• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • ছুটির মজা ফুলটাঁড়ে : সুব্রত সরকার


    রংখোলা একটা নদীর নাম। পাহাড়ি ছোট্ট নদী। এঁকে বেঁকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে গেছে বহুদূর। এই নদীটার পাশেই আছে চা বাগানে ঘেরা এক পাহাড়ি গ্রাম — ফুলটাঁড়।

    গরমের ছুটিতে মেঘ বেড়াতে এসেছে ফুলটাঁড়ে। ফুলটাঁড়-এর কথা এখনও অনেকেই জানে না। তাই এখানে বেড়াতে আসে খুব কম ট্যুরিস্ট। মেঘের বাবা এই সব নতুন নতুন জায়গার খোঁজখবর রাখে খুব। মা-বাবা ও বাবার অফিসের বন্ধু অনির্বাণকাকুদের সঙ্গে মেঘ বেড়াতে চলে এসেছে ফুলটাঁড়ে। এখানে তিনদিন থাকবে। খুব সুন্দর এই ফুলটাঁড়। মেঘের খুব পছন্দ হয়েছে। মুনিয়ারও খুব ভালো লেগেছে। মুনিয়া অনির্বাণকাকুর মেয়ে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। মেঘ সিক্সে। তাই বলে মুনিয়া কিন্তু মেঘকে দাদা বলে ডাকে না! মেঘ মেঘ বলেই ডাকে। মেঘও কিছু মনে করে না। দুজনে বেশ বন্ধু হয়ে গেছে। ফুলটাঁড়কে দুজনেরই ভালো লেগেছে।

    ফুলটাঁড়ে রংখোলা নদীর ধারে তৈরী হয়েছে এই সুন্দর জঙ্গল রিসর্ট। ভীষণ গা ছম্‌ছম্‌, দারুণ রোমাঞ্চকর এই রিসর্টটা। রিসর্টের পাশেই রংখোলা নদী। নদীর পাশে ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলে কি নেই! ভয়ংকর সব জন্তু-জানোয়ার আর বিষাক্ত সাপেরা রয়েছে। দাঁতাল হাতি আছে অনেক। বাইসন, হরিণ, নেকড়ে, অজগর, গোখরো রয়েছে প্রচুর। আর পাখি ও ময়ূর দেখা যায় অনেক। অনির্বাণকাকু বাইনোকুলার এনেছে পাখি দেখবে বলে।

    আজ সকালে রিসর্টে আসা মাত্রই অনির্বাণকাকু মেঘকে একটা দারুণ পাখি দেখিয়েছে বাইনোকুলার দিয়ে। পাখিটা রুদ্রপলাশ গাছের ডালে বসে শিস্‌ দিচ্ছিল। পাখিটার নামটা কি সুন্দর — হর্নবিল। ধনেশ পাখিও অনেকে বলে। ওর ঠোঁটদুটো কেমন বাঁকানো লম্বা। পালকগুলো রং-বেরঙে রঙিন। পাখিটা ডানা ঝাপটিয়ে যখন উড়ে উড়ে দূরে চলে গেল মেঘ দেখে দারুণ মজা পেয়েছে। হেসে হাততালি দিয়ে বলেছে, ‘কাকু, এই পাখিটার একটা ছবি তুলবে তো। ...'

    মেঘ-মুনিয়া বিকেলবেলায় রিসর্টের সাজানো বিরাট বাগানটায় খুব দৌড়দৌড়ি করে খেলে বেড়ালো। কাকু-কাকিমা, মা-বাবা একজায়গাতেই বসে গল্প-আড্ডা ও মজা করেছে। মেঘ ও মুনিয়াকে ওরা কেউ কোনও বাধা দেয় নি। বলে নি, এটা করিস না, ওটা করিস না। আজ সব বারণ বন্ধ। কোনও কিছুতেই ‘না’ নেই। তাই ওরা দুজনও মনের সুখে খেলে বেড়িয়েছে।

    রিসর্টের বনমালি চন্দন বরাইক ওদের কত নতুন নতুন ফুল চিনিয়েছে। গাছ চিনিয়েছে। জঙ্গলের গল্প বলেছে। হাতির গল্প বলেছে। চন্দনকাকুকে ওদের খুব ভালো লেগেছে। মেঘ বলেছে, ‘আচ্ছা কাকু, এই জঙ্গলে অজগর আছে? তুমি অজগরকে দেখেছো?’

    চন্দনকাকু চোখ বড় বড় করে বলেছে, ‘দেখেছি তো! অজগরকে নিজের হাতে ধরে ফরেস্ট বাবুদের গাড়িতে তুলে দিয়েছি।’

    'সত্যি বলছো?' মুনিয়া অবাক হয়ে বলে, 'অজগর সাপ তো বিরাট মোটা হয়। অনেক ওজন। তুমি একা তুলতে পারলে?'

    'আমি একা নয় গো। পাঁচ-ছয়জন মিলে ওকে কোলে করে তুলেছি। আমাদের এই রিসর্টেই তো ঢুকে পড়েছিল!'

    'তাই নাকি?' মেঘ যেন বিশ্বাসই করতে চায় না।

    'হ্যাঁগো। ওই জঙ্গল থেকে নদী টপকে অজগরটা চুপিচুপি রিসর্টে চলে এসেছিল। আমাদের তো অনেক হাঁস মুরগী আছে। ওগুলো সব খেয়ে ফেলত।'

    'তুমি দেখলে কি করে?' মুনিয়া খুব গল্প শোনার নেশায় মেতে যায়।

    'আমি তো প্রথমে দেখিনি। আমাদের নাইটগার্ড সাধন বসুমাতা ওকে প্রথম দেখেছে। ওই আমাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে যায়।'

    'কি করলে তখন তোমরা?' মেঘও গল্প শুনতে মশগুল হয়ে পড়ে।

    'আমাদের ম্যানেজারবাবু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে ফোন করলেন। ফরেস্টের বিট অফিসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। গাড়িতে চার-পাঁচজন ফরেস্টগার্ড। তারপর সবাই মিলে সেই বিরাট অজগরকে বস্তায় ভরে গাড়িতে তুলে দেওয়া হল।'

    'বিট অফিসার অজগরকে ধরে নিয়ে গিয়ে কি করবেন?' মেঘ-মুনিয়া একসঙ্গেই যেন এই কথাটা জানতে চাইল।

    'ওকে আরও গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসবে। জঙ্গলের প্রাণী জঙ্গলেই থাকুক।'

    'তাই! বাহ্‌ বেশ মজা তো!' ওরা দুজনেই হাসল।

    চন্দনকাকুর কাছে সারা বিকেল এমন অনেক জঙ্গলের গল্প শুনে ওদের বেশ মজায় কাটল। জঙ্গলে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। নদীর ধারে এসময় নাকি হাতিরা দলবেঁধে জল খেতে আসে। এই রিসর্টে সুন্দর একটা ওয়াচ-টাওয়ার আছে। ম্যানেজার এসে বললেন, এবার আপনার ওয়াচ-টাওয়ারে গিয়ে চুপ করে বসে থাকুন। ধীরে ধীরে এই সন্ধ্যা নামাটা দেখুন। এখানকার সানসেট চমৎকার। রংখোলার জলে কি সুন্দর সূর্যাস্তের রং এসে গড়িয়ে পড়বে দেখবেন। নদীর জল তখন কি অপরূপ রঙিন হয়ে উঠবে। আর ভাগ্য ভালো থাকলে জন্তু-জানোয়ারও দেখতে পাবেন। ওরা এই সময় একবার নদীতে জল খেতে আসে। আপনার চলে যান। ওয়াচ-টাওয়ারে আমাদের লোক আছে সার্চলাইট নিয়ে, ও আপনাদের গাইড করবে।

    ম্যানেজারবাবুর এমন প্রস্তাবে বাবা-মা, কাকু-কাকিমা তো আনন্দে লাফিয়ে উঠল। মেঘ-মুনিয়াও খুশি। দারুণ ব্যাপার তো। সবাই আর একমুহূর্ত দেরি না করে ছুটল ওয়াচ-টাওয়ারের দিকে। একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে লম্বা টাওয়ারটা। বেশ সুন্দর করে কাঠ দিয়ে বানানো। সেই দিকে সবার আগে ছুটল মেঘ। তার পিছনেই মুনিয়া। আর ওদের পিছনেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটতে শুরু করল অনির্বাণকাকু।

    নীল আকাশের সূর্যটা তখন একটু একটু করে কেমন রাঙা হয়ে নরম আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে চারপাশকে। পশ্চিম আকাশ এই সেই রংয়ের ছটা আর নরম আলোয় কেমন অপরূপ সুন্দর হয়ে সেজে উঠছে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের মা অতসী বললেন, অসাধারণ! অপূর্ব! ...


    ।। দুই।।

    আজ রাতে বৃষ্টি হল খুব। তার আগে মেঘ ডেকেছে বহুবার। গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করে। বিদ্যুৎও চমকেছে মুহুর্মুহু। জঙ্গলে ঝম্‌ঝম্‌ বৃষ্টির আওয়াজ বেশ জোরে শোনা গেছে।

    সন্ধেবেলায় ওয়াচ-টাওয়ারে বসে হাতির পাল দেখেছে ওরা সবাই। মেঘ-মুনিয়া তো অত কাছ থেকে হাতি দেখার আনন্দে মেতে উঠেছিল। হাতির দলে একটা বাচ্চা হাতিও ছিল। সে কি সুন্দর নদীর হাঁটুজলে নেমে জলখেলা করছিল। ওয়াচ-টাওয়ার থেকে একদম পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল সেই দৃশ্য। অনির্বাণকাকু অনেক ছবি তুলেছে। মেঘের মা মোবাইলে ভিডিও করেছে।

    ম্যানেজারকাকু রাতে খাবার টেবিলে এসে বলেছিল, কাল ভোরে উঠবেন। ভাগ্য ভালো থাকলে কাল ভোরেও অনেক জন্তু-জানোয়ার দেখতে পাবেন। ময়ূর দেখা যায় এসময় অনেক।

    মেঘ এই কথাটা মন দিয়ে শুনেছিল। তাই ঘুম থেকে আজ সবার আগে উঠে পড়ল। কেউ ওঠে নি তখন। অনির্বাণকাকুরাও ঘুমোচ্ছে। মুনিয়াও ঘরে। মেঘ চুপি চুপি বাবা-মাকে না বলে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। ভোরের আকাশ কি সুন্দর এখন। মেঘ একা একাই ঘর থেকে বেরিয়ে রিসর্টের মস্ত বাগানে নেমে এল। বাগানের চারপাশে শক্ত জাল দিয়ে ঘেরা লম্বা ফেন্সিং। তার ওপারেই রংখোলা নদী। গভীর জঙ্গল। মেঘ গুটি গুটি পায়ে সেই জাল ঘেরা ফেন্সিং-এর কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল কতগুলো লোক নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে কি যেন কুড়োচ্ছে। ওদের হাতে তীর-ধনুক, বর্শা-বল্লম। মেঘ তো ভয় পেয়ে যায় ওদের দেখে। ভাবে ওরা কি শিকারী! কি সাহস ওদের। পাশেই তো জঙ্গল। জঙ্গলে হাতি বাইসন চিতা সব আছে। তবু ভয় নেই! লোকগুলো একমনে কি যেন কুড়োচ্ছে। মেঘ ফেন্সিং-এর ফাঁকে মুখ দিয়ে জোরে বলল, 'ও কাকু, তোমরা কি কুড়চ্ছো ওগুলো?'

    লোকগুলো মেঘের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়েই দূর থেকে বলল, 'আমরা ময়ূরের পালক কুড়োচ্ছি।'

    ময়ূরের পালক! মেঘ ভীষণ অবাক হয়ে বলে, 'ময়ূরের পালক এখানে কি করে এল?'

    লোকগুলো হেসে হেসেই বলল, ‘কাল রাতে যখন খুব মেঘ ডাকছিল, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, তারপর বৃষ্টি হল অনেক, আমরা তখনই জানতাম ভোরে নদীর পাড়ে এলে ময়ূর পালক পাব। তাই এসেছি কুড়োতে।'

    'কাকু তোমরা এমন জানতে পারো!' মেঘ ভীষণ খুশি হয়ে আবার বলে, 'কাকু, তোমরা কি করবে এই ময়ূরপালকগুলো?'

    'আমরা বাজারে বিক্রি করব।'

    মেঘ চুপ করে যায় একথা শুনে। একটু ভেবে বলে, 'আমার তো পয়সা নেই, আমাকে একটা দেবে?'

    লোকগুলো হেসে বলে, 'তুমি নিয়ে কি করবে?'

    'আমার ঠাম্মাকে দেখাব। ঠাম্মা খুব খুশি হবে।'

    'তাই! ঠিক আছে তাহলে তোমাকে একটা ময়ূর পালক দেব।'

    ওরা এই জঙ্গলের বনবস্তির লোকজন। ওরা এবার এগিয়ে এসে মেঘের হাতে একটা ময়ূর পালক তুলে দেয়। মেঘ যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এটা সত্যিকারের ময়ূরের পালক। এই জঙ্গল থেকেই কুড়িয়ে পাওয়া। মেঘ ময়ূরপালকটা হাতে নিয়ে আনন্দে হেসে বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ!'

    লোকগুলো এবার বলল, 'তোমার নাম কি?'

    'আমার নাম মেঘ।'

    'কি সুন্দর তোমার নাম। জানো তো ময়ূর মেঘকে ভালোবাসে।'

    'তাই!'

    'হ্যাঁ মেঘ করলেই ময়ূর নাচে। পেখম মেলে ঘুরে বেড়ায়।'

    ‘অ্যাই মেঘ, মেঘ...' মুনিয়া দূর থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে। লোকগুলো হেসে বলে, 'ও কে হয় তোমার?'

    মেঘ বলল, 'বন্ধু। ওর নাম মুনিয়া।'

    লোকগুলো বলল, 'বন্ধুর জন্য একটা ময়ূর পালক নেবে?'

    মেঘ লাজুক হেসে বলল, 'তোমরা আরেকটা দেবে?'

    'হ্যাঁ দেব। এই নাও।'

    মেঘ ওদের হাত থেকে আরেকটা ময়ূর পালক নিয়ে মুনিয়া কাছে এসে দাঁড়াতেই ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নে দারুণ একটা গিফট!'

    মুনিয়া অবাক হয়ে বলল, 'কি এটা?'

    মেঘ বলল, 'এই জঙ্গলের ময়ূর পালক।'

    'ওমা! সত্যি। থ্যাঙ্ক ইউ।'

    'আমাকে বলছিস কেন? এই কাকুদের বল। কাকুরাই তো দিল।' মেঘ যেন ধমক দিয়ে উঠল।

    মুনিয়া হেসে বনবাসী লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ।'

    নদীতে হঠাৎ ঝপাং শব্দ। রংখোলার জলে ঢেউ খেলে গেল। সবাই চমকে-ভয়ে তাকিয়ে দেখল, একটা মাছরাঙা ছোঁ মেরে নদীর জল থেকে ঠোঁটে করে মাছ নিয়ে উড়ে উড়ে দূরে চলে গেল।

    বনবাসী লোকগুলো বলল, 'এবার আমরা যাই।'

    মেঘ-মুনিয়া দুজনেই ওদের হেসে টা-টা করল। ওরা দলবেঁধে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূরে চলে গেল।

    মেঘ হেসে মুনিয়াকে বলল, 'আমাদের ছুটির মজা দারুণ হল বল!'

    'ঠিক বলেছিস!' মুনিয়াও হাসতে হাসতে বলল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments