• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • সম্রাটের ছোরা : রূপা মণ্ডল



    (১)

    লো, ব্যাগ গুছিয়ে নাও, আমাদের বেড়ানোর প্রোগ্রাম রেডি!

    বাবা আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই হৈ হৈ করে ঘোষণা করলেন। মাকে বললেন, "এই নাও, হোটেল বুকিং কনফার্মেশন।"

    মা জিজ্ঞাসা করলো, "দাদারাও যাচ্ছেন তো?"

    —হ্যাঁ, ওদের জন্যেও রুম বুক করে নিয়েছি।

    পড়ার ঘর থেকে অর্ক ছুটে এসেছিল। সে এতক্ষনে জিজ্ঞাসা করলো, "আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?"

    —আমরা যাচ্ছি দীঘা আর মন্দারমণি। পর পর দিন তিনেক ছুটি। ওখানে বেশ শান্ত নির্জন পরিবেশ। ছুটি কাটানোর পক্ষে খুব উপযুক্ত জায়গা।

    অর্করা বহুদিন কোথাও বেড়াতে যায় নি। বাবার অফিস ছুটি দিতেই চায় না। তার উপরে অর্কর ক্লাস নাইনের পড়াশোনা, পরীক্ষা তো আছেই। মাও সারাদিন বাড়ির কাজ সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই দিন পনেরো আগে রাত্রে খাওয়ার টেবিলে বসে আলোচনা হচ্ছিল যে, আগামী ২৬-শে জানুয়ারি শুক্রবারেতে যে ছুটিটা পাওয়া যাচ্ছে তার সাথে শনিবার একটা দিন অফিস ছুটি নিয়ে নিলেই রবিবার পর্যন্ত পর পর তিন দিন ছুটি পাওয়া যেতে পারে। এই তিন দিনের ছুটিটা কিভাবে উপভোগ করা যায়? তখনই বাবা বলেছিলেন, "চলো, তাহলে তিনদিনের ছুটিতে কাছাকাছি কোথাও থেকে একটু বেড়িয়ে আসা যাক।"

    কিন্তু কাছাকাছি বলতে কোনখানে? দীঘা, তারাপীঠ, শান্তিনিকেতন কয়েকবার ঘোরা হয়ে গেছে। তাই মায়ের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না সেখানে যাওয়ার। সে কারণে বাবা এবারে মন্দারমণিতে হোটেল বুকিং করেছেন। অর্কর অবশ্য বেড়াতে যেতে পারলেই আনন্দ। দিন কয়েকের জন্যে হলেও তো এই বাড়ি আর স্কুলের চার দেওয়ালের বাইরে যেতে পারছে!

    ওদিকে বাঁকুড়ার বাড়ি থেকে জেঠুরা যাবে শুনেও ওর খুব আনন্দ হচ্ছে। কারণ জেঠুরা গেলেও জেঠুর ছেলে দীপদাও যাবে নিশ্চই। আর যাবে জেঠুর মেয়ে পুঁটি। অবশ্য ওর ভালো নাম পূবালী। অর্করাই ওকে "পুঁটি" বলে ডাকে। পুঁটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। দীপদা এখন কলকাতার একটা নামি কলেজে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে। কিন্তু খেতে বসে বাবার কাছে শুনলো দীপদা যেতে পারবে না, ওর কি যেন একটা সেমিস্টারের পরীক্ষা আসছে তাই। যাক যে, পুঁটি তো যাবে। ওর পিছনে লেগেও একটু মজা করা যাবে। ওকে খেপিয়ে যে কি আনন্দ!


    (২)

    নির্দিষ্ট দিনে ভোরবেলায় একটা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে অনির্বাণ ছেলে অর্ক আর স্ত্রী শর্মিলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মন্দারমণির উদ্দেশে। পুব আকাশে তখন দিনের নতুন সূর্যটা সবে উঁকি দিয়েছে। রাস্তায় স্বাস্থ্যসন্ধানীদের ভিড়। গাড়ি চললো ভোরের গন্ধ মেখে। গাড়ি চলছে ভালোই স্পিডে। কত অচেনা রাস্তা, বাড়ি-ঘর পার হয়ে যেতে যেতে অর্ক গুন্ গুন্ করে উঠলো। অর্কর মা মোবাইল ফোনে ছবি তুলেই চলেছে। এই এক মায়ের নেশা, যেখানেই পারবে মোবাইলে ছবি তুলবে আর ফেসবুকে পোস্ট করবে। বাবা বেশ অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দৃশ্যপট দেখে চলেছে। মাঝে মাঝে কমেন্ট করছে। মোবাইলে জেঠুদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। ড্রাইভার কাকুও খুব খোশমেজাজে রয়েছে। গাড়ির মিউজিক সিস্টেমের ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দিয়েছে।

    নানা ধরনের সাইনবোর্ড দেখে অর্ক পড়ে নিচ্ছিল জায়গার নামটা। অবশেষে ওরা কোলাঘাটে এসে গেলো। কিছুটা যাওয়ার পর ওদের গাড়ি গিয়ে থামলো শের বেঙ্গল হোটেলের সামনে। দেখল জেঠুদের গাড়িও ওখানে এসে গেছে তার আগেই। পুঁটি ওদের দেখে ছুট্টে এল। সবাই মিলে হৈ হৈ করে ভিতরে ঢুকে একটা কেবিনে বসে খাবারের অর্ডার দেওয়া হলো। অর্কর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো মালাই চা। ছোট ছোট মাটির গ্লাসে ধূমায়িত চায়ের স্বাদ তুলনাহীন।

    হোটেল থেকে বেরিয়ে আবার সবাই মিলে যে যার গাড়িতে। গাড়ি চললো গ্রাম, জনপদ, দোকানপাট, মাঠঘাট পেরিয়ে গন্তব্যের অভিমুখে। মন্দারমণির জনপদের প্রায় একেবারে শেষে সমুদ্রের গা-ঘেঁষে গড়ে ওঠা নতুন একটি রিসোর্ট--চারিদিকে ঝাউবন, বালির পাহাড় আর সামনেই অন্তহীন সমুদ্র।

    যেতে যেতে দুপুর; সবারই ক্ষিদে পেয়েছিল ভীষণ। ঠিক হলো আগে খাওয়াদাওয়া করে তারপরে সমুদ্রে স্নান করা হবে। বেশিরভাগই বাঙালি পর্যটক--খাবারেও বাঙালিয়ানা পুরোদস্তুর। ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, ফুলকপির তরকারি, সর্ষে বাটা দিয়ে পমফ্রেট মাছের ঝোল, ধনেপাতা দিয়ে টমেটোর চাটনি আর পাঁপড় ভাজা।


    (৩)

    এখানে এসেই অর্ক একটা জিনিস লক্ষ্য করল। খাবার ঘরে দু'জন অবাঙালি লোক সবার মধ্যে কেমন যেন বেমানানভাবে সামনে পরোটা-সবজি জাতীয় খাবার সাজিয়ে রেখে সমানে ফোনে কার সাথে কথা বলে যাচ্ছে। একজন বেশ লম্বা আর একজন ঈষৎ বেঁটে। সবাই খেয়ে উঠে গেলেও ওরা কিন্তু উঠলো না। ফোনে কথা বলার কারণে ওদের খাওয়াও শেষ হচ্ছে না। হোটেলের পরিবেশনকারী লোকগুলো খুব বিরক্ত হচ্ছে; কারণ তারা টেবিল পরিষ্কার করতে পারছিল না।

    বাবা, জেঠু, মা, জেঠিমা ওদের তাড়া দিচ্ছিল সমুদ্রে স্নান করতে যাওয়ার জন্যে। তাই পুঁটি আর অর্ক দোলনা থেকে নেমে পড়ল। সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে ওরা সমুদ্রে স্নান করতে গেল। কিছুক্ষন জলে থাকার পরে সবাই তাড়াতাড়ি জল থেকে উঠে পড়লো। জানুয়ারির শেষেতে এখনও ভালোই ঠান্ডা। বেশ শীত করছিল।

    ওরা ফিরে এসে দেখল সেই লোক দুটো তখনও খাবার নিয়ে বসে! অন্য টুরিস্টরা কেউ বাইরে নেই। সবাই বোধহয় খেয়ে-দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। ওরাও নিজেদের ঘরে চলে গেল।

    দুপুরে অর্কর ঘুম আসে না। ও পুঁটিকে ডেকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসল। ছাদের উপরেও কয়েকটা ঘর আছে। তবে কিছুটা অংশ ফাঁকা। এখনও সেখানে কোনো ঘর বা কিছু হয়নি। খানিক্ষন বাদে সেই অবাঙালি লোকদুটো সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে ওদের দিকে একটু তাকিয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকে গেল। লম্বা লোকটার দোহারা চেহারা, চুলগুলো একটু বড় বড়, কানের দুপাশে মোটা ঝুলফি আছে, চশমা পরে। অন্যটা একটু মোটা, বেঁটে, মাথার পিছনে টাক আছে, নাকটা বল্টুর মতো, কুতকুতে চোখ।

    পুঁটি ওর সংগ্রহের ঝিনুকগুলো অর্ককে দেখাচ্ছিল। খেলাচ্ছলে পুঁটি একটা বড়োসড়ো ভাঙা ঝিনুক ছুঁড়ে দিলো একটু দূরে —সেটা গিয়ে পড়লো ওই লোকদুটোর ঘরের সামনে। পাছে কারো পা কেটে যায়, তাই অর্ক পুঁটিকে একটু ধমক দিয়ে সেটা কুড়িয়ে আনতে গেল। হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে কয়েকটা কথা ভেসে আসতেই অর্কর কান খাড়া! মোটা স্বরে কেউ বলছে, "ইস্কা ভাও হোগা বাইশ লাখ রুপিয়াকা আশপাশ! কোই মামুলি চিজ নেহি হ্যায়।"

    অন্য আর একজন বলছে, "আর ইউ সিওর? ইতনা ভাও হোগা?"

    —হাঁ, জরুর। ম্যায় ঝুট নেহি বোলতা। ইয়ে মুঘল এম্পায়ার কা জমানা মে...বাবর...নেহি নেহি, আকবর ইউজ করতা থা, ইয়ুধ মে!

    —ঠিক হ্যায়, দেখো, কাল শর্মাজী ক্যা ভাও বলেঙ্গে।

    অর্কর মনে পড়ে গেল দিনকয়েক আগেই ও খবরের কাগজে পড়েছে কলকাতার জাদুঘর থেকে নাকি বহু পুরোনো ও মূল্যবান একটি ছোরা চুরি হয়ে গেছে যেটি একদা সম্রাট আকবর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের সময়ে ব্যবহার করেছিলেন। ছোরাটির অগ্রভাগে দামাস্কাস স্টিল দ্বারা নির্মিত ফলা ছিল, সাদা জেড পাথরের হাতলের উপরে সোনার কারুকার্যের মধ্যে মধ্যে বর্মা রুবি খচিত ছিল। মুঘল যুগের অপরিসীম বিলাসিতার পরিচায়করূপে ছোরাটির হাতলের শেষপ্রান্তে একটি মস্তবড় রুবি আটকানো ছিল। সপ্তদশ শতকের এই ছোরাখানি সে যুগের উন্নততম হস্তশিল্পের পরিচয় বহন করে বর্তমানে যার আনুমানিক মূল্য বাইশ লক্ষ, চুয়াল্লিশ হাজার টাকার মতো।

    ওদের কথোপকথন শোনার পর থেকেই অর্কর হার্টবিট অনেকগুন বেড়ে গেছে! কিভাবে ওই মূল্যবান জিনিসটি সে ওদের খপ্পর থেকে উদ্ধার করবে তা ভেবে পেল না। অগত্যা পুঁটিকে নিয়ে সে নিচে নেমে এল।


    (৪)

    পড়ন্ত সূর্যের আলোতে চিক চিক করছে সমুদ্রের জল, বালির উপরে জল উঠে মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো দেখাচ্ছে। পুঁটি সমুদ্রের পাড়ে ঝিনুক কুড়োচ্ছিল। আর অর্ক মনে মনে ভাবছিল কিভাবে লোকগুলোর হাত থেকে ওই ছোরাটাকে উদ্ধার করা যায়। সেটা যে খুব সহজ ব্যাপার নয়, তাও সে জানে। পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই দেখলো বাবা। বাবার কণ্ঠে একটু বিরক্তি, "তুই কোথায়? পুঁটি কই? সারা দুপুর ধরে বাচ্ছাটাকে নিয়ে ঘুরছিস কেন সমুদ্রের পাড়ে? ফিরে আয় তাড়াতাড়ি।"

    পুঁটির হাত ধরে অর্ক গেটের ভিতরে ঢুকে দেখল ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের আলো এসে রিসোর্টের ভিতরে লুকোচুরি খেলছে যেন। লনের ছাতার নিচে সেই অবাঙালি লোকদুটো আবার ফোন নিয়ে বসে পড়েছে। ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন, "রেডি হয়ে নে, আমরা একটু বেড়াতে যাবো।"

    একটু বাদেই চা আর বিস্কুট খেয়ে অর্করা সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে ওঠার আগে দেখল সেই মোটা, বেঁটে লোকটা কুতকুতে চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশের লম্বা লোকটাকে কি যেন বলছে। সেও ওদের দিকে চোখ তুলে তাকালো একবার। রিসোর্টের একজন কর্মচারী এক প্লেট গরম পকোড়া নিয়ে লোক দুটোর টেবিলের দিকে গেল।

    ***

    ওল্ড দীঘা আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। সমুদ্রের ধারটা খুব সুন্দরভাবে বাঁধিয়ে বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। ওখানে অনেক্ষন সময় কাটিয়ে ওরা দোকানে কেনাকাটা করতে গেল। পুঁটি একটা টুপির জন্যে বায়না জুড়ে দিল। মা আর জেঠিমা নানা ধরনের সুন্দর ব্যাগ দেখে দরদাম করতে ব্যস্ত। বাবা অর্ককে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করলো, "কি দেখছিস?"

    —দেখো, ওই সুন্দর হাতলওলা ছুরিটা!

    —ও তো পুরী বা দীঘার সর্বত্রই পাবি। ঝিনুক দিয়ে হাতলে কারুকাজ করেছে।

    —একটা কিনে দাও না!

    —ভালোই ধার আছে কিন্তু। হাত কেটে যেতে পারে।

    —দাও না বাবা!

    —ঠিক আছে, দাম কর। বেশি দাম হলে নিবি না কিন্তু।

    অর্ক ঘাড় নেড়ে দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। দোকানদার প্রথমে আশি টাকা বলল, তারপর আস্তে আস্তে দাম কমিয়ে পঞ্চাশ টাকাতেই দিয়ে দিল।


    (৫)

    রিসর্টে ফিরে আসার পরেও অর্ক লক্ষ্য করল লোক দুটো তখনও লনে চেয়ার দখল করে বসে আছে। তবে ফোনে কার সাথে যেন নিচু গলায় কথা বলছিল। অর্ক ইচ্ছা করেই পাশের দোলনাতে বসে একটু দোল খেতে লাগল।

    —নেহি নেহি। হম ইতনা কম রেট মে নেহি দেঙ্গে। আউর থোড়া বঢ়ানা হোগা।

    অর্ককে একটু কাছাকাছি বসতে দেখে লোকটার গলার স্বর আরো কম হয়ে গেল,

    —ঠিক হ্যায়। হমলোগ কাল বাত করেঙ্গে।

    ওদিকে খাবার জন্য সবাইকে ডাক দেওয়া হয়েছে। তাই ওই লোক দুটোও চলল খাবার ঘরের দিকে। পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ডের একদম ধারে সি বিচের দিক ঘেঁষে খাবার ঘর। তার একপাশে রিসেপশন। সকালে ও দুপুরে খেতে খেতে সমুদ্র দেখা যায়, রাত্রে সব ঘন অন্ধকারে ঢাকা। তবে দূরের কয়েকটা রিসর্টের আলো দেখা যাচ্ছে।

    অর্ক ইচ্ছা করেই আজ খুব আস্তে আস্তে খাচ্ছিল। মা জিজ্ঞেস করতে বললো, "আমার ক্ষিদে নেই।" মা বললো, "ঠিক আছে তুই ধীরে ধীরে খা।" খাওয়া-দাওয়া শেষে সব বোর্ডাররা যে যার ঘরে চলে গেছে। অর্ক লক্ষ করল রিসেপশনে এখন কেউ নেই —এই ফাঁকে সে রিসেপশনে ম্যানেজারের ড্রয়ার থেকে ওই লোক দুটোর ঘরের মাস্টার-কি নিজের পকেটে পুরে নিল। তারপর যত দ্রুত সম্ভব হাত ধুয়ে নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দেখলো শুধু ওই লম্বা আর বেঁটে লোক দুটো লনে বসে আছে ছাতার তলায়।

    হঠাৎ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল সে, সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়। চাবি দিয়ে আলতো করে চাপ দিতেই খুট করে খুলে গেল দরজা। ঘর অন্ধকার! দরজার ছিটকানি লাগিয়ে দিলো ভেতর থেকে। এবারে পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে জ্বালল। দুটো ছোট সুটকেস, একটা ট্রলি ব্যাগ। চাবির গোছাটা ট্রলির ভিতরে একটা চেন-টানা খাপের মধ্যেই মিলল। সব জিনিস সরিয়ে দেখার পরেই একটা সুটকেসের মধ্যে কাগজ মোড়ানো নরম গোছের একটা জিনিস পেল। চট করে মোড়কটা খুলে ফেলল, কাপড়ের ভাঁজে রাখা আছে সেই বহু আকাঙ্খিত বস্তুটি —সম্রাটের ছোরা! অপূর্ব কারুকার্য! দেখলে চোখ সরানো যায় না। অর্ক টের পেল কেউ যেন উপরে উঠে আসছে। সে দ্রুত ছোরাটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে লুকিয়ে পড়ল দরজার পাশে। বাইরে লোক দুটোর গলা পাওয়া যাচ্ছে।

    —আরে, পানি কা বটল কাঁহা ছোড়কে আয়া? চলো, ঢুঁড়না হোগা।

    দুজনেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। অর্কর বুকের মধ্যে ঢিপঢিপানিটা এবারে একটু একটু করে কমছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে সে আসতে আসতে পা টিপে টিপে নিচে নেমে এল। নাহ্‌, কেউ দেখে নি। সবাই যে যার রুমে শুয়ে পড়েছে। রিসর্টের কর্মচারীরা খেতে ব্যস্ত। অর্ক খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল।


    (৬)

    সারা রাত অর্কর ভালোভাবে ঘুম হলো না। লোক দুটোর খপ্পর থেকে কিভাবে ছোরাটা উদ্ধার করা যায় তাই ভাবছিল। আফশোষ হচ্ছিল যে, হাতে পেয়েও জিনিসটাকে ও নিয়ে আসতে পারল না। ওরা যাকে বিক্রি করে দেবে সে হয়তো জিনিসটাকে বিদেশে চালান করে দেবে। এভাবেই আমাদের দেশের কত মূল্যবান জিনিস বিদেশে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই সব ক্রিমিনালদের সর্বদা ধরাও যায় না।

    অর্ক একবার ভেবেছিল বাবা-মা বা জেঠুকে জানাবে ব্যাপারটা। পরক্ষণেই মত পরিবর্তন করল। বাবা-মা কিংবা জেঠু জানলেই সঙ্গে সঙ্গে রিসর্ট বা হোটেল পরিবর্তন করে নেবে। বেড়াতে এসে তারা কোন ঝামেলার মধ্যে জড়াতেই চাইবে না। কে নিজের ঘাড়ে বিপদ ডেকে আনতে চায়? শুধু শুধু থানা-পুলিশের ধারেকাছে যেতে চায় না কেউ। কিন্তু ঐতিহাসিক স্মৃতি সম্বলিত একটি মূল্যবান সামগ্রীকে দেশের বাইরে চলে যাওয়া থেকে আটকাতেই হবে - যে করেই হোক। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল সে।

    ভোরের দিকে সবে ঘুমটা এসেছিল; অর্কর বাবা জোর করে ওকে ডেকে দিল, "এই চল চল, সবাই সূর্যোদয় দেখতে যাচ্ছে, তুইও চল।"

    অর্ক ঘুম জড়ানো গলায় বললো, "তোমরা যাও, আমাকে ঘুমোতে দাও।"

    অগত্যা অর্কর বাবা আর মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ক আবার ঘুমোবার আয়োজন করছিল। কিন্তু পুঁটি এসে জোরজবরদস্তি অর্ককে ঠেলতে লাগল, "এই দাদাভাই, ওঠ না রে!"

    সুতরাং আর ঘুমোনো সম্ভব হলো না। জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে নিয়ে পুঁটির সাথে যেতেই হলো সি বিচে। তবে এখানে না এলে অর্ক সত্যিই খুব ভালো একটা জিনিস মিস করতো। কুয়াশামাখা ভোরে কিভাবে সমুদ্রের মাঝে সূর্য ওঠে সে এক অপরূপ দৃশ্য। সেই সুন্দর দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার জন্য পর্যটকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে যেন। অর্কও বেশ কিছু ছবি তুললো। বন্ধুদের দেখাতে হবে তো?

    অর্ক লক্ষ্য করলো সেই অবাঙালি লোকগুলো কিন্তু এদের মধ্যে নেই। তাদের এসব নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। ওরা নিশ্চয়ই দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে। অর্কর জেঠু রিসর্টে ফিরে ঘোষণা করলেন, "আমরা চা খেয়ে স্নান করে নয়টা নাগাদ বেড়াতে যাবো চন্দনেশ্বর, তালসারি, শঙ্করপুর, মোহনা আর দেখবো একোরিয়াম।"

    মা আর জেঠিমা রান্নাঘরের দিকে গেলেন রিসর্টের কর্মীদের চা দিতে বলার জন্য। অর্কর ঠিক বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করছে না, কারণ সে ভাবছিল কিভাবে ওটাকে উদ্ধার করে আবার মিউজিয়ামে ফেরত পাঠানো যায়। কিন্তু শরীরটা ভালো নেই বলতেই বাবা ব্যস্ত হয়ে বললো, "তবে এক্ষুনি ওষুধ খেয়ে নে, বেড়াতে এসে ঘরে শুয়ে থাকবি —তা কি হয়?"

    চা খেয়ে সবাই তৈরি হতে লাগলো। অর্ক দেখলো আপত্তি করে বিশেষ লাভ নেই, তার ফলে সবারই বেড়াতে যাওয়াটা পণ্ড হবে তাই সে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিল। কিন্তু ওর মন পড়ে রইল সেই ছোরাটার দিকে। কখন সেই লোক আসবে, আর কিনে নিয়ে যাবে ছোরাটা —কে জানে।

    ওরা যখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে তখন দেখল লোক দুটো ঘুম থেকে উঠে ওই ছাতার নিচে এসে বসেছে, সামনে দু-কাপ চা। হঠাৎ ম্যানেজারবাবু হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে রিসর্টের কর্মীদের কি নিয়ে যেন বকাবকি করতে লাগলেন। "মাস্টার কি" কথাটা দু'বার কানে এল।

    অর্ক বাধ্য ছেলের মতো গাড়িতে উঠে পড়ল।


    (৭)

    বিকেল তিনটে নাগাদ ওরা আবার রিসর্টে ফিরে এলো। সবাই অনুভব করল, ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। রিসর্টে ফোন করে আগে থেকেই খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল। তাই ফিরে এসে খাবার পেতে অসুবিধা হলো না। আজকের আইটেমের মধ্যে শুক্তোও ছিল। সবাই খুব তৃপ্তি করে খেল।

    খাওয়ার শেষে সবাই যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে গেল। অর্ক একটুবাদেই ছটফট করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। ওর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, "কোথায় যাচ্ছিস?"

    —এই ভেতরেই ঘুরবো একটু।

    দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখলো সেই লোকদুটো ছাতার নিচে বসে বসে আছে। অর্ক খুব সাবধানে উল্টো দিক দিয়ে দোতলার ছাদে গিয়ে উঠল। উপরের ঘরগুলোর সব ক'টা দরজাই বন্ধ। নিচেও রিসর্টের কর্মীরা ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। অর্ক পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল লোকদুটোর ঘরের চাবি আর ছোট পেন্সিল টর্চটা ঠিক আছে। দেওয়ালের আড়াল থেকে সাবধানে টুক করে ওদের ঘর খুলে ভেতরে ঢুকল।

    সুটকেস দুটো একই জায়গাতে আছে। ট্রলির মধ্যে সেই খোপেই রয়েছে চাবি। চাবি দিয়ে নির্দিষ্ট সুটকেসটা খুলে জিনিসপত্রের নিচে থেকেই মিলল সেই মোড়কটা। হ্যাঁ, সব একই রকম আছে। কাপড়ের ভাঁজ থেকে সম্রাটের ছোরাটা বের করে নিয়ে তার পরিবর্তে ও ভিতরে রেখে দিলো ওল্ড দীঘা থেকে কেনা সেই ছুরিটা। আবার জায়গামতো সব রেখে ছোরাটা খুব সাবধানে জামার ভিতরে পুরে নিয়ে ঘরে চাবি দিয়ে বেরিয়ে এলো। উঃ, জীবনে এমন কাজ আগে কখনো করে নি সে! বুকটা ভীষণ ঢিপ ঢিপ করছে! দেওয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চুপি চুপি দেখল লোকদুটো নিচে বসেই আছে।

    —এখানে কি করছ?

    চমকে পিছনে ফিরে দেখলো ম্যানেজার লোকটা কখন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্কর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে লোকটা আবার বললো, "দুপুরবেলায় বাইরে একা একা ঘুরো না। তাছাড়া আমাদের ছাদে এখনো রেলিং বসানো হয় নি, ওপরে বেশি উঠো না।"

    অর্ক কিছু না বলে নিচে নেমে এসে সোজা নিজেদের ঘরে ঢুকে গেল।

    দরজা ভেজানোই ছিল। মা ঘুমোচ্ছে, বাবাও টি.ভি. দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ক চুপি চুপি নিজের ব্যাগের মধ্যে ছোরাটা রেখে দিয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়ল।

    অর্ক সন্ধেবেলায় ঘরের বাইরে বেরিয়ে একটু অবাক হয়ে দেখলো ম্যানেজার লোকটা ওই লোকদুটোর সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছে। অর্ককে দেখে ফিসফিস করে কি যেন একটা নিজেদের মধ্যে বলাবলিও করল। লোকগুলো আজও পকোড়া খাচ্ছে!

    ঠিক সন্ধ্যাবেলায় একটা সাদা কোট-প্যান্ট পরা লোক গাড়ি চেপে এসে হাজির। প্রথমে রিসর্টের লোকেরা ওই লোকটার গাড়িটাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তারপরে সেই অবাঙালি লোক দুটো এসে, "হমলোগ কা জানপহচান হ্যায়। হমলোগসে মোলাকাত করনে আয়া।" এইসব বলে লোকটাকে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর রিসর্টের এক কর্মী তিন কাপ কফি নিয়ে ওদের ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

    তার কিছুটা পরেই ওই ঘর থেকে বীভৎস চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল--"মুঝকো ঝুট বোলা? মেরেসে মজাক কিয়া?" রিসর্টের দুজন লোক দৌড়ে গিয়ে দেখতে গেল কি হয়েছে। ততক্ষণে সেই সাদা কোট-প্যান্ট পরা লোকটা সবাইকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বসে পড়েছে নিজের গাড়িতে। গাড়ির পাশে যে দুজন ষণ্ডামার্কা লোক দাঁড়িয়েছিল তারা লোকটার দুপাশে বসে পড়ল, ড্রাইভার অসাধারণ দক্ষতায় একঝটকায় ঘুরিয়ে নিল গাড়িটা। অবাঙালি বোর্ডার দুজন কাকুতি মিনতি করে বলছে, "বিসওয়াস কিজিয়ে হমলোগ ঝুট নেহি বোলা। বিসওয়াস কিজিয়ে...."

    গাড়িটা মুঠো মুঠো ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। লোক দুটো খুব হতাশভাবে বসে পড়ল লনের টেবিলে। মাঝখানে একবার ম্যানেজারের সাথে খুব নীচু গলায় কিছু বলাবলি করছিল। পুঁটির সাথে খেলতে খেলতে সব লক্ষ্য করছিল অর্ক।

    ডিনারের ডাক পড়তেই অর্ক বাবা মায়ের সাথে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। সামনে চিকেনের বাটিটা রাখতেই সুগন্ধে তার জিভে জল চলে এলো। সুরুৎ করে টেনে নিলো সে।

    অর্কর মা বলল, "মাংস পেলে ও আর কিচ্ছু খায় না।"


    (৮)

    খাওয়া শেষ হতেই অর্কর ভীষণ ঘুম পেতে লাগল। সে যেন আর দাঁড়াতে পারছিল না। তখনও সকলের খাওয়া হয় নি। অর্ক উঠে পড়ে হাত ধুতে গেল। হাত ধুয়ে সে একতলায় নিজেদের ঘরের দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ ওই ম্যানেজারবাবু ডাকল, "খোকা, দোতলায় তুমি কি কিছু ফেলে এসেছ? দেখো তো তোমার কিছু হারিয়েছে কি না?"

    অর্ক নিজের পকেটে হাত দিয়ে দেখল, নাঃ কিছুই তো হারায় নি। তাহলে লোকটা এরকম বলছে কেন? কি হারিয়েছে তার?

    —কই, কি জিনিস?

    —একবার দেখো তো ওখানে গিয়ে।

    অর্ক তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। নাহঃ কোথাও তো কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তবে কি লোকটা মিথ্যা কথা বলল? অর্ক নেমে আসার জন্যে যেই না পা বাড়িয়েছে অমনি পিছন থেকে কেউ টেনে ধরল। মুখ চেপে ধরে ওই অন্ধকার ঘরে টেনে ঢুকিয়ে নিল।

    অর্ক টের পেল কানের ঠিক পাশেই ঠেকে আছে রিভলভারের নল। বেঁটে লোকটা পিছমোড়া করে ধরে রেখেছে ওর হাত দুটো। লম্বা লোকটার হাতেই রিভলভার রয়েছে। সে ওর কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞাসা করল,

    --কাঁহা রাখ্যা, বোল?

    --কি? কেন আমায় ধরেছ তোমরা?

    --আহিস্তা বোল। নকরানা করছিস? তু কাঁহা লে কে গয়্যা উও চিজ?

    --আমি বুঝতে পারছি না তোমরা কি বলছ।

    --ঝুট বোলনে সে তুঝকো মার ডালে গা। সচ বোল। কাঁহা রাখ্যা উও চিজ?

    --বলছি তো আমি বুঝতে পারছি না তোমরা কি বলছ।

    বেঁটে লোকটা বলল, "অ্যায়সে নেহি হোগা। উসকো থোড়া দাওয়াই দেনা পড়েগা।"

    এই কথা বলতেই লম্বা লোকটা ওর মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে আঘাত করতেই অর্কর মুখ দিয়ে শুধু "আঁক" করে একটা আওয়াজ বেরোল, তারপরেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।


    (৯)

    —ওমা, অর্ক কোথায় গেল?

    অর্কর মা ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল। অর্কর বাবাও অবাক হয়ে অর্কর জেঠুর ঘরে খোঁজ নিতে গেলে তারাও আশ্চর্য হয়ে গেল! একতলায় দুজনদের পাশাপাশি দুটো ঘর। তবে অর্ক গেল কোথায়? না বলে কোথাও যাওয়ার ছেলে তো সে নয়।

    বাইরে এসে খোঁজ করতেই ম্যানেজার বলল, তাকে সী-বীচের দিকে হেঁটে যেতে দেখেছে। তিনি বারণ করেছিলেন কিন্তু সে শোনে নি।

    অর্কর বাবা আর জেঠু বেশ রেগে গিয়ে বললেন, "আপনি তখনই সে কথা আমাদের বললেন না কেন?"

    --আমি কি করে জানব যে সে দূরে কোথাও চলে যাবে? বড় ছেলে হয়ত সামনে থেকে একটু ঘুরে আসতে চাইছে। তাই আর আপনাদের কিছু বলিনি।

    লম্বা বলে অর্ককে বড়ই দেখায়। কিন্তু অনেক খুঁজেও যখন অর্কর কোন খোঁজ মিলল না, তখন পুলিশকে খবর দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করলেন অর্কর বাবা-মা-জেঠুরা। অর্কর মা ভীষণ কান্নাকাটি করছিলেন, সবাই মিলে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল।

    থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। ম্যানেজার প্রথমে থানা কোথায় বলতেই চায় না। খালি বলে, "সে তো অনেক দূর। আজ রাতে কিভাবে যাবেন, কাল সকালে বরং যান না।"

    অর্কর জেঠু বললেন, "না, আজ রাতেই যাব।"

    প্রায় তেরো কিলোমিটার দূরে মন্দারমণি কোস্টাল থানা। অর্কর মা আর জেঠিমার জিম্মায় পুঁটিকে রেখে একটা গাড়ি নিয়ে অর্কর বাবা আর জেঠু থানায় গেলেন। একজন ড্রাইভার হরিচরণ রিসর্টেই রইল।

    হরিচরণ লনের একটা চেয়ারে বসে ভাবছিল একি বিপত্তি, তার তেত্রিশ বছরের ড্রাইভারী জীবনে সে এমন ঘটনা কখনও দেখেনি। ঠান্ডা লাগছিল বলে সে নিজের ঘরেই চলে যাবে ভাবছিল। কিন্তু যদি খোকাবাবু কোথাও থেকে এসে যায় কিংবা ম্যাডামরা ডাকাডাকি করে, অবশ্য মোবাইলে নিশ্চয়ই ফোন করবে। এই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে সে শুতে যাচ্ছিল।

    ঘরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ সে লক্ষ্য করল ম্যানেজারবাবু লোকটি দোতলার একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন খুব নীচু গলায় কথা বলছে। এত রাতে কার সাথে কথা বলছে লোকটা? সব বোর্ডারদের তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। সে মোবাইল ফোনে দেখল রাত্রি সাড়ে বারোটা বাজে। দেওয়ালের গায়ে সেঁটে গেল সে। রাত্রিবেলা সব আওয়াজই একটু জোরে শোনা যায়। তাই সমুদ্রের গর্জন সত্ত্বেও ওদের কথার আওয়াজ একটু একটু কানে এল তার।


    (১০)

    মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা, একটু জ্বালাও করছে। হাত দিয়ে সেখানটা স্পর্শ করতেই ভিজে ভিজে লাগল। মনে হচ্ছে কেটে গেছে। অর্ক আবছা শুনতে পেল ম্যানেজারবাবু হিন্দিতে বলছে, "ওরা পুলিশে খবর দিতে গেছে। এইবেলা ওকে নিয়ে তোমরা পালাও, নাহলে আমার রিসর্টের বদনাম হয়ে যাবে।"

    লোক দুটো বলছে, "কিভাবে আমরা পালাব? ওতো এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে। আমাদের জিনিসটা কোথায় আছে তাও ওই জানে। তাই ওকে আমাদের এখন চাই।"

    —আমি ওসব জানি না। ওকে নিয়ে তোমরা যেখানে পারো চলে যাও। নাহলে আমার রিসর্টের বদনাম হলে আমি মুশকিলে পড়ে যাব!

    —ঠিক আছে। আমাদের একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিন।

    —এত রাতে গাড়ি কোথায় পাব?

    —তাহলে ওকে নিয়ে আমরা যাব কি করে?

    —ওকে অজ্ঞান করার দরকার কি ছিল? একটু ভয়টয় দেখিয়েই তো জেনে নিতে পারতেন। বাচ্চা ছেলে!

    —ও মোটেও বাচ্চা নয়। ও আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করেছে! যদি আমাদের পালাতেই হয়, ওকে খুন করে ফেলে দিয়ে যাব!

    —খবরদার না। কোন খুনোখুনি করবে না। আমাদের বদনাম হয়ে যাবে।

    —হোক তোমাদের বদনাম… আমরা ওকে ছাড়ব না। তাছাড়া এই কাজে সাহায্য করার জন্য তোমাকেও টাকা দিয়েছি আমরা। এখন তুমি আমাদের খালি হাতে চলে যেতে বলছ? চালাকি পেয়েছ? ওর সাথে হাত মিলিয়ে জিনিসটা তুমিও সরিয়ে থাকতে পারো। তোমাকেও আমরা ছাড়ব না।

    অর্ক মরার মত পড়ে থাকল। ওর জ্ঞান ফিরেছে জানলে ওরা ওর ক্ষতি করতে পারে। অন্ধকারে আস্তে আস্তে ওর চোখ সয়ে আসছে। একটা খাটের উপরে সে একটা বড় টর্চ দেখতে পেল। দরকার হলে ওটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

    এবারে ম্যানেজারবাবুর সাথে ওদের একজনের ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। ম্যানেজার ঘরে ঢুকে অর্ককে দেখতে চায়, আর ওরা ঢুকতে দেবে না।

    হঠাৎ লম্বা লোকটা পকেট থেকে রিভলভার বের করল। তারপর দুজন মিলে ম্যানেজারবাবুকে ঘাড় ধরে টেনে ঘরে ঢোকাল। এরপর একটা "আঁক" করে একটা আওয়াজ হল শুধু। নাহঃ আর দেরি করা ঠিক হবে না। হরিচরণ দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে কেউ জিজ্ঞাসা করল, "কৌন হ্যায়?"

    —পুলিশ!

    কোন উত্তর নেই, সব চুপচাপ। হরিচরণ আবার দরজায় টোকা দিল। এবারে দরজা সামান্য একটু ফাঁক হল। ততক্ষণে হরিচরণ দরজার সামনে থেকে সরে গেছে। রিভলভার হাতে একটা মোটা লোক বেরিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে দেখছে। হরিচরণ আগে থেকে রেডি হয়েই ছিল এই রকম পরিস্থিতির জন্য। পাশের অন্ধকার গলির মতন জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এসে অতর্কিতে সে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপর। কুস্তির মোক্ষম প্যাঁচে সে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলল। রিভলভার ছিটকে গেল কোথায় কে জানে। মোটা লোকটা আর উঠতে পারছে না।


    (১১)

    লম্বা লোকটা ম্যানেজারবাবুকে ছেড়ে রিভলভার তাক করল হরিচরণের দিকে। ততক্ষণে অর্ক কোনমতে উঠে দাঁড়িয়েছে। খাটের উপর রাখা ভারী টর্চটা তুলে সে ছুঁড়ে দিয়েছে লম্বা লোকটার দিকে। মাথায় লেগেছে টর্চটা। লোকটা মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়েছে। হাত থেকে খসে গেছে রিভলভার। হরিচরণ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। লোকটাকে মাটিতে ফেলে একটা রুমাল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল তার হাত দুটো। অর্ক তাকে সাহায্য করল।

    মোটা বেঁটে লোকটা এতক্ষণে উঠে এসে আবার ঘরে ঢুকেছে, হাতে রয়েছে একটা ধারাল ও ছুঁচোল ফলার ছুরি। হরিচরণ ডান পায় বিদ্যুৎবেগে এক শট মারল, ছুরিটা ছিটকে গিয়ে পড়ল ঘরের অন্ধকার এক কোণে। তৎক্ষণাৎ সে উপর্যুপরি যুযুৎসুর মোক্ষম এক দাওয়াই দিতেই বেঁটে লোকটাও ধপাস করে উল্টে পড়ল।

    আসলে হরিচরণ যে সে লোক নয়, সে একসময় ভালো কুস্তিগীর ছিল, বেঙ্গলের হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণও করেছিল। কিন্তু অভাবের সংসার, তাই বাড়ি থেকে তেমন উৎসাহ পেত না। পরে কুস্তিতে আর এগোতে না পেরে নিজের পেটের দায়ে গাড়ি চালানোটাকেই পেশা হিসাবে নিয়েছে। অর্কর জেঠু হরিচরণের সেসব গুণের কথা জানেন বলেই তার উপরে খুব ভরসা করেন এবং সেজন্যই অর্কর মা, জেঠিমা আর পুঁটিকে হরিচরণের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রেখে থানায় গিয়েছিলেন ।


    (১২)

    এতক্ষণে রিসর্টের অন্য কর্মীরা জেগে উঠেছে। দুই একজন বোর্ডার বেরিয়ে এসেছে। পুলিশের গাড়িও এসে পড়েছে। সবাই মিলে মোটা আর লম্বা লোক দুটোর হাত দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। হরিচরণকে নিয়ে পুলিশ ওদের ঘরে ঢুকে দেখল একপাশে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ম্যানেজারবাবু আর একদিকে মাথায় আঘাত নিয়ে বসে আছে অর্ক, মাথা থেকে সরু রক্তের ধারা গড়িয়ে এসে শুকিয়ে গেছে।

    ম্যানেজারবাবু আর অর্ককে গাড়িতে করে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে পাঠানো হল। সেই সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল হরিচরণকেও। সেও অল্প-বিস্তর চোট আঘাত পেয়েছে। লোক দুটোর ঘরে ব্যাগ আর সুটকেস সার্চ করে পাওয়া গেল অনেক টাকা, দুটো দেশী রিভলভার, কিছু কাগজপত্র, বিভিন্ন ধরনের ম্যাপ, মাদকদ্রব্য ইত্যাদি। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করে পুলিশ নিয়ে গেল।

    অর্কর বাবা, মা ও জেঠু-জেঠিমা অর্কর সাথেই হাসপাতালে গেলেন। ছেলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না। ডাক্তারবাবু অর্ককে পরীক্ষা করার পর ওর বাবা জানতে চাইলেন আঘাত গুরুতর কিনা। ডাক্তারবাবু বললেন, "ব্রেইন স্ক্যান না করা পর্যন্ত সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে মনে হচ্ছে শুধু মাত্র ফেটে গিয়ে কিছুটা রক্তপাত হয়েছে। পরিপূর্ণ বিশ্রাম আর ওষুধের দ্বারাই সারবে।"


    (১৩)

    মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে অর্ক বেডে শুয়ে আছে। পাশের বেডে ম্যানেজারবাবু। একজন পুলিশ অফিসার ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ওদের সাথে এখন কথা বলা যাবে কিনা। ডাক্তারবাবু বললেন, "বেশি কথা বলবেন না প্লিজ। ঠিক দু'মিনিটের বেশি নয় কিন্তু।"

    ম্যানেজারবাবুর মাথায় আঘাত খুবই গুরুতর এবং কথা বলার মত অবস্থাতে নেই। তাই অফিসার অর্কর পাশে টুলে বসে ডায়েরি খুললেন, "যারা তোমায় মেরেছে তাদের তুমি আগে থেকে চিনতে?"

    অর্ক দু'দিকে ঘাড় নাড়ল, না চেনে না।

    —তাহলে তুমি ওদের ঘরে গিয়েছিলে কেন?

    অর্কর মাথায় সেলাই হয়েছে। মাথায়-মুখে প্রচণ্ড ব্যথা, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে বলল,

    —ওরা একটা মূল্যবান জিনিস চুরি করেছিল। আ.. আমি সেটা....

    আর বলতে পারল না সে। অফিসার শশব্যস্ত হয়ে বললেন, "ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি পরে আবার আসবক্ষণ।" তিনি বুঝলেন যে এখন ওর সাথে বেশি কথা বলা যাবে না।

    অফিসার চলে যেতেই অর্কর মা গিয়ে পাশের টুলে গিয়ে বসে ছেলের গায়ে হাত বোলাতে লাগলেন। তখনই দরজা দিয়ে ডাক্তারবাবু আর একজন নার্স ঘরে ঢুকে অর্কর পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নার্স অর্কর মাকে বললেন, "আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন।"

    অর্কর ব্রেইন স্ক্যান করে দেখা গেছে মাথার ভিতরের আঘাত খুব মারাত্মক নয়। একটা যায়গায় একটু ব্লাড ক্লট আছে, সেটা ওষুধ দিয়েই ঠিক হয়ে যাবে।

    হরিচরণকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে মেদিনীপুরের পুলিশ কমিশনার তাকে সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। অর্কর জেঠুও তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেছেন, "তোমার ঋণ আমরা কখনও শোধ দিতে পারব না। তোমার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। এই সামান্য টাকাগুলো তুমি নিলে বড় শান্তি পাব মনে!"

    সেই শুনে হরিচরণ বেশ কিছুক্ষণ লজ্জায় অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।


    (১৪)

    সাংবাদিকরা খবর পেয়ে ছেঁকে ধরেছিল হরিচরণ ও অর্কর বাড়ির লোকজনদের। পুলিশের নির্দেশ মত তাঁরা বিশেষ কিছু বলেন নি। শুধু বলেছেন, "দুষ্কৃতীরা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ায় আমরা খুব খুশি। হরিচরণ অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, না হলে দুষ্কৃতীদের ধরা এত সহজ হ'ত না। অর্ক সুস্থ হয়ে বাড়ি এলে আমরা ওর মুখ থেকে সব ঘটনা জানতে পারব।"

    অর্কর ব্যাগ থেকে পাওয়া সম্রাট আকবরের সেই মহামূল্যবান ছোরাখানি এখন আরো অনেক বেশি নিরাপদভাবে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামে। যাদুঘর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেও ওদের মানপত্র ও বিশেষ পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

    পরের দিন সমস্ত সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত হল দু’জনের ছবি। অর্কর বাবা কাগজটা খুলেই বললেন, "এই ছবিটা বাঁধিয়ে রাখতেই হবে!"

    অর্কর মা বললেন, "আমি চাইছি অর্ক আর কখনও কোনো ঝামেলায় যেন জড়িয়ে না পড়ে।"

    শুনে অর্কর বাবা বললেন, "সাহসী, নির্ভীক আর বুদ্ধিমান মানুষের কার্যাবলীকে কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments