ঝুপার শব্দটি রাঢ় বাংলার গ্রামে গ্রামে শোনা যায়। বাংলা অভিধানে কিন্তু এই শব্দটির কোন অস্তিত্ব নেই। গ্রামে মা-মনসার পুজোস্থলে, সব জায়গায় নয়, কোন কোন স্থান্ মা-মনসা কাউকে-কাউকে ভর করে। পুজোর স্থলে রাশি, দিন, ক্ষণ, কাল, এইসব কিছুর ওপর নির্ভর করে ঝুপার হতে। সে পুরুষ বা নারী, যেই হোক না কেন, এটা গ্রামের লোকের বিশ্বাস। লোকের মুখে শুনি গতকাল মা’মনসার পুজোর সময় দু-জনের ঝুপার হয়েছে। জিজ্ঞাসা করতে বললো গত রাত্রিতে পুজোর স্থানে দু-জনকে মা-মনসা ভর করেছিল।
অন্ধকার গ্রামে শোনা যায় ঢাক ও কাঁসির আওয়াজ, সঙ্গে ধূপ-ধুনোর গন্ধ, ধুনোর ধোঁয়া, পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ-- কেউ-কেউ ধরে মনসামঙ্গলের গান। পুজোস্থলে মেয়ে, বৌ, বাচ্চা ছেলে-ছোকরা বয়স্কদের ভীড়। জোড়া হাত সাপের ফনার মতো করে মা-মা চিৎকার করা। কোন গৃহবধূর গোবর লেপা উঠানে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মানত করা, এইসব নিয়ে পুজোর পরিবেশ ভক্তিময় হয়ে ওঠে।
ভক্তগণের মধ্যে মা-গো মা বলে একজন ভক্ত ধপ করে উঠোনে পড়ে মৃগী রুগীর মতো ছটফট করে সারা শরীরটা কাঁপাতে লাগলো। ভক্তগণের মধ্যে তিন চারজন চেপে ধরেও আটকাতে পারে না। তখন গায়ে নাকি অসম্ভব জোর হয়। সকলে আরো জোরে চেপে ধরে রাখে। মুখ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ হয়, তারপর ধীরে ধীরে আওয়াজ ক্ষীণ হয়, গোঙানি থেকে কথায় ফিরে আসে। বলতে থাকে ভূত-ভবিষ্যৎ। সকলে ঘিরে ধরে ওর কথা শোনার জন্য। তারপর ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। সকলে চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে ধরাধরি করে খাটিয়ায় শুইয়ে দেয়। এরই নাম ‘ঝুপার’।
এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমি ব্যাকুল নই। ভূত-প্রেত, ডাইনি, ভর-এর প্রতি আমার বিশ্বাসের উপর গ্রাম নির্ভর করে না। শতশত বছর ধরে বেহুলা লখীন্দরের কাহিনী গ্রামে গ্রামে বিশ্বাসের শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
গ্রামে মা-মনসা পুজো এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এসবই ঠিক আছে। কিন্তু ঝুপার আমাকে নাড়া দেয়। আমার মনে বাসনা চাগাড় দিলো, যেমন করে হোক ঝুপার আমাকে দেখতেই হবে।
মনের আকাঙ্ক্ষা চেপে রাখতে হোল চৈত্র মাসের তৃতীয় সপ্তাহের জন্য। কারণ ঐ সময় গ্রামে সব থেকে বেশি মা মনসার পুজো হয়। অনেক চেষ্টা এবং খোঁজখবরের পর একজন পরিচিত বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে মা-মনসার পুজো দেখতে পাবো বলে চৈত্র মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শনিবার বেলা থাকতে থাকতে রওনা দিলাম। গন্তব্য দহিজুড়ি হয়ে বসন্তপুর দিয়ে যেতে হয়, কাঁসাই নদীর পাড়ের দিকে।
উর্বর চাষের জমি পেরিয়ে গ্রামে ঢুকলাম। ঘন বাঁশের বাগান দিয়ে ঘেরা গ্রাম। দক্ষিণ দিকে কাঁসাই নদী বয়ে চলেছে, অজস্র ভালকি জাতের বাঁশবাগান দিয়ে ঘেরা বলে এই চৈত্র মাসেই বেশ মনোরম এই জায়গা। গ্রামের নাম ‘কৈ ডাঙা’। মোরাম রাস্তা গ্রামে ঢুকেছে, রাস্তায় এক বয়স্ক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম — ও দিদি আপনার গ্রামের নাম কি? উত্তর এলো — কৈ ডাঙা। মনে মনে ভাবলাম লক্ষ্য আমার ঠিকই আছে। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। আমি শহর থেকে পুজো অনুষ্ঠানে আসবো সকলে আগে থেকে জানতো। আমার আগমনে সবাই বেরিয়ে এসে বললেন--আসুন আসুন আমরা জানতাম আপনি ঠিক আসবেন ঝুপার দেখতে। আমি হেসে বললাম--আপনারা এত কিছু আগে থেকে জেনে গেছেন।
একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এসে আমার বন্ধু সিন্ধুর নাম না নিয়ে বললেন--আমি কৃপার মা। আমি প্রণাম করে শহর থেকে আনা মিষ্টির প্যাকেট হাতে দিয়ে বললাম--ওর নাম তো সিন্ধু বলে জানতাম। কৃপা বলে তো জানতাম না। উনি হেসে বললেন--সিন্ধুর আগে কৃপা আছে। অত বড় নামে ডাকা যায়? তাই ছোট করে কৃপা বলি--বলে প্রসন্ন মুখে সিন্ধুর মা একটা খাটিয়ায় বসতে দিলেন। এ ছাড়া কৃপা বলে ডাকার একটা কারণও আছে--বলে হাসলেন। এর মধ্যে সিন্ধুর বাবা এসে বসলেন। আমি কৌতূহলী মানসিকতায় প্রশ্ন করলাম কৃপা নামের মধ্যে কি কারণ আছে? বলবো-বলবো আগে জল-টল খাও তারপর বলছি--বললেন কৃপার মা। আমি জেদ ধরলাম--না-না আপনি আগে বলুন, তারপর না হয় জল-টল খাওয়া যাবে। পুজোর বাড়ি অনেক কাজ আছে--বলে একটা চেয়ার টেনে বসলেন তিনি।
তবে শোন--বলে সিন্ধুর মা বলতে শুরু করলেন। --দেখছো তো বাবা আমাদের গ্রাম। এক দিকে কাঁসাই, ডান পাশে খাল, চারিদিকে বাঁশবাগান, দিনের বেলায় রোদ ঢোকে না। রাতের বেলা সেরকম কাজল-কালো অন্ধকার। শ্রাবণ মাস, কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। সন্ধ্যাপ্রদীপ দিতে উঠানে তুলসী মঞ্চের দিকে চেয়ে আছি, পায়ে একটা দড়ির মতো লাগলো, পায়ে ঠান্ডা অনুভূতি হলো। পা সরাতে গিয়ে পায়ের পাতায় কামড় দিলো। সন্ধ্যপ্রদীপের আলোয় দেখলাম একটা চিতি সাপ। আমার 'সাপ সাপ, কামড় দিলো, কামড় দিলো' চিৎকারে তোমার কাকু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাপটাকে আর দেখতে পেলেন না। সাপটা তখন প্রদীপের আলোর নাগালের বাইরে অন্ধকারে মিশে গেছে। তোমার কাকু ধরাধরি করে খাটিয়ায় বসিয়ে পায়ে বাঁধন দিলেন। পায়ের পাতায় দুটি ক্ষত, রক্ত পড়ছে। শুরু হল বিষের জ্বালা, সঙ্গে শুরু হল বুকের ধড়ফড়ানি। গ্রামের কবিরাজ মশায়কে খবর দেওয়া হলো। তিনি খবর পেয়ে সত্বর এসে জংলি পাতা বেটে খাওয়াতে লাগলেন। বিষের জ্বালায় কাঁদতে লাগলাম। শাশুড়ি মা অভয় দিচ্ছেন আর কাঁদতে লাগলেন। ভয় লাগতে লাগলো; ছেলে তখন সাত মাসের পেটে। সকলে আমাকে ঘিরে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। কবিরাজ মশায় মাঝরাত্রি পর্যন্ত ঘন্টায় ঘন্টায় ঐ পাতার রস খাওয়াতে লাগলেন। শেষ রাত্রিতে একটু ভালো লাগতে লাগলো, সে যাত্রায় মা মনসার কৃপায় বেঁচে উঠলাম। পরে ছেলে হলো, মা-মনসার কৃপায় বেঁচে গেলো আমার ছেলেটা। শাশুড়ি মা নাম রাখলেন কৃপা। ওর বাবার নাম দেওয়া সিন্ধু। সেই থেকে ওর নাম কৃপাসিন্ধু। ছেলে হওয়ার পর শাশুড়ি ঠিক করলেন এবার থেকে বাড়িতে মা মনসার পুজো হবে। সেই থেকে আমাদের বাড়িতে এই পুজো চালু হোল।
কৃপার মা আরো বললেন--আমার ভাসুর দেওরের চার সন্তান। সবাই মেয়ে। একমাত্র ওই-ই বংশের সলতে, বংশে বাতি-দেওয়া ছেলে। আমি মুখ ফিরিয়ে দেখলাম বংশে বাতি-দেওয়া ছেলে কৃপা হ্যাজাকবাতি জ্বালাচ্ছে। গল্প করতে করতে অনেকটা সময় চলে গেলো। তুমি বাবা ওর বাবার সাথে গল্প করো--বলে উনি পুজোর জায়গায় চলে গেলেন। আমি বারান্দায় সিন্ধুর বাবার পাশে বসে এ-কথা সে-কথায় কৈ ডাঙা গ্রামের কথায় আসলাম। আমি প্রশ্ন করলাম--আচ্ছা আপনাদের গ্রামের নাম কৈ ডাঙা কেন? কৈ মাছের সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে কি? সিন্ধুর বাবা উত্তর করলেন--ঠিক ধরেছ। আমাদের গাঁয়ের ধার দিয়ে দেখছ যে খাল কাঁসাই নদীতে গিয়ে পড়েছে, বর্ষার জল সেই খাল উপচে পড়ে। ঐ সময় খাল থেকে কৈ-মাছ আমাদের ডাঙ্গায় উঠে আসে, সেই কারণে আমাদের গাঁয়ের নাম কৈ ডাঙা।
এর মধ্যে আমাদের খাবার জন্য মুড়ি আর নারকোল কুরনো এলো। মুড়ি খেতে খেতে দেখলাম এদের বিশাল মাটির বাড়ি। পর পর ঘর দক্ষিণমুখো, খোলা বারান্দা। সামনে উঠোন, উঠোনের একধারে তুলসী মঞ্চ। ঐখানে পুজোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মা-মনসা মূর্তি বেশ বড়। উঠোনে অনেকটা জায়গায় গোবর লেপা হয়েছে। পুজোস্থলে একটা হাড়িকাঠ পোঁতা। পুজোর প্রস্তুতি বাড়ির মেয়ে বৌ-রা করছে। পুরোহিত মশায় কোথায় কি দিতে লাগবে, বৌ-মেয়েদের সাহায্য করছেন। সিন্ধু তিন-চারটে হ্যাজাক জ্বালিয়ে আমার কাছে এলো। আমাকে প্রশ্ন করলো — টিফিন খেয়েছ? আমি উত্তর দিলাম--তোমার ব্যস্ত হবার দরকার নেই, তোমার এখন অনেক কাজ, যদি আমাকে কাজে লাগে তাহলে তোমার সাথে নাও। --না না, তুমি বসে গল্প করো, ঝুপার নিশ্চয় দেখতে পাবে। বলে পুজোর তদারকিতে চলে গেলো।
হ্যাজাকের আলোয় অনেকটা জায়গায় আলোকিত হয়েছে, বাদবাকি গ্রাম অন্ধকারে ছেয়ে আছে। পুজোর আয়োজন শেষের মুখে। ঢাকে কাঠি পড়লো, পুরোহিত মশায় আসনে বসেছেন। সিন্ধু এসে বলে গেলো ঢাকে কাঠি পড়লো, এবার লোকের আসা শুরু হবে।
মা-মনসার মূর্তির উপর চাঁদোয়া টাঙানো। গ্রামের মানুষের উপর তেমনই ভর, ঝুপার, ভয়-ভক্তি-বিশ্বাসের অদৃশ্য চাঁদোয়া যুগ-যুগ ধরে মাথার উপর টাঙানো। এখন সন্ধ্যা সাতটা, সারারাত জেগে কাটাতে হবে। এক একজন করে পুজো-প্রাঙ্গণে আসতে শুরু করেছে। একদল আত্মীয় মোটা মোটা ব্যাগ নিয়ে হাজির। মনে হলো এরা কয়দিন এদের বাড়িতে কাটাবে। ঢাক, কাঁসি, শঙ্খ, উলুধ্বনিতে আবহাওয়া ভক্তিময় হয়ে উঠলো। কেউ কেউ ভেড়া পাঁঠা পায়রা নিয়ে এলো মা-মনসার মানত শোধ করার জন্য বলি দিতে। সিন্ধু তত্ত্বাবধান করছে কোনটা কোথায় বাঁধা হবে, আমার কাছে এসে গর্বের সাথে বললো — আমাদের এখানে অনেকে মানত শোধ করে। মনে মনে ভাবলাম কিসের দেনা, যা কিনা অ-বোধ প্রাণীগুলোকে প্রাণ দিয়ে তা শোধ করতে হবে। কিছু কিছু মহিলাকে দেখলাম চাষের প্রথম ফল মায়ের পুজোয় বাড়ির বৌ-মেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছে নাম গোত্র সহকারে। মনে উৎকন্ঠা নিয়ে বারান্দার এককোণে বয়স্কদের সাথে বসে আছি। ভেড়া পাঁঠা, পায়রা, হাঁস কারো চোখে ঘুম নেই। ভাবছি প্রকৃতি ছেড়ে যে সমস্ত পশু-পাখী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে, সেইসব জীবজন্তুর দুর্ভোগের সীমা নেই। পুরোহিতের মন্ত্রের সাথে সাথে পুজো এগিয়ে চলেছে, পুরোহিত মশায় হাড়িকাঠে জলের ছিটে দিয়ে সিন্দুর লাগিয়ে দিলেন। হাড়িকাঠ রক্তের আশায় উঠানে গেড়ে বসে আছে।
অধীর আগ্রহে ও উৎকন্ঠার মধ্যে মন আমায় জানান দিলো, এত ভক্ত সমাগমের মধ্যে নিশ্চয় ঝুপার দেখতে পাবি। দেখতে দেখতে পুজো অনেকটা রাত গড়ালো। একজন ধুনুচি নিয়ে নাচতে নাচতে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো। আমি ভাবলাম হয়তো পায়ে পায়ে ব্যজ খেয়ে পড়েছে। ভক্তদের মধ্যে কে একজন বলে উঠলো স্বপনের ঝুপার হয়েছে।
সিন্ধু আমার নাম ডাক ধরে পাড়লো--এ দিকে এসো, ঝুপার হয়েছে। আমি আমার জায়গা ছেড়ে ঝুপার দেখতে গেলাম। মাঝবয়সী একজন লোক, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, তার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো, গলার স্বর জড়িয়ে গেছে, বলতে লাগলো, মা-গো-মা এদের ঘরের কারো দোষ নিও না। বৌটা এই সময় কেন পুজোর কাজ করলো। মেয়েদের তো এই সময় পুজোর কিছু ধরতে নাই। মা-গো-মা, দোষ নিও না। কিছু বুঝে ওঠার আগে একটি বৌ ঘোমটায় মুখটা ঢেকে ঘরের দিকে দৌড়ে ঢুকে গেলো। বুঝলাম বৌ-টির শরীর খারাপ হয়েছে। আমি এই দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে গেলাম।
ঢাকের শব্দে স্বপনের সব কথা শোনা গেল না। যেটুকু শুনলাম স্বপন ধরা গলায় বলতে লাগলো, “চ্যাঙ্গ মুড়ি কানি”। তুই আমার বাপকে খেয়েছিস্ আমার ছোট মেয়েটাকে খেলি, কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, তুই একচোখা, তুই মানুষের অনিষ্ট করিস। তোকে মানুষ ভয়ে ভক্তি করে। এইসব বলতে বলতে জ্ঞান হারালো। সকলে ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে গেলো।
আমি পুনরায় সিন্ধুর বাবার পাশে এসে বসলাম। আলো-আঁধারে দেখতে পেলাম ওনার চোখে অস্বস্তির ছাপ। ওখানে বসে শুনতে পেলাম, পুরোহিত মশায় সিন্ধুর মাকে বললেন, কিছু চিন্তা করো না বৌমা, আমি উপায় বার করে সব শুদ্ধিকরণ করে দিচ্ছি, বলে উনি দাঁড়িয়ে উঠে কোসাকুসি থেকে জল নিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে ওঁ গঙ্গা ওঁ গঙ্গা উচ্চারণ করে পুজোর সর্বত্র পবিত্র করে দিলেন।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্বপন ছেলেটা কি আপনাদের গ্রামে থাকে? তিনি উত্তর করলেন, না-না, আমাদের পাশের গ্রামে থাকে। গত শ্রাবণ মাসে ওর বাচ্চা মেয়েটাকে সাপে খেয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি-রকম কি রকম? তিনি বললেন স্বপনের স্ত্রী, বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে একটা তক্তপোষে শুয়েছিল, স্বপন শুয়েছিল আর একটি তক্তপোষে। মধ্যরাতে মা-মেয়ে বাথরুম করতে দরজা খুলে বাইরে বের হয়, সম্ভবত: ঐ ফাঁকে সাপ ওদের বিছানায় ঢুকে পড়ে। বাথরুম করে বিছানায় শোবার পর ওর মেয়েকে ঘাড়ের কাছে কামড় মারে, মেয়ের চিৎকারে স্বপন ঘুম ভেঙে দেখে, ঘাড়ের কাছে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, হেরিকেনের আলো বাড়িয়ে দেখে বিছানা থেকে সাপটা নেমে ঘরের কোণায় আশ্রয় নিয়েছে। একটা শাঁখা চিতি। সাপটা কালো কুচকুচে তার উপর সাদা, ডোরাকাটা। স্বপন সাপটাকে মেরে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে উঠান পর্যন্ত যেতে পারেনি। মেয়েটা বাপের কাঁধের উপর মাথা এলিয়ে দিল। মেয়েটাকে হারিয়ে স্বপন ভেঙে পড়েছে। চাষবাস বন্ধ করে দিয়েছে। বলে, কার জন্য মাঠে খাটবো। এছাড়া স্বপন ছোট বয়সে ওর বাবাকে হারিয়েছে। আমি প্রশ্ন করি, ওর বাবাকেও কি সাপে কামড়েছিল? তিনি উত্তর করলেন — হ্যাঁ সে অনেক দিনের ঘটনা, দহিজুড়ির নিকটে একটা ঘোষবাবুদের বাঁধ ছিল। বাঁধের নাম ‘দারোগা বাঁধ’। স্বপনের বাবা ঐ বাঁধে দেখাশোনার কাজ করতো। ওখানে স্বপনের বাবাকে সাপে কামড়ায়। আমি সিন্ধুর বাবাকে থামিয়ে বললাম-- দাঁড়ান, দাঁড়ান। এতো অদ্ভুত ব্যাপার; কোথাকার জল কোথায় গড়ালো। আমি বললাম ঐ দারোগা বাঁধ তো আমাদের ছিলো। আর ঘোষবাবু যাকে বলছেন তিনি তো আমার বাবা। বাঁধ দেখাশোনার কাজ তো অমূল্য বলে একজন করতো। তাহলে অমূল্যর ছেলে তো স্বপন? ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন তিনি। ও আপনি তাহলে ঘোষবাবুর ছেলে? আমি বললাম ঠিক তাই। সিন্ধুর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন আপনার বাবা — কি? আমি থামিয়ে বললাম বাবা ৮২ বছর বয়সে, ১৪ বছর হলো গত হয়েছেন।
উনি বললেন, বড় উদার মনের মানুষ ছিলেন ঘোষবাবু। আপনাদের বাঁধে আমার আসা যাওয়া ছিলো বলে সিন্ধুর বাবা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলাম আমার মায়ের কাছে শোনা অমূল্যের সাপ ধরার গল্প। কোন এক মাঘ মাসের দুপুর বেলা বাঁধ থেকে ধরা কিলো চারেক একটা পাকা রুই আর এক বালতি কই ও মাগুর নিয়ে আমাদের ঝাড়গ্রামের বাড়িতে হাজির অমূল্য। মায়ের উদ্দেশ্যে ডাক পড়লো--মাসিমা কোথায়? বাঁধের মাছ এনেছি। রান্নাঘর থেকে মা উত্তর করলেন--এই দুপুরে মাছ। বলে প্রাচীর ঘেরা উঠানে বেরিয়ে বললেন এত মাছ। এত মাছ কে কাটবে? অমূল্যর আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে আমার বিধবা পিসিমা বেরিয়ে এসে বললেন, এত মাছ। মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন তুমি তোমার কাজ করো, আমি সব কেটে কুটে দেবো। পিসিমা ছিলেন আমাদের বাড়ির মুশকিল আসান। ওনার সম্বন্ধে বুঝলেন কিছু বলতেই হবে। সিন্ধুর বাবা মাঝে মাঝে হুঁ শব্দ করছে। আর পুজোর দিকে চেয়ে আছেন। বলু্ন, আমি শুনছি--তিনি বললেন।
আমি বলে যাচ্ছি--বুঝলেন আগেকার দিনের মহিলা। ১২ বছর বয়সে বিধবা হয়েছেন। সেই থেকে আমাদের সাথে থাকতেন, ৯৪ বছর বয়সে মারা যান। একবেলা নিরামিষ আহার করতেন কোনদিন অসুস্থ হতে দেখিনি। আগেকার দিনের লেখাপড়া, অসম্ভব সুন্দর হাতের লেখা। সব ধরনের সেলাইয়ের কাজ জানতেন। সব ধরনের রান্নার কাজে দক্ষ ছিলেন। পিঠে, পায়েস, নাড়ু, আমসত্ত্ব, আচার, কাসুন্দি, মোয়ামুড়কি, বড়ি, মুড়ি ভাজা, খই, সারা বছর লেগেই থাকতো। রামায়ণ মহাভারত, মুখস্ত ছিলো। সব ঠাকুরের পাঁচালি মুখে মুখে থাকতো। আমাদের ভাই-বোনদের এবং জন্মের আগেই কাঁথা তৈরীর কাজ শেষ করে রাখতেন।
মাছ কাটতে কাটতে পিসিমা বলতে শুরু করলেন অমূল্য তোমার মাসিমা ভাত দিতে দিতে রুই মাছটা কেটে দুই চাকা ভেজে দিচ্ছি ডালের সাথে খাও ভালো লাগবে। টাটকা বাঁধের মাছ হাতে করে নিয়ে এসেছো। সিন্ধুর বাবাকে বললাম বুঝলেন, যে মহিলা ১২ বছর বয়সে বিধবা হয়ে ৯৪ বছর পর্যন্ত কোনদিন আমিষ খাবার খাননি, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পিঁয়াজ রসুন মুসুর ডালও কোনদিন মুখে দেন নি তিনি-ই বলছেন ডালের সাথে ভাজা মাছ খাও ভালো লাগবে। এখনো আমার কুসংস্কারের ঘোলা জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। ইংরেজরা যদি এ দেশে না আসতো তবে হয়তো পিসিমাকে সতীদাহ প্রথার বলি হতে হতো।
সিন্ধুর বাবা হাঁ-করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন--সত্যিই তো কত শত আমাদের সমাজের বিধবা নারীরা সারা জীবন শুধু ত্যাগ করেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে; আমরা শুধু দিয়ে গেছি কুসংস্কারের মোড়ক। আমি শুরু করলাম আমাদের বাড়িতে অমূল্যর সাপ ধরার কাহিনী। মা অমূল্যকে ভাত দিতে দিতে বললেন, জানো অমূল্য, আজ সকালে ফুল তুলতে তুলতে দেখি টোপাকুল গাছের গোড়ায় একটা গর্তে তেঁতুল রঙের একটা সাপ ঢুকে গেলো। বাড়ির সকলেই জানত অমূল্য সাপ ধরে তার বিষ দাঁত ভেঙে সাপ খেলা দেখাতো। সেই কারণেই অমূল্যকে বলা।
ভাত খেয়ে গর্ত পর্যবেক্ষণ করে বললো, মনে হয় জাঁতালো সাপ। গায়ের রঙ যদি তেঁতুলের মতো হয়, তবে তেঁতুলা খরিস। বলে গর্তের মুখে একটা আস্ত ইট চাপা দিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে কি এক গাছের জংলি পাতা এনে শিল নোড়ায় বেটে এক বালতি জল গুলে বাড়ির সবাইকে ডেকে বললো সবাই বেরিয়ে আসুন, বলে গর্তের মুখ থেকে ইট সরিয়ে ওই এক বালতি জল গর্তের মধ্যে ঢেলে দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো দেখুন দেখুন সাপ বাবার জীবনের কী গতি হয়। কথা শেষ হতে না হতে এক জাঁতালো সাপ বেরিয়ে এলো গর্ত থেকে, অমূল্য এক মুহূর্ত দেরি না করে চকিতে সাপটার মাথা চেপে ধরে বাড়ির সকলকে বিষ দাঁত ও বিষের থলি দেখিয়ে বললো এই দেখুন থলি ভর্তি বিষ। একেবারে জাঁতালো তেঁতুলা খরিস। যাকে ছোবল মারবে তাকে ভেলায় চড়তে হবে লখীন্দরের মতো, বলে একটা মাটির কলসীর মধ্যে ঢুকিয়ে মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে বললো, আমি চললাম মাসিমা। মা প্রশ্ন করলো এটাকে কোথায় নিয়ে যাবে? উত্তর করলো অমূল্য--কেন বাঁধের পাড়ে। শুনেছিলাম ঐ সাপ ধরে রেখে অমূল্য ঘুমিয়ে পড়েছিল। সাপ ওই হাঁড়ির থেকে বেরিয়ে অমূল্যকে কামড়ায়। যখন খবর আসে তখন সব শেষ। বাবা ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য ওঝা কাউকে দেখাতে বাকি রাখেনি, শেষে কলা গাছের ভেলা বানিয়ে অমূল্যর দেহ কাঁসাই নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে বাবা বাড়িতে এসে ভেঙে পড়লেন। বললেন একটা জলজ্যান্ত লোক চলে গেলো। পিসিমা চোখের জল ফেললেন। মা শুধু বলতে লাগলেন কেন যে আমি অমূল্যকে দেখাতে গেলাম যে, ওখানে সাপ বেরিয়েছে। এ আফশোষ বহুদিন পর্যন্ত ছিলো আমার মায়ের।
রাত অনেক গড়িয়ে গেছে, এবার বলির পালা। পায়রা, হাঁস দিয়ে শুরু হলো, সঙ্গে ঢাকের তাল। পুরোহিত মশায় পাঁঠা ভেড়াগুলোর কপালে সিন্দুর লাগিয়ে দিলেন, আমি অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। একে একে বলি হচ্ছে আর এক একজনের দেনা শোধ হচ্ছে। সকলে তারস্বরে চিৎকার করছে, জয় মা মনসার জয়, জয় মা মনসার জয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত্রি তিনটে। ঢাকের আওয়াজ বন্ধ হলো। পুরোহিত মশায় মা-মনসার ঘটের ফুল বেলপাতা এক একজনের হাতে তুলে দিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করছেন। অনেকে ঘুমে ঢুলছে। একটা বাচ্চা গোবর-লেপা উঠানে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ির মেয়ে বৌ-রা সব পা বাঁচিয়ে শান্তির জল নেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। হ্যাজাকের আলোর জোর কমে এসেছে, দূরে মোরগের ডাক শোনা গেলো।
আলো-আঁধারে হঠাৎই একটি ছেলে চিৎকার করে বলে উঠলো মাগো-মা। আমার দোষ নিস না, তুই একটা ‘চ্যাঙ্গ কানি বুড়ি’। তুই এই জগৎ সংসারে সকলকে ভুল বুঝিয়ে এসেছিস। কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা বড় হচ্ছে আর কোকিল আনন্দে জগৎ সংসারকে কুহু কুহু সুরে গান শুনিয়ে বেড়াবে? আসলে ওটা কোকিলের কান্না। জগৎ সংসার তোদের মত দেব-দেবীদের নিন্দা করবে বলে কান্নার সুরটা শ্রুতিমধুর করেছিস। এটাই তোদের চালাকি। এই চালাকি না করলে তোদের পুজো কেউ করবে না।
আমার অবস্থা ঐ কোকিলটার মতো, আমার সন্তান অপরের বাসায় বড় হচ্ছে, আর আমি গুমরে গুমরে কেঁদে মরি। এই কি তোর বিচার? বলতে বলতে ছেলেটার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো, আর মাটিতে শুয়ে কাঁদতে লাগলো। এখন আর ওকে তোলার মতো কেউ নেই; সকলে ক্লান্ত।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বৌ কোলে বাচ্চা নিয়ে দৌড়ে এসে মা-গো-মা তুই আমার সাক্ষী, আমার সব কিছু জানিস মা। আমি ছেলেটাকে ভালোবাসতাম। বাড়ির কেউ মানলো না; অপর ঘরে বিয়ে দিয়ে দিলো, তখন আমার সন্তান দু’মাসের পেটে। আমার শ্বশুরবাড়ির কাকের দল যখন জানতে পারলো বাচ্চাটা ওদের বাড়ির নয়, তখন সন্তান সমেত আমাদের তাড়িয়ে দিলো, বলে কাঁদতে কাঁদতে কোলের বাচ্চাটাকে মাটিতে শুয়ে থাকা ছেলেটির কোলের কাছে শুইয়ে দিয়ে দৌড়ে নিজের অপকর্মের শরীরটাকে অন্ধকার বাঁশবাগানে লুকালো।
... সিন্ধু কাছে এসে বললো, দেখলে ঝুপার? আমি সম্পূর্ণ বাক্রুদ্ধ হয়ে বাঁশবাগানের ফাঁক দিয়ে ভোরের আকাশের অপেক্ষায় চেয়ে রইলাম।