ইউ এস হেড অফিসের সঙ্গে কন-কল ছিল। ফোনের অন্যদিক থেকে খেজুর করা আর ফুরোতে চায় না। ওদের দেশে সকাল হচ্ছে, তাড়া নেই। কাজের থেকে অকাজের গল্পই বেশি। শেষ হতে হতে সন্ধে গড়িয়ে গেল… রাতের দিকে। যেমন করে অসাবধানে বোতল উলটে বেওয়ারিশ জল গড়ায়। আজকাল কৌশিকের দিনগুলো, রাতগুলো এমনি ভাবেই আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে। সব কাজ গুটিয়ে অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় দিনই দেরি হয়ে যায়। তার ওপর নিজেরও কিছু কাজ থাকে। সেসব কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অবশ্য সেই কাজগুলো অফিসের পরেই স্কেডিয়্যুল করা যাবে এমন কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মাঝে মধ্যে দরকার পড়লে অফিস কেটেও বেরোতে হয়।
অধিকাংশ দিনই নিশুত রাতে নিজেই সদর দরজার চাবি খুলে বাড়ি ঢোকে যাতে মায়ের ঘুম না ভাঙে। চোরের মত পা টিপে টিপে লিভিং রুমের টাইলস ডিঙোয়। তবু মা ঠিক টের পেয়ে যায়। নিজের বেডরুম থেকে গলা তুলে বলে, কে বাবু এলি? রাতে মা বেশির ভাগ দিন দুধ মুড়ি খায়। কৌশিকের খাবার ডাইনিং টেবিলের ওপর চাপা দিয়ে রাখা থাকে। কৌশিক নিজেই নিয়ে খেতে পারে। মা কথা শোনে না। উঠে এসে মাইক্রোওয়েভে গরম করে দেয়। সামনে বসে থাকে যতক্ষণ না খাওয়া শেষ হয়।
পার্কিং লট থেকে বের করে গাড়িটা মূল রাস্তায় তুলে আনতে সময় লাগল। নিরবচ্ছিন্ন ট্রাফিক জুরাসিক সরীসৃপের মত শ্লথ গতিতে হেলেদুলে কংক্রিট পেরোচ্ছে। সিগন্যালের শাসনে মাঝেমধ্যে থামছে, আবার ফণা তুলে লাফিয়ে পড়ছে। কৌশিকের বিরক্ত লাগছিল। এদের ওপর দিয়ে উড়ে গেলে কেমন হয়? প্রথম সিগন্যালটায় গাড়ি দাঁড়াতেই বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংটা দেখতে পেল কৌশিক। গতকালও বিলবোর্ডটা ফাঁকা ছিল। বড় বড় হরফে বিজ্ঞাপন এজেন্সির ফোন নম্বর লেখা ছিল শুধু। আজ একটা মিষ্টি মুখের মেয়ে একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চুলের মধ্যে গোটা চারেক রামধনু রঙের প্রজাপতি উড়ছে।
মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগল কৌশিকের। মনে হল আগে কোথাও দেখেছে। অন্যমনস্ক হয়ে হাতের মোবাইলে চোখ রাখল। চার্জ তলানিতে এসে ঠেকেছে। লম্বা সিগন্যাল, নিচু হয়ে প্লাগ পয়েন্টে কর্ড লাগানোর সময় গাড়ির জানলায় টোকা পড়ল। কাঁচ নামাতেই ধাক্কা লাগল বুকে। মিষ্টি মুখের সেই মেয়েটা বিলবোর্ডের থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে। চুল সামান্য উসকো-খুসকো, প্রজাপতি গুলো নেই, উড়ে গেছে কোথাও। সামান্য উদ্বিগ্ন গলায় মেয়েটা বলল, ‘বাস পাচ্ছি না। আপনি সাউথের দিকে যাবেন তো? আমায় রুবির সামনে নামিয়ে দেবেন?’
কৌশিক চিনতে পারলো এবার। ই ডি সাহেব মিস্টার চৌধুরীর পি এ, অরুন্ধতী। চৌধুরী কলকাতা অফিসের সর্বেসর্বা। কৌশিকের থেকে দু ধাপ ওপরে। ফ্লোরও আলাদা। চৌধুরী বসে ডিরেক্টরস ফ্লোরে, মেয়েটিও চৌধুরীর কেবিনের লাগোয়া এন্টিরুমে। দু-একবারই মাত্র দেখেছে, অফিস পার্টিতে। তাই মনে পড়ছিল না, চট করে। আসলে একটা মানুষকে তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে আলাদা করে দিলে চিনতে অসুবিধে হয়। কৌশিক হাত বাড়িয়ে উল্টো দিকের দরজাটা খুলে দিল। বলল, চলে আসুন। মেয়েটা ভিতরে ঢুকে বসে সীটবেল্ট লাগিয়ে নিল। কৌশিক হোর্ডিংটার দিকে তাকিয়ে দেখল ইল্যুমিনেটিং লাইটগুলো নিভে গেছে। বিজ্ঞাপনের মেয়েটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। হয়তো কোনো ইলেক্ট্রিক্যাল ফল্ট। নাকি সত্যি সত্যি বিজ্ঞাপন ছেড়ে মেয়েটা নেমে এসেছে? পাশ থেকে অরুন্ধতী বলল, ‘অসুবিধে করলাম না তো?’
কৌশিক বলল ‘না, না, আমি ওদিক দিয়েই যাই।’ একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, নেহাতই ভদ্রতার খাতিরে, ‘আপনার কি রোজই এমন দেরি হয়?’
অরুন্ধতী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না। উইন্ডশীল্ডের কাঁচের মধ্যে দিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘চৌধুরী সাহেব যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ থাকতে হয়।’
গাড়িটা আবার সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল। কৌশিক মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাল। হাঁসের মত গলা উঁচু করে সামনে তাকিয়ে বসে আছে। সোডিয়াম ভেপারের হলুদ আলো এসে পড়ছে খোলা চুলে, ঘাড়ে, গলায়। গ্রীবার নিচে চুলের চিলিবিলির মধ্যে একটা সদ্যফোটা নখের রক্তদাগ দেখতে পেল কৌশিক। চোখের ভুল নাকি? কৌশিকের কৌতূহল বাড়ছিল। কথাবার্তা চালানোর জন্য প্রশ্ন করল, ‘কোথায় থাকেন আপনি?’
মেয়েটা বলল, ‘কসবায়...।’
আগুপিছু না ভেবেই কৌশিক কথা বাড়াল, ‘অফিসের সামনে একটা হোর্ডিং লাগিয়েছে নতুন। বিজ্ঞাপনের মেয়েটিকে একদম আপনার মতন দেখতে।’
অরুন্ধতী এবার কৌশিকের দিকে ফিরে তাকাল, ‘আমিই তো!’
‘বাহ্! তার মানে আপনি মডেলিংও করেন।’
‘মডেলিং নয় ঠিক। চৌধুরী সাহেবের এক বন্ধু অ্যাড এজেন্সি চালান। চৌধুরী সাহেব রেকমেন্ড করে দিয়েছিলেন। ওরা বলেছিল কিছু টাকা পয়সা দেবে। অথচ যাতায়াতের গাড়িভাড়া ছাড়া কিছুই তো দিল না...।’
কৌশিক অবাক হল। কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ চাপের মধ্যে আছে। সেটা টাকা পয়সার জন্যে হতে পারে। আবার খচ্চর চৌধুরীর জন্যেও হতে পারে। অফিসে চৌধুরীর খুব একটা সুনাম নেই। কানাঘুষোয় শোনা যায় প্রায়ই কোন মহিলা কলিগকে বগলদাবা করে ট্যুরে যায়। একটা উইমেনস সেল আছে অবশ্য। কিন্তু খোদ বড়কর্তার নামে কে কমপ্লেন করবে? এই মেয়েটার সঙ্গেও অসভ্যতা করেছে হয়তো। সন্ধের পরে অফিসটা শুনশান হয়ে যায়। মেয়েটা আবার চুপ করে গেছে। কৌশিক খোঁচাল, ‘কতদিন হল জয়েন করেছেন কলকাতা অফিসে?’
‘বছর দেড়েক... আগে ইলাহাবাদে ছিলাম। বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম। এখানে আত্মীয় স্বজনরা আছে। যদিও তারা খুব একটা...।’
ছাড়া ছাড়া কথা বলছে। বোঝা যায় ডিস্টার্বড। শেয়ার করলে মনের ওপর ভার কমে যায়। তাই হয়তো বলছে। অথবা কৃতজ্ঞতায়। রাত বাড়লে কলকাতার রাস্তাঘাট অচেনা হয়ে যায়। নির্ভর করার মত একজন মানুষ পেয়ে মনের জানলা খুলে গেছে। নইলে কৌশিকের মত স্বল্প-পরিচিতকে এত কথা শোনাবার দরকার কী?
‘সরি টু হিয়ার...।’
‘না, না, আসলে বাবা এত আচমকা চলে গেলেন, কিছুই তেমন প্ল্যান করে যেতে পারেন নি। তারপর ভাইটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছে। চাকরি ছেড়ে দেব বললেই তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।’
কৌশিক চমকালো। বুঝল মেয়েটা নিজের সঙ্গেই কথা বলছে। কিন্তু চাকরি ছাড়ার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ চাকরি ছাড়তে যাবেন কেন?’
অরুন্ধতী মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইল। কৌশিক মৃদু স্বরে বলল, ‘আমায় বলতে পারেন। হয়তো কিছু হেল্প করতে পারব।’
গাড়ি চলছিল। রাস্তায় ট্রাফিক কমে আসছে। খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা ঢুকছে। শীতহাওয়ায় অরুন্ধতীর গলা কেঁপে গেল, ‘মিস্টার চৌধুরী টাকা অফার করছিলেন আজ... আমি নিতে চাইনি... জোরাজুরি করছিলেন নেবার জন্য...।’
রাগে মাথায় রক্ত চড়ে গেল কৌশিকের। চৌধুরী সামনে থাকলে এক্ষুণি একটা খুনোখুনি হয়ে যেত। কোনমতে রাগ চেপে বলল, ‘আমি ফোর্থ ফ্লোরে বসি, বি উইং, কাল লাঞ্চের পরে একবার আমার সঙ্গে দেখা করুন। দেখি কী করা যায়।’
অরুন্ধতী আবার বলল, ‘আমি ঝামেলা চাই না। চাকরিটা আমার খুব দরকার।’
উইমেনস সেলের কর্ণধার সরোজিনী পোদ্দার কোম্পানির সেলস হেড। দেখেই বোঝা যায় বেশ জাঁদরেল টাইপের মহিলা। শোনা যায় স্বামীটিকে ঘেঁটি ধরে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে বিদেয় করেছেন বহুদিন আগেই। এখন সম্মানিত সিংগল। সিঁথিতে সিঁদুর না থাকলেও, চওড়া কপালের মাঝখানে পুরোন আধুলির সাইজের লাল টিপ। কোলের ওপর ফেলে রাখা পাটভাঙা তাঁতের শাড়ির আঁচলের ভাঁজ ঠিক করতে করতে মন দিয়ে কৌশিক আর অরুন্ধতীর কথা শুনছিলেন। চুল সরিয়ে অরুন্ধতীর ঘাড়ের কাছে নখের দাগটাও দেখলেন। অরুন্ধতী কাল সন্ধ্যার ঘটনার বিবরণ দেওয়ার পর কৌশিক বলল, ‘শুনেছি অফিসের কোনো মহিলার সঙ্গেও চৌধুরী সাহেবের সম্পর্ক আছে। দুজনে একসঙ্গে ট্যুর-ফুরে যান।’ সরোজিনী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনও প্রমাণ আছে?’
কৌশিক জিজ্ঞেস করলো ‘কীসের প্রমাণ চাইছেন, ম্যাম?’
সরোজিনী কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিলেন একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘মানে... এই মেয়েটির ওপর জোর করার।’
‘ওর মুখের কথাই কি যথেষ্ট নয়?’
‘ওর ভুলও তো হতে পারে।’
‘ভুল? আপনি চৌধুরী সাহেবকে চেপে ধরলেই উনি...।’
সরোজিনী ঠান্ডা চোখে কৌশিকের দিকে তাকালেন, ‘আপনি এই মেয়েটির কে হন?’
কৌশিক চোখ সরাল না, ‘কেউ না, ও একা আসতে ভয় পাচ্ছিল বলে সঙ্গে এসেছি।’
মনে মনে বলল, একমাত্র আমিই ওকে বিজ্ঞাপন থেকে নেমে আসতে দেখেছি। আমি ওর সঙ্গে আসব না তো কে আসবে?
‘আচ্ছা, দেখি কী করা যায়।’
‘ম্যাম, অরুন্ধতী কোম্পানিতে সবে জয়েন করেছে। দেখবেন যেন ও ভিকটিমাইজড না হয়।’
সরোজিনী ম্যাডামের কেবিন থেকে বেরিয়ে অরুন্ধতী বলল, ‘আমার খুব ভয় করছে।’
কৌশিক ভরসা দিল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। চলুন কফি খাওয়া যাক।’
ভেন্ডিং মেসিন থেকে দুটো মাগে কফি ভরে টেবিলে নিয়ে এলো কৌশিক। মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখের নিচে কালি। মনে হয় ঘুমোতে পারে নি গত রাতে। কৌশিক এসে বসতেই করুণ মুখ তুলে বলল, ‘সরোজিনী ম্যাম বসের ঘরে ডাকছেন, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন?’ কৌশিক ঘাড় হেলাল, ‘আপনি ভয় পাবেন না। কফিটা আগে শেষ করুন। তারপর...।’
নিঃশব্দে বলল, পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত...।
চৌধুরী সাহেবের কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকল দুজনে। চৌধুরী সাহেবের টেবিলের সামনে সরোজিনী ম্যাডাম বসে আছেন। কৌশিককে দেখে চৌধুরী সাহেব ভুরু তুললেন, ‘আপনি?’
লোকটাকে দেখেই আপাদমস্তক জ্বলছিল কৌশিকের। মাথাজোড়া টাকের ওপর ছুলির দাগ। ঝুলন্ত মুখের এক মধ্যবয়স্ক লম্পট। শুনেছে উইডোয়ার। ঘরে জবাবদিহি করার দায় নেই। অফিসে বেলেল্লাপনা চালিয়ে যাচ্ছে। সরোজিনী পিছন ফিরে মুচকি হাসলেন, বললেন, ‘কে কৌশিক? ঠিক আছে, তুমিও এস।’
চৌধুরী সাহেব খুব একটা খুশি হলেন বলে মনে হল না। ওরা দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বসল। সরোজিনী সোজাসুজি প্রসঙ্গে এলেন, ‘চৌধুরী, এরা বলছে তুমি নাকি অরুন্ধতীকে সেক্সুয়্যালি হ্যারাস করেছ।’
চৌধুরী সাহেব আঁতকে উঠলেন প্রায়, ‘সরোজ, কী বলছ তুমি? ভেবেচিন্তে বলবে তো। অরুন্ধতী আমার মেয়ের মত। ওর বুঝতে ভুল হয়েছে। ছেলেমানুষ...।’
সরোজিনী বললেন, ‘সে আমি জানি। সেই ভুলটাই ভাঙাতে চাইছি।’
কৌশিক অবাক হল। অরুন্ধতী এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিল। সেও মুখ তুলে তাকাল। সরোজিনী ম্যাডাম এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে? চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘মেয়েটা বড় অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে। তাই কাল ওকে বলেছিলাম টাকা পয়সার দরকার হলে আমার কাছ থেকে নাও। তা সে বুঝল না, দৌড়ে পালাল।’
চৌধুরী সাহেবের মুখ দেখে মনে হল না মিথ্যে বলছেন। তাঁর ব্যাঙের মত ড্যাবডেবে চোখ বাৎসল্যে কোমল হয়ে উঠেছে। সরোজিনী বললেন, ‘অরুন্ধতী, আই ক্যান ভাউচ ফর চৌধুরী। চৌধুরী আর আমি ক্লাসমেট। আমরা দুজনে দুজনকে ইয়ে... মানে পছন্দও করতাম। কিন্তু দুজনের বাড়ি থেকে মেনে না নেওয়ায় বিয়েটা আর হয়ে ওঠেনি।’
সরোজিনীর গলা কি ভারি হয়ে এল?
চৌধুরী সাহেব অরুন্ধতীর দিকে ফিরে বললেন, ‘আমায় ভুল বুঝো না মা, আমি তোমার ভালোই চাই।’
সরোজিনী চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে আর অরুন্ধতীর ভালো চাইতে হবে না। তার সুবিধে অসুবিধে দেখার জন্য অন্য লোকের ব্যবস্থা করছি। কৌশিক, তুমি রোজ সন্ধেবেলা অরুন্ধতীকে ওর বাড়িতে ড্রপ করে দেবে।’
চৌধুরী সাহেবের কোষ্ঠ-কঠিন মুখে হাসি ফুটল। সরোজিনীকে বললেন, ‘অরুন্ধতী খুব তেজী মেয়ে। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতে গেলাম। এক ঝটকায় মাথা সরিয়ে নিল। আমার হাতের নখ লেগে বোধহয় ওর ঘাড়ের কাছে ছড়েও গেছে।’
অরুন্ধতী বলল, ‘না, না, তেমন কিছু না। আমি খুব সরি, স্যার। ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। আমি একদম বুঝতে পারিনি।’
চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘সরোজ এখনও ভেবে দেখ। আমাদের তিন কুলে কেউ নেই। বুড়ো বয়সে আমাদের দেখবে কে? তুমি বিয়েতে মত দিলে, অরুন্ধতীকে দত্তক নিয়ে নেব।’
সরোজিনী স্পষ্টতই লজ্জা পেলেন। বললেন, ‘আচ্ছা, সে হবে খন। সমস্যা মিটেছে। এবার যে যার নিজের কাজে যাও।’
এপিসোডটা শেষ হল হ্যাপিলি লিভড এভার আফটার টাইপ রূপকথার মত। চৌধুরী সাহেবের কেবিন থেকে বেরোনর সময় কৌশিক না জিজ্ঞেস করে পারল না, ‘ব্যাপারটা কী হল বলুন তো? আপনি কি ফেয়ারি টেল পড়তে-টড়তে ভালবাসেন? সিন্ডারেলা, লিটল রেড রাইডিং হুড...?’
অরুন্ধতী লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না তো! তবে কার্টুন দেখতে খুব ভালবাসি। আমি আর ভাই দুজনে একসঙ্গে বসে এখনও কার্টুন দেখি টেলিভিশনে।’
সন্ধের মুখে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপনের মেয়েটাকে আবার দেখল কৌশিক। আজ বিলবোর্ডের আলোগুলো মহা উৎসাহে জ্বলছে। পাশ থেকে অরুন্ধতী বলল, ‘কী দেখছেন, হাঁ করে?’ কৌশিক বলল, ‘এতক্ষণে মনে হচ্ছে একজন রক্ত মাংসর মানুষের পাশে বসে আছি। গতকাল ভেবেছিলাম আপনি সটান বিজ্ঞাপন থেকে নেমে এসেছেন। তাই লক্ষ্য করে দেখছি কালকের মেয়েটা ঠিকঠাক নিজের জায়গায় ফিরে গেছে কিনা।’
অরুন্ধতী ম্লান হাসল। ভেবে দেখলে, কৌশিকের কথাই ঠিক। অরুন্ধতী রক্ত মাংসর মানুষই বটে, আপনার মাংসই হরিণীর বৈরী। সে জানে এই মুহূর্তে সরোজিনী ম্যাডাম চৌধুরী সাহেবের কেবিনে বসে আছেন। বলছেন, ‘বয়স তো অনেক হল। এখনও ছোঁক ছোঁক করার অভ্যেস গেলো না?’
চৌধুরী সাহেব আহত মুখ তুললেন, ‘সরোজ, এভাবে বলছ কেন? রত্না মারা যাবার পর থেকে তোমার সঙ্গেই তো আছি। এমনকি ট্যুরে গেলেও তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাই। কখনও অন্যথা দেখেছ?’
সরোজিনী ম্যাডাম বললেন, ‘তোমায় চিনি বলেই বলছি। এবারের মত বাঁচিয়ে দিলাম। সামলে চল চৌধুরী। হেড অফিসে খবর পৌঁছলে কিন্তু মুশকিলে পড়বে।’
অরুন্ধতীকে অন্যমনস্ক দেখে কৌশিক জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছেন?’
‘ন্-না। কিছু না।’ অরুন্ধতী মাথা ঝাঁকিয়ে বাস্তবে ফিরে এল। মাঝে মধ্যে সে এমন অনেক কিছু দেখতে পায়, শুনতে পায় যা সাধারণ মানুষের দেখাশোনার কথা নয়। সব মেয়েদেরই বোধ হয় এই ইন্দ্রিয়-বোধটা থাকে, কারো কম, কারো বেশি। ছয় নাকি সাত নম্বর? না থাকলে তাদের পক্ষে বাঁচাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। এই মুহূর্তে কৌশিকের পাশে বসে তার মনে হল ছেলেটার ওপর নির্ভর করা যায়। খানিকক্ষণের জন্যে ইন্দ্রিয়-বোধ-টোধ শিকেয় তুলে রাখলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি নেই।
ফাইল সই করার পর চৌধুরী সাহেব চোখ তুলে তাকালেন, ‘অরুন্ধতী, তোমায় রৌনক অ্যাড এজেন্সির নন্দদুলালের কাছে পাঠিয়েছিলাম, ওরা তোমায় দিয়ে কিছু মডেলিঙের কাজ করিয়েছিল না?’
‘হ্যাঁ, স্যার। একটা বিউটি প্রোডাক্টের অ্যাডে...।’
‘গুড। কাল একটা পার্টিতে নন্দর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলল, তোমার কাজ ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। আরও কাজ দিতে চায়। তুমি একবার গিয়ে দেখা করো।’
অরুন্ধতী কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেলল, ‘স্যার, ওদের কাজগুলো বেশির ভাগ নাইট শিফটে হয়। ফেরার সময় বাস টাস বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি ঢুকতে দেরি হলে মা চিন্তা করে। তাছাড়া আগের বারের কাজের জন্য ওরা কোনো পয়সাও দেয়নি।’
‘সেকী? এ তো ভারি অন্যায়! দাঁড়াও, কথা বলে দেখি নন্দর সঙ্গে।’ চৌধুরী সাহেব মোবাইলে নন্দদুলালের নাম খুঁজতে ব্যস্ত হলেন।
অরুন্ধতী সসঙ্কোচে বলল, ‘না, না, স্যার, এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’
চৌধুরী সাহেব শুনলেন না। ফোন করেই ছাড়লেন। দু মিনিট কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে বললেন, ‘আজ বিকেলেই চলে যাও। ওরা আগের পেমেন্টটা করে দেবে। নতুন কাজের ব্যাপারটাও বুঝিয়ে দেবে। নন্দর ফোন নম্বরটা আছে তো তোমার কাছে? যাবার আগে একবার কল করে নিও।’
অরুন্ধতীর সাত নম্বর ইন্দ্রিয়-বোধ আপাতত কাজ করছে না। মাথাটা ভোঁতা হয়ে আছে। বুঝতে পারছে না যাওয়াটা উচিত হবে কিনা। সকালে অফিসে বেরোনোর সময় ভাই ভয়ে ভয়েই কথাটা পেড়েছিল, কলেজ থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে যাবে… গোয়ায়। সাত হাজার টাকা লাগবে।
অরুন্ধতী ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, ‘গোয়াতে কীসের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর?’
ভাই বলল, ‘আমি কী জানি? ক্লাসে এনাউন্স করল, বলল — কম্পালসারি।’
‘মজা পেয়েছে? গোয়াতে এমন কী ইন্ডাস্ট্রি আছে যেখানে ভিজিট না করলে ইঞ্জিনিয়ারিং হবে না? আসলে সবাই মিলে ফুর্তি করতে যাবে… ।’
মা বলল, ‘আহ অরুণ! সকলে যদি ঠিক করে গোয়া যাবে, ও বেচারা কী করবে? ওর একার কথায় কি জায়গা বদলে যাবে?’
‘তুমি জান না মা, সব বড়লোকের ছেলে, ওদের কাছে টাকা পয়সা খোলামকুচি। এখন মাসের শেষে বললেই সাত হাজার টাকা পাব কোত্থেকে?’
মা জানে সে কথা, কাজের অছিলায় রান্নাঘরে চলে গেল। ভাইটা মুখ চুন করে বসে রইল। রৌনক অ্যাড এজেন্সি আগের কাজটার জন্য কত টাকা দেবে? সত্যিই আরও কাজ দেবে? কে জানে? দোনামনা করে ফোনটা করেই ফেলল অরুন্ধতী।
নন্দদুলালবাবু যেন অরুন্ধতীর ফোনের অপেক্ষাতেই বসে ছিলেন। একটা রিং হতেই ধরলেন। অরুন্ধতী আগের বারের কাজের জন্য সময়মত টাকা-পয়সা পায়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, এজেন্সির একাউন্ট ডিপার্টমেন্টের এক ছোকরা বদমাইশি করছিল। আরও দু-চারজনের কাছ থেকেও কমপ্লেন এসেছে। সে ছোকরাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মধ্য কলকাতার একটা হোটেলের নাম ঠিকানা দিয়ে বললেন দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছে যেতে। ওখানে একটা ইনডোর শ্যুট আছে। সেটা হয়ে গেলে অরুন্ধতীর সঙ্গে পরের কাজটা নিয়ে কথা বলবেন। আগের কাজের টাকাটাও তখন দিয়ে দেবেন।
লাঞ্চের পর চৌধুরী সাহেবকে বলে অরুন্ধতী বেরিয়ে পড়ল। চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও। আজ আর কোনও মিটিং টিটিং নেই তো! আধ বেলা আমি চালিয়ে নেব।’
সাড়ে তিনটে বাজার বেশ খানিকটা আগেই অরুন্ধতী হোটেলটায় পৌঁছে গেল। নতুন হয়েছে হোটেলটা। রিসেপশনে জিজ্ঞেস করতে ওরা বলে দিল ৭১৩ নম্বর রুমে রৌনক এজেন্সির শ্যুটিং চলছে। নন্দদুলালবাবু সেখানেই আছেন। বলে রেখেছেন, অরুন্ধতী এলে তাকে যেন ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লিফটে উঠতে উঠতে অরুন্ধতীর মনে পড়ল, কৌশিককে বলে আসা হয়নি আজ বিকেলে ওর সঙ্গে ফিরবে না। বেচারা হয়তো অরুন্ধতীর জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকবে। খুঁজে না পেয়ে উতলা হবে। মোবাইল বার করে দেখল লিফটের মধ্যে নেটওয়ার্ক নেই। অস্থির লাগল অরুন্ধতীর, এত করে ছেলেটা ওর জন্য! সেভেন্থ ফ্লোরে লিফট থেকে নেমে লম্বা করিডোর। দুদিকে সারি সারি দরজা। করিডোরের শেষে একটা জানলা। শার্শির মধ্যে দিয়ে টুকরো টুকরো রোদ এসে পড়েছে মেঝের কার্পেটে। কৌশিককে আবার ট্রাই করলো অরুন্ধতী। একটি মেয়ে মাখনের মত নরম গলায় জানাল সাবস্ক্রাইবার নট এভেলেবল। এই ভর দুপুরে কোথায় গেলো কৌশিক?
৭১৩ নম্বর রুমের দরজায় নক করতে নন্দদুলালবাবুই দরজা খুলে দিলেন। ঘরটা আয়তনে খুব বড় নয়। তার মধ্যেই একটা গদিমোড়া কিং সাইজের খাট, এক পাশে একটা সোফা, রিডিং টেবিল, ছোট একটা রেফ্রিজারেটর। অরুন্ধতী সোফার ওপর গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ আগেই বোধ হয় শ্যুটিং শেষ হয়ে গেছে। একটা ষন্ডামার্কা ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে রিফ্লেক্টরের ছাতা নাড়াচাড়া করছিল। এইটুকু একটা ঘরে কিসের শ্যুটিং হচ্ছিল কে জানে? নন্দদুলালবাবু ওকে বসিয়ে রেখে রেফ্রিজারেটরের কাছে গেলেন কিছু নিয়ে আসতে। অরুন্ধতীর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। যে দরজা দিয়ে ও ঘরে ঢুকেছিল তার উল্টো দিকে একটা ঘষা কাঁচের দরজা। সম্ভবত ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে যাবার। তার কাঁচে একটা ছায়া সরে গেল। কেউ যেন নজর রাখছিল। অরুন্ধতী দেখছে দেখে আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। নন্দদুলালবাবু রেফ্রিজারেটর থেকে নিজের জন্য একটা বিয়ারের ক্যান বার করলেন। অরুন্ধতীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি সফট ড্রিঙ্কস নেবে তো?’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই একটা কোকের বোতল বার করে আনলেন। নিজের মনেই বললেন, ‘ওপনারটা যে কোথায় রাখলাম?’
নন্দদুলালবাবু কোকের বোতলটা হাতে নিয়ে রিডিং টেবিলের দিকে এগোলেন। ওপনার খোঁজার জন্যই হয়তো। ঠিক তখনি ব্যালকনিতে একটা শব্দ হল। সবাই চমকে তাকাল। নন্দদুলালবাবু চোখের ইশারা করলেন। ক্যামেরাম্যানটা এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজাটা খুলল। অরুন্ধতী সোফায় বসেই দেখল বাইরে একটা ঝুল বারান্দা। ক্যামেরাম্যানটা চারদিক ভালো করে দেখে ফিরে এসে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। হাত নেড়ে জানাল, কিছু না। সাত তলার ওপর কে আসবে? কোনও বেড়াল টেড়াল হবে। নন্দদুলালবাবু কোকের বোতলটায় একটা স্ট্র গুঁজে অরুন্ধতীর হাতে এনে দিলেন। নিজেও রেফ্রিজারেটরের ওপর থেকে বিয়ারের ক্যানটা তুলে নিয়ে খাটে এসে বসলেন।
কোকের মধ্যে ফেনা বুড়বুড়ি কাটছে। দুপুর রোদের মধ্যে বাসে ভিড় ঠেলে এসেছে, অরুন্ধতী এক ঢোঁকে অনেকটা কোক গলা দিয়ে নামিয়ে নিল। নন্দদুলালবাবু একটা চেক লিখে হাতে দিলেন। অরুন্ধতী দেখল পঁচিশ হাজার টাকার চেক। ভাইয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরের জন্য টাকা দিয়েও কিছু টাকা হাতে থেকে যাবে। অরুন্ধতী সত্যিই খুশি হল। কিছু দিনের জন্য অন্তত নিশ্চিন্ত। নন্দদুলালবাবু বললেন, ‘এবার তবে নতুন কাজটা বুঝে নাও। আজই একটা স্ক্রিন টেস্ট নিয়ে নেব।’
অরুন্ধতী হাতের চেকটা রাখতে গিয়ে দেখল হ্যান্ডব্যাগটা রিডিং টেবিলের ওপর ছেড়ে এসেছে। উঠে গিয়ে চেকটা হ্যান্ডব্যাগে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই মাথাটা টলে গেল। চোখে অন্ধকার দেখল অরুন্ধতী। নন্দদুলালবাবু যেন রেডিই ছিলেন। পড়ে যাবার আগেই অরুন্ধতীকে লুফে নিলেন। পাঁজাকলা করে এনে খাটে শুইয়ে দিলেন। অরুন্ধতীর চোখের সামনে এখন একটা কংক্রিটের দেওয়াল। সেটা বেয়ে হাজার খানেক শুঁয়োপোকা উঠছে নামছে। কয়েকটার গুটি কেটে আবার রঙিন প্রজাপতি উড়ছে। নন্দদুলালবাবু কি শুঁয়োপোকার চাষ করেন? রেশমের সুতো বানান? অরুন্ধতীর কানে ঝিঁ ঝিঁ লেগেছে। তার মধ্যেই নন্দদুলাল বাবুর গলা শুনতে পেল, ‘এবার তোমার স্ক্রিন টেস্ট নেব, অরুন্ধতী। পারবে তো?’
অরুন্ধতী চোখ খুলে দেখল নন্দদুলালবাবুর শুয়োরের মত বিশাল মুখটা তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। রিফ্লেকটরের নিচে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠেছে। ষণ্ডা ক্যামেরাম্যানটা মুভি ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে। নন্দদুলালবাবু গায়ের জামা খুলে ফেলেছেন। তিনি অরুন্ধতীকে জোর করে নিজের দিকে টানলেন। তাঁর বুকের লোম নাকে ঢুকে অরুন্ধতীর বেজায় সুড়সুড়ি লাগল। সে সরে যাবার চেষ্টা করল। পারল না। তার হাত পা সীসের মত ভারি। নড়ার ক্ষমতা নেই। উঃ মা!
ঠিক তখনই ব্যালকনিতে যাবার দরজার কাঁচটা ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল। অরুন্ধতী কোনোমতে চোখ খুলে দেখল ভাঙা শার্শির ওপারে মুখোস পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার উজ্জ্বল লাল নীল চেককাটা পোষাক। বুকের ওপর আট শুঁড়-ওলা মাকড়শা। সান গ্লাসে মধ্যদিনের সূর্য ঝলসাচ্ছে। স্পাইডারম্যান, ইজ দ্যাট ইউ?
স্পাইডারম্যান ভার্সেস ক্যামেরাম্যানের লড়াইটা নিতান্তই ছেলেখেলায় পরিণত হল। ক্যামেরাম্যান অবশ্য একটা লোহার রড তুলে এগিয়ে গিয়েছিল। স্পাইডারম্যানের কবজি থেকে স্পাইডার-ওয়েব বেরিয়ে এসে রডটাকে জড়িয়ে ধরে টান মেরে কেড়ে নিল। রডটা ঠন ঠন আওয়াজ করে দেওয়ালের গায়ে ছিটকে পড়ল। তার ঠিক তিন সেকেন্ড পরে ক্যামেরাম্যান রডটাকে পাশবালিশ করে ঘুমিয়ে পড়ল। তার চোয়ালে ঘুঁসিটা দরকারের থেকে একটু বেশি জোরে পড়েছিল। নন্দদুলালবাবু আর রিস্ক নিলেন না। “মা গো!” বলে একটা চিৎকার দিয়ে রুমের দরজা খুলে খালি গায়েই দৌড় লাগালেন।
স্পাইডারম্যান অরুন্ধতীর কাছে এসে তাকে এক হাতে কাঁধে তুলে নিল। তারপর ব্যালকনির ভাঙা কাঁচের দরজা খুলে বেরিয়ে, প্যারাপেট ওয়াল ডিঙিয়ে আকাশে ঝাঁপ দিল। চোখে রোদ পড়ছিল বলে অরুন্ধতী চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। তবে বেশ বুঝতে পারছিল হাওয়ায় ভর করে উড়ে যাচ্ছে এক বহুতল থেকে অন্য বহুতলের মাথায়। আঃ, কী শান্তি! চোখে মুখে হাওয়ার ঝাপটা লাগছে। কানে হাওয়া কাটার শন শন শব্দ।
সরোজিনী ম্যাডাম, কৌশিক ওয়াজ রাইট। চৌধুরী সাহেব একটা লম্পট। চৌধুরী সাহেবের বন্ধু নন্দদুলাল মেয়েদের ড্রিঙ্ক স্পাইক করে তাদের সঙ্গে অশ্লীল ছবি বানায়। তুমি সব জেনে শুনে একজন মেয়ে হয়ে আর একজন মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলে? ভাগ্যিস স্পাইডারম্যান ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। না হলে কী যে হত? কৌশিক কোথায়, কৌশিক? আয়্যাম সরি কৌশিক, তোমায় বলে আসতে পারিনি। তুমি কি আমার জন্যে ওয়েট করছ? এখনও? ওপরে তাকাও, এই যে আমি এখানে। হাত নাড়ছি। তুমি একদম চিন্তা কোরো না। আমি ফ্রেন্ডলি নেবারহুড স্পাইডারম্যানের কোলে চেপে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছি।
মাথার মধ্যে যে ঘুম ঘুম ভাব ছিল সেটা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কেউ বরফের মত ঠান্ডা ভিজে রুমাল দিয়ে কপাল মুছিয়ে দিচ্ছে। অরুন্ধতী চোখ খুলে দেখল সে তার নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়। মা, ভাই উদ্বিগ্ন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ মেলতেই মা বলল, ‘কীরে, কেমন লাগছে এখন? একটু গরম দুধ দিই, খা। গায়ে বল পাবি।’
‘মা, আমাকে এখানে কে নিয়ে এল?’
মা বলল, ‘কে আবার, কৌশিক...।’
অরুন্ধতী মুখ ফিরিয়ে দেখল খাটের উল্টো দিকে কৌশিক দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে বলল, ‘যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। গাড়ি থেকে নাবার সময় হঠাৎ ব্ল্যাক আউট... আজও কি লাঞ্চ স্কিপ করেছিলেন?’
অরুন্ধতী বোকার মত চেয়ে রইল। কিছু বলতে পারলো না। কৌশিক আরও কিছুক্ষণ রইল, যতক্ষণ না অরুন্ধতী স্বাভাবিক হয়। অরুন্ধতীর খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসে চা খেল, গল্প করল। অরুন্ধতীরা খুলনা থেকে এসেছে শুনে অরুন্ধতীর মায়ের কাছে চিতল মাছের মুঠি খাবার বায়না করল। অরুন্ধতীর ভাইকে ডেকে ল্যাপটপে গুগল ম্যাপ খুলে গোয়ার বীচের হাল হদিশ দিল। রাত বাড়তে কৌশিক উঠল। যাবার আগে বলে গেল, হ্যান্ডব্যাগটা অরুন্ধতীর হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। সেটা বেড সাইড টেবিলে রেখে দিয়েছে। আর হ্যাঁ, কাল বাসে ট্রামে দৌড়োদৌড়ি করে যাবার দরকার নেই, বাড়ি থেকেই অরুন্ধতীকে পিক আপ করে নিয়ে যাবে।
কৌশিক চলে যেতেই অরুন্ধতী বেড সাইড টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডব্যাগটা টেনে আনল। খুলে দেখল দু চারটে হাবিজাবি কাগজপত্রর মাঝখান থেকে পঁচিশ হাজার টাকার চেকটা দিব্যি উঁকি দিচ্ছে। কৌশিক চেকটার কথা জানে না বা জানলেও বের করে নিতে ভুলে গেছে। স্পাইডারম্যান হলেই কি সব কিছু জানতে হবে, মনে রাখতে হবে? যতই যাই হোক স্পাইডারম্যানদের ছয়ের বেশি ইন্দ্রিয় আছে বলে কেউ কোনোদিন শুনেছে নাকি?