সাতাশে মার্চ, দু হাজার আঠেরো
বেলা একটা একুশ- মিয়াঁ বিবি দুজনে হাওড়া স্টেশনে হাজির। সোয়া দুটোয় ছেড়ে হাওড়া নিউ জলপাইগুড়ি শতাব্দী রাত সাড়ে দশটায় আমাদের নিয়ে ফেলবে নিউ জলপাইগুড়িতে। পরদিন গাড়িবাহনে গ্যাংটক। সেখান থেকে উত্তর সিকিম।
বেলা তিনটে তেইশ- ছাড়া তো দূর অস্ত, উনি এসেই পৌঁছননি। কখন আসবেন, ‘কেউ তা জানে না’। এর মধ্যে দু-দুবার আবির্ভাবের পুণ্যক্ষণ বদলেছে।
বেলা চারটে এগারো- দৈববাণী হলো, তিনি পাঁচটা পাঁচে আবির্ভূত হবেন। না আঁচালে বিশ্বাস নেই। হাওড়ায় হাপিত্যেশ।
বেলা পাঁচটা পাঁচ- কিমাশ্চর্যম! তিনি পাঁচটা বাজতে পাঁচেই এলেন এবং আমরা তাঁর উদরপ্রবেশের সৌভাগ্যপ্রাপ্ত হলাম। এখন অন্তত আট ঘণ্টা বেগুনপোড়া হওয়ার হাত থেকে রেহাই।
বেলা পাঁচটা পঁচিশ- অবশেষে সত্যি সত্যি রওনা হলাম! এই যদি শুরুয়াত হয়, গোটা ট্রিপে আরও কী কী অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে, ভাবতেই শিউরে উঠছি।
বেলা পৌনে ছটা- বেলা আড়াইটেয় যে লাঞ্চ পরিবেশিত হওয়ার কথা, তিনি বাড়তি সাড়ে তিন ঘন্টা রোদ খেয়ে এসে হাজির হলেন। স্বাদে যে রকমফের হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
আঠাশে মার্চ
রাত একটা আটান্ন- আঁধার রাতের আত্মার মতো আমাদের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে ট্রেন বাবাজী সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়লেন।
রাত দুটো চব্বিশ- তিরুপতি লজ জিন্দাবাদ। শেষ রাতেও আমাদের জন্য তার দুয়ার খোলা। ঘোরের মধ্যেই শুতে চললাম। সারথিকে সকাল আটটায় রথ আনতে বলেছি। ক-টা ঘন্টা যদি ঘুমোনো যায়!
সকাল আটটা আটান্ন- গাড়ির পেটে বসে উত্তরমুখী যাত্রা শুরু হলো। আশা করি ড্যাংড্যাং করে গ্যাংটকে পৌঁছে যাব।
বেলা দেড়টা- নামলিং রিজেন্সিতে নামলাম--আক্ষরিক অর্থে। পথ থেকে বাইশ ধাপ নেমে ঢুকতে হলো হোটেলে। ঘর দেখে দিল খুশ।
বেলা আড়াইটে- খাবার খেয়ে পেট খুশ।
রাত সাতটা- বর্ষা হুমকি দিচ্ছে।
রাত ন-টা উনচল্লিশ- ভরপেটে লেপস্থ হওয়া গেল। কলকাতার চিংড়ি-পোড়া গরম এখানে গল্পকথা মনে হচ্ছে।
ঊনত্রিশে মার্চ
সকাল আটটা ছত্রিশ- সাজগোজ কমপ্লিট। গাড়ি এলেই বেরিয়ে পড়ব।
সকাল ন-টা দশ- গাড়ি নাকি স্ট্যান্ডে থাকবে! ট্যাক্সি করে সেখানে পৌঁছতে হবে আমাদের! এ তো নতুন হোঁচট! উত্তর সিকিমের সমস্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
সকাল ন-টা পঁয়তাল্লিশ- ট্যাক্সি নামালো টিপটিপ বৃষ্টির মাঝে! এজেন্সির লোক এসে ঢালু পথ বেয়ে নামিয়ে নিয়ে এলো সুমো, সওয়ারি, ম্যাক্স-এর জঙ্গলে। অব্যবস্থার চূড়ান্ত! বৃষ্টিও এ-সুযোগে দম বাড়িয়ে আমাদের ভিজিয়ে নিল।
সকাল দশটা দশ- শেষমেশ গ্যাংটকের চত্বর ছেড়ে উত্তরের পথে গড়ালো চাকা।
সকাল এগারোটা দুই- বাইপাস ধরে ছুটছে গাড়ি। বৃষ্টি লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। তবে লুকোচ্ছে বেশি, উঁকি দিচ্ছে কম।
সকাল এগারোটা চল্লিশ- প্রজাপতির টানে থামতেই হলো। বাটারফ্লাই ফল্স্-এর রূপ দেখে বৃষ্টিও থমকে গেছে। কয়েক ধাপে পাখনা মেলে নেমে এসেছে। বর্ষায় নাকি তার রূপের বাহার আরও খোলে।
সকাল এগারোটা একান্ন- রাকদুং টিনটেক। টিন নিয়ে করব কী!
