• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • প্রতিবেশী মিয়ানমার : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


    ছোটবেলায় লুকিয়ে শরৎচন্দ্রের “পথের দাবী” পড়তে গিয়ে বার্মা দেশের নাম জেনেছিলাম। তারপর ভূগোল বইয়ে বার্মার সেগুন কাঠ, চাল ইত্যাদি জানলাম। ব্যাস। অন্যান্য প্রতিবেশী পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার খবর যেমন কাগজে বা টিভিতে পাই (যদিও সবই যুদ্ধের খবর), বার্মার নামও শুনি না কোথাও। এ যেন একই পাড়ার একটা বাড়ি দরজা-জানলা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে রেখেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। এইমাত্র দরজা খুলল। এখন একটু উঁকি না মেরে থাকা যায়?

    ব্রিটিশ শাসনের সময় শরৎচন্দ্রের মতন আরও অনেক ভারতীয় বার্মাতে চাকরি, ব্যবসা ও বসবাস শুরু করেন। অনেক বাঙালিবাবুরা উঁচুপদে বহাল ছিলেন। বলাবাহুল্য বার্মিজরা তাদের ভালো চোখে দেখেননি, অনেকটা উগান্ডা বা ফিজির মতই। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয়দেরও উৎখাত করা হল। এখন ওদেশে ভারতীয়দের সংখ্যা খুবই কম। আমি একজনও দেখিনি, ট্যুরিস্টদের মধ্যেও না।

    ব্রিটিশ শাসনের পর এলো আরও ভয়ানক মিলিটারি শাসন। চলল প্রায় ষাট বছর। দেশটা ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে গেল। ২০১১ সালে গণতন্ত্র আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরিজ্‌ম-এর প্রভূত উন্নতি শুরু হয়েছে। এই কয়েক বছরেই এত উন্নতি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।


    "...ট্যুরিজ্‌ম-এর প্রভূত উন্নতি শুরু হয়েছে"
    বার্মার বর্তমান নাম মিয়ানমার। কিন্তু অনেকেই এখনো পুরনো নাম ব্যবহার করেন। দেশের নেত্রী আং সান সু চিও দুই নামের প্রচলন জারী রেখেছেন। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়ে বাইরে পৃথিবীতে যতই গোলমাল হোক, দেশের ভেতরে মিলিটারি প্রভাবিত সরকার খবরের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন। সু চি দেশের সবার প্রিয় নেত্রী, সবাই তাঁকে ‘দি লেডী’ বলে ডাকে। তাঁর বাবা আং সান আধুনিক বার্মা দেশের ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতার সময় আততায়ীর গুলিতে মারা যান। তারপর সু চির উত্থান, দীর্ঘ একুশ বছর গৃহবন্দী থাকা, সেই সঙ্গেই নোবেল শান্তি-পুরস্কার লাভ। এখনো সাধারণ লোকেরা সরকারের ওপর

    বিশ্বাস করে আর মনে করে রোহিঙ্গারা দেশদ্রোহী ও তাদের দেশ থেকে বের করে দেওয়াই ভাল। মিলিটারি প্রভাব এখনো বেশ, আমাদের পলিটিক্স নিয়ে আলোচনা করতে মানা করে দিয়েছিল। কে জানে কোথায় স্পাই লুকিয়ে আছে।

