।।১।।
সম্প্রতি একজন মার্কিন কবি / অধ্যাপকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটেছিল চিঠিপত্রে। ভদ্রলোক ভিয়েতনামী লোকগাথা ও প্রাচীন কবিতার বিশেষজ্ঞ। ষাটের দশকে আরো লক্ষ লক্ষ মার্কিন যুবক যুবতীর সঙ্গে তিনিও যেতে বাধ্য হয়েছিলেন ভিয়েতনামে, তবে ভাগ্যক্রমে যুদ্ধ করতে নয়, যুদ্ধে বিধ্বস্ত শিশুদের ত্রাণকার্যে। সে কাজের দায়িত্ব মিটলেও ভিয়েতনাম থেকে গেল তাঁর মনে — তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তার মানুষজনের আতিথেয়তা, তার লোকগাথা ও সংগীত। নিজের উদ্যোগে দক্ষিণ ভিয়েতনামে ফিরে গিয়ে তিনি টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখতে শুরু করলেন সেগুলি। এইভাবে কেটে গেল তিন দশকেরও বেশি।
আমি সেই প্রাচীন লোক কবিতার বাংলা অনুবাদে আগ্রহী, অবশ্যই তাঁর ইংরেজি ভাষান্তর অবলম্বনে; সেই সূত্রেই চিঠিপত্রের শুরু। আমি বাংলা ভাষায় লিখি শুনে ভদ্রলোক একটি অদ্ভুত অনুরোধ করলেন — আপনার বাংলা লেখার কিছু নমুনা আমাকে পাঠান। আমি যখন বিস্ময়ে হতবাক, তিনি জুড়ে দিলেন — আমার এক বন্ধু ভাল বাংলা জানেন, আমি তাঁর সাহায্য নিয়ে পড়ব।
আমি তাঁকে পাঠিয়ে দিলাম ব্রহ্মদেশের কবি উ তিন মো-র বিষয়ে আমার একটি লেখা ('কবি সম্মেলন' কাগজের ‘এপ্রিল ২০০৭’ সংখ্যা দ্রষ্টব্য)। তিন-চার দিন পরে তাঁর উচ্ছ্বাসময় জবাব এল — তিনি বুঝতে পেরেছেন আমার লেখাটি যথাযথ এবং প্রামাণ্য; আমাকে সানন্দে অনুমতি দিয়ে ভিয়েতনামী কবিতার অনুবাদকর্মের এবং তার সঙ্গে তাঁর বাংলা জানা বন্ধুর কয়েক পাতা জোড়া লম্বা চিঠি। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার লেখাটি পড়েছেন, বইপত্র ঘেঁটে আমার তথ্যাদির সত্যতা যাচাই করেছেন এবং আমার বাংলায় অনুবাদ করা উ তিন মো-র কবিতাগুলি তিনি তাদের ইংরেজি ভাষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে পড়ে রায় দিয়েছেন আমার অনুবাদগুলি মূলানুগ এবং যথার্থ; শুধু তাই নয় তাঁর মতে বাংলা অনুবাদগুলি ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া ইংরেজির তুলনায় অনেকাংশে বেশি কবিত্বপূর্ণ। তিনি লিখলেন, “My impression based on these spot checks is that the author is a bit of poet himself, at least sufficiently sensitive to the poetry in the translations that he can get across the English with a rather remarkable fidelity.”
