• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | রম্যরচনা
    Share
  • দেশান্তরের কথা : সন্ধ্যা ভট্টাচার্য


    ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়ীতে যে সব ক্রিয়া কাণ্ড, পূজা অর্চনা মূর্তি দিয়ে হতো। সেই সব মূর্তি তৈরী করতেন আমার জ্যাঠামশাই নিজে। যেমন--মনসা, কার্তিক, সরস্বতী, এই সব মূর্তি তৈরীর যত রকম সরঞ্জাম ছিল অর্থাৎ কোনটা দিয়ে কী করা হত সবকিছু আমাদের কন্ঠস্থ ছিল। কারণ জ্যাঠামশাই যখন মূর্তি তৈরীর কাজে হাত দিতেন, আমরা তখন তাঁর ছোট ছোট কাজে পূর্ণ উৎসাহ নিয়ে সাহায্য করতাম। যেমন মাটি ছানা ছিল ছোটদের কাছে এক উৎসাহের কাজ। তাছাড়া এটা সেটা এগিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে তামাকের হুঁকাটা এগিয়ে ধরা। এইভাবে সঙ্গে থেকে থেকে মূর্তি তৈরী সম্বন্ধে সমস্ত কায়দাকানুন আমাদের রপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

    জ্যাঠামশাই পরলোকগত হওয়ার পর বাড়িতে মূর্তি তৈরীর পাট একরকম উঠে গেছিল। তবে মূর্তি তৈরীর সরঞ্জাম সব বাহিরবাড়ীর ঘরে তোলা ছিল।

    ১৩৫২ সনের মাঘ মাস। আমার বয়স তখন ১৭ বছর। সরস্বতীপূজা আসছে। বর্তমান সময়ের মত, তখনকার দিনেও প্রতি বাড়ী বাড়ী পূজা হত। তবে মূর্তি নয়। বই এবং দোয়াত-কলমের। এবং তা হতো ঘরের ভিতর। তবে মূর্তি দিয়ে বা ঘরের বাইরে পূজা করার কোন বাধানিষেধ ছিল না।

    আমরা এবার ফন্দি করলাম মূর্তি তৈরী করব নিজেরাই এবং নানান রকমারি ভাবে সাজিয়ে পূজা করব উঠানে। ছোট ছোট জ্যেঠতুতো ভাইপো ভাইঝিরা মিলে বিল জমি থেকে বয়ে নিয়ে এল এঁটেল মাটি। জ্যেঠামশাইয়ের মূর্তি তৈরীর সরঞ্জাম থেকে বের করে আনলাম মাঝারি গোছের একটি মুখের ছাঁচ এবং তারপর এঁটেল মাটিতে সরস্বতী গড়ে বিভিন্ন রং সমাহারে তৈরী করলাম মূর্তি। মূর্তি গড়বার কাজে সাহায্যকারী হল আমার জ্যেঠতুতো বৌদি।

    আমাদের উঠানের এক কোণে তুলসি মঞ্চের পিছনে একটি শিউলির গাছ ছিল। শরতের জোছনারাতে ঘরের বারান্দায় বসলে দোর গোড়ায় ফুল-ফোটা শিউলিগাছের মিষ্টি গন্ধে এক অদ্ভুত মায়াজাল তৈরী হত। প্রত্যহ সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে ফুলের সাজি নিয়ে দরজা খুলে উঠানের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। কী অপূর্ব স্বর্গীয় মনোরম দৃশ্য! সারা উঠানে শিউলির চাদর বিছানো। চতুর্দিকে ভোরের ঝিরঝিরে হিমেল হাওয়ায় ভুরভুরে গন্ধ। পুব-আকাশে বাঁশবনের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে সূর্যোদয়ের প্রাথমিক পর্ব। প্রকৃতি তার সারাদিনের কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুশীতল ফুরফুরে হাওয়া আর আসন্ন ভোরের আলোর পরশে গাছে গাছে ভোরের পাখিরা বাসার থেকে নিজেদের বিভিন্ন জাতীয় সুরে প্রভাতী গান গেয়ে উঠছে। বাগিচায়, অরণ্যে, বনে ঘুমন্ত ফুলের কলিরা তাদের মুদ্রিত আঁখির পাখনা মেলে সুগন্ধ ভাণ্ডার উজাড় করে ছড়িয়ে ধরিত্রীকে দিল তার দিনের প্রথম অর্ঘ্য।