    বার্মা যাওয়ার আগে আমার দেশটা সম্বন্ধে বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। ভেবেছিলুম ভারত বাংলাদেশের মাঝামাঝি একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ। কিন্তু ইয়াঙ্গন-এ (রেঙ্গুনের আধুনিক নাম) নামামাত্র সে ভুল ভাঙল। ঝকঝকে শহরটি যে কোন বিলিতি শহরকে টেক্কা দিতে পারে। দিল্লী থেকে গিয়ে প্রথম চমক লাগল নিঃশব্দ গাড়ির ভিড় দেখে। ট্রাফিকের সুবিধের জন্য শহরের ভেতরে মোটর স্কুটার চালান বন্ধ, (শহরের বাইরে অবশ্য মেয়ে পুরুষ সবাই স্কুটার চালায়) কিন্তু সবাই নিয়মানুযায়ী যে যার লেন মেনে চলছেন, কেউ একবারো হর্ন বাজাচ্ছেন না! আমার চোখে এটা একটা মিরাকল বলেই মনে হয়। গাড়ি আছে প্রচুর, যানজটও, কিন্তু অন্যান্য এশিয়ার দেশের মতো কেউ হর্ন বাজিয়ে কানের বারোটা বাজাচ্ছে না। সবাই চুপচাপ। এ যেন আমেরিকায় ফিরে গেছি!


    পাত্র হাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সারি, মান্দালয়
    আরেকটা জিনিশ যা ভীষণভাবে চোখে পড়ে--শহরের পরিচ্ছন্নতা-- কোথাও এক টুকরো আবর্জনা দেখতে পাবেন না। কোথাও ছেঁড়া প্লাস্টিকের ব্যাগ বা বোতল জমে নেই, যেখানে-সেখানে পানের পিক, থুতু, ইত্যাদি পড়ে নেই, ভাঙা ফুটপাথে ইট সুরকির পাহাড় নেই, এমনকি গরিবের কুঁড়ে দোকানও তকতকে পরিষ্কার! এটা শুধু বড় শহরের ধনী এলাকাতেই নয়, সারা দেশেই আমি এটা দেখেছি। (আমার গোঁ ধরেছিল যে একটু আবর্জনা আমাকে দেখতেই হবে। অনেক খুঁজে পেতে শহরতলিতে একটা বাড়ির পেছনে আমি একটা আস্তাকুঁড় দেখে একটু স্বস্তি পেয়েছিলুম।)

    এমন পরিচ্ছন্নতা ও গাড়ি চালানোর শৃঙ্খলা এরা কোত্থেকে পায়? আমরা ভারতীয়রা বেশি ধনী ও উন্নত হয়েও কেন এসব করতে পারি না? এসব কি পঞ্চাশ বছরের মিলিটারি শাসনের ফল, না হাজার বছরের বৌদ্ধধর্মর প্রভাব? কে জানে!


    শ্বেডাগন প্যাগোডা, রাত্তিরে--ইয়াংগন
    ইয়াঙ্গনে ব্রিটিশ শাসনের চিহ্ন প্রায় নেই বললেই হয়। সব জায়গায় পুরনো বাড়িঘর ভেঙে নতুন ট্যুরিস্ট হোটেল তৈরি চলছে। তবু, যতই আধুনিক হোক না কেন, প্রতি পাড়ায় ছোট বড় বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা ঠিক দেখা যাবে। বার্মিজরা প্রতিশত নব্বুই জন কট্টর বৌদ্ধ। ইয়াঙ্গনে আছে দেশের সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে উঁচু, সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ প্যাগোডা শ্বেডাগন। এর পত্তন হয়েছিল ৫৮৮ খ্রিঃ পূঃ বুদ্ধের মৃত্যুর ঠিক পরেই। বুদ্ধের মাথার চুল নাকি এই মন্দিরে রাখা আছে। তাই এটা সারা পৃথিবীর বৌদ্ধদের পুণ্যভূমি। প্যাগোডার গোল চূড়াটা পুরো সোনা দিয়ে মোড়া। চূড়ার ওপরে মুকুটে আছে ৪৫০০ হীরে, মুক্তো, চুনি, পান্না ইত্যাদি মণিমাণিক্য। যাতে সবাই ভাল করে দেখতে পায়, দূরবীন লাগানো আছে, enlarged ফটোও আছে। ২৫০০ বছরের পুরনো এই মন্দির প্রতি দিন পূজারি ও ভক্তদের ভিড়ে ভর্তি। (বার্মায় প্রচুর সোনা, চুনি ও জেড-এর খনি আছে। ইয়াঙ্গন এয়ারপোর্টের কাছেই একটা প্যাগোডা আছে যেটা আগাপাশতলা জেড দিয়ে তৈরি।) বার্মায় মন্দির বা প্যাগোডায় ঢুকতে হলে জুতো খুলতে হবেই, মোজাও খোলা দরকার, শর্টস বা হাতকাটা জামাও চলবে না। অথচ বাইরের নেড়িকুকুর স্বচ্ছন্দে মন্দিরের মধ্যে আসাযাওয়া করে, হিন্দু মন্দিরে এটা কল্পনাও করা যায় না।


    ছোট্ট ভিক্ষু-ভিক্ষুনিদের দল
    বার্মায় আমি কোন ভিখারি দেখিনি। মন্দিরের আশেপাশে কোন অন্ধ বা পঙ্গুদেরও দেখা পাইনি। দোকানবাজার, রাস্তাঘাট, সব জায়গাতেই গেরুয়াধারী বৌদ্ধ পুরোহিত, শিক্ষক বা ছাত্রদের বিচরণ। প্রতিদিন ভোরবেলায় খালি পায়ে ভিক্ষুদের বাটি হাতে ভিক্ষায় বেরতে দেখা যায়। সারা দিনের খাওয়া এতেই চলে যায়। পাড়ায় খালি পা দেখলেই এঁদের ভিক্ষু বলে চেনা যায়। সাত আট বছর বয়েস থেকেই প্রত্যেক বর্মী ছেলেমেয়ে অন্তত দুবছর বৌদ্ধ মঠে শিক্ষা নেয়। অনেকেই সারা জীবন মঠেই কাটান। প্যাগোডার মতই সারা দেশে অনেক মঠ ছড়ান আছে। মেয়েদের জন্য আলাদা আয়োজন-- nun-দের কনভেন্টের মতই। ছেলেদের মত মেয়েরাও মাথা কামায়। ছেলেরা পরে গেরুয়া আর মেয়েদের পোশাক গোলাপি।


    সারি-বাঁধা বুদ্ধ, মান্দালয় হিল্‌স

    রাজধানী ইয়াঙ্গন বার্মা দেশের দক্ষিণ প্রান্তে, ইরাবতী নদীর মোহানায়। (নদীটাকে ঐরাবতিও বলে অনেকে--হয়ত বরষায় হাতীর মত ফুলে ওঠে বলেই)। নদী ধরে উত্তরে চললে পথে পড়ে ঐতিহাসিক পুরনো শহর ‘বাগান’ যা ৯ থেকে ১৩ শতাব্দী পর্যন্ত বার্মার রাজধানী ছিল।

    বাগানের বিশেষ দ্রষ্টব্য তার ২২১৭-টি প্যাগোডা। ছোট, বড়ো, লম্বা, গোল, ভাঙা, আস্ত নানা ধরনের প্যাগোডাগুলি ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছড়ানো। ১৩শ শতাব্দীর পরে প্যাগোডাগুলি অনেক বছর জঙ্গলে ঢাকা পড়েছিল, ১৯৭৫ সালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সরকার ও UNESCO-র নজরে পড়ে এবং রাতারাতি দেশের সবথেকে বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট হয়ে ওঠে। প্রতিটি প্যাগোডা একে অন্যের থেকে আলাদা। কোনোটা হিন্দু মন্দিরের মত, কোনোটা শ্রীলঙ্কার প্যাগোডার স্টাইলে তৈরি, কারুকার্য সত্যিই হাঁ করে দেখার মত।

    বাগানের সবথেকে বড়ো আনন্দমন্দির। এটা চোখ-ধাঁধানো সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি। মন্দিরের বুদ্ধ এক দিক দিয়ে দেখলে স্মিত মুখ, অন্য দিক থেকে রুষ্ট মুখ মনে হয়। এই মন্দিরটাও ভূমিকম্পে বেশ ভেঙে গেছিল, ভারত সরকারের সাহায্যে আবার মেরামত করা হয়েছে, এই একমাত্র জায়গায় আমি ভারতের নাম লেখা কৃতজ্ঞতা ফলক দেখলাম।