এইভাবেই তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়, তিনি বলতে অধ্যাপক টোনি কেভিন স্টুয়ার্ট — শুরু হল চিঠিপত্রের আদান প্রদান; জানা গেল তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ক্লিন্টন সিলির ছাত্র ছিলেন। আমার অবশ্যই জানা উচিত ছিল তাঁর নাম এবং পরিচয় — কারণ ২০০৬-সালে যখন সৌম্য দাশগুপ্ত আর আমি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম অধ্যাপক সিলির ('কবি সম্মেলন', ‘সেপেটম্বর ২০০৬’ সংখ্যা দ্রষ্টব্য) তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতার আধুনিক অনুবাদের প্রসঙ্গে তিনি অধ্যাপক স্টুয়ার্টের কাজের কথা তুলেছিলেন — “কপার কেনিয়ন প্রেস থেকে প্রকাশিত ভানুসিংহের পদাবলীর অনুবাদক স্টুয়ার্ট ও টুইচেলও উল্লেখযোগ্য।” কিন্তু তার পর গ্রন্থটির এবং তার লেখকদ্বয়ের কথা আমি সম্পূর্ণ ভুলে যাই। কিন্তু এরপর তার সঙ্গে পরিচয়টি ঝালিয়ে নেওয়া গেল।
টোনি কে স্টুয়ার্ট নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম ও দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তাঁর অধ্যাপনার বিষয় দক্ষিণ এশিয়ার ধর্ম ও ভাষা অর্থাৎ মূলত: বাংলা ও সংস্কৃত। ১৯৭৬-সালে তিনি পশ্চিম কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মবিদ্যায় (Religious studies) স্নাতক ডিগ্রি করেন। তারপর তিনি যোগ দেন এডওয়ার্ড ডিমক এবং ক্লিনটন সিলির ছত্রছায়ায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাত “দক্ষিণ এশিয়া ভাষা ও সভ্যতা” বিভাগে। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে স্নাতকোত্তর শিরোপা এবং ১৯৮৫ সালে বাংলা ভাষা ও ধর্মবিদ্যায় উচ্চ প্রশংসার সঙ্গে ডক্টরেট। তাঁর গবেষণার বিষয় বাংলার ধর্মীয় সাহিত্য এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। তিনি বাংলা সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক অথচ আধুনিক বাংলার কবি সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত নন বিশেষ। তাঁর গবেষণাকর্মের সময়সীমা মূলত: ১৪০০ থেকে ১৮০০ সাল, রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ব্যতিক্রম। তিনি জীবনানন্দ দাশকে চিনবেন না, অথচ কৃষ্ণদাস কবিরাজ অথবা কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের সঙ্গে তাঁর আত্মিক ঘনিষ্ঠতা। মধ্যযুগের মুসলিম সাহিত্যে তাঁর সাবলীল আনাগোনা। জলবসন্ত অসুখের সঙ্গে মা শীতলার সম্পর্ক বা কচিকাঁচাদের প্রাণরক্ষায় মা ষষ্ঠীর ভূমিকা নিয়ে তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধ রয়েছে।
চৈতন্য চরিতামৃতের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এডওয়ার্ড ডিমক। ১৯৯৯-সালে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে এই মহাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেছেন ও ভূমিকা লিখেছেন স্টুয়ার্ট। বইটির সবই ভাল, কিন্তু সমস্যা একটাই — দাম ১০০-ডলার। তাই কেনা মুশকিল, মাঝেমধ্যে লাইব্রেরি থেকে ধার করে এনে পড়তে হয়। গ্রন্থটির অবিলম্বে একটি ভারতীয় সংস্করণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। যাঁরা বাংলা পড়তে পারেন না অথচ মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী, তাঁদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থ।
