• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | উপন্যাস
    Share
  • রাহুলের ডায়েরি থেকে : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত






    || ৬ ||


    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “... সময় থাকতে থাকতে দেবুদার উপর একটা ডসিয়ার বানাতে হবে। আপাতত যতটুকু জানি তাই দিয়ে একটা কাঠামো তৈরি করা যাক।

    প্রিলিমিনারি রিপোর্ট
    -------------------

    ডেট: মার্চ ১৩, ১৯৮৭

    ১. নাম: দেবনাথ সমাদ্দার।

    ২. ঠিকানা: ২০৮এ, বাঁশি ওয়ালা গলি, লক্ষ্মীনগর, দিল্লী।

    ৩. পেশা: কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ। (ম্যানেজার গোছের কিছু।)

    ৪. বয়েস: ২৮-৩০ বছর।

    ৫. শখ: খেলাধুলো (এখন আছে কি?)

    ৬. উচ্চতা: ৫’ ১০”+

    ৭. ওজন: ৭০-৮০ কেজি।

    ৮. দাড়িগোঁফ: নেই।

    ৯. কথাবার্তা: সামান্য বাঙাল টান। “ইসে”-র ব্যবহার। সপ্রতিভ, কিন্তু পলাশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জিভ জড়াচ্ছে।

    ১০. স্বাস্থ্য: বাইরে থেকে দেখলে খুব ভালো। লিভারে টোকা মেরে দেখতে হবে।

    ১১. সম্পত্তি: নিজেদের বাড়ি। একমাত্র ছেলে। স্কুটার আছে।

    ১২. ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স: জানা হয়নি। কি করে কথাটা পাড়ি?

    ১৩. শিক্ষা: মাস্টার্স ডিগ্রী। পড়াশোনায় খুব ভালো। রেজাল্ট ভালোই হবে। খোঁজ নেওয়া হয়নি।

    ১৪. জেনারেল নলেজ: আমার চেয়ে বেশি। কতটা বেশি সেটা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ফিল্মস্টারদের খবর বিশেষ রাখে না।

    ১৫. ধূম্রপান: করতে দেখেছি। কিন্তু চেন স্মোকার নয়। আঙুলের ফাঁকে কোনো বাদামী ছোপ নেই।

    ১৬. মদ্যপান: করে বলেই জানি। অ্যালকোহলিক কিনা জানা দরকার। বিকেলের পর দেখা করতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া।

    ১৭. নারীঘটিত দোষাদি: নেই। প্রায় নিশ্চিত।

    ১৮. বন্ধুবান্ধব: বিচিত্র। কুসঙ্গের সংস্পর্শ থাকা অসম্ভব নয়।

    ১৯. মন: কোমল প্রকৃতি। বাবা-মা-কে ভালোবাসে। পলাশকে ভয় পায়। আপাতদৃষ্টিতে উদার।

    ২০. রাজনীতি: করে না। বোঝে কিনা সেটা বনমালী চেক করে জানাবে।

    ২১. শিল্প-সংস্কৃতি: গানের গলা ভালো, তবলা বাজাতে পারে।

    ২২. উদ্দেশ্য: ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো গভীর চিন্তা করেছে বলে মনে হয় না। বিয়ে করতে চায়। কিন্তু কেন?...”

    ************

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “...রাস্তা জুড়ে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। জলধরের। আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলাম। ওর ঘড়ি, মানিব্যাগ, কিছু কোথাও নেই। ফুটপাতের নিচে ধুলোয় মুখ গুঁজে পড়ে আছে একপাটি জুতো...”

    *************

    জলধরের জীবনে একটা রহস্য আছে।

    এর কোনোদিন কিনারা হবে না। সুভাষচন্দ্রের নিরুদ্দেশ হবার মতো। রাহুলরা হাল ছেড়ে দিয়েছিল।

    পাগলা-মাধববাবু, স্কুলে সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনে চোখ পাকিয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—নেতাজী হাতে গোল ডায়াল-এর ঘড়ি পরতেন, কিন্তু তাঁর পুড়ে যাওয়া লাশের হাতে চৌকো ডায়াল-এর ঘড়ি, হোয়াই? হোয়াই, হোয়াই, হোয়াই?

    তখন রাহুলরা ছোটো। উঁচু ক্লাসের কে একজন, দেবুদাও হতে পারে, পিছন থেকে বলেছিল—দুটো ঘড়ি ছিল বোধহয়। এর চেয়েও খারাপ মন্তব্য করেছিল অবশ্য ক্লাস এইটের কালু। সে বলেছিল—কলিশনে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে স্যার। তারপর সে কবজি থেকে একটা সরু স্টিল-এর বালা খুলে নিয়ে হাতের চাপে সেটাকে চ্যাপ্টা করে দেখিয়েছিল।

    পাগলা-মাধব কিছু বলেননি, কিন্তু নীরেনবাবু কালুকে চুলের ঝুঁটি ধরে হলের বাইরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। ওদিকে পাগলা-মাধববাবু রাহুলদের ফিস ফিস করে বলেছিলেন— এই প্রশ্নের উত্তর একদিন আমরা পাব। পাবই। তিনিই এসে দেবেন।

    অতঃপর হাততালি। রাহুলরা অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল সুভাষচন্দ্রের ফিরে আসার। শেষে একদিন শুনল পাগলা-মাধববাবু সুলেখা-দিদিমনিকে করিডরে দাঁড় করিয়ে বলছেন—এই সেঞ্চুরিতে ফিরবেন না নেতাজী। নেক্সট সেঞ্চু্রিতে ফ্লাইং সসারের টেকনোলোজি নিয়ে আসবেন। সুলেখা-দিদিমনি আশ্চর্য হয়ে বললেন—কিন্তু ব্রিটিশরা তো চলে গেছে? ভুরু নাচিয়ে পাগলা-মাধব বললেন—আবার এলে?

    তখনই একদিন জলধর, শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে এসে চিঠিটা দেখিয়েছিল রাহুলদের। সেই রহস্যের কাছে আর নেতাজীর নিরুদ্দেশ হওয়াটা তেমন গুরুতর কিছু মনে হয়নি।

    **********

    চিঠিটা পাকা ইংরেজিতে। নীল রঙের ইনল্যান্ড-এ সূক্ষ্ম হাতে লেখা। মাত্র তিনটে সেনটেন্স।

    ডিয়ার জলধর,

    আই অ্যাম আ গার্ল।
    আই লভ ইউ।
    লুক ফর মি অ্যাট ইয়োর স্যাক্রেড থ্রেড সেরিমনি।

    ***********

    নিচে কোনো সাক্ষর নেই। কিছুদিন আগেই জলধরের পৈতে হয়েছে। মাথা ন্যাড়া। কেমন একটা থতমত খাওয়া ভাব।

    বনমালী বলল—আগে বলিসনি কেন ব্যাটা? পৈতের সময় চাদ্দিক ভালো করে দেখেছিলি?

    জলধর বলল —মা কালী বলছি সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়েনি। অনেকেই দিদির বন্ধু। বাকিরা মায়ের চেনা মহিলা, আত্মীয়স্বজন।

    বনমালী বলল—স্যাক্রেড থ্রেড সেরিমনি কথাটা কটা লোক জানে বাবা? এ কোনো ঘুঘু মেয়ে। মহিলাও হতে পারে।

    জলধর কাঁপতে কাঁপতে বলল—স্কুলের দিদিমনিরা এসেছিলেন। ভিক্ষা নিলাম। দিদিমনিরাও হাসতে হাসতে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। আমি স্কুল পালটাব। বিনয়নগরে চলে যাব। ওদের রেজাল্ট ভালো।

    রাহুল, বনমালী দুজনেই খিঁচিয়ে বলেছিল—হাতি। একে তো টাক মাথা, তার উপরে ভিতুর ডিম। তোকে টিফিন-বেলা বাথরুমে ধরে নিয়ে গিয়ে ন্যাংটো করে ছেড়ে দেবে। কে বাঁচাবে তখন?

    রাহুল বলল—পীযূষ, হুলো এরা বজ্জাতি করে দিতে পারে না চিঠিটা?

    বনমালী বলল —এত ভালো ইংরেজি কার পেট থেকে বেরোবে রে? এ নির্ঘাৎ কোনো কনভেন্টে পড়া মেয়ে।

    পরে রাহুলরা সাহস দিয়েছিল—ভয়ের কি আছে? এমন ভাব দেখা যেন কোনো চিঠিই পাসনি। আমরা আছি তো।

    ওই একটি চিঠি দিয়ে জলধরের ছাত্রজীবন একই সঙ্গে দুর্বিষহ ও মহিমময় করে তুলেছিলেন কোনো অজ্ঞাত-কুলশীল, সম্ভবত কনভেন্টে পড়া মহিলা। রাহুলরা জলধরের আশেপাশে থাকত। যতগুলি সম্ভব চেনা মেয়ের হস্তলিপি জোগাড় করা হয়েছিল তখন, দুরুদুরু বক্ষে তাই নিয়ে গবেষণা হত। পরে আর চিঠি আসেনি। কিন্তু তারই বা অর্থ কি? এমন কি হতে পারে যে মেয়েটি পৈতের দিন উপস্থিত থাকতে পারেনি, এবং এখন কোনো জরুরী কাজে আটকে পড়েছে? এই রহস্যেরও কোনো সমাধান হয়নি। চিঠিটা জলধর ছিঁড়েই ফেলত, রাহুলরা তা করতে দেয়নি। ওটাই একমাত্র সূত্র বলে। তারপর একসময় সেটা জলধরের পিলে কি যকৃতের মতো শরীরের একটা অঙ্গ হয়ে যায়।

    এত যে সন্দেহবাদী বনমালী, সেও বলতে বাধ্য হয়েছিল রহস্যটা এখনো আছে জলধর। তবে একটা ফাঁড়া কেটেছে তোর।

    কিন্তু অন্য ফাঁড়াটা কাটেনি। পরে ভেবেছিল রাহুল।

    **********

    সেদিন রাতে রাহুলের স্বপ্নে একটি চওড়া কাঁধওয়ালা লোক পুষ্করিণীতে মাছ ধরছে। পিছন থেকে দেখছে তাকে রাহুল।

    হায় চিল, সোনালী ডানার চিল
    তুমি আর কেঁদো না কো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে...
    —আপনি জীবনানন্দ?

    —ও নামে ডেকো না আমায়।

    —কেন?

    —পুলিশ। খুঁজছে।

    ...তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে
    ...আবার তাহারে কেন ডেকে আনো, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা...
    রাহুল বুঝতে পেরে তটস্থ হয়ে যায়। এদিক ওদিক দেখে নেয়। কালো জলের উপর ফাতনা। চতুর্দিকে একটা থমথমে ভাব। কিছু একটা ঘটলে সেই যেন দায়ী।

    —সরি।

    —ঠিক আছে। ওরকম হয়। বসু বোর্ডিং হাউস-এ উঠেছিলাম। গোল-মার্কেট-এ।

    —ভালো জায়গা তো। রাহুল বলে। নিচেই বইয়ের দোকান।

    —তারাই ধরিয়ে দিচ্ছিল। চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছি। আচ্ছা ওরা আমার বই রাখে না কেন বলতে পারো?

    —পুলিশের ভয়?

    —তাই হবে। বাঙলার পঞ্জিকা রাখে। সেটাও আমারই লেখা। ছদ্মনামে। কেউ জানে না। পালিয়ে করোলবাগে গেলাম। মেসে ছিলাম কিছুদিন। বেশিদিন নয়, পুলিশের নজর খুব কড়া। এখন যমুনা-পারে আছি। উদ্বাস্তু কলোনিতে। বাঙলার মুখ এখানে দেখা যায়। তুমি দেখেছ?

    —আজ্ঞে না।

    —দেখো। ফুটবলে আছে। মাছের চোখে চোখ রাখলে দেখতে পাবে। শঙ্খের মুখে একটা হাসি আছে দেখেছ? ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম কিছুদিন আগেরবার। সবাই চেনে। তাই ওদিকটা যেতে ভয় করে। তুমি কি যাও?

    —নিয়মিত।

    একটা মাছ পড়েছে সুতোয়। বড় মাছ বোধহয়। হুইল থেকে ধীরে ধীরে সুতো ছাড়তে থাকে লোকটা। ভীষণ দুরূহ, মনোঃসংযোগের কাজ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কালো জলের উপর ঝিলমিল করছে ফাতনা, ছোটো-ছোটো ঢেউ। পুকুর থেকে ভ্যাপসা গুমোট বাতাস।

    —একটা কাজ করো। লাইব্রেরিতে আমার গোটা ছয়েক বই আছে। একদিন সময় করে সবকটা নিয়ে এসো। রবীন্দ্রনাথের কিছু বইও এনো।

    —পড়বেন?

    —ধুলো মাপব। কার বইতে কতটা ধুলো জমে। একে বলে কমপ্যারেটিভ লিটারেচার। মিলিমিটারে মাপতে হয় সাধারণত।

    পকেট থেকে ফুটস্কেল বার করে দেখায় চওড়া কাঁধওয়ালা লোকটি।

    —এই দ্যাখ পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছি। রবীন্দ্রনাথ, বদল্যেয়র, কালিদাস, জীবনানন্দ।

    —কারটা বেশি?

    —কালিদাস। লখনউতে ৭০ মিলিমিটার, কলকাতায় ১৩৫, ঢাকায় ৩৮৫। আমি সেকেন্ড। ১২০, ৯৫, ৮৫। প্রত্যেক বছর বাড়ছে অবশ্য। কালিদাসকে ধরে ফেলব বছর কুড়ির মধ্যে।

    —পুলিশ খুঁজছে কেন আপনাকে?

    —জানো না তুমি? আশ্চর্য! সবাই জানে। চাকরি দেবে বলে! রবীন্দ্রনাথ মারা যাবার পর বড়কর্তার চেয়ার তো শূন্য।

    লোকটা মাছ ধরছে তন্ময় পুরোপুরি হয়ে। ফুর ফুর করে পাঞ্জাবী উড়ছে হাওয়ায়। রাহুল বুঝতে চায় লোকটাকে। যেন সে খুবই লাভবান হবে এই কথোপকথন থেকে।

    —চাকরিতে ভয় কিসের? কতো লোক তো চাকরি পায় না!

    পিছু না ফিরেই কাঁধ দোলায় মৎস্যশিকারী। রাহুলের স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে যায় চাদর কম্বল ছিঁড়ে ফুঁড়ে। সাদা আকাশ, কালো পুকুর, মাছ, ফাতনা, গোল মার্কেট, হাওয়া সব মিলে মিশে একাকার।

    —সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি!

    স্বপ্নে এসব কথার মানে পরিষ্কার বুঝতে পারে রাহুল।

    *************

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “....সব ঠিকঠাক চলছে। পড়াশোনাটাতে আরেকটু জোর দিতে হবে শুধু। কিছুদিন হোস্টেলে গিয়ে থাকতে হতে পারে। গোয়েল, দীপক এরা কোত্থেকে খবর পায় পরীক্ষায় কি প্রশ্ন আসবে। সব অবশ্য মেলে না। কিন্তু ওরকম সিলেকটিভ পড়া করলে আখেরে অনেক লাভ। কম মেহনতে ভালো ফল। আমাকে নিজের একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করে নিয়ে যেতে হবে। বলব মিরান্ডা হাউসের মেয়ের কাছ থেকে পেয়েছি। দিদিমনির হ্যান্ডব্যাগ থেকে সরানো।

    বনমালী গতবার নিজের ক্লাসে সেকেন্ড লাস্ট হবার পর এবার উঠে পড়ে লেগেছে। আমায় বলল—বুঝতে পারছিস, আমরা ছাড়া আর সবাই লুকিয়ে নোট বানায়। সেগুলো জোগাড় কর। বেমক্কা সময়ে হোস্টেলে গিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়বি।

    আমি ঢুকলেই ওরা বইখাতা লুকিয়ে ফেলে প্লেবয় বের করে বসে। সেইজন্য একটা ডিকয় চাই। সাদা কাগজে মিরান্ডা হাউসের দিদিমনির প্রশ্নপত্রের নকল। সেটা হাতে আছে জানতে পারলেই, সবাই সুড়সুড় করে আমার সঙ্গে পড়তে আসবে। অন্যদিকে একটা টিউশনি হাতে আছে। আগামী দু-মাসে কিছু টাকার মুখ দেখব, ধার শোধ করেও যৎকিঞ্চিৎ থাকতে পারে হাতে। সব মিলিয়ে একটি সম্ভাবনাময় গরমের ছুটির প্রত্যাশা করলে দোষের হয় না। নিজের কর্তব্য ঠিকঠাক করে যেতে পারলে সুসময় আপনা থেকেই আসে...”

    ************

    রবিবার দুপুরে বনমালীর ফোন। জলধর গাড়ি চাপা পড়েছে। সমস্ত রক্ত বেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে রাস্তায়। রাহুলের হাত কাঁপছে অসম্ভব রকম। মা এসে ধরছে টেলিফোন।


    || ৭ ||


    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “... মাঝখানে একদিন আমার ঘরের জানলা দিয়ে লাফিয়ে ঘরে ঢুকেছে একটা বল। একটু পরে মুখ উঠেছে সেই জানলায়। নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আমিও চমকে উঠেছি। জলধর এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল নাকি?

    না। অচেনা একটি বাচ্চা ছেলে। ভয়ে ভয়ে বলটা চাইছে। ধরেই নিয়েছে পাওয়া যাবে না। মনে পড়ল যে আমাদের ছোটোবেলাও পেতাম না। বুড়ো-টুড়োরা কি গালই না দিত। তার কোনো পথ্যির ওষুধের গচ্ছিত পুরিয়া পড়ে ভেঙে গেছে তাই আমাদের বল তো দেবেই না, উল্টে বেজন্মা, বাঁদরের বাচ্চা বলে কুৎসিত কথা শোনাচ্ছে। তখনও আমরা ধরে নিতাম যে আমাদের তা-ই প্রাপ্য। বল হাঁকাবার কৌশলে দোষ। এখন ভাবি যে ওই লোকটারই হয়তো চৌদ্দটা ছেলে-মেয়ে হয়েছিল, গোটা সত্তর নাতি-পুতি। যারা আমাদের সঙ্গে খেলেছে। তখন তো অত বেশি করেই হতো। বাচ্চা যাদের বেশি হয় তারা বাচ্চা কখনো পছন্দ করে না।

    যাই হোক, আমি ছেলেটিকে আশ্বাস দিলাম যে তার বল শিগগিরই পাওয়া যাবে। খাটের নিচে ঢুকে গেছে। বাক্স, প্যাঁটরা, হাঁড়ি-ফাঁড়ি আছে অনেক। তার মধ্যে অন্ধকারে কোথাও ঢুকে বসে আছে। আমি না পারলেও, কেউ না কেউ ঠিক সে বলের সন্ধান পাবে।

    ছেলেটি নিজেই এসে হাফ-প্যান্ট সমেত সেই অন্ধকারে ডুব দিয়ে দু-দুটো বল বের করে আনল। একটা বোধহয় আমাদের বাড়ির বল। বাস্তুবল। সেটাকে আমি আবার ভিতরে রেখে দিতে বললাম।

