১
এ বাড়িতে আসা ইস্তক খুব খিদে পায় খগেনের। না খেতেপাওয়া সারা জীবনের সমস্ত খিদে যেন জমা হয়েছে তার উদরে। পুবের আলো ফুটতে না ফুটতেই তার ঘুম ভেঙে যায় রোজ। আজও ভেঙেছিল। গাঁয়ে ঘরে সকালে উঠেই মুখ ধোয়ার তেমন কোন কারণ ছিল না। ধুতোও না। একে তো তার একটাও দাঁত নেই, তার ওপর কখন কী খাবার জুটবে তারও ঠিকানা ছিল না। মুখ ধুয়ে, চোখের পিচুটি মুছে তার আর কোন্ রাজ-কাজ ছিল, যে রোজ নিয়মিত মুখ ধোবে? এ বাড়িতে ওসব চলবে না। কড়া হুকুম। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে, ফিটফাট বাবুটি হয়ে বসে থাকতে হবে তবে না মিলবে খাবার!
গুঁড়ো মাজন বাঁহাতের তালুতে নিয়ে, লালায় ভেজানো ডানহাতের তর্জনিতে তুলে, সে এখন রোজ মাড়ি মালিশ করে। মিষ্টি স্বাদ আর সুন্দর গন্ধে ভরে ওঠে তার মুখ। অনেকক্ষণ, বেশ অনেকক্ষণ সে মুখের মধ্যে আঙুল পুরে বসে থাকে, পুব আকাশের দিকে চেয়ে। পুবের আকাশ আরো উজ্জ্বল হয়। পাকপাখালিরা বাসা থেকে বেরিয়ে, গাছের খোলা ডালে বসে শরীরের আড় ভাঙে। তাদের যতরকমের ডাক আছে সবগুলি ডেকেডুকে গলাটাও সাফ সুতরো করে নেয়। তারপর উড়ে যায় খাবারের সন্ধানে। তাদের দিকে তাকিয়ে খগেনের মনে করুণা হয়। ছিঃ কী অসভ্য ওরা! সভ্য সমাজে বাস করতে হলে, রোজ সকালে উঠে যে দাঁত মাজতে হয়, মুখ ধুতে হয়, চোখের পিচুটি সাফ করতে হয়, সেই সহবতটুকুও কি ওরা শেখে না, ওদের বাপ-মার থেকে? কিংবা ওদের ছেলেদের থেকে? যেমন খগেন শিখেছে তার উপযুক্ত ছেলের থেকে। শেখার কি কোন বয়েস আছে রে, পাগল? চিতার চড়ার আগেও তাই শিখতে হয়। শেখার ছাই শেষও নেই, ছাই হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত।
এই কাকভোরে বাড়ির লোক কেউ ওঠে না। তবু আড়চোখে ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে, মাজন গোলা লালা দু একবার ঢোঁক গিলে নেয়, খগেন। খেতে খারাপ নয় মোটেই, মুখ থেকে উদর পর্যন্ত মিষ্টি স্বাদ আর সুবাসে শরীরটা বেশ মজে ওঠে। তারপর অনেকটা সময় মুখের মধ্যে আঙুল নাড়াচাড়া করে, খগেন কুয়োতলায় যায়। দড়ি বাঁধা দুধ দোয়ার ছোট বালতিটা পাড় থেকে ঝপাং করে জলে ফেলে, দড়ির অন্য প্রান্তটা টানতে থাকে, লোহার আংটায় ঝোলানো পুলিতে আওয়াজ ওঠে কিঁচ, কিঁচ কিঁচ–-ছুঁচোর ডাকের মতো। দড়ির টানে, ভরা বালতির কিছুটা জল ছলাৎ ছলাৎ ফিরে যায় কুয়োর গর্তেই। আর এইসময়েই খগেন যে খগেন, সেও কিছুটা দার্শনিক হয়ে ওঠে। জলই জীবের জেবন, সে কথাটা খগেন জানে। আর জেবন যেমন অনেক কিছু দেবার জন্যে এগিয়ে এসেও, সবটা দেয় না। কিছুটা ফিরিয়ে রেখে দেয় নিজের জন্যে। কুয়ো থেকে দুলে দুলে উঠে আসা ওই বালতি ভরা জলের মতো, অনেকটা উঠে আসে ঠিকই কিন্তু বেশ কিছুটা সে ফিরিয়ে নেয় কুয়োর মধ্যে!
আঁজলা ভরে জল নিয়ে সে মুখ ধোয়, চোখ সাফ করে। ঘাড়ে কানের পেছনে জলো হাত ঘষে। তারপর প্রায় গলা অব্দি আঙুল চালিয়ে জিভ সাফ করে, গলা সাফ করে। চিৎকার করে ওঠে অ্যা অ্যা অ্যা অ্যা...হ্যা অ্যাক ...থুঃ। বিড়ির ধোঁয়া মাখা কালচে গয়ের তুলে বার বার ছুঁড়ে দেয় নর্দমায়। বড়ো আনন্দ পায় খগেন, শরীরের ভেতরের জমে থাকা যত কাচড়া-আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে, সে যেন ফিরে পাচ্ছে লতুন জেবন। আর ঠিক এই সময়েই তার কানে বেজে ওঠে সানাইয়ের সুর। আজ বাদে কাল তার ছেলের বিয়ে!। সকাল থেকে পাড়া মাতায় করে, বক্সে সানাই বাজছে। হুঁ হুঁ, খগেনের ব্যাটার বে’। কাল রাত পোয়ালেই সে তার বেটার বউয়ের শ্বশুর... দেখলে হবে? খরচা আছে!
নিজের ঘরে গিয়ে হাতপামুখ মাথা মুছে, কাচা লুঙ্গি পরে, গায়ে দেয় সাদা ফটফটে বেনিয়ান। কে বলবে, আজকের এই খগেন এই সেদিনও খগা ছিল? বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে, খগেন মন দিয়ে শুনতে লাগল সানাইয়ের সুর। তার উদরেও বাজতে থাকে খিদের মুদারা। একটা লেড়ো দিয়ে এক গেলাস দুধ চা পেটে পড়লে, খিদেটা অনেকটা মেটে। নিজের জায়গায় হলে, খগেন টুকটুক করে বেরিয়ে পড়ত ইদ্রিশের চায়ের দোকানে। ইদ্রিশ মিয়া, কড়া লিকারে ঘন দুধ আর ভরপুর চিনিতে যা চা বানায় না, আঃ জিভের আড় ভেঙে মগজ অব্দি চানকে ওঠে। চাটা শেষ করে লালসুতোর একটা বিড়ি ধরালেই, ব্যস - শরীরে টগবগিয়ে জান ফিরে আসে। ইদ্রিশ মিয়া বলে, এক এক কাপ চায়ে এক কাপ রক্ত। তা সে চা রক্তই বটে, গতর টসটসে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এ পাড়ায় সে সুযোগ নেই। ছোট্ট মফস্বল শহরের এই পাড়ায় তার ছেলের খুব নামডাক। প্রথম দিনই তার ছেলে তাকে বলে দিয়েছিল, দেখ, যখন তখন আলফাল কোথাও ঢুকে পড়বে না। তোমার যা পেয়োজন আমাদের বলবে, পেয়ে যাবে। মনে রেখো, এখানে তোমার এই ব্যাটার একটা সুখ্যাত আছে, পাড়ার লোক মান্যিগণ্যি করে। তার বাপ হয়ে, তুমি আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে, এ চলবে না। খগেন তার ছেলে মোহিতকে যেমন সমীহ করে, তেমনি ভয়ও পায়। ছেলের মতো ছেলে বটে একখান। গর্বে বুকের খাঁচাটা ফুলে ওঠে, সে খাঁচার পেরাণপাকিটা আনন্দে ঝটপট করে। গাঁয়ে ঘরে, খগেন আর তার ব্যাটা মোহিতকে কেউ পুঁছতো? কেউ ঘরে ডেকে এক কাপ চা খাইয়েছে, কোনদিন? আর এখানে? তার ব্যাটা মোহিত এখন মোহিতদা, আদর করে সবাই ডাকে মদ্দা। এক ডাকে সবাই চেনে। তার ভটভটির আওয়াজ কানে এলে, দুঁদে হাড়বজ্জাত লোকেরাও সমঝে সিধে হয়ে যায়। কুচুটে ধান্দাবাজ লোকেদের মুখেও তখন অমায়িক হাসি, হেহে হেহে, মদ্দা, খপর ভালো তো?
সাতসকালে খগেন সেদিন ঘরেই ছিল। ঘরের সামনে এসে ভটভটির আওয়াজটা থামতে সে বেশ ভয় পেয়েছিল। সক্কালসক্কাল তার কাছে কে আবার এল রে, বাবা? এই সব ভার ভারিক্কি আওয়াজ, গম্ভীর গণ্যিমান্যি কাজের লোকজন, তার কাছে কেউ এলে, খগেনের পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করে ওঠে। বাহ্যে পায়। সে যখন দেখল, ভটভটি থামিয়ে একটা লোক, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে, তার ঘরের দিকেই আসছে, সে আর থাকতে পারল না। বাড়ির পিছন দিকে বাঁশঝাড়ের দিকে খগেন প্রায় দৌড়ে চলল। আর নাছোড় লোকটাও দৌড়ে এসে, শক্ত হাতে খপ করে ধরল তার হাতটা,
‘বলি চললে কোতায়?’
‘কোতাও যাইনি, আজ্ঞে। পেটে বড্ডো মোচড় মারল, তাই বাজ্জে যেতেছিলাম।’
‘আমায় চিনতি পারলে নি, বাবা? আমি মোহিত। তুমি সেই আজও একই রকম মেনিমুখোই রয়ে গেলে? বাইরের লোক দেকলেই হাগতে ছুটতেচো?’
‘হে হে হে হে, মোহিত? হঠাৎ কোতা থিকে এলি বাপ? চোখে ভালো ঠাওর করতে পারি না কী না? তাই চিনতে পারি না।’ মোহিত বাপের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর বলল,
‘বেশ বুড়ো হয়ে গেচো, দেখতিচি? একটাও দাঁত নাই, ফোগলা। চোখে কি ছানিও পড়েচে নাকি? এই কবচরে এত বুড়ো হয়ে গেলে কী করে?’ তার গলায় মায়া। পরিচয়ে এই লোকটা তার বাপ। ভিতু, দুব্বল, খুবই অসহায় টাইপ। সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি, কিছু অন্যায় হয়ে গেল। খগেনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে মোহিত ঘরের দাওয়ায় বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে বলল,
‘ঘর দোরের কী হাল করে রেকেচো? এই ঘরে কুকুর বেড়ালও থাকতে পারবেনি, একেনে মানুষ থাকে?’ মোহিতের সুন্দর জামা-প্যান্ট, জুতো, চুলের কায়দা। গলায় চিকচিকে চেন, হাতে ইস্টিলের বালা। এসব দেখে মুগ্ধ হতে থাকল খগেন। তার ওপরে মোহিতের গায়ের সুবাস? আহা। দাওয়ায় বসে বাবুদের ছেলের মতো দেখতে ওই লোকটা তার ব্যাটা, মোহিত? পেত্যয় হয় কই? খগেন ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল,
‘গলার ওটা কি সোনার?’
‘লয় তো কি, পেতলের? হা হা হা হা।’ মোহিতের দমফাটা হাসির আওয়াজেও খগেন বড়ো আনন্দ পেল। এমন হাসি সে জীবনে কোনদিন হাসতে পারেনি। খুকখুকে হালকা হাসি হাসতে গিয়েও তার বুকে হাঁফ ধরে, কাশি চলে আসে। আশেপাশের লোকজন কেউ কিছু মনে করল কী না! তার দিকে কেউ তাকিয়ে রয়েছে কী না! দশজনকে শুনিয়ে এমন হা হা হাসি তো সে চিন্তা করতেই পারে না। ছেলের প্রতি শ্রদ্ধায় আর সমীহে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বাপের এই দৃষ্টিটা মোহিত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল কিছুক্ষণ, তারপর হেসে জিগ্যেস করল,
‘কাজ কম্ম কিছু করচো? নাকি ফোপরদালালি করেই দিন কাটাচ্চো?’ লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেল খগেন,
‘হে হে হে ওই আর কী? চলে যাচ্ছে কোনরকমে।’
‘বুজে গেচি। তোমার ঘরে কী মালপত্র আচে, তল্পিতল্পা বাঁধো। তা’পরে আমার সঙ্গে চলো।’
‘ক্যা্নে? কোতায় যাবো তোর সঙ্গে?’ খগেনের অবাক জিজ্ঞাসায়, মোহিত হেসে উত্তর দিল,
‘আমার বাড়ি যাবে। সামনের শনিবার আমার বে, সোমবার বৌভাত। ছেলের বাপ না গেলে বে’-বাড়ি মানাবে ক্যানে? তবে এ চেহারায় তোমার যাওয়া চলবে নি। মাথায় ফুলেল তেল মেকে, গায়ে সাবান মেকে পুকুরে দুটো ডুব মেরে এসো। ধুতি জামাও সঙ্গে এনেচি। চামড়ার চটিও আচে। বলি মোহিতের বাপ কী যে সে মানুষ বটে? এমন অখদ্দে চেহারা লিয়ে সকলের সামনে দাঁড়ালে হব্যে? ছেলের বউ শ্বশুর বলে মান্যি করবে ক্যানে?’
