• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • চলমান বাংলাভাষা : উদয় চট্টোপাধ্যায়

    ক নিবন্ধকারের অভিযোগ চোখে পড়ল — বাঙালি এখন যে শুধু হীনম্মন্যতায় ভোগে তাই নয়, সে ভুল বানানে লেখে হীনমন্যতা। অভিধানের শরণাপন্ন হতে হল। চলন্তিকা আর সংসদ বাংলা অভিধান খুলে দেখা গেল ‘হীনমন্যতা’ রয়েছে—হীনম্মন্যতা নয়। আকাদেমি বানান অভিধানে অবশ্য গ্রাহ্য হয়েছে ‘হীনম্মন্যতা’, এবং তার সঙ্গে অনুরূপ ‘পণ্ডিতম্মন্যতা’ উল্লিখিত হয়েছে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে হীনম্মন্যতাই ব্যাকরণসম্মত। যেহেতু শব্দটি তৎসম, এর রূপের পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত নয়। তবু প্রমুখ বাংলা অভিধানে যখন হীনমন্যতা স্থান লাভ করেছে, তখন শব্দটিকে বাংলা ব্যাকরণসম্মত ধরে নিতেই হবে। সেইরকম দেখা গেল ‘অংশীদারি’ আর তার পাশে ব্যাকরণসম্মত ‘অংশীদারত্ব’-র জায়গায় ‘অংশীদারিত্ব’ স্থান পেয়েছে আকাদেমি বানান অভিধানে, কিন্তু সংসদ বাংলা অভিধানে শুধুই ‘অংশীদারি’। বোঝা যাচ্ছে, কিছু তৎসম শব্দ, অনভিপ্রেত হলেও, বাংলায় ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে — বানানে এবং অর্থেও — এবং তারা ব্যাকরণে মান্যতা পেয়েছে। অর্থ পরিবর্তনের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘ফলশ্রুতি’-র। এর আদি অর্থ হল কর্মের বা পুণ্যকর্মের ফল বর্ণনা ও তার শ্রবণ, কিন্তু বাংলায় এর অর্থ দাঁড়িয়েছে পরিণাম বা ফলাফল। নানা আপত্তি সত্ত্বেও এই ‘অপপ্রয়োগ’ ঠেকানো যায় নি। তেমনি আর এক অপপ্রয়োগ — বক্তব্য পেশ করা বা উপস্থাপন করার বদলে ‘বক্তব্য রাখা’ — কায়েম হয়ে বসেছে। ঊনবিংশতিতম বা বিংশতিতমের জায়গায় সরলীকৃত ঊনিশতম বা কুড়িতমের ব্যবহারও তাই।

    ভাষা এক জায়গায় আটকে থাকে না। নানা গ্রহণ আর বর্জনের মধ্য দিয়ে সে গতিশীল, এবং সেটাই তার সজীবতার লক্ষণ। কালাতিক্রমে তার রূপের বদল হয়। বৈদিক ভাষা আর পরবর্তীকালের সংস্কৃত ভাষার মধ্যে ব্যবধান প্রচুর। সংস্কৃত অবশ্যই এক সংস্কার-কৃত অর্থাৎ reformed ভাষা। তার লিখিত রূপের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছে পাণিনির ব্যাকরণকে ভিত্তি করে। পাণিনি-পরবর্তী যুগে বৈদিক ভাষা অব্যবহারের পর্যায়ে চলে গেছে। তার অর্থ বোঝাবার জন্য প্রয়োজন হয়েছে নিরুক্ত সূত্রের।

    ব্যাকরণও এক জায়গায় আটকে থাকে না। ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে তারও পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত হলেও বাংলাভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারে নি। সেটা সম্ভবপরও ছিল না। বরং বুধসমাজে অনুভূত হয়েছে যে বাংলার নিজস্ব ব্যাকরণের প্রয়োজন রয়েছে।

    রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ আর তার পূর্বের হ্যালহেডের ব্যাকরণ বাংলাভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের গোড়াপত্তন। বঙ্কিমচন্দ্র অনুযোগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ করে বাংলাভাষার ধাত নষ্ট করেছেন। এটা তর্কসাপেক্ষ। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা সাধু বাংলাভাষার ব্যাকরণের ভিত্তি হিসাবে অবশ্যই অপরিহার্য ভূমিকা নিয়েছে। পরবর্তীকালে বাংলা ব্যাকরণ রচনায় স্বাক্ষর রেখে গেছেন ব্রজকিশোর গুপ্ত, শ্যামাচরণ শর্মা, লোহারাম শিরোরত্ন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ বিদ্বজ্জন। রবীন্দ্রনাথ এবিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানান সংস্কারের বিষয়ে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্র সমসাময়িক কালে এসেছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সুনীতিকুমারের ভাষাপ্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ পরবর্তীকালের বাংলা ব্যাকরণ সংস্কারের ধারায় দিকনির্দেশকের ভূমিকা নিয়েছে। বাংলাভাষার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে চলেছে বাংলাভাষার ব্যাকরণের ক্রমবিকাশ। শব্দের ধ্বনি পরিবর্তন, রূপ পরিবর্তন, অর্থ পরিবর্তন, নবাগত শব্দের অনুমোদন এই ব্যাকরণের আবশ্যিক অঙ্গ।

    ভাষা শিখতে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাকরণ লাগে না। মায়ের মুখ থেকে আর আশেপাশের মানুষজনের কাছ থেকে শুনে শুনেই মাতৃভাষা উপলব্ধ হয়। যারা নিরক্ষর তারাও সেই ভাষার স্বচ্ছন্দ প্রয়োগ করে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়। ব্যাকরণের প্রয়োজন পড়ে পরিশীলিত ভাষা শিক্ষার জন্য — মৌখিক বা লিখিত যাই হোক — তবে মূলত লিখিত ভাষার জন্য। বৈদিক শ্রুতির স্তর থেকে বিকশিত পরবর্তীকালের লিখিত ভাষার সংহতি বজায় রাখার জন্য তাই প্রয়োজন হয়েছিল পাণিনি সূত্রের। আমাদের বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও তাই। সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারী সাধু ভাষা আর আঞ্চলিকতা বর্জন করে এক পরিশীলিত কথ্য বা চলিত ভাষার উদ্‌ভাবনা — উভয়ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়ে ব্যাকরণ শিক্ষার। বলা বাহুল্য, প্রথম ক্ষেত্রে রয়েছে অপরিবর্তনীয় এক কাঠামো, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা পরিবর্তনশীল।

    বাংলা সাধু ভাষার ইতিহাস কিঞ্চিদধিক দুশো বছরের। এটি গড়ে উঠেছিল সংস্কৃতের প্রচ্ছায়ে ইউরোপীয় মিশনারি ও মুনশিদের হাতে। রামমোহন একে স্থাপন করেন সুদৃঢ় ভিত্তির উপর। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের হাতে তা পূর্ণতা পায়। সাধারণের মুখের ভাষার শক্তি সাহিত্যে প্রথম রূপায়িত হল প্যারীচরণ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালে আর কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা-য়।

    চলিত ভাষার জয়যাত্রা শুরু হল ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের মাধ্যমে, যা রবীন্দ্রনাথকেও চলিত ভাষার আঙিনায় নিয়ে এল। আত্মকথা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মধ্যজীবনে সাধু ভাষায় রচিত হয়েছিল জীবনস্মৃতি, আর অন্তিমপর্বে চলিত ভাষায় ছেলেবেলা । দুটোই অনবদ্য।

    বাংলাভাষার এই দুই রীতির গঠনগত পার্থক্য মূলত দুটি বিষয়ে। এক, সাধু ভাষায় সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়া, সর্বনাম ও অনুসর্গের রূপ পূর্ণাঙ্গ, চলিত ভাষায় তা সংক্ষিপ্ত—যেমন, শুনিতেছে/ শুনছে, তোমাদিগের/ তোমাদের, ইহারা/ এরা। দুই, কিছু অব্যয় ও ক্রিয়া বিশেষণের প্রয়োগে—যেমন, এক্ষণে/ এখন, যদ্যপি/ যদিও, তথাপি/ তবু। রচনায় তৎসম-তদ্ভব শব্দের আনুপাতিক প্রয়োগ কোন বাঁধাধরা নিয়ম অনুসরণ করে না। সক্ষম সাহিত্যিকদের কলমে এদের যথেচ্ছ মিশ্রণ দুই রীতিতেই সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করেছে।

    এখন প্রশ্ন উঠবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কে থাকবে—সাধু ভাষা না চলিত ভাষা? পাল্লা ভারী দ্বিতীয়ের দিকেই। চলিত ভাষা প্রচলিত হবার পরেও তিন দিকপাল বন্দোপাধ্যায়—বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর আর মানিক—সাধু ভাষাতেও লিখেছেন। সাধু ভাষার সম্ভবত শেষ শক্তিশালী মুখপাত্ররা হলেন কমলকুমার মজুমদার, নীরদচন্দ্র চৌধুরী আর রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত। এখন সব সাহিত্যিকই চলিত ভাষায় লেখেন। শুধু আনন্দবাজার পত্রিকা সাধু ভাষায় সম্পাদকীয়ের ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে। কিছু বিদগ্ধজনের অভিমত সাধু ভাষা আমাদের ঐতিহ্যের পরিচায়ক। সাধু ও চলিত ভাষা যার যার ক্ষেত্রে অটল হয়ে আছে। ঐটা বাংলাভাষার এক বিশেষত্বমূলক সম্পদ—এর নির্বাসন কাম্য নয়। তবে কাল নির্মোহ বিধায়ক—ক্ষীয়মাণ পদসঞ্চারে বাংলাভাষার এই পথ হয়তো অনিবার্যভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

    বাংলা বানান সংস্কারের বিষয়ে—সাধু ও চলিত উভয় ক্ষেত্রেই—প্রস্তাবনা ও বিতর্কের সূত্রপাত ১৩৩৯ সালের (১৯৩১ খ্রি) প্রবাসী-তে পর পর তিন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাংলা টাইপ ও কেস’ শীর্ষক প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে। প্রবন্ধটির লেখক ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস ও প্রকাশন বিভাগের মুদ্রাকর অজরচন্দ্র সরকার। এর চার বছর পর উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বাংলা বানান ও পরিভাষা নির্ণয়ের জন্য এক কমিটি গঠিত হয়। কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ৮ মে ১৯৩৬। কমিটির সুপারিশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তদ্ভব শব্দে হ্রস্ব স্বরচিহ্নের ব্যবহার ও রেফের তলায় দ্বিত্ব বর্জন। অচলায়তন ভাঙার যে-কোন প্রয়াসের মতোই এই রিপোর্টের বিরুদ্ধাচারণ কম হয় নি। আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখলেন—“আমরা ‘দরজা’ উচ্চারণ করিতে ‘জ’-তে যতখানি জোর দিই, তদপেক্ষা বেশি জোর দিই যখন ‘দুর্জন’ উচ্চারণ করি। সেইজন্যেই জ-কে দ্বিত্ব করিয়া এইস্থলে ‘দুর্জ্জন’ লেখাই বিধেয়।” ‘বৌ’ বানান পালটে দিয়ে ‘বউ’ লেখা দেখে সুনীতিকুমার নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে মন্তব্য করেছিলেন—“ছি: ছি:, শেষ পর্যন্ত বৌ হল এমন! বৌ, তো বৌ-এর মাথায় ঘোমটা কই?”

    বলা বাহুল্য, এই সব আপত্তি টেকে নি। রেফের তলায় দ্বিত্ব বর্জন এখন কিছু অর্বাচীন মহল ছাড়া ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মান্যতা লাভ করেছে। বৌ ঐখানের জায়গায় চলেছে বউ ওইখানে। তদ্ভব শব্দে হ্রস্ব স্বরচিহ্ন ব্যবহারের সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন এই কমিটির সুপারিশের অনেক আগে। সহজ পাঠে ব্যবহৃত হয়েছে পাখি, দিঘি, পুব। এর ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে অনেকখানি। রানি, বেশি, দেরি, চিন-এর ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ এখন আর চোখকে পীড়িত করে না। ভবিষ্যত প্রজন্ম এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।

    বানান সংস্কারে বিষয়ে আলোচনায় ইংরেজি বানান পরিবর্তনের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। Wiiliam Blake-এর ‘Tyger, Tyger, burning bright’ মনে পড়ে? Tyger এখন অবিসংবাদিত tiger । Realise/realisation, utilise/utilisation আমেরিকান ইংরেজিতে হয়েছে realize/realization, utilize/utilization । ক্রিয়ার past participle-এ দ্বিত্ব বর্জন করেছে আমেরিকান ইংরেজি—স্বচ্ছন্দে চলছে traveled, riveted । Sulphur হয়েছে sulfur, aluminium হয়েছে aluminum । খোদ ব্রিটিশ ইংরেজিতে supersede হয়ে দাঁড়িয়েছে supercede — হয়তো concede, accede, intercede-এর প্রভাবে। এ বিষয়ে Oxford Language Reference-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য — ‘the c spelling is now very common, it has been entered without comment in some modern dictionaries’ । বানান এবং অর্থ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই মন্তব্যহীন অনুপ্রবেশ যে কোন সজীব ভাষারই স্বাভাবিক ধর্ম।

    তা বলে কি পরিবর্তনের নামে অজ্ঞতা বা অনাচারকে প্রশ্রয় দিতে হবে? অবশ্যই না। বিজ্ঞাপনে সাইনবোর্ডে বা ট্রাকের পিছনের লিখনে বানানের শিথিলতা বা শব্দের বিকৃতি আমরা উপেক্ষা করতে পারি, কিন্ত অবশ্যই পারি না সাহিত্যিকের কলমে বা সংবাদপত্রের বিবৃতিতে এই বিচ্যুতির। অতলস্পর্শের স্থানে অতলস্পর্শী, সর্বজনীনের জায়গায় সার্বজনীন, অভ্যন্তরীণ না লিখে আভ্যন্তরীণ, মনোমতো না লিখে মনমতো, ভৌগোলিকের জায়গায় ভৌগলিক অনুমোদনযোগ্য হতে পারে না। শিক্ষিতজন শব্দের ব্যুৎপত্তি ও সন্ধি-নিয়ম বিষয়ে একটু অবহিত হলে এই বিচ্যুতি এড়ানো যাবে। সাধারণ লোক ব্যুৎপত্তি-অবহিত হবে এ আশা করা যায় না, তবে তাদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আর মমতা নিয়ে শব্দের বানানের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। ‘বানান’ কথাটি এসেছে ‘বর্ণনা’ থেকে — শব্দের বর্ণনা, শব্দের ছবি। একবার সেই ছবি মনে গাঁথা হয়ে গেলে শব্দটির বিকৃতি চোখকে পীড়া দেবে। তবু বহু ব্যবহারে ও পাঠকের প্রশ্রয়ে কিছু অপপ্রয়োগ জাতে উঠে চলমান ভাষায় মান্যতা অর্জন করবে — যেমন করেছে হীনমন্যতা। এই পথ বেয়েই হয়তো ‘সম্মাননীয়’-কে স্থানচ্যুত করে ‘সম্মানীয়’ মান্য আসন লাভ করবে।

    সব ভাষাতেই কিছু শব্দ আছে যেগুলোর সৃষ্টি সীমিত বন্ধুমহলে অথবা অপরাধজগতে। একটু চটক সৃষ্টি অথবা বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে গোপনীয়তা রক্ষার কারণে এদের উদ্ভব। ইংরেজিতে এ-ধরনের শব্দকে বলা হয় slang, বাংলায় অপশব্দ। নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে এদের কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়ে সবার মুখে, পরে সংবাদপত্রে ও সাহিত্যে। বাংলায় এ জাতীয় শব্দ আগেও এসেছে ও ব্যবহারিক প্রয়োগে স্থান লাভ করেছে। উদাহরণ হল — আম্বা (স্পর্ধা), গেঁতো (অলস), চিটিংবাজ (প্রতারক), তিলেখচ্চর (খুব পাজি), ফুটানি (গর্ব), বারফাট্টাই (লোকদেখানি বড়াই) ইত্যাদি। সাম্প্রতিকতর সংযোজন হল ছিনতাই, চোট (ক্ষতি অর্থে), ঝাড়, ধোলাই, রেলা, আঁতেল, ঢপ, চামচা ইত্যাদি। খুব সম্প্রতি এক প্রবীণা লেখিকার রম্যরচনায় ব্যবহৃত হতে দেখা গেল ‘মুর্গি করা’ — হিন্দি কথ্যজগতের ‘মুর্গা বনানা’ থেকে সরাসরি আমদানি।

    বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারে বহিরাগত শব্দের সংখ্যা বিপুল। সেটা যে কোন ভাষার সজীবতার লক্ষণ। সুদীর্ঘকাল তুর্ক-আফগান ও মুঘল শাসনের প্রভাবে আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ সর্বাধিক — প্রায় হাজার তিনেক। তা ছাড়া, পোর্তুগিজ শ’খানেক, কিছু ওলন্দাজ ও চিনা, আর হাজার দেড়েক ইংরেজি। অনুপ্রবেশ পর্যবসিত হয়েছে আত্মীকরণে। আজব, আসবাব, এলাকা, উকিল, ওজন, কায়দা, খাতির, খারিজ, জরিমানা, জ্বালাতন, দাবি, বাকি, মতলব, মেজাজ, মেহনত, হাওয়া, হুকুম — এসব আমরা কে আর আরবি ভেবে ব্যবহার করি! তেমনি আন্দাজ, কোমর, খরচ, খরিদ্দার, গরম, চশমা, চামচ, চাকর, দরখাস্ত, দরজা, দোকান, নরম, পছন্দ, বন্দোবস্ত, বাজার, রুমাল, সবুজ, সরকার, সরঞ্জাম, এমন কী হিন্দু যে ফারসি শব্দ তার খবর কে রাখে! এখনও আইন আদালতে ব্যবহৃত বহু পরিভাষাই ফারসি। তুর্কি শব্দের কিছু উদাহরণ — আলখাল্লা, উজবুক, কাঁচি, কাবু, কুলি, দারোগা, বাবুর্চি, বাবা, বারুদ, বোঁচকা; পোর্তুগিজ — আনারস, আলমারি, ইস্পাত, চাবি, জানালা, পেঁপে, পেরেক, বোতাম, বারান্দা, ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এই সব বিদেশি শব্দগুলোর আসল রূপ আর উচ্চারণ বদলেছে বাংলায়। এমন কী অর্থের পরিবর্তন ঘটেছে কিছু শব্দের, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা নিদারুণভাবে। যেমন, ফারসিতে বুজুর্গ শব্দের অর্থ মহৎ বা সাধুব্যক্তি, বাংলায় বুজুর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে বুজরুক এবং তার অর্থ হল প্রতারক বা ঠগ। ইংরেজি থেকে বাংলায় এসেছে অর্ডার, উল, কলেজ, কাটলেট, কার্পেট, কেরোসিন, চেক, চেয়ার তাদের নিজস্ব রূপে; আপেল, আপিল, ইঞ্চি, ইসকুল, টেবিল, ডাক্তার, বুরুশ, বেঞ্চি হাসপাতাল পরিবর্তিত রূপে। General-কে জাঁদরেল, lamp-কে ল্যাম্ফো করে নিতে অসুবিধা হয় নি আমাদের।

    প্রতিবেশী প্রাদেশিক ভাষাদের থেকে সে হিসাবে শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কম। হিন্দি থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি শব্দ বাংলায় এসেছে—রুটি, পুরি, মিঠাই, বটুয়া, কামাই, জলদি ইত্যাদি। ক্রমবর্ধমান সর্বভারতীয় আদানপ্রদানের সুবাদে সম্প্রতি নূতন কিছু হিন্দি শব্দের সংযোজন ঘটেছে ও ঘটছে। অবিরামের জায়গায় লাগাতার, বোঝাপড়ার জায়গায় সমঝোতা, মিছামিছির জায়গায় ঝুটমুট, দেখাশোনার জায়গায় দেখভাল প্রায় কায়েমি হয়ে বসেছে কথ্য এবং লিখিত বাংলায়। তবে তার সঙ্গে উচ্চারণের ক্ষেত্রে কিছু অস্বস্তিকর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রেডিয়োতে সরকারি বিজ্ঞাপনে যখন আধার কার্ড আর মোবাইল সংযুক্তিকরণের জন্য ‘ধিয়ান’ দিয়ে শুনতে বলা হয়, কিংবা নবজাৎ (হসন্ত যুক্ত) শিশুদের টিকাকরণের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয় বা অজ্ঞাৎ (হসন্ত যুক্ত) শিশুকে দত্তক নেবার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়, তখন মনে হয় বাংলা উচ্চারণের স্বাভাবিক চালচলনের উপর জবরদস্তি করা হচ্ছে। দূরদর্শনে উপস্থাপিত অনুষ্ঠানগুলোতে কৃত্রিম বাংলা উচ্চারণের উদাহরণ দিতে গেলে সাতকাহন হয়ে যাবে। ‘কেন না’ না-বলে হিন্দি ‘কেঁউ কী’-র অনুকরণে ‘কেন কি’ বলা হচ্ছে, যার প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে নবপ্রজন্মের কথাবার্তায়। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। বাঙালি বিদেশি ও বহিরাগত শব্দকে চিরকাল নিজের মতো করে উচ্চারণ করে এসেছে — যার সম্প্রতিক উদাহরণ সমঝুতা হয়েছে সমঝোতা। সেটাই বাঙালিয়ানা। নিজের ভাষার শব্দ অন্য ভাষার ঢঙে উচ্চারণ নিজের ভাষার অমর্যাদা করা। প্রবন্ধের সূত্রপাত হয়েছিল বাঙালির হীনমন্যতা নিয়ে। ‘মোদের গরব মোদের আশা’ বাংলাভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে না পারলে বাঙালির হীনমন্যতা বাড়বে বই কমবে না।

    তথ্য স্বীকার:

    ১। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ—জ্যোতিভূষণ চাকী (আনন্দ, কলকাতা), দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৩

    ২। বানান বিতর্ক—নেপাল মজুমদার সম্পাদিত (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা), তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৭

    ৩। বাংলা লেখার নিয়মকানুন—হায়াৎ মামুদ (প্রতীক, ঢাকা) দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৩



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অভীক ঘোষ (পরবাস আর্কাইভ থেকে)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)