• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • চোরে চোরে মাসতুতো ভাই : নিবেদিতা দত্ত


    ল কাঁটা হাতে ধরাই ছিল, সাপ ডিজাইনও একটু একটু এগোচ্ছিল। স্বর্ণর এরকমই অভ্যাস, হাত খালি যায় না। কখনো নতুন উলে রোদ্দুরের স্কুলের কার্ডিগ্যান বুনে দিচ্ছেন, কখনো বাঁচা উলে রং মিলিয়ে মিনির স্নান করে উঠে পরার ছোট কিছু একটা হাল্কা শীতের জন্য মজুত রাখছেন।

    ওঁর হাত তো চলতেই থাকে, কিন্তু মাথা ফাঁকা যায় না। এই যেমন এখন, কেবল ডিজাইনটা ঠিক জোড়া সাপের মত উঠছিল, কিন্তু মাথায় ওই সাপের মতোই একটা চিন্তা পাক দিয়ে, খুলে আবার পাক দিয়ে উঠছিল—ওদের মতোই উনিও ভাবছিলেন তুলি কোথায় বেপাত্তা হ’ল।

    ওরা মানে স্বর্ণর দুই নাতি নাতনী—রোদ্দুর আর মিনি। এই খানিক আগেই ওঁর ঘরে এসে আচার নিয়ে গেছে—ওটা ওদের ডেলি রুটিনের মধ্যেই পড়ে কিনা। কিন্তু মুখগুলো ওদের শুকনো, গম্ভীর। কারণ আর কিছুই না—ওই তুলি—ওদের আধ-পোষা সাদা বিড়ালছানা। আধা এই জন্য যে বিড়াল নিয়ে আদিখ্যেতায় অনুরূপা বড় রকম ‘না’ করে রেখেছে। ও অফিসে বেরোলে এরা রান্নামাসির চোখ এড়িয়ে ভাতের পাতের মাছ, নারকেল মালায় দুধটুকু তুলিকে দেয়। তুলি গা ফুলিয়ে কোলে উঠে আদর খায়, ভাত-মাছ ফুরোলেই টুক করে নেমে হাওয়া হয়।

    এইরকমই চলছিল। হঠাৎই দুদিন থেকে সে একেবারে বেপাত্তা। মিনি তো সকালের দুধ ওটসও সরিয়ে রাখছিল কদিন। ওর মতে তুলি যেন রোগা হয়ে যাচ্ছে, ওটস ওর দরকারই দরকার। আর তাছাড়া ওটস মিনির নিজেরই বিতিকিচ্ছিরি লাগে, তার থেকেই যদি তুলির জন্য দু-এক চামচ সরানো যায় মন্দ কি? কিন্তু কই তুলি? সেই যে মাছ ওয়ালার আঁশবঁটির পাশে ভব্যিযুক্ত হয়ে বসেছিল তারপর থেকেই ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।

    দুদিন পরে আজ তাই রোদ্দুর নীচের ক্যারাম ঘরে একটা জ্রুরি মিটিং ডেকেছে। সেই যেমন পুজোর আগে কম্যুনিটি হলে পুজোর আগে ডাকে না! অনেকটা তেমনই। বলে দেওয়া হয়েছে চা বিস্কুট মানে ক্রীম বিস্কুট, টক মিষ্টি চানাচুর যে যা পারবে আনতে পারে।

    খেলতে যাওয়ার ঘণ্টা খানেক আগেই ওদের জমা হওয়ার কথা। ভোঁ-কাট্টা আগে ভাগে এসে পড়ে রোদ্দুরের পায়ের কাছে লেজ নাড়ছে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ও একটা কিছু আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল ঘটনাটা কি ঘটল। বিশেষ কিছু বোধহয়—ক্যারাম বোর্ডের ওপর কুরকুরে, অরেঞ্জ ক্রীম, হজমি—বেশ কটা তো জমা হয়েছেই।

    রোদ্দুর আর মিনি তো আগেই নেমে এসেছিল দোতলা থেকে। আগে আগে স্বর্ণও নেমে আসতেন এমন কোনো ঘটনা ঘটলে। রান্নামাসিকে বলে লুচি আলুভাজাও করিয়ে দিয়েছেন কতবার। কিন্তু এবার মাসি মেয়ের বাড়ি চাকদহ গেছে, অনুরূপা যা পেরেছে সামাল দিয়েছে। কোমরে হঠাৎ শিরটান লেগে উনি নিজেও নীচে নামতে পারেন নি। রোদ্দুর বলেছে মিটিংএ কি হল রাতে শুতে যাবার আগে ঠাম্মাকে বলে যাবে। ভোম্বল শাওনি আর ছোট খোকাও হাজির হ’ল বলে। সাইকেল দিয়ে গেটে ধাক্কা মেরে ওরাই তো ঢোকে।

    ভোম্বল কটা টিফিন কেক রাখতে গিয়ে স্ন্যাক্সগুলোর দিকে চোখ ফেলেই ভাবছিল মিটিংটার আগে যদি ইটিংটা হয়ে যায় বা দুটোই যদি অল্টারনেটলি চলে মন্দ কি! আফটর অল দুটোই তো মুখের কাজ, কিন্তু রোদ্দুর আবার এসব পছন্দ করে না, কাজের সময় কাজ। আর ও যা বলবে তা-ই হবে; নট নড়ন চড়ন নট কিস্যু।

    যাইহোক, এক এক করে সবাই বলে গেল কে কখন তুলিকে শেষ দেখেছে—দেখা গেল ওই মাছওয়ালা রহমতের পাশেই তুলি বসে ছিল। শুধু মিনি একটা ইমপর্টেন্ট সুত্র যোগালো। ও তুলিকে ওই বিশ্রী হোঁৎকা শ্যামবাবুর সাইকেলের পিছনে ছুটতে দেখেছে। ওনার দেঁতো হাসিটা মিনি ভুলতে পারছে না। রাত্রে ঠাম্মাকে বলাতে উনিও মিনির দেখাটায় জোর দিলেন।

    সেই সূত্র ধরেই প্রস্তাব দেওয়া হ’ল শ্যামবাবুর ভাঙ্গা জিরজিরে বাড়ির পিছনে জঙ্গুলে বাগানটায় ঢুকে দেখা যেতে পারে যদি কোনো হদিস পাওয়া যায়। ঠিক হ’ল শ্যামবাবু মাছের আড়তে বেরিয়ে গেলেই ওরা সাইকেল নিয়ে এগোবে। শনিবার তো ওদের ছুটি, কিন্তু মার অফিস থাকেই, এমন মওকা ছাড়া উচিত নয়। ঠাম্মাকে কিন্তু আধা সত্যিটাই বলে গেল রোদ্দুর—‘এই তুলির খোঁজে একটু এদিক ওদিক যাচ্ছি।’ শ্যামবাবুর বাড়ির কথাটা বাদ দিয়ে রাখলে; ঠামুইকে বেশি ভাবানোটা ঠিক হবে না।

    সেইমতো পরদিন ওরা দুটো সাইকেলে রওনা দিল। রোদ্দুরের পিছনে মিনি, আর ভোম্বল কায়দা করে সামনে ছোট খোকা আর ক্যারিয়রে শাওনিকে তুলে নিল। ভোম্বল এসব কসরত একটু দেখাতে ভালবাসে, রোদ্দুর গা করে না। ভোঁ-কাট্টা ওদের পিছন পিছন ছুটল।

    শ্যামবাবুর বাড়ির নোনা পাঁচিলের গায়ে সাইকেল ঠেসিয়ে যেই ওরা বাগানে ঢুকব ঢুকব করছে, অমনি পড়বি তো পড় এলাকার পাহারাদার লচ্ছুরামের সামনে। ‘হেঁই খোঁকা বাবুলোগ, বগানে ঢুকবিক লাই, সাঁপ উঁপ্ থাগতে পারে, সো হামি বলিয়ে দিলাম, হঁ’। (আসলে রোদ্দুররা প্রায়ই বাজারের কাছে লচ্ছুর টিনের চালাঘরে ওর খাটিয়ায় আড্ডা জমায়। লচ্ছু আটা সানতে সানতে ওর দেশের কিসসা বলে—ডকোইতের কিসসা, শেরের কিসসা। তাই লচ্ছু ওদের ভালবেসেই ফেলেছে, তাই এত চিন্তা ওর)। ‘না, না, কাকু আমরা সে জানি, এই একটু জিরুচ্ছি,’—এই বলে ওরা পাঁচটিতে কালভার্টের ওপর বসে নীচের নালাটায় ঢিল ছুড়তে লাগলো যতক্ষণ না লচ্ছু আড়াল হ’ল রাস্তার বাঁকে।

    তারপর রোদ্দুর সাইকেলে ভর দিয়ে পাঁচিল টপকাল, পর পর ওরা তিন জন। মিনি আর ছোট খোকা ভোঁ-কাট্টাকে নিয়ে সাইকেল দুটোয় নজর রাখল। ছোট খোকা মুখে দু আঙ্গুল পুরে জম্পেশ শিস দিতে পারে। ওর পকেটে একটা ব্যাংবাজিও থাকে, দরকারে ওটাতে কট কট আওয়াজ দিলেও চলে। কথা হ’ল কেউ চেনা এলে ও ব্যাংবাজিটাই আগে বাজিয়ে মুখ লুকিয়ে শিস দিয়ে অ্যালার্ট সিগন্যাল মারবে।

    রোদ্দুর, ভোম্বল, শাওনি বাগানের এক এক দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ভোম্বল আর শাওনি বাড়ির দুপাশে, আর রোদ্দুর বাগানের পোড়ো চালা ঘরটার দিকে পা বাড়াল।

    বেলা বারোটায়ও এই দিকটায় ঘন ঘন ছায়া, ঘাসে পা পড়তেই কি যেন সর সর খস খস করে সরে গেল। ক’টা বাদুড় জামরুল গাছটায় ডানা ঝাপটাল। রোদ্দুর অবশ্য এসবে ডরায় না। ও জানে ফেমাস ফাইভের মত কিছু করতে গেলে মনে অসীম বল থাকা চাই। সঙ্গে একটা ছোটো ফার্স্ট-এড কিটও তো ও রাখে, মামুলি কাটা ছড়ার জন্য। ওর ইচ্ছে ডাক্তার আর ডিটেকটিভ দুটোই হয়, ঠাম্মা বলেছে ডক্টর ওয়াটসন ডাক্তার ছিলেন আবার শার্লক হোমসএর সাথে কেসেও বেরোতেন। আর একজন—কি যেন নাম তাঁর, হ্যাঁ হ্যাঁ ডাক্তার নীহারঞ্জন—ডাক্তারির সাথে সাথে দারুন সব ডিটেকটিভ বই লিখেছেন—নিজের মনেই রোদ্দুর নিশ্বাস ফেলল। কবে যে বড় হবে, কত কি যে ওর সাধ যায়—পুলিশম্যানও হতে ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তিনটে কি একসাথে হওয়া যায়?

    পোড়ো ঘরটার প্যাকিং কাঠের জানলাটা এক ঠেলা মারতেই ঝুলে পড়ল, আর অমনি ‘মিউ!’ ডেকে ধুলো মাখা সাদা বলের মত তুলি লাফিয়ে রোদ্দুরের কাঁধে। বুঝতে আর বা্কি রইল না মাছের লোভ দেখিয়ে শ্যামবাবু তুলিকে এইখানে বন্দি করেছে। ওই একদিন তুলি ওর মাছের আড়তের ইলিশ মাছে মুখ দিয়েছিল । তারই শাস্তি। আর দিবি তো দে, মহাজনের সামনেই। নইলে তো শ্যামবাবু কায়দা করে ওটা ওজন দাঁড়িতে ঠিক চালান করে দিতেন। একেবারে টাটকা ইলিশ! সেই রাগেই তুলি হাপিশের প্ল্যান। যেমন তুলি, বাড়িতেই তো খাস—কিন্তু পেটুকপনা ঘোচে না।

    এসব ভাবতে ভাবতেই ছোট খোকার সিটি কানে এল। ভোম্বল শাওনিকে তুলি দেখিয়েই পাঁচিলের ওপারে ওকে ছুঁড়ে দিল রোদ্দুর। আর নিজেরা শ্যাওলা ধরা দেওয়াল টপকে রাস্তায় পড়তেই—শ্যামবাবু। দু’দলই সব বুঝল। তবে কথা না বাড়িয়ে তুলিকে ঝুলিতে ভরে ওরা স্পীডে উধাও হ’ল। আর শ্যামবাবু দেঁতো হাসি হেসে গেটের তালা খুলতে লাগলেন। উনি তুলিকে চুরি করেছিলেন, এরা চুরি করেই তুলি উদ্ধার করলে; চোরে চোরে যখন মাসতুতো ভাই তখন থানা পুলিশে আর কি কাম?


    —০—

    পুনঃ কদিন পরেই বিশ্বকর্মা পুজো—তুলি উদ্ধারের আনন্দে ঠাম্মা সেদিন লুচি মাংস মিহিদানার জোর ফিস্টির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সময়ের ফল, রান্নামাসির গ্রামের বাতাবি লেবু তো ছিলই—আর ছিল প্রাইজ হিসেবে ঘুড়ি লাটাইয়ের জন্য কড়কড়ে দুশো টাকার একটা নোট!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)