২
হরিহর সর্দারের বাড়ির নিচের তলার বৈঠকখানাটা বেশ বড় একটা হলঘর। মেঝেয় পাতলা গদির ওপর সাদা চাদর বিছানো। দেয়ালের ধারে ধারে পাঁচসাতখান চেয়ার আছে ঠিকই, সেগুলোতে তেমন কেউ বসে না। কোমরে ব্যথা, হাঁটু ভাঁজ না হওয়া লোকজন এসে গেলে, গদিতে বসতে পারে না, তারাই ওই চেয়ারে বসে। তবে তারাও খুব স্বস্তিতে বসতে পারে না, পাছাটা কোনমতে চেয়ারে ঠেকিয়ে রাখে। হরিহর সর্দার মেঝের গদিতে বসে আছেন, আর তার সামনে কেউ নিশ্চিন্তে চেয়ারে বসে থাকবে, এমন ভাবা যায়? অনেকে তো ঠায় দাঁড়িয়েই থাক। বার বার বললেও উত্তর দেয়, ‘না, না, স্যার এই বেশ আছি।’
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ হরিহর বৈঠকখানায় ঢুকেই ধপাস করে আড় হয়ে বসলেন গদিতে, বললেন, ‘এসিটা বাড়িয়ে দে তো। আলোও এত কম কেন ঘরে?’ ঘরের দুটো এসি বাইশে চলছিল, এখন দুটোই আঠারোয় নেমে এল। ঘরের আলোগুলোও সব জ্বলে উঠল ফটাফট। হরিহর সর্দারের মুখ থেকে কথা খসে পড়া মানে, সে কথা রিমোটের থেকেও কার্যকরী। নিজে নিজেই সব নিয়ন্ত্রণ হতে থাকে।
সেই সাতসকালে হরিহর সর্দার কলকাতা গিয়েছিলেন, ফিরছেন এখন। সারাদিন দফায় দফায় আলোচনা, পর্যালোচনা। নির্দেশ, সতর্কবাণী, উপদেশ। পরবর্তী কর্মপন্থা, রাজনৈতিক চাল। প্রত্যেক মাসে একদিন, এই কর্মীসভা শরীরের সব রস রক্ত শুষে নেয়। বড়ো কাঁচের একগ্লাস পরিমিত শীতল জল এগিয়ে এল হরিহরের সামনে। গ্লাসের জল নিঃশেষ করে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন হরিহর,
‘আঃ। কোথায় রে, কোথায় গেলি সব? বলি জলটলের ব্যবস্থা কিছু আছে?’ নিতাই সামন্ত সামনে এসে দাঁড়াল, বলল,
‘ব্যবস্থা আছে স্যার, এখনই নিয়ে আসছে। বাইরে চারটে চাষাভূষো লোক সেই বিকেল থেকে অপেক্ষা করছে, দেখা করতে চায়। ডাকবো?’
‘আঃ কি হয়েছে কী? ওদের আজ যেতে বল, আজ আর হবে না। বল কাল সকালে আসতে। একরাতের মধ্যে কিছু যাবে আসবে না।’
‘ঠিক আছে, স্যার। বলে দিচ্ছি।’
‘হুঁ ভালো করে বুঝিয়ে বলিস। জনগণ নিয়েই আমাদের কারবার, জনতার সেবাই আমাদের ধর্ম, শাআআল্লা, কী উপদেশ! আর ইয়ে, হৃদয় আর পুলক আছে? দুজনকেই ডাক। আর কেউ যেন বিরক্ত না করে।’
নিতাই সামন্ত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই হৃদয় আর পুলক দরজা খুলে মুখ বাড়াল, পুলক বলল,
‘ডাকছিলেন, দাদা?’
‘হুঁ। ভেতরে আয়। জরুরি কথা আছে।’
ওরা দুজনে ভেতরে ঢুকে, হরিহরের সামনেই গদিতে বসল। ঘরের ভেতরের দরজা দিয়ে হারান পল্লে নিঃশব্দে ঘরে এল। তার হাতের বড় ট্রেতে সাজানো বিদেশী স্কচের বোতল, বরফ, ঠান্ডা জলের জগ, চারটে খালি কাঁচের গেলাস। হরিহরের সামনে ট্রে রেখে বোতল থেকে মাপ করে স্কচ ঢালল গেলাসে, তাতে চারটে বরফের টুকরো দিল, ঠান্ডা জলও ঢালল গেলাসে। হারানের হাত থেকে গেলাস নিয়ে হালকা চুমুক দিলেন হরিহর। সারা দিনের টেনসানের পর এই স্কচের গন্ধ আর স্বাদ, অনেকটা স্বস্তি পেলেন হরিহর। তাঁর চোখের ইশারায় আরো দুটো গেলাস রেডি করল হারান। এগিয়ে দিল হৃদয় আর পুলকের দিকে। কৃতার্থের মতো হৃদয় আর পুলক ডান হাত বাড়িয়ে গেলাস নিল, বাঁহাতে ছুঁয়ে রইল ডানহাতের কনুই। হরিহর নিজের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে গেলাসের ওপর দিয়ে তাকিয়ে ইশারা করলেন, হৃদয় আর পুলক খুব সংকোচের সঙ্গে গেলাসে ছোট্ট চুমুক দিল। তারপর দুহাতে গেলাস ধরে উন্মুখ বসে রইল হরিহরের পরবর্তী আদেশ শোনার জন্যে। হরিহর, আরেকটু আড় হয়ে আধশোয়া হলেন, হারানকে বললেন,
‘তুই এখন যা। একটু স্যালাডের ব্যবস্থা দেখ। আর বাদাম-টাদাম, কিসমিস-টিসমিস...।’ হারান নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ঘরে এখন তিনজন, নিবিড় নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ হরিহর কোন কথা বললেন না, ধীরে ধীরে গেলাসে দুবার চুমুক দিলেন, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ব্যাপারটা তো কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে রে? তোরা সবাই থাকতে, আমাকে আজ কলকাতা গিয়ে পঞ্চাশটা কথা শুনতে হলো? কী করতে চাস খুলে বল। পলিটিক্স ছেড়ে হরিনামের দল খুলবি? আমাদের দিয়ে তার বেশি কিছু হবে না, আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে।’
‘ক্-ক্-কোন ব্যাপারটা, হরিদা?’ হৃদয় তোতলা হয়ে গেল ভয়ে। হৃদয়ের দিকে বিরক্তি আর করুণাঘন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হরিহর গেলাসে চুমুক দিল। পুলক একটু বেশি ধূর্ত, সে বলে উঠল,
‘আরেঃ মোহিত। দাদা মোহিতের কথা বলছেন। তোকে তখন বললাম না, মোহিত এখন খুব উড়ছে। ওর ডানা ভাঙার সময় হয়ে এসেছে।’
‘কিন্তু। ও তো আমাদেরই দলে। আমাদের হয়েই তো লাস্ট ইলেকসনে দাদার জন্যে ময়দান সাফ করেছিল।’ এবার পুলকও বিরক্ত হল। বলল,
‘আঃ। তাই বলে কি সে আমাদেরই ঘাড়ে হাগবে? যা খুশি করবে? বিয়েতে কত খরচ করল দেখলি না? সে পয়সা কোথা থেকে পেল? সে টাকাটা ফান্ডে আসতে পারতো কিনা?’
নিজের নির্বুদ্ধিতায় হৃদয় চুপ করে রইল। সে কাজের ছেলে, প্যাঁচ পয়জার ভালো বোঝে না। কিন্তু আদেশ পেলে নিখুঁতভাবে কাজ সম্পন্ন করে। হরিহর কিছু বললেন না, দুজনের দিকে তাকিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগলেন, গেলাসে চুমুক দিতে দিতে।
‘দাদা, আমি বলি কী, ওকে ওয়ারনিং দিয়ে বসিয়ে দিন। কমাস খাক না ব্যাটা বসে বসে, জমানো পয়সা ভাঙিয়ে। কত ধানে কত চাল হয় বুঝে যাবে। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া দুদিনে টাইট হয়ে যাবে।’
হারান দুটো প্লেট নিয়ে ঘরে এল। এক প্লেটে শসার টুকরো, অন্য প্লেটে কিসমিস আর রোস্টেড কাজু। হরিহর সর্দারের সামনে প্লেট দুটো নামিয়ে, খুব নিচু স্বরে বলল, ‘গেলাসটা আরেকবার ভরে দিই?’ হরিহর সর্দার নিজের গেলাসের তলানিটুকু এক চুমুকে শেষ করে, হারানের দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দিলেন। হারান বসল, আর একবার গেলাস ভরতে। হরিহর সর্দার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ভুরু তুলে বলল,
‘মোহিত কাজের ছেলে। বসিয়ে দিলে, অন্য পার্টি ওকে তুলে নেবে। আমাদের হাতের বাইরে চলে গিয়ে, কেস আরো জটিল হয়ে যাবে রে, গাধা!’ পুলক একটু দমে গেল, বলল,
‘তাহলে কী বলছেন? ডানা ছেঁটে দেবো?’ হারানের হাত থেকে ভরা গেলাস নিয়ে হরিহর সর্দার কয়েকটা কাজু নিলেন, দুটো মুখে ফেলে বললেন,
‘মোহিতের সেই কেসটার কথা মনে আছে?’ পুলক আর হৃদয়ের গেলাসও ভরে দিল হারান। পুলক একটা শসা নিয়ে মুখে পুরে বলল,
‘আছে তো, সেটাকে আপনিই তখন চেপে দিয়েছিলেন। তখন থানার ওসি ছিল বিকাশ হাজরা।’
‘কাল সকালেই সুমন মিদ্দাকে বল, সেই ফাইল বের করে, কেস শুরু করতে। তদন্ত হোক, আইন আইনের পথে চলুক।’
‘একটা কথা বলব, দাদা? মোহিত তার বাপকে এনে এখানে রেখেছে। খগেন। সে কিন্তু মোক্ষম সাক্ষী হতে পারে।’ দেড় গেলাসের নেশায় হরিহর সর্দারের মেজাজটা হালকা হচ্ছে। এক চোখ বন্ধ করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বললেন,
‘বাপের নাম খগেন? মোহিতের তো বাপের ঠিক নেই জানতাম, এ বাপটা কত নম্বর বাপ?’ হরিহর সর্দারের এই কথায় পুলক আর হৃদয়ও হ্যা হ্যা করে খুব হাসতে লাগল। পিছনে বসা হারানও হাসল খুক খুক করে। হরিহর সর্দার হাসি থামিয়ে নির্বিকার ভাবে বললেন,
‘সেদিন খুব ভোরে মোহিত এসে আমার কাছে সারেন্ডার করেছিল। বলেছিল, হরদা বাঁচাও। কিচ্ছু লুকোয়নি, সব কথা খুলে বলেছিল। তার ঘন্টা খানেক পরেই সকাল বেলা, জনার্দনদার ছেলে, তিনকড়ি এসে হাজির। হরদা মোহিতর ফাঁসি চাই।’
বছর আষ্টেক আগের এই ঘটনা নিয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে বেশ তোলপাড় হয়েছিল। সে সব কথা আবার মনে পড়ে গেল। গেলাসে বেশ বড়ো একটা চুমুক দিয়ে হরিহরদা আবার বললেন,
‘মোহিত তখন এই বাড়িতেই ছাদের ঘরে ঘাপটি মেরেছে। হে হে হে হে। শালা তখন লাঠি খাওয়া নেড়িকুত্তার মতো ভয়ে কাঁপছে, বুজেচিস? আর নিচেয় এই ঘরে তিনকড়ি খুব তড়পাচ্ছে, এই করেগা। এই মারেগা। শালা পালিয়ে যাবে কোথায়? বললাম, আমার কাছে এসব বলছিস কেন? জনার্দনদা আমাদের শোদ্দেয় নেতা। আর মোহিত একজন সাধারণ কর্মী। আমাদের দল এই সব নোংরা ব্যাপারে কাউকেই সমোত্থন করবে না, কিংবা পোশসয়ও দেবে না। কোন নোংরা রাজনীতিতেও অংশগোহণ করবে না। এটুকু গ্রান্টি। আর মোহিতর ফাঁসি দেওয়ার হলে, দেবে পোশাসন। মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দ্যাখ তিনকু, কোন রাজনৈতিক দল কাউকে ফাঁসি দিতে পারে কি?’ তিনকড়ির মাথা একটু ঠান্ডা হল। ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে বলল, তাহলে আমি এখন কী করবো, হরদা?’ সকলেই একমনে হরদার কথা শুনছিল। হরদা একটু থেমে গেলাসে চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন,
‘আমি বললাম, জনার্দনদা আমাদের সকলের মাথার ওপরে ছাতার মতো ছিলেন। তিনি আর নেই, কিন্তু তাঁর বাকি কাজগুলো আমাদেরই তো শেষ করতে হবে নাকি? জনার্দনদার আদসশো, তাঁর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সে কি আমরা ভুলে যাবো, বল? এখন মাথা গরম করার সময় নয়, তিনকু। মাথা ঠান্ডা করে থানায় যা। আমি আগেই খবর পেয়ে বিকাশকে বলে রেখেছি, তুই গেলেই এফ আই আরের ব্যবস্থা করে দেবে। পোশাসনের কাজ পোশাসনকেই করতে দে, তিনকু। ওদের কাজে আমরা সব সহযোগিতা করবো। আমরাও কি চাই না, দোষী শাস্তি পাক? তুই এখন থানায় যা, থানার কাজ সেরে বাড়ি যা। তোর মা আর তোর পরিবারটা যেন ভেসে না যায়, সেটাও তোকেই সামলাতে হবে, তিনকু!’
গেলাস শেষ করে, হারানের দিকে খালি গেলাসটা আবার বাড়িয়ে দিলেন হরিহর সর্দার। এক মুঠো কিসমিস মুখে পুরে, প্লেটটা বাড়িয়ে দিলেন পুলকদের দিকে, বললেন,
‘কী রে? তোরা কিছুই নিচ্চিস না। কাজু, কিসমিস নে। হারান, দেখিস ওদের গেলাসও যেন খালি না থাকে। আমার কথা শুনে তিনকড়ি কিছুক্ষণ ভাবলো, একটু কান্নাকাটি করল। বলল, “তাহলে আমি আসছি হরদা, থানা থেকে ঘুরে আসি?” আমি বললাম, আয়। তবে বড়ো দাদা হিসেবে আরেকটা কথাও তোকে বলতে চাই। তোর ভালো লাগবে না কথাটা। কিন্তু এই তল্লাটে জনার্দনদার যা ইমেজ সেটাকে নষ্ট হতে দেওয়াটাও ঠিক হবে না, ভেবেই আমার বলা। তিনকড়ি বলল, কী কথা দাদা বলো না, বাবার পরে তোমাকেই আমরা বাবার মতো দেখি। আমি বললাম...’ হরিহর সর্দার কথা বন্ধ করে হারানের হাত থেকে ভরা গেলাস নিলেন, বেশ বড়ো একটা চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,
‘আমি বললাম। তুই এখন বড়ো হয়েছিস। ভালোমন্দ বুজতে শিখেছিস। যে ভাবে, যে অবস্থায় জনার্দনদার লাশ পাওয়া গেছে, ল্যাংটো এক নষ্টা মেয়েছেলের সঙ্গে। সেটা নিয়ে যত ঘাঁটবি ততই দুর্গন্ধ বেরোবে। তাতে তোর, তোর পরিবারের, জনার্দনদার যে খ্যাতি, সুনাম – সে সব একদম মাটি হয়ে যাবে। সে কথাটাও কিন্তু মাথায় রাখিস। উপযুক্ত ছেলে হিসেবে তোর আবেগের সম্মান দিয়েই বলছি, বাবার সম্মান রাখাটাও কিন্তু খুব জরুরি। বাস, এই কথাতেই তিনকড়ির হাওয়া ফুস...বিচারের বাণী-টানি ঢুকে গেল ইয়েতে...’
এক চোখ টিপে খিক খিক হেসে, হরিহর গেলাসে আবার একটা লম্বা চুমুক দিলেন। তাঁর জিভ এখন একটু জড়িয়ে আসছে। নেতাসুলভ গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের যে মুখোশ তিনি সর্বদা পরে থাকেন, সেটা সরে যাচ্ছে। তিনি কিছুটা বাচাল হয়ে উঠছেন।
‘বাপের নাম খগেনকে নিয়ে কী যেন বলছিলি, পুলক?’
‘মোহিত তাকে গাঁ থেকে তুলে এনে নিজের কাছে রেখেছে।’
‘হুঁ? বাপের সুপুত্তুর হইতে বংশের গৌরব বাড়ে। ছোটবেলায় কোতায় যেন পড়েছিলাম। আগে শ্লা ওই বাপটাকে তোল। তুলে এনে খুব হড়কা। এমন হড়কাবি খগেনের বাপের নামও যেন খগেন হয়ে যায়। হে হে হে হে। লোকটা কেমন? চিনিস? মোহিতর মতোই হেক্করবাজ?’
‘না, না। হরদা। একদম মিয়োনো মুড়ির মতো। ভিতু আর হেগো রুগী। এক ধমকেই কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যায়।’ গেলাসের প্রায় অর্ধেক শেষ করে হরিহর বললেন,
‘অমন বাপের এমন ছেলে হয় কী করে বাওয়া? হে হে হে হে। যাকগে যাক, ওসব পরের ঘরের কথা নিয়ে আমাদের কাজ কী? বাপটাকে দিয়ে পুলিশের কাছে সেদিনের সেই ঘটনার বয়ান দেওয়ানোর ব্যবস্থা কর। তারপর মোহিতকে আমি দেখছি। এমন কেস দেব না? ব্যাটা একদিনের জন্যেও জামিন পাবে না। তদন্ত চলবে, বিচার চলবে। আইন আইনের পথে চলবে.এ.এ.এ। শালাকে পনের বছর জেলের ভাত যদি না খাইয়েচি, তো আমার নাম হরিহর সর্দার নয়।’
হরিহরের এখন ঘাড় টলছে। দু হাত ছড়িয়ে পিছনের দিকে ভর দিয়ে বুক চিতিয়ে বসে, পা দুটো ছড়িয়ে দিলেন। তারপর খুব রসিয়ে রসিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে লাগলেন,
‘মোহিতের বাপকে বুজিয়ে বোলবি, বুয়েছিস? খিক...খিক...খিক। তোমার অমন সতী নক্কী বউটা জনার্দনের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে না হয় গিয়েইছিল, তাই বলে শিলপাটা ঠুকে দুটোকেই মেরে ফেলতে হবে? তাও এক্কেবারে...খিক-খিক-খিক...শঙ্খলাগা মুহূত্তে? অ্যাঁ? এত কীসের তাড়া ছিল, হে? এট্টু অপেক্ষা করলে কী হত? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা...মেল ফিমেল ওয়ানটু। দুটোই মরল ন্যাংটুউউউ!’ হরিহর থেমে ঘাড়টা সোজা করল, চোখদুটো বড় বড়ো করে পুলকদের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
‘আর একটা কতা। যদি ইন কেস, মোহিতর বাপটা রাজি না হয়, তাহলে কী করবি?’
পুলক এবং হৃদয় কিছু বলল না, নেশাগ্রস্ত হরিহরের দিকে তাকিয়ে রইল চুপ করে।
‘যদি ইন কেস মালটা রাজি না হয়, তাহলে কিন্তু মোহিত শেষ। ব্যাটা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলবে গাছের ডাল থেকে। পাপের বেতন মিত্ত্যু। ইস্কুলে পড়িসনি? কটা বাজলো রে, হারান?’
‘আজ্ঞে সাড়ে বারোটা বাজতে চলল।’
‘ওই শ্লা। এত রাত হয়ে গ্যাচে? তোরা তবে আয়। আমি ওপরে যাই। কাজ সেরে আমায় রিপোর্ট দিবি। কোন এক্সটা কিচাইন যেন না হয়। হৃদয়, মনে থাকে যেন।’
এর পর হরিহর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন গদির ওপর, বললেন,
‘শালা বেজম্মা। জীবনে কোনদিন স্কুলের দরজা কোনদিকে দেখল না, সে এখন বড়ো নেতা হয়ে, আমার ওপর ছড়ি ঘোরাবে? আমি হরিহর সর্দার, আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনেছিলাম তোকে, ভুলে গেলি হারামজাদা? হারান, আরেকটা দে তো ছোট করে। এটাই লাস্ট। তবে বুজলি হারান, ছেলেটার এলেম আছে। এই কবছরে তরতরিয়ে শিখে নিল সব। কথা, বার্তা, মিটিংয়ের লেকচার, শুনলে কে বলবে, যে ব্যাটা ক লিখতে কলম ভাঙে? মালটাকে এখনই খালাস করতে না পারলে, আমিই না খালাস হয়ে যাই।’
পুলক উঠে দাঁড়াল, সঙ্গে হৃদয়ও। পুলক বলল,
‘আমরা এখন চলি, হরদা?’ হরিহর সর্দার কোন সাড়া দিল না দেখে, ওরা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
৩
এই যে এত আরাম। এত বিলাসিতা। চারবেলা করে খাওয়া। মাছ, মাংস ডিম। জেলাবি, রসগোল্লা, সন্দেশ। এত ঠাট-ঠমক। এ কদিনে খগেন তাও কেন হাঁফিয়ে উঠছে! বিয়ে বাড়ির হৈ চৈ লোকজন আসা যাওয়া মিটে গিয়ে, উথলে ওঠা জীবনটা যখন থিতু হয়ে বসল, খগেন দেখল সে এই বাড়িতে প্রায় বন্দী! মোহিতের কড়া নিষেধ একা একা কোথাও বেরোনো যাবে না। মাঠে ঘাটে আদাড়ে-বাদাড়ে অকারণে ঘুরে বেড়াতে অভ্যস্ত লোকের কাছে সারাদিন ঘরে বসে থাকাটাও কম যন্ত্রণার নয়। বাইরে বেরোতে গেলেই দুজন ছোকরা তাকে বগলদাবা করে, বাইকে চাপিয়ে নিয়ে বেরোয়। এ সব কি ভালো লাগে নাকি? প্রত্যেক দিনের মতো আজও সকাল সকাল ঘুম ভেঙে উঠে, সব কাজকম্ম সেরে চুপ করে বারান্দায় বসেছিল খগেন। টুকরো আকাশ আর গাছপালার দিকে তাকিয়ে, মনমরা হয়ে ভাবছিল, মোহিতকে বলবে, কটা দিনের জন্যে আমাকে গাঁয়ে রেখে আয় মোহিত। মোহিত রাজি হবে বলে মনে হয় না। বলবে, ‘গাঁয়ে খেতে পাও না, শুতে পাও না, সেকেনে তোমার কী মোদু আচে শুনি?’ এ কথার কোন জবাব নেই খগেনের কাছে। বৌটাও খুব আত্মীসূয়ো। খগেনকে খুব বাবা, বাবা বলে। ছেদ্দাভক্তি করে, যত্নআত্তি করে। সেও যদি বলে, ‘কার জন্যি আমাদের ছেড়ে যাচ্চো, তুমি?’ কী উত্তর দেবে খগেন? এই সব যতই চিন্তা করছিল, ততই তার মনে হচ্ছিল, গাঁয়ে ফেরা অসম্ভব। কিন্তু মন যে মানছে না। সুখের ঘরের বন্ধ দোরে, বার বার ক্যানে এসে ধাক্কা দিচ্ছে দুখের জেবন! বহুদিন আগে কোন কীর্তনের আসরে কিংবা পালা গানে শুনেছিল “সুখেরও লাগিয়ে যে করে পীরিতি, দুখ যায় তারই ঠাঁই।” এই দুটো আখরই তার মনে আছে। এই দুটো আখর সে গুনগুন করে ভাঁজতে লাগল আপনমনে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। খগেনও আজকাল গান গাইছে? অবাক কাণ্ড বটে!
সদর দরজায় হঠাৎ জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ আর মোহিতের নাম ধরে বেশ কয়েকজন ডাকাডাকি করছে। খগেনের পেটের ভেতরটা হঠাৎ গুড়গুড় করে উঠল। দড়িতে শুকোতে দেওয়া গামছাটা কোমরে জড়াতে জড়াতে সে দোতলার বারান্দা থেকে মোহিতের গলা শুনতে পেল।
‘কে রে, কে? কী হয়েছে? ও পুলক? কী হয়েছে রে? কোন গণ্ডগোল?’
‘মোদ্দা, একটু নিচে আসবে? জরুরি কথা আছে।’
‘কী কথা বল না!’
‘এভাবে বলা যাবে না। নিচেয় এসো না একবার।’
‘আসছি, দাঁড়া।’
মোহিত ঘরে এসে লুঙ্গির ওপর একটা টি-শার্ট গায়ে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা আঁচড়ে দেখে নিল চেহারাটা। শম্পা, মোহিতের বউ জিগ্যেস করল,
‘কী হয়েছে, গো? এত সকালে এসে পুলকদা এত চেঁচামেচি করছে কেন?’ মুচকি হেসে মোহিত বলল,
‘এ সব পলিটিকের খেলা। ও সব তোমার না বোঝাই ভালো। আজ ভোরে হরদা মাডার হয়েছে। খবর পেয়ে তাই দৌড়ে এসেচে।’ শম্পা আতঙ্কে শিউরে উঠল, উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘হরদা মাডার হয়েছে? বলো কী গো? আর তুমি চুপ করে বসে আছো? তোমাকে কতো ভালবাসত। এই সেদিনই আমাদের বিয়েতে এসে কত কথা বলল। বলল, “শম্পা তোমার হাতে একটা খ্যাপা ঘোড়া তুলে দিলাম, তাকে বাগ মানাতে হবে!” আর আজ মাডার?’ মোহিত নির্বিকার ভাবে বলল,
‘বললাম যে পলিটিকের খেলা। আমি আসচি, কী বলে দেকি।’
পুলক এবং তার দলবল অধৈর্য হয়ে উঠছিল। খবরটা এতই জরুরি। মোদ্দা গুরুত্বটা বুঝতে পারছে না। মোহিত ধীরে সুস্থে নিচেয় নেমে, সদর দরজা খুলল,
‘আয়, ভেতরে আয়।’ ভেতরের বারান্দায় ঢুকেই পুলক বলল,
‘মোদ্দা, হরদা মার্ডার হয়েছে।’
‘কি বলছিস? কখন? কী ভাবে? কারা করল, কোন খবর পেয়েছিস?’
‘ভোরে হরদা রোজ হাঁটতে যায়, বকুলতলা পার্কে। পার্কের গেটের মুখে দুটো ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হরদা কাছাকাছি যেতেই পেছনের সিটে বসা ছেলেটা পাঁচ রাউন্ড ফায়ার করেছে। দুটো পেটে, একটা গলায়, একটা কানে। হরদা পড়ে যেতেই, সামনের ছেলেটা বাইক নিয়ে চম্পট!’
‘সিকিউরিটি কেউ ছিল না? সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি?’
‘নিয়ে গেছিল, সদানন্দ জেনারেলে। গাড়ি জোগাড় করতে দেরি হয়েছিল একটু। হাসপাতালে নেওয়ার পর বলল, ডেড, কিছু করার নেই। বলছে কান আর গলারটাই...’
‘পোস্টমর্টেম হবে তো? তোরা হাসপাতালে যা। যত তাড়াতাড়ি পারিস, হরদাকে বের করে আন। হাসপাতাল থেকে মিছিল করে, পার্টি অফিসে নিয়ে যাবো। সেখানে সারাদিন হরদা থাকবেন। তারপর বিকেলের দিকে আমরা শ্মশানে নিয়ে যাবো।’
‘ঠিক আছে, মোদ্দা।’
‘বাকিরা কোথায়? হৃদয়, তপন, বিজন, মলয়, তরুণ?’
‘হৃদয় থানায় আছে। বাকিরা হাসপাতালে।’
‘হুঁ। ঠিক আছে, সুমনবাবুর সঙ্গে আমি কথা বলছি।’ হাসপাতালের সামনে পাণ্ডে চকে আমরা একটা পথসভা করবো, তার ব্যবস্থা কর। আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি। কলকাতাতেও একবার ফোন করতে হবে। এখনই বেরিয়ে পড় - অনেক কাজ, সময় নেই!’
পুলকরা বেরিয়ে যাওয়ার পর, সদর দরজা বন্ধ করে দিল মোহিত। পিছন ফিরে দেখল খগেন দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। একটু হেসে বলল,
‘বাবা, আমি না বলা পর্যন্ত, তুমি কিন্তু কোত্থাও বেরোবে না...। তোমার যা দরকার শম্পাকে বলবে, ও আনিয়ে দেবে।’ তারপর তরতরিয়ে উঠে গেল দোতলায়। ঘরে ঢুকে টি-শার্ট খুলতে খুলতে শম্পাকে বলল,
‘চট করে খাবার দাও তো। সারা দিন কপালে কিছু জুটবে কী না, কে জানে?’
‘দুপুরে খেতে আসবে না?’
‘পাগল হয়েছো? আজ সারাদিন একদম টাইম পাবো না। ফিরতেও রাত হবে। সেই শ্মশান থেকে ফিরবো।’
‘শোনো না। গাড়িটা সময় করে একবার পাঠিয়ে দিও, টিফিন কেরিয়ারে পাঠিয়ে দেবো।’
‘সেটা খারাপ বলো নি। তবে, মাছ – মাংস কিছু দিও না। পাব্লিক দেখলে নজর দেবে। ডিম চলতে পারে। আমি চান করতে ঢুকছি, তুমি বেকফাস্ট রেডি করো। ও হ্যাঁ, সাদা পাজামা আর কলার দেওয়া সাদা পাঞ্জাবিটা বের করে রাখো, চান করে ওটাই পরবো।’
৪
‘বন্ধুগণ, আজ আমরা ভয়ংকর এক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ, নীতি-দুর্নীতির কোন বাছবিচার নেই। ক্ষমতার লোভ আর ছোট ছোট স্বাত্থের নেশায় আমরা কী মনুষ্যত্ব ভুলে যাচ্ছি? আমরা চিরকাল গণতান্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি, শাসকপক্ষ – বিরোধীপক্ষ, গণতন্তের দুই স্তম্ভ। কিন্তু নীচ ঘৃণ্য কিছু রাজনীতিক যারা যে কোন উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। তারা বারবার অশান্তি আর সন্তাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এসব তাদের হতাশার লক্ষণ, তারা জানে তারা কোনদিনই সফল হতে পারবে না। যার ফলে এই এলাকার সব থেকে শোদ্ধেয়, সমাজের বন্ধু, যিনি আমাদের সমস্ত দুঃখে বিপদে আমাদের সকলের মাথার ওপর ছাতার মতো ভরসা জুগিয়েছেন, তিনি আজ নিহত। তাঁর নিশংস এই মিত্যুর জন্যে দায়ী কে? পোশাসনের কাছে আমাদের দাবি, অবিলম্বে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তদন্ত করতে হবে কারা কারা আছে এই ষড়যন্তের পিছনে?
‘বন্ধুগণ, আমরা কিন্তু ভয় পাইনি। আমরা পিছিয়ে যাবো না। সত্যের জন্যে ন্যায়ের জন্যে আমাদের এই লড়াই থেমে থাকবে না। বিরোধীদের এই জঘন্য চক্কান্ত আমরা ভাঙবোই। দেশ থেকে এই সব জঘন্য নিশংস পিশেচদের নিকেশ না করা পর্যন্ত আমাদের এই লড়াই চলতেই থাকবে। হরিহরদা আমার বড়ো ভাইয়ের মতো ছিলেন। তাঁর এই অকাল পয়াণে, আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কাজেই আজ আর বেশি কিছু বলে আপনাদের সময় নষ্ট করবো না। শেষ করার আগে, আমি শুধু বলতে চাই, বন্ধুগণ আজ হিংসার দিন নয়। কোন পোরোচণায় পা দেবেন না। গুজবে কান দেবেন না। হিংসার বদলা হিংসা আমরা চাই না। হিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করা যায় না। আমরা শান্তিপূন্নভাবে মিছিল করে হরিহরদার প্রতি শেষ শোদ্দা জানাবো। আমরা এই সন্তাসের মোকাবিলা করবো রাজনৈতিক ভাবে। জয় হরিহরদা। হরিহরদা তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলবো না। হরিহরদা অমর রহে।’
মোহিতের উদাত্ত বক্তৃতায় সমবেত জনতা আপ্লুত। তারা মোহিতের সঙ্গে একসঙ্গে গর্জন করে উঠল, হরিহরদা অমর রহে। হরিহরদা তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলবো না। অস্থায়ী মঞ্চ থেকে নেমে এল মোহিত। পিছনে একটা মেটাডোর গাড়ি সাদা কাপড়, ফুল আর অজস্র ধূপ দিয়ে সাজানো। মাঝখানে লোহার খাটের ওপর স্ট্রেচারে হরিহরদার মরদেহ। সাদা চাদরের ওপর ফুলে ফুলে ঢাকা। দুই নাকের ফুটোয় তুলো দেওয়া না থাকলে মনে হত, হরিহরদা ঘুমোচ্ছে। তরুণ আর মলয়কে মোহিত ইশারা করল গাড়ি এগিয়ে নিয়ে আসার জন্যে। তারপর মোহিত নিজে মিছিলের সামনে এগিয়ে গেল। তার দুপাশে রইল তার দলের মাঝারি নেতারা। তার পরনে সাদা পায়জামা, গুরুশার্ট, পায়ে সাদা স্নিকার্স। বুকের কাছে ছোট্ট কালো একটা ব্যাজ। সকলে প্রস্তুত কিনা একবার দেখে নিয়ে, হাতের ইশারা করে চিৎকার করে বলল, ‘সন্তাসবাদীদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।’ তারপর একসঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল পার্টি অফিসের দিকে, যেখানে হরিহর সর্দারের মরদেহ শুইয়ে রাখা হবে। তাঁর গুণগ্রাহী ভক্তদের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
মিছিল চলতে শুরু করল। মেটাডোর হরিহর সর্দারের মরদেহ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাকে ঘিরে মিছিলের লেজ চলে গেছে অনেক দূর। মোহিতের আন্দাজে হাজার ছয়-সাত লোক তো হবেই, আটও হতে পারে। মোহিতের চেহারায়, আচরণে আজ অদ্ভুত পরিবর্তন। এ তল্লাটে হরিহর সর্দারের পর সেই যে অবিসংবাদিত নেতা, উপস্থিত জনতার মনে এ নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। মিছিলের সামনে একটা পুলিশের জিপ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। থানার বড়ো এবং মেজবাবু হেঁটে চলেছেন মিছিলের আগে। তাঁরা গতকাল পর্যন্ত মোহিতকে মোহিতবাবু বলতেন, আজ সকাল থেকে বলছেন, স্যার। বেশ কয়েকজন কন্সটেবলও রয়েছেন, তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে সতর্ক লক্ষ্য রাখছেন। মোহিতের আজ ম্লান মুখ, আজ সকালে সে দাড়িও কামায়নি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। হরিহরদার মৃত্যুতে সে যেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। জোড়হাত করে দুপাশের রাস্তার ধারে, দোকানের সামনে, বাড়ির জানালায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ও মহিলাদের নমস্কার করছে। মাঝে মাঝে হাত নাড়তে নাড়তে বলছে ‘হরদা, তোমায় আমরা ভুলছি না ভুলবো না।’ পিছনের মিছিল গর্জে উঠছে একসঙ্গে।
কিলোমিটার দুয়েক চলার পর, মোহিত দুপাশে পুলক আর হৃদয়ের কাঁধে হাত রাখল। যেন খুব ক্লান্ত। পার্টি অফিস পৌঁছতে আরো প্রায় দেড় দু কিলোমিটার বাকি। মিছিলের গর্জনের মধ্যেই মোহিত চাপা স্বরে বলল,
‘কোথা থেকে কী যে হয়ে যায়, ভগবানই জানেন। কাল রাত সাড়ে বারোটার সময় তোরা যখন হরদার বাড়ি থেকে বেরোলি, তখন কেউ ভাবতে পেরেছিলি, আজ এমনটা হবে?’ পুলক আর হৃদয় দুজনেই শিউরে উঠল। তাদের দুজনেরই মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, মোহিতের সেটা নজর এড়াল না। ‘তুই, হৃদয়, আমি, কত দিন, সন্ধে, সারারাত, হরদার ওই বৈঠকখানায় কাটিয়েছি, বল? সেই হরদা বলল “মালটাকে এখনই খালাস করতে না পারলে....”’ কথাটা শেষ করল না মোহিত। ঘাড়ে ঝাঁকানি দিয়ে মিছিলের সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ‘হরদা আমরা তোমায় ভুলছি না। ভুলবো না। ভুলবো না ভুলবো না।’ তারপর গলা নামিয়ে বলল ‘ভুলবো না রে, পুলক তোকেও না, আর তোকেও না, হৃদয়। ভুলবো না।’ দুজনেরই শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল শীতল আতঙ্কের স্রোত। মৃত্যুর মিছিল এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে।