• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | রম্যরচনা
    Share
  • দেশান্তরের কথা : সন্ধ্যা ভট্টাচার্য


    মাদের দেশে একটি নিয়ম ছিল, মেয়ে যখন বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়, তখন বয়সে ছোট কেউ একজন একটি ছোট্ট পাথরের থালায় করে জল এনে পালকির কাছে রাখবে আর শ্বশুরবাড়ি-যাত্রী মেয়েটির পা এই পাথরের জলে ধুয়ে ছোটরা কেউ তা মুছে দেবে। তারপর মেয়ে পালকি চেপে রওনা দেবে। পাথর-সুদ্ধ সেই পা-ধোয়া জল রেখে দেওয়া হবে ঘরের এক কোণে। ইহা নাকি পুরানো লোককথায় কথিত আছে যে মেয়ে উমা পিত্রালয় থেকে শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সময় মা মেনকার নির্দেশে উমার পুনরাগমনের আশায় পা ধুইয়ে রেখে বলেছিলেন, “আবার এসো।” এই নিয়মকে কেন্দ্র করে একটি প্রচলিত গানের কলি উদ্ধৃত করছি। যেমন--

    চরণের ছায়া রেখে যাও ঘরে
    আসিও মা তুমি বরষের পরে
    ভুলো না ভুলো না শারদ প্রতিমা
    মনে রেখো মাগো দুঃখহরা।
    আগেই উল্লেখ করেছি আমার বিয়ে ইংরাজি ১৯৪৫ আর বাংলা ১৩৫২ সালের মার্চে। বিয়ের অলঙ্কার যা কিছু, তার কিছু অংশ আসবে কলকাতা থেকে কারণ আমার ছোড়দা তখন খিদিরপুর ডকে কর্মরত। সমুদায় অলঙ্কারের কিছু অংশ সেখান থেকে তৈরি করে নিয়ে আসবেন বলে প্রতিশ্রুত। উপযুক্ত সময় যখন এগিয়ে এল তখন হল কলকাতায় সর্বাত্মক হরতাল। তখন এই হরতালের তাৎপর্য বোঝার মতো কোন জ্ঞান আমাদের ছিল না। বার্ধক্যে পৌঁছে জানতে পারলাম আজাদ হিন্দ ফৌজের সুবিচারের দাবিতে নাকি হয়েছিল এই হরতাল। যাই হোক শেষকালে অলঙ্কার নিয়ে ছোড়দা এসে পৌঁছেছিলেন বটে তবে হরতাল কবলিত অস্থির কলকাতায় অনিয়মিত কাজকর্মের দরুন নির্দিষ্ট সময়ে আসতে পারলেন না। কলকাতায় এক বন্ধুভাবাপন্ন কারিগরের দক্ষ হাতে তৈরি অলঙ্কার এসে পৌঁছলো বিয়ে বাড়িতে রাত দশটায়।

    যাই হোক, আমাকে নিয়ে বিয়ের দু’দিন আগে মেজদা এবং আরো দুজন সঙ্গে মালপত্র নিয়ে বেলা দ্বিপ্রহরে রওনা দিলেন স্টেশান অভিমুখে। বেহারাগণ পালকি নিয়ে দ্রুততালে রওনা দিল।

    গ্রামের রাস্তা ছাড়িয়ে সোজা পূর্বদিকের রাস্তার একপাশে পূর্বকথিত সেই ডোবা (পগার), ছোটবেলায় পুতুল সিদ্ধেশ্বরীকে কোলে নিয়ে লাল গাইয়ের গুঁতায় গড়িয়ে পড়ে গেছিলাম যে পগারের তলায়। এই পগারের পাশ দিয়ে রাস্তা সোজা কিছুদূর পর্যন্ত গিয়ে বাঁয়ে বাঁক ঘুরল। এই বাঁকের পাশে ধানক্ষেতের পাশ ঘেঁষে উচু রাস্তা। এই রাস্তার উপরেই ছিল বিরাট আকারের একটি আমগাছ। মুকুলে বিভূষিত গাছটির তলা দিয়ে পালকি যাচ্ছে। আমের গুটি (করা) থেকে শুরু করে কাঁচা, পাকা, সব অবস্থাতেই সেই গাছের তলায় একদা আমাদের থাকত সর্বক্ষণের উপস্থিতি।

    ক্রমে পালকি গিয়ে পৌঁছল বড় সড়কে। বেহারাগণ দ্রুততালে রাস্তার ধূলা উড়িয়ে চলল। পালকির দরজা একটু ফাঁক করে জল ভরা চোখে তাকিয়ে দেখছি, দূরে, স্বপ্নের মায়াপুরী আমাদের গ্রামটিকে। তাকে আজ আমি চিরদিনের মত পর করে চলে যাচ্ছি। ফেলে যাচ্ছি চিরমধুর অনেক স্মৃতিচিহ্ন। রাস্তাঘাট, গাছপালা, মাঠ, গোপাট, আখের ক্ষেত, সবই পিছন থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। একে একে দেখছি আর মনে পড়ছে পিছনে ফেলে যাওয়া এক একটি মজার ঘটনার কথা।

    পথে পড়ল একটা আখের ক্ষেত। গ্রামের প্রান্তে। চারধারে পাটকাঠির ঘন বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত ছিল সেই আখ ক্ষেত। একবার আমি, বিমলা, ঊষা, কল্যাণী, জ্যোৎস্না, আর সাফি (একটি মুসলিম মেয়ে) মিলে কিভাবে সেই আখ ক্ষেতে ঢুকে আখ ছিঁড়ে এনেছিলাম, সেই দস্যিপনার কথা মনে পড়ে গেল। বর্ষার জলে অনবরত ভিজে কমজোর হয়ে যাওয়া পাটকাঠির বেড়া ভেঙে আখ ক্ষেতে ঢুকেছিলাম আমরা, আর ইচ্ছামত আখ ভেঙে নিয়ে নিরাপদেই পালিয়েছিলাম। তখন অবশ্য আমাদের সকলেরই বয়স ছিল নয় কি দশ।

    আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে একটি রাস্তা সোজা গিয়ে মিলেছিল দূরদূরান্তে যাতায়াতের সরকারি সড়কে। গ্রাম থেকে বেরোনোর রাস্তা আর সরকারি সড়কের সংযোগস্থল থেকে অল্প দূরে মেঠো পথের পাশে ছিল এক বিশাল বটগাছ। শ্রান্ত পথিক, হাটুরে আর রাখাল ছেলেরা ছাড়া গোপাটে চরে খাওয়া অগুনতি গরু-ছাগলের বিশ্রামস্থল ছিল সেই বটের ছায়া। অগুনতি শাখা-প্রশাখা ছড়ানো এই ছায়াময় বুড়ো বট ছিল শ্রান্তি অপনোদনের জায়গা। সেকালের পালকির দুপাশের দেওয়ালে থাকত জানালার মত ছোট ছোট খুপরি। যাত্রাপথে আমি পালকির ভেতর থেকে সেই খুপরির মতো জানালা দিয়ে তাকিয়েছিলাম ফেলে আসা পথের দিকে; একসময় ছায়াময় সেই বুড়ো বটকে পিছনে ফেলে রেখে পালকি বাঁক নিল উত্তরদিকে।

    হঠাৎ দূরে নজরে পড়লো আমার বৃদ্ধ বাবাকে। ক্রমশ দূরে চলে যাওয়া পালকির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, শ্রান্ত, অবসন্ন, রিক্ততায় ভারাক্রান্ত মনে বটের ছায়াতে দাঁড়িয়ে আছেন আমার ষাটোর্দ্ধ বাবা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে, নিজের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, সেই কারণে ভারাক্রান্ত মনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর বিষণ্ণ চেহারাটা দেখামাত্র মনটা পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মতো ছট্‌ফটিয়ে উঠল। বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন যেন মহর্ষি কণ্ব। দীর্ঘদেহী, সৌম্যকান্তি, পুণ্যদীপ্তিতে দীপ্তিমান আমার বাবা যেন কন্যা বিদায়ে ভারাক্রান্তমন এক ঋষি। সে-দৃশ্য দেখে আমার চোখ আবার জলে ভরে গেল। দ্রুত বেগে পালকি অদৃশ্য হল, সঙ্গে অদৃশ্য হল আশৈশব আমার চেনা পরিবেশ। বাধ্য হয়ে, কান্না থামিয়ে চুপ করে বসলাম।

    সে সময়ে যানবাহনের অপ্রতুলতা, বহুদূরের গ্রাম থেকে বর ও বরযাত্রী আনয়নের অসুবিধা, বা খরচ বহনের অক্ষমতা, আবার কখনো বরপক্ষের ইচ্ছাক্রমে, গ্রামে ‘তুলে বিয়ে’ (বাঙাল ভাষায় ‘তুইল্যা বিয়া’) দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। এক্ষেত্রে পাত্রীকে বিয়ের দু-এক দিন আগে, শুভদিন দেখে নিজের বাড়ি থেকে বিবাহসামগ্রীসহ পাত্রের গ্রামের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হত। গ্রামের কাছাকাছি কোন আত্মীয় বা আত্মীয়সম কোন পরিবারে পাত্রীর থাকার ব্যবস্থা হত। সঙ্গে পাত্রীর দাদা বা মামাস্থানীয় কেউ কেউ বিবাহসামগ্রী নিয়ে আলাদা সেই বাড়িতে পৌঁছে যেতেন বিয়ের আগের দিন। পরদিন সেই বাড়ির মেয়ে বউরাই সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করে, নিজের বাড়ির মেয়ের মতই পাত্রীকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করে দিত। সে বিষয়ে কোনো কার্পণ্য তারা করতেন না। এমন বিয়ে তখনকার বাংলাদেশে অহরহই হত। তাছাড়া, আমার বিয়ের সময়টি ভারত ভাগের ঠিক দুবছর আগে, সেকথা আগেই বলেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অবস্থা তখন খুব ভালো নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দেশের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। বিবাহযোগ্যা কন্যাদের নিয়ে পরিবারের চিন্তার অন্ত নেই। অনূঢ়া কন্যা, অল্পবয়সী বউদের নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম রক্ষার চিন্তায় বাড়ির পুরুষেরা সদাই বিষন্ন। এমন সময় পাত্রপক্ষের ইচ্ছেমতই পাত্রীপক্ষের চলতে হত। নির্বিঘ্নে কন্যাকে পাত্রস্থ করে গুরুভার নামাতে বাধ্য হতেন তারা।

    আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে বেরোবার অনেকক্ষণ পরে, পরিশ্রান্ত বেহারারা একটু বিশ্রাম নেবার জন্য পালকি নামাল পথের ধারে এক অশ্বত্থ গাছের তলায়। বেহারারা মাথায় বাধা বিড়ে পাকানো কাপড়টি খুলে রেখে, কাঁধের গামছাটি মাটিতে বিছিয়ে একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল। গাছের হাওয়ায় শীতল করে নিচ্ছিল নিজেদের শরীর। আমি পালকির মধ্যে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর পালকির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, যেখানে পালকি নামিয়েছে সে জায়গাটা আমার বিশেষ পরিচিত, জায়গাটির নাম ‘পুরানো বাজার।’ বহুকাল আগে গ্রামবাসীদের জিনিসপত্র কেনাবেচার কোন নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। তখন আশপাশের গ্রামের লোক তাদের উৎপন্ন জিনিসপত্র বেচাকেনার জন্য এই অশ্বত্থের তলায় বসত। ক্রমে তা একটি ছোট্ট বাজার হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে সরকারি তত্ত্বাবধানে অন্যত্র এক নির্দিষ্ট জায়গায় নতুন বাজার বসানো হয়, ক্রমে লোকমুখে এই জায়গাটার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘পুরনো বাজার।’

    পালকির দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখতে লাগলাম জায়গাটা। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল এখানে।

    তখন আমার এক দিদির সবে বিয়ে হয়েছে। ‘সোয়ারী’ করে সে যাবে শ্বশুরবাড়ি। পালকির থেকে সোয়ারী ছিল একটু আলাদা। চারদিক ফাঁকা কাঠের কাঠামোর চারদিকে কাপড়ের ঘেরা দেওয়া হত, আর সেই ঘেরাটোপের মধ্যে বসত কনেবউ। দিদির বিয়ের পরদিন বাড়ির উঠোনে সোয়ারী এসেছে, বেহারারা সোয়ারীর চারধার কাপড় দিয়ে ঢাকা দিচ্ছে। পাড়ার গিন্নিবান্নিরা, বয়স্ক গুরুজন স্থানীয় বৃদ্ধরা, আর ছোটছোট ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছে ‘কনেবিদায়’ দেখতে। বাড়ির মেয়েরা, মা-খুড়িমারা যথারীতি কান্নাকাটি শুরু করেছেন। তবে তাঁদের কান্না আওয়াজ করে নয়, সবাই হাতে কাজ করছেন আর কাপড়ের আঁচলে অনবরত চোখনাক মুছছেন। দিদির তো কথাই নেই, ‘ও মা আমি যাব না, যাব না’ বলে গলা ছেড়ে কান্না জুড়েছে। দিদির কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করেছি। আমার সঙ্গীসাথীরা যারা এসে জড়ো হয়েছিল সবাই আমার কান্নায় যোগ দিয়েছে। সে এক মজার ব্যাপার।

    কনে ঘর থেকে বেরিয়ে সোয়ারীতে বসলে, সোয়ারী কাঁধে নিয়ে বেহারারা চলতে শুরু করল। বেহারারা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে অল্প সময়ে বড় সড়কে পৌঁছুবার জন্য গ্রামের মাঠের কোনাকুনি পথ ধরে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। আমিও ক্রন্দনরত সাথীদের নিয়ে সোয়ারীকে অনুসরণ করলাম।