    এই বাচ্চাটাকে দেখে চমকে ওঠার কারণ জলধরের সাথে ওর মুখের মিল। ছোটোবেলায় ঠিক এরকমই তো ছিল জলধর! ঢোলা হাফ-প্যান্ট। নাক দিয়ে ঝোল। বড়ো বড়ো চোখ।

    ছেলেটার নাম কপিল। আমি তাকে একটু দাঁড় করিয়ে বললাম — খুব সাবধানে থাকো কপিল। কোনো রিস্ক নিও না।

    ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান। সে — ওকে আঙ্কেল, বলে হাসি দিল খুব সুন্দর।

    বাচ্চা জলধর আমার জন্য একবার প্রায় মরতে বসেছিল। স্কুল থেকে পালাচ্ছি ফোর্থ পিরিয়ডের পর। ফুটবল-মাঠের তলা দিয়ে একটা বড়ো স্যুয়েজ পাইপ ছিল। ব্যবহৃত হতো না কোনো কারণে। পাশে একটা খাদ, যেখান থেকে পাইপটাতে ঢোকা যেত। সেই পাইপ দিয়ে সিকি-মাইল গেলে বড়ো রাস্তা এবং অফুরন্ত ছুটি।

    সেদিন সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে দুটো বাস আসেনি। স্কুল বলতে গেলে খালি। কেউ যখন নেই, তখন জলধরকে বললাম আমি —আমরাই বা থেকে কি করব? পাইপে গিয়ে ঢুকলাম। সূর্যের আলো কিছু দূর গেছে, তারপর অন্ধকার। জলধর বলল —ভিতরে কি আছে জানিস? জানতাম না, তবু বললাম —জানি। পাঁক আছে। অ্যা-ট্যা থাকতে পারে। সাইড দিয়ে দিয়ে দৌড়তে থাক।

    আমি আগে জলধর পিছনে। আস্তে আস্তে ছুটছি। একেবারে অন্ধকার নয়। হালকা আলো আছে। হঠাৎ একটা ঝাঁঝালো গ্যাসের গন্ধ। ফিনাইল আর সরষে-বাটা আর মলমূত্র একসঙ্গে মিলে যেরকম গন্ধ হয়। নাকে হাত দিয়ে এগোচ্ছি। গন্ধটা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু এগিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আরেকটু এগোই, বাতাস পেয়ে যাব ঠিক।

    জলধর একসময় —মাথা ঘুরছে রে, বলে পিছু ফিরে দৌড় দিল। যাতে সে পালাতে না পারে তাই আমি আরো জোরে দৌড়ে ওর প্যান্টালুন ধরলাম পিছন থেকে। জলধর এক ঝটকায় হাত সরাতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে মাটিতে। আমি গিয়ে পড়লাম ওর ঘাড়ে।

    জামাকাপড়ে কাদা লেগে গেছে। তার উপর নি:শ্বাস নিতে পারছি না কেউই। জলধর হাঁ করে বলল —মরলাম, মরলাম। তখন ওর অবস্থা দেখে আমিও ঘাবড়ে গেছি। নিজের কষ্টও দ্বিগুণ হয়ে গেল যেন। দুজনেই উঠে পড়ি কি মরি করে ইস্কুলের দিকেই ছুট। বেরিয়ে এসে মাঠের ধারে চিৎপাত। নিশ্বাস নিচ্ছি কিন্তু মনে হচ্ছে বুক-পেট ভর্তি গ্যাস। মাথা ঘুরছে, গা গুলোচ্ছে। জলধর বালির মধ্যে গর্ত করে বমি করে দিল। সমানে বলে যাচ্ছে —মরলাম, মরলাম, কেন তোর কথা শুনতে গেলাম?

    ফিফথ পিরিয়ডের শেষে দুজনে ক্লাসে চুপি চুপি ঢুকে লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছি। সারাদিন ধরে মাথা ঝিম ঝিম করল দুজনেরই। অত ছোটো বয়েসে গ্যাস পয়জনিং। ছোটো বলেই হয়তো বেঁচে গেলাম। ছোটো বুক। নি:শ্বাসে বাতাস নিতাম খুব কম...”

    ***********

    রাহুলের ডায়েরি:

    “… সেই জলধরের খেলা সাঙ্গ হবার পরেই গরমের দিন। প্রচণ্ড খর তাপের মধ্যেই পুড়ছিল লাশ। ওর বাবা পুত্রবিয়োগে শয্যাশায়ী; তাঁকে বাঁচাতে ছোটোভাই বাড়ি আর হাসপাতাল করে মরছে। বনমালীই ভালো করে ঘি মাখিয়ে দিল কপালে, দুগালে, সমস্ত বুকে, কাঁধে।

    তার নিচে যাওয়া গেল না। সাদা কাপড়ে ঢাকা। কারা যেন একটু তুলে দেখেই ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। বলল—বুকে মাখালেই হবে। আসল কথা আমরা জানি। তলপেট বলে যা আছে তা দেখার যোগ্য নয়। ব্লাডার ফুটো হয়ে গেছে। আরো যা ফাঁসবার ফেঁসে গেছে। অন্ত্র, নাড়ি সব ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। উপরে উপরে মুচির সেলাই। দৃষ্টির আড়ালে থাকাই ভালো।

    পাতলা সাদা কাপড়ে জলধর। দুচোখ বন্ধ। ঘি চক চক করছে। চারদিকে ভয়ানক ফুলের গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে। গরমের মধ্যে জলধরের ঠান্ডা গা ছুঁতেই ভালো লাগে একরকম। লিমকা এনে দেয় একজন। আমি আর বনমালী দুজনেই ব্যাপক ঘামছিলাম।

    দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতা। অনেকক্ষণ বসে বসে দেখলাম। তারপর আর কোথায় মানুষ কোথায় কাঠ কিছু বোঝা গেল না। বনমালী আর আমি উঠে গিয়ে যমুনার জলে হাত, পা, ঘাড় ধুলাম ভালো করে। একটি নাগা সন্ন্যাসী ইউক্যালিপটাস আর বাঁশের জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়োচ্ছিল। আমাদের দিকে লাল চোখ করে তাকাচ্ছিল। লোকটাকে আগেও দেখেছি। যমুনার তীরে আর একটা কাঠের মাচা আছে কিছুদিন যাবৎ। বনমালী বলল—লোকটা বার বার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে কেন? আমি বললাম—ছেড়ে দে। বনমালী যা কখনো করে না তাই করল সেদিন। আচমকা উঠে হন হন করে এগিয়ে গেল লোকটাও বাঁশের জঙ্গলে অদৃশ্য। বনমালী সেখানে ঢুকতে গিয়েই হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। কিছু একটা ঘটেছে, দূর থেকে দেখতে পাইনি আমি। লাফিয়ে দূরে সরে এসেছে বনমালী, তারপর অকস্মাৎ দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে গিয়ে কাঠের মাচাটা ধরে ঝাঁকাচ্ছে। ভেঙে ফেলে দেবে সব। এদিকে নাগা সন্ন্যাসীর টিকিও দেখা যাচ্ছে না। চড়চড়ে রোদে বনমালী পাগলের মতো বাঁশের খুঁটি ধরে ঝাঁকাচ্ছে। আমি বললাম—পাগল হলি নাকি? সে বলল—জানোয়ারটা আমার গায়ে কি সব ছিটিয়ে দিল। অ্যাঃ, নোংরা করে দিল আমায়! অ্যাঃ!

