অনেকদূরে একটা পাহাড়। অল্পদূরে একটা পাহাড়ি নদী। নদীতে অনেক জল। স্রোতও আছে। বড়ো বড়ো কত পাথর নদীর জলে ডুবে আছে। এই নদীটার পাশেই একটা বিরাট জঙ্গল। জঙ্গলে হাতি আছে। ময়ূর আছে। বাইসন, হরিণ ওরাও আছে অনেক।
নদীটার এপারেই বিরাট একটা সবুজ মাঠ। মাঠের পাশে ছোট্ট এক পাহাড়ি বস্তি। বস্তিতে অল্প কিছু ঘর-বাড়ি। সব বাড়িগুলোই কাঠ ও টিন দিয়ে বানানো। বাড়িগুলোতে গাছপালা অনেক, লোকজন খুব কম।
এই সবুজ সুন্দর মাঠটাতেই আনন্দনগর নেচার লাভার্স ক্লাবের অ্যানুয়াল নেচার স্টাডি ক্যাম্পের লাল নীল সবুজ বেগুনি রঙের রঙিন তাঁবুগুলো সাজানো হয়েছে।
কাল রাতে কলকাতা থেকে ট্রেনে উঠেছিল কাহিনি। ওরা ছিল তিরিশজন ক্যাম্পার। ক্যাম্প কম্যান্ড্যান্ট, ইন্সট্রাকটার, কোয়ার্টার মাস্টার, ডাক্তার, গাইড ও রান্নার লোকজন নিয়ে আরও দশজন। আজ ভোরে ট্রেন থেকে নেমে অনেকগুলো জিপে করে ওরা দল বেঁধে চলে এসেছে এই সুন্দর জায়গাটায়। ক্যাম্পসাইট দেখে সবারই খুব আনন্দ। তিনরাত-চারদিনের এই নেচার-স্টাডি ক্যাম্প। কাহিনি এই প্রথম ক্যাম্পে এল। ক্যাম্পে আসার কত মজা, সে সব গল্প ওর বন্ধু, শঙ্খমালার কাছে অনেক শুনেছে। শঙ্খমালা প্রতিবছর ক্যাম্পে আসে। ওর অনেক অভিজ্ঞতা। শঙ্খমালাই কাহিনিকে উৎসাহ দিয়ে এবছর ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে।
ক্যাম্পগ্রাউন্ডে পৌঁছে সবাই খুব খুশি মনে কথা বলছে। গল্প করছে। পায়ে পায়ে হেঁটে-বেড়িয়ে ঘুরছে। আর একটু পরেই বাঁশি বাজবে। বাঁশি বাজলেই দৌড়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে। সেখানে সবার সঙ্গে সবার পরিচয় হবে। সেলফ ইনট্রোডাকশন হবে। তারপর ক্যাম্পের তরফ থেকে সব বলে দেবেন স্যারেরা--এই চারদিন কি রুটিন, কি কি করতে হবে, কি কি একদম করা যায় না। এবং সবাইকে টুপি দেওয়া হবে। সবশেষে কে কোন তাঁবুতে থাকবে, কার সঙ্গে থাকবে স্যারেরা জানিয়ে দেবেন।
কাহিনি, শঙ্খমালা ও তিস্তা মাঠের সবুজ ঘাসে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। শঙ্খমালা একে একে বলছে, দূরের ঐ পাহাড়টার কি নাম, নদীটার নাম, জঙ্গলের নাম। শঙ্খমালা বেশ সব জানে!
কাহিনি গল্প শুনতে শুনতে আনমনে একবার নদীর দিকে চেয়ে দেখে দু’তিনজন পাহাড়ি মেয়ে-বউ মাথায় কলসি করে জল নিয়ে এসে ওদের ক্যাম্পের বড়ো বড়ো ড্রামগুলো ভরে দিচ্ছে। এই জল দিয়েই সবাই হাত-মুখ ধোবে। নিজের খাওয়া থালা-গ্লাস নিজেই ধোবে। এই চারদিন কেউ চান করতে পারবে না। ক্যাম্পে এলে চান করা মানা। জল খরচ করতে হবে খুব মেপে-বুঝে। কারণ দূরের ঐ নদীর জল অনেক কষ্ট করে এখানকার পাহাড়ি মেয়ে-বউরা মাথায় করে করে বয়ে এনে দিচ্ছে। তাই সেই জল সাবধানে খরচ করা শিখতে হবে। কাহিনিকে এসব কথা অনেক আগেই শঙ্খমালা বলেছে।
কাহিনি শঙ্খমালার সঙ্গে গল্প করতে করতেই দেখল ওই মেয়ে-বউদের দলে ওদের বয়সী একটা ছোট মেয়েও রয়েছে। ওই মেয়েটাও জলের একটা ভারি জার মাথায় করে বয়ে আনছে।
বাঁশি বাজার আওয়াজ শোনা গেল। স্যারেরা সবাই চলে এসেছেন একজায়গায়। সেখানে ক্লাবের পতাকা লম্বা-খুঁটিতে মুড়ে রাখা রয়েছে। ক্যাম্প শুরু হয় ক্লাবের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে, শেষ হয় পতাকা নামিয়ে। এই চারদিন ক্লাবের পতাকা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়বে।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যারা ছিল, সবাই চলে এল। তারপর গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। ক্লাবের তরফ থেকে প্রথমে একজন কিছু কথা বললেন। সবাই মন দিয়ে শুনল। তারপর সবার পরিচয়পর্ব হল। পতাকা তোলা ও টেন্ট ভাগ করে দিয়ে সবশেষে ক্যাম্প কম্যান্ড্যান্ট অর্থাৎ সি সি স্যার বললেন, আমরা যা যা বললাম, তোমরা কি সবাই সব বুঝতে পেরেছো?
হাত তুলে সবাই বলল, হ্যাঁ স্যার।
আমরা তাহলে ক্যাম্প অ্যাকটিভিটিস শুরু করব এবার। তোমাদের কারও যদি কিছু বলার বা জানার থাকে বলতে পারো।
সবাই চুপ করে আছে। কাহিনি হঠাৎ হাত তুলে বলল, স্যার, আমি একটা কথা বলব।...
শঙ্খমালা অবাক হয়ে কাহিনিকে দেখছে। ভাবছে ও আবার কি বলবে? শঙ্খমালা তো সবই ওকে বলে দিয়েছে।
নীল টুপি পরা সি সি স্যার বললেন, নিশ্চয়ই বলবে। বলো।
স্যার, আমাদের ব্যবহার করার জন্য ঐ দূরের নদীর জল যাঁরা বয়ে বয়ে আনছেন, তাঁদের মধ্যে ছোট একটা মেয়েকেও দেখলাম। সে ও কত কষ্ট করে মাথায় জলভরা জার বয়ে বয়ে আনছে। ও তো ছোট মেয়ে। স্যার, চাইল্ড লেবার তো ঠিক নয়!
গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা চুপ। স্যারেরাও আর কোনও কথা বলতে পারেন না। শঙ্খমালা অবাক হয়ে কাহিনির দিকে চেয়ে আছে। নীল টুপি পরা সি সি স্যার একটু একটু করে এগিয়ে এলেন কাহিনির দিকে। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। তুমি ঠিক বলেছো। আমাদের চোখের সামনে একটা চাইল্ড লেবার রয়েছে, অথচ আমরা খেয়াল করিনি। এটা ভুল হয়েছে আমাদের। ওকে আমরা দেখছি। তোমরা সবাই এবার টেন্টে যাও। ঠিক দশ মিনিট পরে বাঁশি বাজলেই তোমরা বাটি নিয়ে কিচেন রুমের সামনের টেবিলে চলে আসবে, কোয়ার্টার মাস্টার তোমাদের ব্রেকফাস্ট দেবেন।
বন্ধুরা সবাই যে যার টেন্টে চলে গেল। শঙ্খমালা কাহিনিকে নিয়ে ওর টেন্টে ফিরে এসে বলল, তুই তো দারুণ কথা বলেছিস। থ্যাঙ্ক ইউ কাহিনি।
টেন্টে রুকস্যাক রেখে হাত-মুখ ধুয়ে চটজলদি তৈরি হয়ে নিল সবাই। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় বাঁশি বাজল। সবাই বাটি হাতে দৌড়ে চলে এল কিচেন রুমের কাছে। সেখানে লম্বা এক টেবিলে রাখা গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খাবার। সবাই সুন্দর লাইন করে দাঁড়িয়েছে। কাহিনিও দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় হঠাৎ ওরা দেখল, সি সি স্যার একটা ছোট পাহাড়ি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন। মেয়েটাকে সবাই চিনতে পারল না। কিন্তু কাহিনি চিনতে পেরেছে। ও তো সেই জল ভরা মেয়েটা! মেয়েটার হাতেও একটা বাটি। স্যার এসে হাসতে হাসতে বললেন, ছোট্ট বন্ধুরা, এবারের ক্যাম্পে তোমরা এক বন্ধুকে পেলে। আমাদের নতুন ক্যাম্পার। ও এই চারদিনে তোমাদের সঙ্গেই ক্যাম্পে থাকবে। তোমরা খুশি তো?
সবাই একসাথে বলল, হ্যাঁ স্যার, আমরা খুশি।
পাহাড়ি ছোট মেয়েটাও বাটি হাতে ওদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়াল। কাহিনি একটু দূর থেকে দেখতে পেল ও খাবার নিচ্ছে। ওর চোখে-মুখে কি আনন্দ। স্যারকে একবার জিগ্যেস করতে হবে, স্যার ওর টেন্ট কোনটা? ওর নাম কি?
কাহিনি ব্রেকফাস্ট নিতে এসে ওর বাটিটা এবার বাড়িয়ে দিল। স্যার কাহিনির বাটিতে গরম খাবার তুলে দিয়ে হেসে বললেন, কাহিনি ও তোমাদের টেন্টে থাকবে। ওর নাম জুলি শেরপা। সিক্সে পড়ে। তুমি এবার খুশি তো!
কাহিনি সত্যিই খুব আনন্দে হেসে বলল, হ্যাঁ স্যার। ভীষণ খুশি। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।