দুপুর বারোটা পঁয়ত্রিশ- ডিকচু। তিস্তাকে বেঁধে জলাধার বানিয়েছে।
দুপুর বারোটা পঞ্চাশ- রালাক। কার লাক?
দুপুর বারোটা বাহান্ন- রংরং-এর রংঢং দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। আমরাও সুযোগ পেয়ে ঝটপট ডানহাতের ব্যাপারটা সেরে নিলাম। সবুজ পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে মেঘেরা ভুরু কুঁচকে নজর রাখছে।
দুপুর পৌনে দুটো- উত্তর সিকিমের সদর। উত্তর সিকিমের সদর।
বেলা আড়াইটে- মানুল। এমন নাম কে রেখেছে ক্যায়া মালুম!
বেলা তিনটে দুই- নাগা (নাকি নাগ?) ফল্স্-এর রূপ থমকে দেওয়ার মতোই। আপনমনে ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কলকলিয়ে ব্রিজের তলা দিয়ে গিয়ে আবার ঝাঁপ মেরেছে তিস্তার সঙ্গে দেখা করবে বলে।
বেলা তিনটে একুশ- অনিচ্ছাসত্ত্বেও নাগাকে ছেড়ে এগোতে হলো।
বেলা তিনটে তেতাল্লিশ- থেং।
বেলা চারটে দশ- বাঁধের বাঁধনে থমকে থাকা তিস্তার দুই জন্মদাত্রী লাচুং চু আর লাচেন চু-র পান্নাসবুজ জলের ধারে চুপটি করে বসে থাকা চুংথাং আর ছোটটি নেই (চুং মানে ছোট)। তাকে ব্রিজের ওপারে রেখে লাচেন চুং-র সঙ্গে ভাব জমিয়ে গাড়ি চড়াই বাইতে লাগল। চুংথাং-এর কাছে জঙ্গল একটু সরে বসেছিল। নির্জন পথে সে আবার কাছে ঘনিয়ে এসেছে ভাব জমাতে।
বেলা চারটে চল্লিশ- বনসোই। বন কই? (২২৮১মি: )
বেলা চারটে চুয়ান্ন- চেপতেন। কে কাকে চেপতেন? (২৪৬২মি: )
বেলা চারটে আটান্ন- চাতেন। চা খেতেন? কে?
বেলা পাঁচটা পনেরো- লাচেন চেক পোস্ট থেকে দেখলাম, লাচেন চু-র ডান তীরে গাছপালারা সরে বসে লাচেন (লা=গিরিবর্ত্ম, চেন=বড়) কে জায়গা করে দিয়েছে। ২০০৯ সালে দেখা গ্রাম থেকে মফস্বল শহর হতে চাওয়া লাচেন আজ পুরোদস্তুর কংক্রীটের জঙ্গল। রডোডেনড্রনেরা সবুজ জামায় লাল ফুল তোলা শুরু করে দিয়েছে।
বেলা ছ-টা- কী ছিঁচকাঁদুনে আকাশ রে বাবা!
রাত আটটা আটত্রিশ- বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খেয়ে এসে কাঁথা, থুড়ি, লেপ মুড়ি দিয়ে....
ত্রিশে মার্চ
সকাল ছ-টা- সূর্যের ছটা এখনও লাচেনকে ছোঁয়নি।
সকাল ছ-টা ষোলো- সূর্যকিরণ মেঘের ফাঁক দিয়ে আঙুল বাড়িয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে লাচেনের বাড়িঘর গাছপালা। সেই ছোঁয়ায় ঝিকিয়ে উঠছে লাচেন। সব মাথা ছাড়িয়ে তুষারশৃঙ্গেরা উঁকিঝুঁকি মারছে।
সকাল ছ-টা বাইশ- গাড়ি তৈরি; আমরা নই।
সকাল ছ-টা একত্রিশ- আমাদের বেরোতে দেখেই হিংসুটে আকাশের মুখ গোমড়া। আমাদের গুরুদোংমার না যেতে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে।
সকাল ছ-টা চল্লিশ- জেমা (২৭৪৭মি:)। ষড়যন্ত্র আরও পাকিয়ে উঠছে। স্লেটের মতো আকাশ গম্ভীরমুখে মেঘের ঝারি দিয়ে ঝিরিঝিরি জল ঝরাতে শুরু করেছে।
সকাল সাতটা বত্রিশ- দু’পাশের পাহাড়ের গায়ের বরফ গুটিগুটি পথের ধারে নেমে এসেছে, চেপে বসেছে সব গাছের ডালপালায় পাতায়।
সকাল সাতটা বেয়াল্লিশ- ঢুকে পড়েছি সুইজারল্যান্ডে। যেদিকে চোখ যায় সাদা-কালো, কালচে সবুজের আলপনা। আকাশ এখন সাবুদানা ঝরাতে শুরু করেছে। গুরুদোংমার পৌঁছতে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র গুরুতর হয়ে উঠছে।
সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশ- রেগেমেগে তুষারপাত বাড়িয়ে দিয়েছে আকাশ — ওয়াইপার থামানোই যাচ্ছে না। মনটা ভারি চা চা করছে।
সকাল সাতটা উনপঞ্চাশ- বরফের মোটা আলোয়ান মুড়ি দিয়ে থুম মেরে বসে রয়েছে সেনা ছাউনি, বাঙ্কার আর ছড়ানো কিছু বাড়িঘর। আকাশ তার ওপরে চাপিয়ে দিচ্ছে নতুন বরফের লেপ। বারো হাজার ফুট ছাড়িয়ে এসেছি। গাছপালারা থমকে থেমে গিয়েছে আগেই। মাঝেমধ্যে দেখা দিচ্ছে দু-একটা ঝাঁপখোলা চা-খাবারের দোকান — তাদের সামনে গাড়ির জটলা। বন্ধ কাচের মধ্যে দিয়েও চায়ের গন্ধ আর উষ্ণতা জড়িয়ে ধরেছে, অথচ আমাদের সারথি ‘কানে গুঁজেছি তুলো’! মনের চা চা-টা এখন প্রায় কা কা রব তুলেছে। বাইরের সাদার ওপর কালচে আলপনা আর মন ভোলাতে পারছে না তেমন।
সকাল সাতটা পঞ্চাশ- কাল্পে (৩৭৪৬মি:)। তুষারপাতে ডুবে থাকা সেনাছাউনি ছাড়িয়ে আদিগন্ত তুষারক্ষেত্রের মাঝে এসে একটা কাফেটেরিয়ার সাইনবোর্ড পেরিয়ে হঠাৎ রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে নেমে পড়ে একটা খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল। বিরাট সাদা চত্বরে একপাশে একটা একতলা পাকাবাড়ি, তার গা ঘেঁষে একটা ছাউনিতে টুকিটাকি চটজলদি খাবার (চিপস, কুরকুরে জাতীয়) সাজানো; চত্বরে গোটা ছয়েক গাড়ি দাঁড়ানো। দূরপ্রান্তে একটা ডগ-হাউস। তার থেকে বেরিয়ে একটা সাদা-কালো ঝাঁকড়ালোমো কুকুরছানা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ওপরওয়ালা বোধহয় বরফের কলটা খুলে দিয়ে অফিস চলে গিয়েছেন।
সকাল সাতটা তিপান্ন- কাফেটেরিয়ার ভেতরটা আগুনে মানুষে জমজমাট। ঠান্ডাটা এক ধাক্কায় কমে গেল কয়েক ডিগ্রি। সবাই খাবারে গল্পে মগ্ন; সবার চোখেমুখেই উত্তেজনা।
সকাল আটটা বারো- খাবার আর খারাপ খবর, দুটোই একসঙ্গে পেলাম। সামনে পথে এতটাই আলগা বরফ যে, গাড়ির চাকা পিছলোচ্ছে; সেনাবাহিনী কাউকে যেতে দিচ্ছে না।
সকাল আটটা বত্রিশ- গতকাল রাত্রে আমাদের হোটেলেই ওঠা একঝাঁক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সুদূর মুম্বই থেকে তারা ছুটে এসেছে রোমাঞ্চের খোঁজে। গ্যাংটক থেকে মোটরবাইক ভাড়া নিয়ে তারা এসেছে গুরুদোংমার দেখতে। দেখলাম, আমাদের মতো তারাও এখানে হাজির। ‘কতদূর যাওয়া যায় দেখি’ বলে হাসিমুখ আর বগলে হেলমেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
সকাল আটটা বাহান্ন- আমরা এখন আছি থাঙ্গুর ঠিক বাইরে। আমরা আছি ১৩০০০ ফুটের কাছাকাছি, আর গুরুদোংমার ১৭১০০ ফুট। সেখানে পৌঁছতে পারব না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। সারথিবাণী—‘যতদূর পারব যাব। প্রচুর গাড়ি ফিরে আসছে। রাস্তা ডেঞ্জারাস’।
সকাল আটটা পঞ্চান্ন- যদিও দেখে মনে হচ্ছে শেষবেলা। গাড়ি গড়ালো। তুষারপাতের বিরতি নেই। আজ বোধহয় ওর বারো ঘন্টার ডিউটি।
সকাল ন-টা নয়- পেরিয়ে এলাম জবুথবু থাঙ্গু। (৩৯৫০মি: )। পথ হঠাৎ চড়তে শুরু করেছে।
সকাল ন-টা বারো- লাচেন নালার ওপরে একটা ঢালে দু তিনটে বন্ধ বাড়ি আর গোটা বারো গাড়ি নিশ্চল। গোটা চারেক গাড়ি ফেরার চেষ্টায়। ওপর থেকে নেমে আসা তুষারের ঝাপটা তাদের সে কাজে উৎসাহ জোগাচ্ছে।
সকাল ন-টা তেরো- সেই ঢালে আমরাও। সবাই মেতে উঠেছি বরফ ছোঁড়ার ছেলেমানুষি খেলায়। আর যে এগোনো যাবে না, সেটা এখন দেখতে না পাওয়া দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ফিরতে হবে এই ৪১৮০মি: থেকেই।
সকাল ন-টা বত্রিশ- আবার ফেরত সেই কাফেটেরিয়ায়—কফির টানে। আমাদের ফিরতে দেখে কুকুরছানাটা আনন্দে নেচেকুঁদে একশা।
সকাল এগারোটা আটচল্লিশ- তুষারপাত পেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাড়ি ফিরে এলো লাচেন।
বেলা তিনটে তেইশ- বর্ষার ধারাপাত চলছেই।
সন্ধে সাতটা সাতাশ- বৃষ্টি দেখি ফিউচার কনটিনিউয়াস টেন্স হয়ে গেল!
রাত আটটা আট- চলছে। কী আবার? বৃষ্টি। তবে তার আবেগ কমেছে।
একত্রিশে মার্চ
সকাল ছ-টা- পরিষ্কার নীল আকাশ থেকে হাসিমুখে আমাদের দেখছে তুষারশৃঙ্গেরা। রডোডেনড্রনেরা হাসছে।
সকাল আটটা- মেঘেরা আড়মোড়া ভাঙছে। তবে মুখে আর রাগের চিহ্ন নেই।
সকাল আটটা আঠাশ- আজ লাচেন ছেড়ে লাচুং। তাই যাবার আগে লাচেন গুম্বাকে দর্শন করার ইচ্ছা।
সকাল ন-টা তিন- লাচেন গুম্বা। লোহার গ্রিলের সিংদরজা থেকে বেশ খানিকটা মাঠ পেরিয়ে গুম্বা।
সকাল দশটা- গুম্বা দর্শনের পুণ্য অর্জন সম্পন্ন।
সকাল এগারোটা একচল্লিশ- বিদায় লাচেন।
দুপুর বারোটা তেরো- তারুম উষ্ণ প্রস্রবণ। গরম জলের ঝরনা।
দুপুর বারোটা ছাপান্ন- চুংথাং। লাচেন চু-কে ছেড়ে লাচুং চু-র হাত ধরা।
বিকেল পাঁচটা- বাইরের বাঁধানো ‘উঠোনে’ বসে কফি— কাফী হ্যায়।
সন্ধ্যা পাঁচটা পঞ্চান্ন- বিদ্যুতবাবু সোয়া তিনটেয় গিয়েছিলেন, এখন এলেন। খানিক আগে লাচুং চু-র সং অ্যান্ড ডান্স শো দেখে এলাম। নতুন বন্ধু এরিকার সঙ্গে এখন বেলুন নিয়ে খেলা চলছে। ম্যানেজারের ছ-বছরের মেয়েটা দারুণ মিষ্টি।
পয়লা এপ্রিল
সকাল ছ-টা ছাব্বিশ- আজ অল ফুল্স্ ডে। ইয়ুমথাংও আমাদের গুরুদোংমারের মতো বোকা বানাবে না তো? সঙ্গে চলেছে হোটেলের ম্যানেজার সোনিলা আর ওর মেয়ে। ওদের পয়ে যদি এপ্রিল ফুল হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সকাল সাতটা সাতান্ন- গাড়ি গড়ালো। আকাশ সোনা রোদে ভাসছে।
সকাল ন-টা উনত্রিশ- ফারগাছ আর ক্যাসুরিনার মাঝ দিয়ে এসে পড়লাম ইয়ুমথাং। ন-বছর আগে দেখা নির্জন ইয়ুমথাংয়ে আজ আধুনিক পসরার অঢেল আয়োজন। সারথির পরামর্শ — ইয়ুমথাংয়ের সঙ্গে আলাপচারি হবে ফেরার পথে। এখন ইয়ুমেসেমডংয়ের ডাকে সাড়া দেওয়া যাক।
সকাল ন-টা বাহান্ন- পথ চড়চড়িয়ে চড়ছে। যে বরফের পাহাড়গুলোকে ঘাড় তুলে দেখছিলাম, তারা এখন পড়শি। এরিকার আনন্দ বাঁধ মানছে না। লাচুংয়ের মেয়ে হয়েও ওর এই প্রথম তুষারপ্রান্তর দেখা।
সকাল দশটা দশ- ইয়ুমেসেমডংয়ের জিরোপয়েন্ট (১৪০০০ ফু.)। সুবিশাল তুষারক্ষেত্রে মানুষ আর গাড়ির মেলা। মানুষগুলো আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছে, আর গাড়িগুলো হতভম্ব হয়ে জট পাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাগলদের কাণ্ড দেখে সূর্য কিরণ ছিটিয়ে হেসে আকুল।
সকাল এগারোটা এক- এক ঘন্টাতেও ‘মিটিল না আশা’। তবু, ফিরতে তো হবেই। গাড়ি উৎরাইয়ের পথ ধরল, সবার চোখ তখনও ফেলে আসা শুভ্র স্বর্গের দিকে।
সকাল এগারোটা চল্লিশ- ইয়ুমথাং চু-কে বুকে নিয়ে বসে আছে ইয়ুমথাং উপত্যকা।
সকাল এগারোটা পঞ্চাশ- ইয়ুমথাং চু-র সঙ্গে আলাপ করে এলাম। লাজুক নদী খিলখিলিয়ে হেসে বয়ে চলল জলের নূপুর রিনঝিনিয়ে।
ভরদুপুর- ইয়ুমথাং, বিদায়।
বেলা একটা চব্বিশ- আবার লাচুং। চোখ বুজলেই তুষারক্ষেত্র। এপ্রিল Full।
দোসরা এপ্রিল-
সকাল সাতটা সাতাশ- আজও সুনীল আকাশ।
সকাল সাতটা চল্লিশ- কাটাও দর্শনে বেরোনো হলো।
সকাল সাতটা বেয়াল্লিশ- পেরোনোর সময় লাচুং চু শুভেচ্ছা জানালো।
সকাল আটটা পঁচিশ- ফার আর রডোডেনড্রনেরা আমাদের দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালো। উল্টোদিকে তুষারমৌলিদের সঙ্গে ভাব জমাতে হাজির সাদা মেঘের দল।
সকাল আটটা পঞ্চাশ- একটা বাঁক ঘুরতেই আমাদের থামিয়ে দিল বরফ ভেঙে নেমে আসা এক দুরন্ত জলপ্রপাত। তার পাশে চুপটি করে বসে একটা বন্ধ চায়ের দোকান। গাড়ি থেকে নেমে প্রপাতের সঙ্গে আলাপ করতে এগোতেই তিনজন চারপেয়ে বন্ধু ল্যাজ নেড়ে জানিয়ে দিল, আমাদের দেখে তারা বেশ খুশি। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে তার সূর্যকিরণমাখা পরাক্রম দেখলাম মুগ্ধ হয়ে।
সকাল ন-টা- আবার আটকে দিল। এবার সেনা ছাউনির গেট। এর পরে তুষারের ঘনঘটার বাড়াবাড়ি। তাছাড়া সেনাবাহিনীর প্র্যাকটিস চলছে। অতএব — নো এন্ট্রি। তুষার মেখে ভূত সেজে থাকা ফারগাছেরা আমাদের নীরব সমবেদনা জানালো। পথে বসে থাকা, ঝুলে থাকা তুষারেরাও সান্ত্বনা দিল।
সকাল ন-টা পঞ্চান্ন- অতৃপ্ত আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম লাচুংয়ে।
সকাল দশটা কুড়ি- এবারের মতো শুভ্রতার দেশ থেকে বিদায়। সোনালী রোদের আলোয় উজ্জ্বল লাচুং আমাদের আসন্ন বিরহে বিষণ্ণ বিদায় জানালো। তুষারঢাকা উত্তর সিকিম ছেড়ে ফিরে চললাম রোদমাখা সমতলে।