    ফুল তোলার নেশায় বা ছলে অতি প্রত্যূষে উঠে প্রকৃতির এই মায়াময় দৃশ্য দেখা আমার নেশা ছিল। এতো চিত্তাকর্ষক দৃশ্য যে পরবর্তী জীবনের চলার পথের প্রতিকূল অনুকূলতার ধাপে ধাপে চলতে গিয়েও মন থেকে হারায়নি।

    প্রত্যহ সাজিভর্তি ফুল নিয়ে অতি ভোরের জনমানবশূন্য নির্জন রাস্তায় হাঁটতাম। আমার আনকোরা, স্বচ্ছ, ভুত-ভবিষ্যতচিন্তার অনুভূতিশূন্য মনে এক অপূর্ব স্বর্গীয় আনন্দের উপলব্ধি হত। অনুভব করতাম, আমার চর্তুদিকে প্রিয়জনদের আদর স্নেহ ভালবাসার বেষ্টনী। চিন্তাভাবনাহীন নিরাপত্তার এই স্বর্গীয় আনন্দই হয়ত আসল স্বর্গীয় সুখ।

    আমাদের বাহিরবাড়ীর উঠানের এক কো্ণে ছিল একটি রক্তকাঞ্চন ফুলের গাছ। ফাল্গুনে যখন ফুল ফুটত, তখন শীতের শেষের পাতাঝরার দিনে ফুলে বিভূষিত গাছটিকে দূর থেকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাত। ভোরে যখন ফুল পাড়তে গাছে চড়তাম, প্রতিটি ফুলে অসংখ্য মৌমাছি গাছে নাড়া পেয়ে ভন্ ভন্ আওয়াজে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত।

    আমাদের পাশের বাড়ীর দূর সম্পর্কের জ্যেঠতুতো দাদাকে আমরা ছোড়দা বলতাম। এই ছোড়দাদের বাহিরবাড়ীর উঠানে ছিল একটি লিচু গাছ। কোন এক কালে ভয়ঙ্কর ঝড়ে কাৎ হওয়া গাছটি কাৎ অবস্থাতেই বাকি উপরমুখে বেড়ে উঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে কোন এক সময় প্রয়োজনে এই গাছের পাশ ঘেঁষে ঘর তোলায় বাহিরবাড়ীর উঠানের দিকের বারান্দায় গাছের গোড়ার অর্ধেক পড়েছিল। আমরা কোন সময় লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ঘরের বারান্দা দিয়েই গাছের কাৎ হওয়া অংশটা দিয়ে সোজা উপরে উঠে যেতাম।

    গাছটিতে যখন লিচু ধরত, এক-একটি ছড়ায় অনেকগুলি করে বড় বড় লিচু হত। লিচুর ভারে গাছের ডালগুলি এত নীচু হয়ে থাকত যে হাত দিয়েই পাড়া যেত। কিন্তু যত ভোরেই উঠতাম, লিচু চুরির কোন সুযোগ পেতাম না। বাড়ীর চাকর শ্যামাচরণ লিচুগাছের তলার দিকের ঘরের বারান্দায় টুল পেতে শুয়ে থাকত। চুপি চুপি লিচুর ঝুলে থাকা ছড়ায় হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যমদূতের মত মস্ত একখানা বাঁশের লম্বা লাঠি নিয়ে এমন তাড়া দিত বলবার নয়। ভয়ে আমরা মরিপড়ি ছুটে পালাতাম।

    যখন গাছে লিচুর গায়ে সিঁদূরে রং দেখা দিত তখন নিশাচর বাদুড়, ভোঁদড় (লেন্দর) এদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সমস্ত গাছটাকে বিরাট আকৃতির একটি জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হত। এরপর গাছের মগডালের একটি মোটা অংশে লম্বা একটি বাঁশ বেঁধে তার সঙ্গে বাঁধা হত একটি বড়োসড়ো কেরোসিন টিনের কেনেস্তারা।

