হারান শুয়েই ছিল।
আওয়াজটা কানে যাচ্ছে না এমন নয়। কিন্তু এসব দিনকাবারি ঝুটঝামেলা এই রাতেরবেলায় আর পোষায় না তার। মাঝরাত্তিরে এক প্রকৃতি ছাড়া আর কারো ডাকে সাড়া দেয়না হারান। তাও খুব বেশিরকম প্রয়োজন হলেই উঠতে হয় কোনো কোনোদিন। আগে তাও কম ছিল। এখন বয়সের ঊর্ধক্রমাঙ্ক যেন তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে রেখেছে এই সময়টুকুর দিকেই। প্রতিদিনই একবার দুবার উঠতেই হয়। আজকেও প্রথম যখন ঘুমটা ভাঙে, তখন সেরকমই অনুভব হচ্ছিলো। গোড়ায় তেমন একটা মালুম হয়নি। পৌষালী রাতে আর কে'ই বা কাকে বুঝে উঠতে চেষ্টা করে! হারান নিজের বিছানায় এসে কম্বলের ওমে ঢুকে পড়েছে । কিন্ত একটু পরেই সেই অস্বস্তিকর শব্দটা ফিরে এলো! আবার!
একটা অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ! চাপা, কৃশশক্তি। যেন দম ছাড়ার কথা ভেবেও ঠিক পুরোপুরি ছেড়ে উঠতে পারা যাচ্ছে না। হারান শুয়ে থাকে। কিন্তু কানে ভেসে আসা আটকানো যায়না। শুয়ে শুয়েই ঠাহর করার চেষ্টা চালায়। পাশের ঘরে মিনতি। আছে। থাকে। যেমন ছিল তেমনই। নড়াচড়া ওই সেও প্রকৃতির ডাক ছাড়া নয়। তাও বুঝি না গেলেই ভালো হয়। কখন যায় সেটাও হারান জানে না। আজ এত বছর হলো, ওই সরু তক্তপোষ ছাড়া মিনতিকে কোথাওই দেখেনি হারান। অদ্ভুত ভাবে বসে থাকে! দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। শুধু নির্বিচারে তাকিয়ে থাকে! হারান জানে, এখনো যদি ও পাশের ঘরে যায়, দেখবে মিনতি জেগেই আছে। হয়তো বসেও আছে। ফ্যালফেলে শূন্য দৃষ্টিতে কিছু ধরা নেই, আর ধরার চেষ্টাও নেই। যে দৃষ্টির প্রতিফলন নেই, সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়ানো খুব কঠিন কাজ, হারান জানে। মনে হয় যেন নিজের শরীরটা নানা মাপের নানা ঘনত্বের কাচের তৈরী , আর ওই চোখদুটো মনের সব গলিঘুঁজি ডাস্টবিন অবধি টেনে নিয়ে আসে।
ওই চোখ দুটোর কথা ভাবলেই হারানের আর ওই ঘরে যেতে ইচ্ছে করলো না এত রাতে। সে জানে এখন গেলেও বিশেষ দেখার মতো কিছু নেই। কখনই বা থাকে। বাহুল্যহীন মাটির দেওয়াল দাঁড়িয়ে থাকে ভাঙা টালির মুকুট মাথায়। একটা আধখোলা জানলায় ছেঁড়া পর্দা দেওয়া। জানলার ধারেই তক্তপোষে মিনতির শরীরটা গুটিয়ে পড়ে থাকবে।দেওয়ালের দিকে মুখ করে থাকা ওই শরীরটার প্রতি আকর্ষণ বা বিকর্ষণ কোনোটাই অনুভব করে না হারান। সেও আজ অনেকদিন তো হলোই। কিন্তু হারান জানে, মিনতি জেগেই আছে। এখনো তাকিয়েই আছে জানলার দিকে। আর কিই বা দেখার বাকি আছে ? হারান আর দেখতে চায় না কিছু।
ওঘরে নাই বা গেল, কিন্তু শুয়ে শুয়েও কি ঘুম আসা এত সহজ নাকি? সেই হাঁপধরা চাপচাপ শব্দটা ক্রমেই গাঢ় গোঙানিতে পরিণত হয়েছে। হারান জোর করে চোখ বুজে শুয়ে থাকে।
সরকারবাবুদের সীমানার একদম দক্ষিণ পশ্চিমে যে পুকুরটা, তার গায়ে গা লাগিয়ে চাট্টি আম কলা পেয়ারা গাছের বেয়াদপ বেড়ে ওঠার জায়গা ছিল খানিকটা। নামেই ফলগাছ, কিন্তু একটাও মুখে তোলার যুগ্যি নয়। এঁড়ে জমি, তেমন কাজেরও না, আর ওই খানিক বেজাতের গাছগুলোও নিজেদের মধ্যে আকড়াআকড়ি করে অনেকটা জায়গায় এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল, দিনেমানেও খুব একটা আলো ঢোকে না। লোকজন এদিকটা খুব একটা আসাযাওয়া করতো না আগেও। হারানও আসতো না। বাবুদের দালানের পাশেই একটা ছোট ঘর ওদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল।
মিনতিকে সবাই ডাইনি বলতে শুরু করার পরে, হারান তাই এই বাগানের এক কোণে কুঁড়ে বানিয়ে নিলো নিজেদের। মেজবাবুর দয়ার শরীর, তিনিই একমাত্র হারানকে তাড়িয়ে দেওয়া আটকেছিলেন। কিন্তু বাসা একত্র রাখার ভরসাটুকু করতে পারেননি। তাঁকে আদেশ করতেও হয়নি, হারান নিজেই উঠে এসেছিল এই চুলোর দুয়ারে। বাবুরা তাকে থাকতে দিচ্ছেন,কাজ থেকে তাড়িয়ে দেননি, এইটুকুই ঢের পাওনা তার।
আর মিনতি? তার কোনোই বিকার ছিল না। তার কিছুই এসে যায় না যেন। কোথায় থাকবে কী খাবে তাতেও না, আর লোকে ডাইনি ভাবলেও না।
হারানেরও কোনো পরিবর্তন দেখেনি কেউ। আগেও মানুষটা চুপচাপ থাকতো, নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করতো। এখনো তাই। শুধু হারান জানে, এই ঘটনাটা তাকে আরো চুপ করিয়ে দিয়েছে। ডাইনির স্বামীর কথা বলা চলে নাকি? আসলে কিন্তু হারানের এই গোবেচারা নিস্পৃহভাবটাই বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। নাহলে সবাই মিনতির সাথে তাকেও হয়তো দাগিয়ে দিত!
বাচ্চাটা তো তাদের দুজনেরই ছিল!
ঘুমটা এবার ভাঙলো একটা শব্দে, হালকা ক্যাঁচক্যাঁচ , হুড়কো ডাঁশা লাগানোর মৃদু আওয়াজে। বাইরের ঘরে না, ভেতরে মিনতির ঘরে খিড়কি দরজা খোলার আওয়াজ। এতই আস্তে, অন্যদিন হলে হারানের ঘুম ভাঙতো কি না সন্দেহ। কিন্তু আজ প্রথম থেকেই পলকা ঘুমে থাকায়, হারান চোখ খুলেই বুঝতে পারলো শব্দটা কিসের। মিনতি উঠেছিল তবে? কতদিন মিনতিকে স্বাভাবিক দেখেনি হারান! আগে কত হাসিখুশি ছিল মেয়েটা। ওই ব্যাপারটার পর থেকেই , কেমন যেন শুকিয়ে যেতে লাগলো। ভেতরে ভেতরে কষ্ট হলেও কখনো হারান প্রকাশ করেনি। হারানের চোখটা আবার প্রায় লেগে লেগে আসছিলো, হঠাৎ একটা আওয়াজে হারানের সব স্নায়ু একসাথে সজাগ হয়ে উঠলো!
এ কি!
আজ এত বছর পর, একি শুনছে হারান!
পাশের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আস্তে নয়, মৃদু নয়, শুধু বুক খালি করে ডুকরে ডুকরে কান্না।
মিনতি কাঁদছে!
এতদিন পরে!
হারান উঠতে পারে না, নিশ্চল শুয়ে থাকে।
সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়েছিল হারানের। যখন ঠিকঠাক ঘুমটা ভাঙলো, একটু যেন অস্বস্তি হচ্ছিলো। কয়েক মুহূর্ত পরে স্বাভাবিক সচেতনতায় ফিরে আসতেই হারান কারণটা বুঝতে পারলো। এই নির্জন জায়গায় এই প্রথম মানুষজনের কোলাহল কানে আসছে!
এই বাদাড়ে লোকজন আগেও আসতো না, আর ওরা ডেরা নেওয়ার পরে তো কাকপক্ষীতেও না। সেখানে আজ এত মানুষের উত্তেজিত স্বর ভেসে আসছে.....হারান ধড়মড় করে উঠে বসলো। কোনোরকমে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দরজা খুলেই বুঝতে পারলো, ভীষণ শীত বাইরে। আর তেমন কুয়াশা। আওয়াজের উৎস আন্দাজ করে পুকুরের দিকে হাঁটা দিলো সে। তাদের খিড়কি দরজা দিয়ে গেলে আরো কাছে হতো। হারান জংলা গাছের আড়াল সরিয়ে সরু পায়ে চলা পথটাই বেছে নিলো। চারদিকেই হিম জমে গাছের পাতাগুলোও ভারী হয়ে আছে। এরকম একটা সময়ে হারানের মনে হয় প্রতিটা গাছেরই কিছু না কিছু বলার আছে, আছেই। অন্য কোনো একটা দিন হলে হারান ঠিক সেঁধিয়ে যেত কুয়াশার অন্দরে, গাছেদের ভেতরে...শুনে নিতো ওদের গল্পটুকু... অপাংক্তেয় হয়ে বেঁচে থাকার একটা সুর নিশ্চয়ই মিলবে। কিন্তু আজকে আর বেশি কিছু বোঝার আগেই হারান দেখলো সে পুকুরপাড়েই এসে দাঁড়িয়েছে।
হারানকে কুয়াশায় প্রথমে কেউ সেভাবে ঠাহর করেনি। সবাই যে উত্তেজিত হয়ে কি বলছে আর কি দেখছে , সেটাও হারান বুঝতে পারলো না প্রথমে। একটু এগোতেই দুর্গাকাকাকে দেখতে পেয়ে হারান ডাকবে কিনা ভাবছিল। এতক্ষণ ঘোলা ঘোলা ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় চোখ সইয়ে যেতেই হারান বুঝতে পারলো, সবার আলোচনা ও উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে পুকুরটা। আরো পরিষ্কার করে বললে, পুকুরের মধ্যে ভাসমান একটা কিছু। হারান টের পেলো , ওটা দেখা মাত্র উত্তেজনাটা ওর মধ্যেও চারিয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে ও পুকুরের পাড়ে। চোখটা আরেকটু সইয়ে নিলে বোঝা যায়, ওটা আসলে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ, ভেতরে কিছু আছে তো বটেই, কিছুটা বেরিয়েও আছে। এখান থেকে হারান সেটা বুঝে উঠতে পারেনা। আস্তে আস্তে লোকজনের কোলাহল বাড়ছে আর কুয়াশার প্রাবল্য কমছে, তারই মধ্যে হারান বুঝতে পারে সরকারবাবুরাও এসেছেন এই জমায়েতে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অবশ্য তাকে জানান দিচ্ছে , আশেপাশের লোকেরা তার উপস্থিতি টের পেয়ে সরে সরে যাচ্ছে। হারান যদিও এতে অভ্যস্ত, কিন্তু কেন কে জানে তার মনে হচ্ছিলো সবাই একটু বেশিই ভয় পেয়ে রয়েছে! হারান আবারো দেখার চেষ্টা করলো ভাসমান জিনিসটার দিকে।
কতক্ষন এভাবে দেখছিলো, জানে না ঠিক। চটকাটা ভাঙলো কালুর ডাকে।
" বলি ও হারানদা, একডু উদিগপানে চলি চল দেগি।"
কালু, রমেশ কাকার ছোট ছেলে,একটাসময় যথেষ্ট সখ্যতা ছিল তাদের, মানে মুখচোরা হারানের সাথে যতটা বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব আর কি। ঘরে আসা যাওয়া ছিল, মিনতিকে হাঁকডাক ছিল, চায়ের আবদার ছিল। কালু কখন না জানি কুয়াশা ফেঁড়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশেই। কিন্তু না, একদম ঠিক পাশে নয়, একটু নিরাপদ ব্যবধান রেখেই।
"কান দুখান কুথে রাখছস হারানদা! বলি মেজকত্তায় উদিগে ডাগতিসে, এগবারডি চল ইবেলা।"
মেজবাবুর নামে হারানের সম্বিৎ ফিরে আসতে চায়। গুঁড়ি মেরে পুকুরপাড়ে এতক্ষণ দেখছিল সবকিছু, ধীরে ধীরে শরীরটা তুলে আনে। যদিও কোনকিছুতেই পুরোপুরি মন দিয়ে উঠতে পারেনা। মনটা কেমন কু ডাকছে, হারান নিজেও জানেনা তার কারণ।
"কি হইচে কালু, আমাগে আবার ডাগাডাগি কিনে?"
কুয়াশা আগের মতো অতো ঘন না হলেও এখনো যথেষ্ট ঘিরে আছে ওদেরকে। আবছা, অস্পষ্ট অবয়বগুলো শুধু চোখের সামনে নয়, হারানের মনের ভেতরেও ইতিউতি পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। সেই অস্বচ্ছতার মধ্যেও হারান স্পষ্ট দেখতে পেলো, কালুর মুখটা কুঁচকে গেছে তার জবাব শুনে।
" ইসব কতা কুয়ো না হারানদা, দিখো নাই কি ভাসতিছে পুকুরির মদ্যি! "
কালুর কথায় নিশ্চয়ই নয়.... কিভাবে, সেটা হারান নিজেও জানে না, কিন্তু হঠাৎ করেই কুয়াশা একটু ফিকে হওয়ায়, আর হারান উঠে দাঁড়ানোর জন্যই হয়তো....এই প্রথমবার হারান দেখতে পেলো ..... যেটা দেখার জন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে।
সেই মুহূর্তটা যেন এতক্ষণ ওত পেতে বসেছিল। সুযোগ পেতেই গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এসেছে, হারানের সমস্ত শরীরের সব বল সব শক্তি শিকার করে নিয়েছে। হ্যাঁ সেই মুহূর্তটা হারানের মুখ থেকে সব রক্ত শুষে নিয়েছিল। সাদা ফ্যাকাশে মেরে গেছিলো হারান।
পুকুরে ভেসে ওঠা প্লাষ্টিক জড়ানো ওই জিনিসটা, একটা বাচ্চার শরীর না? এতক্ষণ জলে ভেসে আর ভিজে ওর ওই ছোট্ট ছোট্ট হাত পা যেগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সব সাদা হয়ে গেছে! রঙহীন, বিবর্ণ! হারানের মুখের মতন!
আর....আর...হারান আর মিনতির ওই মরা বাচ্চাটার মতো...অবিকল.....সেই নধর শিশুদেহ, শুধু সাদা ...ফ্যাকাশে...রক্তশূন্য....!
কালু এতক্ষণে বুঝতে পারলো, যে হারান সবে দেখেছে। গলাটা ধরে এলো কালুর।
"হারানদা, মেজকত্তার কাছি একবাট্টি ঘুরি যা। সবি বুঝি ...তুই ...আমি...কিন্তু ...কিন্ত...বাচ্চাকাচ্চা তো ঘরে মদ্যি সবারি..... তুই ...তুই..."
কালু কথা শেষ না করেই হাঁটা দিয়েছে। কিছু কথা বোধ হয় শেষ না হলেই ভালো।
ওর হেঁটে যাওয়া পথটুকুর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে হারান। পুকুরপাড়ের স্যাঁতসেঁতে আগাছা ঘাস মাড়িয়ে চলা একফালি পথ, সারারাতের হিমে এমনিতেই নুয়ে ছিল। তাতে কিছু এসে যায়না যদিও। পিষে যাওয়াই নিয়তি যাদের, তারা পিষে গেলে তবেই প্রাপ্তি সুগম হতে পারে।
সরকারবাবুদের দালান থেকে চলে যাওয়ার পরে, হারান আর ভিতরবাটিতে পা রাখেনি তেমন। এদিক ওদিকের কাজ করতো বাইরেই। আজ অনেকদিন পরে অন্দরে পা রেখে হারান বুঝতে পারছে, পাল্টে যাওয়ার মাপটা অনেকখানি। বারদালানের ভিতরে চওড়া উঠোনে রোদ পড়েছে বেশ ছড়িয়ে। কুয়াশাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গাছের পাতাগুলোও নড়েচড়ে উঠবো উঠবো করছে। অন্দরের দিকে সরাসরি দৃষ্টি না দিয়েও হারান বুঝতে পারছে যে সে উঠোনে পা রাখা মাত্র ভিতরেও একটা চাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেছে। কেউ সরাসরি বাইরে আসছে না ঠিকই। কিন্তু ডাইনির সঙ্গে নিত্যদিন উঠবোস করা এই মানুষটাকে দেখার কৌতুহল কারোরই বড় কম নয়। তাকাবে না ভেবেও হারান একবার চোখ তুললো ভিতরবাড়ির দিকে। একসময় তার আর মিনতি দুজনেরই অবাধ ছিল আনাগোনা। কত্তামা টুকটাক স্নেহও করতেন, মুখ বুজে সব ফরমায়েশ খেটে দিত সে। এখন আর তার ধারও মাড়ান না। তাতে হারান রাগ করে না, কষ্ট পায় না। আরে সে'ও বোঝে, ছেলেপুলে নিয়ে ভরভরন্ত সংসারে বাচ্চাখেকো ডাইনির জায়গা হয় নাকি কখনো?
সকালের গা এলানো রোদে আরামকেদারায় ততোধিক গা এলিয়ে বসেছেন মেজকত্তা। বড়োকত্তা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে ইনিই সংসারের সর্বেসর্বা; গাঁয়েরও, বলা গেলেই যেতে পারে। আর মোড়লদের গায়ের কাছেই যে মাছি ভ্যানভ্যানায়, সেতো হারান কবে থেকেই জানে। এখানেও সন্ধানী মাছির সংখ্যা বড়ো কম নয়। কত্তামশায়ের কানের কাছে তারা ওড়াওড়ি করছে আর বাণী ঢালছে। তেমনই কেউ বোধহয় হারানের আগমন সংবাদ দিয়ে থাকবে কানে। বা হঠাৎ করে সবাই সতর্ক সন্ত্রস্ত হয়ে গেল বলেই কিনা কে জানে, কত্তামশায় এলানো অবস্থা থেকে একটু নড়ে উঠলেন। গমগমে গলায় ডাক ছাড়লেন, "কে হারান এলি নাকি?"
হারান গায়ের চাদরটা আরেকবার ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে একটা গড় ঠুকতে উদ্যত হতেই কত্তামশায় হাত নেড়ে থামতে বললেন।
শরীরটা আদ্ধেক ঝুঁকিয়েও আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় হারান।
"শোন হারান, চারদিকের সব খবরই তো আমার কানে যেমন আসে, তোর কানেও আসে নিশ্চয়ই।"
হারান কোনো সাড়াশব্দ দেয় না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
" আমাকে সবাই অনেক কথাই বলে। অ্যাদ্দিন আমি তেমন গা করিনি। কিন্তু আজ যা হলো....."
মন্দিরপাড়ার বকুল কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল কত্তামশায়ের। সে ঝুঁকে কি একটা কানে কানে বলাতে, কত্তামশায় আবার মাথা ঝাঁকিয়ে উঠলেন।
".....অ্যাঁ ... হ্যাঁ হ্যাঁ.... হ্যাঁ মানে, হারান, ক'সপ্তা আগে নাপতেদের ছোট ছেলেটাও কেমন হঠাৎ করে মরে গেল....তার মাস আটেক আগে পান্নামুদির দুধের নাতিটাও চার বেলার মধ্যেই শেষ....তোর নিজেরটা কে তো আর ধরলাম না রে...."
হারান দাঁড়িয়েই থাকে।
"শোন, ছেলেপুলেদের সাবধানে রাখাটা খুব দরকার বুঝলি। একসময় তোদের এখানে থাকাতে আমি আপত্তি করিনি বটে, কিন্তু এখন আর ঠিক মনে কচ্ছি না।"
হারান আর দাঁড়ায় না। একবার গড় করে তবু, বেরিয়ে আসার আগে। কত্তামশায় আবার এলিয়ে রোদ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তিনি আর সেটুকু লক্ষ্য করার চেষ্টা করেননি।
বারদালান থেকে বেরিয়ে এসে আর দেখে না পেছনপানে। চলে যেতে হবে। মাসকয়েক আগে হারান ভাসা ভাসা শুনেছিল, ওই বাদাড়ে নাকি কারা কিসব যন্ত্রপাতি আনবে, কিসব করবে বলে লীজ নিতে চেয়েছে বাবুদের কাছে। হারান এত দুঃখের মধ্যেও মুচকি হেসে ফেলে।
হাসি স্থায়ী হয়না যদিও বেশিক্ষণ। রোদটা বেশ চড়চড়িয়ে উঠছে, আর হারানের মনের ভেতর দুঃশ্চিন্তাও। কোথায় যাবে ও? তাও আবার মিনতিকে নিয়ে? ওই হাড়হাভাতে মাগীর জন্য কে দুয়ার খুলে রেখেছে?
হারান ঘরের ধারে সোঁদা মাটিতেই বসে পড়ে। ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে যায় না আর। ঘরে তো ওই মরা মাছের মতো ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে ডাইনিটা। হ্যাঁ হ্যাঁ, এতদিন পরে হারানও বিশ্বাস করতে চাইছে, ওটা ডাইনিই! নইলে সবার কেমন বাচ্চা হয় গায়েগতরে, আর এর বেলায় অমন সাদা ফ্যাকাশে মরা বাচ্চা কেন হবে? বাচ্চাখেকো ডাইনিটা নিজের পেটের বাচ্চাটাকেও ছাড়েনি! সব রক্ত চুষে খেয়েছে পেটে পেটেই। নইলে অমন হতো না। আবার পেটে থাকার সময় শখ করে উলের জামা বোনা হচ্ছিলো! শয়তান ডাইনি কোথাকার! সব খেলো সব খেলো! সবাই ঠিকই বলতো, হারান এতদিন মানেনি। সত্যিই তো, তারপর থেকেই কেমন খ্যাপা হয়ে গেলো তো! হারান ভাবতো দুঃখে বুঝি......না না আসলে রক্তের নেশায়....আরো কত বাচ্চাকে খাবে কে জানে....
হঠাৎ খেয়াল হলো হারানের, কাল রাতে কাঁদছিলো কেন ডাইনিটা? ওই বাচ্চাটা কার কে জানে, ওটাকেও খেয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে মনে হয় পুকুরে! খিদে মেটেনি তাই ওরকম ক্ষুধার্ত কান্না কাঁদছিলো .... তবে কি এবার হারানের পালা? ভাবতেই হারানের শিরদাঁড়া দিয়ে কি যেন একটা কিলবিল করে নামতে থাকে..... হ্যাঁ, ওই জন্যেই কাঁদছিলো ...ওই কান্নার শব্দে ভুল করেও যদি হারান একটিবার পা রাখতো ও ঘরে, ডাইনিটা ওত পেতেই বসেছিল নিশ্চয়ই.... এত ঠাণ্ডাতেও হারান টের পেলো সে ঘামছে। এখন কি করবে ও? আস্তানাটাও লোপাট হবে এই ডাইনির জন্যে...যাবে কোথায়, কি কাজ করবে, খাবে কি? তার মধ্যে ঘরের ভিতর রক্তচোষা ডাইনি...হারানের মাথাটা কেমন দপদপ করতে থাকে।
যতটা আস্তে সম্ভব, ততটাই আস্তে শব্দ না করে হারান ঘরের দরজাটা খোলে। ভাঙা কাঠের পাল্লা তাও ক্যাঁচ করে ওঠেই। হারান আস্তে করে পা রাখে ভেতরে। ডান হাতে ওই গাছকাটা কুড়ুলটা আরেকটু জোরে চেপে ধরে। ঘরের ভেতরটায় চাপ চাপ অন্ধকার বসে আছে যেন শিকারের আশায়। একটু চোখ সওয়ানোর চেষ্টা করতেই হারান দেখতে পায় মিনতিকে...ওই তো ডাইনিটা!
যেমন ভাবে শুয়ে থাকে সবসময়, ঠিক তেমনি শুয়ে....কিন্তু হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করা। হারান আরেকটু এগোনোর আগে আরেকবার কুড়ুলটা অনুভব করে নেয়। ডাইনিবুড়ি বোঝার আগেই দু ফাঁক হয়ে যাবে!
অন্ধকারটা এতক্ষণে চোখে সয়ে এসেছে। মিনতির শরীরটা পুরোটাই দেখতে পাচ্ছে হারান। সবই যেমন থাকে তেমনি, উল্টোদিকে গেলে হারান জানে চোখ খুলে তাকিয়ে থাকবে শালীটা। মনে মনে আরো খানিক খিস্তি আউড়ে নেয় হারান। ওর চোখের সামনে দিয়েই সব শেষ করবে হারান! ওর নিজের রক্তে ভাসিয়ে দেবে ওকে। হারান খাটের পাশটা ঘুরে ঐদিকে আসে। তখনই হারানের শিরদাঁড়া আবার দাঁড়িয়ে পড়লো.... এই প্রথম দেখলো....এত বছরে এই প্রথম মিনতির চোখ বন্ধ...মিনতি চোখ বুজে আছে...আর বুকের কাছে জড়িয়ে চেপে রেখেছে ওই ....ওই আধবোনা উলের জামাটা.... তাদের সন্তানের...যার আসার অপেক্ষায় দিন গুনতো দুজনেই!
হারানের হাত থেকে কুড়ুলটা খসে পড়েছে, কিন্তু শব্দ হলো না। হারান মিনতির পাশে বসে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। বহুদিন পরে মিনতির হাতে হাত রেখে আবার কেঁপে উঠলো হারান। নিমেষে কান্না বন্ধ হয়ে গেল ওর।
মিনতির শরীরটা কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেছে।মুখটা ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য।
হারান চুপ করে বসে রইলো। হাতে আধবোনা উলের টুপি।
পরের দিন আবার লোক ডাকতে হলো, পুকুর পরিষ্কার করানোর জন্য।