আপনার ব্যাপার অনেক শুনেছি স্যার, আমার মনে হয়েছে আপনিই কেবল আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। অনেক কষ্টে আপনার খোঁজ পেয়েছি। যারা আপনার এখানে এসেছিলেন তাদের অনেকেই...
— উনাদের কথা বাদ দিন। আপনি আপনার সমস্যার ব্যাপারে কথা বলুন।
স্যার, আমার সমস্যার ব্যাপারেই যেহেতু বলতে এসেছি, তাই সেটিই বলবো, কিন্তু আমার সমস্যাটি শুনতে হলে বা বুঝতে হলে আপনাকে আমার গল্পটি শুনতে হবে। আমার মনে হয় সব সমস্যা গল্পের মতো, বা গল্পই মনে হয় সমস্যার মতো, আপনার কি মনে হয়? — আমার মনে হয়, সময়। সময়ই গল্প, সময়ই সমস্যা।
এবং সময়ই জগৎ বিস্তার। আপনি এটা ঠিক বলেছেন। এজন্যই হয়ত পবিত্র গ্রন্থাদিতে জগৎ বিধাতা নিজেকে সময় বলেন। আমাদের গল্প এবং অগল্প সকল কিছুর ভিত্তিভূমিই তো হচ্ছে সময়।
— ঠিক আছে। আপনি আপনার গল্পটি শুরু করুন।
জী। আমার গল্পটি শুরু করা যায় আমার ছোটবেলা থেকে। আমাদের গ্রামের পেছনে, আমাদের গ্রামটি অনেক সবুজ ছিল, প্রচুর গাছগাছালিতে এবং অসংখ্য পাখপাখালিতে পূর্ণ। সেই, আমাদের গ্রামের পেছনে ছিল বড় একটি দীঘি। এই দিঘিতে বর্ষাকালে প্রচুর পানি হতো। বর্ষাকালে দিঘি দিয়ে নৌকা চলতো। আর আমার নানার একটি ছোট নৌকা ছিল এবং কয়েকটি বড় নৌকা ছিল। আমার চাচাতো ভাই আব্দুল হামিদ পাখি পুষত। শালিক। আমরা তখন মনে করতাম শালিক পাখি একদিন ঠিক মানুষের মতো কথা বলতে শিখবে। কিন্তু ঠিক মানুষের মতো কথা বলতে কোন পাখিকেই আমি এ পর্যন্ত দেখি নি। খুব সম্ভবত এইসব জিনিস রেয়ার হয়। হঠাৎ হঠাৎ কোন পাখি মানুষের মতো কথা বলা শিখতে পারে, কিন্তু সব পাখি পারে না। যেমন দেখা যায় হঠাৎ হঠাৎ কোন মানুষ পাখির মতো হয়ে গেছে। মগধের লোকেরা নাকি এতদঞ্চলের লোকদের পক্ষীজাতীয় মনে করতো। এই ইতিহাসের সত্যতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, কোন কোন মানুষ মাঝে মাঝে পাখি হয়ে যায়, ফলে মূলে ঠুকরায়। আমি এমন মানুষ দেখেছি। আমার বাবা এমন মানুষ ছিলেন। সবার অলক্ষ্যে তিনি গাছের ডালে উঠে বসে থাকতেন। তাঁর নাম ছিল সইদুল্লা। তিনি যখন গাছের ডালে বসে থাকতেন, তখন আমার বৃদ্ধ দাদী গাছের নিচে গিয়ে, প্রগাঢ় মমতার সাথে ডাকতেন, বাপ, ও বাপ, সইদুল্লা, নাইমা আয় বাপ!
গাছের উপর থেকে আমার বাবা পাখির স্বরে জবাব দিতেন। অবিকল পাখির মতো।
— আচ্ছা, আপনি বলছিলেন দিঘিটা নিয়ে।
হ্যাঁ, দিঘি, আমার চাচাতো ভাই আব্দুল হামিদ যখন পাখি পুষত, শালিক পাখি, তখন সেই পাখির জন্য কাচা হরিং ধরতে আমরা যেতাম দিঘিতে। কাচা হরিং মানে কি আপনি বুঝতে পারছেন? সবুজ রঙের ঘাসফড়িং। দিঘির জলে যেসব লতাপাতা জাতীর উদ্ভিদ জন্মে, এসবের মধ্যে ঘাসফড়িংরা থাকতো। আমরা ছোট নৌকা দিয়ে সেখানে গিয়ে ঘাসফড়িং ধরে ধরে, তাদের দুই প্রধান ঠ্যাঙ ফেলে দিয়ে, প্লাস্টিকের বোতলে ভরে নিয়ে আসতাম। কোমল পানীয়ের বোতল বা পানির খালি বোতলে। সেইসব বোতলের মধ্যে আবার কয়েকটা ছিদ্র করে দেয়া হতো। যাতে সেদিক দিয়ে বাতাস প্রবেশ করতে পারে। কারণ তা না হলে ঘাসফড়িংরা নিঃশ্বাস নিতে পারবে না ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সবার জন্যই। প্রাচীন যোগীরা বলে গেছেন, প্রাণীর জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্বাস বরাদ্দ থাকে। তাই ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে শ্বাস ফেলা উচিত, এক্ষেত্রে দীর্ঘজীবন লাভ হয়। অবশ্য বোতলবন্দি ঘাসফড়িং-এর জন্য এই যোগীদের উপদেশ মেনে দীর্ঘ শ্বাস নিলে-ফেললেও কোন লাভ ছিল না। কারণ তারা ধৃত হয়েছে, এবং অচিরেই পক্ষীর ভোজনে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে। এটা খুব মজার জিনিস নয় কি? খুবই মজার জিনিস।
— আপনি আপনার মূল গল্পে আসুন।
হ্যাঁ, সেটাতেই আসছি। এর জন্যই মূলত দিঘির প্রসঙ্গ আনা। ঐ দিঘিতে ঘাসফড়িং ধরতে গিয়ে একবার আমি পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম, লগির বাড়ি খেয়ে। সাঁতার তখন অল্পবিস্তর জানতাম। কিন্তু তবুও দ্রুত পড়ে যাওয়ার ফলে পানির কিছু গভীরে চলে যাই প্রথমে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি সন্ত্রস্ত ছিলাম এবং পানির নিচে যখন তাকালাম, দেখলাম যে লাল নীল কতো সহস্র ফুল ফুটে আছে। এতো সুন্দর সে দৃশ্য, আমি বলে বুঝাতে না পারি। সুন্দরের তীব্রতায় আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার সাথে যারা ছিল তারা আমাকে টেনে তুলে। তারা ভেবেছিল হয়ত পানি খেয়ে আমি ডুবে গিয়েছিলাম। তাই স্কুলে-শেখা প্রাথমিক চিকিৎসাজ্ঞান কাজে লাগাতে তারা আমাকে নৌকায় রেখে পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা শুরু করেছিল। কিন্তু তখন আমি ঘুম থেকে মানুষ উঠে যেমন তাকায় সেরকম ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হইছেটা কি? চাপাচাপি ক্যান?
এই হলো স্যার আমার জীবনের অত্যাশ্চর্য ঘটনা। এই ঘটনার পর আমি বদলে যাই।
— কীরকম?
এই দিনের পর আমার মনে হতে থাকে আমি যা দেখে এসেছি, এর চাইতে সুন্দর আর কিছু নাই। কোথাও নাই। আমার ইচ্ছা হয় আমি সেই সৌন্দর্য সম্পর্কে অন্যদের বলি। কারণ সুন্দর সম্পর্কে না বলা গেলে যেন মনে হয় ঐ সুন্দরের অস্তিত্ব নাই। কিন্তু বলতে গিয়ে দেখলাম, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। তখনই আমার ছবি আঁকার ইচ্ছা হয়। নিতান্ত ভেতরের প্রয়োজনের তাগিদে আমি ছবি আঁকতে শুরু করি। একের পর এক ছবি। মানুষ মুগ্ধ হয়, বিস্মিত হয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি আমি যে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে চাচ্ছি, তা আরো সুন্দর, আরো বেশী সুন্দর।
— এটাই আপনার সমস্যা?
হ্যাঁ, না মানে, এটাই ছিল প্রাথমিকভাবে। ঐ লাল নীল ফুলের দৃশ্য আমার বার বার মনে পড়ত। আমি প্রতিবারই ঐ দৃশ্য আঁকতে বসতাম। একই ছবি। কিন্তু কেমন করে যেন ভিন্ন কিছু হয়ে উঠত। বার বার একই ছবি...একই ব্যর্থতা ইত্যাদিতে আমি বিমর্ষ ছিলাম। এই সময়ে আমি এলকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ি। তবে সমস্ত ব্যাপারটা তখনো সহনীয় ছিল। সহনীয় বলতে একজন আর্টিস্টের, একজন প্রকৃত আর্টিস্টের জীবন যেমন সহনীয় হয় আর কি। সব সময় যেন একটা ব্যর্থতার বোধ, সব সময় যেন একটা ভালো কিছু আমি করতে পারি, এমন একটা পিকিউলিয়ার অসহায়তার বোধ।
কিন্তু এরপরে একদিন থেকে শুরু হলো সেই মারাত্মক সমস্যা। কিভাবে শুরু হলো আমি বলতে পারি না। অতি মারাত্মক সমস্যাগুলি হয়ত এরকম। তারা কীভাবে শুরু হয়, ঠিকঠাক বলা যায় না।
আপনি জানেন নিশ্চয়ই অটোমান সুলতান ইবরাহিমের অনেক কনকুবাইন ছিল। এই ইবরাহিম তার ২৮০ জন রক্ষিতাকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।
সেই ২৮০ জন সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে কোনভাবে মাছ হয়ে যায়। আমি সেই মাছেদের আঁকতে পারছি না। সমস্যাটি আপনি বুঝতে পারছেন স্যার?
— হ্যাঁ, পারছি। বলে যান।
আমার দুঃখে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা হয়। আমার মনে হয় আমি কোন ভালো চিত্রকর হতে পারি নি। অতি তুচ্ছ হয়েছি, তুচ্ছ এক ছবি আঁকার লোক মাত্র।
সেই মাছেদের আমি দেখতে পারি। ঘুমন্ত অবস্থায় আমার অবচেতন যেন অন্যরকম সচেতন হয়ে উঠে, আর সেথায় এসে উপস্থিত হয় সুলতান ইবরাহিমের হারেম বন্দিনীরা, যারা সাগরের তলদেশে মাছ হয়ে গিয়েছিল।
তারা আমার সাথে কথা বলে। হাস্য করে, তাচ্ছিল্য করে। আমি তাদের দেখি, কথা শুনি আর নিজের ক্ষুদ্রতায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে। আমি বার বার, অজস্র বার চেষ্টা করেছি তাদের ছবি আঁকতে। কিন্তু প্রতিবারই উদ্যতযৌবনা, সমুদ্র থেকে উঠে আসা খলবল মাছের ছবি আঁকতে গিয়ে আমি এঁকে ফেলি ভ্যানিটাজ।
আমার খারাপ লাগে। মনে হয় যে আমার সব শেষ হয়ে গেছে, ও আমি মরে যাব। আমি কি মরে যাব বলে আপনার মনে হয়?
— না। মরবেন না, মৃত্যুই তো সকল কিছুর শেষ। আর শেষ মানে তো একেবারেই শেষ এখানে, সমাপ্তি। তাই মরার কথা আসছে না। আপনার বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। কাগজপত্র যা সাথে এনেছেন, এবং আমার কিছু ইন্টারনেট রিসার্চে দেখলাম, আপনাকে মাতিসের মতো বড় শিল্পী হিসেবে দেখা হয়। তাহলে একটা ছবি আঁকতে না পারায় আপনার এতো তুচ্ছতার বোধ আসার কথা না। আর যা আঁকছেন, ভ্যানিটাজ, জীবনের নশ্বরতার চিত্র, তাও বা কম কি? এগুলির তো ভিন্ন অর্থব্যঞ্জনা আছে, নয় কি? তার মানে আপনি এক ধরনের আর্ট করতে গিয়ে অন্য ধরনের করছেন। কিন্তু আর্টই তো করছেন। তাই আপনার তুচ্ছতার বোধ আসার কথা না। কিন্তু যেহেতু আসছে, তাই ধরে নেয়া যায় ছবি আঁকতে না-পারার যন্ত্রণায় নয়, অন্য কোন এক কারণে আপনি যাতনা ভোগ করছেন। সেটা হতে পারে ঐ দিঘির সাথে সংযুক্ত কোন ঘটনা, অথবা হতে পারে অন্য কোন ঘটনা।
আপনি কি বলতে চান? এরকম কোন ঘটনা হলে আমি কি আপনাকে বলতাম না? অবশ্যই বলতাম। আমি এখানে এসেছি নিজের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে। আমি এসেছি সুস্থতার আস্বাদ পেতে, এখানে আমি নিশ্চয়ই কিছু লুকাবো না।
— আমি বলছি না আপনি ইচ্ছে করে কোন কিছু লুকিয়েছেন। আপনি কেন এখানে এসেছেন, যে উদ্দেশ্যের কথা বললেন, এ ব্যাপারেও আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক ব্যাপার আছে, ভাবুন সুলতান ইবরাহিমের কথা। কনকুবাইনদের নিয়ে থাকতো সে সুলতান। একবার সে জানতে পারলো তার এক কনকুবাইন অন্য এক লোকের সাথে রতিক্রিয়া করেছে। এইজন্যই সে তার সব রক্ষিতাকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়, তাই নয় কি?
জী, এটাই।
— কিন্তু আপনি বলার সময় একটা বিষয় আমাকে বলেন নি। আপনি বলেন নি কোন কারণে ইবরাহিম তার রক্ষিতাদের ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আপনি কারণটি ছেড়ে গেছেন।
কিন্তু এটি ইচ্ছে করে নয়। দ্রুত কথাবার্তায় হতেই পারে এটা।
— আমি বলছি না ইচ্ছে করে বা সচেতনভাবেই আপনি এটি করেছেন। করেছেন অবচেতনে। এমন অনেক কিছু হয়ত আপনি এড়িয়ে গেছেন দিঘি নিয়ে বলার সময়ে।
তার মানে...আপনি বলতে চাচ্ছেন...আমি কি এড়িয়ে যাব!
— ভেবে দেখুন। উত্তর আপনার মধ্যেই আছে।
একটি ব্যাপার আমি বলতে পারি, ঐ দিঘি নিয়ে, যা আগে বলি নি, আমার কাছে মনে হয় নি অত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এখন মনে হলো ঐ ঘটনাটিও আমার জীবনের এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। যদিও এটি নিয়ে আমি খুবই কম ভেবেছি।
— ঘটনাটি বলুন।
আমার চাচাতো ভাই আব্দুল হামিদের কথা আপনাকে আগেই বলেছি। আব্দুল হামিদ আর আমি একসাথে মাছ শিকারেও যেতাম। অনেকদিন রাতেও গিয়েছি। আমাদের ওখানে এক বড় হাওড় আছে, নাম দেখার হাওড়। ওখানে আমরা কতবার মাছ ধরতে গেছি, দিনে ও রাতে। কিন্তু সেদিন ছিল শনিবার। আপনি নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন দিন হিসেবে শনি মঙ্গলবার খুব একটা ভালো না। তখন এটি আমার কিংবা আব্দুল হামিদ কারোরই মনে ছিল না। দিঘিতে নতুন পানি এসেছে, এবং বিচিত্র ধরনের মাছেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে। আব্দুল হামিদ আর আমি উড়াল জাল নিয়ে ও নৌকা নিয়ে গেলাম দিঘির মাঝখানে। আমরা মাছ ধরতে লাগলাম। কিছু সময় পর আব্দুল হামিদ ও আমার অনেক গরম লাগতে শুরু করলো। আকাশে সূর্য তখন প্রখর। আমরা দুজনেই নেমে গেলাম দিঘির জলে। সেখানে আব্দুল হামিদ ডুব দিয়ে দিয়ে মাছ ধরতে শুরু করল। আমরা এক প্রতিযোগিতায় লাগলাম কে কয়টা মাছ ডুব দিয়ে ধরতে পারে। আমি একটা ভেদা মাছ ধরেছিলাম আর সেটি নৌকায় রাখতে যাবো তখনই দেখতে পাই আব্দুল হামিদ একটি কই মাছ ধরেছে, আর মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটিয়ে সে মাছটি মুখ দিয়ে কামড়ে ধরে পুনরায় মাছ ধরতে ডুব দিয়েছে।
আমি নৌকায় আমার ছোট মাছটি যখন রেখেছি, তার একটু পরেই আব্দুল হামিদ পানির নিচ থেকে ভেসে উঠল। সে খুবই দ্রুত সাঁতরে নৌকার দিকে এলো। তাকে আমার অস্বাভাবিক লাগছিল। আমি নেমে ওকে টেনে তুললাম।
আব্দুল হামিদ চিৎকার করছিলো দু হাতে গলা চেপে ধরে। আমি দেখলাম তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
জ্যান্ত কই মাছটি তার ভেতরে প্রবেশ করেছে। হয়ত অসাবধানতাবশত কামড় আলগা হয়েছিল, আর জীবন বাঁচাতেই কই মাছ যেদিকে জায়গা পেয়েছে সেদিকেই ছুটে গেছে। কিন্তু সেদিকটা হয়েছে আব্দুল হামিদের অন্তঃস্থল, নিশ্চয়ই এখন মাছটি খাদ্যনালি ছিঁড়েফুড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বা পাকস্থলীতে উদ্দাম নৃত্য করে বেড়াচ্ছে মুক্তির আশায়, আর তার পিঠের তীক্ষ্ণ ফলাগুলি আব্দুল হামিদের পাকস্থলীর দেয়ালকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে।
এসব ভাবতে ভাবতে আমি ভয়ে জমে গেলাম। তবুও যথাসম্ভব দ্রুত নৌকা চালিয়ে পাড়ে আসতে লাগলাম। আমার সামনে নৌকায় ছটফট করতে করতে, একসময় আব্দুল হামিদ মাছের মতো পানিতে লাফিয়ে পড়েছিল।
পরদিন তাকে পাওয়া যায় দিঘির অন্য পাড়ে, মৃত।
এই গল্পটি আমার কাছে অত প্রাসঙ্গিক মনে হয় নি। তাই হয়ত বলি নি। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
— এই গল্পটিও ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আমার ধারণা সুলতান ইবরাহিমের রক্ষিতাদের মাছ হয়ে যাওয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। বরং, আমরা অন্য ভাবে ভাবতে পারি। ধরে নিন, আপনি সুলতান ইবরাহিম। আপনি কোন নারীকে ভালোবাসতেন। একদিন জানতে পারলেন সে অন্য লোকের সাথে শুয়েছে। তাই আপনি তাকে ঐ দিঘিতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন।
এসব অবাস্তব কথা আপনি বলছেন। এটা কেন হবে? কেমন করে হবে? আমি আপনার ব্যাপারে অনেক ভালো ভালো কথা শুনে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি দেখছি বুজুরুকি দিয়ে ব্যবসা করেন। আপনার কথায় কোন যুক্তি নাই। আপনি মানুষকে মিথ্যা বলেন। ভুল ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেন। আমার মনে হচ্ছে, মানুষ যে ধাঁধা থেকে মুক্তি পেতে আপনার কাছে আসে, আপনি তাদের আরো বড় ধাঁধার মধ্যে, ভিন্নরকম ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়ে আপনার ব্যবসাটা করে নেন। নীচ, জঘন্য মনোবৃত্তি আপনার। আপনার ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
— নিতে পারেন। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। উত্তেজিত হবার দরকার নেই। আপনি আমার কাছে এসেছেন সমস্যা নিয়ে। আপনার গল্প বলেছেন। আমার কাজ বিশ্লেষণ করা, সমাধান দেয়া। আমি দিয়েছি। আমি আমার পদ্বতিতে কাজ করি। যে পদ্বতিতে আমি কাজ করি, তার যুক্তি অনুসারেই আমি সমাধানে পৌছাই। আপনার ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে।
কিন্তু কিভাবে? কিভাবে এটি সম্ভব? কোন যুক্তিতে আপনি একথা বললেন? আমি আপনাকে যা যা বলেছি, তা থেকে এমন অদ্ভুত কথা বলা যায় না। এছাড়া আমার যিনি স্ত্রী ছিলেন, তিনি এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন, যদিও আমার সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। ফলে, আপনি যা বলছেন, তা অবাস্তব। অবাস্তব কল্পনা।
— আমি আপনার গল্প শুনেছি। আপনি যা বলেছেন তা শুনেছি, যা লুকিয়ে গেছেন তাও শুনেছি। একজন প্রকৃত গল্পের শ্রোতা যেমন করেন, প্রকৃত পাঠক যেমন করেন। যা উপস্থাপিত হয় তাই নয় কেবল, উপস্থাপনের ভঙ্গি এবং এর আড়ালও হচ্ছে গল্প। গল্প যদি রোদ হয়, আলো হয় তাহলে আড়াল হচ্ছে ছায়া। আলোর মাঝে মাঝে থাকা ছায়াদের নিয়েই প্রকৃত চিত্র। কেবল আলো লক্ষ্য করলে কখনোই ঠিকমতো বুঝা যাবে না সব।
আপনি কি কি ছায়া পেলেন? আর কি দেখে আপনার সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন?
— আপনি গল্পে যা বলেছেন, যা লুকিয়েছেন, তা তো আছেই। এসব নিয়ে আমি আর কিছু বলব না। আপনি আপনার আঁকা যেসব চিত্র এনেছেন, সেগুলির দিকে লক্ষ করে দেখুন। সুলতান ইবরাহিমের হারেম বন্দিনীদের ছবি আপনি আঁকতে চেষ্টাই করেন নি। আপনি একটা মাছই আঁকতে চেয়েছেন। অর্থাৎ, ঐ নারীকে যাকে আপনি ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তো ডুবে নি, আপনার অবচেতন অংশে সে শক্তিশালী রূপে অবস্থান করছে, এবং একসময় ফিরে এসেছে অটোমান সুলতান ইবরাহিমের ডুবিয়ে দেয়া ২৮০ জন রক্ষিতাকে সাথে নিয়ে। তাদের মাধ্যমেই সে আপনার সাথে যোগাযোগ করছে হয়ত, অথবা হতে পারে তাকে হত্যাজনিত অপরাধবোধ আপনার মধ্যে ছিল, আর সেটাই এইসব হারেম বন্দিনীদের মৎস্যরূপ কল্পনা করে নিয়েছে।
একেবারে বাজে কথা সব। আপনার কাছে আসাই আমার ভুল হয়েছে। আপনার সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে।
— হয়ত।
কিন্তু...আপনি যা বললেন, যে সমাধান দিলেন, তা শুনে আমার মনে হচ্ছে এখন, আপনাকে আমার জীবনের আরেকটা অধ্যায়ের কথা বলা যায়। সবার জীবনেই কালো কিছু জায়গা থাকে, অন্ধকার কিছু অংশ থাকে। যেটা সে সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখে। আমিও লুকিয়ে রেখেছিলাম। কাউকে বলি নি। নিজেও ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপনার সেই গল্পটা বলা যায়। বলব কি?
— আজ আর সময় নেই। আজ নয়। আপনি আগামী সপ্তাহে আসুন।
কিন্তু গল্পটি বলা আমার খুব দরকার। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আপনি আমার সমস্যার তীব্রতা বুঝতে পারছেন না।
— বুঝতে পারছি আমি। কিছু ওষুধ দিচ্ছি। রাতের বেলা, ঘুমানোর আগে খাবেন।
আর ঘুম! ওরা, অর্ধ মৎস্য-মানবীরা আসে রোজ, দরজায় ধাক্কায়। কথা বলে ফিসফিস করে। আমি ঘুমাতে পারি না। আপনি আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন না।
— আমি যা বলছি তা শুনুন। আপাতত যে ওষুধ দিয়েছি, তা খান। আগামী সপ্তাহে আসুন, আপনার গল্প শুনব।
কিন্তু...আচ্ছা...ঠিক আছে। আগামী সপ্তাহে আপনাকে পাবো তো?
— হ্যাঁ, পাবেন। এখন সোজা চলে যান।
ওকে যাচ্ছি, বিদায়।
— ভালো থাকুন।