• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • নকশী কাঁথার মাঠ : সৈকত ভট্টাচার্য



    || ১ ||

    ঘুমটা ভাঙতেই সাঁঝবাতি টের পেল যে নটা বাজে। এর জন্য ঘড়ি দেখার প্রয়োজন পড়ে না। বাবার গাড়ির শব্দ খুব ভাল করেই চেনে সে। সাঁঝবাতির যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, তবে থেকেই রবিবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে ঠিক সকাল নটায় বাবার গাড়ি গেট দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখে আসছে। বাবা মানুষটা এতটাই পাংচুয়াল যে এই চেম্বারে যাওয়ার জন্য গাড়ি বের করা দেখে ঘড়ি মেলান যেতে পারে। গাড়ির শব্দটা শুনে আজ ভারি মন খারাপ হয়ে গেল সাঁঝবাতির।

    বিছানায় শুয়েই ঘরের মধ্যে চারিপাশটা একবার দেখল। ঠিক কবে থেকে যে এই ঘরটা ‘ওর ঘর’ হয়ে গেছিল, সেটা ঠিক মনে পড়ে না এখন। ক্লাস ফাইভ বা সিক্স। একদিন মা ডেকে বলল, “সাজু, তুমি এখন বড় হয়ে গেছ। এই ঘরটা তোমার ঘর। তোমার পড়াশোনা, তোমার খেলার জিনিস, গল্পের বই - সব এখানে থাকবে। আর ওই আলমারিতে থাকবে তোমার জামাকাপড়। আর এই খাটটাও তোমার। একা থাকতে হবে তো…”

    প্রথম কদিন যে একা রাতে ঘুমাতে ভয় করেনি, তা নয়। তবে নিজের সাথে থাকার যে একটা স্বাধীনতা - সেটা সে অনুভব করেছিল। তাই খুব ভয় পেলেও টিনটিন কিংবা ফেলুদার কথা ভেবে মনে সাহস এনে ঘুমিয়ে পড়ত। মাকে ডাকেনি কখনও এর জন্য। মা-বাবাও এটা খুব ভাল করে বুঝেছে যে কোনটা সাজুর ব্যক্তিগত পরিসর। সেই ছোট বয়স থেকেই ক্লাসের অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মায়েরা বাড়ি ফিরলে যেমন স্কুলের ব্যাগ চেক করত, কী হোমটাস্ক আছে, কোন টীচার কী বলল, স্কুলে গিয়ে টীচারের সাথে কথা বলা - সাজুকে কোনদিন এসবের সম্মুখীন হতে হয়নি। মা তাকে দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছিল। অন্তত নিজের দায়িত্বটুকু। স্কুলে হোমটাস্ক করে না নিয়ে গেলে যে শাস্তি পেতে হবে, সেটা সাজু জানত। তাই তার নিজের হোমটাস্কের জন্য মাকে কোনওদিন ভাবতে হয়নি।

    নটা অবধি শুয়ে থাকাটা খুব একটা সাধারণ ঘটনা নয় সাজুর জন্য। সাতটা বাজলেই উঠে পড়াটা বাবার কাছ থেকে শেখা। বাবা অবশ্য আরও আগে ওঠে। এখনও। উঠে সামনের পার্কে দশ পাক হেঁটে বাড়ির সামনে থেকে খবরের কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরা। এ যেন রুটিনে বাঁধা কাজ মানুষটার। চেম্বারে বের হওয়ার সময়ের মত এসবেরও কোনওদিন নড়চড় হতে দেখেনি সাজু। ডাক্তার অমিয়াংশু মিত্রের মত ব্যস্ত পেডিয়াট্রিক সার্জেনের পক্ষে এত সময়ানুবর্তিতা বজায় রাখতে গেলে যে কতটা ডিসিপ্লিনড হতে হয়, সেটাই শেখার। সাজু শেখে। ছোটবেলা থেকে এই মানুষটার কাছ থেকে জীবন সম্পর্কে এত কিছু শিখেছে যে বলে শেষ হবেনা। এখনও শেখে, রোজ শেখে।

    আজ উঠতে একটু দেরিই হল। বিছানায় উঠে বসে বেড সাইড টেবিলে রাখা বইটা চোখে পড়ল। ‘দ্য এপিক সিটি’। কাল রাতে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যেই রেখেছে। একটা কোণা একটু মুড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে ঠিক করে দিল। বইটা এই কোলকাতা নিয়ে। তার এত বছরের চেনা শহরটার আনাচ-কানাচ নিয়ে। শহরটা ছাড়ার আগে, এই সব কিছু যেন বড্ড আপন হয়ে উঠছে সাজুর কাছে - এই শহরটা, এই বাড়িটা, এই ঘরটা - এমনকি পাশের কোলবালিশটার জন্যেও খুব মন খারাপ করছে।

    সাজু বিদেশ পাড়ি দেবে কাল। পিএইচডি করতে সেই আমেরিকা। একটা ভাল ইউনিভার্সিটিতে ফুল স্কলারশিপ সহ এরকম অফার পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু তাতে ওর মন খারাপটা কাটছেনা। কাল ভোররাতের ফ্লাইট ধরে উড়ে যেতে হবে। আরব সাগর, পুরো ইউরোপ, গোটা অতলান্তিক সাগর পার হয়ে সেই আমেরিকা। পৃথিবীর একেবারে অন্য প্রান্ত। সব ছেড়ে যাওয়া। জানেনা আর কখনো বরাবরের জন্য এই ঘরটা তার হয়ে উঠবে কিনা।

    নীচের থেকে মায়ের ডাকে এইসব চিন্তার জাল ছেঁড়ে। ব্রেকফাস্ট তৈরী। জলদি নীচে আসতে বলছে।

    ‘আসছি। দাঁড়াও।’ বলে ঘর লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে দরজা দেয় সে।


    || ২ ||

    রূপল অটোতে উঠতে গিয়ে আকাশের মেঘটা দেখল। ছাতাটা ডাইনিং টেবিলের উপরেই রয়ে গেছে। মা বারবার করে বলে দিল। তাও দেরী হয়ে গেছে বলে তাড়াহুড়োতে ভুলে গেল। এত ভুলে যায়! নিজের উপর নিজেরই রাগ হয় মাঝে মাঝে। যাই হোক, এখন তো আর ফিরে যাওয়ার মানে হয়না। বন্ধুরা অলরেডি অপেক্ষা করছে। আবার ফেরত গিয়ে আসতে হলে মারবে ওরা।

    সবাই মিলে আজ দেখা করার কথা আছে। সাউথ সিটি মলে। কলেজের বন্ধুরা। কলেজের পর মাস্টার্স করার সময় সবাই ছিটকে গেছিল এদিক সেদিক। কিন্তু মাস্টার্স শেষ করে সবাই আবার গুটিগুটি এক হয়েছে। শুধু সাঁঝবাতিটা বিশ্বাসঘাতক। ফটাস করে একটা পি এইচ ডি বাগিয়ে পাড়ি দিতে চলেছে আমেরিকায়। কাল চলে যাবে। তার আগে তাই বন্ধুরা মিলে দেখা করার প্ল্যান করেছে। একসাথে লাঞ্চ, তারপর আড্ডা দিয়ে বিকেলে ফেরা।

    পাশে এক বিপুলাকায় মহিলা উঠে রূপলকে প্রায় পিষে দিল। অটোতে মাঝে বসা এই সমস্যা। নিজের হাতগুলো যে কোথায় রাখবে বুঝে পাওয়া যায়না। ভেবেছিল ট্যাক্সি নেবে। কিন্তু এই মাসের শেষে টিউশনির টাকা যা আছে তা গুনে গেঁথে দেখল ট্যাক্সি নেওয়াটা নেসেসিটি হলেও সেটা উপস্থিত পরিস্থিতির বিচারে লাক্সারির বাকেটে পড়ছে। অতএব ‘হামারা বাজাজ’ই ভরসা। অটো।

    নাহ, পাশের মহিলার চাপে হাতের প্যাকেটটা না ছিঁড়ে যায় এবার। সাজু চলে যাবে বলে সকালে আগে বেরিয়েছিল গিফট কেনার জন্য। একা সাজুকে দিলে খারাপ দেখায়। তাই সৌম্যশ্রী আর অরিত্রিকার জন্যও কিনেছিল। তিনটে প্যাকেট র‍্যাপ করে মনে রেখেছিল যে উপরেরটা সাজুর, মাঝেরটা সৌম্যশ্রীর আর নিচেরটা অরিত্রিকার। আলাদা রঙের র‍্যাপার নিলেই হত। কিন্তু তাড়াহুড়োয় আবার ভুল হয়ে গেছে রূপলের।

    সাজুর সাথে সেই ক্লাস ইলেভেনের টিউশন থেকে বন্ধুত্ব। হ্যাঁ, বন্ধুত্বই। খুব কাছের বন্ধু শৌনক বা আবীর ছাড়া বন্ধুত্বর ভিতরে একটা গোপন গভীর ব্যথা যে রূপলের হৃদয়ের কোথায় লুকিয়ে আছে সেটার টের পায়না কেউ। এমনকি সাজুও পায়নি। আসলে রূপল পেতে দেয়নি কখনও। কলেজে থাকতে সাজুর এক বয়ফ্রেন্ড ছিল। ওর বাবার কোন বন্ধুর ছেলে। সেসব হাই সোসাইটির প্রেমের গল্প প্রায়ই শুনত। সানডে কিছু করার নেই বলে তাজ বেঙ্গলের পাবে কিংবা ক্যালকাটা ক্লাবে গিয়ে একটু সময় কাটিয়ে আসত ওরা। বাকি বন্ধুদের মত রূপলও, “কী রে, তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল?” বলে ইয়ার্কি ফাজলামো মেরে এসেছে। সাজুর বয়ফ্রেন্ডের নাম শেষে ‘শ্যামলাল'ই হয়ে গেছিল ওদের কাছে।

    অটোর উইন্ডস্ক্রীনে বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়তেই প্রমাদ গুনলো রূপল। রাস্তা পার হয়ে মলের ভিতর ঢুকতে তো ভিজে যাবে! বৃষ্টির ছাঁট থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য দুপাশের দুজনেই মাঝের দিকে চাপতে শুরু করেছে। এবার তো ও স্যান্ডুইচ হয়ে যাবে! মনে হল এক ধাক্কায় দুটোকে ফেলে দেয়। ছাতাটা না নিয়ে বের হয়ে কি বিপদে পড়ল! বাড়ি ফিরে মা তো দেবেই আজ, মায়ের কথা না শুনলে কী কী হতে পারে - তার লম্বা ফিরিস্তি!

    ‘সাউথ সিটি নামবেন’ হেঁকে দাঁড়িয়ে গেল অটো। আর কী হবে! পকেট থেকে টাকাটা বের করে দিয়ে ঝপাস করে নেমেই পড়ল রাস্তায়। আর নামতে গিয়েই হাতের প্যাকেট থেকে তিনটে গিফট ছড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।


    || ৩ ||

    “মাইরি তোকে কি সুন্দরী লাগছে রে! আমেরিকায় যাবি বলে রূপ লাবণ্য ফুটে বের হচ্ছে তো! ফিরে এলে তো চেনা যাবেনা… ” অভিষেক ধপাস করে বসে পড়ে এক নিশ্বাসে বলে ফেলল কথাগুলো। সত্যি আজ সাজুকে বেশ লাগছে। একটা গাঢ় জলপাই রঙের জিন্সের উপর সাদাটে টপ পরেছে। মাথার চুলগুলো পিছনে ক্লিপ দিয়ে বাঁধা। দু এক কুচি অবাধ্যের মত কপালের উপর গড়াচ্ছে। দুকানে দুটো ছোট্ট গাঢ় সবুজ দুল লতিগুলোতে চেপে বসে আছে।

    আপাতত সবাই মীট করার জন্য ফুডকোর্টটাই বাছা হয়েছে। এরপর সবাই মিলে কোথাও একটা খেতে যাওয়া হবে। 'ক্যাফে মেজুনা’ সাজুর পছন্দের। ও তাই ওটাই সাজেস্ট করছিল। অরিত্রিকা আর সৌম্যশ্রী এসে গেছে আগেই। এই ছেলে দুটোই লেট লতিফ। অভিষেক তাও এসে গেছে। রূপলটা এখনও এসে পৌঁছায়নি। একটু আগে যখন ফোন করল বলল রবীন্দ্র সরোবর থেকে অটোতে উঠছে। কোথায় কে জানে!

    অভিষেকের কথায় সবাই হেসে উঠল। অভিষেকের মুখে লাগাম এমনিতেই একটু কম। কোথায় কখন থামতে হয় এই বোধগুলোর অভাব। কলেজে নামই হয়ে গেছিল ‘ব্রেকলেস'। এখনো একই আছে। বলে চলেছে, "সাঁঝবাতি, কদ্দিন পর দেখলাম তোকে! এরপর তো আরও কতদিন দেখতে পাব না! প্লিজ যাস না আমায় ছেড়ে… “ সাজু টেবিলের তলা দিয়ে পাটা চালিয়েই দেয় অভিষেকের পা লক্ষ্য করে। আর তখনই দেখতে পায় যে প্রায় কাক ভেজা হয়ে রূপল এস্কেলেটর দিয়ে উঠে আসছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি? দূরের কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে দেখার চেষ্টা করে সাজু।

    - “এ কি রে! ভিজলি কেন?” সৌম্যশ্রী বলে ওঠে।

    - “কী করব? আমার বাপের তো গাড়ি নেই! আসার সময় তো একটু তুলেও আনতে পারতিস! হাড় কেপ্পনের যে স্ট্যাটাস চেঞ্জ হয়না তোকে দেখে বোঝা যায়।” ব্যাস! এসেই এদুটোর ঝগড়া শুরু হয়ে গেল! রূপল আর সৌম্যশ্রীর ‘না দেখলে প্রাণে মরি, দেখলে কাটাকাটি’ - অবস্থা। চোখের আড়াল হলেই 'শ্রী-এর মনটা এমনিতে ভাল’, ‘রূপলটা এখনও ইমম্যাচিওর্ড’ - এইসব চলতে থাকে। দেখলেই শুরু হয়ে গেল।

    তবে আজ সৌম্যশ্রী ওয়াক ওভার দিয়ে দিল। রূপলের কথায় উত্তর না করে অরিত্রিকার সাথে কী একটা বলে হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল। পকেট থেকে রুমাল বের করে তাই দিয়ে মাথা মুছে ‘এই মেয়েগুলো, চিরুনী বের কর কেউ একটা’ বলে সাজুর পাশেই বসে পড়ল। অরিত্রিকা ব্যাগ থেকে একটা চিরুনী বের করে এগিয়ে দিল। রূপল সেটা নিয়ে অভিষেকের থুতনি ধরে ‘আমার দিকে তাকিয়ে থাক’ বলে ওর চশমায় নিজের রিফ্লেকশন দেখে মাথাটা আঁচড়ে নিল। অভিষেক সেই ফাঁকে রূপলের দিকে চেয়ে হেঁড়ে গলায় ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন/ আজ ওই চোখে সাগরের নীল’ গেয়ে নিল দুকলি।

    রূপল চিরুনীটা অরিত্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা অভিষেক, তুই কি ট্যারা?”

    “কেন? ট্যারা হতে যাব কেন?” গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করল অভিষেক।

    “নাহ, আমার দিকে তাকাতে বললাম। তুই আমার দিকে চোখ করে সাজুর জন্য গান গাইছিস তো…” কথা শেষ হওয়ার আগেই সাজুর হাতের মুঠোয় রূপলের সদ্য আঁচড়ানো চুলের দফারফা হয়ে গেল। অরিত্রিকা বিনা বাক্যব্যয়ে চিরুনীটা আবার এগিয়ে দিল রূপলের দিকে।


    || ৪ ||

    ফ্লাইট অন টাইমই ছিল। বরাবরের মত উইন্ডো সীট বেছেছিল সাজু। হাতে দুটো ব্যাগ। ল্যাপটপওলা ব্যাগটা থেকে একটা বই বের করে ছোট হ্যান্ডব্যাগটায় ঢুকিয়ে নিয়ে সেই ব্যাগটা ওভারহেড লাগেজ কম্পার্টমেন্টে তুলে দিল। জানলার ধারে বসে ব্যাগটা সীটের পাশে রেখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় সাজু। প্লেনের পেটের মধ্যে জিনিসপত্র তুলছে দুজন লোক। অন্য একটা ছোট গাড়ি এসে টায়ারের হাওয়া চেক করছে। চলছে খাবার তোলার পালাও। বাইরে অল্প আলো ফুটছে। একটা মায়াবী আলোর আভা গোটা শহরটার বুকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। এর পর ধীরে ধীরে সকাল হবে। মালতীমাসি কাজে এসে বেল বাজাবে। বাবা তৈরী হবে। খবরের কাগজটা নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে মায়ের কাছে বকুনি খাবে, “খাবার সময় খবরের কাগজটা না নিয়ে বসলেই চলেনা তোমার? দুটো কথাও তো বলতে পার আমার সাথে!” বাবা হাসবে। কিছু বলবে না। ঠিক নটার সময় গাড়িটা বের হয়ে যাবে গেট দিয়ে। সত্যিই এই সব হবে আজ? বাবার আজকেও একটুও দেরী হবে না? বাবা কি বাথরুমে একটু বেশী সময় কাটাবে না আজ? মা কি আজকেও বাবাকে বকবে? বাবা নিশ্চই আজ পার্কে হাঁটতে যাবেনা। তাই খবরের কাগজটা বাড়িতে ঢুকবে মালতীমাসির হাত দিয়ে। কিন্তু মালতীমাসি যদি কামাই করে আজ? সাজু নেই - সাজু এই শহর, তার প্রিয় বিছানা, বালিশ, ঘর, পড়ার টেবিল সব ছেড়ে চলেছে অতলান্তিক পার হয়ে - এর কোনও প্রভাব থাকবেনা তার বাড়িতে?

    পাশের ভদ্রলোক এসে বসতেই সাজুর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসি হাসলেন একটা। সাজু একটু হেসে কোমরের সীটবেল্ট লাগিয়ে নিল। মাঝরাতে বের হয়েছে। এই ফ্লাইটটা বোম্বে ছুঁয়ে উড়ে যাবে নিউ ইয়র্কের দিকে। তার আগে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। নইলে মাথাটা ধরে যাবে। এই ভেবে হ্যান্ডব্যাগ থেকে নেকপিলোটা বের করতে যেতেই চকচকে কাগজে মোড়া দুটো গিফট নজরে পড়ল।

    কাল ফেরার আগে ছেলেদুটো ওদের সবাইকে গিফট দিয়েছে। যদিও অরিত্রিকা আর সৌম্যশ্রী কোথাও যাচ্ছে না। তবু সাজুর জন্য ওরাও গিফট পেয়ে গেল। এই নিয়েও এক চোট হাসাহাসি হয়ে গেল। দুজনেই বলে দিয়েছিল সবাই যেন বাড়ি গিয়ে এগুলো খোলে। বাড়ি আসার পর ফাইনাল গোছগাছ বাকি ছিল। সেই সব তালেগোলে সাজু ভুলেই গেছিল এই গিফটগুলোর কথা। হাতব্যাগের মধ্যেই রয়ে গেছিল। ভাগ্যিস এই ব্যাগটাই নিয়ে এসেছে। নাহলে বাড়িতেই রয়ে যেত।

    সাজু ব্যাগ থেকে র‍্যাপড গিফটদুটো বের করল। দেখেছ অবস্থা! কোনটা কার? নাম অব্দি লিখে দেয়নি! ছেলেগুলো কী যে করে!

    আস্তে আস্তে একটা প্যাকেট আনর‍্যাপ করে। একটা কালো রেক্সিনে বাঁধানো ডায়রি। প্রথম পাতায় লেখা - রোজনামচা।

    অন্যটায় একটা পেইন্টব্রাশের সেট। সাজু একটু অবাক হল। ও তো কোনওদিন ছবি আঁকেইনি। ওকে পেইন্ট ব্রাশ দিল কে? তবে সাজুর ভাল লাগল। বিদেশে গিয়ে একলা সময়ের অনেকখানি এই রোজনামচা লিখে আর ছবি আঁকার চেষ্টা করে অন্ততঃ কাটিয়ে দিতে পারবে। নাহয় নতুন একটা কিছু শেখা হবে পড়াশোনার বাইরে।

    ফ্লাইটটা ধীরে ধীরে গড়াতে শুরু করেছে রানওয়ের দিকে।

    ঠিক সেই সময় দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বেশ কিছু কিলোমিটার দূরে একটা বাড়ির বিছানায় প্রায় পুরো রাত না ঘুমিয়ে এই ভোরের দিকে ঘুমে ঢলে পড়েছিল সৌম্যশ্রী। সারাটা রাত এপাশ ওপাশ করেছে। ছেলেদুটো গিফট তো দিল। নাম লিখে দিল না। একটা প্যাকেটে একটা অয়েল প্যাস্টেলের সেট। তার ছবি আঁকার অভ্যাসটা এখনও আছে। অবসর পেলেই স্কেচ প্যাড নিয়ে নিজের প্রিয় টেবিলটাতে বসে যায় শ্রী। তাই অয়েল প্যাস্টেলের সেটটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু অন্য প্যাকেটটা খোলার পর থেকে তার ঘুম আসেনি বাকি রাত। জসীমুদ্দিনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’। বই-টই সে বিশেষ পড়েনা। তাই জীবনে প্রথমবার কারোর কাছ থেকে বই পেয়ে একটু অবাক হয়ে গেছিল। এই বইএর কিছুটা অংশ কোন একটা ক্লাসে ছিল যেন - মনে করতে পারেনা শ্রী। প্রথম পাতা উল্টে ফেলেই চমকে উঠেছিল সে - গোটা গোটা হাতের লেখায় লেখা রয়েছে - “তোর জন্যে অপেক্ষায় থাকব। - তোর রূপাই।”

    রানওয়েতে দৌড়তে শুরু করেছে ফ্লাইট। সাজুর খুব মন কেমন করা শুরু করল। নিজের ফেলে আসা সব কিছু, এই শহরটা, তার বন্ধুরা সব কিছু সেই একই থাকবে - শুধু সেই এই সবের মধ্যে থেকে চলে যাচ্ছে। মা-বাবা ছাড়া আর কেউ কি তার কথা ভাববে একবারও এই শহরে বসে?

    ফ্লাইটটা মাটি ছেড়ে একটা ছোট্ট লাফে আকাশে ওঠে। আস্তে আস্তে সকালের আলোর সাথে জাগতে থাকা কোলকাতা শহরটা খুব ছোট্ট হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ - অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)