২০০৩-সালে প্রকাশিত হয় “ভানুসিংহের পদাবলী”-র দ্বিভাষিক (ব্রজবুলি এবং ইংরেজি) সংস্করণ “The Lover of God”, টোনি কে স্টুয়ার্ট এবং চেজ টুইচেলের যৌথ অনুবাদে। আর ২০০৪-সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনূদিত প্রাচীন বাংলার সত্যপীরের আটটি গল্পের সংকলন — “Fabulous Females and Peerless Pirs — Tales of Mad Adventures in Old Bengal.” — ডাকাবুকো নারী চরিত্র সমেত হিন্দু মুসলমানের যৌথ জীবনের রগুড়ে, সরস কাহিনী। কাহিনীগুলির সাফল্য কেবল তাদের রহস্যঘন রসময়তাই নয়, মধ্যযুগে এক জাতি দুই ধর্মের যৌথজীবনের এক নিবিড় ছবিও প্রস্ফুটিত সেখানে। আমরা অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও জেনে যাই যে সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা প্রভু ইংরেজদের সৃষ্টি, যদিও তাতে ইন্ধন জুগিয়েছেন উভয়পক্ষে লুংগি ও ল্যাঙ্গট মৌলবাদীরা।
।। ২।।
The Lover of God— Rabindranath Tagore; Translated by Tony K. Stewart and Chase Twichell; Copper Canyon Press; Port Townsend, Washington; Cover: Untitled Kalight Painting; x+120 Pgs; 2003; ISBN 1-55659-196-9
ভানুসিংহের পদাবলীর আটটি কবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন চোদ্দ বছর বয়েসে — প্রকাশিত হয়েছিল “ভারতী” সাহিত্যপত্রে। কিন্তু তাদের লেখক দুঁদে ব্যবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়:সন্ধিতে উর্ত্তীর্ণ কনিষ্ঠ পুত্র নয়, সেখানে তাঁর অঙ্গে প্রাচীনতার ছদ্মবেশ। কবির নাম ভানুসিংহ, তিনি সপ্তদশ শতকের এক নামী বৈষ্ণব কবি — তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত পুঁথি থেকে রচনাগুলি পাওয়া গেছে। কবিতার ভাষাও সমকালীন বাংলা নয়, অনেককাল আগে বিলুপ্ত সান্ধ্য ভাষা — “ব্রজবুলি”। ভাঙা সংস্কৃত আর ভাঙা বাংলার মিশ্রণে নির্মিত সেই ভাষা বৈষ্ণব পদাবলীর কবিদের একান্ত নিজস্ব। কবির নামটিও রহস্যময়, কারণ ভানু = রবি; হয়ত তিনি আরো বোঝাতে চাইছিলেন যে নামের মধ্যে “ভান” রয়েছে।
কবিতাগুলি প্রথমে তিনি লিখেছিলেন স্লেটে, তারপর খাতায় কপি করে ঠাকুর পরিবারের এক সুহৃদ, “ভারতী”র সম্পাদককে দেখালেন; রহস্য করে তাঁকে বললেন, ব্রাহ্ম সমাজের গ্রন্থাগারে তিনি একটি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পেয়েছেন এবং তাতে লেখা গানগুলি পড়ে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে এই কবি এখনো অপ্রকাশিত এবং অনাবিষ্কৃত। ১৮৭৫-সালে “ভারতী” কাগজে প্রকাশিত হল আটটি গান (বর্তমান সংকলনে তাদের ক্রমিক সংখ্যা ১ থেকে ৭ এবং ১২)। পরবর্তী আট বছরে ভারতী প্রকাশ করলেন আরো তেরটি গান, যদিও তাদের পিতৃত্ব সম্বন্ধে সুধীমহলে এবং ঠাকুর পরিবারে সন্দেহ থেকেই গেল (নতুন গানগুলির ক্রমিক সংখ্যা ৮ থেকে ১১, ১৩ থেকে ১৯ এবং ২২)। পরের বছর ১৮৮৪-সালে প্রকাশিত হল একুশটি গান নিয়ে নতুন কাব্যগ্রন্থ “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী” এবং ওই একই বছরে “নবজীবন” পত্রিকায় শ্রাবণ, ১২৯১ সংখ্যায় “ভানুসিংহ ঠাকুরের জীবন” নামে গদ্য, রবীন্দ্রনাথের কলমে এক কাল্পনিক বৈষ্ণব কবির কল্পিত, রসময় জীবনকথা, ছদ্ম গাম্ভীর্যে ভরা মনগড়া পাদটীকা সমেত। ১৮৮৬ সালে শেষ গানটি লিখে ভানুসিংহের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।
এর আগে ১৮৭৮ থেকে ১৮৮০-সাল রবীন্দ্রনাথের কেটেছে ইংল্যান্ডে। ১৮৮০-সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ “সন্ধ্যাসঙ্গীত”— বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশংসা ছাড়া বিশেষ কোন খ্যাতির অধিকারী হয়নি গ্রন্থটি। ১৮৮৩-সালে বাইশ বছর বয়েসি রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হল দশ বছর বয়েসি মৃণালিনীর সঙ্গে; বিবাহের কিছুদিন আগে ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রকাশ করলেন নতুন কাব্যগ্রন্থ, “ছবি ও গান”; তার উৎসর্গ বৌঠান কাদম্বরীকে। এবং তার কয়েকমাস পরেই স্বহস্তে বিষপানে মৃত্যু হল তাঁর। মৃত্যু ও বিবাহের অমোঘ ছায়াপাতে “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী”র প্রকাশক্ষণটি কবির জীবনে গুরত্বপূর্ণ। এই গানগুলির পেছনে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ ছিল কাদম্বরীর। উৎসর্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।”
গদ্যে পদ্যে নাটকে গানে অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ছে তাঁর, কিন্তু কৈশোরে লেখা বাইশটি গান থেকে গিয়েছে তাঁর হৃদয়ের কাছাকাছি। শক্তিশালী, মর্মস্পর্শী, হৃদয়দ্রাবী, বেদনাদায়ক কবিতাগুলিতে যৌনতার ছিটেফোঁটা না থাকলেও, প্রেম ও বিরহের সুতীব্র, ঝাঁঝালো, খরখরে, তীব্রতায় তাদের অভূতপূর্ব উপস্থিতি। পরবর্তী ছেষট্টি বছরে তিনি বার বার ফিরে আসবেন কবিতাগুলির আশ্রয়ে, পরিমার্জনা করবেন, একটু ফুরসত পেলেই গা ভাসাবেন “পদাবলীর জালিয়াতি”-তে।
তাঁর আগেও রাধাকৃষ্ণের “অবৈধ” প্রেমকে বিষয় করে কমবয়েসে কবিতা লিখছেন ঊনবিংশ শতকের অন্য মহীরুহেরা — বংকিমচন্দ্র, মধুসূদন প্রমুখ, কিন্তু তাঁরা ছদ্মনাম নেননি, গড়ে তোলেননি প্রাচীন, কৃত্রিম ভাষাভঙ্গী বা অনেক বছর ধরে পিতৃত্ব অস্বীকার করেননি তাদের। কবির জীবৎকালে গ্রন্থটির অন্তিম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৪০-সালে — মৃত্যুর এক বছর আগেও তিনি নতুন একটি ভূমিকা লিখেছেন, স্বীকার করেছেন কৈশোরের আতিশয্য ও অমিতাচারের কথা এবং নিজের তুলনা করেছেন ব্রিটিশ কবি চ্যাটার্টনের সঙ্গে। “অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলাম বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প। তাঁকে নকল করার লোভ হয়েছিল।” অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্ষণজন্মা কবি টমাস চ্যাটার্টন (১৭৫২ - ১৭৭০)ও এক কল্পিত প্রাচীন কবির নাম করে লোক ঠকিয়েছিলেন তাঁর মার্চ, ১৭৬৯-সালে প্রকাশিত “The Rise of Peyncteynage yn Englan de, wroten by T. Rowleie. 1469 for Mastrecanynge” গ্রন্থে (না, কোন ছাপার ভুল নেই, এটাই গ্রন্থের প্রকৃত নাম!) বিতর্কের ঝড় উঠেছিল বিদ্বৎসমাজে, কিন্তু চ্যাটার্টনের অকালমৃত্যুতে তার জল আর বেশিদূর গড়ায়নি।
আমাদের আলোচ্য কবি তাঁর দীর্ঘ জীবনের যাত্রায় সাফল্যের উচ্চ থেকে উচ্চতর চূড়ায় পা রেখেছেন, কিন্তু বার বার আপনমনে ফিরে এসেছেন তাঁর নির্ঝরের নিবিড়তম উৎসে। বাইশটি প্রেম ও বিরহের গান কেন তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ রূপ নিয়েছিল তা নিয়ে আমরা জল্পনা-কল্পনা করতে পারি — শৈশবের ভাল লাগা, বৌঠানের স্মৃতি, বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি নিবিড় মমতা--এর যে কোনটিই তার কারণ হতে পারে। অন্যদিকে অনুবাদক মহাশয়ও বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন দু-দশক, ব্রজবুলি তাঁর কাছে অতি পরিচিত ভাষা। আর দুয়ের সংমিশ্রণে আমরা পেলাম এক অপরূপ গ্রন্থ।
।।৩।।
“ভানুসিংহের পদাবলী”র আক্ষরিক অনুবাদ যে অসম্ভব, সে কথা খোলাখুলি ভাবেই জানিয়েছেন স্টুয়ার্ট — তিনি শুরু করেছেন গ্রন্থটির ১৯৪০-সালে প্রকাশিত সংস্করণ থেকে এবং কবিতার আখরগুলির বদলে ভাব, মেজাজ ও আবেগের দিকে নজর দিয়েছেন বেশি। তাঁর গবেষণা বৈষ্ণব সাহিত্য বিষয়ে এবং বৈষ্ণব পদাবলীগুলি পাঠের ফাঁকে ফাঁকে এসে গেছেন ভানুসিংহও। ১৯৭৮-সালে তিনি কলকাতায় American Institute of Indian Studies-এ এসে বাংলা শিখছিলেন; তাঁর শিক্ষিকা সুপ্রিয়া চ্যাটার্জি তাঁকে কবিতাগুলি পড়তে ও বুঝতে সহায়তা করেন। শিকাগো ফিরে আসার পর তিনি শুরু করেন তাঁর অনুবাদকর্ম — ক্লিন্টন সিলি ও এডওয়ার্ড ডিমকের পড়ানো বাংলা কোর্সের টিউটোরিয়াল হিসেবে। প্রথম পর্বের অনুবাদে সন্তুষ্ট না হয়ে সেগুলি সরিয়ে রেখে দেন তিনি। দ্বিতীয় পর্ব চলে খানিকটা এলোমেলো ভাবে পরবর্তী দেড়-দশক — নতুন নতুন পাঠে উন্মোচিত হয় নতুন অর্থ, নতুন ব্যঞ্জনা — তাদের ভাবের গভীরতায় তিনি মুগ্ধ, তাদের অনুভূতির রহস্যময়তায় তিনি অভিভূত। তারপর ১৯৯৬-সালে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গবেষোণাকালে তিনি তৃতীয়বার অনুবাদ করেন বাইশটি কবিতা।
এতদিনে গ্রন্থের প্রতিটি ব্রজবুলি শব্দ তাঁর পরিচিত, তাদের ইংরেজি অর্থগুলিও আংশিকভাবে হলেও ধরা দিয়েছে তাঁর মননে, কিন্তু এখনো হয়ে রয়েছে তা শব্দের সমষ্টিমাত্র — তাদের কবিতা করে তোলা যায় কিভাবে? তাঁর নিজের পক্ষে কাজটির পরবর্তী পর্ব সমাধা করা সম্ভব নয়। বন্ধু কবি লি আপটন পরামর্শ দিলেন একজন স্বভাবকবির শরণাপন্ন হতে এবং সেই সূত্রেই যোগাযোগ ঘটল মার্কিন কবি চেজ টুইচেল (১৯৫০ -) এর সঙ্গে। তাঁর দখলে পাঁচটি প্রশংসিত কাব্যগ্রন্থ এবং বেশ কয়েকটি কবিতা পুরস্কার। অধ্যাপনার কাজে পদত্যাগ করে ভদ্রমহিলা এক কবিতা প্রকাশনাসংস্থা স্থাপন করেছেন। তিনি রাজি হলে দুজনের যৌথ অনুবাদকর্মের কাজ শুরু হল।
অনুবাদের পদ্ধতিটি একটি উদাহরণ সহযোগে বিশদ বর্ণনা করেছেন স্টুয়ার্ট তাঁর মুখবন্ধে। উদাহরণটি হল সংকলনের তিন নম্বর গান —
“হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে,স্টুয়ার্ট কবিতাটি পড়ে শোনালেন টুইচেলকে বারংবার, দুয়েক কলি গেয়েও শোনালেন যাতে ছন্দের খাঁজখোঁজগুলি ধরা পড়ে কবির কানে। তারপর রোমান হরফে লিখে দিলেন পুরো কবিতাটি যাতে টুইচেল তাকে পড়তে পারেন আপন মনে। (জানি না সেটা সঠিকভাবে ছাপা সম্ভব হবে কিনা। )
কন্ঠে বিমলিন মালা।
বিরহবিষে দহি বহি গল রয়নী,
নহি নহি আওল কালা।“
“hrdayaka sadha misaola hrdaye,পাঠের ব্যাপারটি মিটে গেল, এবার অক্ষর ধরে ধরে অনুবাদের কঠিন কাজ; ব্রজবুলির ব্যাকরণটি বাংলা না-জানা মানুষকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করা — ইংরেজি ব্যাকরণের সঙ্গে তার মোদ্দা তফাৎগুলিকে ধরিয়ে দেওয়া; সেই সঙ্গে প্রেম ও কামময় ইঙ্গিতগুলিকে সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা। প্রথম প্রচেষ্টা দাঁড়িয়ে গেল এইভাবে — টুইচেলের ভাষায় “শব্দের মেঘরচনা”—
Kanthe vimalina mala.
Virahabise dahi bahi gala rayani,
Nahi nahi aola kala.”
heart’s / yearing, striving, worship / has been mixed,হাস্যকর ছেলেমানুষি মনে হতে পারে, কিন্তু আমি ভূক্তভোগী, স্পেনিয় ফরাসি, জর্মন ভাষার কবিতা নিয়ে আমাকেও এরকম উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়েছে অনেকবার। একই কবিতার দুটি বা তিনটি বিভিন্ন আক্ষরিক রূপ তৈরি করাও অন্য ভাষায় বিরল নয়। শেষ পর্যন্ত শব্দের পাহাড় ভেঙে ভেঙে শেষ পর্যন্ত একটি আক্ষরিক অনুবাদ রূপ পেতে লাগল (যদিও সেটি কবিতা পদবাচ্য নয়)।
mingled in heart/
on or around neck / devoid of stain, unsoiled / garland
pain of separation / with poison / bearing, enduring / melted, pass through, be overwhelmed / through or in night /,
not, not (=but [he] never) / come / Dark one(=Krsna).
The desire of hearts he has joined in mine,আমরা যারা কবিতাটির সঙ্গে আকৈশোর পরিচিত এবং মোহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাভি থেকে উঠে আসা যার সঙ্গীতায়ন আমাদের দুকানে মধু ঢেলে দেয়, তারা এখানেই “good enough” বলে হাল ছেড়ে দিতে পারি — কারণ আমরা এখানে রবীন্দ্রনাথকে আবছা হলেও চিনে নিতে পারি। কিন্তু এই সংকলন তো আমাদের মত রবীন্দ্রনাথে সম্পৃক্ত পাঠকের জন্যে নয় — ডাবলিন, নাইরোবি, হোবোকেন বা তেগুসিগালপা শহরে আধুনিক কবিতার যে মনস্ক পাঠক বা পাঠিকা তাগোরের কবিতা পড়তে চান — যিনি ভানুসিংহের ভ-ও জানেন না তাঁর কাছে এ কবিতাটি পাঠযোগ্য মনে হবে কিনা।
On my neck hangs garland unstained,
Afire with parted love’s poison
The night passed - the Dark One never came.
অতএব টুইচেল শুকনো কাঠের এই শক্ত হাড়ে কবিতার মাংস লাগালেন — জুড়ে দিলে রূপক, শিল্পমূর্তি, মানসপ্রতিমা। ভানুসিংহকে আর চেনা যায় না সেখানে — সম্পূর্ণ নতুন একটি কবিতার সৃষ্টি হল —
He never came to me.মূল কবিতার প্রথম বারো পংক্তি দুই অনুবাদকের শিল্পিত রসায়নে আট পংক্তির নতুন ইংরেজি কবিতা হয়ে জন্ম নিল। তার নাম এখন “ভানুসিংহের পদাবলী” নয়, তার নাম “The Lover of God”.
In the whole long dark he never came
To tend my lacerated heart.
I am a girl with nothing, a free
With neither flower nor fruit.
Go home, poor tragedy. Distract yourself
with cleores, dry your eyes. Go on now
dear tattered garland, limp with shame.
অনুবাদের পদ্ধতিটি বিশদভাবে বর্ণনা করার একটি গূঢ় কারণ রয়েছে, যা আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় সম্পৃক্ত। বিদেশি পাঠক পাঠিকার কাছে বাংলা কবিতার পাতে দেবার মতন অনুবাদ করতে হলে এইরকম যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়ে পড়বে। না হলে সে অনুবাদ কবিতা পদবাচ্য হবার সম্ভাবনা কম। বাঙালি কবি নিজে অথবা গভীরভাবে বাংলা জানা কোন ব্যক্তি মূল কবিতাটির লাইন ধরে ধরে আক্ষরিক, মূলানুগ ইংরেজি করবেন। তারপর সেই কাঠামো থেকে কোন ব্রিটিশ বা মার্কিন কবি তাকে কবিতায় রূপ দেবেন।
শেষ করার আগে একটি সুখপাঠ্য, সুমুদ্রিত, সুদর্শন কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় কবিকে মনস্ক মার্কিন পাঠকের সামনে পৌঁছে দেবার জন্যে কপার কেনিয়ন প্রেস (www.coppercanyonpress.org) কে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।