অনেকদিন  বাদে  ব্যাংকক  গিয়ে  দেখলাম  তুক-তুক  বা  অটোরিক্সা  অনেক  কমে  গেছে। পঁচিশ  বছর  আগে  যখন  এসেছিলাম, ওরাই  ছিল  আমার  বাহন, মাঝে  মাঝে  মোটর  বাইকের  পিছনেও  উঠেছি। মনে  আছে  তুক-তুকের  ড্রাইভাররা  মাঝে  মাঝে  ভুলভাল  ইংরেজিতে  নানারকম  সাধু  প্রস্তাব  দিত। শহরে  হরেক  কিসিমের  লালবাতি  এলাকা  থাকতে  আমার  মতো  বিদেশী  ছোকরা  সন্ধ্যাবেলায়  একলা  হোটেলে  ফিরছে  দেখে  ওদের  খুবই  সমবেদনা  হতো  হয়ত। একজন  অনেক  কষ্ট  করে  আমাকে  বুঝিয়ে  বলেছিল  যে  কিছু  কিছু  ভারতীয়  ভদ্রলোক  যে  এখানে  এসে  মেয়ের  বদলে  ছেলের  খোঁজ  করে, সে  কথা  তার  বিলক্ষণ  জানা  আছে। সেসব  কথা  খোলসা  করে  বলতে  আমি  যেন  একটুও  সংকোচ  না  করি, এই  বিষয়ে  পতপঙ্গের  সেরা  জায়গাগুলো  তার  নাকি  নখদর্পণে। সে  তুরন্ত  আমাকে  নিয়ে  যাবে, তুরন্ত  ফেরৎ  আনবে, হোটেলে  আমার  বৌ  টেরও  পাবেনা। বলাবাহুল্য  তখন  আমি  বিয়ে  করিনি। দেশ  ছাড়ার  পরীক্ষা  দিতে  পয়সা  ধার  করে  ব্যাংকক  গেছি, এমনিতেই  মাথার  ঘায়ে  কুকুর  পাগল  অবস্থা। প্রাণপণে  আমার  পরিস্থিতিটা  বুঝিয়ে  বলার  চেষ্টা  করেও  যখন  ফল  হোল না  বরং  লোকটা  মানুষ  বাদ  দিয়ে  জীবজন্তুর  কথা  শুরু  করলো, তখন  তো  আমার  মেজাজ  চড়ে  গেছে। মজার  কথা, আমার  মুখে  একবার  পুলিশ  কথাটা  শুনেই  লোকটা  কেঁচো  হয়ে  গেছিল, বিড়বিড়  করে  থাই  ভাষায়  আমার  মুণ্ডুপাত  করতে  করতে  সোজা  হোটেলে  পৌঁছে  দিয়েছিল  সেদিন। তখন  জানতাম  না  যে  থাইল্যান্ডের  সবজায়গায়  ট্যুরিস্ট  পুলিশ  থাকে, এইরকম  অযাচিত  আদর  আপ্যায়নের  হাত  থেকে  বিদেশীদের  বাঁচানোই  তাদের  কাজ। এ  তো  গেল  ছেলেবেলার  কথা। এই  যাত্রায়  আমি  সত্যিই  বড়লোক  ট্যুরিস্ট, ভুঁড়িওয়ালা  মাঝবয়েসী  এবং  বাইশ  বছর  যাবৎ  আমেরিকাবাসী  হবার  দরুন  হাবভাবে  বেশ  একটু  গ্রাম্ভারী  চালিয়াতি  ফুটে  বেরোচ্ছে। দেখলাম  এর  মধ্যে  ব্যাংককও  কিছু  বদলেছে, তুক-তুকের  সংখ্যা  অনেক  কম, দালালরা  ভালো  ইংরেজি  বলে, অতটা  গায়ে  পড়াও  নয়। আমাদের  গন্তব্য  অবশ্য  ব্যাংকক  নয়, প্রতিবেশী  দেশ  কম্বোডিয়া  এবং  সেখানকার  বিশ্ববিখ্যাত  ত্রয়োদশ  শতাব্দীর  মন্দির  আংকোর  ভাট। কম্বোডিয়া  অবশ্য  পাইকারি  খুনখারাপি, ল্যান্ডমাইন, বিকলাঙ্গ  লোকজন  আর  খুনে  একনায়ক  পল  পটের  কাণ্ডকারখানার  জন্যেও  বিখ্যাত। আমার  সুপুত্র  এবং  ভ্রমণসঙ্গী  শ্রেয়ানবাবু  মন্দির  দেখতে  অতটা  উৎসাহী  নন, তিনি  আমেরিকান  বিশ্বপ্রেমিক  সংস্থা  পীস  কোর  বা  শান্তিসেনার  সদস্য  হিসাবে  কম্বোডিয়ার  দারিদ্র্য  পরিদর্শন  করতে  যাচ্ছেন। এই  পৃথিবীতে  যাদের  হাতে  লাঠি  থাকে  তারা  বেদম  ধোলাই  দেবার  পর  পিঠে  লাগানোর  মলমটা  বিনামূল্যে  পাঠিয়ে  দেয়। ইউরোপ, আমেরিকার  হলোকস্ট  মিউজিয়ামগুলোর  দেখাদেখি  কম্বোডিয়াতেও  কামেরুজ  সরকারের  আমলে  আড়াই  মিলিয়ন  লোকের  গণহত্যার  ওপর  মিউজিয়াম, মেমোরিয়াল  ইত্যাদি  বানানো  হয়েছে। শ্রেয়ানের  ইচ্ছা  ওইগুলো  ভালো  অরে  স্টাডি  করে। বাপ-ব্যাটায়  মিলে  আপোষে  ঠিক  করলাম  যে  আমরা  ব্যাংকক  থেকে  কম্বোডিয়ার  রাজধানী  নোম  পেং  যাবো, সেখান  থেকে  বিখ্যাত  আংকোর  ভাট  আর  কুখ্যাত  কিলিং  ফিলড  দুটোই  দেখে  আসা  যাবে। তারপর  সেখান  থেকে  আমি  ফেরৎ  আসবো, পুত্র  যাবেন  এক  গণ্ডগ্রামের  স্কুলে  কম্বোডিয়ান  বাচ্চাদের  অঙ্ক  শেখাতে। বাপ-মায়ের  উন্মাদ  রোগ  যে  ওর  মধ্যে  এতটাই  প্রবল  হয়ে  দেখা  দেবে  সেকথা  পঁচিশ  বছর  আগে  জানা  থাকলে  থোড়াই  আমি  বিয়ে  করে  সংসারের  চক্করে  মাথা  গলাতাম! কিন্তু  ওই  বয়েসে  কারই  বা  আক্কেল  থাকে? তাই  চট  করে  ব্যাংককের  রয়্যাল  প্যালেসে  এক  চক্কর  লাগিয়ে  দুপুর  হবার  আগেই  আমরা  কম্বোডিয়া  বর্ডারের  দিকে  রওনা  হলাম। 
 


ব্যাংকক  থেকে  নোম  পেং  মাত্র  এক  ঘন্টার  ফ্লাইট  কিন্তু  পুত্র  আমার  সাধারণ  মানুষের  সঙ্গে  ঘামতে  ঘামতে  ট্রেনে  যাবার  সুখ  পেতে  চায়। ট্রেনের  ভাড়া  মাত্র  ৪৯  ভাট  বা  একশো  টাকার  মতো, স্টেশন  থেকে  আরো  মাইল  দুয়েক  দূরে  বর্ডার, তুক-তুক  ধরে  যেতে  হয়। থাই  গ্রামগঞ্জের  মধ্যে  দিয়ে  সেই  বিচিত্র  যাত্রায়  আমাদের  সহযাত্রী  হয়ে  গেলেন  পরমজিৎ  সিং  নামে  বছর  পঁয়ত্রিশের  এক  শিখ  ভদ্রলোক। দেখা  গেল  আদতে  সে  এক  আমেরিকান  ব্যাঙ্কার, গোলডম্যান  স্যাকসে  কাজ  করতো। মন্দার  সময়  অষ্টপ্রহর  ছাঁটাইয়ের  ভয়ে  আরো  বারো  ঘন্টা  কাজের  চাপে  নাজেহাল  হয়ে  একদিন  ধুত্তোর  বলে  চাকরি  ছেড়ে  দিয়েছিল। কপালের  ফেরে  সর্দারজীর  হাই  স্কুলের  সুইটহার্ট  আবার  থাইল্যান্ডের  মেয়ে, ওরই  মতো  দ্বিতীয়  প্রজন্ম। ব্যাস, গুরুর  নাম  নিয়ে  পরমজিৎ  তাকে  বিয়ে  করে  ফেললে, তারপর  বৌয়ের  হাত  ধরে  পাড়ি  দিল  শ্বশুরবাড়ির  দেশে, চাকরিও  পেয়ে  গেল  সঙ্গে  সঙ্গে। এখন  ব্যাংককের  পাঁচমিশালি  সমাজে  দিব্যি  মানিয়ে  নিয়েছে  দুজনে, নিউইয়র্কের  থেকে  অনেক  শান্তিতে  আছে। আমি  ওদের  কথা  শুনতে  শুনতে  ভাবছিলাম  আমার  ছেলেবেলাকার  নানান  রহস্য  বিস্ময়ে  ভরা  বিরাট  পৃথিবীটা  কি  ছোট্ট  হয়ে  দিব্যি  ফিট  করে  গেছে  ওদের  সেলফোনের  পর্দায়। ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি  সবকিছু  ইন্টারনেটের  গামলায়  ভেলপুরির  মতো  বেমালুম  মিশে  যাচ্ছে। তা  যাকগে, ওইসব  আইডিয়া  ধুয়ে  তো  অনেক  জল  খাওয়া  হলো  অ্যাদ্দিন। 
থাইল্যান্ড  কম্বোডিয়ার  বর্ডারে  পৌঁছে  দেখি  ভিসা  নিয়ে  ঢালাও  দুনম্বরি  ব্যবসা  চলছে। গাছতলায়  ইউনিফর্ম  পরা  লোকজন  পুরীর  পাণ্ডাদের  মতো  ট্যুরিস্ট  পাকড়াও  করে  পয়সা  চাইছে। কম্বোডিয়ার  ভিসা  ফি  কুড়ি  ডলারের  মতো, এরা  চাইছে  প্রায়  চল্লিশ। আপনি  টাকা  আর  পাসপোর্ট  ওদের  হাতে  দিলেই  ওরা  ঝট  করে  পিছনের  দরজা  দিয়ে  অফিসে  ঢুকবে  আর  আপনার  ভিসাটি  বার  করে  আনবে। সর্দারজী  বুঝিয়ে  দিলেন, যে  বর্ডার  পোস্টে  পাঁচজন  অফিসার  লাগে;  কম্বোডিয়া  সরকার  যেখানে  দরাজ  হাতে  পনেরজনকে  চাকরি  দিয়ে  দিয়েছে  কিন্তু  মাইনেপত্তর  খুবই  কম। এরা  সবাই  ইমিগ্রেশন  অফিসার, তবে  অফ  ডিউটি, এটাই  এদের  পেট  চালাবার  উপায়। আমি  পকেটে  হাত  দেবার  আগেই  শ্রেয়ান  ঝাঁপিয়ে  পড়েছে। 
‘তোমার  মতো  বড়লোক  ট্যুরিস্টদের  জন্যে  গরীব  দেশগুলো  এইরকম  সিস্টেম্যাটিক  করাপশনে  ছেয়ে  যাচ্ছে। আমরা  লাইনে  দাঁড়িয়ে  ভিসা  নেবো, যা  সময়  লাগে  লাগবে। বলো  আমাদের  পয়সা  নেই।’ 
পয়সা  নেই! আমার  পকেটে  ক্রেডিট  কার্ড  আর  ডলারে  ঠাসা  ওয়ালেটটা  ফোঁড়ার  মতো  টাটিয়ে  উঠলো। ওরে  শ্রেয়ান, আমরা  যে  পয়সার  জন্য  দেশত্যাগ  করেছি, দারিদ্র  স্বীকার  করতে  আমাদের  বড়ো  লজ্জা। তোদের  মতন  যারা  আজন্ম  প্রাচুর্যের  মধ্যে  মানুষ  হয়েছে, তোরা  এই  হীনমন্যতার  জ্বালা  কি  বুঝবি? কিন্তু  একুশ  বছরের  মাথা-গরম  ছোকরাদের  সঙ্গে  তক্কো  করা  বেকার, আমরা  অনেক  কসরত  করে  ঘন্টাদুয়েক  বাদে  কম্বোডিয়ায়  ঢুকলাম। আমাদের  গন্তব্য  কম্বোডিয়ার  রাজধানী  নোম  পেং  হয়ে  সিয়েম  রিপ, আংকোর  ভাটের  শহর। কিন্তু  মন্দির  দেখার  আগে  পীস  কোরের  ভলান্টিয়ার  এলিজাবেথ  ওরফে  লিজ  এসে  আমাদের  পাকড়াও  করলো। শ্রেয়ান  আর  লিজ  হাইস্কুলের  বন্ধু, তারা  একমিনিটের  মধ্যে  আমে  দুধে  মিশে  গেল, আমি  মূর্তিমান  বেরসিকের  মতো  হাই  তুলতে  লাগলাম। এই  বয়সে  পাঁচ  ছয়  ঘণ্টার  বাস  জার্নির  পর  গরম  জলে  স্নান, দুপেগ  স্কচ  আর  নরম  বিছানাটার  জন্য  প্রাণ  কাঁদে, কিন্তু  এরা  যে  এখন  বিয়েবাড়ি  চলল, তাও  আবার  ট্যুরিস্ট  এলাকার  বাইরে  একটা  গ্রামের  বাড়িতে। গ্রামটার  কিন্তু  মোটের  ওপর  বেশ  একটা  ছিরিছাঁদ  আছে, লোকজন  গরীব  কিন্তু  কঙ্কালসার  নয়। খুব  বৃষ্টি  হয়  তাই  বাড়িগুলোর  ঢালু  ছাত  সেখানে  আবার  কিছু  কিছু  কারুকার্যও  করা  আছে  ফলে  দূর  থেকে  প্যাগোডার  মতন  দেখায়। বেশিভাগ  লোক  বৌদ্ধ  কিন্তু  চারদিকে  হিন্দু  দেবদেবীর  মূর্তি  ছড়ানো, গ্রামে  ঢোকার  মুখেই  বুদ্ধ  আর  বোধিসত্ত্বদের  সাথেই  বিষ্ণু  আর  গণপতি  হাজির  আছেন। এখানে  বিষ্ণু  তাঁর  অংশাবতার  বুদ্ধের  সাথে  গরুড়  আর  অনন্তনাগ  নিয়ে  দিব্যি  সহাবস্থান  করছেন, কোথাও  কোনো  কাজিয়া  নেই। 





বিয়েবাড়ির  পরিবেশ  বেশ  চেনা  চেনা  ঠেকলো। দেশের  বিয়েবাড়িতে  যেমন  শোরগোল, বাচ্চাদের  ছুটোছুটি, অঢেল  খাবার  আর  আতিথেয়তা  পাওয়া  যায়  ঠিক  যেন  তেমনটাই। শুধু  খাবারটা  সাবধানে  একটু  শুঁকে, একটু  চেখে  তবেই  মুখে  দেওয়া  উচিত  নাহলে  বেমক্কা  একটা  কেলেঙ্কারি  হবার  সম্ভাবনা  আছে। তাছাড়া  চোখ  লাগলো  বর  বৌয়ের  পরনে  সাবেক  স্টাইলের  ইউরোপিয়ান  স্যুট  আর  গাউন। ভারতবর্ষের  বাহাদুরি  এখানেই  যে  হাজার  হাজার  বছরের  হামলাদারি  সত্ত্বেও  সে  তার  নিজস্ব  সংস্কৃতির  মণিমুক্তাগুলি  কোথাও  পুরোপুরি  হারিয়ে  ফেলেনি। দক্ষিণ-পূর্ব  এশিয়া  বোধহয়  সে  গর্ব  করতে  পারে  না। বিয়ের  অনুষ্ঠানে  হিন্দু, বৌদ্ধ  এবং  ফরাসী  ঔপনিবেশিক  প্রভাব, তার  সঙ্গে  মিলেছে  কম্বোডিয়ার  লোকনৃত্য  আর  স্থানীয়  ভাঁটিখানায়  তৈরি  আংকোর  বিয়ার, তার  স্বাদগন্ধের  কথা  আর  নাই  বা  লিখলাম। ঘন্টাতিনেকের  মধ্যে  বর  কনে  মিলে  মোট  দশবার  পোষাক  বদলালো। 


বিয়ের  শেষ  অনুষ্ঠানটি  হবে  গ্রামের  বৌদ্ধমন্দিরে  যা  নাকি  উড়িষ্যার  খণ্ডগিরির  মতো  এক  বিরাট  পাথরের  ঢিপির  মাথায়  বসে  আছে। প্রায়  শ’খানেক  সিঁড়ি  ভেঙে  হাঁপাতে  হাঁপাতে  সেখানে  উঠে  দেখি  দেবদেবীদের  এক  বিচিত্র  প্রদর্শনী। বুদ্ধ  ঈশ্বর-উদাসীন  অ্যাগনস্টিক  লোক  ছিলেন  কিন্তু  পাবলিক  তাঁকে  বেশ  নিজেদের  মতো  করে  নিয়েছে। এখানে  নানারকম  হিন্দু  আর  বুদ্ধমূর্তি  তো  আছেই, তার  সঙ্গে  পৌরাণিক  চরিত্র, তান্ত্রিক  ভূতপ্রেত  ইত্যাদি  সবাই  বেশ  গলায়  গলায়  ভাব  করে  বিরাজ  করছেন, খুঁজলে  হয়তো  সাঁইবাবা  আর  যীশুখ্রীষ্টকেও  পাওয়া  যেতে  পারে। কোথাও  কোথাও  দেবতাদের মধ্যে  বেশ  জগাখিচুড়ি  পাকিয়ে  গেছে। এক  অদ্ভুত  বিষ্ণুমূর্তি  চোখে  পড়লো, যার  মুখটা  বুদ্ধের  মতো, দশহাতে  দশরকমের  যন্ত্রপাতি  যা  দেখে  বিশ্বকর্মার  কথাই  মনে  হয়। বিকেলবেলাটা  কাটালাম  গ্রামের  স্কুলে, দেখলাম  বাচ্চারা  এঁকেছে  গণহত্যার  ছবি। তাদের  অনেকেরই  হাত  বা  পা  নেই, আমেরিকান  বোমা  বা  কামেরুজ  সরকারের  ল্যান্ডমাইনে  উড়ে  গেছে। এখনও  এই  এলাকায়  নাকি  মাঝে  মাঝেই  দুচারটে  মাইন  খুঁজে  পাওয়া  যায়। 
 

পরের  দিন  সকালবেলায়  আমরা  কম্বোডিয়ার  রাজধানী  নোম  পেং  শহরে  পৌঁছে  গেলাম। শহরে  অনেক  কিছু  দেখার  আছে, নৈশজীবনও  সক্রিয়  কিন্তু  আমার  নাদান  সহযাত্রী  সবার  আগে  এখানকার  কুখ্যাত  কিলিং  ফিলড  বা  জেনোসাইড  মিউজিয়ামগুলো  দেখতে  চায়  যেখানে  কিনা  বুলেটের  অভাবে  বাঁশের  শলা  দিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মারা হতো। রয়্যাল প্যালেস, সিলভার প্যাগোডা, আর প্রাচীন ভাট নোম মন্দির কোনরকমে  ঘুরে  দেখা  হল, তারপর  তুক-তুক  সওয়ার  হয়ে  আমরা  রওনা  হলাম  শহর  থেকে  মাইলদশেক  দূরে  চোং-এক  নামে  গণকবর  দেখতে। এখানে  পল  পটের  আমলে  প্রায়  বিশ  হাজার  অতিকায়  কবর  খুঁড়ে  তার  মধ্যে  এক  মিলিয়ন  মানুষের  মৃতদেহ  পুঁতে  দেওয়া  হয়েছিল। এখানকার  মাঠঘাটে  এখনও  একটা  জোর  বৃষ্টি  হলে  বা  চাষের  জন্য  মাটি  চষতে  গেলেই  মানুষের  হাড়  বেরিয়ে  পড়ে। ১৯৭৫  থেকে  ১৯৭৯, এই  মাত্র  চারটে  বছরের  মধ্যে  এই  সরকার  নিজের  দেশের  দেড়  কোটি  লোককে  মেরে  ফেলেছিল। বাকি  যারা  আমেরিকান  বোমায়  আর  ল্যান্ড-মাইনে  পঙ্গু  হয়ে, আধপেটা  সিকিপেটা  খয়ে  কোনক্রমে  টিঁকে  যায়, তাদের  নিয়েই  আধুনিক  কাম্বোডিয়া। ‘দি  কিলিং  ফিলড’  নামে  ১৯৮৪  সালে  বানানো  বিখ্যাত  সিনেমায়  কামেরুজ  জমানার  অতিবামপন্থী  শুদ্ধিকরণ, বুদ্ধিজীবীদের  ওপর  অত্যাচার  আর  পাইকারি  হত্যাকাণ্ডের  রোমহর্ষক  বিবরণ  পাওয়া  যাবে, আগ্রহী  পাঠক  দেখে  নিতে  পারেন। এইটুকু  বলাই  বোধহয়  যথেষ্ট  যে  সেই  সময়ে  চশমা  পরলে  পুলিশ  ধরতো  কারণ  চশমা  শিক্ষিত  লোকেরা  পরে  এবং  তারা  সবাই  শ্রেণীশত্রু। কামেরুজ  সরকার  চেয়েছিল  আদি  সমাজবাদ  বা  ইয়ার  জিরোতে  ফিরে  যেতে  যখন  নাকি  সমাজ  ছিল  সরল, কৃষিভিত্তিক, সবরকম  মুনাফাবাজি  এবং  নাগরিক  ভ্রষ্টাচার  থেকে  মুক্ত। মজার  কথাটা  হলো  এই  যে  আজ  চল্লিশ  বছর  বাদেও  অবস্থা  কিছুই  বদলায়নি, অন্য  এক  অলীক  স্বর্গ  বানানোর  চেষ্টায়  এখনও  খুনখারাপি  করে  চলেছে  এই  মহাদেশেরই  আরেকদল  মানুষ। 



গা  শিরশির  করে  এইসব  মিউজিয়াম  দেখলে। অডিও  গাইডের  মাধ্যমে  প্রতিটি  দৃশ্যকে  যেন  জীবন্ত  করে  তোলা  হয়েছে। সবশেষে  দেখলাম  হাড়ের  গাদার  ওপরে  দাঁড়িয়ে  আছে  এক  নয়নাভিরাম  মন্দির। আমার  চোখের  সামনে  ভেসে  উঠলো  প্যারিসের  আর্ক-ডি-ট্রিয়াম্ফ। মানুষ  তার  ঐতিহাসিক  মূর্খামি  আর  পাশবিকতাকে  চাপা  দেবার  চেষ্টায়  কোথাও  বানিয়েছে  বিজয়তোরণ  কোথাও  স্মৃতিসৌধ। 

নোম  পেং  থেকে  সিয়েম  রিপ  বাসে  করে  যেতে  ঘণ্টা  সাতেক  লেগে  যায়, ট্যাক্সিতে  পাঁচ  ঘন্টা, ভাড়া  আশি  ডলারের  মতো। আংকোর  ভাটে  সূর্যোদয়  দেখার  ইচ্ছা  থাকলে  আগের  দিন  চলে  আসা  ভালো। সিয়েম  রিপ  আংকোর  ভাটের  শহর, এখানে  দ্বাদশ  শতাব্দীর  হিন্দু  রাজধানী  যশোধরাপুরের  ধ্বংসাবশেষ  দেখতে  দুনিয়ার  লোক  জড়ো  হয়, অজস্র  হোটেল  আর  দোকানবাজার  আছে। দিনের  বেলাটা  আমরা  কাটালাম  পুরনো  রাজধানী  আংকোর  থম  আর্কিওলজিকাল  পার্কে। বেয়ন  মন্দিরের  বিশাল  মুখগুলোর  দিকে  তাকিয়ে  রইলাম  অনেকক্ষণ  ধরে। এগুলো  কিন্তু  বৌদ্ধমন্দির, বানিয়েছিলেন  রাজা  সপ্তম  জয়বর্মণ। মাটি  থেকে  ছাত  পর্যন্ত  পাথরে  খোদাই  অতিকায়  মুখগুলি  রাজার  না কি  বোধিসত্ত্বদের  তাই  নিয়ে  অনেক  মতামত  আছে। যার  মুখই  হোক  তাদের  আধবোজা  পাথরের  চোখে  লেগে  আছে  শতাব্দী  পার  হওয়া  শান্তি  আর  নির্বেদ। আমার  মনে  হল  ওদের  ঠোঁটের  কোণায়  একফালি  ব্যঙ্গের  হাসিও  যেন  দেখা  যাচ্ছে। চোং  একের  রাশি  করা  নরমুণ্ডর  সঙ্গে  মিলিয়ে  দেখলাম  হাসিটা। মন্দির  ছাড়াও  এখানে  দেখার  আছে  কম্বোডিয়া  ওয়ার  মিউজিয়াম, আংকোর  ন্যাশানাল  মিউজিয়াম, পুরনো  বাজার  আর  পাথরের  মূর্তির  দোকান। শহর  থেকে  একটু  দূরে  খুব  সুন্দর  ফোম  কুলেন  ন্যাশানাল  পার্ক  সেখানে  নদী, পাহাড়, ঝর্না, হ্রদ  আর  ফ্লোটিং  ভিলেজ  নিয়ে  এক  নয়নাভিরাম  প্রাকৃতিক  দৃশ্যপট, তার  মাঝে  মাঝে  ছড়ানো  আছে  কামের  স্থাপত্যের  নানা  নিদর্শন, প্রাচীন  বৌদ্ধস্তূপ, প্যাগোডা  আর  মন্দির। 





পরের  দিন  আংকোর  ভাটে   সূর্যোদয়  দেখার  কথা। কামের  রাজা  দ্বিতীয় সূর্যবর্মণের  উদ্দেশ্য  ছিল  পৃথিবীতে  বিষ্ণুলোক  সৃষ্টি  করা  যার  মাঝখানে  থাকবে  দেবতাদের  আবাসস্থল  মেরুপর্বত, চারদিকে  কয়েক  মাইল  এলাকা  জুড়ে  বিস্তীর্ণ  গ্যালারি। তাদের  বিশালতা  আর  সৌন্দর্য  দেখে  বাকরুদ্ধ  হয়ে  হাঁ  করে  দাঁড়িয়ে  আছে  দুনিয়ার  মানুষ। গোপুরশোভিত  প্রাচীর  ঘিরে  রেখেছে  প্রায়  দুশো  একর  জোড়া  এই  অমানুষিক  স্থাপত্য। ভোরবেলায়  আধো  অন্ধকারে  মন্দিরের  অতিকায়  সিল্যুট  দাঁড়িয়ে  আছে  যেন  এক  নিষিদ্ধ  রহস্যময়  প্রেতপুরী। কয়েকশো  ট্যুরিস্ট  তাদের  অভ্যস্ত  কোলাহল  ভুলে  গিয়ে  ফিসফিস  করে  কথা  বলছে। এই  আধিভৌতিক  অন্ধকারে  সময়ের  স্রোত  থেমে  গেছে, অস্পষ্ট  অতীতের  শব্দহীন  গাঢ়  উপস্থিতি  যেন  মন্ত্রমুগ্ধ  করে  রেখেছে  সকলকে। ইচ্ছা  করে  দলছুট  