার হলুদ ডোরাকাটা আর লম্বা লেজওয়ালা সেই বিরাটাকৃতি বাঘকে দেশীয় ভাষায় নাম দিয়েছিল ‘ঢইর্যা বাঘ’। সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত। সে বাঘটি খুবই হিংস্র ছিল। গ্রামের মাতব্বর আর যুবকেরা সকলে মিলে ঠিক করল বাঘকে মারতেই হবে। না মারতে পারলে গ্রামের মানুষের জান যাবে, গোয়ালের গরু যাবে। সকলে মিলে একদিন বাঘ ধরার পরিকল্পনা করল। অনেকগুলি পাকাটির মশাল জ্বালিয়ে হাতে নিল। সঙ্গে নিল টিনের ক্যানেস্তারা। একদিকে আগুন হাতে সবাই ক্যানেস্তারা পিটিয়ে জঙ্গলখেদা করে বাঘকে কোনঠাসা করে বন্দুকের গুলিতে শেষ করে দেবে।
তখন গ্রামে দুতিন জনের কাছে বন্দুক এসে গেছে। বনের মধ্যে মশালের আগুন দেখে আর ক্যানেস্তারার শব্দ শুনে ভয়ে দিশেহারা হয়ে বাঘ দৌড়তে লাগলো এদিক ওদিকে। বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজে ভয় পেয়ে হঠাৎ দিল শূন্যে এক লাফ। যেন এক হলদে বিদ্যুৎ চমকে চলে গেল এদিক থেকে ওদিক। সবাই মরীয়া হয়ে বাঘের খোঁজে ছুটতে লাগলো, সঙ্গে ক্যানেস্তারা বেজেই চলেছে। কোথায় বাঘ! সবাই হতচকিত। এদিকে বাঘ একলাফে গিয়ে ঢুকেছে সেই পূর্বকথিত পোড়ো বাড়িতে, বিশাল বেড়ের উইয়ে খাওয়া কাঁঠাল গাছের গুঁড়ির ফোকরে। সবাই ভয়ে অস্থির, তাড়া খাওয়া হিংস্র বাঘকে তো ছাড়া যাবে না।
অতিকষ্টে বিশাল দেহটি নিয়ে সেই কোটরে খানিকক্ষণ বসে থেকে বাঘ বাধ্য হল বেরিয়ে আসতে। মাথাটি যেই না কোটর থেকে বের করেছে, লাফ দেবে ভাবছে, অমনি একজনের চোখে পড়তেই চীৎকার শুরু হল ওই যে বাঘ, ওই যে বাঘ। যাদের হাতে বন্দুক ছিল তারা বন্দুক তাক করতে না করতেই বাঘ দিল এক লম্বা লাফ। বাঁচার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ওপর দিকে লাফিয়ে উঠল। সকলের মাথার ওপর দিয়ে লাফ মেরে পালাতে চাইল।
তাক করা বন্দুকের পরপর দুটি গুলি ছুটে গিয়ে লাগলো বাঘের বুকে আর পেটে। বিশাল শব্দে রক্তাক্ত বাঘ নীচে মাটিতে পড়ে গেল। আর বেঁচে নেই সে। তবে এই বাঘের মৃত্যুর পর গ্রামে আর কোনদিন বাঘ ঢোকেনি। কারণ, তারপর আমরা বনে জঙ্গলে ঘুরেছি, খেলা করেছি, বাঘ থাকলে হয়ত কোনদিন কেউ না কেউ বাঘের শিকার হতই।
আবার ফিরি গ্রাম বেড়ানোর কথায়। পুকুরধারের সরু রাস্তা ধরে চলতে চলতে হাতের ডানদিকে পড়ল আমার ছেলেবেলার সেই ইস্কুল--হরচরণ মাষ্টারের পাঠশালাটি। এখন সেটির দৈন্যদশা। গ্রামে আরও শিক্ষিত মুসলমান যুবক শিক্ষক এসেছেন, তার পাঠশালায় এখন বেশির ভাগ ছাত্র পড়াশুনা করতে যায়। দেশের অবস্থাও বিশেষ শান্তিপূর্ণ নেই। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে গেছেন। ছেলেদের শহরের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, ভবিষ্যতে কাজ করে খাওয়ার মত শিক্ষা লাভের জন্য। দেশ যে ছাড়তেই হবে, হিন্দুরা যে পুর্বপুরুষের ভিটেয় আর বেশিদিন নিশ্চিন্তে বাস করতে পারবেন না তা বুঝে গেছেন। ছেলেদের বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে নেবার উপযুক্ত করে তুলতে চাইছেন। মেয়েদের যে কোনও উপায়ে পাত্রস্থ করে একরকম দায়মুক্ত হচ্ছেন। এরপরে কন্যাসন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের ভার হস্তান্তরিত হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে।
পাঠশালাটির পাশেই ছিল যে বিরাট তেঁতুল গাছটি, যার তলায় ছিল আমাদের খেলার জায়গা, তেঁতুল কুড়ানোর জায়গা, আজ সব নীরব। কোলাহল নেই। দেখতে দেখতে চলছি। মনে পড়ে গেল এক কোজাগরী পুর্ণিমার রাতে এই তেঁতুল গাছের নীচের ছায়ান্ধকারে ভূত দেখার কথা। এক কালের এত আনন্দের দিনগুলি কোথায় হারিয়ে গেল, কোথায় গেল সেই ছেলেবেলায় উদ্দীপনাময় দিনগুলি? পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পুকুরের এপার ওপার হওয়া, সাথিদের নিয়ে পলামুঞ্জি খেলা, আম কুড়নো, সব স্মৃতিগুলি ভিড় করে এল। মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল সব হারিয়ে গেল বলে। এদেশ আর আমার থাকবে না, এ গ্রামও আর আমার থাকবে না। আমার দেশ হবে অন্য কোথা অন্য কোনখানে, সে আভাস পেয়েছিলাম বিয়ের সময় মেজদার কথায়। তাঁর চিন্তাচ্ছন্ন মুখে পড়েছিলাম আগতপ্রায় দিনের কথা। তাছাড়া আমার স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিমের বাংলাদেশে, আমার এই পুবের বাংলাদেশে নয়। সেখানে তো যেতেই হবে শীঘ্রই। এটাই তো মেয়েদের অনিবার্য ভবিতব্য।
চলতে চলতে চলে এলাম এক সময়ের খেলার সাথি বিমলিদের বাড়ি। বাড়িটি আগে ছিল এক নিঃসন্তান ব্রাহ্মণ দম্পতির। সেটি পরে কিনেছিলেন মথুরা দাস, যাঁর প্রথম পক্ষের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা বিমলি ছিল আমার খেলার সাথি। বিমলির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আমার বিয়ের কিছুদিন আগে। প্রিয়সখি বিম-এর সাথে আর দেখা হবে না কোনদিন, ভেবেই মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল।
মনে পড়ে গেল বিমলিদের বাড়ির পূর্বেকার মালিক, নিঃসন্তান হাতুড়ে ডাক্তা্র, রাসবিহারীবাবুর কথা। কুমিল্লার লোক ছিলেন। এখানে বাসের সময় নিঃসন্তান ডাক্তারের পোষ্য ছিল একটি দুধেল গাই, একটি কুকুর আর দুটি নেউল (বেজি)। বেজিগুলো আর কুকুরটি সহবত শিখেছিল প্রভুর কাছ থেকে। বেজিগুলো দিনে বিশ্রাম করত লম্বা একটা লাউয়ের নলের মত দেখতে শুকনো খোলার মধ্যে। এদের খাদ্য ছিল দুধভাত। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত, ওদের ভয়ে সাপ দেখা যেত না আশপাশে। ওদের একটির নাম ছিল বাতাসী। দুপুরে খেয়ে উঠে ডাক্তারবাবু দুধভাতের সরা হাতে নিয়ে ডাকতেন ‘বাতাসী আয় আয়’ করে। ডাক শুনে ছুটে আসত দুটিতে। এসে সরা থেকে দুধভাত খেয়ে দুজনে ঢুকে যেত বারান্দায় ঝোলানো লাউয়ের খোলার বাসায়।
ডাক্তারবাবুর গরুটি ছিল সর্বভুক। সেবাড়িতে একটা হাজারি পেয়ারার গাছ ছিল, কিন্তু খেতে ছিল বিস্বাদ। পাখিতেও খেত না। পাকা পেয়ারায় গাছের তলা হলুদ হয়ে থাকত। গরুর একদিন পেয়ারা খাওয়ার সাধ হল, দড়ি ছিঁড়ে এসে সেই সব পড়ে থাকা পেয়ারা চেটেপুটে খেয়ে নিল। সেই খাওয়াই কাল হল, পেট ফুলে ঢোল হল, তখন পশুর ডাক্তার ছিল না, তিনদিন ভুগে সুন্দর দুধেল গরুটি চারদিনের দিন মারা গেল। ডাক্তারের ভেষজ ওষুধের মধ্যে ছিল, ডালিমের কুঁড়ি, রক্তজবার পাতার রস, সুপুরি গাছের কচি শেকড়, কুটীশ্বরের ছাল সেদ্ধ, নানা গাছের পাতা, মূল ইত্যাদি।
শুচিবাইগ্রস্ত ডাক্তারগিন্নি বাড়িটি পরিচ্ছন্ন রাখতেন, দরজার পাশে রাখতেন একতাল কাঁচা গোবর, ঘরের বাইরে এলেই গোবরে পা ঠেকিয়ে ঘরে ঢুকতে হত। তাঁর পোষ্য ছিল একপাল বেড়াল। সেগুলিও ছিল বেশ শাসনে। গিন্নি রান্না করে মাছ, ডিম, দুধ ইত্যাদি আর রান্না করা খাবার না ঢেকে রেখে বাইরে গেলে বিড়ালেরা সেগুলি স্পর্শও করত না, বরং সেগুলির চারদিক ঘিরে বসে সেই খাবার পাহারা দিত।
তাঁদের কুকুরটি ছিল আরও কাজের। রাতের খাওয়া মিটলে এঁটোকাটা বাসন নিয়ে শুচিবাই গিন্নি যেতেন বাড়ির পিছনের পুকুরে, বাসন ধুয়ে, গা-কাপড় ধুয়ে ঘরে ঢুকবেন। কুকুরটি হ্যারিকেনের হ্যান্ডেলটি মুখে করে ধরে তাঁর পিছন পিছন যেত পুকুর ঘাটে, গিন্নিমাকে পাহারা দিতে আর অন্ধকারে আলো ধরতে। এমন লক্ষীমন্ত একটি শান্তির সংসার কার অভিশাপে যে শেষ হয়ে গেল তাই ভাবছিলাম সেই বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ আর ম্যালেরিয়ায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে গেছিল। সেবারের অসুখে ডাক্তারগিন্নি মারা গেলেন, ডাক্তারের ভেষজ ওষুধে কোন কাজ হল না। ডাক্তারবাবু মনের বেদনায় সব বেচে দিয়ে আবার ফিরে গেলেন কুমিল্লায়, জন্মভূমিতে। আমাদের খেলার জায়গা ছিল তাঁদের শান্তির নীড়টি। ডাক্তারদম্পতি আমদের খেলায় উৎসাহ দিতেন, খুশি হতেন, আমরাও খুব আনন্দে খেলতাম সেখানে। আজ সবই অতীতের গর্ভে, বিলীন হয়ে গেছে সেই স্মৃতিমাখা মধুর পরিবেশটি।
এইসব দেখতে দেখতে বেশ কদিন কেটে গেল বাপের বাড়ির গ্রাম আমতলাতে। জামাইষষ্ঠীর দিন এগিয়ে এল। আমার শ্বশুরমশায়ের অনুমতি নিয়ে বাবা পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত জামাইকে ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণপত্র পাঠালেন। সব আয়োজন চলছে আমাদের বাড়িতে, আগের দিন জামাই আসার বদলে এল টেলিগ্রাম। ভগীরথ দশহরার দিন আয়োজিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে, নৈহাটির গঙ্গায় সাঁতার কেটে জ্বরে পড়েছেন। প্যারাটাইফয়েডে আক্রান্ত। রিপ্লাই টেলিগ্রামে জামাইয়ের কোন খবর না আসাতে মেজদা আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন নৈহাটির উদ্দেশ্যে।
সকালে রওনা হয়ে দুপুরে পৌঁছলাম ময়মনসিং শহরে। সেখানে আমার মেজদির বাড়িতে রাত্রিটুকু কাটিয়ে, পরদিন ভোরের ট্রেনে যাত্রা করলাম, পৌঁছলাম সিরাজগঞ্জের স্টিমারঘাটে। সেখান থেকে যেতে হবে মেঘনার ওপারে জগন্নাথ ঘাটে। সেখান থেকে আবার ট্রেনে চেপে যেতে হবে নৈহাটি। বেলা দশটায় জগন্নাথ ঘাটে পৌঁছে সেখান থেকে রানাঘাট লোকালে রওনা দিলাম নৈহাটির উদ্দেশ্যে। স্টিমারের উঁচুতলায় বসে দেখছিলাম মেঘনার জলরাশির উচ্ছ্বসিত সৌন্দর্য। পেছনে পড়ে রইল আজন্মের স্মৃতি বিজড়িত দেশ, মা-বাবা। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি ভাবছিলাম বসে বসে। আনমনে চিন্তা করতেই এল আবার ট্রেনে ওঠার সময়।
রানাঘাট থেকে রেলে চেপেছিলাম। গাড়ি চলছিল, আমি দেখছিলাম পালটে যাচ্ছে আমার দেখা দেশের শ্যামল, সবুজ রূপ। ইট, কাঠ, লোহালক্কড়ের দেশে ঢুকছি। লাইনের ধারে ধারে ঘেঁষাঘেষি করে তৈরি শ্রমিক আর গরীব মানুষদের বাসগৃহ। সেগুলির বাঁশের বা ইটের দেওয়াল। ঘরের চালে সারি সারি মাটির গেলাস বসানো, তাও আবার আধখানা করে।
মেজদাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওগুলি মাটির গেলাস নয়, ওগুলিকে বলে খোলা। আমার দেখা মাটির তৈরি টালির বদলে মাটির খোলা দিয়ে অন্যরকমভাবে ঘরের চালগুলি ছাওয়া। দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রিয় ছোটবোনটির ভবিষ্যৎ নিয়েই বোধ হয় চিন্তিত ছিল মেজদা, তাই সারা পথ ছিল নির্বাক, গম্ভীর, চিন্তামগ্ন। আমার সরল প্রশ্নে জোর করে মুখে হাসি এনে জবাব দিচ্ছিল আমার কথার। নিজের অজান্তে আমি ঢুকে চলেছিলাম এক নতুন জীবনে।
(ক্রমশ)