    ইরাবতী নদীতে সূর্যাস্ত
    বাগানে বিরাট বিরাট বাগানবাড়ি ও ক্ষেতে বিদেশি টুরিস্টদের জন্যে রিসর্ট হোটেল করা হয়েছে। শহরটা ছোট, ভাড়া স্কুটার চালিয়ে সব প্যাগোডা ঘুরে দেখা যায়। তাছাড়াও ইরাবতীতে বোটিং করে সূর্যাস্ত দেখা, (বার্মিজরা সূর্যাস্ত খুব ভালবাসে, অন্য কিছু না থাকলে ওরা একটা মাটির ঢিবি বানিয়ে তার ওপর চড়ে সূর্যাস্ত দেখে)। পাশের গ্রামে কেনাকাটা করা--ওখানকার ল্যাকারের কাজ খুব প্রসিদ্ধ--আর সবথেকে পপুলার (এবং সবথেকে দামীও) হট এয়ার বেলুনে চড়ে ভোরবেলা বাগানের প্যাগোডার বাগান দেখা, এইসব নিয়ে বাগান ট্যুরিস্টে জমজমাট।


    সোনায় মোড়া বুদ্ধ, মান্দালয়
    বাগানে প্যাগোডার বুদ্ধ মূর্তিগুলি দেখে আমার মনে হল বার্মিজ থেরাবাদি বুদ্ধ ভারতীয় মহাযান বুদ্ধের থেকে বেশ আলাদা। আমাদের গাইড বোঝাল, ভারতীয় বুদ্ধের তুলনায় বার্মার বুদ্ধের কপালে টিপ নেই, মাথার চুল কোঁকড়ান নয়, সোজা, কানদুটি অনেক লম্বা, প্রায় কাঁধ ছোঁয়, চোখ সবসময় খোলা, হাতের চারটে আঙুলই সমান লম্বা, এবং স্তনবৃন্ত, নাভিমূল ও হাঁটু দেখানো হয় না। সুযোগ পেলে মিলিয়ে নেবেন।

    বাগান থেকে ইরাবতী বেয়ে আরও উত্তরে গেলে পড়ে বার্মার দ্বিতীয় প্রধান শহর মান্দালয়। নাম শুনলেই কিপলিং-এর রোমান্টিক কবিতা ‘Road to Mandalay’ মনে পড়বে। তবে আজকাল রেঙ্গুন থেকে মান্দালয়ের রাস্তা একটা ঝাঁ-চকচকে হাইওয়ে হয়ে গেছে। রোমান্স আর নেই।


    আকাশে বেলুনের ঝাঁক, বাগান
    মান্দালয় বার্মার সাংস্কৃতিক রাজধানী। বার্মার বেশিরভাগ নামকরা স্কুল, কলেজ, স্থাপত্য, কারিগরি বিদ্যা, এমনকি বৌদ্ধধর্ম শেখানোর মঠও এই শহরে। মহাগান্দেওন নামক একটি বিখ্যাত ১৫০ বছরের পুরনো মঠে গেছিলাম। সেদিন এক ধনী পরিবার সবাইকে দুপুরের ভাত খাওয়াচ্ছিলেন। আমরাও বসে গেলাম। বড়ো থেকে ছোট পর্যন্ত সব শিক্ষক ও ছাত্ররা লাইন করে নিঃশব্দে নিজেদের ভিক্ষাপাত্রে খাবার নিয়ে নিজেদের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে গেল। সবই নিঃশব্দে, খাওয়ার সময় কেউ কথা বলে না। সাত বছরের ছোট্ট ছেলেদেরও এরকম ডিসিপ্লিন দেখে অবাক হতে হয়।

    বার্মিজ খাবার ভারতীয় ও চাইনিজের মিশ্রণ। ভাত অবশ্যই প্রধান কিন্তু ন্যুডলসও খুব প্রিয়। ভাতের সঙ্গে মরশুমি শাকসবজি দিয়ে একটা সালাদ আর মাছ বা মাংসের কারি। মিষ্টি পদ বলতে ফল ছাড়া কিছু নেই তবে তেঁতুল আর গুড় দিয়ে একটা লজেন্সের মত মিষ্টির খুব চল। আমি ভেবেছিলুম বাংলাদেশের মত নারকোলের খাবার পাওয়া যাবে কিন্তু তা নেই। শুধু একটু মিষ্টি স্বাদের নারকোল-ভাত ছাড়া আর কোন নারকোল দেওয়া খাবার দেখিনি। কিন্তু ডাবের জল আর নারকোল গাছ সব জায়গায় দেখেছি।


    মুখে তানাকা-মাখা বর্মী সুন্দরী
    বার্মার জাতীয় পোশাক পুরো পা-ঢাকা লুঙ্গি। মেয়েদের লুঙ্গি বেশ রংচঙে, সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ, ছেলেরা শুধু শার্টই পরেন। আরেকটা ফ্যাশন মেয়েদের মুখে মাখার ক্রিম তানাকা, শ্বেতচন্দনের মতই। ছোট, বড়ো সবার দুই গালে তানাকা লাগানো। তানাকা গাছের (?? Murraya spp.) বাকল পাথরে ঘষে পেস্ট করে লাগায়, এটা নাকি ত্বক নরম রাখে আর সানস্ক্রিন-এর কাজ করে। বাজারে বাকলের গোছা কিনতে পাওয়া যায়, রেডিমেড ক্রীমও কেনা যায়। আমিও লাগিয়ে দেখেছি, চন্দনের মতই সুন্দর। অন্য কিছু আর লাগাবার দরকার পড়ে না। দেখেছি গালে তানাকা লাগালে খুব চট করে অন্য তানাকামণ্ডিত মহিলাদের সঙ্গে ভাবও করা যায়।

    বার্মায় শুধুমাত্র একজনের দেখা পেয়েছিলাম যিনি ভারতে বেড়িয়ে এসেছেন। ভদ্রলোক দোকানদার, আমরা ভারতীয় শুনে একগাল হেসে জানালেন তিনি অনেকবার ইন্ডিয়া গেছেন। আমি একটু অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম কোথায় গেছিলেন? চোখ টিপে হাসলেন, মিজোরাম! বর্ডার নাকি একেবারে খোলা, জঙ্গুলে। কোনো পুলিশ বা কাস্টমসের বালাই নেই। স্বচ্ছন্দে আসাযাওয়া করা যায়। বুঝলাম চোরাই কারবারির ব্যাবসা। বার্মা থেকে ভারতের সীমান্ত প্রদেশগুলিতে এইভাবে প্রচুর ড্রাগও আসে।


    হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সোনার পরত তৈরি হচ্ছে, মান্দালয়
    মান্দালয়ে সবথেকে বিখ্যাত মহামুনি মন্দিরের বুদ্ধমূর্তির উচ্চতা সাড়ে বারো ফুট ও ওজন ছয় টন (সোনা ছাড়া)। প্রথানুযায়ী ভক্তরা প্রার্থনাপূরণের আশায় বুদ্ধের গায়ে দু ইঞ্চি সাইজের সোনার পাত লাগিয়ে দেন। পাতগুলি অবশ্য খুবই পাতলা--মিষ্টির ওপর রুপোর পরতের মতই। এভাবে সোনা দিয়ে মূর্তি বা মন্দির মুড়ে দেওয়ার চল সারা দেশে। একমাত্র মান্দালয়েই হাজার বছরের পুরনো প্রথায় এই পাতগুলি তৈরি করা হয় আর সারা দেশে বিক্রি হয়। একটা ছোটো সোনার টুকরো শক্ত চামড়ায় মুড়ে ভারি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে পাতলা করে ফেলে, তারপর সেটাকে আবার টুকরো করে কেটে পেটান হয়, একেবারে ফিনফিনে পাতলা করে ফেলে। তারপর সেগুলো দু ইঞ্চি সাইজে কেটে বিক্রি করে। যার যত সামর্থ্য ততোগুলি কেনে। মহামুনি বুদ্ধের মুখ ছাড়া আর সব জায়গায়, হাতে, পায়ে, বুকে, পেটে, এমনকি হাতের আঙ্গুলগুলো পর্যন্ত ছয় ইঞ্চি পুরু সোনায় ঢাকা। একমাত্র পুরুষ ভক্তরাই লাগাতে পারেন, মেয়েরা নয়। দেখলে মনে হয় বেচারা বুদ্ধ হঠাৎ আস্বাভাবিক ভাবে মোটা হয়ে পড়েছেন।


    পৃথিবীর বৃহত্তম ঘন্টা, মিনগুন গ্রাম
    এসব ছাড়াও মান্দালয়ের আশেপাশে অনেক ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য জায়গা ছড়িয়ে আছে। ইরাবতী নদীর উলটো পাড়ে মিনগুন গ্রামে আছে ২০০ বছরের পুরনো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো পেটানো লোহার আস্ত ঘণ্টা। আরও দুটি বড়ো ঘণ্টা মস্কো আর ফিলাডেলফিয়াতে, দুটোই ভাঙা। আরও আছে-- মান্দালয় পাহাড়ে গুহায় ৪৫টি বুদ্ধ মূর্তি, অনেকেই পুজো দিতে যান।

    পাহাড়ের কাছেই আছে কুথোড প্যাগোডা যার বাগানে আছে ৭২৯টি মিনি সাইজের প্যাগোডা, প্রত্যেকটির মধ্যে একটি চার ফুট সাইজের মার্বেল ফলক, তার ওপর পালি ভাষায় ত্রিপিটকের এক একটি পাতা খোদাই করা। সম্পূর্ণ থেরাবাদি বুদ্ধধর্মের বর্ণনা। এটা হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বই।


    পাথরের ফলকে খোদাই বইয়ের পাতা, মান্দালয়
    মান্দালয় থেকে আমরা চললাম দক্ষিণ-পূর্বে, থাইল্যান্ডের দিকে, শান প্রদেশে। প্রায় ১৬০ মাইল দূর, বাসে বা গাড়িতেও যাওয়া যায়; কিন্তু সময় বাঁচাবার জন্যে আমরা প্লেনেই গেলুম। পাহাড়ি জায়গা বলে আবহাওয়া সুন্দর। প্রায় পঞ্চাশ বর্গ মাইল জোড়া লেক ইনলে, তার তীরে জলের ওপরেই খুঁটি পুঁতে বিরাট বিরাট হোটেল আর কেবিন তৈরে করেছে। ইয়াঙ্গন ও মান্দালয় থেকে লোকেরা এখানে ছুটি কাটাতে আসে।

    ইনলে লেকের ধারে ছোটো ছোটো গ্রামে বাড়িঘর সব হয় নৌকোর ওপর ভাসমান নয়তো জলের মধ্যে উঁচু খুঁটির ওপর তৈরি। এরা খুব গরিব নয়। ভেতরে গিয়ে দেখলাম বেশ সাজানো-গুছনো ঘর, ইলেক্ট্রিসিটি, কেবল টিভি পর্যন্ত আছে। পাড়ায় আছে এইরকম ভাসমান ক্লিনিক, স্কুল, পোস্ট অফিস, পুলিশ স্টেশন, এমনকি একটা প্যাগোডা পর্যন্ত। যাতায়াত সব নৌকো করেই। এই লেকের বাসিন্দারা ইন্তা উপজাতি। বার্মায় প্রায় সত্তরটি উপজাতি আছে। বেশিরভাগ সীমান্তে পাহাড়ে, জঙ্গলে থাকে। রোহিঙ্গাদের মত কেউ কেউ স্বতন্ত্র হবার চেষ্টা করেছে কিন্তু মিলিটারি শাসন দাবিয়ে রেখেছে সবাইকে।


    এক পায়ে নৌকা চালানো, ইনলে লেক
    ইন্তারা সবাই জেলে, লেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে। পুরুষরা সারাদিন এই নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর মেয়েরা ঘরের কাজ সেরে সবাই মিলে সিগার (মোটা বিড়ির মত) বানায়। মেয়েপুরুষ সবাই সিগার খায়। কোন কোন জায়গায় লেকের জলে প্রচুর পানা জমে শক্ত মাটির মত হয়েছে, সেখানে লোকেরা শাকসবজির চাষও করে। এখানকার জেলেরা একটু অদ্ভুতভাবে নৌকো চালায়। নৌকোর ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাটা লগিতে জড়িয়ে নেয় আর সেই পা দিয়ে নৌকো চালায়। এইভাবে দুই হাতই জাল ছড়াবার ও গুটোবার জন্য খালি থাকে। এইরকম এক পায়ে নৌকো চালানো এই লেক ছাড়া আর কোথাও দেখা যায়না।


    গ্যাপ-বিল্‌ড স্টর্ক-দম্পতি, ইনলে লেক
    লেকের একদিকে আছে জলচর পাখির সংরক্ষণের পার্ক। অবশ্যই সেখানে একটা ঢুঁ মারতে হল। নানাজাতির পাখি--stork, মাছরাঙ্গা, পানকৌড়ি, বক, ইগ্রেট, পন্ড হেরন এবং অনেক ডাঙার পাখি দেখতে পেলাম। ঐ সময় stork-রা গাছের ওপর বাসা বাঁধছিল। বিরাট বিরাট পাখির ভারে গাছ প্রায় নুয়ে পড়ে। এই gap-billed stork-দের ঠোঁটের মাঝে ফাঁক, ওতে নাকি গুগলি শামুক ধরতে সুবিধা।

    লেকের একপ্রান্তে প্রতিদিন সকাল ছটা থেকে দশটা পর্যন্ত বাজার বসে। আশেপাশের গাঁ থেকে লোকেরা আসে, রোজকার মাছ, শাক সবজি, ফলমূল ইত্যাদি বেচাকেনা চলে। সবকিছুই নৌকোয় করে। বাজারে খাবার জিনিশ ছাড়াও কাপড়, জুতো, গয়না, পুঁতির মালা, ওষুধবিষুধও কিনতে পাওয়া যায়। দশটার পর যে যার নৌকো নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। একটা নৌকোয় দেখলাম বাদামী রঙের পিঁপড়ে ও পিঁপড়ের ডিম বিক্রি হচ্ছে, খেতে নাকি লেবুর মত স্বাদ। আরেকটা নৌকোয় এক গাদা আধুনিক ওষুধ-মলম। দোকানী উপসর্গ শুনেই ওষুধ বেছে দেন। দু একটা চেক করে দেখলাম অন্তত পুরনো expired ওষুধ নয়।


    গলায় আংটা পরা কায়ান মহিলা
    বাজারে নানা উপজাতিদের দেখা পাওয়া যায়, এদের গয়না বা পোশাক দেখেই চিনতে পারা যায়। এদের ভাষা বার্মিজ থেকে একেবারে আলাদা। কায়ান উপজাতির (অন্য নাম পাদাউং) মেয়েরা গলায় এক সারি পেতলের আংটা পরে থাকে। এতে নাকি গলা লম্বা হয়, আর কে না জানে যে লম্বা গলা সৌন্দর্যের প্রতীক। (কেউ কেউ বলে এটা শত্রুর ছুরি থেকে গলা বাঁচাবার চেষ্টা।) আসল কারণ কে জানে! কিন্তু প্রথাটা চলে আসছে অনেক কাল থেকে। ইদানীং এদের ফোটো তোলার জন্য ট্যুরিস্টদের ভিড় জমে, এদেরও কিছু উপরি রোজগার হয়।

    ইনলের বাজারে আরেকটা নতুন জিনিশ দেখলাম--পদ্মের ডাঁটা থেকে সরু আঁশের মত সুতো বার করে তাই দিয়ে শাল বা গায়ের চাদর বোনা। তসর সিল্কের মত দেখতে, কিন্তু ভীষণ দাম।

    বাগান, মান্দালয়, ইনলে ইত্যাদি বেড়িয়ে ফেরার পথে আবার ইয়াঙ্গন। একটা জায়গা দেখা বাকি ছিল--ভারতের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কবরস্থান। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহর পর বৃদ্ধ, পরাজিত মোগল সম্রাটকে ব্রিটিশরা বন্দী করে সুদূর বার্মায় নির্বাসন দেয় যাতে তাঁকে কেন্দ্র করে আর কোন বিদ্রোহ না গড়ে ওঠে। এই একই কারণে বার্মার শেষ রাজা থিবওকেও (১৮৭৮-১৮৮৫) সুদূর দক্ষিণভারতে রত্নগিরিতে নির্বাসিত করা হয়। ১৯১৬ সালে সেখানে তিনি মারা যান।

    দুর্বল শরীরে বাহাদুর শাহ মাত্র পাঁচ বছর কারাগারে বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা তাঁর কবরের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তারা চেয়েছিল সারা পৃথিবী এই অপদার্থ সম্রাটকে ভুলে যাক। কারাগারের পাশেই একটুকরো জমিতে তাঁকে কবর দেয়া হয়, পরে তাঁর স্ত্রী জিনতমহল ও ছেলে জওয়ান বখতকেও ঐ একই চিহ্নহীন জায়গায় কবর দেওয়া হয়।

    এরপর সবাই তাঁদের ভুলে যায়, কিন্তু ১৯৯৫ সালে কর্মীরা ড্রেন খুঁড়তে গিয়ে ইট দিয়ে ঘেরা একটি কফিন আবিষ্কার করে। ভেতরে শুকনো ফুলের নীচে দামী সিল্ক দিয়ে মোড়া সম্রাটের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। বার্মার মুসলমানদের অনুরোধে তিনটি কফিন আবার ভাল করে কবর দিয়ে, ওপরে একটা মসজিদ তৈরি করা হয়। এঁরা সম্রাটকে পীর বলে মনে করেন। তাই জায়গাটি এখন একটা পুণ্যস্থান। দেখে ভাল লাগলো যে নিরপরাধ, শান্তিপ্রিয়, রোমান্টিক কবি সম্রাট অবশেষে তাঁর উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের মোদী দুজনেই এখানে এসে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।


    বাহাদুর শাহ্‌ জাফরের সমাধিস্থান, ইয়াংগন
    জায়গাটা ইয়াঙ্গন শহরের মধ্যেই, শ্বেডাগন প্যাগোডা থেকে দক্ষিণে কিছু দূরে, সুন্দর, পরিষ্কার ছিমছাম। ভেতরে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা প্রার্থনার জায়গা। ওপরে সম্রাটের স্ত্রী ও ছেলের কফিন, কয়েক ধাপ নিচে মাটির তলায় সম্রাট একা। ভক্তরা চারদিক প্রদক্ষিণ করেন আর কফিনের ঢাকা চাদরের প্রান্ত ধরে প্রার্থনা করেন।

    আমরাও সম্রাটের কাছে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে ফিরলাম, এবার দিল্লির প্লেন ধরতে হবে।


    (ভ্রমণকাল---ডিসেম্বর ২০১৭)





    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)