• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • স্বাধীনতা-উত্তর কোচবিহারের কবিতাঃ বিষয় ও শৈলীর অভিমুখ : দেবায়ন চৌধুরী


    বাংলা কবিতার ইতিহাসে রাজন্যশাসিত কোচবিহারের বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য হতে পারেন কবি মাধবকন্দলী। দুর্গাবরের বাংলা রামায়ণ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। মহারাজা নরনারায়ণের রাজত্বকালে ষোড়শ শতাব্দীর কবি রামসরস্বতীর কথা পাই যিনি সংস্কৃত মহাভারতের সবগুলি পর্ব অনুবাদ করেছিলেন। দ্বিজ হৃদানন্দের চৈতন্যজীবনীকাব্য থেকে পৃথক চরিতসাহিত্য ধারার খোঁজ পাওয়া সম্ভব। মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ ও তাঁর পুত্র শিবেন্দ্রনারায়ণ গান রচনা করেছিলেন। শিবেন্দ্রনারায়ণের পত্নী বৃন্দেশ্বরী দেবীর লেখা ‘বেহারোদন্ত’ বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহিলা কবি দ্বারা লিখিত ইতিহাস। এই আখ্যানকাব্যটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। মহারাণী সুনীতি দেবীর লেখা ‘অমৃতবিন্দু’, নিরুপমা দেবীর লেখা ‘বসন্তমালিকা’, ‘গোধূলী,’ ‘শেষের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থগুলি থেকে আবহমান কালের বাংলা কবিতার কিছু পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।

    কোচবিহারের কবিতা বলতে এই জেলার কবিদের দ্বারা লিখিত কবিতাকেই বোঝাতে চেয়েছি। জানি সাহিত্যকে কোনো নির্দিষ্ট ভূগোলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায় না। তবে এই অঞ্চলে জন্ম ও জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে কবিরা যে নিজস্ব আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে চেয়েছেন এবং পেরেছেন, তাঁদের কবিতার সূত্র ধরে রাজনগরের সেই অনন্য স্বরটিকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না আমাদের। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ‘কোচবিহারের কবিতা’ প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করে। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে কোচবিহার থেকে প্রকাশিত ‘পরিচারিকা’ (নবপর্যায়), ‘কোচবিহার দর্পণ’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় ব্যাপকভাবে কাব্যচর্চা হত। আমরা জানি ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে স্বাধীন করদমিত্র রাজ্য কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। এবছরই প্রকাশিত হয় কোচবিহারের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন—‘অয়ন’। সম্পাদক প্রবোধ চন্দ্র পাল ছিলেন বিশিষ্ট কবি। ষাটের দশকে প্রকাশিত হয় কবি রণজিৎ দেবের সম্পাদনায় ‘ত্রিবৃত্ত’ পত্রিকা। ১৯৭০-র মার্চ মাসে অরুণেশ ঘোষ শুরু করেন ‘জিরাফ’ পত্রিকা। কবি স্বপনকুমার রায় বিভিন্ন সময় প্রকাশ করেন একাধিক পত্রিকা—‘অন্যস্বর’ (১৯৭৯), ‘কবিমেলা’(১৯৮৩), ‘সাগরদীঘি’ (১৯৮৬), ‘জেরোম্যাগ’ (১৯৯০)। এবারে আমরা চলে আসি কবিদের প্রসঙ্গে।

    কোচবিহারের কবিদের আলোচনায় অরুণেশ ঘোষ অগ্রগণ্য। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শব ও সন্ন্যাসী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। ‘গুহা মানুষের গান’ (১৯৮৫), ‘সহজ সন্তান যাঁরা’ (১৯৮৯), ‘দীর্ঘ নীরবতা’ (১৯৯৪), ‘বিপথিক’ (১৯৯৫), ‘কাল কবীরের দোহা’ (২০০২), ‘কবিতা সংগ্রহ’ (২০০৬), ‘পশুরাও অন্তর্লীন হাসে’ (২০০৭) গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি নিজস্ব কাব্যভুবন তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। ১৯৮০ সালে ‘জিরাফ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে অরুণেশ ঘোষ লিখেছিলেন—“আমার কাছে কবিতা এক প্রচণ্ড শক্তি, যা আমার অভিজ্ঞতা—চেতনা থেকে নির্গত হয়ে সমস্ত জগৎকে আক্রমণ করে এবং তাকে বদলাতে চায়।

    "এই পৃথিবীতে যা ঘটে আমার ভিতরেও তাই ঘটে—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আমার ভেতরেও সেই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ফলে আমার মনের তলদেশ উন্মুক্ত করতে পারলেই তার মধ্যেই ধরা পড়বে সত্যগুলি। আমি জগৎ ও জীবনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে থাকতে চাই না—আমি রূপান্তরিত হতে চাই সমগ্র চেতনায় এবং সেই চেতনা জগতে প্রত্যক্ষ করতে চাই জড় ও জীবনের, স্থবিরতা ও গতির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া—এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখাই কবির বিশ্বরূপ দেখা।’’ আর এই বিশ্বরূপ দেখার সূত্রেই উদ্ধৃত করছি তাঁর লেখা একটি কবিতা—

    “নিরাশ্রয় যে তার দিকে তাকিয়ে হাসি
    ‘চল তোকেও সেখানে রেখে আসি
    যেখানে স্বপ্ন, আগুন আর কুয়াশা...’
    আমার সঙ্গী এক ভিখারি বালিকা
    আমার সঙ্গী এক পথের গণিকা
    আমার সঙ্গী এক ব্যর্থ বিপ্লবী
    আমার সঙ্গী জীবন, জীবনের শিখা
    নয় নয় মৃতেরা সঙ্গী নয় আর
    নয় নয় পঙ্গুরা বন্ধু নয় আর
    যার সামনে দাঁড়িয়ে এই স্তব্ধ নমস্কার।’’
    আমাদের মনে পড়তে পারে কবি নিজের কবিতার অভিযাত্রা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সামগ্রিকভাবেই বলেছিলেন—“একজন সৃষ্টিশীল লেখক শুধু আঘাত করাই নয়, সে চায় পাঠক রুচিকে পরিবর্তন করতে, সে চায় নতুনতর ভাষায় তার সময়ের কথা বলতে—যার মধ্যে ধরা থাকবে দূর অতীত থেকে দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত। সমস্ত ভণ্ডামিকে তার অসহ্য মনে হয়, সৃষ্টির জন্যই বহুব্যবহৃত শব্দগুলোকে বর্জন করে নতুন নতুন শব্দ খোঁজে।’’ অরুণেশ ঘোষের কবিতার ভূগোল থেকে কোচবিহারকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তাঁর ‘জীবনানন্দ’ নামক ক্ষীণতনু বইটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। কোচবিহারের অখ্যাত গ্রাম হাওয়ার গাড়ি থেকে কীভাবে অরুণেশ ঘোষ বাংলা-কবিতার মানচিত্রে জায়গা করে নিলেন, তা বিস্ময়কর। তিনি কবিতায় আত্মজৈবনিক উপাদান ব্যবহার করেছেন আমাদের মেকি সভ্যতার মুখোশ খুলে দিতেই। তাঁকে হাংরি জেনারেশনের কবি মনে করা হলেও তিনি শুধু হাংরি ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। কবি মণীন্দ্র গুপ্ত ‘ষাট দশকের কবিতা’ শীর্ষক এক আলোচনায় বলেছিলেন—“আমরা কে, কোথা থেকে আসি, কোথায় যাই—সেই পুরোনো প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো করে দিতে চেয়েছেন ‘ষাটে’র সবচেয়ে স্বাধীনচেতা, গভীর, শক্তিশালী কবি অরুণেশ ঘোষ।’’

    ষাট দশকের প্রকৃতিতন্ময় কবি সমীর চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থগুলি হল—‘সূর্য প্রদক্ষিণে ছায়া’, ‘ভালবাসা ছড়িয়ে রয়েছে, তুলে নাও’, ‘দূর নক্ষত্রলোকে, মধ্যরাত্রে’, ‘আত্মপীড়নে এক জন্ম কেটে যায়’,‘ উত্তরের চিঠি’, ‘ভাঙো, পাথরের দীর্ঘ পর্যটন’ ইত্যাদি। ইতিহাস সচেতন আঞ্চলিক স্বরের প্রকাশ পাই তাঁর লেখায়। কোচবিহারের কবি কিংবা পুরুলিয়ার কবি—এমন অভিধায় কবিকে আটকানো ঠিক নয় কিন্তু কোনো অঞ্চলের রঙকে পরখ করতে হলে আমাদের বিশেষভাবে মুখাপেক্ষী হতেই হয় কারো কারো লেখার ক্ষেত্রে। ‘তমসুক’ পত্রিকার সম্পাদক সমীর চট্টোপাধ্যায় রাজনগরের কবিতার ক্ষেত্রে তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব। ‘কুচবিহারে একটি বৃষ্টির দিন’, ‘লালবাঈ চন্দনবাঈ’, ‘ভাওয়াইয়ার সুর ভাসে’, ‘টগর অধিকারীর দোতারা’ প্রভৃতি কবিতা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। ‘সাগরদীঘি/১’ কবিতায় যেমন লিখেছেন—“পাওয়া ও হারাবার দুঃখে ও সুখে/ সাগরদীঘির জল আজ/ কুচবিহারের চিঠি হয়ে গেছে।’’ স্বপন কুমার রায়ের সম্পাদনায় ‘সাগরদীঘি’ পত্রিকায় সমীর চট্টোপাধ্যায়ের কবি পরিচিতিতে লেখা হয়েছিল—“ষাট দশকের প্রথম সারির প্রকৃতি-তন্ময় কবিদের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র স্থান করে নিতে পেরেছেন কবি সমীর চট্টোপাধ্যায় (১৯৪২)। উত্তরবাংলার জলবায়ু, পাহাড়, প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর কবিতা জুড়ে নিরাভরণভাবে ছেয়ে আছে। কবিতায় পঙ্‌ক্তি-নির্মাণ, শব্দের সারল্য, সবমিলিয়ে তাঁর অমোঘ চৈতন্যস্রোতে ধৃত আছে এক শৈল্পিক পূর্ণবলয়, যার জ্যোতি সহৃদয় পাঠককে মুহূর্তেই করে তোলে উদ্ভাসিত, স্নিগ্ধস্নাত। মূলত এ সবই তাঁর কাছে উঠে আসে এক রোমান্টিক প্রতিফলনে।’’ উদাস বাউল নামে কবির গদ্য লেখার তথ্য পাচ্ছি এই লেখা থেকে। সমীর চট্টোপাধ্যায় মূলত গদ্য কবিতাই লিখেছেন। এটি তাঁর অন্যতম অভিজ্ঞান। ‘মৈষাল বন্ধুর দোতারায়’ কবিতার শেষ অংশটুকু উদ্ধৃত করছি কবিমনকে বুঝতে চেয়েই—

    “সবাই এক দীর্ঘ ঘুমে ঘুমিয়ে আছে
    মৈষাল বন্ধুর দোতারায় ‘কি ও কাজল ভোমরা রে’
    তার জীবন নিংড়ানো দুঃখে কেঁপে উঠছে আকাশ
    গানের সে একাই শ্রোতা।’’
    অরুণেশ ঘোষ, সমীর চট্টোপাধ্যায়, রণজিৎ দেব প্রায় সমসময়ের কবি। ‘ত্রিবৃত্ত’ পত্রিকার সম্পাদক রণজিৎ দেবের কাব্যগ্রন্থগুলি হল—‘প্রভু অন্ধকারে আমি একা’, ‘শাখা প্রশাখা শেকড়গুচ্ছ’, ‘হেমন্তের সকাল ও একসারি বালিহাঁস’, ‘নির্জন ভূমিতে জলপ্রপাত’ ইত্যাদি। উত্তরের প্রকৃতি ও জনজীবন তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আন্তরিক সান্নিধ্য তাঁর রোম্যান্টিক কবিচেতনার মূলে ক্রিয়াশীল। ‘দোতরার (??দোতারা?) টান’ কবিতায় লিখছেন—“ভালবাসায় দোতরা(??)র টান--/ নিতে জানি আমি।/ সবাই সব কিছু দিতে পারেনা।’’

    “‘কবিতা লেখা, আমার কাছে, নিজেকে চাবকে সোজা রাখা।’—একটা সময়ে এরকমটাই ভেবেছিলাম। বেশ কিছুদিন পার করে এসেও আজও তেমনটাই প্রতিভাত হয়। শরীরের বয়সবিচারে কিঞ্চিদধিক সাড়ে ছয় দশক পার হলেও মনের বয়ঃসন্ধি, যৌবন, তারুণ্য আর গেল না।’’-- কবি নিত্য মালাকারের অনুভব মুদ্রিত হয়েছে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘যথার্থ বাক্যটি রচনার স্বার্থে’ কাব্যগ্রন্থের ব্লার্বে। এই বই শুরু হচ্ছে ‘কেন্দ্রিকতা’ নামের কবিতা দিয়ে—

    “নাল্পে সুখমস্তির দিন ছিল কাল
    আজ নিরম্বু উপবাস
    কাল ঘনঘোর ছিল অকথ্য-সুকথ্যভরা
    কী কী সব ছিল
    আজ দুরূহ চড়াই-উৎরাই সার
    ঘুরে ফিরে ঘুরে
    আমি কিছুটা না-মরে পড়ে
    কেন্দ্রিকতার থেকে দূরে, বহু দূরে’’
    এই পঙ্‌ক্তিগুলি থেকে কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা নিবাসী নির্জন প্রচারবিমুখ এই কবিকে চিনে নেওয়া সম্ভব। অন্তর্মুখী এই কবির উপমা প্রয়োগ অসাধারণ। রোম্যান্টিক কবিমনের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘লিরিক’ কবিতায়। শেষ স্তবক এরকম—,"ধরো, পেছনে তখনো মায়া আলো/ দেখে, এই প্রথম তোমার চোখে/ লিরিক ঘনালো।’’ তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল—‘সূত্রধারের স্বগতোক্তি’, ‘অন্ধের বাগান’, ‘দানাফসলের দেশে’, ‘গীতবিতানপ্রসূত রাত্রি এই বৃষ্টিধারা’ ইত্যাদি।

    ‘চিত্রকল্প’ পত্রিকার সম্পাদক অমর চক্রবর্তী কোচবিহারের প্রতিনিধি স্থানীয় কবি। আশির দশকের এই কবি সহজ সুরে গভীর কথা বলতে ভালোবাসেন। ‘অনুপ্রাস’ কবিতার প্রথম স্তবক থেকে তাঁর মন মেজাজের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে—

    “অনেক শব্দই আমি বাদ দিই লেখা থেকে
    যেমন ধ্বস্ত, ধংস, ধর্ষণ
    আমার পছন্দ ধর্ম, ধান্য, ধারণ।’’১০
    হৃদয় দহন ঘর তিনি জানেন, বিশ্বায়ন যে বর্গীহানা দিয়েছে আমাদের ঘরে, মনে করিয়ে দেন সে কথাও। পরম বিশ্বাস আঁকড়ে ভালোবাসার আলো মেখে বাঁচতে চান। ‘উন্নয়ন’ কবিতার শেষে যেমন পাই—
    “উন্নয়ন, আয় রে আয় অভ্রকান্তি ডানা মেলে
    তবে শুধু বিষণ্ণ মেঘের ছবি আনিস না!
    কৃষকের কথা ভাবিস, ভাবিস ভালোবাসার কথা।’’১১
    সুজয় বিশ্বাস নির্জনচারী, একাকী কবিসাধক। ‘এ বিষাদ অর্জন’ কাব্যগ্রন্থের ‘আরও একটি রক্তবিন্দু’ কবিতায় তিনি লিখছেন—“আপনি জীবনানন্দের কথা খুব বলেন, আমি বলি কাফ্‌কার কথা/ কিন্তু কী অদ্ভুতভাবে তাঁরাও বন্দি হয়ে পড়লেন কিছু সুখী আর/ ন্যাতানো মানুষের কাজুবাদামের প্লেটে, কফির পেয়ালায়,/ আমলাতান্ত্রিক আমোদের মধ্যে’’১২ কবি সঞ্জয় সোমের লেখা ‘অক্ষরে আত্মভ্রমণ’, ‘অনুভবে চন্দ্রাবলী,’ ‘আমার অজ্ঞাতবাসের নীরব কবিতারা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থগুলির কথা অবশ্য উল্লেখ্য। তাঁর আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তিমূলক কবিতাগুলি পাঠকের মনোযোগ আদায় করে নিতে পারে। সুবীর সরকার নব্বই দশকের কবি হিসেবে বিশেষ পরিচিত। উত্তরজনপদের বৃত্তান্ত এক মায়াপৃথিবী তৈরি করে তাঁর কবিতায়। প্রভাত চৌধুরী সম্পাদিত ‘পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা’ সংকলিত এই কবির গুচ্ছ কবিতা। সেখান থেকে একটি কবিতা উদ্ধৃত করছি—
    “অথচ কচুগাছ কাটতে কাটতে আমরা সব ডাকাত হলাম,
    নেত্রছায়ার খুব নিচু দিয়ে সারি সারি পিঁপড়ের শোকযাত্রা
    অথচ ফুঁ সিরিজের পাশে হলুদ দোলনা,
    হারিয়ে যাওয়া তারিখের দিকে দৌড়তে
    থাকে শুধু দিগন্তরেখা। অথচ কচুগাছ কাটতে কাটতে
    আমরা খুঁজে পেলাম আমাদের ডানা।’’১৩
    তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল—‘যাপনচিত্র’, ‘চর্যাপদের হরিণ’, ‘নাচঘর’, ‘জ্যোৎস্নাগীটার’, ‘হরফলিপি’ প্রভৃতি। অকালপ্রয়াত কবি সুজিত অধিকারী (১৯৭৫–২০১৪) নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণ করতে পেয়েছিলেন। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘ফুলের জন্ম’ কবিতায় পাই—“সত্যিকারের কোনও মানুষের মৃত্যু হলে/ ফুলের জন্ম হয়/ গন্ধ ছড়ায় তার বহুদূর বিস্তৃত/ ভালোবাসা আছে, ভালোবাসা আজও... তার মৃত্যু হলে ফুলের জন্ম হয়।’’১৪ এই আলোচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কথা আমরা বলতে পারলাম না।

    গৌরাঙ্গ সিনহা সম্পাদিত ‘তোর্সা পাড়ের গুচ্ছ কবিতা’ বইটি থেকে রাজনগরের কবি ও কবিতা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। সঞ্জয় সাহার লেখা ‘কবিতীর্থে এক পদাতিক’ গদ্যের বইটি থেকে মাথাভাঙা মহকুমার কবি ও কবিতা সম্পর্কে খানিক আঁচ পাওয়া যেতে পারে। নিত্য মালাকার, সন্তোষ সিংহ, অনুভব সরকার, কমল সাহা প্রমুখ কবিদের যাপনচিত্র পাঠককে যেন কবিতার আড্ডায় হাজির করে। এবারে আমরা চলে আসি জেলার নারীদের লেখালেখিতে।

    স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে প্রথম দিকে পাই অপরাজিতা গোপ্পীকে। তাঁর কবিতা বামপন্থী রাজনৈতিক দর্শন থেকে উঠে এসেছে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম—‘আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটায়।’ লখনৌ-এর একটি নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে তিনি লেখেন—“রাজপ্রাসাদের অন্তরালে রাজাবাবুরা/ ভোটের বাক্সে নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে তৎপর।/ আমরা সমাজের অচ্ছুৎ মেয়েরা/ শুধু লাশ হয়ে সস্তা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে/ রক্তাক্ত কবরের বুকে/ রক্তকরবী হয়ে/চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।’’১৫ সাম্প্রতিক সময়ে চৈতালি ধরিত্রীকন্যা, মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, পাপড়ি গুহ নিয়োগী, মাধবী দাস প্রমুখ কবিতায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানকে বহুমাত্রিকভাবে তুলে ধরছেন। চৈতালি ধরিত্রীকন্যা ‘প্রত্যয়’ কবিতায় লিখছেন—“আমি জানি/ যে জ্বলজ্বল করে সে/ শুকতারা নয়/ শুক্রগ্রহ।’’১৬ স্বভাবে রোম্যান্টিক কবি মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসের কবিতায় পাই বিভিন্ন মিথের প্রয়োগ। ‘সুইসাইডাল নোট’ কবিতায় তিনি লিখছেন—“অবস্থিতি কোথায় বুঝি না। ভুলে যেতেও পারো/ অনায়াসে...অন্য আঙুলে শরীর জড়িয়ে/ আসলে কীভাবে মানুষ চেনা যায় আর মুখোশ/ অন্য এক পাখার বিস্তারে ঘুম লেগে থাকে...’’১৭ ‘একলা মেয়ের আগুন-জ্বলা টান’ হিসেবে তাঁর কবিতা প্রয়াসকে দেখা যেতেই পারে। পাপড়ি গুহ নিয়োগীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘বিনির্মাণ’ কবিতাটি উদ্ধৃত করছি—

    “এইসব
    রাস্তাও আজ বাঁক নিচ্ছে আমার ভেতর

    স্বীকৃতি নেই জেনেও
    আকর্ষণ
    স্বপ্নে চুম্বন
    বদলে দেয় রসায়ন

    যত দূরেই থাকো
    ক্ষরণটুকুই তো
    বিনির্মাণ’’
    —এভাবেই বিনির্মিত হয়ে উঠছে নারীদের স্বর, নারীদের ভাষ্য।

    কোচবিহারের কবিতা বলতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষের ‘যমুনাবতী’ কবিতার কথা মনে পড়তে বাধ্য। ১৯৫১-র খাদ্য আন্দোলন ও এক কিশোরীর মৃত্যু কীভাবে কাব্যরূপ পেল ধরা আছে কবির ‘কবিতার মুহূর্ত’ বইতে। বিখ্যাত কবিদের লেখায় কোচবিহারের অনুষঙ্গের আলোচনা পৃথক পরিসর দাবি করে। পরিশেষে এটুকুই বলার রাজঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে কোচবিহারের কবি ও কবিতা বাংলা কবিতার মানচিত্রে বিষয় ও শৈলীর বহুমাত্রিক অভিমুখ তৈরি করতে পেরেছে। আমাদের কেবল সহৃদয় পাঠক হয়ে ওঠার অপেক্ষা...


    তথ্যপঞ্জিঃ


    ১। জিরাফ, সম্পাদক- অরুণেশ ঘোষ, কোচবিহার, সংকলন ১০, ১৯৮৫ জানুয়ারি, পৃঃ ২৪।

    ২। অরুণেশ ঘোষ, আমার কবিতাযাত্রা, পুরুলিয়া, নাটমন্দির, প্রথম প্রকাশঃ কলকাতা বইমেলা ২০১৩, পৃঃ ৯।

    ৩। মণীন্দ্র গুপ্ত, ষাট দশকের কবিতা, কলকাতা, আধুনিক কবিতার ইতিহাস, সম্পাদনা- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম দে’জ সংস্করণ, জানুয়ারি ২০১১, পৃঃ ২০৩।

    ৪। সমীর চট্টোপাধ্যায়, নির্বাচিত কবিতা, জলপাইগুড়ি, তিস্তা তোরষা, প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ১৯৯৯, পৃঃ ২৫।

    ৫। সাগরদীঘি, সম্পাদনা- স্বপনকুমার রায়, কোচবিহার, প্রথম সংখ্যা, বইমেলা ১৩৯৩, পৃঃ ৭।

    ৬। সমীর চট্টোপাধ্যায়, নির্বাচিত কবিতা, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৪।

    ৭। রণজিৎ দেব, হাওয়ার মিথুন, কলকাতা, সহযাত্রী, প্রথম প্রকাশঃ ১লা জানুয়ারি, ২০১০, পৃঃ ২৬।

    ৮। নিত্য মালাকার, যথার্থ বাক্যটি রচনার স্বার্থে, কলকাতা, দিবারাত্রির কাব্য, প্রথম প্রকাশঃ আশ্বিন ১৪১৯, পৃঃ ৯

    ৯। তদেব, পৃঃ ১০।

    ১০। অমর চক্রবর্তী, কুসুম নিবাস, কলকাতা, পত্রলেখা, প্রথম প্রকাশঃ কলকাতা বইমেলা, জানুয়ারি ২০১৩, পৃঃ ১২।

    ১১। তদেব, পৃঃ ১১।

    ১২। সুজয় বিশ্বাস, এ বিষাদ অর্জন, কোচবিহার, দশদিগন্ত, প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০০৬, পৃঃ ১৫।

    ১৩। সুবীর সরকার, শোকযাত্রার প্রতিবেদন, পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা, প্রভাত চৌধুরী (সম্পাদনা), কলকাতা, কবিতা পাক্ষিক, প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি, ২০০২, পৃঃ ৪৮৫।

    ১৪। ডাউন ট্রেনের কামরায়, সুজিত অধিকারী, কলকাতা, পাঠক, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা বইমেলা ২০১৫, পৃঃ ১৮।

    ১৫। অপরাজিতা গোপ্পী, রক্তকরবীর পাপড়ি ঝ’রে যায়, কলকাতা, উবুদশ, সম্পাদক- সিদ্ধার্থরঞ্জন চৌধুরী, ২৫ বর্ষ সংখ্যা ১, অক্টোবর- ডিসেম্বর ২০১৫, পৃঃ ৬৪।

    ১৬। চৈতালি ধরিত্রীকন্যা, মলাটে রৌদ্র কাঁপে, কলকাতা, প্রতিভাস, প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০০৮, পৃঃ ১০।

    ১৭। মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, সুর লেগে আছে বারান্দায়, কলকাতা, সিগনেট প্রেস, প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ২০১৫, পৃঃ ৪২।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ এখান থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments