"কি হোলো বলো তো? এতটুকু নড়তে পারছি না কেন? কেন যেতে পারছি না তোমার কাছে? হঠাৎ কি হোলো আমার? এভাবে চুপ করে আছো কেন তুমি? হা ভগবান! তুমি এ কি করলে?" — আর্তকন্ঠে বলতে লাগলো সে।
"দেখছি — কিন্তু আমি তো অক্ষম — মনে করো এসব ঈশ্বরেরই লীলা" — উত্তর এলো তার সামনের সঙ্গীটির কাছ থেকে।
এরপর অনন্ত জ্যোৎস্না যেন অবিরাম ঝরে পড়তে লাগলো ওদের ওপর .....নিশব্দে ..... উপরের আকাশ কিংবা ঈশ্বরের হাত থেকে।
এর খানিক আগেই ....যখন দিনটা শেষ হয়ে এসেছে .... হঠাৎই দেখা হোলো ওদের .... বহু কাল বাদে ....সেই ছাড়াছাড়ির পর .... ফের দেখা ....ফের কথা বলা ....এভাবেই ....
"একি! তুমি এখানে! কি ভাবে এলে?"
— "ঘুরতে ঘুরতে — এদিক ওদিক — কিন্তু তুমি এখানে ...এভাবে ..."
— "অনেককাল থেকেই আছি — তা তুমি কোত্থেকে এলে?"
— "আমার আবার কোত্থেকে কি? কখনো কোনো ঠাঁই তো জোটেনি আমার"
— " কেন? জোটেনি কেন?"
— "আমারই স্বভাবের জন্য — এই ভাবে এদিক সেদিক ভেসে বেড়ানো — যাকগে। তোমার কথা বলো"
— " আমার ঠিক উল্টো। এইভাবেই আছি। অনেক কাল ধরে। দেখে বুঝতে পারছো না?"
— "দেখতে কিছুটা অন্যরকম হয়ে গেছো — তবে এখনো জৌলুষ আছে যথেষ্ট।"
— "সেটা তোমার চোখে। কিন্তু তোমার চেহারাটা একেবারে বদলে গেছে।"
— "জানি। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে--"
— "কেন? এভাবে ঘুরে বেড়ালেই বা কেন?”
— "নিজেই ঠিক জানিনা। হয়তো যেদিকে ঢেউ সেদিকে ভেসে গেছি বরাবর। তোমার মতো নই সে তো জানোই।"
— "তা ঠিক। আমার তো কোনো গতি নেই।"
দু তরফেই কথা গুলো ছিলো ভাসা ভাসা। দিনের শেষ আলো হঠাৎ সোনার রঙে বদলে গেলো। কথাগুলোও যেন বদলে গেলো ওদের —
— "আমি কিন্তু তোমার পাশেই থাকতে চেয়েছিলাম।"
— "জানি। আমিই পারলাম না।"
— "কেন পারলে না?”
— "জানোই তো। বলেছিলাম তখনই।"
—"মনে আছে। কিন্তু মানতে পারিনি কোনোদিনই।"
—"কেন মানতে পারলে না?"
—"তোমায় সবচেয়ে কাছের করে পেতে চেয়েছিলাম — তাই — "
— "ভালো তো আমিও বেসেছিলাম — কিন্তু..."
—"জানাও নি কখনো। তাই না?"
—"কখনো না।"
—"কিন্তু কেন?"
—"ভয়ে।"
—"কিসের ভয়ে?"
একথার কোনো উত্তর এলো না। বিকেলের সোনালী আলো ক্রমশ নিভে আসতে লাগলো ওদের ওপর। হঠাৎই ভারী হয়ে উঠলো ওদের পরের কথাগুলোও —
— "হ্যাঁ। ভয় পেয়েছিলাম — তবে নিজেকে — নিজের চরিত্রকে।"
— "সে তো আমার কারণেই।"
— "তুমি ছিলে অসম্ভব আকর্ষণীয়া।"
— "সেটা কি আমার দোষ?"
— "তা কেন? সে তোমায় যিনি বানিয়েছেন তাঁর কৃতিত্ব।"
— “আমি কেবল বাইরে থেকেই সুন্দর ছিলাম? ভিতরটা কি খুব খারাপ ছিলো আমার?"
— "নাহ্। কক্ষনো না।"
—"তাহলে?"
— "সাহস ছিলো না আমার।"
—"ইচ্ছে?"
—"ছিলো। কিন্তু সেটাকে মেরে ফেলতে হয়েছিলো।"
— "কেন?"
—"নয়তো আমিই শেষ হয়ে যেতাম তোমার কাছে গিয়ে।"
এরপর আবার চলে গেলো কয়েকটি নিরুত্তর মুহূর্ত। চারিদিক থেকে শান্ত ছায়া ওদের উপর এসে পড়লো নিশ্চুপে। ওদের এরপরের কথাগুলো ছিলো যেন নিজেদের কাছেই নিজেদের ভাবনা চিন্তার জাল বোনা আর জাল কাটা —
— "তবুও কি বোকার মতো তোমার পিছু পিছু ঘুরতাম -- তোমার সবচেয়ে কাছের হতে চেয়েছিলাম — বুঝিনি কখনো তোমার সর্বনাশ করে দিতে পারি আমি — তাই যে মুহূর্তে তোমার নিজের মুখ থেকে শুনলাম সেই কথাগুলো — ' — এর বেশি কাছে আর এসো না— তাহলে শেষ হয়ে যাবো আমি' — সেই মুহূর্তেই নিজের কাছে নিজে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিলাম — জানতাম না — সত্যিই জানতাম না এত ভয়ঙ্কর আমার চরিত্র — আর তখনই চলে গেলাম তোমার থেকে অনেক দূরে — তোমার চোখের বাইরে —তোমায় মুক্তি দিয়ে — যাতে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো বাকি জীবন"....... এ ছিলো একতরফের ভাবনা।
— হ্যাঁ মুক্তি পেলাম —প্রতি মুহূর্তে শেষ হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেলাম — তুমি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিলো আমার — মনে হয়েছিলো —এবার বাঁচবো নিজের মতো করে — নিশ্চিন্তে। তাই ভেসে বেড়াতে লাগলাম আপনমনে। কিছু কাল বাদেই মনে হতে লাগলো — এভাবে কোথায় ভেসে চলেছি? কার খোঁজে? তখনই মনে পড়লো তোমার কথা। তোমার সেই আগুনের মতো রূপের কথা। তোমার আমার পাশে পাশে ঘোরার দিনগুলোর কথা। যা বরাবরের মতো হারিয়েছি আমার জীবন থেকে। আমার নিশ্চিন্তে বাঁচার জন্যে। .....অন্য তরফ একথা গুলোই ভাবছিলো আপনমনে।
এইসব ভাবনা চিন্তার আঘাতে আঘাতে সম্পূর্ণ বিবশ হয়ে ওরা স্থির হয়ে রইলো পরস্পরের অদূরে। আকাশের সব মেঘ যেন জড়ো হয়ে হঠাৎ ঘন অন্ধকারে মুড়ে দিলো ওই দুই কথাহীনকে। অথচ তখন কিন্তু সেই আঁধারে, নিরুচ্চারে ওরা পরস্পরকে যেন এই কথাগুলোই বলছিলো —
—"আমি কিন্তু এভাবে চলে যেতে চাইনি কখনো — কোনো দিন--"
— "আমিও তো চাইনি এভাবে ভেসে যেতে।"
— “তখন রাগে দুঃখে সব বোধবুদ্ধি শূন্য হয়ে গিয়েছিলো আমার।"
—"আমি ভাবলাম ঈশ্বরের কৃপায় এবার আর সর্বনাশের আর কোনো ভয় নেই — এবার যেমন ইচ্ছে যেতে পারি — যেখানে খুশি --- তখন নিয়তি আমায় আমায় এমন দূরে পাঠালো যে সেখানে আমার আর কোনো গতিই রইলো না।"
—"আর ঈশ্বর আমায় শুধু ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন অসংখ্য জোয়ারভাটায় যার মাঝে নিজে থেকে থামতে পারিনি কিছুতেই।"
"তারপর অনেক দিন ধরেই এই একই ভাবে পড়ে আছি।"
— "আর আমি এসে পড়লাম তোমার সামনে — কতো কাল পরে — কি আশ্চর্যভাবে--”
'আশ্চর্যভাবে' —কথাটা তখনই এতো গভীর ভাবে ফুটে উঠবে কে জানতো? কে ভেবেছিলো তখনই যেন কোনো জাদুমন্ত্রে সরে যাবে সব মেঘ? হঠাৎ চাদেঁর আলোয় উছলে উঠবে চারিদিক?
বিধাতা। সর্বনিয়ন্তা বিধাতা। কারণ এ সবই বিধাতার লীলা। তাই এইবার ওরা পরস্পরকে দেখতে পেলো অন্য আলোয়।
"— এই চাদেঁর আলোয় ওকে এখনো কি অপরূপা লাগে"— ভাবলো একপক্ষ।
আর অন্যপক্ষ অপরের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে নিজেকেই যেন বললো —"ইস কতো ঝড়ঝাপটার চিহ্ন লেগে আছে ওর মুখে।"
এরপর ওদের কথাগুলো সেই বিপুল জ্যোৎস্নায় বড়ো মায়াময় হয়ে ভেসে এলো —
"আমরা কি এখন আর কাছাকাছি আসতে পারি না?"
"কাছাকাছি আসবে? নষ্ট হয়ে যাও যদি?"
"ঠাট্টা করছো? সে দিনের জন্য?"
"নাহ্। ঠাট্টা নয়। ভয় পাচ্ছি।"
"ভয়? না না —আজ আর ভয়ের কিছু নেই"
"ভয়ের কিছু নেই — কারণ আমাদের বয়স হয়ে গেছে তাই না? এখন তুমি নির্ভাবনায় আমার সবচেয়ে কাছে আসতে পারো — তাই তো? ভাবো দেখি সময়ের কি আশ্চর্য মহিমা।"
"খুব ভুল ভাবে ভাবলে তুমি — কিন্তু সময়ের মহিমা তো বটেই — নয়তো এতকাল বাদে ঈশ্বর বলো বা সময় বলো আমায় এভাবে সুযোগ দেয় ভুল শোধরানোর জন্য?"
"আর আমায় দেখো — একসময় আমি তোমার পিছ পিছু ঘুরে বেড়াতাম সারাক্ষণ — আজ এতটুকু চলার সাধ্যও নেই —”
— "আর সেই জন্যই ঈশ্বর সবশেষে এইভাবে আমাকে তোমার সামনে নিয়ে এলেন — তাই যদি শেষ হয়েও যাই তোমার কাছে গিয়েই শেষ হই — জানবো সেটাই তার ইচ্ছা।"
— "তাই? তাহলে এসো?”
এরপর ওই অপার জ্যোৎস্নায় ওই প্রাচীন দুটি সত্তা ওদের কাঙ্খিত চরম ঘনিষ্ঠতায় নিমগ্ন হোলো এইভাবে তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে।
এটা যদি বাস্তব হয় তাহলে এই সেই বাস্তব যা হার মানায় সব কল্পকাহিনীকে।
কিন্তু আমরা যে কল্পকাহিনীকে খুব ভালোবাসি। তাকে যত্ন করে বসিয়ে রাখি মনের কোণে। তাই প্রবল কৌতূহলে সেদিকে তাকিয়ে দেখি —
নাহ্। কোথায় তাদের ঘনিষ্ঠতা? আর কি করেই বা হবে? ভাটার পাঁকে থিকথিক করছে চারদিক। এতটুকু নড়ার উপায় নেই। অত এব স্থির হয়ে থাকো। যে যেখানে আছো।
কারণ মাটির কলসীটা জোয়ারের জলে ভেসে এসে আটকে গেছে ভাটার কাদায়। আর পিতলের ঘড়াটা তো কবে থেকেই ওই ভাঙা ঘাটের পারের নোংরা মাটিতে ডুবে আছে।
এতো অতি সাধারণ ঘটনা মাত্র।
যদিও একটি তুচ্ছ কাহিনী ছিলো এর আগে--
বহুকাল আগে....
হু হু করে উড়ে যাওয়া অগুনতি মেঘের নীচে ....
রূপোলী আলোমাখা এই নদীর জলে ....
ভরা জোয়ারের ঢেউয়ে....
যখন ভেসে বেড়াচ্ছিলো এই লাল ঝকঝকে মাটির কলসী আর ঝলমলে সোনার পিতলের কলসীটা ....
তখন সেই উজ্জ্বল উচ্ছলতায় পিতলের কলসীটা বারবার চলে আসছিলো মাটির কলসীটার খুব কাছাকাছি ...
আর ওই মধুর মুহূর্তে যখন সে ভালোবেসে বলেছিলো — 'চলো আমরা পাশাপাশি যাই...'
মাটির কলসীটির তখনই মনে হয়েছিলো — কি সর্বনাশ এর সামান্য স্পর্শ তো আমায় শেষ করে দিতে পারে এক মুহূর্তে!
সে তখনই বলেছিলো — "না গো! আমার দূরে থাকাই ভালো।"
এইভাবে এই তুচ্ছ কাহিনীটি চমৎকার একটি নীতিকথা হয়ে বাসা বাধে আমাদের মনের কোণে।
কিন্তু তা যদি স্থির নীতিকথা না হয়ে আবার এগিয়ে চলে গল্পের মায়াপথে তাহলে দেখা যাবে —
কালক্রমে এ নদীর জল গেলো শুকিয়ে — পিতলের কলসীটি এসে ঠেকলো এই পরিত্যক্ত ঘাটের পাঁকে — সময়ের সাথে মাটির পলেস্তারায় ঢেকে গেলো তার সোনালী আকার — আর মাটির কলসীটা অনেক জোয়ার ভাটায় এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে আবার কিভাবে এসে পড়লো এই মজা নদীর ঘোলা জলে —তারপর এসে থামলো ওই পিতলের কলসীটার সামনের একরাশ পাঁকে —
"কি হোলো বলো তো?....
"এতটুকু নড়তে পারছি না কেন? ....
"কেন যেতে পারছি না তোমার কাছে? ....
"হঠাৎ কি হোলো আমার?....
"এভাবে চুপ করে আছো কেন? ....
"হা ভগবান তুমি এ কি করলে?" — আর্ত কন্ঠে বলতে লাগলো সে।
"দেখছি — কিন্তু আমি তো অক্ষম — ভাবো এসব ঈশ্বরেরই লীলা।" — উত্তর এলো তার সামনের সঙ্গীটির কাছ থেকে।
এরপর অপার জ্যোৎস্না যেন অবিরাম ঝরে পড়তে লাগলো....নিঃশব্দে.... উপরের আকাশ কিংবা ঈশ্বরের হাত থেকে......
.....এই অতিকল্পিত কাহিনীবিন্দুটির উপর