    সেকালে আমরা ছোট মেয়েরা পরতাম শুধু একখানা শাড়ি, আর ছেলেরা পরত ছোট ধুতি আর পিরান। আমরা মেয়েরা পরনের শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে, সমবেতভাবে হু হু আওয়াজে কাঁদতে কাঁদতে চললাম সোয়ারীর পিছন পিছন। যেতে যেতে গ্রাম ছাড়িয়ে পৌঁছে গেলাম বড় সড়কে। কান্নার বিরাম নেই। যদি কেউ অন্যমনস্কতা হেতু কান্না থামিয়ে ফেলেছে তৎক্ষণাৎ অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে এখনও কার কান্নার বেগ কতটুকু চলছে; দেখে নিয়ে ফের হু হু আওয়াজ শুরু করছে। এই করতে করতে আমরা গ্রাম ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে গেছি, তাই দেখে আমার দিদি তখন নিজের কান্না থামিয়ে দিতে বাধ্য হল। আমাদের বিপদের আশঙ্কা করে কনে বউ আমার দিদি, সোয়ারীর কাপড় উঁচু করে ঘোমটা-পরা মাথাটি বের করে গলা ছেড়ে আমাদের ফিরে যেতে বলতে লাগল। আমরা কি আর এত সহজে ফিরি এমন একটা মজার খেলা ফেলে! আমরা চলতেই থাকলাম।

    এই করতে করতে সোয়ারী গিয়ে পৌঁছেছিল এই পুরানো বাজারের অশ্বত্থতলায়। বিকেলবেলায় আমরা বাড়ি থেকে এতদূরে এসে গেছি, কিছুতেই ফিরছি না দেখে দিদির বেহারাদের বলল আমাদের গ্রামের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। দিদির কথায় বেহারারা অশ্বত্থের তলায় সোয়ারী নামিয়ে রেখে আমাদের দিকে ফিরল। তারপর তাদের নিত্যসঙ্গী লম্বা বাঁশের লাঠিগুলো উঁচিয়ে যমদূতের মত ছুটে আসতে লাগল। তাড়া খেয়ে আমরা দে দৌড়। সমবেত দৌড়ে রাস্তার ধুলোয় চতুর্দিক অন্ধকার। আমরা সবাই একসাথে প্রাণপণে ছুটছি আর পিছন ফিরে এক একবার তাকিয়ে দেখছি বেহারারা ছুটে আসছে। আমাদের চোখে তাদের চেহারা তখন যমদূতের মতো, নেড়া মাথায় এক গোছা টিকি বাতাসে উড়ছে। পরনে খাটো ধুতি, গলায় পেঁচানো গামছা, মাথায় পাগড়ি, হাতে বিশাল এক লাঠি। এ-হেন ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ভয়ের ঠেলায় দৌড়োতে দৌড়োতে এসে পৌঁছলাম গ্রামের সীমানায়। বেহারারা আমাদের তাড়া করে গ্রামের সীমানায় তুলে দিয়ে ফিরে গেল। তখন সন্ধে হয় হয়, যে যার বাড়ি গেল। আমিও বিষণ্ণবদনে বাড়ি ফিরলাম।

    এবার আরো একবার ফিরে যাই নিজের বিয়ের বিবরণে। বিয়ের কনেকে পালকি করে পৌঁছে দেওয়া হল স্টেশনে। সেখান থেকে রেলগাড়ি চেপে গিয়ে পৌঁছোলাম শ্বশুরবাড়ির স্টেশনে। সেখানে পাত্রীপক্ষের লোকজন আর কনেকে এগিয়ে নেওয়ার লোক মোতায়েন ছিল। স্টেশন থেকে আবার পালকি চেপে গিয়ে পৌঁছোলাম আমার ভাবি শ্বশুরমহাশয়ের এক শিষ্যের বাড়িতে। মেজদার কাছে জানলাম রাত তখন আটটা। আমার ভাবী মেজ ননদ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে, কনের জন্য অপেক্ষা করছিল ঐ শিষ্যবাড়িতে। সেই রাতটা সে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার সঙ্গেই রয়ে গেল শিষ্যবাড়িতে। পরদিন সকালে আবার রওনা দিলাম আমরা। পথে আমাকে নির্দিষ্ট করা বিয়েবাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমার ননদ ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল তার বাপের বাড়ি অর্থাৎ আমার ভাবী শ্বশুরবাড়িতে।

    শ্বশুরবাড়ির প্রায় কাছে এসে গেছি। (তাই তখনো বিয়ে না হলেও) গ্রামদেশের নিয়ম অনুযায়ী মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে, মুখ ঢেকে নামতে হল পালকি থেকে। অসহ্য ব্যাপার। লম্বা ঘোমটার জন্য চোখে তো দেখতে পাচ্ছি না। সে-বাড়ির একটি মেয়ে এসে আমাকে হাত ধরে নামিয়ে নিয়ে গেল। মনে ভাবলাম বাঁচালে ঠাকুর, নয়ত ঘোমটার ঠেলায় কোথায় পড়ে যেতাম!

    সে-বাড়ির দু’জন গিন্নিই ছিলেন অতিশয় সদাচারী। তাঁদের কর্তব্যজ্ঞান দেখে কনেপক্ষ মুগ্ধ হল। যথাসময়ে যথাবিহিত নিয়ম অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বিবাহকার্য শেষ হল। আমাকে সম্প্রদান করেছিলেন আমার মেজদা। সম্প্রদান হয়ে যাবার পরে, আমার মেজদা সেই যে বিয়েবাড়ির কাছারি ঘরে গিয়ে শুলেন, সে রাতে আর উঠলেনও না, কিছু খেলেনও না। সারারাত কেঁদে কাটালেন।

    পরদিন সকালবেলা ভিতরবাড়ির উঠানে পালকি এল। মেজদা সকাল থেকে আমার কাছে বসে রইলেন, আর সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমার মেজদা খুবই মেধাবী ও অত্যন্ত দূরদর্শী লোক ছিলেন। মেজদা ময়মনসিংহ শহরের আনন্দমোহন কলেজে পড়তেন। সেখানে ছাত্রাবস্থায় একবার ‘অস্পৃশ্যতা বর্জন’ বিষয়ে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন (সন তারিখ আমার জানা নেই)। জ্ঞান হয়ে মায়ের একটি কাঠের বাক্সে বরাবর দেখেছি মেজদার পুরস্কার পাওয়া সেই পদকটি।

    যাই হোক, আমার বিয়ের পর থেকে মেজদার এই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাবান্তরের কারণ তখন বুঝতে পারিনি। সামনেই দেশের মানুষের যে ঘোরতর বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে, সে বিষয়ে আমার দুই দাদাই ভালরকম ওয়াকিবহাল ছিলেন। কন্যাদায় থেকে মুক্ত হলেও, বাংলাদেশে নিজেদের গ্রামের সাতপুরুষের জন্মভিটেতেও যে বয়স্থা মেয়েবউদের নিয়ে নিশ্চিন্তে আর বেশিদিন থাকা যাবে না সেকথা মেজদা ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। তাই মেজদার ঘনঘন চিঠি আসত আমার শ্বশুরমশায়ের কাছে।

    পত্রের তাগাদায় আর ঘনঘন আমার শ্বশুরমশায়ের সাথে আলাপ আলোচনায় বুঝতে পারতাম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কি তা তখন বুঝিনি। আমার এদেশে আসার কিছুদিন পর থেকেই, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আর দেশভাগের পরই সত্যটা উপলব্ধি করলাম। দেশছাড়া ছিন্নমূল শত শত পরিবারের নৈহাটি চলে আসা দেখে আমি মেজদার সেদিনের চিন্তার কারণটা বুঝেছিলাম। সে কথায় পরে আসছি।

    যাই হোক, বিয়ের পরদিন ভিতর বাড়িতে পালকিতে চাপলাম। আমি আর আমার একটি বছর তিনেকের ছোট্ট দেওর। বর উঠলেন বাহির বাড়ির উঠানের পালকিতে। দাদার সঙ্গে সেই পালকিতে উঠল আমার মেজননদ। অন্যান্য ছেলে বুড়ো আর পুরুষরা চলে গেছে পায়ে হেঁটেই। পালকি চলল শ্বশুরবাড়ির পথে। আমার সঙ্গে থাকা ছোট্ট ছেলেটি দীর্ঘ সময় পালকিতে বসে থাকার দরুন, পরনের প্যাণ্টুলখানা ভিজিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছিল না। অসুবিধার দরুন শিশুটি অনবরত উসখুস করছে দেখে আমি তাকে ভিজে প্যান্টুলটা খুলে বসতে বললাম। অবোধ শিশু বিনাদ্বিধায় প্যাণ্টুলটি খুলে গায়ের লম্বা শার্টটি টেনেটুনে বসল।

    দীর্ঘ সময় পরে পালকি থামল বুঝতে পারলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম বেহারারা তাদের কাঁধ পাল্টাতে পালকি নামিয়েছে একটি সর্ষেক্ষেতের মাঝখান দিয়ে চলা সরু দুপেয়ে রাস্তায়।

    পালকির দু’দিকেই ক্ষেত ভরে ফুটে আছে বাসন্তী রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। লোভ সামলানো গেল না। বেহারাদের চোখ এড়িয়ে, পালকির দরজা সামান্য ফাঁক করে সেখান দিয়ে টেনে টেনে সর্ষে ফুল ছিঁড়লাম ছোট্ট দেওর আর বৌদি, দুজনেই। এখন এই ফুল রাখার সমস্যা দেখে সমাধান আমার ছোট্ট দেওরটিই করে নিল। বাড়ির কাছাকাছি পালকি এসে গেছে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে শার্টখানি উল্টে কোঁচড় তৈরি করে তাতে সরষে ফুলগুলি তুলে নিল। একহাতে সর্ষেফুল ভর্তি কোঁচড় ধরে আর এক হাতে নতুন বউ এর হাতে ধরে পালকি থেকে নামল সে। তাকে দেখে তখন বাড়িসুদ্ধ লোকের কি হাসাহাসি, শিশুর কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

    আমোদ-অনুষ্ঠানের মধ্যেই বউভাত বা পাকস্পর্শ সমাপ্ত হল। তখনকার দিনে, বউভাতের বদলে বলা হত পাকস্পর্শ, কারণ সেদিনই প্রথম নতুন বউ শ্বশুরবাড়ির পাকশালায় যাবে, রান্না করা অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করবে গুরুজনদের পাতে। বর্তমান সময়ের মত বউভাতের দিন বউকে রকমারি উপহার সামগ্রী দেওয়ার বিশেষ প্রচলন ছিল না। আত্মীয়স্বজন যাঁরা বিয়েতে আসতেন তাঁদের অধিকাংশই শাড়ি দিয়েই আর্শীবাদ করতেন। তবে সে শাড়ির মান যে সব সময়েই উৎকৃষ্ট হত তা নয়। ক্ষেত্রবিশেষে অলঙ্কারাদিও উপহার সামগ্রীতে স্থান পেত।

    আর পরিবারের অধীনস্থ নিম্নশ্রেণীর নিমন্ত্রিত প্রজারা দিত দর্শনী। নতুন বউকে সাজিয়ে-গুছিয়ে, একগলা ঘোমটায় মুখ ঢেকে বাহির বাড়িও নয় আবার ভিতরের অন্দর মহলেও নয়, মাঝামাঝি কোন একটি ঘরে চারপাইয়ে বসানো হত, কাছাকাছি ননদ, জা প্রমুখ পরিজনরাও বসতেন। বউয়ের সামনে একটি উঁচু কানাওয়ালা থালা রাখা থাকত। নিমন্ত্রিত প্রজারা তাদের সাধ্যানুসারে টাকা, সিকি, আধুলি প্রণামী রেখে দিত সেই থালায়। অনেক সময় থালা ভর্তি হয়ে যেত। বর্তমান সময়ে যেমন উপহার সামগ্রীর পাইপয়সাটিও নববিবাহিতা বউটির দখলে থাকে, তখনকার দিনে এই উপহারের হিসাব বা নজর রাখাটা নববধূর পক্ষে নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল। এই সব প্রাপ্য উপহার সামগ্রী থেকে আত্মীয়াদের কিছু কিছু পাওনা থাকত। গৃহকর্ত্রীর মনের বাঁধন যদি শিথিল হত তাহলে আত্মীয়ারা অনায়াসে নিজেরাই পছন্দমত সেসব ভাগ করে নিয়ে নিত। তবে অবশ্যই অলঙ্কার বাদে।

    এইসব বাঁটোয়ারা হতে থাকা উপহার সামগ্রীর মধ্যে ছিল, সুবাসিত চুলের তেলের বোতল (অজন্তা), সুবাসিত অজন্তা সাবান, মনোহারি আয়না, চিরুনি, স্নো, পাউডার ইত্যাদি। আমার মাথায় প্রচুর চুল ছিল। সে-কথা মাথায় রেখে শেষকালে আমার শ্বশুরমশায় এগিয়ে এলেন গন্ধতেলের বোতল রক্ষা করতে। আড়াই-পোয়া মাপের সুবাসিত অজন্তা তেলের বোতলগুলি এই বাঁটোয়ারার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি, যেগুলি আমি পরে অনেকদিন ধরে ব্যবহার করেছি।

    যাই হোক বউভাতের পর দিন আমার শ্বশুরমশায় বাড়ির ভিতর ঘরে,একটি ছোট্ট গানের আসর বসানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। বরের একজন গ্রামীণ বন্ধু ছিলেন, তিনি গান-বাজনা জানতেন। ডেকে আনা হল তাঁকে। স্বজনবেষ্টিত হয়ে বসে, এক গলা ঘোমটায় মুখ ঢেকে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইলাম। আমায় আর্শীবাদ করতে গিয়ে আমার শ্বশুরমশায় আমার গান শুনে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাছাড়া আমার শ্বশুরমশায়েরও গানের গলা ছিল। গান-বাজনা ভালোবাসতেন। আমার কয়েকটি গান শোনার পর আমার শ্বশুরমশায় আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন। হাত থেকে তামাকের নল নামিয়ে রেখে নিজেও হারমোনিয়াম বাজিয়ে মধুর সুরে গাইলেন শঙ্করাচার্য রচিত ‘মোহমুদ্গর’ শ্লোকের একটি অংশ। এত সুন্দর আর এত শ্রুতিমধুর ছিল সেই শ্লোকসঙ্গীত, শুনে অবাক হয়েছিলাম। তখন অবশ্য আমি এই শ্লোকের মর্মার্থ কিছুই বুঝিনি কিন্তু মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। অনেক বয়স্ক মহিলাও ছিলেন সেখানে যাঁরা এই শ্লোকের অর্থ বোঝেননি। আসলে আমাদের আগের আগের প্রজন্মের মেয়েদের তো সে-অর্থে শিক্ষার কোন সুযোগই ছিল না। কথ্যভাষাই ছিল ভাবপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম, সংস্কৃত শ্লোকের অর্থ বোঝা তাঁদের পক্ষে সত্যিই অসম্ভব ছিল। তবে হ্যাঁ, শতকরা দু’একজন ব্যতিক্রমও ছিলেন বইকি, যেমন ছিলেন আমার মা।

    তখনকার দিনে স্কুল-কলেজে সংস্কৃতভাষার চর্চাই ছিল প্রধান। ইংরেজ শাসকদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয়ও পড়ানো হত। তবে সেই ব্যবস্থা ছিল কলেজে আর শহরের স্কুলে। গ্রামগঞ্জের স্কুলে ছেলেরা প্রধানত সংস্কৃত মাধ্যমেই লেখাপড়া করত, বিশেষত টোলে।

    আমার বাবা ছিলেন হাইস্কুলে সংস্কৃতের প্রধান শিক্ষক। বাবার কারণেই সংস্কৃত ভাষার চর্চা আমাদের বাড়িতে ভালরকমই ছিল। বাবার সঙ্গে তাঁর ধর্মীয় কাজে অংশ নেওয়ার কারণে, আমার মা সংস্কৃত খানিকটা বুঝতে শিখেছিলেন। সংস্কৃত শব্দার্থ বোঝার মত জ্ঞান আমার মায়ের অনেকটাই হয়েছিল বুঝতাম তাঁর সংস্কৃতে স্তবমালা পাঠ শুনে। সমস্তটাই বাবার পাঠ শুনে শুনে মুখস্ত করেছিলেন মা। পরবর্তীকালে এই ‘মোহমুদ্গর’ শ্লোকাবলী বাংলা অক্ষরে পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। পরিণতবুদ্ধিতে সে-সময় উপলব্ধি করেছিলাম মোহমুদ্গরের তাৎপর্য।

    শ্লোকের কথা এখন থাক। এখন বলি আমার বিয়ের পরবর্তী সময়ের কিছু কথা। আমার বিয়ের তারিখ ছিল ২৫শে ফাল্গুন। অতএব বিয়ের পর নানারকম নিয়ম অনুষ্ঠানে বাকি তিনদিন কাটল। নতুন চাকরিতে ছুটির স্বল্পতা হেতু আমার স্বামী, ২৯শে ফাল্গুন তারিখে রওনা দিলেন কর্মস্থল অভিমুখে, অধুনা পশ্চিমবঙ্গে। পরের মাস চৈত্রমাস, মাস দোষ হেতু একমাস শ্বশুরালয়েই থাকতে হল।

    বৈশাখের প্রথম আমার বাবা আনতে গেলেন আমাকে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সামাজিক পরিবর্তনও দ্রুত হচ্ছিল, সেটা বুঝলাম গ্রামের যান চলাচলের উন্নতি দেখে। বিয়ের আগে তো গ্রামের বাইরে বিশেষ যাইনি, ফলে সে-বিষয়ে বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। বাবার সঙ্গে বাপের বাড়ি আসার সময় দীর্ঘ পথে লক্ষ করলাম অনেক পরিবর্তন। আমাদের গ্রাম থেকে দুই ক্রোশ দূরে স্থাপিত হয়েছিল বাসস্টপ। ফলে এতকাল পালকি সোয়ারী, গোযান, পায়ে হাঁটাই ছিল যাদের স্থানান্তরে যাওয়ার আদি মাধ্যম, তাদের কাছে যন্ত্রচালিত যান এনে দিল দ্রুত যাতায়াতের সুবর্ণ সুযোগ। গ্রামের মানুষের আনন্দ আর ধরে না।

    আগে মহিলাদের পালকি বা সোয়ারীর ঘেরাটোপের আড়ালে বাড়ির বাইরে যেতে হত। প্রকাশ্যে চলাফেরা করা, বাড়ির বাইরে যাওয়া নিন্দনীয় ছিল। বাস চালু হওয়াতে তাদের সে বাধাটা দূর হল। বাসষ্টপ থেকে সরকারি সড়ক দিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছোনোতে আর বাধা ছিল না। নিন্দায়ও ভাটা পড়েছিল, কারণ প্রায় সব বাড়ির বউঝিদেরই কোথাও যেতে বাসে যাতায়াত করতে হচ্ছিল। তবে হ্যাঁ, বিবাহিত বা অবিবাহিত ছোট বড় সব মেয়েদেরই চলাফেরা করতে হত পোষাকের শালীনতা বজায় রেখে। সঙ্গী হিসাবে বা পথপ্রদর্শক হিসাবে একজন পুরুষ সবসময়ই সঙ্গে থাকত।

    যাই হোক, দীর্ঘ একমাস আবদ্ধ থাকার পর পিঞ্জরমুক্ত, শেকলছেঁড়া পাখির মত মুক্ত আনন্দে, উৎসাহে, আবেগে ভরপুর মন নিয়ে পড়ন্ত বেলায় গিয়ে নামলাম গ্রামের বাস স্টপেজে। মাসেককাল পরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলাম, অতীত স্মৃতির সুখ অনুভব করলাম। গ্রীষ্মের সায়াহ্নে, অস্তগামী সূর্যের সোনালী ছটায় উদ্ভাসিত পশ্চিমের আকাশকে অনেক দিন বাদে যেন নতুনভাবে প্রত্যক্ষ করলাম। সড়কের দুই পাশে অন্তহীন ফসলের জমি। চলতে চলতে প্রায় আঁধার হয়ে এল। আলো-আঁধারী সন্ধ্যার আকাশে দু একটি তারার মিট্‌মিটে উপস্থিতি। কদাচিৎ দু-একটি ঘরে ফেরা মানুষের যাতায়াত। গ্রীষ্মের সন্ধ্যার ফুরফুরে বাতাসকে সাথী করে চলছি আমি, বাবার পিছন পিছন।

    বড় সড়ক থেকে নেমে গ্রামে ঢোকার মুখে পড়ল সেই শান-বাঁধানো পুকুর। যাকে আমরা ছোটবেলায় বলতাম ‘বান্ধাঘাট’। এই শান বাঁধানো পুকুরে ঢোকার মুখে দুপাশে ছিল দুটো মস্ত উঁচু পিলার। পিলারের মাথায় বসানো ছিল দুটো টব, তাতে লাগানো মালঞ্চের ঝুলে পড়া অগুনতি লতানো ডালগুলি ছোট ছোট লাল ফুলে বিভূষিত হয়ে থাকত। দুই পিলারের সঙ্গে যুক্ত দুই দিকে ছিল শানবাঁধানো বসার জায়গা। মুখোমুখি জনাপঞ্চাশ লোক হেলান দিয়ে আরামে বসতে পারত।

    বসার জায়গার মাঝখানে ছিল একটি ছোট্ট চাতাল। স্নানার্থীরা এই দুই পিলারের মাঝখান দিয়ে ঢুকে চাতাল দিয়ে সোজা নেমে যেত জলমগ্ন সিঁড়িতে। পিলারের বাইরে অর্থাৎ রাস্তার দিকে দুই পিলারের লাগোয়া ছিল দুটো বিলাতি তালের গাছ। জ্ঞান হয়ে থেকে এই তালগাছকে একই অবস্থায়ই দেখেছি। এর থেকে বড় হতে দেখিনি কোনদিন। তালের এই ঝাঁকড়া পাতার নীচে আর শান-বাঁধানো চেয়ারের নীচের ফাঁকা জায়গা ছিল আমাদের লুকোচুরি খেলার অতি উত্তম স্থান।

    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments