• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • অশোক মিত্র স্মরণে : রবিন পাল


    বিস্মৃতি ছাপিয়ে; অশোক মিত্র; প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি, ২০১৮; আনন্দ পাবলিশার্স - কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ২৮৮; ISBN: 978-93-5040-946-6

    ‘স্মৃতি পিপীলিকা...পুঞ্জিত করে/আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা’। (সুধীন্দ্রনাথ) জীবনের সব কিছুই জমে স্মৃতিতে, ঝরে, থাকে বর্তমানের প্রান্তরে। জানি আমাদের কর্তব্যে, করণীয়ে স্মৃতির ভূমিকা প্রয়োজনীয়। স্মৃতিচারণটা বুড়ো বয়সের লক্ষণ, অথবা বুড়োটেপনা-- মৃণাল সেনের এ-কথাটায় মন সায় দেয় না। বরং ‘যতই ফুরায়ে যাই স্মৃতিগুলি তত করে ভিড়’ (অজিত দত্ত)-এর কথাটাই পছন্দ হয় আমার। প্রবচনে বলে স্মৃতিশূন্য মানুষ তো ভাঙা এক পাত্র মাত্র। স্মৃতি কাজ করে চলে, পরিস্থিতির প্রভাব মান্য করেই। তবে স্মৃতি সঞ্চয়ে থাকে নির্বাচন, মুক্ত হয় ব্যাখ্যান। ব্যক্তিগত স্মৃতি, বিশ্বগত স্মৃতি চলে হাত ধরাধরি করে। তাই বলা হয় স্মৃতি হল বিশ্ব ও ব্যক্তির ধ্যান ও প্রত্যাশার মিশ্র প্রবাহ। মনস্তাত্ত্বিকরা স্মৃতির বিভাজনে বলেন ঘটনাস্মৃতি, শব্দস্মৃতির কথা। ক্ষণস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির কথাও আসে। স্মৃতি তাই জরুরী, যা অনুধাবনে, শিক্ষনে, সামাজিক সম্পর্কায়নে দরকারি। বিশেষ স্মৃতির উদঘাটন বর্তমান অনুধাবনে জরুরী, অতীত ঘটনা বা তথ্যায়নে স্মৃতির সংগ্রহ, সঞ্চয়, ব্যবহার অতীত ও বর্তমানকে সেতুবন্ধিত করতে, চিন্তা উদ্রেকে, আত্মমূল্যায়নে, কর্তব্য নির্দেশে, বিবেক মার্জনে, ধিক্কারে, দু:খে, ক্রোধে, ব্যক্তিকতায়, বিশ্ববোধে মনকে আলোড়িত করে। বয়স স্মৃতিকে ধ্বংস করতে চায়, তবু মানুষ, বিশেষত: প্রখর বুদ্ধিজীবী বিস্মৃতিকে ছাপিয়ে যেতে চায়। এই পারাটা একটা কৃতিত্ব, এই সক্ষমতা ও অতীত ও বর্তমানের সমন্বিত ব্যাখ্যান পথনির্দেশক হয়ে ওঠে কখনো কখনো, বিরল দৃষ্টান্তে। অশোক মিত্র মহাশয়ের ‘বিস্মৃতি ছাপিয়ে,’—তাঁর প্রয়াণ-পর্বের সম্ভবত: শেষ বই-- তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

    তাঁর প্রয়াণের দু’দিন পরে এক বিশিষ্ট দৈনিকে লেখা হয় অশোক মিত্রের বেদনাতুর ক্রোধ এবং ক্রুদ্ধ বেদনার আর্তি দেশবাসীকে সজাগ রেখেছিল অর্ধশতাব্দীর বেশী সময় ধরে। তিনি ক্রমাগত লেখায় কাছের ও দূরের ঘটনাপ্রবাহে সাড়া দিয়েছেন নিজের মতো করে, জানিয়েছেন নিজের মত, নিজের বিচার বিশ্লেষণ। দেশের বামপন্থী দল ও নেতৃত্ব সম্পর্কে দলের নীতি ও কর্মপন্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। ছিলেন অর্থশাস্ত্রের লোক। কিন্তু কবিতার প্রতি তাঁর টান ছিল অকৃত্রিম। অর্থশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের জন্যই সত্তর দশকের গোড়ায় ইন্দিরা আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। সে দায়িত্ব ছেড়ে কেন্দ্রীয় কৃষি-মূল্য কমিশনের চেয়ারম্যান। তারপর রাজ্যের প্রথম বাম সরকারের অর্থমন্ত্রী। তারপর মতানৈক্যে প্রশাসন থেকে পদত্যাগ। মার্ক্সবাদী তত্ত্বে নিজেকে দীক্ষিত করেছিলেন নিজের মতো করে। রাজ্য জুড়ে অরাজকতা ও অন্ধকারের মধ্যে তাঁর কলম থেকেছে সদা সক্রিয়। অন্যদিকে রুক্ষতার আড়ালে এক বন্ধুবৎসল, স্নেহশীল এক মানুষের বসত। ‘বিস্মৃতি ছাড়িয়ে’, তাঁর এই শেষ বইটিতে অশোকবাবুর সুতীক্ষ্ণ বেদনা ও ক্রোধ, মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ এবং বন্ধুবৎসল হৃদয়ের পরিচয় আছে নানান লেখায়। এখানে একদিকে তিনি প্রিয় বন্ধুদের স্মৃতিচর্চায় বেদনাতুর, অন্যদিকে দেশ ও জাতির সমসাময়িক নরকগামিতায় ক্ষুব্ধ। তিনি সুস্থ জিজীবিষার কথায় নিরন্তর সোচ্চার, বিশ্লেষণে নিপুণ, তথ্যে পারদর্শী। বলা যাবে হয়ত জাগ্রত বিবেক, তাতে সমালোচ্য যদি কিছু থাকে, তবুও। এ সময়ের দিকে বলতে বাধ্য--এমন কার লেখায় পেয়েছি একালে, বা পাব?

    তাঁর সুদীর্ঘ লেখকজীবনে সাহিত্য লেখা কম, এ বইতে আরো কম। এ লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হলো এক গুচ্ছে অকিঞ্চিৎকর বিষয়েই তাঁর অনুরাগ। যেমন বীণা বন্দ্যোপাধ্যায় নাম্নী মহিলার একটি কবিতা, অসীম রায় বিষয়ে টুকরো কথা, মৃদুল ভট্টাচার্যের কবিতা, আশরাফ সিদ্দিকীর একটি কবিতা। তাঁর স্মৃতির প্রাখর্য বিস্মিত করে, কিন্তু বাংলা কবিতার মুখ্য সৃজন সম্পর্কে তিনি নীরব। অন্নদাশঙ্করের কবিতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। বিষ্ণুদে-র সঙ্গে কবিতা নিয়ে উত্তর-প্রত্ত্যুত্তর আছে। কিন্তু বিষ্ণুদে-র কবিতা বিষয়ে, তাঁর সামগ্রিক চর্চা সম্পর্কে কোনো কথা নেই। বুদ্ধদেব ঘরানা, অরুণ সরকার বা অনুরূপ আবহ-সান্নিধ্যের কথা আমরা বারবার শুনেছি। কিন্তু ঘোষিত বামপন্থী অশোকবাবুর মুখে বাংলা বা অ-বাংলা বামপন্থী কবিতা সম্পর্কে পূর্বাপর কথা নেই। বামপন্থী এই বিদ্বান কি মানতেন না যে, মার্ক্সবাদীরা কবিতা চর্চাকে রাজনীতিচর্চার আর একটি হাত মনে করতেন? অশোকবাবু, বেদনার্ত চিত্তে পাঠক লক্ষ্য করবেন, বাংলা গল্প উপন্যাস নিয়েও উচ্চবাচ্য করেন না। সুভাষের শেষ জীবনে অ-বাম সভায় যাওয়া নিয়ে তাঁর অসন্তোষ আছে কিন্তু সুভাষের পূর্বাপর কবিতা নিয়ে, তাঁর অতগুলো উপন্যাস নিয়ে একটি কথাও কোথাও বলেন না। জীবনানন্দের উপন্যাস পছন্দ করেন না বলেছেন আলাপচারিতায়। কিন্তু কাদের গল্প উপন্যাস ভালো লাগে, লাগল এসব কথা নেই। ‘সুমিত্রার অপমৃত্যু’ গল্প নিয়ে অনুরাগের কথা আছে একটি লেখায়, রবীন্দ্রনাথের কাব্যচয়নিকা নিয়ে, গদ্য কবিতা নিয়ে, শেষ সপ্তক নিয়ে কথা আছে আর একটি লেখায়। কিন্তু সে-সব হঠাৎ আসা উড়ো ভাবনা। তাঁকে যাঁরা কাছের থেকে দেখেছেন তাঁদের মুখে শুনেছি, রবীন্দ্রের ‘গোরা’ উপন্যাসও পুরোটা তাঁর পড়া হয় নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে অন্তত লেখার ভিত্তিতে মনে হয় একমাত্র গীতবিতানের রচয়িতা, রবীন্দ্র অধ্যাত্মচেতনা নিয়ে যে-মন্তব্য তা তথ্যভিত্তিক নয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অধ্যাত্মচেতনা কমে গেছে একথা রবীন্দ্র-সাহিত্যপাঠকরা মানবেন না, এ হল গতানুগতিক পল্লবগ্রাহী মন্তব্য। আমাদের মনে পড়বে অশোকবাবু যাঁকে অনুপ্রেরণা-সঞ্চারী মনে করতেন সেই বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র-গল্প নিয়ে, উপন্যাস নিয়ে, কবিতা নিয়ে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও করেছেন, যা এই অর্থনীতিবিদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। লীলা মজুমদারের রচনা নিয়ে লিখতে গিয়ে সঠিক ভাবেই বলেন, তাঁর গদ্যে ‘কোনো ঘোর প্যাঁচ নেই। কঠিন কঠিন শব্দের ব্যবহার নেই, লম্বা বাক্যের পাল্লায় পড়া নেই।’ লীলার ছোটদের লেখা বড়োরাও হামলে পড়ে পড়বে। অবনীন্দ্র-চর্চা বা পারিবারিক চর্চা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে সতর্কতা আছে, কিন্তু তা-ও বহিরাঙ্গসর্বস্ব। লীলার রচনা অন্য প্রাসঙ্গিক রচনার সঙ্গে তুলিত হয় না। তাঁর শান্তিনিকেতন ত্যাগ নিয়ে কথা নেই, লীলার মৌলিক রচনা সম্পর্কে মন্তব্য নেই। অবশ্য এই ভূমিকা যেন একটি খণ্ডের, তাই তাঁকে সীমাবদ্ধ থাকতেই হয়। নাটক নিয়ে একাধিক লেখা আছে এ-বইতে। একটি রচনায় তিনি অনেকগুলি নাটক দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। কিন্তু উৎপল দত্তের নাটক কি ‘ওঁর নাটক যেমন হয়, জোড়াতালি দেওয়া নাটক’ এমন বলা চলে? (পৃ. ৪১) উৎপল রাজনৈতিক প্রচারের জন্য নাটক লিখতেন সত্য, কিন্তু তথ্য ও সত্য রচনায় তাঁর প্রতি তাচ্ছিল্য কি প্রকাশ করা চলে? উৎপলের ‘কল্লোল’ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গানের উচ্চারণের মর্মার্থ তিনি বুঝতে পারেন নি। সে-কালটা এমন ছিল যে বিশেষ স্থান-কাল-পাত্রের নাটক হয়ে উঠত আন্তর্জাতিক — আমাদের ‘কল্লোল’ বা ‘মানুষের অধিকার’ বা ‘তীর’ বা আরও কিছু নাটক দেখার অভিজ্ঞতা তো তা-ই বলে। ব্রেখট প্রসঙ্গেও তাঁর কথার সামনে আমরা থতমত খেয়ে যাই। ব্রেখটের রচনার ‘সবচেয়ে বিস্ময় তাতে রূপবর্তনের অব্যয়ভাব’-- মানে কি? (পৃ. ৪৫) ব্রেখটের নাটক মানেই কি শুধু কবিতা ও নাট্যের পরস্পরস্পর্শিতা? ব্রেখট যে রাজনীতিকে সুকৌশলে ব্যবহার করতেন কবিতায় বা নাটকে সে কারণেই তাঁর মহত্ত্ব, এই কথাটা তিনি বুঝতে পারেন নি একথা বললে ছোটমুখে বড় কথা হয়ে যায়। লোকসংস্কৃতি নিয়ে প্রবন্ধে যে যথার্থ লোকসংস্কৃতি কিভাবে জনসংস্কৃতি হয়ে ওঠে সে সম্পর্কে ভাষা-ভাষা মন্তব্য আছে। ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ প্রসঙ্গে আজকের সংস্কৃতি ভাবনা যে অর্থমনস্ক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত তার কথা সত্য, যদিও গোপাল হালদারের বইটির (সংস্কৃতি নামিত অন্য ২টি বই-ও) কথা উঠলেও ত্রয়ী গ্রন্থের তাৎপর্যকথা নেই। সব কেমন যেন তাৎক্ষণিকতায় সমর্পিত।

    নিজের ও অন্যদের পারিবারিক বৈভবের সঠিক মূল্যায়নে, বিস্তৃত উপস্থাপনে তাঁর লেখনীর প্রশংসা করতেই হবে। বিশেষত: ‘কুল কলঙ্ক গরিমা কথা’, ‘অভীক সেনের দিদিমা’, নীলিমাদেবী অথবা নানা চরিত্রায়নে তাঁর কৃতিত্ব অপরিসীম। অমলেন্দু গুহ বৃত্তান্ত এক প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। সমর সেনের নাউ বা ফ্রন্টিয়ার বিষয়ের তথ্যনিষ্ঠ উপস্থাপনা নানাভাবে উত্তরচর্চাকারীদের কাছে বহুমুখী কারণে মূল্যবান হবে। ওয়াসেক খান বা আবু বসর এই দুই বাল্যবন্ধুকেও তিনি পরিণত বয়সে ভোলেন নি। হিন্দুত্ব, গীতা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব তিনি রাখ-ঢাক না করেই হাজির করেছেন। ‘রেবতীবর্মণ’ কথা পুরোন বামনিষ্ঠ প্রকাশনা কর্মীর কথা যাঁরা বামসংস্কৃতি গঠনের ইতিবৃত্ত লিখবেন তাদের কাজে লাগবে। সুধাংশু দাশগুপ্ত বা জ্যোতি ভট্টাচার্য বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধার্পণ সংস্কৃতি-সমাজ ইতিহাস রচনার উপাদানকে এগিয়ে দেয় উত্তরপুরুষের কাছে। এক্ষেত্রে তাঁর স্মরণশক্তির কাছে বিনত হয়ে আমরা ধন্য হই।

    দুটি ব্যতিক্রমী লেখায় (এ-বইতে) তিনি প্রতিবাদী গ্রীসের কথা বলেছেন, তাদের সাহসিকতার বন্দনা করেছেন, চে গুয়েভারা ও জর্ডনের দুই বিমান চালকের মুণ্ডচ্ছেদের কথা বলেছেন। যদিও বেশিরভাগ লেখাই এ বইতে জাতীয়জীবন-কেন্দ্রিক। সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গায়নে বলতে ভুলেছি একটি ছোট্ট প্রবন্ধের কথা, যেখানে মান্না দে, সুচিত্রা সেন, যাযাবর প্রভৃতি কয়েকজনের প্রতি পরবর্তী শাসকদের অগভীর আগ্রহের কথা আছে। অতিবিখ্যাত এই ব্যক্তিদের নিয়ে বামপন্থীদের ঔদাসীন্য এবং নতুন শাসকদের অতি উৎসাহের কথা ব্যক্ত করেছেন যথাসম্ভব স্পষ্ট ভাবেই।

    অশোক মিত্রের ইংরাজী ও বাংলা প্রবন্ধের বড়ো গুণ ইতিহাসনিষ্ঠতা — ছোট ব্যাপারে, বড় ব্যাপারে। এই ইতিহাসনিষ্ঠতা তাঁর কালের লেখকদের মধ্যে বিরল। শৈশবের বন্ধুদের ক্রমান্বয় বড়ো হয়ে ওঠা। মোহনবাগানের গোলকিপার নগেন কালীর কথা, সমরেন্দ্র সান্যাল, অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথা। দৃষ্টিপাতের লেখক, রেবতী বর্মণ প্রভৃতির কথাবৃত্তান্ত উত্থাপন এক অর্থে ইতিহাসের কাঠকুটো সংগ্রহ করে দেওয়া। বড়ো প্রসঙ্গের দিকে এই দৃষ্টি তো ছিলই। এ ব্যাপারে তিনি মুক্তমনা, তাঁর প্রশংসা করবই বার বার।

    অশোক মিত্রকে বামপন্থী রাজনীতির লোক বলেই সবাই জানে। তিনি বামপন্থী রাজনীতির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক, দুটো দিক সম্পর্কেই যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াকিবহাল। তাঁর পি.এইচ.ডি. গবেষণার বিষয় ছিল আয়ের বন্টন। জরুরী অবস্থার ভয়াবহতা, বাম কর্মীদের নির্মম হত্যার প্রতিবাদ বিরূপ সমাজব্যবস্থা ও অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরে একদা যেসব লেখা লিখেছেন তা আছে ‘ক্যালকাটা ডায়েরী’ বইটিতে। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নিয়ে তিনি সরব হন। কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কগত আন্দোলনের বিশিষ্ট সংগঠক ছিলেন। রাজ্যসভার সাংসদ থাকাকালীন মনমোহন প্রবর্তিত নয়া আর্থিকনীতি ও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন। জনমত গড়ে তুলতে চান কর্পোরেট বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে। আলোচ্য বইতে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ আছে যেখানে তিনি সাম্প্রতিক বামপন্থা এবং পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী প্রয়াসের সদর্থক ও নঞর্থক, দুটি দিক সম্পর্কেই আলোচনা করেছেন। কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক। একটি প্রবন্ধে ২০১৫-তে বলেন-- ‘রাজ্যের বৃহত্তম বামপন্থী দলটির নেতৃত্বের একাংশের উভয়ার্থেই বুদ্ধি-সুদ্ধি লোপ পেয়েছে বলে সন্দেহ হয়।’ ‘কংগ্রসের কোলে আহ্লাদে ঢলতে চাওয়া, যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন দেখা নেতাদের বৃথাই মনে করিয়ে দেওয়া স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকে প্রায় সত্তর বছর পশ্চিম বাংলার খেটেখাওয়া মানুষ কংগ্রেসের শ্রেণীস্বার্থান্ধ নীতির শিকার হয়েছেন।’ তবে এই বাম নেতাদের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ শাণিয়ে লাভ নেই, এরা সবাই ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছেন, ছাত্র আন্দোলনের পরই ক্ষমতার লোভনীয় সিংহদ্বারে। দু:খের বিষয় এই দ্বিমুখী মনোভাব তাঁর, অশোক মিত্রের বক্তব্যের সমালোচ্য দিক। যারা ক্ষমতান্ধ তাঁদেরকে তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন--‘সর্বস্তরের দলীয় কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করুন, অত্যাচারিত কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে গিয়ে সাহস দিন, তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটিয়ে গুন্ডাশাহীর প্রতিরোধের ব্যবস্থা করুন।’ পশ্চিমবঙ্গবাসী যাঁরা ক্ষমতার অন্তর্গত নন তাঁরা সবাই জানেন গত তিন দশকে এদের হাতে পরিশ্রমশ্রান্ত মানুষ কিভাবে অবজ্ঞা, লুন্ঠন, অত্যাচার পেয়েছে। ‘লালঝাণ্ডার আপাত-পরাভব; কিন্তু কেন?’ প্রবন্ধে বলেন এ এক বিবেকবিহীন বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি বলেন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ব্যবহার করার চিন্তা অবশ্যই প্রশংসনীয়, দরিদ্রদের কাছে সরকারী অর্থ পৌঁছে দেওয়ার ভাবনা সমর্থনযোগ্য। কিন্তু পঞ্চায়েত বা দরিদ্রদের হাতে অর্থ পেয়েছে কারা ও কজন? ক্ষমতার লোভ কি এক্ষেত্রে কাজ করেনি? সিঙ্গুরে আমলাতান্ত্রিক মনোভাব এবং গুলি চালিয়ে নির্মম হত্যা কল্পনাতীত বলেন, পুলিশবাহিনীর বর্বর পরাক্রমের কথা বলেন। তা হলে এই নেতারা আত্মবিসর্জন দিয়ে কিভাবে টগবগে নেতৃত্ব খুঁজবে? ব্রিগেডে উপচে পড়া ভিড়, সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের ক্ষমতাবর্ধনের মোহ ও দুর্নীতি যদি সত্য হয় তাহলে তাদের দ্বারা লালঝাণ্ডার আপাত-পরাভব কাটানোর স্বপ্ন কিভাবে সফল হবে তা বোঝা যায় না। ‘সফলতা-অসফলতা’ প্রবন্ধে স্বীকার করেন বামপন্থী নেতারা ‘বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন’, ‘তাঁরা কতগুলো গুরুতর ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাইরের কারো অভিমত বা পরামর্শ আমল দেন নি। তা হলে তাঁরা এই প্রাজ্ঞ বামপন্থী পণ্ডিতের স্বপ্ন কিভাবে সফল করবে। এখানেই তিনি বলেন, ‘কোনো বামপন্থী দলই এখন আর বিপ্লবের কথা তেমন উচ্চারণ করে না,’ তারা ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার ‘প্রতিযোগিতায়’ ব্যস্ত, তাহলে সৎপরামর্শ কিভাবে তারা গ্রহণ করবে? অশোকবাবু বলেন ‘দেশে দেশে বামপন্থী দলগুলি অতি রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে’ এবং ‘বিপ্লব সম্ভাবনা এখনো ঘোর পরাহত’ তাহলে হাতে থাকে প্রত্যাশা আর ‘গভীর বেদনা’। ‘যে নেতারা বামপন্থীদের পথে বসিয়েছেন’ তাদের সাফল্য সম্মেলনে ছুটে যান তিনি কোন্‌ প্রত্যাশায়? মে-দিবস নিয়ে স্বপ্ন দেখা, ব্রিগেডে ইন্দিরা গান্ধীর সম্রাজ্ঞীসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাঠের আনন্দ নিয়ে দুটো প্রবন্ধ আছে। ‘সাধারণ বুদ্ধিতে বোধগম্য নয়’ প্রবন্ধে জ্যোতি বসুর প্রতি সুতীব্র আস্থার কথা আছে, প্রমোদ দাশগুপ্তের ভিন্ন ভাবনার কথা আছে, হরেকৃষ্ণ কোঙারের গ্রামাঞ্চল গঠনের কথা আছে। কিন্তু বাম পার্টির ইতিহাস যাঁরা জানেন তারা এই আস্থা রাখতে পারবেন কি? প্রমোদবাবুর ‘গণতান্ত্রিক নিয়মকলায় গভীর বিশ্বাস’ ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, সমরেশ বসু প্রভৃতির ঘটনায় ভিন্ন উপলব্ধিই ব্যক্ত করে। অতএব ‘বামফ্রন্টের প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়া’ আকাশ থেকে পড়ে নি, তার অধ:পতনের ইতিহাস আছে, সেদিকে তাকানোর সময় নেতাদের ছিল না, আজও নেই। অশোকবাবুর স্মৃতিশক্তি অসামান্য বলেছেন অনেকে, তিনি নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক প্রসঙ্গের সাতকাহন জানতেন।

    সুধাংশু দাশগুপ্ত প্রসঙ্গে অশোকবাবু বলেন ‘তাত্ত্বিক আদর্শ, সেই সঙ্গে আদর্শজড়িত তত্ত্ব, সহজ করে বোঝাতে তাঁর জুড়ি নেই।’ সুধাংশুবাবু গরিব-ক্লিষ্ট মানুষগুলির দু:খকষ্ট মোচনের স্বার্থেও কষ্ট পেয়েছেন, জেল খেটেছেন, তারপর পত্রপত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, প্রবন্ধ পুস্তক পুস্তিকা লিখেছেন। সুধাংশুবাবুদের মতো আদর্শ মানুষ আরও অনেকে ছিলেন কিন্তু তাহলে বামপার্টি গোল্লায় গেল কেন? রেবতী বর্মন-এর কাজকর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন আর একটি লেখায়। কিন্তু ক্ষমতালুব্ধ নেতারা কি এদের মনে রেখেছিল? এঙ্গেলস-এর রচনা সংক্ষেপ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন ‘ভূতের বেগার’ লেখেন তখন নেতারা হৈচৈ করেন, একদল প্রাজ্ঞ সুভাষের সমর্থনে কথা বললেও প্রমোদ দাশগুপ্ত পাত্তা দেননি। সাবিত্রী রায়ের ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসটি পছন্দ হয় নি বলে গোপনে প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সলিল চৌধুরীর ‘কোন এক গাঁয়ের বধূ’ গানটিকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলা হয়, সলিল দু:খ পেয়ে বোম্বে চলে যান। সমরেশ বসুর বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রী ও অন্যান্যদের লেলিয়ে দেওয়া হয়, সত্য মাস্টার খুন হন। এসব রেকর্ডেড হিস্ট্রি। প্রমোদ দাশগুপ্তদের কীর্তিকলাপ অজস্র। অনিল বিশ্বাস ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা পশ্চিমবঙ্গীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নষ্ট দলতন্ত্রে সামিল করেন। শিক্ষার সপিণ্ডকরণ শুরু হয়। এ সত্ত্বেও অশোক মিত্র এঁদের বা পরের নেতাদের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণের ডাক দেন। বলিহারি তাঁর পাণ্ডিত্য। জ্যোতি ভট্টাচার্য একদা যুক্তফ্রন্টের শিক্ষামন্ত্রী, বিখ্যাত অধ্যাপক। তাঁর ‘পরিপ্রশ্ন’ বইটি পড়ে মুগ্ধতার কথা বলেন অশোকবাবু। কিন্তু ‘তাঁর সঙ্গে বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈসাদৃশ্য’ দেখা দেওয়ায় ‘স্বেচ্ছায় সরে গেলেন।’ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্পণ অশোকবাবুর মনের উদারতার পরিচায়ক। সফদর হাসমির ‘গণ চেতনা উন্মোচনে’র প্রয়াসে সম্মান জানানোর জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু উৎপল দত্তকে ট্রটস্কিপন্থী বলে বর্জন কি বামনেতাদের সম্মান বৃদ্ধি করে? পৃ. ৪১-এ বলেছেন উৎপল দত্তের নাটক ‘জোড়াতালি দেওয়া নাটক’ (তাই কি? উনি যদি একটা প্রবন্ধ লিখতেন উৎপল নাটক বিষয়ে তাহলে পাঠক উপকৃত হত। উনি যদি ব্রেখট ও তাঁর এপিক থিয়েটার নিয়ে একটা ভালো লেখা লিখতেন তাহলে পাঠক উপকৃত হত। অশোকবাবু মন্তব্য করেছেন (ঐ, পৃ. ৪১) প্রচারমূলক নাটক যেহেতু, রাজনৈতিক প্রচারের জন্য তাই তাতে ‘দুর্বলতা’ থাকতে পারে। কিন্তু বামপন্থী অশোকবাবুর জানা উচিত ভালো নাটক মাত্রেই প্রচারমূলক, তা যদি নাও মানি, প্রচারমূলক নাটকের গুরুত্ব আছে বামপন্থী আন্দোলনে, উনি সেসব যদি বলতেন আমরা অনুপ্রেরণা পেতাম। রাশিয়া, চীন ও অন্য বামপন্থী একদা প্রচারপন্থী নাটকও সমাদৃত হয়েছে।

    আলোচ্য বইটির কয়েকটি লেখাকে আমরা বলতে পারি--প্রসঙ্গ কথা। যেমন ধরা যাক--‘গীতা ধর্ম, গীতা স্বর্গ’ লেখাটি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উড়নচণ্ডীরা ভারতে গীতাকে অবশ্য পাঠ্য করতে চান নিজেদের দাপট দেখাতে। এখানে অবশ্য আলোচনা গীতা বইটির মূল কথায় নয়। বরং গীতা নিয়ে, হিন্দুধর্ম নিয়ে নিজের কথা বলেন। উনি বলেন—‘আমি কিছুতেই মহাভারতে তেমন কিছু মহত্ত্ব খুঁজে পেতাম না, এ তো স্রেফ যুদ্ধ মারামারি চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক বর্ণনা’। তাছাড়া বইটির নানা সামাজিক আচার কলা প্রথা তাঁর পছন্দ ছল না। যেমন-- নারী ও পুরুষ উভয়েরই বহুগামিতা। গীতা তাঁর মধ্যে বিদ্রোহ জাগাত। খাঁটি হিন্দু পরিচয় দিতে যথেষ্ট অনীহা। তরুণ পাঠকের মনে গীতার তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা থাকলে ভালো হত। মহাভারত তো এক কথায় সোস্যাল হিস্ট্রির ভাণ্ডার --কোশাম্বী থেকে থাপার বলেছেন। ‘ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ প্রবন্ধটিও প্রসঙ্গকথার গুরুত্বে আমাদের আকর্ষণ করে। অশোকবাবু দেখাচ্ছেন ‘আজ পর্যন্ত এমনকি একজনকেও বাবরি ধ্বংসের অপরাধে শাস্তি দেওয়া হয়নি’, মসজিদটি পুনর্গঠনে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ নেই। ১৯৯০-এ মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলীর আগে পরে শিবসেনা বা দোসর দলগুলি শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে যোগ প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর। অন্যদিকে ইয়াকুব মেমনের প্রাণদন্ড। দেখা যাচ্ছে বিচারক্ষেত্রেও সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর প্রতি তারতম্য যথেষ্ট। শেষে লেখক জানান পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় সংকীর্ণতা নেই বলে কিছু লোকের যে ধারণা আছে তা সত্য নয়। কথাটি সত্য। আর একটি প্রবন্ধে দেখান বড়লোকেরা যত সহজে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার পায়, গরীবরা তা পায় না। ঋণশোধে বড়লোকের অনীহা যথেষ্ট। সব ধর্মেই পবিত্র মানবিকতার কথা বলা হলেও পেশোয়ারে শিশুমেধযজ্ঞ ও বীভৎস তাণ্ডবলীলা ঘটে। অন্য একটি লেখায় অসাধু অর্থলগ্নি সংস্থার কথা আছে। বামফ্রন্ট আমলে ‘সঞ্চয়িতা’ নামক ফান্ডের বিরুদ্ধে অর্থমন্ত্রী হিসাবে এই প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। তাতে অনেকের অসন্তোষ। পরবর্তী প্রশাসনে এই অসৎ ফান্ডের কুকীর্তিতে কর্তাদের যোগের উল্লেখ করেন। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে প্রশাসন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার, সরকারি জমি বন্ধক দেওয়ার, আর্থিক দুর্গতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আড়াই লক্ষ কোটি বরাদ্দের অনুরোধ ইত্যাদির কথা বলে কিঞ্চিৎ বিদ্রূপের সুরে রাইটার্সকে মার্কিন ধনকুবেরদের কাছে বেচে দেওয়ার কথা বলেন। অন্য একটি লেখায় বলেন একদিকে সংবাদপত্র-জগৎ মোদীময় অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রীর কল্যাণে জনগণ এক নেশার উপত্যকা থেকে আর এক নেশার উপত্যকায় পৌঁছে যান। কলকাতাকে লন্ডন বানানোর ইচ্ছাপ্রকাশ তার একটি। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে বিজয়ী দলকে নিয়ে হৈচৈ আর একটি। হাজার হাজার মানুষ প্রশাসনের দাক্ষিণ্যে নেশার পর নেশায় আচ্ছন্ন। অপ্রিয় কথা প্রচুর আছে। ভিন্ন প্রবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য দেখা যায় গরীব সমস্যা সংকুলতাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর কর্মসুচির সব আগে থাকে ‘কোন বিখ্যাত বঙ্গসন্তানের অপর্যাপ্ত পরিচর্যা’। প্রবাদপ্রতিম বাঙালি গায়ক কিংবা বঙ্গীয় মহানায়িকার প্রয়াণে তাঁর শেষকৃত্য। অশোকবাবুর মতে ‘এই যে বিখ্যাতদের ধাওয়া করা তা আসলে আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে পরিস্ফুট।’ অথচ বিদ্যাসাগর-পুরস্কার প্রাপক বিনয় মুখোপাধ্যায়, ‘দৃষ্টিপাত’ বইটির রচয়িতা, পুরস্কার সভায় যথাযোগ্য সম্মানে বঞ্চিত। তাঁর সুতীক্ষ্ণ ও জাগ্রত ভঙ্গিতে তিনি লক্ষ্য করেন অসাধু লগ্নি প্রতিষ্ঠানের রমরমা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের অনুপ্রবেশ। সমাজবিরোধী প্রশ্রয় এবং সংখ্যালঘু সম্পর্কে বিমিশ্র মনোভাব এবং বিজেপি ও সঙ্ঘের কার্যকলাপ বৃদ্ধি বিষয়ে সতর্ক করে দেন। ‘শৃঙ্খলা কাকে বলে’ প্রবন্ধে দেখান দেশে ফ্যাসিবাদের প্রকট প্রবেশ এবং জনগণের বিভ্রান্তি। তিনি অবশ্য মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী বড়ো দলই ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করতে পারে। সত্যিই কি তা পারে, না অলীক প্রত্যাশা বোঝা শক্ত। হুগলী জেলার কয়েকজন বাম নেতার স্মৃতিতর্পণে তাঁর যাওয়া দায়বদ্ধ বিবেকের অভিঘাতে, কিন্তু তবু তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন ‘এই ঋতুতে সব কিছুই ঝাপসা হয়ে আসে এমনকি স্মৃতিও’। আসলে অপ্রিয় সত্যে তিনি পরাঙ্মুখ নন, কিন্তু গভীর চিন্তা সজ্জায়, স্ববিরোধিতা কাটাতে অক্ষম। তাই বিষাদ।

    ব্যক্তি, ব্যক্তিগত, ব্যক্তিস্মৃতি এ-বইতে প্রবল এবং তাঁর এ-সব রচনার উপলব্ধি, স্ববিরোধিতা বাদ দিলে একটা কালের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে জরুরী বলেই মনে হয়। ‘অভীক সেনের দিদিমা’ রচনাটি এ ধারার চমৎকার দৃষ্টান্ত। তাঁর বাল্যকালের বরিশাল কংগ্রেসী ও বিপ্লবী দলগুলির সক্রিয়তা। অশ্বিনী দত্ত প্রতিষ্ঠিত একাধিক বিদ্যালয়, মঙ্গলাভবনের নেপথ্যে কৃষক পীড়ন, সেকালের ঘরজামাই বৃত্তি, সেকালীন মহিলা সমাজের কেউ কেউ কিভাবে দেশ সেবায় নিয়োজিত ছিলেন তার টুকরো কোলাজে সমুজ্জ্বল রচনা। আর একটি লেখায় আছে সিগনেট প্রেসের নীলিমা দেবী, যিনি জীবন-কাহিনীতে ‘অত্যাশ্চর্য বিস্ময়’, নীলিমা দেবীর ব্যতিক্রমী দাম্পত্য, বিজয়লক্ষ্মীর সঙ্গে সখীত্ব যেমন আছে তেমনি ইন্দিরা গান্ধীর চলচ্চিত্রপ্রীতি, একসময়ে অসন্তোষ, তবু নীলিমা দেবী সম্পর্কে রচনা পাঠে ইন্দিরার প্রশংসাজ্ঞাপন প্রভৃতি এইসব ব্যক্তিত্বময়ীদের ফুটিয়ে তোলা হয়। ‘আলো না মরীচিকা’ রচনায় জনৈক পদস্থ ব্যবসায়ী বাড়িতে নিমন্ত্রণ, জনৈকা সম্পন্ন নারী যিনি এক নকশাল নেতার ভাগনী, তার সঙ্গে পরিচয়, রায়বাহাদুর কন্যার ব্রিটিশ রাজপুরুষদের দিকে গুলি, বিগত কালে আদর্শবোধের সম্পদ, সম্পন্নর বামপন্থী পাগলামির কথা ওঠে। ‘নাটকীয় মুহূর্ত’ রচনায় আছে নাটক কিভাবে আবেগকে নিষ্কাশিত করে তার কথা, অতি শৈশবে শিশিরবাবুর অভিনয় দেখা (রীতিমত নাটক), শিশিরবাবুর ব্যক্তিগত স্বর, মানিকবাবু ও পূর্বাশা, পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসের সূচনাংশ সম্পর্কে কথা, দিল্লীতে বহুরূপীর রক্তকরবী দেখা, জওহরলালের আগমন ও তৃপ্তি মিত্রের সম্বর্ধনা, জীবনানন্দের একটি কবিতায় নাট্যমুহূর্ত সন্ধান, উৎপল দত্তের নাটক, কল্লোলের বিজ্ঞাপন, নির্বাচনী বক্তৃতা দিতে দিতে গ্রামে গ্রামে যাওয়া, কালসন্ধ্যা নাটকে অসুস্থ কুমার রায়ের অভিনয় সব যেন অটুট স্মৃতি, যদিও কিছু কিছু অনেক আগের। শেষের দিকে আছে ‘হারিয়েও যা হারায় নি’ রচনাটি, যেখানে আছে ‘একটি বিশেষ গোত্রের শৈশবস্মৃতি’, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের, স্কুল সহপাঠীদের কথা। মৌচাক ও রামধনু পত্রিকা পড়েছিলেন যে বাল্যবন্ধুর বাড়িতে সেইকথা, ‘যে কটা দিন টিঁকে থাকা একমাত্র স্মৃতিনির্ভরতাই সম্বল’-- এই কথা আমাদের মন যেমন ভালো করে দেয় স্মৃতির অবিনশ্বরতায়, তেমনি খারাপ করে দেয় এমন মানুষটির অনিবার্য অভাবে। তেলেঙ্গানার চেরাপল্লি সেন্ট্রাল প্রিজন থেকে তরুণ বন্ধুদের চিঠি পত্রিকার জন্য পেয়ে তিনি খুশী। এই তরুণরা ‘আদর্শকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেন নি’।

    আদর্শকে আঁকড়ে নব্বই বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকা, তীক্ষ্ণ শাণিত কলমজীবি এই ব্যতিক্রমী মানুষটি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর ইংরেজি ও বাংলা বিস্তর লেখা থেকে গেল আমাদের চারপাশে। বিস্মৃতি মাত্রেই বেদনাদায়ক। জীবনানন্দর ভাষায় বলা চলে-- আমরা মোটেই অন্ধকার পিয়াসী নই। ‘মানুষের প্রয়াণের পথ অন্ধকার/ ক্রমেই আলোর মতো হতে চায়’।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)