হয়ে  অন্ধকার  মন্দিরের  দেহলিতে  আমরা  পিতাপুত্র  হেঁটে  চলেছি, টর্চের  আলোয়  দেখা  যাচ্ছে  নিস্তব্ধ  মন্দিরের  বিশাল  বিশাল  থামগুলোয়  আঁকা  মহাভারত  আর  পুরাণের  দৃশ্য। আমাদের  মনে  হচ্ছে  যেন  কোন  মহান  অতীন্দ্রিয়  শক্তির  কেন্দ্রবিন্দুতে  এসে  গেছি। চারপাশের  সজীব  অন্ধকারের  মধ্যে  শোনা  যাচ্ছে  নামহীন  অসংখ্য  মানুষের  নি:শ্বাস, মহান  ঐশ্বর্যময়  এক  সংস্কৃতির  অপৌরুষেয়  প্রবাহ। দক্ষিণ  আমেরিকার  মায়া  বা  ইনকা  ধ্বংসাবশেষ  দেখে  আমাদের  এরকম  মনে  হয়নি  কারণ  তারা  চিরদিনের  জন্যই  মৃত। এই  মন্দিরের  সবকিছু  এখনও  জীবন্ত, এখনও  স্পন্দিত  হয়ে  চলেছে  কোটি  কোটি  মানুষের  প্রতিদিনকার  জীবনচর্চায়। 




এইসব  কথা  বলতে  বলতে  একসময়  দেখি  আকাশ  পরিষ্কার  হয়ে  উঠেছে, পাথর  আর  গাছপালার  ফাঁক  দিয়ে  চুঁইয়ে  পড়ছে  নরম  রোদ্দুর। পরিখার  জলে  পদ্মফুলের  ওপরে  থিরথির  করে  কাঁপছে  মন্দিরের  ছায়ারা। আমরা  দেখলাম  সকালের  রোদে  সোনার  মতো  জ্বলছে  পাঁচ  চূড়া  মন্দির, মাঝখানেরটি  সবচেয়ে  উঁচু, তার  চারদিকে  তিন  ধাপ  গ্যালারি, তাদের  দেওয়ালে  রামায়ণ, মহাভারত  আর  পুরাণ  থেকে  নেওয়া  অজস্র  দৃশ্যের  প্রতিলিপি, দেবতা  অসুর, যক্ষ, নাগ  আর  কিন্নরীদের  ভিড়। সমুদ্রমন্থনের  একটা  রিলিফ  দেখলাম, চোখে  পড়লো  গরুড়  আর  বাসুকি  নাগের  একাধিক  মূর্তি, আবার  দেখলাম  এসবের  মধ্যে  মধ্যে  বুদ্ধদেবও  হাজির  আছেন। ত্রয়োদশ  শতাব্দীর  শেষে  আংকোর  ভাট  বৌদ্ধমন্দিরে  রূপান্তরিত  হয়, অবশ্য  তার  জন্য  পুরনো  মূর্তিগুলো  ভেঙে  তছনছ  করার  দরকার  হয়নি। মন্দিরে  ঢুকলেই  চোখে  পড়বে  হাজার  বুদ্ধের  গ্যালারি। বুদ্ধমূর্তিগুলোর  এখনও  পূজা  হয়, গৈরিক  পোষাকে  ভিক্ষুদের  প্রায়ই  দেখা  যায়  আশেপাশে। সব  মিলিয়ে  এখানে  একশোটার  ওপর  মন্দির  আছে, বোঝাই  যায়  একদিন  এর  চারপাশে  কি  বিরট  শহরাঞ্চল  ছিল, পৃথিবীর  যে-কোনো  মেট্রোপলিটন  শহরের  সঙ্গে  যার  তুলনা  দেওয়া  চলে। সভ্যতার  সেই  মহান  উচ্চতা  থেকে  কি  অসহায়  এই  পতন, কি  চূড়ান্ত  অব্যবস্থা, নৈরাজ্য  আর  গণহত্যার  ভার  পিঠে  নিয়ে  খুঁড়িয়ে  খুঁড়িয়ে  চলছে  বিকলাঙ্গ   দেশটা! আমার  মনে  হল  চারপাশে  সেই  যুগের  দৃপ্ত, সবল  ও  সুখী  আত্মারা  আজকের  কম্বোডিয়ার  এই  অন্ধ  অসহায়  ভ্রাতৃহত্যার  নিদর্শন  দেখে  লজ্জায়  মুখ  লুকিয়ে  আছে। যাদের  বাঁশের  শলা  দিয়ে  বা  কোদাল  দিয়ে  কুপিয়ে  মারা  হয়েছিল, চাবুক,  বিষ  আর  ইলেকট্রিক  শক  দিয়ে  যাদের  ওপর  অত্যাচার  করা  হয়েছিল  দিনরাত, না  খেতে  পেয়ে  মরেছিল  যে  লক্ষ  লক্ষ  মানুষ, এই  মন্দিরে  কি  তারা  আশ্রয়  পেয়েছে? তাদের  ক্ষত  কি  নিরাময়  করেছে  পূর্বপুরুষের  হাতে  গড়ে  তোলা  এই  সুরম্য  বিষ্ণুলোক? বিষ্ণু  আর  বুদ্ধই  শুধু  এর  উত্তর  দিতে  পারেন  কিন্তু  তাঁদের  পাথরের  চোখগুলো  এখানে  বসে  বসে  কেবল  তামাশা  দেখেই  চলেছে  এক  হাজার  বছর  ধরে। 


বেলা  বাড়ছে, আমরা  ক্লান্ত  হয়ে  একটা  গাছতলায়  বসে  পড়েছি, চারদিকে  প্রাচীন  পাথরগুলোকে  শতাব্দীর  পর  শতাব্দী  ধরে  জড়িয়ে  ধরেছে  বিশাল  বিশাল  বট  আর  ডুমুরগাছ। তাদের  রাক্ষুসে  শিকড়  আর  ঝুরিগুলো  সাপের  মতো  পেঁচিয়ে  ধরেছে  দেবতাদের  মুখ। এখন  পৃথিবীর  আর  দশটা  ট্যুরিস্ট  স্পটের  মতোই  আংকোর  ভাট  সরগরম, চারদিকে  খচাখচ  ক্যামেরা  চলছে, আধুনিক  মানুষের   অপার  ঔদ্ধত্যের  সঙ্গে  পাল্লা  না  দিতে  পেরে  মন্দিরের  প্রেতাত্মারা  পাথরের  খাঁজে  খাঁজে  লুকিয়ে  পড়ছে। সকলবেলার  ম্যাজিক  এখন  উধাও, আমরাও  একটু  পরে  গুটি  গুটি  পায়ে  বাসের  দিকে  রওনা  হবো। 




পরের  দিন  আমরা  একটা  ট্যাক্সি  নিয়ে  চলে  গেলাম  কো  চাং  বীচের  দিকে, সেখানে  দুদিন  কাটিয়ে  ফেরত  যাব  ব্যাংকক। সিয়েম  রিপ  থেকে  থাইল্যান্ডের  কো  চাং  বীচ  চারশো  কিলোমিটারের  কাছাকাছি  যেতে  ঘন্টা  সাতেক  লেগে  যায়। এমনিতে  রাস্তাটা  খারাপ  নয়  কিন্তু  বর্ডার  পার  হওয়াটাই  সবচেয়ে  বিরক্তিকর  কারণ  সবার  নজর  আপনার  পকেটের  দিকে। কো  চাং  বীচ  থাইল্যান্ডের  আর  পাঁচটা  রিসর্টের  মতই, তার  বর্ণনা  অন্য  কোনো  সময়ে  দেওয়া  যাবে। জমজমাট  বেলাভূমিতে  যখন  হাজার  প্রদীপের  আলো  জ্বলে  উঠেছে  আমি  তখন  একটুখানি  চুরি  করা  নির্জনতায়  বসে  শ্রেয়ানকে  অনুবাদ  করে  শোনাচ্ছি  আমার  প্রিয়  কবিতা, সাগরিকা। 
‘দেখিনু  আমি  নটরাজের  দেউলদ্বার  খুলি 
তেমনি  করে  রয়েছে  ভরে  ডালিতে  ফুলগুলি 
    হেরিনু  রাতে,  উতল  উৎসবে 
        তরল  কলরবে 
আলোর  নাচ  নাচায়  চাঁদ  সাগরজলে  যবে 
    নীরব  তব  নম্র  নতমুখে 
আমারি আঁকা পত্রলেখা, আমারি মালা বুকে। 
    দেখিনু  চুপে  চুপে 
আমারই  বাঁধা  মৃদঙ্গের  ছন্দ  রূপে  রূপে 
    অঙ্গে  তব  হিল্লোলিয়া  দোলে 
    ললীতগীতকলিত  কল্লোলে।’ 
 শ্রেয়ান  অবাক  হয়ে  আমার  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  রইল। খোলামেলা  আকাশের  তলায়  বড়ো  হওয়া  আত্মবিশ্বাসী, এই  নতুন  প্রজন্ম  বুঝতে  চেষ্টা  করছে  প্রাচীন  পৃথিবী  থেকে  নির্বাসিত  মানুষের  আত্ম  অনুসন্ধান, তার  ছিন্নমূলে  অস্তিত্বের  হাহাকার।