    এই কেনেস্তারার সঙ্গে একটি মোটা এবং বিশাল লম্বা পাটের দড়ি বেঁধে সোজা ভিতরবাড়ীতে ছোড়দার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে খাটের রেলিং এর সাথে বাঁধা থাকত। নিশাচররা যখন নিশুতি রাতে লিচুগাছে এসে ঝপ করে পড়ত ছোড়দা তখন ঐ কেনেস্তারার দড়ি ধরে টানত। গাছের উপরে টিনটি এক বীভৎস ঘটর ঘটর আওয়াজে বেজে উঠত।

    অতর্কিত এই শব্দে প্রাণের ভয়ে পাখার ঝটপটানি আওয়াজ করে ছুটে পালাত বাদুড়ের দল। লাফিয়ে গাছ থেকে পালাত সব ভোঁদড়ের দল। ভোঁদড়রা আবার একটু চালাক বেশী। তাদের আগমনবার্তা সবসময় টেরও পাওয়া যেত না। কারণ এদের তো আর পাখা ছিল না! এদের দেহ বেজির মত (নেউল)। কাল কুচকুচে গায়ের রং। অন্ধকারে তাই এদের দেখা যেত না। তবে চোখ দুটো ছিল যেন দুখানা টুনিলাইটের মতো। অন্ধকারে কখনও-সখনও এদের দেখলে মনে হত দুখানা পাশাপাশি সচল আলোর ফুটকি। সচরাচর দেখলে ভয় হত।

    তবে এরাও মানুষকে ভয় পেত। লোকালয়ে এলে খুব সতর্ক হয়ে আসত। এদের বাসস্থান ছিল গভীর জঙ্গল, গাছের কোটর অথবা কোন পরিত্যক্ত বন্ধ ঘরে। অন্ধকার ছাড়া এদের বড় বেশী একটা দেখতে পাওয়া যেত না।

    ছোটবেলায় একবার খেলা করতে গিয়ে এদের বংশ ও বহু সন্তানসন্ততি পরিবেষ্টিত আড্ডায় ঢুকে পড়ায় কী ভয়ানক কাণ্ডই না ঘটেছিল! ছোড়দাদের বাহিরবাড়ীর কাছারিঘর, বছরের কোন কোন সময় প্রয়োজনবোধে খোলা হত, নচেৎ বন্ধ থাকত। এই বন্ধ ঘরের উপরে কাঠের পাটাতনে থাকত কোন উৎসব অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় মালপত্র। যেমন একসঙ্গে পাঁচশ নিমন্ত্রিত একত্রে খেতে বসতে পারে সেই অনুপাতে তৈরী সামিয়ানা, আসন, গেলাস, পুণ্যাহের নানা সরঞ্জাম ইত্যাদি। ঘরের এককোণে মাটিতে বসিয়ে রেখেছে, পুরানো ঐশ্বর্য্যের শেষ নিদর্শন, নানানরকম বাহারি নকশায় বিভিন্ন রং সমাহারে অঙ্কিত একটি পালকি। তারই পাশ দিয়ে কাঠের মজবুত সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের পাটাতনে।

    পাটাতনের উপর ঘোরতর অন্ধকার দূর করার জন্য ছিল চারদিকে চারটি ছোট ছোট জানালা। চাকরবাকরদের অসতর্কতা হেতু কোন সময় চারটি জানালার মধ্যে কোন একটি কপাটের এক অংশ ঢিলা রয়ে গিয়েছিল। বনের ভোঁদড়রা বাচ্চা দেবে বলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কোন একসময়ে এই ঢিলা জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে গিয়েছিল। এই পাটাতনের উপর এবং উপযুক্ত সময় সংখ্যাধিক বাচ্চায় বেষ্টিত হয়ে তাদের মা-বাবাগণ বসে আছে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।

    কাছারির বন্ধ ঘরের একদিকের টিনের দেওয়ালের কিছু অংশ জং ধরে নষ্ট হয়ে গেছিল। লুকোচুরি খেলায় লুকানোর জন্য দুর্গম জায়গার সন্ধানে আমরা খেলার পার্টির কয়জনা গ্রিলে জং ধরা টিনের দেওয়ালের ফাঁকা অংশ টেনে আরো ফাঁক করে ঢুকে গেলাম বন্ধ ঘরের ভিতরে। ঢুকে কেউ পালাল পালকিতে, আর ক’জনা পাটাতনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম উপরে।

    উপরে উঠে যেই না সিঁড়ি থেকে পাটাতনে এক পা দিয়েছি, অমনি অন্ধকার ঘুটঘুটে পাটাতনের উপর দুই জোড়া চোখ উঁচু হয়ে দাঁড়াল। নীচে বিন্দু বিন্দু জোনাকির মতো চোখ চিউ চিউ আওয়াজ করে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিয়েছে।

    এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যে ভয়ের ঠেলায় চিৎকার করতে করতে কাঠের সিঁড়ির ধুম ধুম আওয়াজ তুলে মরিপড়ি করে নীচে নেমে এলাম। ভয়ে আর তরাসে ভুলে গেলাম বাইরে বেরোবার চোরা পথটিকে। ফলে পালকিতে যারা পলাতক ছিল তারাও কিছু না দেখে না বুঝে আমাদের চিৎকারে সঙ্গী হয়ে গেল।

    বন্ধ ঘরে এতগুলি মেয়ের একত্রিত ‘ওরে মারে বাবারে’ চিৎকারে চাকর শ্যামাচরণ সহ আশপাশের লোক ছুটে এসে দরজা খুলে এবং ব্যাপার শুনে শ্যামাচরণ সহ বড় মানুষ দু’চারজন কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। অমনি, সিঁড়ির ধমাধম্ শব্দ শুনে ভয়ার্ত ভোঁদড় মা-বাবারা এক লাফে ঢিলা জানলার কপাট গলে বাঁশবনে।

    এরপর কেরোসিন আলোর সাহায্যে বাচ্চাগুলিকে একটি ঝুড়িতে করে ধরে এনে বাড়ীর ভিতর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তখনও দিনের আলো। চলাফেরায় অসমর্থ বাচ্চারা চোখে দেখতে পায় না কিছুই। শুধু চিউ চিউ আওয়াজ করে মাটিতে মাথা গুঁজে এদিক-ওদিক গুটি গুটি হাঁটার চেষ্টা করছে। সন্ধে হয় হয়, এমন সময় আবার চাকর শ্যামচরণ ঝুড়ি করে তাদের বাঁশবাগানে রেখে এল। পরদিন অতি প্রত্যুষে গিয়ে দেখি ঝুড়িতে একটিও বাচ্চা নেই। রাতের অন্ধকারে হয়ত মা-বাবা এসে নিয়ে গেছে।


    যাই হোক ১৯৪৬ বাং ১৩৫২ আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের লেখার শুরুতেই এসে গেল হাজারো বাল্যস্মৃতি। মাঘ মাস। সরস্বতীপূজার আগের দিন। মূর্তি তৈরী সমাপ্ত। পূজার অন্যান্য আনুষঙ্গিক সমস্ত তৈরী। শিল্প সৃষ্টির পূর্ণতার আনন্দে ঘুরে ফিরে এক একবার দেখে নিচ্ছি নানারকম রাংতার গয়না, চূড়া নুপূর পরা ঠাকুরকে। এমন সময় গ্রামের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এলেন শমনের পরোয়ানা নিয়ে। অর্থাৎ আগামীকাল আমার বিবাহের লগ্ন স্থির হবে (বর্তমানে যাকে বলে আর্শীবাদ)। গ্রামের বিশিষ্ট লোকেদের সমক্ষে লগ্নপত্র লেখা হবে। তারপর হবে নানা স্ত্রী-আচার, মঙ্গলাচরণ। এককথায় চুক্তিপত্রেরই নামান্তর।

    যথাসময় নানারকম আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হওয়া সমাপ্ত হল। ২৫ ফাল্গুন বিবাহের দিন ধার্য হল।

    সরস্বতী পূজায় আমাদের বাড়ীতে পূজাপাঠ শেষ হবার পর বসত গানের আসর। পূজিত ঠাকুরের সামনে পাটি পেতে সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসতাম সবাই। গাইয়ে ছিল দিদি, আমি, আর আমার জ্যেঠতুতো দাদার ছোটমেয়ে। হারমোনিয়াম নিয়ে বসত জ্যেঠতুতো দাদা, ছোড়দা বাজাত বাঁশি। মেজদা বাজাত সেতার।

    ঘন্টার পর ঘন্টা চলত এই গানের আসর। দর্শক শ্রোতার অভাব হত না। সব মিলিয়ে অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে উঠত সরস্বতীপূজার দিনটি। যেসব গান সেদিন গাওয়া হত তার দু একটি নমুনা এখানে তুলে ধরলাম--

    প্রথমটি--

    বাণী গো বাণী গো
    এসগো এ দীন ভবনে
    কর মা পবিত্র ক্ষুদ্র গৃহ
    চরণপদ্ম অর্পণে
    বাণী গো বাণী গো।

    দ্বিতীয়-

    এস মা সারদে শুভদে বরদে
    এস মা জননী বাণী
    এস মা...... বাণী।

    তৃতীয়-

    শ্বেতবরণা নীলবসনা
    বাগদেবী বীণাবাদিনী।
    পিঙ্গল জটায় সুশোভিত শির
    কেয়ূর নূপুর বাজে রিনি ঝিনি
    ডাকিছে তব সন্তান সকলে
    বিদ্যাং দেহি জননী
    > শ্বেতবরণা নীলবসনা----।

    সরস্বতী পূজার দিন আমরা পরতাম শিউলি ছোপানো শাড়ী। বাড়ী বাড়ী দু’তিনটি করে শিউলি গাছ থাকত। যদিও মাঘ মাসে শরতের শিউলির কিছুটা স্বল্পতা দেখা দিত। তবু কোন কোন গাছ একবার ফুল ফোটার পর এই ফুল ফোটার রেস চলত ফাল্গুন পর্যন্ত।

    আবার এই শিউলির মালায় সেজে আমরা শুরু করতাম পদাবলী পালা। কেউ রাধাকৃষ্ণ, কেউ বা বৃন্দা, ললিতা, বিশাখা। পাতাবাহারের তৈরী চূড়া আর শিউলির মালায় সেজে পদাবলী পালাকে হুবহু নকল করা।

    বর্তমান যুগের মত এত চিত্তাকর্ষক বিনোদনের বাহুল্য, অতীতে গ্রামদেশে কিছুই ছিল না। অতএব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আমোদ প্রমোদের উপকরণ ছিল দেখা জিনিষকে দলবদ্ধ হয়ে হুবহু নকল করে তার পুনরাবৃত্তি করে আনন্দ পাওয়া।

    যাক সেসব কথা। আমার বিবাহের চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হল। প্রস্তুতিপর্ব আরম্ভ হয়ে গেছে। ১৩৫২ সনের ২৫ শে ফাল্গুন বিবাহের দিন ধার্য হয়েছে। অতএব এখন আর বাড়ীর বাইরে যাওয়া চলবে না। মুহূর্তে মনের এক গুরুতর বিপর্যয় ঘটে গেল। জ্ঞান হবার পর থেকে যেসব সুখস্মৃতি, চোখের সামনে থেকে পলকে সবই যেন অদৃশ্য হতে লাগল। মনের কোণে এক অদৃশ্য বিদায় সুরে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।

    মনের এক অব্যক্ত দুঃখে ঘরের পিছনের জামগাছে টাঙানো দোলায় বসে একা সারাটা বেলা কাটালাম। পাড়ায় আশেপাশে যে সব সাথীরা ছিল, তারা অধিকাংশই একে একে চলে গেছে। পিছনে ফেলে গেছে আবাল্য লালিত মাতৃভূমি। তার চিরপরিচিত পথ, ঘাট, মাঠ, অরণ্য, নদী, নালা, গাছপালার মায়াজাল ছিঁড়ে যে যার নির্দিষ্ট গন্তব্যে হরষে বিষাদে পাড়ি দিয়েছে।

    যাই হোক তো যথাসময় শুরু হল বিবাহের নানা ক্রিয়াকাণ্ড, পূজা-আর্চা। প্রথমেই বলে নেই যে-পদ্ধতিতে আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তার বিবরণ। তবে সে-পদ্ধতির প্রচলন বাংলাদেশের ঘরেঘরেই ছিল। উভয় পক্ষের আলোচনা অথবা উভয় পক্ষের সুবিধা অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে একমত হয়ে।

    যাই হোক তো পদ্ধতিটি কেমন ছিল? যেমন কনের বাড়ীতে সমস্ত মঙ্গলাচারণ শেষে, দূরত্ব অনুযায়ী বিয়ের একদিন কি দুদিন আগে বিয়ের কনেকে নিয়ে চলে গেল বরের বাড়ীর কাছাকাছি বরপক্ষের নির্দিষ্ট করা কোন এক বাড়ীতে। তবে সে বাড়ী যদি কনেপক্ষের বিশেষ পরিচিত বা আত্মীয়ের থাকত তবে তো কোন ব্যাপারই ছিল না। নতুবা বরপক্ষের নির্দিষ্ট করা বাড়ীর লোকজন বিয়ের সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে করে তৈরী থাকত। যথাসময়ে কনে ঐ বাড়ী গিয়ে পৌঁছলে বাড়ীর মহিলারা কনের মা মাসী পিসি কাকি জ্যেঠিতে রূপান্তরিত হয়ে বিবাহকার্যের খুঁটিনাটি সমস্ত কাজ সুষ্ঠরূপে সুসম্পন্ন করত। পরদিন বরকনেকে নানা আচার নিয়ম অনুষ্ঠানের পর তুলে দিত পালকিতে। এর পর কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে উভয় (অর্থাৎ যে বাড়ী থেকেই বিয়ে হত) পক্ষেরই মনের আকর্ষণ অনুযায়ী পিত্রালয়ের মতো আদান প্রদান কর্তব্যাককর্তব্যের এক সুসম্পর্ক গড়ে উঠত চিরদিনের মতো। তেমনভাবেই আমারও বিয়ে হয়েছিল (পাত্রপক্ষের মতানুযায়ী) আমার শ্বশুড়বাড়ী থেকে মাইলখানেক দূরে তাদেরই বিশেষ পরিচিত এবং আমার বাবার প্রাক্তন ছাত্রের বাড়ী থেকে।

    যাই হোক এ তো গেল বিয়ের দুই নম্বর পদ্ধতির বিবরণ। আবার ফিরে যাই বিবাহের পূর্বে পিত্রালয়ে নানান অনুষ্ঠান নিয়ম পূজা-আর্চার পর বিয়ের কনেকে পূর্বকথিত পদ্ধতি অনুসারে বিয়ের দুই দিন আগে রওনা করে দেওয়ার বিবরণে। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি শুরু হল বিবাহ সম্বন্ধে নানা রকম ক্রিয়াকাণ্ড।

    দেশীয় পদ্ধতিতে নিয়ম ছিল, লগ্নস্থির, আর্শীবাদের পর পাত্রপক্ষের মঙ্গলকার্য নির্বাহের পর বার্তা আসবে কনের বাড়ীতে যে এবার আপনারাও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হন। যাই হোক তো পাত্র পক্ষের সংবাদ পেয়ে, পঞ্জিকা মতে বারবেলা কালবেলা বেছে শুভদিনে শুভক্ষণে দেওয়া হল পান খিলি। এতে দেওয়া হত মস্ত বড় একখানা বাঁশের বোনা ডালায় করে পান, সুপুরি, ছোট্ট বাটি করে চুন, মিষ্টি দ্রব্য (বাতাসা), বাটি করে সরষের তেল, আর সিঁদুরের বাটিতে সিঁদূর (তেল দিয়ে গোলা)।

    উঠানের আলপনায় জলঘট বসিয়ে সামনে একটি পাঁচ-পলতের প্রদীপ রেখে পিঁড়িতে কনেকে বসিয়ে পাঁচজন এয়ো মিলে উলু দিয়ে ডালাসুদ্ধ পানসুপুরি বাইরে এনে কনের কপালে ছোঁয়ানোর পর নিমন্ত্রণ বিষয়ক নানারকম গীতের সঙ্গে প্রথমে পাঁচখান পানে খড়কের সাহায্যে খিলি করা হত। এরপর নিষ্ঠাভরে পান, চুন, মিষ্টি, সিঁদূর, তেল তুলে রেখে আসা হত দেবগৃহে। সেই হল প্রথমে দেবতাদের নিমন্ত্রণ।

    এই নিমন্ত্রিত দেবতাদের গীতের মাধ্যমে আহ্বান করা হত। তা ছিল এইরকম।

    তোরা সবে আসি পুরবাসী করো মঙ্গলাচরণ
    চল যাই মা দুর্গার ভবন
    মায়ের সোনার বরণ
    সিংহ রথ বাহন
    নারায়ণকে সঙ্গে লইয়া করলেন আগমন
    মায়ের সোনার বরণ পেঁচা রথ বাহন
    শঙ্খ ঘন্টা বাজাইয়া করলেন আগমন
    মায়ের সোনার বরণ
    > মকর রথ বাহন
    শঙ্খ ঘন্টা বাজাইয়া করলেন আগমন।

    পাড়া বা গ্রামের নিমন্ত্রিত এয়োগণ একত্রিত হয়ে এইভাবে গাওয়া হত বিবাহ বিষয়ক নানারকম গীত। আর এই এয়োগনকে আপ্যায়িত করা হতো পানসুপারি দিয়ে।

    এয়োদের সম্মিলিত গীতে থাকত বেশিরভাগ কৈলাস ভবনে শিব দূর্গার বিয়ের বিবরণ আর অযোধ্যা অথবা মিথিলার জনকপুরীর রাম সীতার বিয়ের বিবরণ সম্বলীত গীতি।

    আবার বিবাহের দিন বিগত পূর্বপুরুষদের আভ্যুদয়িক দ্বারা জানানো হতো প্রার্থনা। তখন এয়োরাও বসত তাদের গীতের আসর জমিয়ে। তাতেও ঐ আভ্যুদায়িক বিষয়ক গীত হতো যেমন--

    শ্রী হরিস্বরী
    প্রাতঃস্নান করি
    আভ্যুদিকে বসিলেন রাজন
    অয্যোধ্যধীকারি পট্ট বস্ত্র পরি
    পূর্ব মুখে বসিলেন রাজন
    হরতকী, বদরী, বস্ত্র আর দধি।
    কুশ হস্তে বসিলেন রাজন
    > কুশ হস্তে বসিলেন রাজন
    কুশ হস্তে বসিলেন রাজন
    ইত্যাদি ইত্যাদি।

    বাংলা দেশে, বিবাহের সময় আর এক নিয়ম ছিল জল ভরা। এই জল ভরা ব্যাপারটা মহিলা বা ছোট বড় মেয়েদের এক আনন্দের ব্যাপার ছিল।

    তবে বিশাল এয়োবাহিনীর দলবদ্ধ জল ভরার গীত চলাকালে বিপদও হত অনেক সময়। বিভিন্ন ধরনের চামর বাদ্যের সাথে রকমারী কাঁসি বাঁশীর শব্দে আকাশবাতাস কাঁপিয়ে জলে নেমে দলবদ্ধ জলঘট ভরার সময় ছোট ছোট বাচ্চাদের কখনও সখনও যে সলিল সমাধি হতো সেই মূহূর্তে কেউ খোঁজ রাখত না। এ ঘটনা কোথাও কখনও ঘটেছে তবে ইহা দৈবাৎ অসতর্কতা হেতু। যাক সে-সব কথা। এই জল ভরায় গাওয়া হতো যে সব গান সে সব গান ছিল রাধাকৃষ্ণ আর যমুনা বিষয়ক গান। যেমন-

    প্রথম--

    আর যাব না জল আনিতে
    কদম তলায় দাঁড়ায়ে কালা।

    দ্বিতীয়--

    সখি আজ অবেলায়
    কলসি নিয়ে জলকে যাব কেমন করে
    পথের মাঝে দাঁড়িয়ে কালা
    তার গলে দোলে বনফুলের মালা
    অধরে তার মুচকি হাসি ইশারাতে ডাকলে মোরে
    আজ অবেলায়...

    তৃতীয়--

    নিদারুণ শ্যাম তোর লাগি জলে আসিলাম
    সন্ধে হলো নদীর কূলে
    পথ চেয়ে রইলাম ভুলে
    আমি একা বসে নয়নজলে
    মালা গাঁথিলাম বন্ধু নিদারুণ শ্যাম
    ইত্যাদি ইত্যাদি।

    আমার বিয়ের দুদিন আগে বিবাহের মঙ্গলার্থে হয়েছিল কালীপূজা। আচার্য ঠাকুর সকাল থেকে এসে মূর্তি তৈরী করলেন। রক্ষাকালী মূর্তি আবার দিনের তৈরী মূর্তিতে পূজা হত রাতে। বাড়ীতে শেষ কাজ, মেজদার নির্দেশে যে ক’জনা খেলার সাথী অবশিষ্ট আছে, আনন্দ করার জন্য কালীপূজার রাতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলাম। একদিকে পূজা হচ্ছে আর আমরা সাথীরা মিলে সীমার মধ্যে থেকে পুনরায় বাঁধনহারা উচ্ছলতায় প্রবৃত্ত হলাম।

    অন্ধকার রাতে কালো আকাশ ভর্তি অগুণতি রূপোলী তারার আলোয় এ-বাড়ী ও-বাড়ীর বাহির উঠানে বেরিয়ে গল্পের জোয়ার বইয়ে খানিক হাসিকান্নায় কাটালাম।

    সে রাতের কথা আমি জীবনেও ভুলিনি। আমার ভাষাহীন এক অব্যক্ত চেতনা নিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছিলাম নিস্তব্ধ গ্রামের নিকষ অন্ধকারে কালো আকাশের বুকে ঝকঝকে রূপোলী তারারা যেন গাঢ় বেগুনী বেনারসীর রূপালী বুটির আঁচলের শামিয়ানার তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। কী অদ্ভুত ছিল সে-দিনের সে-আকাশের রূপ!

    সে-রূপ জীবনে দ্বিতীয়বার চোখে পড়েছে বলে আর মনে পড়ে না। অথবা হয়ত সেই মন্ত্রমুগ্ধকারী রূপ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার মত মানসিকতার যবনিকা সেই রাতেই টেনে দিয়ে জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেছিলাম।

    কালীপূজার পরদিন সকাল থেকেই সব কাজকর্মে ব্যস্ত। বিয়ে পরশু, আগামীকাল তেলকাপড়। অতএব আজ সব আচার নিয়ম সেরে কনে নিয়ে রওনা দিতে হবে। বেলা এক প্রহর মা আর কাকিমা চলল পরসীদের ঘরে ঘরে সোহাগ সাধিতে। এই সোহাগ সাধার (মাগার) চিত্রটা এইরকমঃ

    কনের মায়ের পরনে একখানা ভাল শাড়ী। হয় বেনারসী, নয়তো বোম্বাই নয়তো পার্শি। তখনকার মতে এইসব শাড়ী ছিল শুদ্ধ এবং উৎকৃষ্ট। মায়ের শাড়ীর আঁচলে ঢাকা কুলো। তাতে খুব ছোট ছোট সরায় হলুদের কুঁচি, আদা, রাঁধুনী, চাল, সিঁদুর ইত্যাদি সাতরকম জিনিস। মাথায় শাড়ির আঁচল-ঢাকা কুলো নিয়ে মা আগে আর পিছনে শাড়ীর আঁচলে আঁচলে গিঁট দেওয়া কাকিমার কাঁখে আমসরা দিয়ে মুখঢাকা জলঘট। পিছনে বাচ্চা, জোয়ান, বৃদ্ধার দল।

    খানিক বাদে গীত-জোকাররত সেই বিরাট বাহিনীর সোহাগ মাগা সমাপ্ত। কুলো মাথায় মা কাকিমা ফিরে এলেন বাড়ী। পালকি এল উঠানে, আমার স্নান-খাওয়া সাজগোজ তৈরী। ঘরের দুয়ারে জলঘট সামনে রেখে আমাকে বসিয়ে আমার বাবা যাত্রার মন্ত্র পড়াচ্ছেন। মন্ত্র পড়াতে গিয়ে আমার বাবাকে দেখছি বার বার গলার আওয়াজ রুদ্ধ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। বাবাকে এত বিচলিত হতে কোনদিন দেখিনি।


    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)