• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | কবিতা
    Share
  • চারটি কবিতা : আনন্দ সেন


    কথা

    কথারা গড়িয়ে কলমের ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল বলেই
    আকাশে মেঘেরা আড়ি পেতেছিল, বৃষ্টিও তাই চলেই
    যাবে ভেবে শেষে থমকে দাঁড়াল খোলা জানলার পাশে
    একটা কি দুটো প্রেমের গল্প যদি বা ভিজতে আসে।

    পথের কোনায় আগাছার সাথে রোদের স্পর্শ মেখেই
    লুকোনো যে ফুল মাথা তুলেছিল তার চোখে চোখ রেখেই
    দামাল কিশোরী নাবাল জমিটা পেরিয়ে দিয়েছে ছুট
    তার কথাগুলো অপ্রকাশিত, ইচ্ছেরা অস্ফুট।

    যে কথা কালকে ঘর ছেড়েছিল উলটো হাওয়ার টানে
    কোলাহল থেমে আলো নিভে গেলে স্বপ্ন ভাঙার মানে
    জেনেছে বলেই আজকে সে ঠিক ঠিকানা পেয়েছে নিজে
    পুড়েছে বলেই তার লেখা আছে আগুনের আঁচে ভিজে।

    কথারা তো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এদিক সেদিক
    দু মুঠোয় ভরে, তার বুক চিরে, যার যা নেবার সে নিক
    আমার কলম বন্ধ হবে না যতদিন কথা আছে
    যদি চাঁদ ডোবে রাতে, বৃষ্টির সাথে, চলে যাব তার কাছে।

    ব্যালান্স বীম

    মেয়েটা হাঁটছে
    একটা কাঠের পাটাতনের উপর
    পাঁচ মিটার লম্বা আর দশ সেন্টিমিটার চওড়া
    হাঁটছে, ডিগবাজি খাচ্ছে সামনে পিছনে
    মাঝে মাঝে নিজের ছোট্ট শরীরটা শূন্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে
    আবার নিপুণ দক্ষতায় এসে নামছে পাটাতনের উপর ।

    ব্যালান্স বীম।
    সব জিমন্যাস্ট চায় এই ইভেন্টে বাজিমাত করতে
    কেউ পারে, কেউ পারে না
    কঠিন মনঃসংযোগের প্রয়োজন
    কতদূর শরীরটাকে ছুঁড়তে হবে
    পা দুটো ঠিক কতক্ষণ শূন্যে থাকবে
           তার অঙ্ক জটিল।
    হিসেবের এক চুল এদিক ওদিক হলে পদস্খলন
    মাটিতে নেমে আসবে পরাজয়
    যত না শরীরে চোট, তার থেকে বেশি চোট মনে।

    মেয়েটা তা জানে।
    তাই সকাল সন্ধে প্র্যাকটিস করে সে
    ঐ এক চিলতে কাঠের পাটাতনের সাথে কথা বলে
    তার গায়ে হাত বুলোয়
    তাকে চিনিয়ে দ্যায় দেহের প্রত্যেক অণু পরমাণুর ওজন।


    এটাই তার ইভেন্ট
    এক একটা মুভমেন্ট করে চলে যন্ত্রের মত
    বিস্ফারিত মুগ্ধতায় হাজার হাজার দর্শক
                                  দেখতে থাকে।

    আর দ্যাখে গ্যালারীতে বসে থাকা তার মা।
    তার মুখে অনেক ক্লান্তির পলি।
    দুরুদুরু বুকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে
    আর মনে মনে বলে
    এই খেলাটায় জিতে আয় মা
    শিখে নে ব্যালান্স বীমকে জয় করবার রণকৌশল
    এই খেলাটাই তো তোকে খেলতে হবে।
                                  সারাজীবন।


    প্রতিবেশিনী

    গলির মোড়ে ‘হ্যালো
    আজ রোদ উঠেছে ভালো’
    এক গুছি চুল মাঝকপালে
    আড়ালে টিপ কালো।

    কোন দুপুরবেলার শীতে
    হয়তো পাড়ার সিসিডিতে
    কেমন আছেন, ভাল তো সব --
    হঠাৎ অতর্কিতে।

    হয়তো আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েন
    নারীমুক্তির বিষয় নিয়ে লড়েন
    আবার মন খারাপের বিকেলবেলায়
    কৌশিকিতে মরেন।

    আকাশ যদি জলজ আশায় ভরে
    আপনারও কি খুব ইচ্ছে করে
    ছাদে উঠে বৃষ্টি নামান
    মেঘেদের হাত ধরে?

    কোন রাত্রি জাগার শেষে
    ভোরের আলো হঠাৎ যখন সম্ভাবনায় মেশে
    আপনিও কি দাঁড়ান সেদিন
    জানলার পাশ ঘেঁষে?

    আপনিও কি ঋত্বিক আর ঋতুপর্ণ চাখেন?
    বুকফেয়ারে বইয়ের গন্ধ মাখেন?
    মাঝে মাঝে একলা ঘরে
    হৃদয়ে চোখ রাখেন?

    আপনার কি রঙ তুলিতে প্রকাশ
    নাকি সেতার হাতে ভাঙেন হিসাব নিকাশ
    বা কথার ঘেরে খাতার পাতায়
    বন্দী করেন আকাশ?

    আপনি হয়তো ফুচকা ভালবাসেন
    তারাপদর চুটকি পড়ে হাসেন
    আর মাঝে মাঝে মেঘলা হলে
    জয় গোঁসাইয়ে ভাসেন।

    এসব কথা হয়নি আমার জানা
    জানতে গেলে হাজার রকম না না
    আমরা থাকি দু সংসারে
    গণ্ডী আছে টানা।

    তার চেয়ে এই ভাল
    গলির মোড়েই হ্যালো
    একটু হেসে বলব না হয়
    উফ্‌, কাল কী বৃষ্টিটাই না গ্যালো।


    বৃষ্টিরা সব থেকেই যায়

    কবেই আমি হারিয়েছি তোর ভুরুর ভাঁজে, ঠোঁটের তিলে
    এখনও তাই ডুব দিয়ে যাই অস্তরাগের অন্ত্যমিলে।

    আজকেও তোর হাতের ছোঁয়ায় আংরাভাসায় জোয়ার আসে
    তোর বাড়ীতেই মেঘেরা সব আড্ডা মারে আষাঢ় মাসে।

    সেদিনও তোর কাজল চোখের সর্বনাশের মাত্রাগুলো
    তোর সাথে আজ আড়ি বলেও কখন জানি জড়িয়ে শুলো।

    এখনও তোর রান্নাঘরে রোদ ঝাঁপিয়ে ছুঁচ্ছে চুল
    পাশের বাড়ীর বেচারি চোখ অঙ্কে খালি করছে ভুল।

    তোর মুখের কথায় আসমানি রঙ, পায়ের ছন্দে দুলছে রাত
    তোর গালের উপর ভাঙবে বলে জ্যোৎস্না এসে ধুচ্ছে ছাত।

    মরা আলোয় সন্ধে মেখে হাঁটছিলি তুই রাস্তা দিয়ে
    একটা শালিক তাই না দেখে পাতার কানে ফিসফিসিয়ে

    শুনিয়ে ছিল নতুন বাঁধা দু চার কলি ইমন রাগে
    থমকেছিল এক মুঠো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরার আগে।

    যে কবিতা অনেক দিনের এখনও সে হাত বাড়ায়
    গলির মোড়ে, গাছের তলায়, বৃষ্টিরা সব থেকেই যায়।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments