হরিপদ একজন সাদামাটা ছোটখাটো লোক। এতই ছোটখাটো আর এতটাই সাদামাটা যে তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা প্রায় চলেই না। মাথায় মেরেকেটে পাঁচফুট হবে হয়তো, শিরা-ওঠা হাত-পা, গর্তে ঢোকা গাল আর কালি হয়ে আসা চেহারায় আরো ছোটখাটো দেখায়। অবশ্য আজকাল রাস্তাঘাটে লোকটাকে আর তেমন দেখা যায় কই? মাঝেমধ্যে তেলচিটে একটা গামছা কাঁধে পাড়ার বাগানওয়ালা বাড়িগুলোর গেটে দাঁড়িয়ে "বাগান সাফ করাবেন নাকি গো?" বলে মিয়োনো গলায় ডাক পাড়ে। যারা সত্যিই বাগান পরিষ্কার করাবে বলে লোক খুঁজছে, তাদের উৎসুক কানে ছাড়া অন্য কোথাও সে ডাক পৌঁছনোর কথা নয়। তারপর অল্প দর কষাকষি আর দুটো বাসি রুটি বা একবাটি কালকের ভাতের কড়ারে হরিপদ বাগান কোপানোর কাজে বহাল হয় একদিন বা দু'দিনের জন্য, তা-ও যেসব বাড়িতে কাস্তে-কোদাল-খুরপি-ঝুড়ি মজুত আছে, সেসব বাড়িতেই। কেননা, ওসব বাগান কোপানোর সরঞ্জাম হরিপদর ভাঁড়ারে বাড়ন্ত।
তবে সব বাড়িতেই যে শুধু বাসি রুটি জোটে তা নয়। কপাল তেমন ভাল থাকলে গরম ভাত আর মাংসের ঝোলও জুটে যায়। তবে ওসব সোয়াদের খাবার হরিপদর মুখে আজকাল আর রোচে না। মুখের ভেতরটা টক হয়ে যায়, বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে মাংসের ঝোলের গন্ধ নাকে গেলেই। বরং ঠান্ডা চচ্চড়ি আর বাসি রুটিতেই জ্বালাটা কম হয়।
একা মানুষ, হপ্তায় দু'দিন কি তিনদিন বাগান কোপানোর কাজ পেলেই বাকি ক'টা দিন শুয়ে বসে কেটে যায় লোকটার। বাড়ির বাইরে বেরনোর আর দরকার পড়ে না। অবশ্য বাড়িটাই তো পুরো হাড়গোড় বের করে দাঁড়িয়ে আছে। আধা টালি অ্যাদ্দিনে গায়েব, মেঝেয় শুয়ে দিব্যি পা নাচিয়ে নাচিয়ে আকাশ দেখা যায়। নেহাত মাথার ওপর একটা পুরনো বটগাছ আছে, তাই বিষ্টিবাদলায় ঝরঝরিয়ে জল পড়ে না ঘরে, গাছের পাতা চুঁইয়ে যেটুকু জল ঘরে ঢোকে ওতে হরিপদর কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। সেবার বর্ষার আগে ফেলির মায়ের দাঁত কিড়মিড়ুনির ঠেলায় দেওয়ালগুলো পাকা করেছিল ভাগ্যিস, নয়ত পাঁচ-পাঁচটা বর্ষা পেরিয়ে অ্যাদ্দিনে মাটির দেওয়াল ধসে গাছতলায় দাঁড়াতে হত। অবিশ্যি গাছতলাই বা খারাপ কিসে? আজকাল বরং ঘরে ঢুকলেই মাঝেমধ্যে মাথার মধ্যেটায় কেমন ধাঁধা লেগে যায়। রাতবিরেতে মনে হয় বুঝি ফেলিটার গা থেকে কাঁথা খসে গেছে, হাত বাড়িয়ে কাঁথা ঠিক করতে গিয়ে খেয়াল হয় পাঁচবছর আগে ঐ কাঁথাখানায় মুড়েই তো ফেলিটাকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিল হরিপদ আর ওর দাদা তারাপদ।
ফেলির মা বোধহয় ততক্ষণে ঘোলাটে চোখ আর মাটিতে লুটনো আঁচল নিয়ে থানায় গিয়ে বলে বসেছে "মেয়েটাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছি গো বাবু, সাতদিনের ফাঁসি দাও আমায়।"
কমলির পেছন পেছন ছুটে গিয়েছিলো দাদার বৌ লক্ষ্মী। ছোট জায়ের সঙ্গে গলার বা গায়ের জোরে সে কোনোদিনই পেরে উঠত না, তবুও ছ'মাসের পোয়াতি ছোট জা যখন রাগের মাথায় বড় মেয়েটার গলা টিপে ধরেছিল, তখন সে-ই প্রাণপণে মেয়েটাকে খুনে মায়ের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কমলির গায়ে তখন খ্যাপা মোষের বল ভর করেছে, দড়ি পাকানো চেহারার লক্ষ্মী তার সঙ্গে পারবে কেন? তার ওপর আগের দিন থেকে দু'মুঠো মুড়ি আর জল খেয়ে থেকেছে, গায়ে বল পাবে কোত্থেকে? সেইদিনই বিকেলে আর থাকতে না পেরে ভারী শরীরটা টেনে কমলি গিয়েছিলো নন্দীদের বাড়ি, ঠিকে কাজের খোঁজে। কাজ পায়নি, তবে একবাটি ভাত পেয়েছিল, বোধহয় উঁচু হয়ে ওঠা পেটটার দৌলতেই।
ফেলিকে একমুঠো, লক্ষ্মীকে একমুঠো দিয়ে নিজে বাকিটা শেষ করবে বলে সরিয়ে রেখেছিল। এক খাবলা নুন নিতে পেছন ফিরেছে, সেই ফাঁকে ফেলি ভাতের বাটিটা নিজের পাতে উপুড় করেছিল। মা যখন চুলের মুঠি ধরে টান দিয়েছে, তখনও ঢ্যাঁটা মেয়ে বলে চলেছিল, "বেশ করেছি খেয়েছি। না খেতে দিয়ে নিজে গিলবি তো পেটে ধরেছিলি কেন?"
সাত বছরের মেয়ের অমন মুখে মুখে চোপা শুনে লক্ষ্মী হাঁ! পোয়াতি মানুষ, তার তো এখন পুরো দুনিয়া গিলে খাওয়ার দশা! অবিশ্যি পোয়াতি মায়ের ক্ষিধে কি আর কচি মেয়ে টের পায়? আধবুড়ি হতে চলল লক্ষ্মী, সে-ই এখনো বুঝল না কেমন সে ক্ষিধে, তো এ ছুঁড়ি জানবে কেমনে?
মেয়েটাকে দুটো চড় কষাবে বলে রান্নাঘরে ঢুকেই লক্ষ্মী হাঁউমাউ করে উঠেছিল। ততক্ষণে কমলির দুটো হাত সাঁড়াশি হয়ে চেপে বসেছে ফেলির গলায়, মেয়ে যে নেতিয়ে পড়েছে মায়ের সে খেয়াল নেই। সে তখন গলার শির ফুলিয়ে মেয়ে আর তার চোদ্দ-পুরুষের বাপ-বাপান্ত করছে। বড় জায়ের চড়ে হুঁশ এল যখন, মেয়ে ম'রে কাঠ।
হরিপদ এসব নিজের চোখে দেখেনি। সে গিয়েছিলো তারাপদর বাড়ি, দু'ঘণ্টার রাস্তা। সেখানে দু'একটা কাজের সন্ধান দিয়েছে দাদা, যদি হিল্লে হয়। গেছিলো দুদিন আগে, সেইদিনই সন্ধেয় ফেরার কথা। পোয়াতি বউ মেয়ে নিয়ে একলা থাকবে, তাদের আগলাতে বৌদি এসে ক'দিন ছিল। বাঁজা মানুষ, পিছটান নেই। থাকুক ক'দিন। যদিও দুই বৌ এক জায়গায় থাকলে বাড়িতে কাক-চিল বসতে পায় না, তবুও একটা মনিষ্যি তো রইল বাড়িতে। খেতে দেওয়ার মত অবশ্য ঘরে কিস্যু ছিল না। আকাশ-ভাঙ্গা বৃষ্টি আর কাঁপুনি দেওয়া জ্বরের জালায় হরিপদ হপ্তাখানেকের ওপর ঘরের বার হতে পারেনি। চাল, তেল সবই বাড়ন্ত। তবে কিনা, এ তো আর কুটুম নয় যে রেঁধেবেড়ে দিতে হবে, আর তারাপদরা-ও এমনকিছু দু'বেলা ভাত খেয়ে রাজার হালে থাকে না, যে তার বৌয়ের পেটে জলমুড়ি সইবে না। এইসব সাত-পাঁচ ভেবে হরিপদ রওনা হয়ে গিয়েছিলো।
সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে দেখেছিল রান্নাঘরে পড়ে আছে মেয়েটার কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর, পাশে বসে আছে মেয়ের মা, যেন পাথুরে মূর্তি, মুখে আঁচল চেপে উনুনের সামনে বসে আছে বৌদি। বৌদিই বলেছিল সব কথা। দাদার বাড়ির আশপাশে দুটো বাড়িতে বাগান কুপিয়ে পাওয়া ক'টা টাকা সঙ্গে ছিল বলে মেয়েটাকে পোড়াতে পেরেছিল, নইলে শ্মশান-খরচা জোগাড় করতে ভিক্ষে করতে হত। ভিক্ষেয় হরিপদর বরাবরের অরুচি। যাই হোক, সেসব কাজ সেরে ঘরে ফিরে দেখে বাড়িতে পাড়ার লোকে উপচে পড়ছে। ফেলিকে নিয়ে শ্মশানে রওনা হবার পরেই নাকি ফেলির মা খালি পায়ে থানার দিকে দৌড়েছে। সঙ্গে গেছে বৌদি।
তারপর কদিন হুড়োহুড়ি, দৌড়োদৌড়ি। হরিপদর বৌ-এর পাঁচ বছর জেল হয়েছিল শেষ অব্দি। রায় বেরনোর আগেই তার চাউনি কেমন ঘোলাটে, কাপড়চোপড় জায়গায় থাকেনা, কেউ কিছু শুধোলে বোবা চোখে চেয়ে থাকে, এসব দেখেই বোধহয় জজসাহেব শাস্তির মেয়াদ কমিয়েছিলেন। মাসছয়েক আগে তাকে জেল থেকে ছেড়েছে। হরিপদ খোঁজ রাখত না, কদিন আগে দাদা এসে বলে গেল কমলি এখন ওদের কাছেই থাকে। বাপ-মা মরেছিল জন্ম দিয়েই, বুড়ি পিসি বিয়ে দেওয়া অব্দি বেঁচে ছিল, বাপের কুলে আর কেউ নেই। লক্ষ্মীর বাচ্চা-কাচ্চা নেই বলে মায়াটা বেশি, সে নাকি বরের পায়ে প'ড়ে বলেছে, কোলের ছেলে খোয়ানো মাথা-খারাপ মেয়েমানুষ একলা কোথায় ঘুরবে, তার চেয়ে তাদের কাছেই থাকুক।
"থাকুক গে যে যেখানে আছে, মৌজ করে থাকুক সব," বিড়বিড় করতে থাকে হরিপদ। আজকাল এই এক রোগে ধরেছে তাকে। মনের ভেতর ঘাই মারতে থাকা কথাগুলো কখন যে মুখের আগল খুলে বেরিয়ে পড়ে, সে নিজেও বুঝতে পারে না।
মাঝেমধ্যে হরিপদর মনে পড়ে, জেলে যাওয়ার সময় তো কমলি পোয়াতি ছিল। সেটাকেও কি সে-ই নিকেশ করেছে জেলে বসে? খোঁজ নেওয়া হয়নি আর। যাক্গে, মরে গেলেই বরং ভালো, ল্যাঠা চুকেছে। থাকলেই তো সেই রাক্ষুসে ক্ষিধে। পেটের আগুন নেভাতে জীবন যেত। এখন দ্যাখো, একটাই পেট। ক্ষিধে পেলে জল খাও পেটভরে। ব্যস। হুঁ হুঁ বাবা, জল খেতে তো আর পয়সা লাগে না। ধারবাকি রেখে কারো মুখঝামটাও শুনতে হয় না।
পুজো পেরনোর পর থেকেই রাতের দিকে হিম পড়ছে। রাতে ঘরটা বড় স্যাঁতসেতে হয়ে থাকে আজকাল। প্রায়দিন সকালে মাথা ভার, গায়ে বেদনা। একখানা ছেঁড়া কাঁথা থাকলে রাতটা কাটত। হরিপদ রাতে মেঝেয় শুয়ে ভাবে, এ হপ্তায় বাবুদের বাড়ি গিয়ে হাত-পা কুঁকড়ে চলতে হবে। মুখ ফুটে কাঁথা চাইতে মানে লাগে। ভিক্ষের গন্ধ আছে ওতে। ফেলির মায়ের কাছে কম গাল খায়নি এজন্য।
"পেছন ঢাকার কাপড় নেই, ভিখ মাংতে লাজ লাগে! ঢং দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়--"
উঠতে বসতে সইতে হত এসব বাক্যির জ্বালা।
বাবুরা যদি শীতে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে দেখে এক-দুটো গরম কাপড় দেয় তবে শীতের দুটো মাস একটু হিল্লে হয়।
সেদিনও ভোররাতে গায়ের ব্যথায় ঘুম ভেঙ্গেছিল। ঘরের আগল খুলে বেরিয়েই হরিপদর মত নিরেট নির্জীব মানুষের মাথাও চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল। কারা যেন কাত্তিক ফেলে গেছে দোরগোড়ায়। পোড়ারমুখোদের এ কেমনধারা ছ্যাবলামো? পাড়ার একধারে ভাঙ্গা টালির আধখানা ঘরে তার বাস, কারো সাতেপাঁচে সে থাকে না, কেউ ডেকে খাওয়ালে খায়, নইলে জল খেয়ে পেট ভরায়, তার এমন কেউ ইয়ারদোস্ত নেই যারা এমন মস্করা করবে। সত্যি বলতে কি, হরিপদ এমনই নিস্পৃহ ধরনের মানুষ, হয়ত বা শোকেতাপে এমনটা হয়েছে, যদিও পাড়ার পুরনো লোকেও মেয়ে-বৌ খুইয়ে তাকে খুব একটা শোক করতে দেখেনি, সে এতই আপনভোলা মানুষ, আড়ালে আবডালে যে তাকে কিছু লোকে 'ছিটেল হরে' বলে ডাকতে শুরু করেছে, সে খবর এখনো তার কানে পৌঁছয় নি। তা, 'ছিটেল হরে'র মনের খাঁজে এখনো 'মানুষ'এর মতো রাগ, দুঃখের বোধগুলো বেঁচে আছে, নাকি সেসব বোধ মুছে গিয়ে পাড়ায় একটা টাটকা পাগল তৈরি হচ্ছে, সেইটে পরীক্ষা করে দেখার জন্যই বোধহয় কজন মিলে তার ঘরের দোরগোড়ায় কার্তিকঠাকুরের মূর্তি ফেলে গিয়েছিলো। জল খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষটা ক্ষেপে উঠবে, নাকি ছেলে পাওয়ার আশায় তার সেই খুনে বউকে ডেকে এনে কাত্তিকপুজো করবে দুজনে মিলে, তা নিয়ে কেউ কেউ বাজিও ধরেছিল কি?
তবে হরিপদ সেসব কিছুই করল না। কাত্তিককে পাশ কাটিয়ে গামছা কাঁধে চলল মাঠের দিকে। কাজকম্ম সেরে ঘরে ঢুকছে, মনে হল কোত্থেকে যেন কচি গলার কান্নার আওয়াজ আসছে? থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হরিপদ। ঠিক শুনল? নাকি যেমনভাবে ফেলির গায়ে কাঁথা জড়াতে যায় এখনো মাঝেমাঝে, তেমনই কিছু? মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে লোকটা। নাঃ, ভুল নয়, পষ্ট শোনা যাচ্ছে এখন। খুব কচি গলায় "ওঁয়া ওঁয়া" কান্না। এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে কাত্তিকের পায়ের কাছে ঝোপের মধ্যে একটা পুঁটলি পাওয়া গেল। হায় ভগবান! এ কি পাপ গো! কাদের ছেলে পড়ে আছে ঝোপের মধ্যে? ক্ষিধের জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে মুখ লাল হয়ে গেছে গো! হরিপদ কি করে এখন? ঘরে একবাটি মুড়ি আছে কেবল। এই কচি ছানা তো মুড়ি খেতে পারবে না। দুধ কোত্থেকে জোগাড় করবে সে? কাঁথায় মোড়া কচি ছেলেটাকে নিয়ে মহা আতান্তরে পড়ে যায় হরিপদ। বাবুদের কাছে নিয়ে যাবে? একটু দুধ চেয়ে নেবে? বাবুরা যখন শুধোবে কে এটা? তখন কি বলবে সে? বরাবর ঝঞ্ঝাট থেকে পালানো আলাভোলা মানুষটাকে আজ বড্ড চিন্তা করতে হচ্ছে। তাকে যদি ছেলেচোর ঠাউরে বসে? না, না, সে বদনাম সে সইতে পারবে না। না খেয়ে বউ-মেয়ে নিয়ে মরার জোগাড় হয়েছে তবু কখনো সে পরের গাছের ফল অব্দি না বলে নেয়নি, চোর বদনাম সে সইবে কেন?
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। গামছার কোণাটা জলে ভিজিয়ে সলতে পাকিয়ে খোকার মুখে ধরে। তেলচিটে গামছার কোণা চুকচুক করে চুষতে চুষতে খোকা দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ে হরিপদর বুক আঁকড়ে।
মাথাটা খাটাতে হচ্ছে তো, পরিশ্রম হচ্ছে, তাই ক্ষিধে চাগাড় দিয়ে ওঠে হঠাৎ। একবাটি মুড়ি আর একপেট জল খেয়ে কলজেটা জুড়লো যেন। বসে বসে আকাশপাতাল ভাবতে থাকে হরিপদ। সে একলা তো আর এই গুঁড়োটাকে আগলাতে পারবে না। অবিশ্যি আগলানোর দরকারটাই বা কী? ঘরের লোকে তো আপদ দূর করবে বলেই ঝোপে ফেলে গেছে, বেজম্মাটাকে পুষে সে-ইবা কেন হ্যাপা বাড়ায়? ধুত্তোর, ফেলেই দিয়ে আসবে। আপদ যত্তসব!
ঘুমন্ত বাচ্চাটার ঠোঁটের ওপর ভিজে গামছার সলতেটা ঠেকায় হরিপদ আরেকবার। ফেলি ঘুমোলে কমলি মাঝেমধ্যে এমনটা করত, যেসব রাতে সোহাগ জেগে উঠতো, সেসব রাতে, মেয়ে যাতে আরো খানিক ঘুমোয়, ঘুমন্ত বাচ্চার মুখে বোঁটাটা গুঁজে দিতো। ঘুমের মধ্যেই দুধ টেনে আবার ঘুমে কাদা হয়ে যেত ফেলি।
এ-ও দেখি সলতে মুখে পুরে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। হরিপদও আর দেরি না করে নিজের একটা ছেঁড়া ধুতিতে খোকাকে মুড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেলা বাড়লে লোকজন উঠে পড়বে। কেউ টের পাওয়ার আগেই এই ঝঞ্ঝাটকে বিদেয় করতে হবে। শ্মশানকালীর মন্দিরের কাছটায় এইসময় লোকজন থাকে না, ঐখানেই নামিয়ে আসবে। মায়ের সন্তান, মা-ই বুঝবে কি করবে বালাইটাকে নিয়ে। কেষ্টর জীবটাকে হরিপদ যে মায়ের পায়ে ফেলে দিয়ে চলে যাবে, পাপ হবে না? হোক গে পাপ, একলা মানুষ, কি করবে অত পুণ্যি ধুয়ে? হোক একটু পাপ। এ আর এমন কি? যে মায়ে এমন কচি ছেলে ঝোপে ফেলে গেছে তারও কি পাপ হয়নি? সে কি তবে ভয়ে কুঁকড়ে থেকেছে? ফেলিটাকে যে বউটা রাগের বশে গলা টিপে মেরে ফেলেছিল পাঁচ বছর আগে, তাতেও তো পাপ হয়েছিল। সেই পাপেই বোধহয় পেটেরটাও গেছে। পাপের ওপর আবার পাপ। হাসি পেয়ে যায় হরিপদর। মনের হাসিটা পিছলে মুখে চলে আসে। দু'দুটো পাপের বোঝা বুকে নিয়েও তো দিব্যি বেঁচে আছে কমলি। খেয়েদেয়ে গায়েগতরে বাড়ছেও নিশ্চয়ই। দাদার কাছে যদিও শুনেছে তাকে নাওয়ানো-খাওয়ানো সবই বৌদি করিয়ে দেয়। সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে, আর মাঝেমধ্যে রাতবিরেতে "ফেলি মুখপুড়ি, এই রাতদুপুরে চরতে বেরোলি কোথায়?" বলে হাঁক পেড়ে দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। দাদা-বৌদি মিলে তাকে চেপে ধরে ঘরে ফিরিয়ে আনে। সে তো হরিপদও রাতে ফেলির গায়ে কাঁথা জড়াতে চায় ভুল করে। আচ্ছা, ক'বছর পরে কি এই গুঁড়োটার মা-ও অমন করেই ছেলেকে খুঁজবে রাতবিরেতে? এ-ই কি তবে পাপের সাজা? বেজন্মাটাকে মায়ের মন্দিরে ফেলে গেলে হরিপদও কি থেকে থেকে কচি গলার কান্না শুনতে পাবে? মহা জ্বালা তো! চিন্তাভাবনা থেকে সাত-হাত দূরে থাকা লোকটা পাপ-পুণ্যের চিন্তার ঘূর্ণিতে হাবুডুবু খেতে থাকে।
আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে আচমকা আলোর দেখা পাওয়া যায়। পাপের বদলে পুণ্যি করলে আগের পাপের সাজা কিছুটা মকুব হয় কি? হরিপদ যদি কুটোটাকে (আপদটাকে কখন যেন কুটো বলে ডাকতে শুরু করেছে) ফেলির মায়ের কাছে নিয়ে যায়? কুটোর দুধ, ভাত জোগাড় করতে পারবে কিনা হরিপদ জানে না, হয়তো ক'বছর পর সে বা কমলি কুটো-টারও গলা টিপে ধরবে, তা-ও যে ক'টা দিন খোকাটাকে বুকে ধরে কমলি দু'দুটো পাপের শোক ভোলে, যে ক'টা দিনের সাজা মকুব হয়, সেটাই পাওনা। নিরেট মাথার হরিপদ অবশ্য এতকিছু গুছিয়ে ভাবতে পারেনি, মাথার মধ্যে এলোমেলো উড়তে থাকা ছেঁড়া কথার কুচিগুলোকে সাজালে খানিকটা এরকমই দাঁড়ায়।
মোদ্দা কথাটা হল, সাদামাটা ছোটখাটো হরিপদ তেলচিটে গামছাটাকে আবার ভিজিয়ে সলতে পাকিয়ে কুটোর মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে মন্দিরের পথ ছেড়ে উল্টোমুখে ঘুরে বাসরাস্তার দিকে চলল। বাসরাস্তার ধার ধরে এখন হাঁটা দিলে তবে তো ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে দাদার বাড়ি পৌঁছতে পারবে। হরিপদর হাঁটার দুলুনিতে আর তার কোলের মাঝে ছেঁড়া ধুতির ওমে কুটোও তখন দিব্যি ঘুমোচ্ছে, আর বোধকরি গতজন্মেরই পুণ্যের কোনো স্বপ্ন দেখে ঘুমের মাঝে মুচকি হাসছে, হেসে চলেছে, হেসেই চলেছে।