আলো ক্রমশ মৃদু হয়ে এলো।
বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে গেলো।
ছায়া ক্রমশ ঘন হতে লাগলো।
কিন্তু কোথাও ঝোড়ো হাওয়া টের পাওয়া গেলো না। আকাশে কোনো বিদ্যুৎ চমক দেখা গেলো না। চারিপাশে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চিহ্ন মাত্র চোখে পড়লো না।
এইবার তাঁরা উঠে পড়লেন। ওই জায়গা থেকে। কষ্ট করে। একে অন্যের সাহায্যে। অদ্ভুত ভাবে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে। তখনই সেখানে টলটল করে উঠলো তাদের একান্ত দুঃখের কিংবা আনন্দের মুক্তোবিন্দু।
ওঁরা কি হাসলেন? না বেদনার্ত হলেন? সেই দিনান্তের আলোয়?
আমরা কি কখনো জানতে পারবো সে কথা?
আমরা শুধু জানি যে তাঁরা এক প্রাচীন দম্পতি। জীবনের দীর্ঘপথ হেঁটেছেন ওঁরা একসাথে। সুখেদুঃখে বিজড়িত হয়ে। এইভাবেই হাঁটতে হাঁটতে ওঁরা হঠাৎ করে এসে পড়েছেন এই আশ্চর্য জায়গাটিতে।
—'কি আশ্চর্য জায়গা! এ কোথায় নিয়ে এলে বলো তো?'
— 'তোমার পছন্দ হয়েছে?
— 'এতো সুন্দর জায়গা আমি খুব কমই দেখেছি — এতো শান্ত — যেন মনে হয় ছবির মতো আঁকা--'
—'ওই দেবদারু গাছটার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে দ্যাখো — একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়বে।'
— 'কি অদ্ভুত জিনিস?'
—'এই দিক থেকে দ্যাখো — গাছটার এই দিকের অংশটা — যেন কারো হাত — আকাশের দিকে বাড়ানো।'—
বিকেলের হলুদ আলো গড়িয়ে পড়ছিলো গাছের চূড়ায় — মনে হচ্ছিল গাছটা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বেঁকে উঠেছে আকাশের দিকে। ওঁরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলো দুজনেই। ওঁরা আউটডোর স্টাডির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলো যত্রতত্র। কলকাতা থেকে একটা দূরপাল্লার বাসে চড়ে— তারপর একজায়গায় নেমে সেখান থেকে আবার সাইকেল রিক্সায় কিছুটা গিয়ে — সেখান থেকে পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছেছিলো এই গণ্ডগ্রামে। সারা দিন আউটডোর স্টাডি করে ওদের ফিরে যাওয়ার কথা সন্ধের মুখে।
ওঁরা অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষা আর সম্বিত। একসঙ্গে পড়া আর্ট কলেজের বন্ধু। দুজনেরই থার্ড ইয়ার। তিন বছরের বন্ধুত্ব এখন পরস্পরের একান্ত অবলম্বন ।
'চলো শুরু করি' — বলতে বলতে আঁকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে বসে পড়েছিলো সম্বিত। হ্যান্ডমেড পেপারে অতি দ্রুত চারকোলের দাগ পড়ছিলো। আকাঙ্ক্ষা নিজের কাজ ছেড়ে নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়েছিলো সম্বিতের পিছনে।
কিন্তু একটু পরেই সম্বিতের মনে হয়েছিলো চারপাশের আলোটা হঠাৎ যেন বদলে গেছে। উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখেছিলো এতক্ষণ যেখানে সোনালী আলো আর মেঘ একাকার হয়ে ছিলো, এখন সেখানে চাপচাপ কালো মেঘের অন্ধকার। আকাঙ্ক্ষাও অবাক। —'যাহ্। সব গণ্ডগোল হয়ে গেলো।'। একটা অদ্ভুত ঠান্ডা আর ভারী বাতাস বয়ে গিয়েছিলো তাদের উপর দিয়ে।
আর তারপরেই ওঁরা দেখতে পেয়েছিলো দূরের গাছগুলোর মাথা কি ভয়ানক ভাবে দুলে উঠছে — আর সেই সাথেই শুরু হয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি — কিন্তু যতো না বৃষ্টি তার চেয়ে ঢের বেশি ঝোড়ো হাওয়া — আর তার সঙ্গে অনবরত বিদ্যুতের ঝিলিক।
দুর্যোগ ক্রমশ বাড়ছিলো। মাঝে মাঝেই বৃষ্টির দাপটে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে পড়ছিলো একটার পর একটা গাছ। বিকট শব্দে বাজ পড়ছিলো খুব কাছেই।
—'চলো পালাই' — বলেছিলো সম্বিত।
—'কোথায়?' — জিজ্ঞেস করেছিলো আকাঙ্ক্ষা।
—সামনে — যেদিকে হোক — দৌড়ে যতোটা যাওয়া যায়।' — উত্তর ছিলো সম্বিতের।
— 'পাগল হয়েছো? —সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলো আকাঙ্ক্ষা।
— 'তর্ক কোরো না। এখনো সময় আছে।'— চেঁচিয়ে উঠেছিলো সম্বিত।
— 'না। কোথাও যাবো না আমরা। কোত্থাও না।' — এই কথা বলেই আকাঙ্ক্ষা শক্ত করে চেপে ধরে ছিলো সম্বিতের হাতটা।
— 'যাবে না?' — মরীয়া হয়ে প্রশ্ন করেছিলো সম্বিত।
—'না' — অবিচল উত্তর ছিলো আকাঙ্ক্ষার।
বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রাগৈতিহাসিক জীবের মতো অনড় হয়ে এই কথাগুলো বলেছিলো তারা — ওদের অন্তিম মুহূর্তে — ওই অভিশপ্ত জায়গাটিতে।
'—কি অভিশপ্ত জায়গা রে....'
—'এ অতি পুণ্যস্থান কারণ ....'
—'আমার কেন জানি না খালি মনে হচ্ছে একটা মিথ আর রিয়েলিটি এখানে...'
কতো জনের কতো কথাই না উড়তে থাকে ওই জায়গাটিকে ঘিরে। নির্মম বাস্তবের গায়ে লাগে কল্পনার কতো রঙের আঁকিবুকি। কারণ লোকে যে ভালোবাসে গল্পকথা। কল্পকাহিনী। তাই গল্পটি শুরু হোলো আকাঙ্ক্ষা আর সম্বিতকে নিয়ে। যা নিছক অনুমানের অলীকবিন্দু থেকে নয়। একটি সত্য ঘটনার আধার ছিলো অবশ্যই। এবং সেই সত্যটি হোলো—
..
--১৯৮৫ সালে জুলাই মাসে এক প্রবল ঝড় হয়েছিলো। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিলো দক্ষিণবঙ্গের একটি বিরাট অংশ। নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো অসংখ্য চালাঘর। প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় পঞ্চাশ জনের। নিহতদের তালিকায় ওরাও ছিলো। ওরা অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষা আর সম্বিত।
এটি কোনো অনুমান নয়। নিষ্ঠুর সত্য। এবং এর সাথে আরো একটি আশ্চর্য সত্য হোলো যে তাদের মৃতদেহের নীচেই ছিলো একটি সতীফলক। মাটির কিছুটা গভীরে। উপড়ে যাওয়া গাছটা সরাতেই জমির ভিতর থেকে উঠে এসেছিলো সেই ভয়ঙ্কর প্রাচীন নিদর্শন —
"অদ্য ১৭৪১ শক, ১১ই ভাদ্র, স্বর্গত শ্রী হরিচরণ ভট্টাচার্য্যের বিধবা পত্নী বিরাজমোহিনী দাসী স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়া অক্ষয় স্বর্গ লাভ করিলেন।"
অতএব এই মৃত যুগল ও সতীফলকটি নিয়ে তৈরি হোলো এক গল্পের সহজ রসায়ন। লোকমুখে। নানাভাবে—
"আগের জন্মে ওরাই পুড়ে মরেছিলো এখানে ..."
"ভালোবাসার টান দ্যাখো কিভাবে জন্মান্তরেও ফিরে আসে...."
"কি ভয়ঙ্কর জায়গা এটা, এখানে দাঁড়ালে মনে হয় কেউ গলা টিপে ধরছে ..."
এইভাবেই লোকমুখের হাজারো কথায় জায়গাটি দ্রষ্টব্য হয়ে উঠলো। লোকেরা আসতো কৌতূহলে — ভক্তিতে —এমনকি ঘৃণায়। জায়গাটিকে ঘিরে দেওয়া হোলো লোহার রেলিংয়ে। তার ভিতরে উঠলো পাথরের বেদী। লাগানো হোলো একটি পাথরের স্মৃতি ফলক।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব গল্পের রঙই ফিকে হয়ে আসে। শ্যাওলা জমে পড়ে থাকা সাদা পাথরের বেদীর পাশে। অস্পষ্ট হয়ে যায় অযত্নের স্মৃতিফলকের অক্ষর।
তাই এখন এই জায়গাটিতে দেখা যায় একটি ভাঙাচোরা জং ধরা লোহার বেড়া। তার ভিতরে আগাছায় ভরা পাথরের বেদী। ফাটলধরা ফলক। যার উপরের কিছুটা অস্পষ্ট অক্ষর গুলির উপর এসে পড়েছে দিনান্তের আলো। যাকে চেষ্টা করলে এখনও পড়তে পারা যায় —
"দাঁড়াও পথিকবর১৯৮৫ সালের এক প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে এইখানে একটি দেবদারু গাছ ভেঙ্গে পড়ে। গাছটি চাপা পড়ে নিহত হন দুটি যুবকযুবতী। গাছটি সরিয়ে ওই যুগলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অতি আশ্চর্যভাবে গাছটির নীচের মাটিতে একটি সতীফলক দেখতে পাওয়া যায়। সতীফলকটি বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে।"
দুই আশ্চর্য যুগলের স্মৃতিতে নির্মিত এই বেদীর সামনে
তোমার ব্যস্ত সময়ের কয়েকটি মুহূর্ত দান করো
দুটি মর্মান্তিক সত্য ঘটনার সাক্ষী এই স্হান
লেখাটি খুব মন দিয়ে পড়লেন সেই বৃদ্ধমানুষটি। তারপর তার সঙ্গের বৃদ্ধাটিকে বললেন — "এসো — এদিকে এসো —দ্যাখো কি লেখা আছে —"
বৃদ্ধা নড়বড় করতে করতে এলেন ওই ফলকটির কাছে। চোখ কুঁচকে ঘাড় তুলে এই কষ্টকর কাজটি করলেন কোনোমতে। তারপর যেন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন বৃদ্ধের মুখের দিকে। এরপর তাঁরা দুজনে দুজনকে ধরে আবার এসে বসলেন পাশাপাশি।
তারপর দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধটি বললেন — 'ওই দ্যাখো।'
বৃদ্ধাটি বললেন — 'কি বিরাট মেঘ করেছে।'
বৃদ্ধ বললেন — 'ওই দিকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।'
বৃদ্ধা মানুষটি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— 'বাজ পড়বে?'
বৃদ্ধলোকটি যেন নির্বিকারে উত্তর দিলেন বললেন — 'হয়তো।'
— 'তাহলে চলো — চলে যাই।'
— 'নাহ্।'
বৃদ্ধা মহিলা অবাক হয়ে বললেন — 'কেন?' বৃদ্ধ মানুষটি কোনো উত্তর না দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন। তারপর তার হাতটি নিজের শীর্ণ হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলেন।
এবার খুব আস্তে করে বললেন — 'বসেই থাকি না এইভাবে।'
বৃদ্ধা অতি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — 'সে কি? কতক্ষণ?'
বৃদ্ধলোকটি বৃদ্ধার চোখে চোখ রেখে যেন নিজেকেই বললেন — 'অনন্তকাল।'
বৃদ্ধাটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উত্তর দিলেন — 'কি পাগলামি করো এখনও।'
আলো ক্রমশ মৃদু হতে লাগলো। বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠলো। ছায়া ক্রমশ ঘন হয়ে এলো।
কিন্তু হঠাৎ কোনো ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের মাথাগুলি দুলে উঠলো না। কিংবা আর কোনো বিদ্যুতের রেখা আকাশ চিরে চলে গেলো না। কাছে কিংবা দূরে কোনো বাজ পড়ার শব্দ শোনা গেলো না। এমনকি একটা বৃষ্টির ফোঁটাও পড়লো না।
অর্থাৎ আর নতুন কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলো না। কোনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটলো না। এবং আরেকটি বিয়োগান্তিক কাহিনীর সৃষ্টি হোলো না।
এইবার তাঁরা উঠে পড়লেন। অতিকষ্টে। পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে। অদ্ভুতভাবে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে। তখন সেখানে টলটল করে উঠলো তাদের নিজস্ব দুঃখ কিংবা আনন্দের মুক্তোবিন্দু।
ওঁরা কি হাসলেন? না বেদনার্ত হলেন? সেই দিনান্তের আলোয়?
অতো কিছু আমরা জানি না। আমরা শুধু জানি যে তাঁরা এক প্রাচীন দম্পতি। জীবনের দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন একসাথেই। সুখে দুঃখে বিজড়িত হয়ে।
এইভাবেই হাঁটতে হাঁটতেই ওঁরা হঠাৎ করে এসে পড়েছিলেন এই জায়গাটিতে। কিছুক্ষণ ছিলেন। তারপর এখন চলে যাচ্ছেন এই আসন্ন অন্ধকারে।
এতক্ষণ এইভাবে এইখানে বসে কি ভাবছিলেন ওঁরা? ভাবছিলেন কি —' .....এতকাল একসাথে হেঁটেছেন.... এইবার কি আলাদা হয়ে যাবার সময় এসে গেলো ?.... একা হয়ে যাওয়ার সময় এসে গেলো ?.... যদি না আশ্চর্যভাবে....'
হয়তো এসব আমাদের অলীক কল্পনা।
সমাগত সন্ধ্যার অন্ধকারে — ওই সতীস্থানে — যেন এক বিপুল ভারে ঝরে পড়লো সেই মুক্তোবিন্দু দুটি— এইসব কাহিনী কল্পনাকে তুচ্ছ করে।