• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা: আপন বাপন জীবন যাপন, বাঙালির ইন্দ্রিয়দোষ ও ছোটলোকের সংস্কৃতি, আজে গল্প বাজে গল্প, Laughing Gallery : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || কুমার-কমল-রাধার উত্তরসূরী, বা সন্দীপনের ||

    আপন বাপন জীবন যাপন—সম্বিৎ বসু; ৯রিকাল বুকস; কলকাতা-২৫. প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৮; ISBN 978-81-935370-9-1

    একটি স্মৃতিকথাধর্মী কেতাবের অলংকরণ এতো সুপ্রযুক্ত এতো মোহময় হতে পারে, এ’খানি হাতে না পেলে জানতেই পারতুম না। অহোমদেশের ভূমিপুত্র, বর্তমানে শান্তিনিকেতনবাসী। শ্রীমান ভাস্কর হাজারিকা। নৈলে, সম্বিৎ বসু মহাশয়ের এই লেখাগুলি ‘মুখবই’-এর পৃষ্ঠায় সব পড়া পড়া ছিলো; সেগুলো একস্থানে একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মহতোদ্দেশ্যেই বইখানি হস্তগত করা। হাজারিকা-সাহেবের অলংকরণ উপরিপ্রাপ্তি, পেয়ে মোহিত, মনে হলো প্রকাশিকা-দি সহী দাম ফেলেছেন বইটির।

    *

    কুমারপ্রসাদের শোনানো কমলকুমারের সেই গল্পটি নিশ্চয়ই কেউ ভোলেননি। ঘরের পাশের পুরীভ্রমণের গল্প। কফিহাউজের আড্ডায় শাঁটুলবাবু-বর্ণিত পচার ছাত্তরের হোটেলের হামেহাল ব্যবস্তার মাঝে মাঝেই ঠোক্ পাড়ছে কোন্ এক আপস্টার্ট, নিজের বিলেতভ্রমণের গল্প ফাঁদিয়ে শোনাতে চায়। একমেবদ্বিতীয়ম্ কমলকুমারের অমোঘ উক্তি, ‘দাঁড়াও না বাপু, এঁদের পুরীর গল্পটা শুনতে দাও না। বিলেত-টিলেত তো আজকাল ভদ্দরলোকের ঘরের বউঝিরাও হামেশাই যাচ্ছে কুণ্ডু স্পেশালে চড়ে...’!

    এটা ১৯৫০এর দশকের কথা। আর পোষ্ট-এল্পিজি (Liberalization Privatization Globalization) সম্বিৎ-রা যখন বিলেত টপকে আটলান্টিকও টপকে ম্যারিকা গেছেন তদ্দিনে মোটামুটি সেখানে বাৎসরিক দুগ্গাপুজো, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলেনটন শুরু হয়ে গেছে প্রায়। তাই ষাট থেকে আশির দশকের আ-দ্যাখ্লা বঙ্গীয় ঔপন্যাসিকদের কলমের হ্যাংলামিপনার দিনও চলে গেছে।

    সম্বিতের লিখন এই প্রেক্ষিতে পড়তে হবে, এবং এ’বিষয়ে লেখক সচেতনও যথেষ্ট বটেন।

    *

    যদিও আম্রিকার চাইতে সত্তর-আশির দশকের উত্তর কলকাতা, লেকটাউন-সল্টলেক, নিজামী বীফরোল, মোহনইস্ট দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ইত্যাদিই বেশি উঠে এসেছে এঁর কলমে, কেতাবের প্রথম ভাগেঃ ‘ক্যালিকাটা’। আর বড়ো সুখপাঠ সেই সাদাকালো ছবির গপ্প। ‘মন মেতেছে মন ময়ূরীর কি খেলায়/ নাম না জানা ফুল ফোটানোর এই বেলায়’! কোনো সরলরৈখিক পথে এগোয়নি বলে এ’ গল্পপাঠ আরও স্বাদু হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের সতীর্থ প্রথম স্নাতক যদুনাথ বসু ও স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ির দৌত্তুরের বংশের গপ্প থেকেই লং কাট সত্তরের দশকের বাঙুর এভন্যু ও সহপাঠী ব্রাত্য বসু........থেকে শীতে ফ্লুরিজের ফ্রুটকেক থেকে হেলমেটহীন টেস্ট ক্রিকেট। ক্লাস টেনের ছেলের পক্ষে পর্নোগ্রাফির বহিঃসীমা ছিল নিরোধ ও ‘সত্যম্’-এ’ জীনত আমনের অর্ধোন্মোচিত বক্ষযুগল। এখানে এর বেশি উন্মোচিত করলে কপিরাইটে ধরবে।

    *

    গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বঃ ‘ক্যালিফোর্নিয়া’, যার মধ্যে সন্দীপনীয় ‘স্টার্ট আপ সম্বন্ধে দু’চার কথা....’ পড়ে ফ্ল্যাট হবো, না বড়বাবু যখন সমুদ্রসৈকতে সিরিয়ান-শিশুর মরদেহ দেখে ‘বড় পাপ হে’ বলে ডুকরে ওঠেন, তখন,...ভাবি। বস্তুতঃ, এই বড়বাবু জলধরবাবুর বয়ানে বলা গল্পগুলি লেখকের জাত চেনায়, ও কেন তিনি কলমে আরও সময় দেন না ভেবে আক্ষেপ করি। সে যা-ই করুন, বুকের মধ্যের ‘বড়বাবু’-টিকে তো আর আস্তিনের তলায় গুটিয়ে ফেলা যায় না, তা দিয়েই না এই ‘আপন বাপন জীবন যাপন’!

    *

    লেখকের জিভের তার বোঝার ক্ষ্যাম্‌তা ও কলমে তাকে এনে ফেলা আরেক আকর্ষণ কেতাবটির। সে টেরিটিবাজারের চৈনিক খাদ্য হোক্‌ বা সানফ্রান্সিসকোর ইতালিয় চপিনো বা গ্রীক জাইরো বা আরবী শোয়ার্মা। ডিমভাজাকে ‘মামলেট’ বলা তো আজকাল উঠেই গেছে, ভীম নাগের ‘বাবু সন্দেশ’-এর নামও প্রায় ভুলে ছিলুম, এখন প’ড়ে গন্ধটা এলো নাকেতে। হ্যাঁ, এ’ধাঁচে বাঙলা বলাটা উত্তর-কলকাতার এক আগমার্ক ছিল, এদান্তে উঠে যাচ্ছে। সম্বিতের কলমে ‘গরগরে মশলা’, ‘বিলকিছিলকি’, ‘হাকুচ’ (কালো বা তিক্তের বিশেষণরূপে) ‘দেয়ালা (আরও দখ্‌নে ভাষায় ‘দ্যায়্‌লা’)’ পড়ে তাই নস্টালজিয়ায় (পড়ুন, বুড়ত্বরোগে) ভুগতে হয়।

    *

    হামদি বে (১৯১৫--....)! বিগতকালের এই দিকপাল সাংবাদিকের লেখার সঙ্গে আজকের প্রজন্ম বিশেষ পরিচিত নয়। ছাপরাবাসী জিন-প্রেমী এই মানুষটি সিভিল সার্ভিসের চাকুরি হেলায় ত্যাগ করে স্টেটসম্যান পত্রিকার নিউজবয় হয়েছিলেন লেখার টানে। সেকালের জীবন্ত গুগল ছিলেন হামদিঃ টমাস পেইন থেকে মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত যাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। সম্বিতের এই ‘যাপন’ আজ পড়তে পড়তে হামদি-সাহেবের লেখা বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছিল।

    এটি যেন জলধরবাবুর প্রথম বইই হয়।

    *

    নতুন প্রকাশনালয়ের কাজ মন কেড়েছে, যদিও ছাপার ভুল দু’একটি চোখে পড়েছে।

    লেটার মার্কস পাবার মতো বই গো, দশে আট!



    || আমার এ’ঘরখানায় কে বিরাজ করে...? ||

    বাঙালির ইন্দ্রিয়দোষ ও ছোটলোকের সংস্কৃতি---সোমব্রত সরকার; সিসৃক্ষা প্রকাশন; শ্রীরামপুর, হুগলী--৭১২২০৩; প্রথম প্রকাশ পৌষ ১৪২৪; ISBN 978-81-934722-8-6

    নিছক বিনোদন হোক্‌, বা সাধনা---তার যে বা যে যে পথে ভরোসা নেই, বিশ্বাস নেই, সঠিক বলে মনেও করিনা (তাতে কারো কিসুই আসে যায় না), তেমনই পথ-বেপথের আলোচনাঋদ্ধ এক পৃথুলা পুস্তকের এ’হেন গোগ্রাস পাঠ আগে কখনও করেছিলুম কিনা ভাবতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী মহাশয়ের গভীর নির্জন পথে মনে পড়ে গেল। আজকের আলোচ্য পুস্তকের শীর্ষকে ঐ ‘বাঙালির ইন্দ্রিয় দোষ’ বলতে লেখকের ঠেস্‌ তথাকথিত বর্ণহিন্দুদের প্রতিই, ‘ছোটলোকের সংস্কৃতি’-তে যেমন একটা অদৃশ্য পেরেন্থেসিস আছে। অবিশ্বাস ও অসমর্থনের উর্ধে উঠে অবশ্য এ’কথা নির্দ্বিধায় বলি, যে আলোচ্য বিষয়ের উপর এতো গভীর গবেষিত (ইনক্লুডিং ক্রস-রেফারেন্স) বই আগে পড়িনি। নবীন লেখককে বধাঈ জানাই তাই। দেহসাধনা, দেহসাধনায় যৌনতা, ভৈরবী-অঘোরী প্রভৃতি সম্পর্কিত-বিষয়ের উপর এঁর একাধিক গবেষণাপুস্তক রয়েছে, জানা গেল, ও পড়বার ইচ্ছে জাগলো। (যদিও বাঙলা বইয়ের প্রচ্ছদ ও বিজ্ঞাপনের উপর এঁর দুইটি বইয়ের উল্লেখ পরিশিষ্টের ‘গ্রন্থপাঠ’-এ কী সূত্রে এলো, বুঝতে পারিনি)।

    *

    মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা রুথ মাজো কারাসের চমৎকার একটা বই, ‘Common Women: Prostitution and Sexuality in Medieval England’ পড়েছিলুম কয়েকবছর আগে। সোমব্রতের বর্তমান বইটির প্রথম দু’তিনটি অনুচ্ছেদ পড়তে পড়তে কারাসের সেই বইটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কারাস অবশ্য অনেক নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্তি নিয়ে লিখেছেন, সোমব্রত যেখানে আগাগোড়াই তাঁর নিজস্ব মতে অটুট। আর, হ্যাঁ, সেটা রসিক পাঠককে মনে মনে চুনৌতি দেয় বৈ কি? সন্ধ্যাকর নন্দী থেকে বিনয় ঘোষ পর্যন্ত যে কোনো ‘উচ্চবর্ণীয়’/’উচ্চশিক্ষিত’ লেখকের মতবাদই সোমব্রতের তির্যক মন্তব্যের লক্ষ্য হয়েছে। কায়াবাদী যে যে সব সাধনার ধারা, শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাদের ‘বাড়ির পায়খানার দরজাটি দিয়ে ঢুকে ছাদে পৌঁছনোর চেষ্টা’ বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন। বর্তমান লেখক বইটির একাধিক স্থানে এই মতকে ব্রাহ্মণ্যবাদী বলে নিন্দা করে দিয়েছেন। বেশ করেছেন। যদিও এর অন্যথাটিও তো কৈ আর কোথাও কিছু খুঁজে পেলুম না। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক থেকে শহর কলিকাতা যেমন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ব্যবসাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে থেকেছে, ঠগজোচ্চুরি থেকে বেশ্যাবৃত্তির মতো নানান সামাজিক ব্যাধির ডেরাও তা হতে থেকেছে ক্রমশ। ব্যবসা, অর্থ ও বেশ্যাবৃত্তির মধ্যে এক অমোঘ সম্পর্ক আছে, কারাস-দিদিমণি যেটা দেখিয়েছেন, সোমব্রত যদিও বেশ্যাবৃত্তিকে ‘সামাজিক ব্যাধি’ আখ্যায়িত করায় রুষ্ট হতে পারেন।

    একটা উদাহরণ দিই এখানেঃ সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর মশায়ের সহকারী দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা ‘মার্জিত রুচি, প্রাঞ্জল ভাষা ও নির্ভীক সমালোচনার জন্য বিশুদ্ধ রাজনীতি ও সুস্থ সাহিত্যের প্রসারে দীর্ঘদিন বাংলা সংবাদপত্রজগতে শীর্ষস্থান অধিকার করে ছিল’ [সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান]. সোমব্রত কিন্তু দ্বারকানাথ মহাশয়কে তুলোধুনে ছেড়েছেন, কারণ তিনি কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ভৈরবীচক্র, ইন্দ্রিয়দমনের নামে অবাধ যৌনাচার ইত্যাদিকে সমর্থন করেননি। বহুবার ‘যেন’ ‘যেন’-র উল্লেখে ভৈরবী আর বারাঙ্গনাকে এক করার অভিযোগ তুলেছেন লেখক (পৃ ৪৮-৪৯)। এখানে অবশ্য স্মর্তব্য, আজকের দিনেও এমনকি মুচি, ধাঙড়, ডোম প্রভৃতি তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ’হেন অবাধ যৌনাচারের চল নেই। এমন ‘সাধনপথ’ করে-গোনা কয়েকটি ক্ষেত্রে চলে, যা আমজনগণের পালনীয় নয়।

    বইটির অনুচ্ছেদের নামগুলো পড়ে পাঠক যেন আবার অন্য রকম ভেবে বসবেন নাকোঃ ‘রাঁড়ের বাড়ি উঁকিঝুঁকি মাচ্ছে কুলিকুলি’, বা, ‘স্বেচ্ছাচারিণী স্বধর্মভ্রষ্টা বারবণিতার হৃদয়যাতনা’, বা, ‘সাত ভাতারী সাবিত্রী বারো ভাতারী এয়ো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নিখাদ গবেষণাধর্মী পুস্তক এটি; লেখকের অতি দীর্ঘ দীর্ঘ বাক্যবন্ধে যদিও একটু কিন্তু-কিন্তু রাখলুম। বইটির ব্যাপক ও গভীর গবেষণাগুণের কথা গোড়াতেই লিখেছি। ঊনবিংশ শতকের সংবাদপত্র ছেনে ছেনে লেখক তাঁর বক্তব্য সাজিয়েছেন। যদিও কোথাও কোথাও , যেমন, ‘সাত ভাতারী সাবিত্রী....’ অধ্যায়টিতে সারা বিশ্বের ইতিহাস ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে নানান দেশকালের যৌনাচারের কুলুজী সাজানো হয়েছে---সুখপাঠ, যদিও গ্রন্থশীর্ষের ‘...ইন্দ্রিয়দোষ...’ এর সঙ্গে তার কোনো সংযোগ খুঁজে পেলুম না। বা, যেমন ২১৮ পৃষ্ঠায় ‘অহমদিয়া’-দের এক সুফিপন্থী বলা হয়েছে। এক্কেবারেই নয়। এঁরা পারস্য থেকে আসেনওনি। অবিভক্ত পাঞ্জাবের কাদিয়ান শহরে মীর্জা গুলাম আহ্‌মদ (১৮৩৫-১৯০৮ খৃ.)-সাহেবের হাতে ইসলামের এই পন্থের শুরুয়াৎ।

    *

    বাঙলা প্রকাশনার আদিযুগে শ্রীরামপুর তো দেশের তাজ ছিল কিন্তু পরে সে স্থান আর থাকেনি। বর্তমান গ্রন্থটি শহর কলকেতার অনতিদূরের সেই পীঠ থেকে বেরিয়েছে, আর এই মানের ও গুণের , দেখে আনন্দ পেলুম। বইটিতে একখানি সুলিখিত ‘ভূমিকা’ থাকবার দরকার ছিল, যেমন অতি-জরুরী ছিল গ্রন্থশেষে একটি বর্ণানুক্রমিক পরিশিষ্ট, যেখানে অজস্র কোটেশন, ব্যক্তিনাম ও গ্রন্থনামের আলাদা তালিকা থাকবে। এতে ভবিষ্যত পাঠক-গবেষকদের অসীম উপকার হবে।


    || পেট সেলাই-এর গুণছুঁচ রেডি তো? ||

    আজে গল্প বাজে গল্প—তাপস মৌলিক; ‘বর্ণদূত’; কলকাতা-১৫৬; ISBN--নাই

    নিখাদ ছোটদেরগল্প লেখা, অর্থাৎ শিশু-বালকপাঠ্য গল্প, যে একটা কঠিন কাজ, অতি কঠিন কাজ, মানে তা সকলেই। সুখলতা রাও লিখতেন, আশাপূর্ণা-লীলা মজুমদার তো ছিলেনই, শৈলেন ঘোষ মশায় লিখে গেছেন অনবদ্য কিছু, দিদি সুফিয়া কামাল-ও। শরদিন্দু-সত্যজিৎ-শীর্ষেন্দুর টার্গেট-গ্রুপটা কিন্তু আরেকটু বড়োদের জন্যে, আজকে যাদের young adult বলছে। আর শিবরাম তো ছিলেন এ’গোত্রের এক মহীরুহ, যদিও টিল্টটা একটু বিশেষ! সেই ঘরানার সেই ঘ্রাণের এক বই সম্প্রতি পড়ে মনে হলো ‘পরবাস’-পাঠককুলের সঙ্গে ভাগ করে নিই সে অভিজ্ঞতা।

    *

    এ’বইটির ক্ষেত্রেও বলি, প্রচ্ছদপৃষ্ঠা থেকে শুরু করে অন্দরের বহু বহু অলংকরণ এতো মুগ্ধ করেছে যে অনেক সময়েই পড়া থামিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে হয় পাশের ছবিটার দিকেঃ ‘গুগাবাবার সরগম’ (পৃ ৯৩), ‘খালপার অভিযান’ (পৃ ১৩১) বা গজুমামার কল্পতরু হবার গপ্পের (পৃ ৫১) ছবি এমন তিনটে মাত্র উদাহরণ। শিল্পী অরিজিত ঘোষ। বধাঈ। প্রচ্ছদ ছাড়া বাকি সবগুলি ছবিই সাদাকালোয়,যদিও তাতে ভালোলাগা ঘাটেনি, বরং বেড়েছে। অলংকরণ যে শিশুসাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য আভরণ সেটা এই বই পড়তে পড়তে পুনরায় অনুভব করি। আমাদের বাল্যে-কৈশোরে কিংবদন্তীর প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাই ধর, শৈল চক্রবর্তী, নারায়ণ দেবনাথ মহাশয়দের অলংকরণ দেখেছি। সেই ধারা আজও বজায় আছে দেখলে মন প্রফুল্ল হয়। অলংকরণ শুধুমাত্র অতি-ভালো-আঁকা-ছবি হলেই চলে না; তাকে গল্পটির মূলসুরের সঙ্গে সঙ্গত করে চলতে হয়। যে তত্ত্বটা এই বইয়ের ছড়াগুলির প্রসঙ্গেও বলবো।

    ফিকশনের গ্র.-স. এটি। গল্পগুলো তাই বলে দোব না কিন্তু। কিন্তু ছোটকা বা গজুমামার বলা ইন্সট্যান্ট ছড়াগুলো দু’একটা ছাড়লে প্রকাশক-দা কপিরাইটে ধরবে না,আশা করিঃ

    ‘কত কিছু আছে পেটে/ নাড়িভুঁড়ি পিলে মেটে/মনে ভাবি দেখি ঘেঁটে/ছুরিকাঁচি দিয়ে কেটে’

    বা,

    ‘হরিদ্বার গঙ্গাতীরে/মলয় বাতাস বইছে ধীরে/নরম রোদে পাচ্ছে খিদে/জলখাবারে কী খাবি রে?’

    [ ডিসক্লেইমারঃ যাদের মনে হবে ছড়াগুলো তো কৈ খুউউব ভালো হলো না, তাঁরা যেন সেগুলোর ইন্সট্যান্টত্বও বিবেচনা করেন। এরচে’ বেশি ভালো হয়ে পড়লে ‘বানানো-বানানো’ মনে হতো না?]. বস্তুতঃ, চিত্রের মতন ছড়াগুলিও এই বইয়ের বড় প্রিয় আভরণ। সারা বইয়ের অঙ্গজুড়ে এমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বলা ছড়া ‘উকুনে বুড়ি পুড়ে মোলো’ বা, ‘বুড়ি গেল ঢে---র দূর’ মনে করায়। বড্ড মিষ্টি লাগলো!

    *

    ‘গজুমামা যখন কল্পতরু’,‘মশাগ্রামের মশা’, ‘গুগাবাবার সরগম’....কেমন কেমন মজাদার নাম,না,গল্পগুলির? .... প্রত্যেকটিই নিজের নিজের রসে জারানো। তবে ‘গোয়েন্দা লোবো’ গল্পটির তুলনা নেই কোনো। আজ এই ইন্টারনেট আর ফেসবুক আর ওয়াটসএপের যুগে এক কৃতবিদ্য এঞ্জিনিয়র যে এমন এক পেলব-সুন্দর বিষয় নিয়ে মনকাড়া গল্প লিখতে পারেন ভাবলে শ্রদ্ধা জাগে। সাবেক সোভিয়েত কালের চমৎকার চমৎকার শিশুসাহিত্যে এমন পশুপাখি নিয়ে মিষ্টি গপ্প পড়তে পাওয়া যেতো....সেই ভালুক মিশা..নেকড়ে...। তাপসবাবু বাল্য ফিরিয়ে দিলেন আমাদের। এ’ও জেনে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় যে উনি কেবল শিশুসাহিত্যের টানে বাঁধাধরা চাকুরি করা থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে, এবং সাহিত্যের পাশাপাশি শিশুদের জন্যে গান, নাটিকা, পুরষ্কার-প্রকল্প.... এইসবের মধ্যেই কালাতিপাত করছেন।

    মাথার টুপি খুলি, ঝুঁকে।

    *

    প্রকাশক ‘বর্ণদূত’-ও এক আনকোরা সংস্থা, এবং শিশুসাহিত্যে নিবেদিত। এঁদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই ও স্বাগত,স্বাগত। বইয়ের গোড়াতেই এঁরা এক ‘উপহার’-লেখা পাতা ছেড়ে রেখেছেন দেখে স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠলো মনটা। আমাদের বাল্যকালে এ’চল-টা বড্ড ছিল, ইদানীং উঠে গেছে। ব্লার্বটা একট্টু বড় হয়ে গেছে।মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি, এক ঐ ‘খালপার’ ছাড়া।

    যত্নে করা কাজের ছাপ বইটির সারা অঙ্গে। পাঠকদের হাসিয়ে হাসিয়ে পেট ফাটিয়ে দেবার অঙ্গীকার নিয়ে কলম ধরেছিলেন এই তরুণ লেখক, যাঁর কানে কানে আলিবাবার গল্পের সেই দর্জি মুস্তাফা ফাটা পেট বেমালুম সেলাই করে দেবার ভরোসা দিয়ে গেছেন।

    পাঠশেষে তাই মুস্তাফাকে ঢুঁড়ি।

    পুনঃ- শিল্পী অরিজিতের অঢেল প্রশংসা করেও লিখি, ৭৩ পৃষ্ঠার ঐ চিত্রে কিন্তু লোকটার মুখে মঙ্গোলীয় ছাপ আসেনি।



    || হাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদী ||

    Laughing Gallery—S. Phadnis; Jyotsna Prakshan; Pune-411030; Sixth edition 2014; ISBN: 978-81-7925-242-0.

    পরবাসের কোনো একটি সংখ্যাতে অ-বাঙলাভাষায় হাইয়েস্ট একখানি পর্যন্ত গ্র.স. লেখার অলিখিত ছাড় আছে আমার। এই বইখানিকে কি সেই দলে ফেলা যায়? প্রচ্ছদের নামটা ইঙ্গভাষায় জরুর, কিন্তু অন্দরে?

    গতসংখ্যায় বাঙলা কমিকসের উপর পৃথুলা কেতাবখানি নিয়ে লিখতে লিখতে কার্টুন-কমিকস-ইলাস্ট্রেশনের ওপর ছেলেবেলার টানটা উথলে উঠলো ফের। আমাদের ছোটবেলায় তখন বাড়িতে আনন্দবাজার আসে, সেখানে পি কে এস কুট্টি-সাহেবের কার্টুন দেখে হেসে কুটিকুটি। পরে জানি, শঙ্কর হলেন ভারতের সেরা কার্টুনিস্ট! এর কিছু পরে পরে ‘টয়’-তে আর কে নারয়ণের ‘কমন ম্যান’ দেখে কার্টুনের রস নতুন করে নিতে শেখা।

    কুট্টি, শঙ্কর, আব্রাহাম, বিজয়ন থেকে আজকের অজিত নৈনন---ভারতের প্রথম সারির কার্টুনিস্টগণ সক্কলেই কেরলীয়, এটা কি কাকতালীয় ? লক্ষ্মণ সাহেব অবশ্য তামিল ছিলেন, মারিও মিরাণ্ডা গোয়ানীজ, বাল ঠাকরে ছিলেন মারাঠি, শিবরাম ফাড়নীসও, যাঁর অনবদ্য এই সংকলনটি নিয়েই লিখতে বসেছি আজ। তবে ঐ ঐ মহারথীদের সঙ্গে শিবরাম ফাড়নীসের মূলগত এক তফাৎ হলো এই যে শিবরাম কিন্তু কখনো রাজনৈতিক কার্টুন আঁকেননি (মাত্র কয়েকটি ছাড়া)। আমাদের চারিপাশে ছড়িয়ে থাকা নানান কিসিমের মানুষজন পশুপক্ষী সামাজিক কম্ম-অকম্ম—এই সব নিয়েই নবতিপর মানুষটি (জ. ১৯২৫) কাটিয়ে দিলেন প্রায় সাত সাতটি দশক । এবং রমরম করে। (বাঙলার নিজস্ব চণ্ডী লাহিড়ী-মশায়ের সঙ্গে তাই ফাড়নীসজী-র মিল এক্ষেত্রে: স্মর্তব্য, ‘তির্যক’!)। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন সাহেব মস্ত ভক্ত ছিলেন শিবরামের কার্টুনের, দিলীপকুমার থেকে অমিতাভ বচ্চনও। দেশেবিদেশে ওঁর কার্টুনের প্রদর্শনী সংখ্যায় বড় একটা কম হয়নি। ‘লাফিং গ্যালারি’-র সে-সব প্রদর্শনীতে দর্শনপ্রার্থীদের লম্বাআআ কিউ দেখলে স্তম্ভিত হতে হয় (কিছু ফটো এখানে রয়েছে, নেট ঘাঁটলে এমন বহু দেখা যাচ্ছে)। ১৯৮৪-থেকে ওঁর ‘চিত্রহাস’ সিরিজও অসম্ভব জনপ্রিয় হতে থাকে, যেখান উনি স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে বিশাল সংখ্যক দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি কথপোকথনে মস্ত মস্ত ইজেলে কার্টুন আঁকতেন ও স্লাইড-শো করতেন। মুম্বাই-দূরদর্শনে এমন অনেক প্রোগ্রাম দেখেছি বলে মনে পড়ছে, নব্বুইয়ের দশকে। এখনও ইউ-টিউব খুললে দেখা যায়।

    শিবরাম দত্তাত্রেয় ফাড়নীসজী-র কার্টুনের প্রতি আকর্ষণের দ্বিতীয় ও প্রধান কারণটিতে আসি, যেটা আমার ঐ প্রথম প্যারার দ্বিধার জবাব দেবে।এবং এই বিষয়ে উনি কিন্তু একদমই অনন্য। সেটা হলো এই, যে ওঁর কোন্নো কার্টুনে কক্ষনো কোন লিখন-শব্দ-ক্যাপশন ব্যবহৃত হয়না, হয়নি। ছবিই এখানে কথা বলে।সেইজন্যেই শিবরাম ফাড়নীসকে এক মারাঠী-কার্টুনিস্ট বলে দেগে দেওয়া যায় না এবং অনায়াসে উনি এই বাঙলা পত্রিকায় স্থান পান।

    *

    নিজে চিত্রী তো নই, তবু কার্টুনের ভক্ত ও সংকলনটির ক্রেতা হিসেবে দু’একটি কথা বলতে বাধা কোথায়? ফাড়নীসের এই ‘সিগনেচার সংকলন’-টির এটি ষষ্ঠ সংকলন (২০১৪), সেটাই কি অনেক কথা বলে দেয় না? আর, আজ ফেবু-হোআ-র যুগে ফাড়নীসের চল্লিশ বছর আগে আঁকা কার্টুন অনায়াসে হাতে-নেটে ঘুরছে, আমাদের ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলছে হাসির আভাস এর চাইতে বড়ো স্বীকৃতি এক শিল্পীর আর কী চাই? যেমন, ঐটা.....সাইকেলের কেরিয়ারের ক্লিপে ছেলেকে এঁটে মা দোকানের শাড়ি পছন্দ করছে, বা তানপুরো নিয়ে মায়ের কালোয়াতি গানের গমকে শিশুপুত্র ঝুমঝুমি হাতে তাকে ভোলাতে আসছে, বা বিজয়ী-পালোয়ানকে পুরষ্কার দেবার সময় করমর্দন করতে গিয়ে নেতা-র হাতই খুলে এলো....এ’হেন একশত পাঁচটি কার্টুনের সংকলন এটি। বেশিরভাগই সাদাকালো, যদিও তাতে রস বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি। কয়েকটির শ্লেষ তো অনবদ্য! যেমন, এটিঃ (পৃ ৯৪) শিল্পীর তুলিতে নগ্না নারী সৌন্দর্যের প্রতীক, ধনী ক্রেতার চোখে তা-ই কিন্তু যৌনতা...যা থেকে বাঁচতে ঐ নারীচিত্র ইজেলের কোণা তুলে এনে অঙ্গ আবরিত করছে। বা, বিশ্রম্ভালাপরত প্রেমিকযুগলের একাত্মতা প্রস্ফুটিত হচ্ছে কেবল ওঁদের মৃদু আলিঙ্গনেই নয়,....সাইকেল-জোড়ায়,শুকসারীতে ও পাদুকাযুগলেরও অদলবদল আলিঙ্গনে। প্রচ্ছদের কার্টুনটি,অবশ্য, সেই অনুপাতে অনেক সাধারণ বলে মনে হলো, প্রতিনিধিস্থানীয় নয়।

    এই কলমচির পক্ষে কেবল কথা দিয়ে কার্টুনের রস উপস্থাপিত করা পুরোই অসম্ভব, তাই শিল্পীর অনুমতিসাপেক্ষে এখানে দু’একটি নমুনা দিতে পারলে মন্দ হতো না (কিন্তু, কপিরাইটের কারণে...)

    *

    যুগে যুগে দেশে দেশে নানান ধর্ম ও তাদের উদ্গাতাগণ মানুষের ভালো চেয়ে এসেছেন, চেয়ে এসেছেন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তুলি বা কলম বা সেলুলয়েডে যাঁরা সেটা করে এসেছেন, সেই চ্যাপলিন থেকে জারোম থেকে শিবরাম চক্র বা আমাদের আজকের এই ফড়নীসজীও সে কঠিন কাজটিই জীবনের ব্রত হিসেবে মেনে চলেছিলেন, বা করে চলেছেন।

    সত্তর বছর ধরে ভাষাহীন, অ-রাজনৈতিক কার্টুন এঁকে মানুষকে হাসিয়ে চলাটাকে তাই এক ধর্মাচরণের দর্জা দিই।

    প্রণাম জানাই।



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)