• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • আবর্ত : পূর্বিতা জানা পুরকায়স্থ


    র কতবার চান করলে আমি পরিষ্কার হব? গা ঘিনঘিন করছে। ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তপা নিজেকেই নিজে বলছিল। নীলাঞ্জনা তপার ঘরে বিছানায় বসে ওকে লক্ষ্য করছিল। উঠে গিয়ে বলল চলে এস, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। তোমার গায়ে কোত্থাও নোংরা লেগে নেই। হাতের আঙুলগুলো দেখেছ? জল লেগে লেগে কেমন সাদাটে হয়ে গেছে।

    জল তো ভেতর অব্দি কিছুতেই পৌঁছুচ্ছে না। ভেতরটা তো নোংরাই থেকে গেল। কি করে ভেতরটা ধোব আমি? আমাকে ওরা নোংরা করে দিল। এই শরীরটা যদি ছেড়ে দেওয়া যেত! তপার চোখ ভাবলেশহীন। স্বরে কোনো উত্তাপ নেই।

    নীলাঞ্জনা আর তপার মায়ের চোখাচোখি হল। মায়ের চোখে জল। কষ্টের ছায়া মুখ জুড়ে।

    নীলাঞ্জনা এগিয়ে গিয়ে তপার কাঁধে হাত রেখে বলল, তপা, শরীরের ভেতরটা যদি ধোয়া যেত তাহলে আমরা সবাই তোমাকে তাই করতে বলতাম। আর তুমি অপবিত্র হবে কেন? তোমার মনে তো কোন পাপ নেই। তপা সব শুনে শিশুর মত তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ওকে যেন ভরসা করতে চাইছে। যেন আশ্রয় খুঁজছে ওর মধ্যে।

    গত একমাস ধরে তপা নীলাঞ্জনা ছাড়া আর কারুর সাথে কথা বলে নি। মা, বাবা, অনিরুদ্ধ কারুর সাথে নয়। নীলাঞ্জনা একটা এনজিও-তে উঁচু পদে কাজ করে। তপার ঘটনাটা শুনে নার্সিংহোমে দেখতে যায়। তপার বাবা রাজ্য সরকারের রিটায়ার্ড আধিকারিক। ঘটনার পর মিডিয়ার লোকেদের থেকে তপাকে আড়াল করার জন্যে উনি অনেক চেষ্টা করেছেন। নীলাঞ্জনাকে প্রথমে দেখা করতে দেন নি। পরে ওর ব্যবহার ওঁকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করেছে। প্রথম দিন হাসপাতালের কেবিনে ঢুকে নীলাঞ্জনা দেখেছিল তপা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ইনফিউশন স্ট্যান্ডে স্যালাইনের প্যাকেট ঝোলানো। একটা চোখের চারদিক ফোলা ও নীলচে। ঠোঁটে ক্ষতচিহ্ন। কানের লতিতে সেলাই। শরীরের আর কোথায় কি আঘাত রয়েছে তা তখনকার মত বোঝার উপায় ছিল না। গায়ে চাদর আর চোখের কোনে শুকনো জলের রেখা। ক্যাথিটার লাগানো। মাথার পাশে মা ও পায়ের কাছে বাবা বসে ধ্বস্ত ন্যুব্জ দুটো স্তম্ভের মত অবস্থা সামলানোর চেষ্টা করছেন।

    নীলাঞ্জনা চোখ নামিয়ে বলল, মাসিমা, আমি কি ওর পাশে একটু বসতে পারি?

    — ও তো কারুর সাথে কথা বলছে না।

    — আমি কিচ্ছু জিজ্ঞেস করব না। শুধু বসব ওর কাছে।

    নীলাঞ্জনা খেয়াল করেছিল সেই থেকে তপা একবারের জন্য চোখ খোলে নি। মাঝে মাঝে চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আর মুখটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মা জল মুছিয়ে দিচ্ছেন। ও এগিয়ে গিয়ে তপার মাথায় হাত রাখল। ধীরে ধীরে চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। তপা তাকাল না। একই ভাবে শুয়ে রইল।

    হাসপাতালে তপা যতদিন ছিল নীলাঞ্জনা রোজ যেত। তপার মা ও বাবার সাথে কথা বলে চলে আসত। তপা একটা কথাও বলেনি কোনোদিন। তবু নীলাঞ্জনা যেত রোজ; কেন জানি তপাকে দেখে ওর খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। কাগজে যখন খবরটা পড়েছিল তখন আলাদা কিছু মনে হয় নি। প্রতিটা রেপ সার্ভাইভারের সাথে যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দেখা করতে যায় তপার সাথেও সেভাবেই দেখা করতে এসেছিল ও। কিন্তু দেখা হবার পর মেয়েটার প্রতি একটা আলাদা টান ও অনুভব করেছে। কী সুন্দর দেখতে তপাকে! কৌলিন্য ও বুদ্ধির সমন্বয় ওর সৌন্দর্যকে আলাদা ব্যাপ্তি দিয়েছে।

    নার্সিংহোম থেকে তপা বাড়ি ফিরে আসার পর নীলাঞ্জনা ক্রমেই যেন ওদের বাড়ির লোক হয়ে উঠেছিল। ওই বিপদে যখন আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা কৌতূহল কিংবা সমালোচনার পাহাড় নিয়ে মিশতে আসে তখন নীলাঞ্জনা একমাত্র ব্যতিক্রম। ও প্রায়ই ওদের বাড়িতে যেত। একদিন তপার মা নীলাঞ্জনাকে কফি দিয়ে পাশে বসতেই ও জিজ্ঞেস করল — শুধু আমার?

    — এই বাড়িতে খাওয়া দাওয়া উঠে গেছে মা। নিতান্তই ক্ষিদে মেটানোর জন্যে খাওয়া। তুমি আসছ বলে আমরা কথা বলি। তিনজন পাশাপাশি ভূতের মত বাস করছি। রাতে ঘুম নেই। মেয়েটার দিকে তাকাতে পারি না। বাইরে বেরোলে মনে হয় আমরাই অপরাধী। এটা কি সমাজের লজ্জা নয়? সমাজের কোন দায় নেই এতে?

    একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে নীলাঞ্জনা বলল

    — আমি আজ থানা হয়ে এসেছি মাসিমা। অনিরুদ্ধের শুরু করা কাজটাকে সবাই মিলে শেষ করতে হবে।

    — থানায় কি বলল?

    — সাস্পেক্টেড আসামীদের ওরা প্যারেড করাবে। তখন আইডেন্টিফাই করতে হবে।

    — এ তো অসম্ভব নীলা!

    — আমিও তাই ভাবছি।

    — তার মানে পুলিশ এরেস্ট করেছে।

    — তাই তো মনে হয়।

    — আচ্ছা নীলা, অনিরুদ্ধ কখন এফ. আই. আর. করেছিল?

    — থানার রেকর্ড অনুযায়ী পরের দিন ভোরবেলায়।

    — ভোরবেলায়? তাহলে তপাকে যখন ওরা বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে গেল তখন ও কোথায় ছিল? তারপর থেকে একবারও ও যোগাযোগ করেনি!

    — কী ভাবে করতো মাসিমা? ও তো মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। শেষ রাতে যখন জ্ঞান ফিরে আসে তপাকে ও অনেক খোঁজে। তারপর একাই যায় থানায়। পুলিশ ওকে সারারাত বাইরে বসিয়ে রাখে। আহত দেখেও কেউ ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায় নি। শেষে বসে থাকতে না পেরে ও বেঞ্চে শুয়ে পড়ে অবশেষে যখন ওকে ভেতরে ডাকল তখন ভোর হয়ে এসেছে। ওর চোখের চারদিকে কালশিটে ও ফোলা মুখ দেখে ওসি নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন — কোথায় মারপিট করে এলে?

    অনিরুদ্ধ মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে পুরো ঘটনাটা বলার পর ওসি বললেন, রাত দশটার ঘটনা আর এখন ভোর সাড়ে চারটা, পাখি পালিয়েছে। এফ. আই. আর. তো কর তারপর দেখছি। অনিরুদ্ধ কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার, সূর্যতপার কী হবে? ওর একটু খোঁজ করবেন না? আমি পাঁচ ঘন্টা ধরে এখানে অপেক্ষা করছি স্যার। কিছু তো একটা করুন।

    — কোথায় থাক?

    — হস্টেলে।

    — ডাকলেই আসতে হবে কিন্তু।

    সেই থেকে অনিরুদ্ধ অসংখ্যবার থানায় গেছে। গত একমাস ধরে কাজ একটুও এগোয় নি। আমারও কোন পলিটিকাল কানেকশন নেই যে কাজে লাগাব।

    — কিন্তু অনিরুদ্ধ কেন একবারও এল না বাড়িতে? তপার মোবাইলটা না হয় ওরা নিয়ে গেছে। বাড়িরটা তো আছে।

    — ও আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারছে না। ও নিজেকে অপরাধী ভাবছে।

    — কেন?

    — ও ভাবছে ও তপাকে প্রোটেকশন দিতে পারেনি।

    ।। ২ ।।


    নীলাঞ্জনা তখন বাড়িতে। তপার মায়ের ফোন এলো।

    ক্লাবের ছেলেরা বাড়িতে আসতে চাইছে নীলা।কী হবে?

    — মেশোমশাইকে ক্লাবে দেখা করতে বলুন।

    পরে নীলা শোনে এতে ক্লাবের ছেলেরা রাজি হয় না। ওরা তপার সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু তপা দেখা করতে চাইছিল না।

    অগত্যা নীলাঞ্জনা তপাকে রাজী করানোর ভার নিল।

    — আমার এ ব্যাপারে কথা বলতে ভাল লাগে না।

    — আমরা বুঝি তপা। কিন্তু পাড়ায় থাকতে হলে কিছু আপোষ তো করতেই হবে। তোমার উত্তর দেবার ইচ্ছে না করলে চুপ করে থাকবে।

    বিকেল পাঁচটা নাগাদ পাঁচ-ছয় জন ছেলে এল। ওদের বসতে দিয়ে তপার বাবা মা বসলেন উল্টোদিকে পাশে নীলাঞ্জনা ও তপা।

    একজন জিজ্ঞেস করল নীলাঞ্জনাকে, আপনি?

    — ওর বন্ধু।

    এবার তাদের মধ্যে একজন তপার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি পুলিশের কাছে কিংবা আমাদের কাছে সব খুলে বলছ না কেন? তপা নীলাঞ্জনার দিকে অসহায় চোখে তাকাল।

    নীলাঞ্জনা বলল কী বলবে? অন্ধকারে ও কী কারুর মুখ দেখতে পেয়েছে?

    — এতক্ষন ধরে ঘটনাটা ঘটল ও কাউকে চিনতে পারল না! আপনারা চেপে যাচ্ছেন।

    — তাতে আমাদের লাভ?

    আবার আরেকজন বলল পুলিশ যাদের ধরেছে তাদের আইডেন্টিফাই না করলে কেসটা টিঁকবে না। আচ্ছা, তোমার সঙ্গে যে ছেলেটা ছিল তোমার বন্ধু না কে, তার ঠিকানাটা দাও দেখি!

    নীলাঞ্জনা বলল, অনিরুদ্ধ থানায় গিয়েছিল আর পুলিশ যাদের দাঁড় করিয়েছিল তাদের কেউই সেই রাতে ওখানে ছিল না।

    দলের একজন আরেকজনকে বলল, মনে হচ্ছে সবাই ওই দলেরই বুঝলি। একবার ফাঁদে ফেলতে পারলে হয়।

    — আচ্ছা কাকু, আপনি তো অনেকদিন রাজ্য সরকারের বড় অফিসার ছিলেন, কেউ শত্রুতা করল না তো!

    — এতদিন পর! তপার মায়ের গলায় উষ্মা। উনি তো রিটায়ার করেছেন আজ তিন বছর!

    — আচ্ছা কাকু চলি। আপনার পুরোনো যোগাযোগ কাজে লাগিয়েও তো কিছু করছেন না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকলে কী হবে! আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।

    নীলাঞ্জনা লক্ষ্য করল তপার বাবার বেদনাদীর্ণ মুখটা আরো দীর্ণ হয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পুরো সময়টা জুড়ে তপা দেয়ালের দিকে দুটো চোখ স্থির রেখে বসেছিল। মাঝে মাঝেই মুখের ছবিটা পাল্টে যাচ্ছিল। কখনো ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছিল, চোখ জলে ভরে উঠছিল, কখনো মুখ বেঁকে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়।

    ।। ৩ ।।


    নীল হ্রদ আমার স্বপ্নে আর আসে না। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের মাথায় সেই হ্রদ যেখানে দেবতারা আসেন স্নান করতে; চারদিক তখন সুন্দর গন্ধে ভরে যায়। সেই হ্রদ আরো অনেক কিছুর মত হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। আর সেই বাড়িটা! সূর্যের প্রথম আলোতে স্নান করে যে রোজ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত; তার অবয়বও আমার কাছে আর স্পষ্ট নয়। ধোঁয়াশায় ঢেকে গেছে।

    এখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে; বন্ধ জানালার কাঁচ বেয়ে জল পড়ছে। এই বৃষ্টি কি পারবে পৃথিবীর শরীরের সমস্ত দাগ মুছে ফেলতে? আমাকে যেখানে ওরা আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, সেই দাগ কি মুছবে এই বৃষ্টিতে? সেই দাগ মুছলেও আমার মনের দাগ মুছবে কীসে? যে দাগ আমার সমগ্র আমিকে গ্রাস করে ফেলছে ক্রমশ।

    এখন যাকে আমার সবচেয়ে প্রয়োজন সেই বা কোথায়? একদিনও তো যোগাযোগ করল না! আমাকে কি তাহলে উপেক্ষা করছে?

    তপা লিখতে লিখতে হু হু করে কেঁদে ওঠে। চোখের জল ওর মনের ক্ষত ধুইয়ে দিতে থাকে। আর মন অন্ধ গলিতে ভালবাসার অর্থ খুঁজে চলে।

    ।। ৪ ।।


    কেসটা দাঁড়ায়নি শেষপর্যন্ত। অনিরুদ্ধ একা তদ্বির করে কিছুই করতে পারেনি। নীলাঞ্জনা চেয়েছিল অনিরুদ্ধের সাথে দেখা করে কেসটাকে নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে। এই ভেবে ওর সাথে দেখাও করতে গিয়েছিল একদিন। হস্টেলের ভিসিটর রুমে বসে দেখতে পাচ্ছিল লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে আসছে অনিরুদ্ধ। দীর্ঘ চেহারাটা কেমন নুয়ে গেছে! চোখ বসে গেছে। দেখে মনে হচ্ছিল কতদিন ভাল করে ঘুমোয় নি।

    — কেমন আছ অনিরুদ্ধ?

    অনিরুদ্ধ ম্লান হেসে বলল, তপা কেমন আছে?

    — ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে। ও নিশ্চয় তোমার ফোনের অপেক্ষায় আছে। তোমাকে এখন ওর খুব প্রয়োজন।

    অনিরুদ্ধ মাথা নিচু করে বলল, দিদি পুরুষ হয়েও আমি ওকে বাঁচাতে পারি নি। কী ভাবে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াই?

    নীলাঞ্জনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

    — তোমাকে কি আর থানা থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল?

    — না।

    — তাহলে কেসটা আর এগোয় নি!

    — আদৌ কি কিছু এসে যায় তাতে? আমাদের যে ক্ষতি হয়ে গেল তা অপূরণীয়।

    দুজনের দীর্ঘশ্বাস সেই ক্ষণটাকে ভারী করে দিল। মাথা নিচু করে বসে থাকা অনিরুদ্ধের পিঠে হাত দিয়ে নীলাঞ্জনা বলে,

    — আজ চলি, নিজের খেয়াল রেখো। দেখল জলে ভরে আছে ওর চোখ।

    সেই শেষ দেখা! ঘটনার পর হস্টেল থেকে ওর মোবাইলে লোড করা নং দেখে যাদের ফোন করে জানানো হয়েছিল নীলাঞ্জনা তাদের একজন। তাহলে কি তপাকে ওরা সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিল? অনিরুদ্ধের চলে যাবার খবর তপার মা-বাবাকে নীলাঞ্জনাই দেয়। তপার কাছে পুরো ব্যাপারটাই গোপন রাখা হয়েছে। নীলাঞ্জনার মনে হয়েছিল চেনা জগৎ থেকে অনিরুদ্ধ অনেকটাই আলাদা। যেতে যেতে ও 'ভালবাসা' শব্দটাকে এক নতুন অভিধা দিয়ে গেল। তপার জন্যে ওর কষ্ট হয়। ভালবাসার এত সুন্দর ফল্গুধারা ওর জীবনে এসেও এল না।

    ।। ৫ ।।


    কটা ঝড় এতদিনে তার সমস্ত রেখাচিহ্ন নিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছে। নীলাঞ্জনা নিয়ম করে তপাদের বাড়িতে যাতায়াত করে। এরকমই একদিন কথায় কথায় ও জিজ্ঞেস করে

    — মাসিমা, ছেলে এখন কোথায়?

    — ইউএসএ-তে। ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই রকেট সায়েন্টিস্ট।

    — তপার ব্যাপারটা ওদেরকে জানান নি।

    — জানিয়েছি অনেক পর। ওরা প্রচণ্ড শক্‌ড। শুনেই বলল তপাকে এখানে নিয়ে চলে এস। নতুন করে জীবন শুরু করবে। তপার সাথেও কথা বলেছে।

    — এত বড় ভরসা কে দেয়! তপা কী বলেছে? ও রাজি তো?

    — এখনো কিছু বলেনি। তুমি একটু জিজ্ঞেস কোর তো মা।

    নীলাঞ্জনা তপার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তপা বসে আছে ওর পড়ার টেবিলে। নীলাঞ্জনাকে দেখে ম্লান হেসে বলল — এস, কখন এলে?

    — অনেকক্ষন, মাসিমার সঙ্গে ছিলাম। তুমি কী করছ?

    — আমি লিখছিলাম।

    — তুমি ডায়েরি লেখো?

    — হ্যাঁ। তবে আগে লিখতাম অনিয়মিত, এখন এটাই আমার একমাত্র সাথী।

    — আর আমি?

    — তোমাকে কতক্ষণ পাই? তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। তপা নীলাঞ্জনার হাত ধরল।

    — সত্যি! এভাবে তো আমাকে কেউ বলেনি! কিন্তু তুমি তো অনেক দূরে চলে যাবে দাদার কাছে।

    — দাদা বলছে যেতে। আমি এখনো কিছু ঠিক করিনি।

    — তুমি অবশ্যই যাবে। এরকম সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়।

    — কিন্তু নীলা, আমার এই শহর, এই বাড়ি সব ছেড়ে চলে যাব?

    — বাড়ি তো তোমারই থাকবে। ক’বছর পর যখন সবার স্মৃতিতে ঘটনাটা ম্লান হয়ে যাবে তখন তুমি ফের চলে আসবে। আর শহর? কী দিয়েছে তোমাকে এই শহর? নিরাপত্তা দিতে পেরেছে? না কি সুবিচার দিতে পেরেছে? তুমি অবশ্যই যাবে! নতুন করে জীবন শুরু করবে। জীবনের এই অংশটাকে মুছে ফেলে নতুন করে লিখবে। এতদিন ধরে যা কিছু ঘটে গেছে তা অন্য কেউ লিখেছে। এবারের ঘটনাগুলো তুমি লিখবে। কালকের সূর্যোদয় তোমার জন্য হবে তপা।

    — আমার জন্যে?

    — হ্যাঁ তোমার জন্যে। প্রতিদিন সূর্যোদয় হয় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সাহসে ভর করে দাঁড়িয়ে ওঠা মানুষের জন্যে। আর তুমি তো সূর্যতপা! সূর্যের তপস্যা কর তাই না?

    — কিন্তু আমি তো সবকিছু মুছে ফেলতে চাই না জীবন থেকে। আমার ছোটবেলা, আমার স্কুল, স্বপ্নগুলো, আমার বাড়িটা, অনিরুদ্ধ। তপা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। নীলাঞ্জনার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এতদিন পর ও অনিরুদ্ধের নাম উচ্চারণ করল। তপা কাঁদুক। ঘটনার পর থেকে ও একবারও এভাবে কাঁদে নি। বরফ গলছে। গলে নদী হোক, সেই জলে চান করে নতুন জীবনের অভিষেক হবে। একটাই আফসোস সেই জীবনে অনিরুদ্ধ থাকবে না।

    নীলাঞ্জনা তপার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

    — মাসিমা, তপা কাঁদছে। অনিরুদ্ধের কথা বলছে। ও ইউএসএ-তে যেতে রাজী হয়েছে, আপনার ছেলেকে জানিয়ে দিন। অনিরুদ্ধ ওর মনে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক।

    দুজনের চোখে তখন জল।

    ।। ৬ ।।


    পাদের পাসপোর্ট আগেই করা ছিল। ভিসার জন্যে আবেদন করা হল। একটু একটু করে যাবার আয়োজন সম্পূর্ণ হল। ও ওখানে গিয়ে কী করবে তাও ঠিক হয়ে গেল। সবাই খুশি এই ভেবে যে তপা জীবনের স্রোতে ফিরে আসছে!

    যাবার তখন দিন তিনেক বাকি। তপা নীলার হাতটা ধরে বলল নীলা, তুমি কি অনিরুদ্ধের কথা জান?

    — কী কথা?

    — এই ও আর আমি যে ভাল বন্ধু।

    — হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

    — আমি যে চলে যাচ্ছি তা তো ও জানে না। না জানিয়ে চলে গেলে তো ও দু:খ পাবে।

    — একেবারে গিয়েই না হয় যোগাযোগ কোরো। একটা বিরাট সারপ্রাইস হবে।

    তপা ম্লান হাসল।

    — নীলা, আমি তোমাকে খুউব মিস করব।

    — ওখানে কত বন্ধু হবে তোমার! আমাকে তখন মনেই পড়বে না।

    — এরকম কক্ষনো হবে না। তুমি যেভাবে আমার মনকে ছুঁতে পার এভাবে কেউ পারে না। অবশ্য আরেকজন পারে!

    নীলা চোখ নামিয়ে নিল। ভাবল কী হবে এই মেয়ের? সত্য যেন চিরকাল গোপনই থাকে!

    তপাদের ফ্লাইট ছিল শেষরাতে। দুপুর নাগাদ নীলাঞ্জনা ওদের বাড়িতে দেখা করতে যায়।

    — মাসিমা, গোছগাছ সব শেষ নিশ্চয়।

    সবাইকে চুপ থাকতে দেখে নীলাঞ্জনা ঘাবড়ে যায়। তপার মা মৃদুস্বরে বলেন, ও যাবে না বলছে।

    — যাবে না!

    নীলাঞ্জনা একছুটে তপার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

    তপা মাথা নিচু করে বসে আছে। টেবিলে ডায়েরি খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। বোধহয় লিখছিল।

    ও তপার মাথায় হাত রাখল।

    তপা ফিরে তাকিয়ে বলল, নীলা, আমি যেতে পারছি না। ভেতর ভেতর অনেক যুদ্ধ করলাম। পারলাম না। আমি অনিরুদ্ধের সঙ্গে আবার নতুন করে স্বপ্ন গড়ব। সেই বাড়িটা, সেই হ্রদটা আবার আমার স্বপ্নে আসবে। আমি এসব ছেড়ে কিছুতেই যেতে পারব না নীলা! কিন্তু এই ভেবেও খারাপ লাগছে ....... নীলাঞ্জনা কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিল না। ওর পা ঠকঠক করে কাঁপছিল। তপাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলে নিতে চাইল। বাইরে তখন মৃদু মৃদু সন্ধ্যা নামছে। সময় প্রস্তুত হচ্ছে আরেকটা রাতের জন্যে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments