কদিন ধরেই দেখছি আমাদের পাড়ায় একটা পাগল এসেছে। বাসস্ট্যান্ডের পাশে এককোণে গুটিসুটি বসে কিসব বিড়বিড় বকে। সামনে রাখা এক দিস্তে পুরোনো খবরের কাগজ, খালি সিগারেটের বাক্স, ছেঁড়া ঠোঙা, ছেঁড়া পোস্টার — এক এক করে চোখের সামনে তুলে কি যেন পড়ে আর ফিক-ফিক হাসে। কখনও আবার কোন অদৃশ্য বন্ধুর সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে তামাদি হয়ে যাওয়া সংবাদপত্রের কোন হেডলাইন নিয়ে, তারপর কেমন হালছেড়ে অসহায় তাকিয়ে থাকে সামনের দেওয়ালে চোখ রেখে। লম্বা হিলহিলে রোগা, সম্প্রতি কে বা কারা ন্যাড়া করে দিয়েছে, দাড়ি-গোঁফ কামানো। একটা আস্ত জামা ও পাজামা পরা — ঐ একটাই জামা ওর। একটা প্লাসটিকের মুখবাঁধা ব্যাগে কি সব টুকিটাকি আছে, খুব সাবধানে যত্ন করে কাছে কাছে রাখে ব্যাগটাকে। বেশ নিশ্চিন্ত আরামে বসে থাকে, দেখে মনে হয় ও যেন খুব মজা পাচ্ছে এই চারদিককের কাণ্ডকারখনায়, খুশিতে একেবারে টইটম্বুর, যখনই দেখি চোখটা হাসিতে চিকচিক করছে। খুব ভব্যিযুক্ত, সপ্রতিভ, প্রসন্ন ভাবে হাঁটু মুড়ে বসে থাকে, যেন ও বরযাত্রী এসেছে নিমন্ত্রণ বাড়িতে, অপেক্ষায় আছে, সমাদর করে পঙ্ক্তিতে বসার ডাক আসে কখন।
আমি কাজ করি এক প্রাইভেট অফিসে, ডাটা অ্যানালিসট। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভরা সন্ধে, সুধাদি আমি না-আসা পর্যন্ত আমার সংসার সামলায়। আট বছরের মিঠুয়া স্কুল থেকে ফিরলে তার স্নান-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, মোবাইল গেমস বন্ধ করে জোর করে ঘুম পাড়ানো দুপুরে, দিদিমণি এলে চা-এর বন্দোবস্ত, রাতের জন্য আটা মেখে রুটি করা — অনেক কাজ ওর। ওর নিজের মেয়ে, মিঠুয়ারই বয়সী,সন্ধে-রাত অবধি তিনটে ছোট ভাইবোনকে সামলে রাখে। তাদের স্নান করায়, খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, এঁটো বাসন ধোয়। আমি বাড়ি ফিরলে সুধাদি ওর ভাগের রুটি আর আগের দিনের বাড়তি ডাল তরকারি নিয়ে চলে যায়। কখনও আমি এক-আধ টুকরো মাছ দি’ বাচ্ছাদের নাম করে, জানতে পারলে অলোক বকে — ওর আবার ফালতু জিনিস নষ্ট সহ্য হয় না।
মিঠুয়ার দিদিমণি আমাকে দেখলেই হোয়াটস অ্যাপ বন্ধ করে মোবাইলটা টেবিলে রেখে মিঠুয়ার খাতা চেক করতে থাকে — আমাকে বলে, “পড়ায় একদম মন নেই, করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও সব হোমটাস্ক ভুল করে এসেছে।” আমি মিঠুয়াকে বকি, মিঠুয়া কাঁদে এবং ফলতঃ পড়ার ছুটি হয়ে যায়। দিদিমণি টেবিলের তলায় ছাড়া চপ্পল পায়ে দিয়ে বলে “এ মাসে একটু তাড়াতাড়ি দরকার ছিল।” আমি কড়া গলায় বলি,“টাকা তোলা হয় নি, পরের সপ্তাহে। ছাত্রীর রেজাল্ট কিন্তু ভাল হচ্ছে না।” দিদিমণি একটু ভিতু চোখে চেয়ে দেখে, কিছু বলে, আমি মন দিয়ে শুনি না। মেয়েটার বাবা নেই; পাস কোর্সে বিএ পড়ছে, কে জানে পাস করে কি করবে, চাকরিতো পাবে না। এই টিউশনিটা চলে গেলে ও বিপদে পড়বে, আমিও। এত কম টাকায় কেউ পড়াতে রাজি হবে না। অলোক আবার ফালতু টাকা নষ্ট বরদাস্ত করতে পারে না।
দিদিমণি চলে গেলে আমি মিঠুয়াকে অঙ্ক করতে দিয়ে রাঁধতে যাই। রোজ মাছের ঝোল কি চিকেন স্যুপ খেতে চায় না মিঠুয়া, পিজা খেতে চায় কিন্তু মাসে দুদিনের বেশি পিজা অর্ডার হয় না । অলোক কোনো ফালতু অনিয়ম সহ্য করে না। অলোক ফেরে রাত দশটায়। ওর অফিস ছুটি হয় ছটায়। ছুটির পর অনেকক্ষণ অফিসে বসে কাজ না করলে নাকি বসের নজরে পড়া যায় না, প্রোমোশন ইনক্রিমেন্ট কিছুই পাওয়া যায় না। আমাদের স্বামীস্ত্রীর যা আয় তাতে এই দামী পাড়ায় দামী অ্যাপার্টমেন্ট, লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, দামী স্কুল, বছরে একবার ফরেন ট্যুর ইত্যাদির জন্য অনেক হিসেবনিকেশ করতে হয়। ফেসবুকে ছবি আপলোড করলে লোকে ভাবে, বাঃ কি সুখে আছে! কিন্তু আমিতো জানি একটা স্ট্যাটাস আপলোডের পর কি ভাবে কি ম্যানেজ করতে হয়! অলোক চাটার্ড অ্যাকাউন্টান্ট, খুব প্ল্যান করে সব কাজ করে, দাবা খেলার মত আগে থেকে সব চাল ভেবে রাখে। তাই সামান্য দানে ভুলচুক হলে রাগে ফেটে পড়ে, ওর আগামী দশ বছরের সব ঘুঁটি চালা ভেস্তে যায়।
আমারও সিনিওরিটি হিসাবে আরো দু একটা ইনক্রিমেন্ট পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু মিস করে গেছি। অলোক খুব বকাবকি করেছিল, আমার নাকি ঠিকমত ফোকাস নেই, অ্যাম্বিশন নেই, আর কি কি সব যেন নেই। ও বলেছিল মিঠুয়াকে আমার মায়ের কাছে রেখে দিতে উইক-ডে গুলোতে, যাতে আমি বেশিক্ষণ অফিসে থাকতে পারি। আমি রাজি হই নি, আমি অফিস থেকে ফিরলে মিঠুয়ার কতযে গল্প থাকে আমার সঙ্গে, স্কুলের কথা, বাসের গল্প, রাস্তায় দেখা খুঁটিনাটির গল্প, ওর কাঁচা চোখ দিয়ে পৃথিবীটা যেমন যেমন চিনছে আমাকে চেনায়, আমি কি জানতাম নাকি যে ওর ক্লাসে অবন্তিকার মা আঙ্কেলের সঙ্গে কোথায় চলে গেছে, তাই অবন্তিকার ইউনিফর্ম ডার্টি থাকে, চুলে পনিটেল থাকে না, নিজে রেডি হয় তো! আন্টি মার্কস কেটে নেয়। দেবাঞ্জনের ড্যাডি এম এল এ, তাই ও ক্লাসে মোবাইলে গেমস খেললেও কেউ কিছু বলে না। ইনক্রিমেন্ট পরেও হতে পারে কিন্তু মিঠুয়ার এই বয়েসটা একবার চলে গেলে আর ফিরে আসবে না।
মিঠুয়া ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি টি ভি দেখি যতক্ষণ অলোক না ফেরে। খবরের চ্যানেলগুলো ইচ্ছে করে বাদ দিয়ে যাই, কি যে সব খবর দেখায়, হাঁফিয়ে উঠি। কালই তো দেখালো একটা কচি বাচ্চাকে দশ বারোজন মিলে কতদিন ধরে ধর্ষণ করেছে, একেবারে গ্রাফিক ডিটেলসহ বিশদ বিবরণ। বাচ্চাটা আমার মিঠুয়ার বয়সী। কি বীভৎস — এদের ফাঁসি দিলেও কম হয়, সেই মধ্যযুগীয় কোন বর্বর শাস্তি দেওয়া উচিত। রাতে খেতে বসে গা গুলিয়ে উঠছিল, আমার মেয়ের মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার। পরেরদিন কাগজেও একই গল্প, একই ছবি — কত রকম বর্ণনা ও বিশ্লেষণ — ঠান্ডা মাথায় কি করে আলোচনা করে, রক্ত টগবগ করে ফোটে না? অলোককে বলতে ও ধমক দিল, “এত সেন্টিমেন্টাল হওয়ার কি আছে? এ সব কি নতুন হচ্ছে নাকি?”
সেদিন সকালে দেখি পাঁউরুটিতে ছাতা পড়েছে, পুরনো রুটি দিয়েছিল নিশ্চয়! সুধাদিই দেখেছে, সুতরাং ওকে ওই রুটি আর দেওয়া যাবে না, ধারগুলো কেটে একটা খবরের কাগজে মুড়ে রুটিগুলো নিয়ে নিলাম। গলির মোড়ে পাগলটা যথারীতি বসে আছে, ওকেই দিলাম প্যাকেটটা। ও পাঁউরুটিগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে প্যাকেটটা মুখের কাছে ধরে দেখতে লাগল। কি মনে হল, বললাম, “আজ কাগজ পড়েছ? দেখলে বাচ্চাটাকে কি করেছে? জানোয়ারও এমন করে না। মানুষ কি সব পাগল হয়ে গেছে?” পাগলটা আমার দিকে কেমন করুণার চোখ মেলে তাকালো, তার সঙ্গে অর্থহীন বিড়বিড় বুলি। আমিই লজ্জা পেলাম, নিজেই কি পাগল হয়ে গেছি নাকি? ওর সঙ্গে কাগজের খবর নিয়ে আলোচনা কর। লোকে দেখলে কি বলবে!
কয়েকদিন ধরে একটা বৃদ্ধ কিন্তু রাজকীয় অ্যালসেশিয়ান রাস্তায় ভিখিরির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে, গলায় বকলস। বোঝাই যায় বয়েস হয়ে গেছে বলে বা অন্য জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে গেছে বলে ওর মালিক বেওয়ারিশপথে ছেড়ে দিয়েছে। নিজে খাবার জোগাড় করে খাওয়া অভ্যেস নেই, রাস্তায় শোয়ার অভ্যেস নেই, রাস্তার কুকুররা খাবলে ছিঁড়ে দিয়েছে একটা কান, লোম উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। সেদিন চায়ের দোকানে রাস্তার কুকুরদের সঙ্গে ভাঙা বিস্কুট খেতে এসেছিল, এই বড় একটা ঢিল ছুঁড়ে ওকে তাড়িয়ে দিল দোকানের মালিক, অতবড় কুকুর এলে নাকি ওর খদ্দেররা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে। একটা ঘ্র ঘ্র আওয়াজ করে ধীরে ধীরে অন্যদিকে চলে গেল সেই বিশাল চেহারার পরাজিত বাদশা। বেচারা — কি করুণ দৃশ্য। আমাদের আবাসনের লোকজন আবার কুকুর একদম পছন্দ করে না, না হলে নীচে রাখা যেত। তবু ভেবেছিলাম একবার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলব, তার আগেই ও একটা গাড়ির তলায়পড়ে কোমর ভেঙে রইল দিন দুয়েক। শেষ কদিন ওর কাছে একটু খাবার, জল দিয়ে আসতাম, তারজন্য বেচারার কি কৃতজ্ঞতা, গেলেই আমার হাত চাটত, চোখ ভরে আদর জানাতো। আমি একজন ভেটকে খবর দিয়ে ওর মৃত্যুযন্ত্রণাটা একটু কমাতে চেয়েছিলাম, খরচ হয়েছিল কিন্তু খুব একটা লাভ হয় নি। মনটা গুমরে আছে খুব, এমন লোকেদের কুকুর পোষা কেন? ওরা তো শিশুর মত অসহায়, অবোধ। অলোককে বলে লাভ নেই, ও বরং বিরক্ত হয়েছে, “তোমার যত বাড়াবাড়ি, একটা বেওয়ারিশ কুকুরের জন্য শুধু শুধু খরচ, কোন মানে হয়?”
পরদিন অফিস থেকে ফেরার সময়অঝোরে বৃষ্টি, দেখি পাগলটা একটা বড় প্লাসটিক শিটে আপাদমস্তক ঢেকে জড়সড় হয়ে বসে আছে একটা দোকানের শেডের তলায়। ফিক ফিক হাসিটা কিন্তু লেগে আছে মুখে। অবশিষ্ট অর্ধেক স্যান্ডুইচ বেঁচেছিল টিফিনে, ফেলাই যেত, ওকে দিয়ে দিলাম। ও মিষ্টি হেসে নিল খাবারটা। আমি বললাম “জানো তো মানুষ খুব নিষ্ঠুর, অত সুন্দর কুকুরটাকে ওভাবে কেউ ছেড়ে দেয়, বলো? কোন শেলটারে তো দিতে পারত!” খুব সহানুভূতির সঙ্গে শুনলো ও, যেন কত বুঝছে। বেশ খানিকক্ষণ এক তরফা বক বক করে দেখি ঝুম বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গেছি, তা যাক এখন বেশ হালকা লাগছে।
বাড়ি ফিরে আর রাঁধতে ইচ্ছে করছিল না, অলোকের অফিসে ককটেল পার্টি আছে, ও রাত দুপুরে ফিরবে, আমার আর মেয়ের জন্যে খিচুড়ি ডিম ভাজা করে নিলাম। আজ মিঠুয়ার প্রশ্ন ছিল, যে বাচ্চা ছেলেগুলো বড় রাস্তায় বাঁদরবাচ্চা ঘাড়ে ভিক্ষে চায়, তারা বাঁদর বাচ্চাগুলো কোথায় পায়? কে ট্রেনিং দেয় ওদের? উত্তরটা আমারও জানা নেই, তবে জানতে ইচ্ছে করছে। রাত সাড়ে বারোটায় অলোক এল, নেশা করলে লোকে ফুরফুরে মেজাজে থাকে, অলোক কিন্তু ঠিক উলটো। খুব সামান্য একটা বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি, চেঁচামিচি, শেষে তুমুল হজ্জুতি, গালিগালাজ করে, দু চারটে কাপ ডিস ভেঙে রাত দুটোয় সে শুতে গেল, আমি যথারীতি চুপচাপ, এই সময় কথা বলতে গেলে হাত উঠবে ওর, আমার অভিজ্ঞতা আছে। রাতে আর ঘুম এল না।
পরদিন অফিস থেকে ফেরার সময় গেটে দেখা হল পাগলটার সঙ্গে, এক গাল হেসে আমাকে বল “ম্যাডাম, রুটি?”
সর্বনাশ, ওকি ভাবছে এবার থেকে আমি রোজ ওকে রুটি দেব সন্ধেবেলায়? এতো ভাল ঝামেলা। বললাম “আজ রুটি নেই।” সেরকম হাসি মুখেই বলল, “রুটি খাবো ।” বোঝো, এতো জাতে মাতাল, তালে ঠিক। হঠাৎ কি হল আমার, ওকে কাল রাতের পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম, কারোকে তো বলতে পারি না, লজ্জা করে, ঘরে বাইরে সবাই জানে আমি খুব ভাল আছি। টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে গোছা গোছা সুখী ছবি পোস্ট করি। আমার সব বন্ধুরা অসম্ভব জেলাস — বলে উইলসের সেই মেড ফর ইচ আদার অ্যাডটা তোদের জন্যই করা হয়েছিল। মা তো জামাইএর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, পাড়া প্রতিবেশিকে ডেকে ডেকে দেখান কত দামী দামী উপহার নিয়ে এসেছে দেশবিদেশ থেকে, মা আমার কথা বিশ্বাস করে না, ভাবে স্বামী-স্ত্রীর সাধারণ কথা কাটাকাটি। এসব বলতে বলতে আমার লুকোনো ব্যথার এক উৎসমুখ খুলে গেল কি ভাবে — অনেকদিন পর ঝরঝর করে কান্না এল। ভীষণ অপ্রস্তুতে পড়লাম, তাকিয়ে দেখে নিলাম একবার, চারপাশে চেনা কেউ নেই তো! ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে চোখ মুখ মুছে ওকে দশটা টাকা দিয়ে প্রায় দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে। আজ মিঠুয়া অঙ্কে ফুল মার্ক্স পেয়েছে, দারুণ খুশি। এই অনারে ওর জন্য একটা পিজা অর্ডার দিলাম, মিঠুয়াও জানে, বলল “ড্যাডি বকবে না তো?” হাসি পেল, হায় ভগবান, আমার মেয়ে ভাবে মায়ের একটা পিজা কেনার সাধ্য নেই, এই শিক্ষা দিচ্ছি মেয়েটাকে! চাকরি করে কোন ঘোড়ার ডিমটা লাভ হচ্ছে তবে!
কি মনে হল, একটুকরো পিজা বাঁচিয়ে রাখলাম, কাল সকালে পাগলটাকে দেব। বেচারার সঙ্গে একটু ভালভাবে কথা বললে, এক আধটা রুটি দিলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়! সত্যি বলতে কি এখন পাগলটাকে আমার পাগল বলে ভাবতে কেমন লাগে। এও হতে পারে, লোকটা আসলে পাগল নয়, এমন তো হয়, মাথার গণ্ডগোল ছিল, বাড়ির লোক হাসপাতালে দিয়ে ভেবেছিল আপদ গেছে। সেরে যাওয়ার পর আর কেউ নিয়ে যেতে চায় না। হয়ত বউ আবার বিয়ে করেছে, বাবা-মা চায় না ছেলে যে পাগল তা জানাজানি হোক, ভাবে, পাগল আবার সারে নাকি? তাহলে মেয়ের আর বিয়ে দিতে পারবে না। ভাইরা বাড়ির ভাগ দিতে চায় না পাগল দাদাকে। কি করবে ও? ওই বৃদ্ধ পরিত্যক্ত অ্যালসেশিয়ানটা যেমন রাস্তায় রাস্তায় খুব লজ্জিতভাবে অন্য কুকুরদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খাবার কেড়ে খেত, তাই-ই করছে। পাগল সেজেছে, ভেক না ধরলে ভিখ মিলবে না বলে। হঠাৎ হাসি পেল আমার, সাধে অলোক বলে তোমার “ফার্টাইল ইমাজিনেশন! উপন্যাস লেখ বরং!” এ পাগলতো আমায় শুদ্ধ পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
আমি আজকাল দিনের মধ্যে যখনই সময় পাই পাগলটার সঙ্গে গল্প করি, যে-সব কথা আগে আমার নিজের মনে সীমাবদ্ধ থাকত এখন সেসব কথা শোনার একটা লোক এসেছে। যদিও এক তরফা কথা, যদিও পাগল কিছু বোঝে না, কিন্তু আমার মনের ভার হালকা হয়। এই যে আজকাল ধোঁয়া ও দূষণের জন্য আকাশে কোন তারা দেখা যায় না, আমাদের ছোটবেলায় তো বেশ দেখা যেত। কত নক্ষত্র চিনেছিলাম বই দেখে দেখে। দুঃখ রয়ে গেল, আমার মেয়েকে আকাশ দেখিয়ে কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, বৃশ্চিক চেনাতে পারলাম না! পাগল যেন খুব আঘাত পেল এই কথা শুনে, নক্ষত্র আর দেখা যায় না কলকাতার আকাশে! ওর চোখে এক মেদুর পর্দা ঢেকেছে। অফিসের সামনে বুড়ো গাছটায় জন্মে কখনও ফুল ফুটতে দেখিনি, এবারে ছেয়ে গেছে বকুলফুলে, সন্ধে বেলায় ঝাঁঝ ঝাঁঝ গন্ধে ভরে থাকে গাছের তলা। তাই? কলকাতায় বকুলফুল ফুটেছে? পাগল খুশি হয়, নির্বোধ হাসে। সেই যে মহিলা ফুটপাথে বসে ভিক্ষে করে, কোলে যে বাচ্ছাটা আছে যখনই দেখি নেতিয়ে পড়ে থাকে। মহিলার বয়স বাড়ে, শিশুর বয়স বাড়ে না, আকার বাড়ে না। ও কি সত্যি ঘুমোয় না নেশায় বুঁদ করে রাখে? ও কি ওর নিজের ছেলে, না ভাড়া করে এনেছে? নাকি চুরি? যদি বাচ্চাটা মরে যায়? ওর মা কি কাঁদবে? নাকি এবারে তার পরের বাচ্ছাটাকে ভাড়াদেবে ভিক্ষে করতে! আমার চিন্তায় পাগলও চিন্তায় পড়ে যায়, গম্ভীর মাথাটা দোলাতে থাকে পেন্ডুলামের মত। ক্লাস ওয়ানে বাবার কিনে দেওয়া গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভোঁদড় বাহাদুরটা কোথায় হারিয়ে গেছে, অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাই নি। সেদিন কলেজস্ট্রীটের ফুটপাথে সেই একই এডিশনের পুরোনো প্রিন্ট এক কপি পেয়েছি, আমি আর মিঠাই দুজনে মিলে পড়বো — কি দারুণ না? পাগলের চোখদুটো আনন্দে ঝিকিয়ে ওঠে, সত্যি হারানো একটুকরো ছোটবেলা খুঁজে পাওয়ার মত মজা আছে?
আমি এসব কথা বলে চলি পাগল শুনে যায়, সময়ের হিসাব থাকে না আমার। পাগলের মাথায় আবার চুলের জটা জমে, দাড়ি গোঁফ ঘন হয়, জামা নোংরা হয়। চোখটা কিন্তু কেমন যীশুখ্রীষ্টের মত আশ্চর্য আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে। আমার সন্দেহ হয়, খুব সন্দেহ হয়, ও পাগল নয়, পাগল সেজে থাকে।
আজকাল অনেকদিন পর আমি রাতে একা ড্রয়িংরুমে বসে কবিতা পড়ি, পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা খুব আপন লাগত আমার।
“নতজানু হয়ে কারো পদতলে বসি, ইচ্ছে করেসুধাদি কখনও রাগ করে — “আমি বাড়ি যাবো না? তুমি এত দেরি করলে কি করে হবে?” অলোক রাগ করে, বকে, কখনও কেমন সন্দিগ্ধভাবে তাকায়। সেদিন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে, সুধাদি চলে গেছে। দেখি মিঠুয়ার মুখ ভার।
অকপটে সব কথা তার সাথে বলাবলি হোক।
খুলে দিই কপাটের খিল
পর্দার আড়াল, ঘন বনবীথি ছায়া, ভিজে ছায়া
নোনাধরা পুরনো পাঁচিল
দেয়ালে কামড়ে থাকা সুপ্রাচীন ঘন অন্ধকার
স্যাঁতলার নানাবিধ মুখভঙ্গী, ফাটলের দাগ
তেল ও জলের দাগ, পান পিক, পিপাসার দাগ
সব চিহ্ন, সব ছারখার
সমস্ত গোপন দুঃখ শোক
অকপটে বলাবলি হোক।”
“কি রে কি হয়েছে?” মিঠুয়া হঠাৎ আমায় জড়িয়ে কোলে মুখ রেখে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
“রায় আঙ্কেল বলেছে যে তুমি পাগল হয়ে গেছ। সারাক্ষণ ওই পাগলটার সঙ্গে গল্প করো।”
“কাকে বলেছে?”
“ড্যাডিকে। আজ তুমি যখন ছিলে না সবাই এসে ড্যাডিকে বলেছে তোমায় ডাক্তার দেখাতে।”
“ড্যাডি কি বলল?”
“দেখছি।”
“তুই তো আচ্ছা বোকা। আমাকে দেখে কি তোর পাগল মনে হচ্ছে?”
“তবে তুমি ওর সঙ্গে এত কথা বলো কেন?”
“ও আমার বন্ধু।”
“ধ্যেৎ, পাগল কারো বন্ধু হয়?”
“ও পাগল তোকে কে বলেছে? ও তো কিছু করে না, শুধু চুপ করে বসে থাকে।”
“না, ও পাগল।”
“কি জানিস, আসলে আমরা সবাই পাগল। কেউ জানে, কেউ জানে না।”
মিঠুয়া ঠিক বোঝে না, তবে সান্ত্বনা পায়। আমায় জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
অলোক আজকাল আমায় কেমন একটু ভয় করে চলে, সহজে তর্ক করে না। আবাসনেও দেখছি সবাই আমাকে একটু এড়িয়ে চলে, সেদিন মিটিং-এ এবছর পূজোর কাজ ভাগ করার সময় আমাকে কোন গ্রুপে রাখে নি। কারণটা তাহলে এই! যাক আমি ভালই আছি, এত নিজের কথা আমি কতদিন বলিনি, এত নিজের কথা আমি কতদিন ভাবি নি। শুধু ই এম আই কিভাবে দেব, প্রিমিয়ামের টাকা কোথা থেকে আসবে, পার্টিতে কোন শাড়ি পরব যা একেবারে ইউনিক হবে, ধাওয়ানরা ইউরোপ যাচ্ছে, আমরা কবে যাবো। চৌধুরীরা নতুন মডেলের গাড়ি কিনছে, আমাদেরটা এখন বদলাবো, না কি নতুন মডেল লঞ্চ করার পর — এই নিয়ে রাতদিন কথা কাটাকাটি, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, পাগলের পাগলামি যত! সত্যি আমরা সবাই পাগল!
সেদিন অফিস থেকে ফিরতে আমার একটু দেরি হয়েছে, হাউসিং এর কাছাকাছি আসতে একটা কোলাহল শুনতে পেলাম। পা চালিয়ে এসে দেখি গেটের ঠিক সামনে সবাই পাগলটাকে মাটিতে ফেলে খুব মারছে, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। আমি আছড়ে পড়লাম সামনে, “কি হয়েছে? এ বেচারাকে এ ভাবে মারছেন কেন? কি করেছে ও?”
“সরে যান ম্যাডাম, এ ব্যাটা সাজা পাগল। পুলিশে দেব। এত বড় সাহস, মিসেস হালদারের হাত ধরে টেনেছে!”
“হাত ধরে টেনেছে? কেন?”
“ভদ্রমহিলার হাত ধরে লোকে কেন টানে? আপনি তো আচ্ছা লোক।” ফুঁসে উঠলেন মিসেস হালদার।
“ছেড়ে দিন ওকে, ও মরে যাবে। আপনারা কি মানুষ?”
মাটিতে লুটিয়ে থাকা পাগলটার ওপর পড়ে ওকে হাতের বেড়ে ঘিরে নিলাম। মিসেস হালদারকে দেখেই বুঝেছি কি হয়েছে। আসলে আজ আমার দেরি হওয়ায় ওকে সন্ধের খাবার দেওয়া হয় নি ঠিক সময়ে। ভদ্রমহিলার ঠিক আমার মত একটা শাড়ি আছে, যেটা উনি এখন পরে আছেন। পাগলটা আমার খোঁজে হাউসিং অবধি এসে মিসেস হালদারকে আমি ভেবে খাবার চেয়েছে। কিন্তু এটা এদেরকে বিশ্বাস করাবো কি করে। সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করছে, মহিলারা মুখ টিপে হাসাহাসি করছে। আজ আবার অলোকের অফ ডে ছিল, একজন তাকে ডেকে এনেছে — রাগে আর লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ওর মুখ। টুকরো টুকরো গুঞ্জন কানে আসছে — “আমি তো আগেই বলেছিলাম।” “একে বলে পার্ভারশান।” “অলোকবাবু, মনে হয় আপনার স্ত্রী ঠিক সুস্থ নয়, ওনার ট্রিটমেন্ট দরকার” ইত্যাদি।
পাগলটা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, ঠিক সেদিন যেমন মিঠুয়া জড়িয়ে ধরেছিল। আমি ওকে বুকের কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছি, যেমন সেদিন মিঠুয়াকে দিয়েছিলাম। অলোকের মুখটা ক্রমশঃ কঠিন নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে, মোবাইলটা কানে দিয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে “খুব তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিন, অ্যাটেন্ডেন্ট যেন থাকে।”
হাউসিং-এর দরজায় এসে দাঁড়ালো একটা পুলিশের ভ্যান। কয়েকজন এগিয়ে এসেছে পাগলটাকে টেনে নিয়ে যেতে। এবং শুনতে পাচ্ছি ক্রমাগত কাছে চলে আসা একটা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। আমাকে কয়েকজন তুলে ধরে শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে, মিঠুয়া কাঁদছে, “আমার মা পাগল নয়, পাগল নয়।”
কেউ আমার কথা শুনতে চাইছে না, একটা সামান্য ঘটনাকে এত দূর টেনে নিয়ে যাচ্ছে ... সত্যি এরা সবাই পাগল!