    জলধরের মড়া ছুঁয়ে আছে যে সারাদিন তার আবার শুচি অশুচি কি? বনমালী কখনো এরকম অসংলগ্ন কথা বলে না। খুব শান্ত, ধীর থাকে। আমি ওর দেখাদেখি অন্য একটা খুঁটি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেছি তখন সে পট করে শান্ত হয়ে মাটিতে থুতু ফেলে আবার চলে গেল হাত, পা ধুতে।

    ফিরে এসে দেখি এতটুকু ছাই পড়ে আছে। জল ভর্তি মাটির হাঁড়ি ভেঙে সেইসব গরম ধকধকে ছাই আমরা ঠান্ডা করে দিলাম। নাভিটা খুঁজে বার করল চণ্ডাল। বনমালীই নিল হাতে। ততক্ষণে তার মাথা একেবারেই ঠান্ডা...”

    ************

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “... যেমন তেমন করে পরীক্ষা দিলাম। কোনো নোট নয়, কোনো গেস-পেপার দেখা হয়নি। বনমালী, আমি, হারু এবং অন্যদিকে সম্ভবত পলাশ। জলধর আমাদের যে ডুবিয়ে দিয়ে গেল সেকথা বনমালীকে বলতেই সে ঠান্ডা গলায় বলল—ওসব অজুহাত দিস না। দেবার দরকারও নেই। গতবার যেরকম রেজাল্ট হয়েছে তাতে এবার আর কেউ তেমন কিছু আশা করছে না।

    কিন্তু একদিন সুখেনবাবু আমাকে ডিপার্টমেন্টে খুঁজে বার করলেন। বললেন—আমার ক্লোজ ফ্রেন্ডদের মধ্যে অর্ধেকই এখন গত। কিছুদিন পরে জীবিতরাই মাইনরিটি হয়ে যাবে। তাই বলে আমি থেমে যাইনি। যারা বেঁচে আছে তাদের দিকে একটু বেশি মনোযোগ দিয়েছি। এটাই কি লজিক্যাল নয়?

    ওটাই লজিক্যাল। সুস্থ, স্বাভাবিক থাকাই মানুষের কর্তব্য। মরা মানুষ হলো খালি তেলের টিনের মতো। ফেলে দিয়ে ভুলে যাও। মনের উপর ব্রেনের কন্ট্রোল রাখ।

    এতদিন অনিয়ম করে করে শরীর ভেঙে গেছে। খাবার পর বমি। পেটব্যথা। এত উপসর্গ নিয়ে পড়াশোনা করা যায় না। আমার কর্তব্য এর চিকিৎসা করানো।

    ভোরবেলা লম্বা লাইন দিয়ে ডাক্তার দেখালাম। দিন-কে দিন রুগীর লাইন শুধু বেড়েই চলেছে। চারদিকে রক্ত, ডেটল, স্যাভলনের গন্ধ। পুঁজ, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন ওয়াটার। কারো চোখ দিয়ে কফ বেরিয়ে পড়ছে। স্বেদগন্ধময় ভারতবর্ষ। একবার টুক করে ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডটা ঘুরে এলাম। কয়েক-শো পোয়াতি মহিলা সন্তুষ্টভাবে বসে আছে। অর্থাৎ আরো বাচ্চা আসছে। জলধর। কপিল। এরা কি খাবে, কোথায় খেলবে তার কোনো ঠিক নেই। শুধু ঠিক হয়ে আছে কোন হাসপাতালে বসে মুদ্দফরাশ পেট সেলাই করে ঠান্ডাঘরে ঢুকিয়ে রাখবে।

    আমারও পেটে রোগ। ভিতরে অ্যাকসিডেন্ট। আলসার। আমৃত্যু জ্বালাবে। ওষুধ আছে অবশ্য। উপশমের। সেই সঙ্গে ঠান্ডা দুধ। পেটের দেয়ালে চুনকাম করলে যতদিন চালানো যায়। বিস্কুট খেতে হবে ঘন্টায় ঘণ্টায়। —ড্রিংক করো? ঝাল মশলা খাও? -আজ্ঞে প্রথমটা অকেশনালি, দ্বিতীয়টা মাঝে মাঝে। —মেক দ্য অকেশনস রেয়ার। নইলে ওষুধে কিছু হবে না। পেটের লাইনিং কেটে সব বাইরে চলে আসবে।

    সেইভাবেই পরীক্ষা দিলাম। এক ঘন্টার বেল পড়লেই নিস্তব্ধ এগ্‌জামিনেশন হলে কে কুড়মুড় শব্দ করে থিন-অ্যারারুট বিস্কুট খায়। সবাই কান খাড়া করে শোনে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কুড়মুড় কুড়মুড়। ওই আবার এসেছে কুড়মুড়াসুর। লোকজনের বিরক্ত মুখ। পরীক্ষার হল না পিকনিক? একদিন ইনভিজিলেটর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে আধ-ডজন বিস্কুট খাওয়া দেখলেন। কিছু বললেন না। মুখে চাপা আনন্দ। ইনভিজিলেটর আমার পক্ষে। তাঁর নিজের কোন চুলকানি-দুরূহ গোপন চর্মরোগ আছে কে জানে!.. ”

    *********

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “… পরীক্ষার পর নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ। মদ খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। হারু ল কলেজে ভর্তি হবে কিনা ভাবছে। সেই সূত্রে কলকাতা গেল। অশৌচ কবে কেটে গেছে কিন্তু আমি আর বনমালী মনে মনে মড়া ছুঁয়ে বসে আছি। বনমালী লাইব্রেরি থেকে কিছু সাধু সন্ন্যাসীর বই এনেছে পড়বে বলে, কিন্তু পড়ছে না।

    মাস দেড়েক কি দুয়েক পর একদিন দেবুদা আমাদের বাইরে খাওয়াতে নিয়ে গেল। পলাশ দেবুদার স্কুটারের পিছনে বসেই এল। কনট প্লেস-এর একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত জায়গা। বনমালী আর আমি আগেই গিয়ে বসেছিলাম। বনমালী একটা বিয়ার আনিয়েছে। পলাশদের স্কুটারে আসতে দেখে বলল—আশ্চর্য! ওরা ঠিক প্রেম করে যাচ্ছে! লাইক বার্ডস অ্যান্ড বীজ্‌। ওয়াইল্ড গীজ্‌!

    আমি বললাম—রেগে আছিস তো এলি কেন? জলধরের জন্য পুরো পৃথিবী থেমে যাবে নাকি? তুই মরলে জলধর সাধু হয়ে যেত?

    বনমালী শান্ত গলায় বলল—পলাশের প্রতি তোর দুর্বলতাটা খুবই অশ্লীল।

    বনমালী আমার সাথে ইচ্ছে করে একটা ঝগড়া বাধাতে চাইছে বুঝতে পেরে আমি চুপ করে রইলাম। দেবুদা অফিস থেকে ফিরেছে, এবং গলায় টাই। পলাশ যথেষ্ট সাজগোজ করে এসেছে। এসব দেখে বনমালী ভিতরে ভিতরে আরো রেগে গেছে সেটা বুঝতে পারছি। আমি কিছু বললে আরো খারাপই হবে। সবচেয়ে বড়ো ভয় দেবুদার সামনেই অনুচিত কিছু যদি বলে ফেলে!

    দেবুদা এসেই বলল—কি খাবে বলো? ড্রিংক্‌স আনাই?

    পলাশ লাইম-জুস আনালো, আমি মিল্কশেক। দেবুদা নিল একটা বিয়ার। বনমালী আমার চোখের নিষেধ অগ্রাহ্য করে একটা হার্ড ককটেল অর্ডার করে বসে রইল। যতক্ষণে সেই ককটেল এল, ততক্ষণে তার আগের বিয়ারটা সে শেষ করেছে।

    দেবুদা আর আমি অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলছি। ওদের প্রেম, বিয়ে, জলধরের শেষ হয়ে যাওয়া, আমাদের শোক এসব নিয়ে ইচ্ছে করেই কেউ কিছু বলছি না। পলাশ কিছুই বলছে না। আমি পলাশ আর বনমালীর মুখ দেখেই মনে মনে প্রমাদ গুনেছি। কিন্তু দেবুদা বনমালীকে চিরকাল চুপচাপ জেনেই কিছু বুঝতে পারেনি বা সেই ভাব দেখাচ্ছে। ককটেলের পর এল খাবার। বনমালী আরেকটা বিয়ার আনালো। পলাশের মুখ যথেষ্ট থমথমে। লাল হয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত দেবুদা প্রথম ভুলটা করল।

    পলাশের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে দেবুদা গলা নামিয়ে বলল—তোমাদের একটা কথা আগেই জানিয়ে দিচ্ছি। এখনই কাউকে বোলো না। ব্যাপারটা আমাদের মধ্যেই থাকুক। আমাদের বিয়ের একটা টেনটেটিভ ডেট ঠিক হয়েছে। আগামী দুমাস আমি বাঙ্গালোরে থাকব। ফিরবো অগাস্টে। সেপ্টেম্বরে বিয়ে।

    বনমালী উদ্ভাসিত মুখে অমনি দুহাত তুলেছে হুর্‌রে!

    আমি তাড়াতাড়ি বললাম—কনগ্র্যাচুলেশনস।

    কিন্তু ছাড়বে না বনমালী। সে বাঘের মতো পলাশের দিকে ঝুঁকে ভাঙা গলায় বলল—এটা কি এনগেজমেন্টের পার্টি, পলাশ?...”

    ************

    রাহুলের ডায়েরি:

    “... দেবুদা একটু থতমত খেয়ে গেছে। —তা ঠিক নয়। সেরকম ফর্মাল এনগেজমেন্ট কিছু হচ্ছে না।

    —ইনফর্মাল এনগেজমেন্ট বোধহয়। বনমালী কেটে কেটে বলে। পলাশই বনমালীর লক্ষ্য।

    এতক্ষণ পলাশ কোনো কথা বলেনি। এবার চামচটা প্লেটে রেখে সে টেবিলে দুহাত ভাঁজ করে বসল। ক্লান্ত একটা দৃষ্টি। যেন, যা বলার বল!

    বনমালী ভ্রুক্ষেপ না করে খেয়ে যাচ্ছে। —পার্টি দেওয়া খুব ভালো, আমরাও একটা দেব শিগগির।

    আমরা মানে? আমরা মানে কে? দেবুদা? পলাশ? আমি? প্রশ্নটা মাছির মতো ওড়াউড়ি করছে। কেউ বলছে না। বনমালীই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেয়। —আমরা কজন আর কি। হারু, রাহুল, শ্যামল, আমি। তুইও স্পনসর হতে পারিস।

    দেবুদা বলল—কিসের পার্টি?

    বনমালী একটুও না আটকে বলে-–ফেয়ারওয়েল পার্টি। পার্টি ছাড়া কাউকে পুরোপুরি বিদায় করা যায় না। সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে যে জলধর ইজ নো মোর। ভালো হবে না?

    বনমালীর চোখ একেবারে লাল। কোয়াইট ড্রাংক। স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। দেবুদা চট করে চেয়ারটা পিছনে করেই উঠে দাঁড়িয়েছে। —একটু বাথরুম হয়ে আসছি বুঝলে! এত বিয়ার পেটেও পড়েছে। ব্লোটেড হয়ে গেছি। তোমরা খেতে থাকো।

    দেবুদা চলে যেতেই পলাশ ঝুঁকে আমায় বলল—আমার উপর তোরা এমন রেগে আছিস কেন বলতো? তোরা জানিস না আমি এখন বিয়ে করতে চাইনি?

    পলাশের উপর আমার এতটুকু রাগ ছিল না। মদও খাইনি। কিন্তু বনমালীর পাশে বসার ফলেই আমার কি হোল কে জানে। মুখ ফসকে একটা অদ্ভুত কথা বেরিয়ে গেল। বললাম—কিন্তু প্রেম করতে চেয়েছিলি!

    শুনে পলাশের চোখ হঠাৎ আকস্মিক ধ্বক করে জ্বলে উঠেছে। বুঝেও বুঝলাম না আমি। কি বলে ফেললাম? কি করে বেরোল মুখ দিয়ে?

    পলাশ আস্তে করে বলল—আর তুই? তুই কোনোদিন কারো সাথে প্রেম করতে চাসনি?

    আমি আর পলাশ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি। একটা জমাট, নিস্তরঙ্গ, নিহৃদয়তার ব্যবধান। আস্তে আস্তে দূরে করে দিচ্ছে আমাদের। কি চেয়েছিলাম, কোন দিকে যাচ্ছি! পলাশ আমাকে এরকমভাবে বলতে পারল?

    সব বুঝতে পেরেও আমার ভিতর থেকে একটু একটু করে রাগ, ক্রোধ, ব্যর্থতা, ভালোবাসা এবং ঘৃণা বেরিয়ে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিকে কাবু করে দেয়। ওদিকে বনমালী আমাদের দিকে তাকিয়ে বিয়ারের গ্লাসে সিপ দিয়ে বলল—ডার্টি বিজনেস। অশ্লীল! দেবুদার সামনে একটা সিন করিস না তোরা। প্লিজ...”

    ********

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “... সেইদিনই পলাশের সাথে ছাড়াছাড়ি। যেটুকু ছিল, সমস্ত কাট-অফ হয়ে গেল। জলধরের মতো নয়। হুট করে অকারণ চলে যাওয়া নয়। এমন নয় যে সবার অনিচ্ছার মুখে ছাই দিয়ে ডেস্কভর্তি বই, সেকেন্ড-ইয়ারের পরীক্ষা, রাজনীতি, অ্যাডজর্ন-করা দাবার ছক, সব ছেড়ে হেলাফেলায় ঘর খালি করে চলে যাওয়া। কিন্তু জলধরের পরেই পলাশও গেল। নাকি আগেই গিয়েছিল। টের পাইনি। দুবারই কিছু করতে পারিনি। শুধু পলাশের যাওয়াটা আর কেউ জানলো না। বুকের উপর থেকে একটা পাহাড়ি পাখির ভারি পালক নেমে গেল যেন। সবার অলক্ষ্যে, তবু কষ্ট হলো।

    তারপর জানতাম শুধু বাকি আছে বনমালী। এরপর আর কি হতে পারে?

    বনমালীর সঙ্গে সেঁটে রইলাম। সন্ধেবেলা ওডিয়ন, রিভোলি, প্লাজা, শীলার সামনে টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। টিউশনি সেরে ফিরত বনমালী। কোনো কোনো দিন এত দেরি করত—হলের সিঁড়িতে বসে মুখ কালো করে আমি ভাবতাম আমাকে টিকিট ব্ল্যাকারই মনে হচ্ছে বোধহয়। ভীষণ লোভ হতো। কিছু এক্সট্রা কেটে রাখলেই হয়, নিজেদের খরচটা উঠে আসে। হয়তো ধাপে ধাপে উঠে যেতে পারি। আজ এই হল্‌, কাল ওই হল্‌। পিছনে ইঁদুরের মতো পাবলিক, পুলিশ। খুব বেশি খাটনিও নেই। বনমালীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে পার্ট-টাইম। কত কি যে কুচিন্তা মাথায় আসত তার ঠিক নেই। কিন্তু কোনোদিন ওপথে পা বাড়াইনি।

    বনমালী এক একদিন আধঘণ্টা একঘণ্টা পরে এসেও আমাকে সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে বোধহয় অবাক হয়ে যেত। অতঃপর হাতড়াতে হাতড়াতে অন্ধকারে সিট খুঁজে বের করা। এর কোলে বসে, ওর হাঁটুতে হাত রেখে নাসির, মিঠুনদার জগতে ঢুকে পড়া। তিনঘন্টা বাহ্যজ্ঞানহীন। সমস্ত জাগতিক শোচ্যাশোচ্যের উর্ধ্বে।

    লেখালিখি তখনই ছেড়ে দিয়েছি। সত্যিকারের কবিতা বলতে যা বোঝায় তা আমার জন্য নয়। লেখার সঙ্গে সঙ্গে পড়াও ছেড়ে দিলাম। লিখব না যখন তখন পড়েই বা কি হবে? তাছাড়া যা পড়তে ভালো লাগত সবাই বলে সেগুলোই অপাঠ্য। বাজে লেখা। তাহলে হয়তো ড্রাগের মতো ভুল জিনিসেই আসক্ত ছিলাম। ছেড়ে দেওয়া যখন সহজ তখন ছাড়াই ভালো। যাঃ!

    একদিন সিনেমা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমের মধ্যে মনে হলো নতুন জীবন শুরু করেছি একটা। অন্য জীবন, অন্য নাম। বাঙালিই নয়। চেনাজানা কেউ নেই সেই স্বপ্নে। একেবারে অপরিচিত একটি বোরখা পরা মেয়ের সাথে হিন্দীতে কথা হচ্ছে। চিনি না। মুখ তো দেখাই যাচ্ছে না। কিন্তু হাবভাবে মেয়েটি এত স্বতন্ত্র, কোনো চেনা মেয়েকে এতটা জীবন্ত ভাবে দেখিনি। ঘুমের মধ্যে মেয়েটির নাম ঠিকানা কিছুই জানতে পারলাম না। দেখতে কেমন সেটাও মনে করতে পারিনি পরে। শুধু তার কথাবার্তা, ব্যবহারের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস, এমন স্বকীয়তা, মর্যাদাবোধ ছিল যা কোনো কাল্পনিক চরিত্রের হতেই পারে না।

    সুতরাং এই চরিত্র আমি কোথাও দেখেছি, বা মেয়েটি কোথাও আছে। আবিষ্কারের অপেক্ষায়। রাজার বাড়িতেও হতে পারে, গণিকালয়েও হতে পারে। সব জায়গাতেই চোখ কান খুলে রাখা দরকার। তার ব্যক্তিত্ব হলো তার অভিজ্ঞান। আমাকেই চিনে নিতে হবে। এমন যেন কিছুতেই না হয় যে সে পাশ দিয়ে চলে গেল আর আমি দুষ্ম্যন্তের মতো রাজকার্য নিয়ে ব্যস্ত। আর আমার রাজকার্য যে কি ঢপের তা তো জানাই আছে। জীবনে একটি মাত্র কাজের কাজ করেছি। একবার ক্যাম্প-এর কাছাকাছি রাস্তায় একটা রোগা খেঁকুরে লোক ধুঁকতে ধুঁকতে মদের দোকানের খোঁজ করছিল। তাকে চট করে টিবি হাসপাতালের দিকে রওনা করে দিয়েছিলাম। হারু ব্যাপারটা দেখে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল। তার বেশি কিছু পাইনি, পাওয়ার কথাও নয়।

    ঘুম ভাঙতেই একটা উল্লাস বোধ করলাম। মনে হলো মেয়েটি হলের ভিতরেই কোথাও আছে। ব্যালকনির সিটে বসে আছে আপাদমস্তক কালো বোরখা পরে। সেরকম হলে যে ভাব করাই কঠিন হবে এ সমস্যার কথা মাথায় এলো না। তখন শুধু মনে হলো—আমায় হিন্দী-উর্দু-ফার্সী প্রভৃতি ভাষা ভালো করে শিখতে হবে। গালিব আর হাফিজ পড়ে প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে। উর্দুতে গজল লেখার সাথে সাথে চলবে অন্বেষণ। এমন একটা নতুন, প্রীতিজনক অ্যাডভেঞ্চার জীবনে এসে গেছে জেনেই সেই উল্লাস। যেন বিপুল বড়লোক হয়ে গেছি। জামসেদজি দত্তক নিয়েছেন। কিম্বা পদ্মবিভূষণ পেয়ে গাঁদাফুলের কেজি কেজি মালার মধ্যে হর্ষমত্ত সম্বর্ধনা।

    হাসতে হাসতে পাশের সিটে বসা বনমালীর ঊরুতে চাপড় মারতেই সন্ধ্যাটি পণ্ড। সেই চাপড় ফিরে এল গালের চড় হয়ে। মধ্যবয়স্ক অন্য একটা লোক—চেনাজানা কিছু নেই—আমার পাশের সিটে বসেছিল। প্রথমে সে লাফিয়ে উঠে গাল দিয়েছে। তারপর আমাকে হাসতে দেখে মেরেছে এক চড়। সেই ধাক্কায় আমার তন্দ্রা পুরোপুরি কেটেছে এবং আমি কিছুতেই ঠাহর পাচ্ছি না—অন্ধকারে এই নোংরা মাতাল অপরিচিত গন্ধের খলিফার পাশে আমি এলাম কি করে? বনমালীই বা কোথায়?

    তারপর দু-টাকার সিটে বসে টাকা বাঁচাবার যা ফল হয় তাই হাতেনাতে টের পেয়েছি। গুঁতোগুঁতি, কোস্তাকুস্তির মধ্যে সামনের চারটে সারি জুড়ে বাঁদরের নৃত্য। সকলেই চায় অন্যরা চুপ করুক। তাই সে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। বনমালীও জিব্রীলের মতো যথাসময়ে এসে পড়ল এবং যে লোকটা আমায় মারছিল তাকে পিছন থেকে চুলের ঝুঁটি ধরে তুলে নিল। আমার গলায় এতক্ষণ যা আটকেছিল তা সেই ঝাঁকুনিতে মুখে। কাশতে কাশতে একটু কফ তখন আমি না চেয়েই লোকটার পায়ের উপর থুক করে ফেলেছি।

    ওটাই সেদিন আমার একমাত্র অপরাধ। কিন্তু প্রোজেক্টর বন্ধ করে আলো জ্বালিয়ে আমাদের ধরে নিয়ে গেল বাইরে। আমি লাইটম্যানদের মাঝখানে মাথা নিচু করে—ধরা পড়া হোমোসেক্সুয়াল—যাতে তাবৎ হলের লোক দেখলেও বোরখা পরা কেউ চিনতে না পারে।

    ম্যানেজারের ঘরে ঢুকিয়ে চোখ রাঙানি। কিন্তু ততক্ষণে বনমালী আর আমি দুজনেই টুটোফাটা ইংরেজিতে কথা শুরু করে দিয়েছি। মিথ্যে করে বললাম—ওই লোকটাই আমার জামার ভিতর হাত ঢোকাচ্ছিল। গালে গাল ঠেকাতে চাইছিল। লোকটার জামাকাপড় নোংরা, মুখে বিড়ির গন্ধ। মদের গন্ধ। তার কথা কে বিশ্বাস করবে? প্রমাণের অভাবে দুজনকেই কড়া ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল।

    বাইরে এসেও, আশ্চর্য, উল্লাসটা যায়নি। বনমালী বলল—লেগেছে? আমি হা হা করে হাসছি—তুই তো মেরেছিস। আমিও কফ ফেলে দিয়েছি পায়ে। তার কাছে একটা দুটো চড় লাগে না।

    বনমালী বলল—সরি। ঘুমোচ্ছিলি তাই জাগাইনি। হাফ-টাইমে বাথরুমে যাব বলে বেরোলাম। এত লম্বা লাইন, দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়েই আছি। মুত-পাগল লোক সব। সিগারেট ধরালাম একটা। হিসি করে সিগারেটটা শেষ করে যখন ফিরলাম তখন ব্যাটারা আলো নিভিয়ে দিয়েছে। তোকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বাঁদিকে একটা ফাঁকা রো দেখে বসে পড়েছি।

    বললাম—কুছ পরোয়া নেই। দরকারের সময় যে ছিলি সেটাই যথেষ্ট।

    কনট প্লেস-এর ফাঁকা রাস্তায়, পার্কে সেই আগের মতো হাসতে হাসতে ঘোরাফেরা করছি। বনমালীকে স্বপ্নের কথা বললাম। মনোযোগ দিয়ে শুনল। বলল—আগের কোনো চেনা মেয়েই হবে। তখন কোয়ালিটি চিনতে পারিসনি। দেরিতে অঙ্ক বুঝতে পারার মতো এখন মাথাটা খুলছে। মুখটা মনে আছে? আমি বললাম—দেখিই নি তো। বনমালী তখন পেট, কোমর, পিঠ, নিতম্ব, স্তন ও উরু মনে আছে কিনা এই নিয়ে সিরিয়াসলি জেরা করে গেল।

    শুধু ব্যক্তিত্ব, আত্মাভিমান আর কথা বলার ধরনে কি একটা মেয়েকে মনে রাখা, চিনে ফেলা সম্ভব? জলধর থাকলে এর ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা পেতাম কিছু নিশ্চয়ই। জলধর তো আর নেই। আছে শুধু বনমালী। সে আমার স্বপ্নে দেখা মেয়েটিকে নিয়ে ঠাট্টা করে যাচ্ছে। আমি তাতেই খুশি হচ্ছি। এরপর বনমালীর সাথে যেন কাট-অফ না হয়ে যায়। ঈশ্বরকে ডাকছি।

    এইটে তুমি দেখো...”

    ************

  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments