।। ১ ।।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুণ্য আবির্ভাবের পর দুশোবছর পার হতে চলেছে। দুশো বছর আগের একজন মানুষ তাঁর জীবনবোধের ব্যাপ্তিতে, তাঁর মানবিকতায় উদারতায়, তাঁর সংগ্রামী সাহসিকতায় আজও বঙ্গসমাজে একক হয়ে রয়েছেন। ইতিহাসের পটে এবং বর্তমানের জাগতিকতায় তাঁর ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করলে আজও এই নি:সঙ্গতা আমাদের শিহরিত এবং লজ্জিত করে। নিজেদের অগৌরবজনক মানসিক মলিনতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতা আমাদের প্রতিনিয়ত তাঁর একান্ত অযোগ্য দেশবাসীরূপে প্রতিপন্ন করে চলেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁকে স্মরণ করার অধিকারও কি আমাদের আর আছে?
কিন্তু বিলাপের লজ্জা গভীরতর, তাই নিজেদের সামান্যতা মনে রেখেই তাঁর জীবনচিত্রকে দূর থেকে দেখার এই প্রয়াস। দৈনন্দিন যাপনের বিদ্যাসাগরমশাইকে দেখার মধ্যে দিয়ে যদি একটু তাঁকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করা যায়। এই লেখায় তাঁর বিখ্যাত জীবনীগুলিকে পাশ কাটিয়ে প্রধানত দুটি স্মৃতিকথার শরণ নিচ্ছি। প্রথমটির রচয়িতা ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত পজিটিভিস্ট কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, দ্বিতীয়টির লেখক ঊনবিংশ শতাব্দীর আরেক নামকরা পণ্ডিত শিক্ষক-অধ্যাপক পূর্ণচন্দ্র দে উদ্ভটসাগর। দুজনেরই দুর্লভ সৌভাগ্য বিদ্যাসাগরের স্নেহধন্য হওয়ার সুযোগ লাভ। এঁরা বিদ্যাসাগরকে দেখেছেন পার্শ্ববর্তী থেকে, দিনানুদিনের কাজে-কর্মে, তাই এঁদের স্মৃতিকথার মধ্যে বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি যেন জীবনের উত্তাপসহ অনুভব করা যায়। প্রয়োজনে আরও দু একজনের স্মৃতিকথার সাহায্য নেব।
কৃষ্ণকমল বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সুবিখ্যাত ডাক্তার জনসনের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এই সাদৃশ্য অবশ্য শুধু ভাষা ব্যবহার প্রসঙ্গে।
‘যিনি লিখিবার সময় গমগমে Johnsonese ও Latinisims ছাড়া আর কিছুই লিখিতে পারিতেন না, তিনি কিন্তু সাধারণ কথাবার্তায় একটিও ল্যাটিন কথা ব্যবহার করিতেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সাধারণ কথাবার্তায় সংস্কৃত শব্দ আদৌ ব্যবহার করিতেন না। তাঁহার লেখা পড়িলে মনে হয় যে, যেন তিনি সংস্কৃত ভাষা ব্যতীত আর কিছুই জানেন না; কিন্তু লোকের সঙ্গে মজ্লিশে কথা কহিবার সময় এমনকি বাঙ্গালা slang শব্দ পর্য্যন্ত ব্যবহার করিতে কুন্ঠিত হইতেন না--। ফ্যাপাতূড়ো খাওয়া (to be confounded) ‘দহরম মহরম’, ‘বনিবনাও’, ‘বিধঘুটে’, ‘বাহবা লওয়া’-- এই রকমের ভাষা প্রায়ই তাঁহার মুখে শোনা যাইত।’অর্থাৎ সুগম্ভীর পণ্ডিতি ভাব নিয়ে বসে থাকার পাত্র তিনি ছিলেন না, মাটির কাছাকাছি মানুষজনের জন্য যেমন ছিল তাঁর দরদ, তেমনি তাঁদের ভাষাও তিনি আপনজনের মতো বলতেন। নিজের মঞ্চ উচ্চ করে তৈরি করার ব্যাপারে তাঁর অনীহা সুবিদিত। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই শেষজীবনে কার্মাটাঁড়ের সাঁওতালদের সঙ্গে আত্মীয়বৎ মেলামেশা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। ক্রমাগত, শিক্ষিত ভদ্র সমাজের দ্বিচারিতা, বিশ্বাসঘাতকতা, কদর্য ব্যবহার পেতে পেতে শেষের দিকে তিনি ক্রমশ নৈরাশ্যবাদী হয়ে পড়েছিলেন। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ও ইংরেজিজানা শিক্ষিতাভিমানী দুই শ্রেণীরই কূপমণ্ডুকতা, স্বার্থপরতা, অনুদারতা তাঁর কাছে এমনভাবে অনাবৃত হয়ে গিয়েছিল যে চারপাশের মানুষের ওপর আস্থা রাখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। একটি ঘটনার কথা কৃষ্ণকমল উল্লেখ করেছেন, একজন ইংরেজিপড়া তার্কিক বিধিবাবিবাহের বিপক্ষে যুক্তি স্থাপন করতে গিয়ে বলেছিলেন, পুরুষের থেকে স্ত্রীজাতির সংখ্যা অনেক বেশি, বিধবাদের বিয়ে দেওয়া হলে অনেক বিবাহযোগ্যা কুমারীর পাত্র জুটবে না — সেটা সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না। যাঁরা ভারতবর্ষের আদি অনাদিকাল ধরে কন্যাসন্তান হত্যা, কন্যাসন্তানের অনাদর — ফলত নানা রোগে মৃত্যু ইত্যাদি ইতিহাস জানেন তাঁদের সেই সব পরিসংখ্যানের সঙ্গে সে যুগে ব্যাপকহারে প্রসূতিমৃত্যুর হিসেবটিও ধরে নিতে বলি। এবার বিদ্যাসাগরের প্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যাক।
‘ছেলেপুলেকে আর যা করি আর না করি, ইংরাজি ত কখনও শেখাবো না, অসার ও ডেঁপো হবার এমন পথ আর নাই।’তুলনায় সাঁওতালদের তাঁর অনেক সরল ও অকপট মনে হতো। একটি গল্প তিনি প্রায়ই বলতেন। একবার একজন চতুর বাঙালি সাঁওতাল পরগণায় কিছু জমি কিনে, আশেপাশের পাঁচজনের জমি আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছিল। ফলে মামলা লেগে গেল। বাঙালিটি একজন বৃদ্ধ সাঁওতালকে শিখিয়ে পড়িয়ে মিথ্যে সাক্ষী দাঁড় করাল। সে যথাসময়ে বলবে, অমুক শিমূল গাছ থেকে সীমানার আরম্ভ।
‘মোকদ্দমার সময়ে যখন হাকিম জিজ্ঞাসা করিলেন, তখন সাঁওতাল প্রথমে মিথ্যা কথা বলিল — অমুক শিমূল গাছটা বটে, পরক্ষণেই আসল কথাটি আর চাপিয়া রাখিতে পারিল না; আপনা হইতে বলিয়া উঠিল, কিন্তু ঐ গাছটি বটে, বলিয়া আর একটি গাছ দেখাইয়া দিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই গল্পটি করিতেন আর হাসিতেন; বলিতেন, ‘দেখ ইহারা এখনও কেমন সাদাসিধে আছে; সত্যটা কোনও রকমেই গোপন রাখিতে পারে না’।অল্পবয়েসী অনুগামীদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন বিদ্যাসাগর। এই সম্বোধনে তাঁদের প্রতি স্নেহ ও আত্মীয়তাবোধ প্রগাঢ় ভাবে প্রকাশ পেত। পূর্ণচন্দ্র দে উদ্ভটসাগর এবং কৃষ্ণকমল দুজনেই তাঁর চটিজুতো পায়ে নক্ষত্রবেগে হাঁটার গল্প করেছেন। হেঁটে তিনি কখনো ক্লান্ত হতেন না। হেঁটে বীরসিংহ থেকে নিয়মিত কলকাতা আসতেন। এই দূরত্ব ছিল চল্লিশমাইল পথ, বলেছেন কৃষ্ণকমল। বিদ্যাসাগরের হাঁটা স্বভাবতই চারপাশের মানুষজন, জীবনকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা। তিনি কখনো আত্মবৃত্তে বন্দী থাকতে পারতেন না। কৃষ্ণকমলের কাছে একটি ঘটনা জেনেছি, বিদ্যাসাগরের নিজের বয়ানে, —
‘আমি একদিন বাড়ি যাবার সময় দুপুরের রোদে কিঞ্চিৎ বিশ্রামের জন্যে একটি খোড়োবাড়ীর বাহিরের রোয়াকে বসে আছি, এমন সময়ে বাড়ির ভেতর থেকে গুটি দুই তিন ছেলে নাচতে নাচতে আর গানের সুরে চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে এল। তাদের মুখে এই বুলি — আজ আমাদের ডাল হয়েছে, আজ আমাদের ডাল হয়েছে, আজ আমাদের ডাল হয়েছে। আমি ত দেখে শুনে অবাক্। ভাবলুম যে, এঁদের এত দুরবস্থা যে বছরের মধ্যে পালা পার্ব্বণের মত দু’এক দিন ডাল রান্না খেতে পায়। আর বোধ-হয় এমন অনেকেই আছে’। এই গল্প করিতে করিতে কখনও কখনও তাঁহার চক্ষুতে জল আসিত’।আরেকটি কাহিনী বলেছেন পূর্ণচন্দ্র দে। গিরীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বাড়ি থেকে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর আহ্বানে তাঁর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। বিদ্যাসাগরের ডাকটি খুব মধুর, আয়, পূর্ণ! আমার সঙ্গে আয়। কিছু উদ্ভট দিব’। অর্থাৎ উদ্ভট শ্লোক দেবেন — যা সংগ্রহ ছিল পূর্ণচন্দ্রের নেশা।
‘বিদ্যাসাগর মহাশয় নক্ষত্র-বেগে চলিতে লাগিলেন। আমি তাঁহার পশ্চাদ্ভাগে থাকিয়া একপ্রকার ছুটিতেছি বলিলেই হয়। তথাপি তাঁহাকে ধরিতে পারিতেছি না। তখন তিনি থামিয়া পড়িয়া হাসিতে হাসিতে আমাকে বলিলেন, ‘পেট ভ’রে খাস না কেন? গায়ে জোর হয় না কেন? তাড়াতাড়ি চলিতে অভ্যেস কর’। তখন তাঁহার বাটীর প্রায় নিকটেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি’।লক্ষণীয় বিখ্যাত মানুষটি নিজের হাতে পূর্ণচন্দ্রের জন্য রাবড়ির বাটি এনেছেন। বাড়ির মেয়েদের বা দাসদাসীদের আদেশ করেননি। এসব কাজ তাঁর কাছে মোটেও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তু ছিল না। ঘরের কাজ করলে মর্যাদাহানি হয় এই ধরনের সংস্কার বা বিশ্বাস তাঁর ছিল না। শ্রেণীসচেতন পিতৃতান্ত্রিক মানবজগতে এমন ব্যতিক্রমী মানুষ কালেভদ্রে দেখা যায়। তাঁর কাছে বিধবাবিবাহ প্রচলন, পুরুষের বহুবিবাহ নিরোধ আন্দোলন, স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ও বিস্তার, বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার দিশা দেখানো, অনুবাদ ও মৌলিক রচনার দ্বারা বাংলা গদ্যের বিশৃঙ্খলতা দূর করে সুষম গদ্যরীতি প্রচলনের পাশাপাশি একান্ত স্বাভাবিক ছিল নিজে হাতে রান্না করে প্রিয়জনদের খাওয়ানো। রন্ধন বিষয়ে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল সকলেই জানেন। খুব ভালো ‘মাংস’ রাঁধতেন, দশ-বারো রকমের অম্বলের রেসিপি তাঁর জানা ছিল। এই পুরুষসিংহের অন্তরে ছিল সুকোমল জননীসদৃশ মমতা। সে মমতা তাঁর চারপাশের মানুষদের প্রতি অবিরল বর্ষিত হোত। কল্যাণী দত্ত তাঁর ‘পিঞ্জরে বসিয়া’ গ্রন্থে নিজের পিসিমা শিবমোহিনীর কাহিনী লিখেছেন। বাল্যবিধবা শিবমোহিনী বিমাতার সংসারে নির্যাতিত হতেন। গ্রামের প্রতিবেশী সহমর্মী বান্ধবী হেমাঙ্গিনীর পরিবারের সঙ্গে পিতার সম্মতিতে তিনি কলকাতা আসেন। তখন বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবাদের বিয়ে নিয়ে প্রবল হৈ চৈ হচ্ছে। একদিন হেমাঙ্গিনী আর শিবমোহিনী বিদ্যাসাগরের বাড়ির বাইরের রোয়াকে এসে বসে রইলেন। বাজার থেকে ফিরে বিদ্যাসাগর তাঁদের দেখে বলে ওঠেন, ‘ওরে দেখরে, আজ আবার কারা দুটো মেয়েকে বসিয়ে রেখে চলে গেছে’।বিদ্যাসাগর তাঁকে কলে হাতমুখ ধুয়ে আসতে বললেন। প্রথমে এল জলখাবার — তারপর এল ভোজনের আদেশ। ‘আমি ‘যে আজ্ঞা’ বলিলাম। নচেৎ বাপান্ত না করিয়া তিনি ছাড়িতেন না। আহারের সময় উপস্থিত হইল। আহার করিতে বসিয়া বার আনা খাইয়াছি, এমন সময়ে তিনি স্বয়ং একটা শ্বেত-পাথরের বাটীতে অনেকটা রাবড়ী আনিয়া উপস্থিত হইলেন। পাতে যে সব তরকারী দেওয়া হইয়াছিল, তাহা সমস্ত খাইতে পারি নাই। তিনি কৌশল করিয়া সমস্তই খাওয়াইলেন। পরে রাবড়ী খাইতে দিলেন। ... বিদ্যাসাগর মহাশয়! কোথায় আপনি চলিয়া গেলেন! আপনি একটা স্বয়ং দেবতা।‘
তার মানে এরকম প্রায়ই ঘটত। নিজেরা সমাজ ভয়ে না এগোলেও পরিবারের অসহায় বিধবা বালিকাদের গৃহস্থরা বিদ্যাসাগরের বাড়িতে রেখে যেত। অনেকটা যেন অবাঞ্ছিত বেড়ালছানা পার করার মতো। নিজেরা দায়দায়িত্ব না নিয়ে অভিভাবকরা ভাবতেন, যদি মেয়েটা বিদ্যাসাগরের কৃপায় ঘরবর পেয়ে যায়, তো পাকনা, আমাদের তো বদনাম হচ্ছে না। ঋণগ্রস্ত হয়ে নিজের উদ্যোগে যাঁদের বিদ্যাসাগর বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের অনেকসময় বররা ভয় দেখাতেন যে বিদ্যাসাগর আরো টাকা না দিলে তাঁরা স্ত্রীকে ত্যাগ করবেন। অনেকেই একাধিক পত্নী বর্তমানে, তা লুকিয়ে বিদ্যাসাগরকে ঠকিয়ে তাঁর দেওয়া যৌতুক নিয়ে বিধবাবিবাহ করতেন। শিবমোহিনীকে বিদ্যাসাগর নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন। পরে নিজে দাঁড়িয়ে সুপাত্র চণ্ডীচরণ সিংহের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। কী কী দিয়েছিলেন তিনি পালিতা কন্যাকে? কল্যাণী দত্তের দেওয়া তালিকা থেকে এইরকম অজস্র বিবাহে তাঁর ব্যয়ের একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
‘মোটা অমৃতিপাকের বালা ও গলার হার ছাড়া ও খাগড়ার সর্বসুন্দরী ঘড়া, কামরাঙা বাটি, মেদিনীপুরের বেলের গড়নের ক্ষীর খাবার বাটি, যাজপুরী কাঁসি, নবাসনের থালা, পানের বাটা, ভালো যাঁতি দিয়েছিলেন।
এছাড়া বিবাহের অনুষ্ঠান খাওয়াদাওয়া কাপড়চোপড়ের খরচ তো ছিলই। এখানে লক্ষ করার মতো বিদ্যাসাগরের স্বভাবের অপূর্ব নান্দনিকতা। তিনি নিজে খুব সাধারণভাবে থাকতেন কিন্তু গৃহস্থালীর জিনিসপত্রের ছিলেন উঁচু মাপের সমঝদার। বাসনের বর্ণনায় তা আমরা বুঝতে পারি। কোন জায়গার কোন তৈজসপত্র বা খাদ্যবস্তু ভালো তা তিনি বেশ খোঁজখবর রাখতেন।
শিবমোহিনী বিদ্যাসাগরের কাছে সংসারের প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি শেখেন। ‘বৈঠকখানার সংলগ্ন ঘরে দেরাজে ও তক্তপোশের তলায় বিদ্যাসাগর নানারকম ফল, মিষ্টি, নাড়ু ইত্যাদি রাখতেন। তাঁর কাছে সমাজের প্রধান তেমন কেউ এলে তিনি নিজের হাতে বঁটিতে ফল কেটে ও মিষ্টি সাজিয়ে খেতে দিতেন। যাঁতিতে সুপুরি কেটে টাটকা পান সেজে দিতেন’। যাতে শুষ্ক হয়ে খিচ না ধরে তার জন্য চুনের ভাঁড়ে রোজ সামান্য জল দিতে তাঁর কখনো ভুল হত না। অপচয় তিনি সহ্য করতে পারতেন না।
শিবমোহিনী তাঁর কাছে আরো শিখেছিলেন, হাঁড়ির তলায় বিড়ে রাখা, সন্দেশের হাঁড়ির মুখে পাতলা ন্যাকড়া বেঁধে খুরো বসিয়ে জলভরা কাঁসির ওপর মিষ্টি রাখা, যাতে পিঁপড়ে না ধরে, গন্ধ না হয়ে যায়। কী জন্য বকুনি খেয়েছিলেন শিবমোহিনী? রোয়াক ধুয়ে ঝাঁটা ফেলে রেখেছিলেন বলে। কাঠির ঝাঁটা জলঝাড়া দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় তবে পরিচ্ছন্ন থাকে -- শিখিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। তাঁর বসার ঘরে কলম ও দোয়াতদান ঝক্ঝক্ করত, খাম কাগজ সব তিনি নিজে গুছিয়ে রাখতেন। তাঁর লাইব্রেরির কথা সবাই জানে। প্রতিটি বই সযত্নে বাঁধানো —দোক্তাপাতা ও নিমপাতা দেওয়া, যাতে পোকা না ধরে।
কোথাও বেড়াতে গেলে আত্মীয়বন্ধুদের জন্য গাঁটরি বেঁধে কাপড়, ঝোড়া ভরে মিঠাই, কাঁচের চুড়ি, খেলনা আর নানারকম পেতল কাঁসা পাথরের বাসন আনতেন বিদ্যাসাগর। তারপর সস্নেহে সবাইকে বিলিয়ে দিতেন। রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁর আত্মস্মৃতিতে এমন একটি অভিযানে তাঁর সঙ্গী থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। কাশীতে গিয়ে চুড়ি খেলনা কিনতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। পরদিন ট্রেন, মনে পড়ল রাতে। তখনি যাওয়া চাই কিনতে — না নিলে চলবে কেমন করে! আমাদের মনে পড়বে বালক অবস্থায় সামান্য জলপানির (স্কলারশিপ) টাকা থেকে সংস্কৃত কলেজের গরিব কর্মচারীদের তিনি কাপড় কিনে দিতেন। নিজে সারাজীবন পরেছেন মোটা কাপড়জামা, তালতলার চটি — দান করতেন রাজার মতো।
তাঁর কাপড় চেনার দক্ষতার কথা উল্লেখ করেছেন পূর্ণচন্দ্র। জোড়াসাঁকোর ন্যায়রত্ন কোম্পানীর দোকানে বিদ্যাসাগর কাপড়-চোপড় কিনতেন। দুর্গা পুজোর আগে পূর্ণচন্দ্র আর তাঁর শ্বশুর সেই দোকানে গিয়ে দেখেন স্তূপাকার কাপড় থেকে তিনি কাপড় বাছাই করছেন। পাশাপাশি একটি অপরিচিত গরিব কৃষকের বৌ-এর জন্য কাপড় কিনতে এসে দাম শুনে পিছিয়ে যাওয়া দেখে করুণাপরবশ হয়ে নিজেই তাকে কাপড়টি কিনে বলছেন, ‘এই কাপড়খানি তোর বৌকে দিলাম’। দুই বড় গাঁটরি কাপড় কিনে পুজোর বার্ষিক দেওয়ার জন্য কিনলেন — আবার পূর্ণচন্দ্রের শ্বশুরের অনুরোধে তাঁর জন্য কাপড় বেছেও দিলেন। যেখানে থাকবেন সকলকে ভালোবেসে — কাছে টেনে একটি অপূর্ব জগৎ তৈরি করতে পারতেন। তামাক খেতে ভালোবাসতেন, একথা সবাই বলেছেন। তবে অভিজাত সুলভ আলবোলা সট্কা নয়, তিনি ব্যবহার করতেন থেলোহুঁকো। হুঁকো হাতে করে জোড়াসাঁকোর দোকানে তিনি জমিয়ে বসে কাপড় কিনছেন, আড্ডাও দিচ্ছেন — এই ছবিটি ভোলা যায় না। পূর্ণচন্দ্রের শ্বশুর তাঁকে দেখে বলেছিলেন, ‘অদ্য সাক্ষাৎ সরস্বতী দর্শন করিয়া জীবন সার্থক করিলাম’। বিদ্যাসাগর সপাটে উত্তর দিলেন, ‘এ যে বাবা-সরস্বতী হে!’ সহজাত রসবোধ তাঁর ব্যক্তিত্বকে আরো অসামান্য করে তুলত। পরবর্তী পরিচ্ছেদে এই রসবোধের কিছু পরিচয় নেবার চেষ্টা করব।
।। ২ ।।
কৃষ্ণকমল বিদ্যাসাগরের রসবোধের অনন্যতা স্মরণ করে বলেছেন, ‘এই রসিকতা সে কালের ঈশ্বরগুপ্ত বা গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যের মত গ্রাম্যতাদোষে দূষিত নহে, ইহা ভদ্রলোকের, সুসভ্য সমাজের যোগ্য। ... এরূপ উচ্চ অঙ্গের রসিকতা বাঙ্গালা ভাষায় অতি অল্পই আছে।’ ‘ব্রজবিলাস’, ‘রত্নপরীক্ষা’, ‘কস্যচিত ভাইপোস্য’ গ্রন্থগুলিতে কৃষ্ণকমল ভলতেয়ারের রসবোধের অনুরণন শুনেছেন। তাঁর মনে হয়েছে বাঙালি পাঠক এই রসবোধের কদর করেনি। ‘যদি য়ুরোপে হইত, তাহা হইলে এ প্রকারের গ্রন্থপাঠ করিয়া এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত একটা হাস্যপরিহাসের তরঙ্গ বহিয়া যাইত, এবং বিদ্যাসাগরের নাম এক্ষণে বিদ্যাধতার জন্য যে প্রকার উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছে, রসিকতার জন্যও তদ্রূপ উচ্চস্থান অধিকার করিত, সন্দেহ নাই।’
শুধু লেখায় নয়, বলাবাহুল্য কথাবার্তায় এই রসবোধ উচ্ছলিত হত। বাঙালি বিদ্যাসাগর ও শরৎচন্দ্রের অশ্রুজল যত স্মরণ করে, রসবোধকে ততোটা সমাদর করতে পারেনি। এতে ক্ষতি বাঙালিরই — তাঁদের ব্যক্তিত্বকে খণ্ডিত করে জেনে আমাদের লাভ নেই। কৃষ্ণকমল দু একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
বেথুন স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন ফিরিঙ্গী — স্কুলের একজন পণ্ডিতের ওপর তাঁর অকারণ আক্রোশ ছিল। তাঁকে পদচ্যুত করার জন্য তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তদন্তের ভার ছিল বিদ্যাসাগরের ওপর — তিনি পণ্ডিতের দোষ কিছুই পেলেন না। কমিটি মেম্বাররা পড়লেন বিপদে, তাঁরাও শ্বেতাঙ্গ, প্রধানা শিক্ষয়িত্রীও তাই। পণ্ডিতকে একেবারে ছেড়ে দিলে — হেড্ মিস্ট্রেসকে অপমান করার মতো ব্যাপার দাঁড়ায়। তাঁরা বলাবলি করলেন ‘তবে দুএকমাসের জন্য পণ্ডিতকে সাসপেন্ড করা যাক।’ বিদ্যাসাগর যেন আপাত উদাসীন ভাবে বললেন, ‘Yes do it, if you think some sacrifice is necessary to appease her.’ দেবী কিছু বলিদান না হলে যখন সন্তুষ্ট হবেন না — ভাবটা এমন। সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। পণ্ডিতও বেঁচে গেলেন।
একবার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সভা গবর্নমেন্টের কাছে কোনও এক বিষয়ে দরখাস্ত করে বিলক্ষণ অপমানিত হয়। বিদ্যাসাগর তাদের বিমর্ষভাব দেখে ফিরে এসে বললেন, ‘ওহে, আজকে political world-এ যে বড়ই gloom দেখে এলুম।’ এই gloom কথাটা তিনি এমন মুখভঙ্গী করে বললেন যারা শুনছেন সবাই হেসে ফেলল।
‘দুরাবস্থা’ এই ভুল শব্দটি নিয়ে তাঁর মজা করার কথা আমরা সকলেই জানি। এক পণ্ডিত এসে তাঁকে বলে ‘আমার বড়ই দুরাবস্থা।’ বিদ্যাসাগরের উত্তর ছিল ‘সে ত আকারেই বুঝতে পারছি।’ স্বভাবতই ‘আকার’ শব্দটি এখানে দ্ব্যর্থব্যঞ্জক। যদিও পণ্ডিতটির রোজগারের একটা ব্যবস্থা করতে তাঁর ভুল হয়নি।
মাঝে মাঝে তিনি বোলপুর-রায়পুরে ধনী জমিদার সিংহমশাইদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। তাঁদের বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী বলে একজন রাঁধুনী ব্রাহ্মণ ছিল। সিংহবাবু ও তাঁর ছেলেরা পরিহাস করে তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ বলে ডাকতেন। একদিন বিদ্যাসাগর তাঁদের অতিথি হওয়াতে, কর্তামশাই ছেলেদের সাবধান করে দিলেন আজ যেন কিছুতেই রাঁধুনীকে ‘বিদ্যাসাগর’ বলে ডাকা না হয়। তবু প্রমাদ ঘটেই গেল। ছেলেরা যেই ডেকে বলেছে, ‘বিদ্যাসাগর, ঝোল দিয়ে যাও’ অমনি ব্যাপারটা কী বুঝতে বিদ্যাসাগরমশায় রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বসলেন। তখন তাঁকে সব খুলে বলতেই হল। বিদ্যাসাগর রাগও করলেন না, কিছু মনেও করলেন না। বরং সেই রাঁধুনীকে বললেন, ‘ভাই ঈশ্বর। তুমি আজ থেকে আমার ‘মিতে’ হলে। কাল তুমি রেঁধোনা — আমি নিজে রেঁধে সবাইকে খাওয়াবো। কাল তোমার ছুটি।’ এরপর যখনই তিনি ঐ বাড়ি গিয়েছেন তখনি ‘মিতে’র খোঁজ নিয়েছেন। এই গল্পটি আমাদের স্তব্ধ করে রাখে। শুধু হাসি নয়, এর মধ্যে সহমর্মিতা সমবেদনার অশ্রু টলমল করছে। সেই সঙ্গে সিংহদের নিজের ধরনে উত্তরও তিনি দিয়ে দিলেন। চৈতন্যদেব নাকি মানুষের প্রতি অবজ্ঞা বা অপমানসূচক ব্যবহার সহ্য করতে পারতেন না। কৃষ্ণকমলের মতে বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন। নাস্তিক হোন বা না হোন ‘ঈশ্বর’ নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নি:সন্দেহে মাথা ঘামাতেন না। কিন্তু মানুষের প্রতি অবজ্ঞা বা অপমানের প্রশ্নে দুই যুগের দুই বিখ্যাত বাঙালির সমপ্রাণতা লক্ষ না করে উপায় নেই।
পরিশেষে তাঁর লেখায় শ্লেষাত্মক কৌতুক কীভাবে খরশান হয়ে উঠত তার ছোটো একটু নিদর্শন হিসেবে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিতে চাই। প্রথমটি ‘ব্রজবিলাস’ থেকে। বিধবা বিবাহের বিরোধী ব্রজনাথ বিদ্যারত্নকে উদ্দেশ্য করে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে লেখা বিদ্যাসাগরের উত্তর।
ক) এই প্রশংসনীয় দেশের অতি প্রশংসনীয় সাধুসমাজের অভিমত, নিরতিশয় প্রশংসনীয়, নির্মল, সনাতন ধর্মের অপার মহিমা!!! বোধ করি, এমন নিরেট, টনটনিয়া, নিখিরকিচ ধর্ম ভূমণ্ডলে আর নাই। ইঁহার ক্ষমাগুণ ও হজমশক্তি অতি অদ্ভুত। ইনি অপেয়মান, অভক্ষ্যভক্ষণ, অগম্যগমন প্রভৃতি অনায়াসে ক্ষমা করিতেছেন হজম করিতেছেন। এইরূপ অদ্ভুত ক্ষমতাশালী হইয়াও কি কারণে ঠিক বলিতে পারিনা, কেবল একটি অকিঞ্চিৎকর বিষয়ে, অর্থাৎ বিধবাবিবাহে, ইনি কিঞ্চিৎ অংশে দুর্বলতা ও অক্ষমতা দেখাইতেছেন। ইহাতে কেহ কেহ বলিতে পারেন, সাধুসমাজের অভিমত নির্মল সনাতন ধর্ম লোক ভাল, তার সন্দেহ নাই; কিন্তু তিনি বড় পক্ষপাতী; পুরুষজাতির উপর, তিনি যত সদয়, স্ত্রীজাতির উপর, তিনি তত সদয় নহেন। আমার বিবেচনায় কিন্তু, তাঁহার উপর, এ অপবাদ প্রবর্তিত হইতে পারেনা। কারণ, তিনি স্ত্রীজাতির উপরেও বেয়াড়া সদয়। দিব্য চক্ষে ঘর ঘর দেখিয়ে লও, তিনি স্ত্রীজাতির ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা, বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন প্রভৃতি, অকাতরে, বিনা ওজরে, ক্ষমা করিতেছেন, হজম করিতেছেন। তবে, তাহাদের পুনর্বার বিবাহে যে যৎকিঞ্চিৎ গোলযোগ করিতেছেন, তাহা, ধরাধরি করিতে গেলে, একপ্রকার দোষের কথা বটে।’দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি আরো মারাত্মক। এটি তাঁর ‘বহুবিবাহ’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে। হিন্দু পুরুষের বহু বিবাহ রোধ করার জন্য তাঁর প্রাণপণ চেষ্টা তখন বিফল হলেও বিংশশতাব্দীর মধ্যভাগে এসে এই বিষয়ে আইন পাস হয়েছিল। বিদ্যাসাগরমশাই যে সময়ের থেকে বহু অগ্রবর্তী ছিলেন তা না বললেও চলে। এই বিষয়ে তবু একশোবছর পরে তাঁর দেখানো পথে পদক্ষেপ করা সম্ভব হয়েছে। বহুবিবাহের বিপক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে বিদ্যাসাগর স্বভাবতই কৌলীন্যপ্রথাকে আক্রমণ করেছেন। এই কদর্য প্রথা যে বঙ্গসমাজে কীভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, চরিত্রভ্রষ্টতা, অসদাচরণ, অর্থলালসা বাড়িয়ে তুলছিল তার তথ্যভিত্তিক বিবরণ তাঁর থেকে ভালোভাবে আর কেউ দেননি।
‘যে সকল হতভাগা কন্যা স্বকৃতভঙ্গ অথবা দুপুরুষিয়া পাত্রে অর্পিতা হয়েন, তাঁহারা যাবজ্জীবন পিত্রালয়ে বাস করেন। বিবাহকর্তা মহাপুরুষেরা, কিঞ্চিৎ দক্ষিণা পাইয়া, কন্যাকর্তার কুলরক্ষা অথবা বংশের গৌরববৃদ্ধি করেন, এইমাত্র। সিদ্ধান্ত করা আছে, বিবাহকর্তাকে বিবাহিতা স্ত্রীর তত্ত্বাবধানের, অথবা ভরণপোষণের ভারবহন করিতে হইবেক না। সুতরাং কুলীন মহিলারা, নামমাত্রে বিবাহিতা হইয়া, বিধবা কন্যার ন্যায়, যাবজ্জীবন পিত্রালয়ে কাল যাপন করেন। স্বামিসহবাস-সৌভাগ্য বিধাতা তাঁহাদের অদৃষ্টে লেখে নাই, এবং তাঁহারাও সে প্রত্যাশা করেন না। কন্যাপক্ষীয়েরা সবিশেষ চেষ্টা পাইলে, কুলীনজামাতা শ্বশুরালয়ে আসিয়া দুই চারিদিন অবস্থান করেন। কিন্তু সেবা ও বিদায়ের ত্রুটি হইলে, এ জন্মে আর শ্বশুরালয়ে পদার্পণ করেন না।কোনও কারণে কুলীনমহিলার গর্ভসঞ্চার হইলে, তাহার পরিপাকার্থে কন্যাপক্ষীয়দিগকে ত্রিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে হয়। প্রথম, সবিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়া জামাতার আনয়ন। তিনি আসিয়া, দুই একদিন শ্বশুরালয়ে অবস্থিতি করিয়া, প্রস্থান করেন। ঐ গর্ভ তৎসহযোগসম্ভূত বলিয়া পরিগণিত হয়। দ্বিতীয়, জামাতার আনয়নে কৃতকার্য হইতে না পারিলে, ব্যভিচারসহচরী ভ্রূণহত্যাদেবীর আরাধনা। এ অবস্থায়, এতদ্ব্যতিরিক্ত নিস্তারের আর পথ নাই। তৃতীয় উপায় অতি সহজ, অতি নির্দোষ ও সাতিশয় কৌতুকজনক। তাহাতে অর্থব্যয়ও নাই, এবং ভ্রূণহত্যাদেবীর উপাসনাও করিতে হয় না। কন্যার জননী, অথবা বাটীর অপর গৃহিণী, একটি ছেলে কোলে করিয়া, পাড়ায় বেড়াইতে যান এবং একে একে প্রতিবেশীদিগের বাটীতে গিয়া, দেখ মা, দেখ বোন, অথবা দেখ বাছা, এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া, কথাপ্রসঙ্গে বলিতে আরম্ভ করেন, অনেকদিনের পর কাল রাত্রিতে জামাই আসিয়াছিলেন; হঠাৎ আসিলেন, রাত্রিকাল, কোথায় কি পাব, ভাল করিয়া খাওয়াইতে পারি নাই; অনেক বলিলাম, একবেলা থাকিয়া, খাওয়াদাওয়া করিয়া যাও, তিনি কিছুতেই রহিলেন না; বলিলেন, আজ কোনও মতে থাকিতে পারিব না; সন্ধ্যার পরেই অমুক গ্রামের মজুমদারদের বাটীতে একটা বিবাহ করিতে হইবেক; পরে অমুকদিন, অমুক গ্রামের হালদারদের বাটীতেও বিবাহের কথা আছে। সেখানেও যাইতে হইবেক। এই বলিয়া ভোর ভোর চলিয়া গেলেন। স্বর্ণকে বলিয়াছিলাম, ত্রিপুরা ও কামিনীকে ডাকিয়া আন্ তারা জামায়ের সঙ্গে খানিক আমোদ আহ্লাদ করিবেক। একলা যেতে পারিব না বলিয়া ছুঁড়ী কোনমতেই এল না। এই বলিয়া, সেই দুই কন্যার দিকে চাহিয়া বলিলেন, এবার জামাই এলে, মা তোরা যাস ইত্যাদি। এইরূপে পাড়ার বাড়ী বাড়ী বেড়াইয়া জামাতার আগমনবার্তা কীর্তন করেন। পরে স্বর্ণমঞ্জরীর গর্ভসঞ্চার প্রচার হইলে, ঐ গর্ভ জামাতাকৃত পরিপাক পায়’।