সে অনেক দিন আগের কথা। ছত্তিশগড়ের ঘন অরণ্যের মধ্যে বয়ে যেত এক খলবলে নদী। নদীর পারে মাথা তুলে খাড়া দাঁড়িয়ে কোসগাই পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের চুড়োয় জেগে আছে কোসগাই মাতার মন্দির। সেই নদীর নাম হসদেও। বনের নাম অজগরবাহার। সেই ঘন বনের পাশে একটি গ্রাম। গ্রামের নাম ছোটকি ছুরি।
সেই গ্রামে ছিল কয়েকঘর কাঠুরের বাস, তাদের একজন গোবিনরাম। স্থানীয় উপভাষায় ওদের বলত—লকড়হারা। গোবিনরাম খুব খাটিয়ে। রোজ ভোর ভোর ‘বাসি’ বা পান্তাভাত খেয়ে বেরিয়ে যায় কাঠ কাটতে। সারাদিন কাঠ কেটে ঘরে ফেরে সূয্যিডোবার আগে। তারপর কুয়োর জলে হাত-পা ধুয়ে খেয়েদেয়ে বিড়ি ধরিয়ে বৌয়ের কাছে সারাদিনের বিক্রিবাটার হিসেব নেয়। এবার শুতে যাবার আগে স্বামী-স্ত্রী কপালে হাত ঠেকায় আর বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে গ্রামদেবতা ঠাকুরদেবের কাছে—‘হে ঠাকুর! সবাইকে ভাল রেখো। তোমার দয়ায় বনের কাঠ যেন না ফুরোয় আর আমাদের কুয়োর জল যেন না শুকোয়।’
গোবিনরাম আরো দুটো কথা জুড়ে দেয়।
‘আর ঠাকুর, আমাদের একটিই ছেলে ফেকলুরাম। তুমি তো সবই জান, ছেলেটা বড্ড আলসে। খালি খেয়েদেয়ে বিছানায় গড়িয়ে ইয়ারবন্ধুদের সাথে তাসপাশা খেলে ফক্কুড়ি করে দিন কাটায়। কতবার বলি—জোয়ান হচ্ছিস, আমার সঙ্গে জঙ্গলে চল। কোন কাঠ কাটতে হয়, কোন গাছটা ছেড়ে দিতে হয়, বনের কোনদিকে যেতে মানা—এসব সময় থাকতে শিখে নে। কী আর বলব ঠাকুর, এখনও ঠিকমত কুড়ুলের কোপ দিতে শেখেনি। আমাদের মত ঘরে কি এসব রাজার জামাইয়ের মত চালচলন মানায়? আসলে মায়ের আদরে ছেলেটা দিন দিন মহা ফেকলু হয়ে যাচ্ছে।’
তারপর খাটাখাটনিতে ক্লান্ত গোবিনরামের চোখের পাতা জুড়ে ঘুম নামে।
কথাটা মিথ্যে নয়। কাঠুরে বা লকড়হারা মহল্লার অন্য ছেলেপুলেগুলো বেশ খাটিয়ে, কিন্তু এ ছেলে একেবারে অন্যরকম। ছেলের মা বুধবারিন বাঈ আশা ছাড়ে নি। ও জানে যে ঠাকুরদেবের কৃপায় একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
এইভাবেই দিন কাটছিল। ছেলের চালচলনে হতাশ গোবিনরাম ভাবল আরও খেটে কিছু পয়সা জমিয়ে একটা চাষের জমি কিনে নেবে। তাহলে আর রোজরোজ জঙ্গলে যেতে হবে না। বয়সও হচ্ছে তো! কিন্তু পুবের জঙ্গলে কাঠ ফুরিয়ে আসছে। ভাবল, যদি জ্বালানি কাঠ ছাড়া আরও কিছু শাল-সেগুনের বন থেকে কেটে এনে ছুতোরপাড়ায় বিক্রি করা যায় তবে ভাল দাম পাওয়া যাবে। কিন্তু তার জন্যে যেতে হবে আরও ঘন বনে, নদীর পশ্চিমপারের জঙ্গলে।
কিন্তু ওদিকপানে যাওয়া! সে তো বাপ-পিতামোর সময় থেকেই মানা। গাঁওবুড়ারা তাই তো বলেন। ওদিকের জঙ্গলে নাকি এক রাক্ষস পরিবারের বাস। যারা গেছে, কেউ ফেরে নি। গোবিনরাম নিজের মনকে বোঝাল—ওসব গালগল্প, যত আলসে আর ঘরকুনো ভিতুদের তৈরি গুজব। আচ্ছা, না হয় বেশি গভীরে যাব না। কিছু দূর গিয়ে সূয্যিডোবার আগে ফিরে আসব।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। গোবিন চলল পশ্চিমপারে। বুধবারিন বাঈ পইপই করে মানা করেছিল। শেষে হার মেনে মাথার দিব্যি দিয়ে বলল—ফেকলু কে দদা! সূরজ ডুবনে কে পহিলে আ জাইও গ।’
হ্যাঁ, বৌয়ের কথা রেখেছে বটে গোবিন, আলো থাকতেই ঘরে ফিরেছে আর হাসিমুখে শুনিয়েছে দারুণ সব গাছ আর কাঠের কথা। অনেক কাঠ কেটেছে, কিন্তু এত দূর থেকে টেনে আনা মুশকিল। তাই কিছু এনে বাকি ডাঁই করে রেখে এসেছে। পরদিন কাঁওড় ঝুলিয়ে আনতে হবে। একা পারবে না, যেতে হবে গোটা পরিবারকে—মাঈ- পিলা সব্বোঝন!
ফেকলুরামের কোন উৎসাহ নেই। শেষে বাপের বকুনির চোটে উঠে কুয়োর জলে হাতমুখ ধুয়ে একথালা বাসি খেয়ে পেছন পেছন গেল বটে, কিন্তু মুখের ভাব যেন নিমপাতা চিবুচ্ছে।
এভাবে ক’দিন চলল। হাতে দু’পয়সা আসায় গোবিনরাম কোষ্টা মানে তাঁতিদের পাড়ায় পুকুরপাড়ে একটুকরো জমিও দেখে রেখেছে। তবে তাঁতিব্যাটা বড্ড দাম হাঁকছে।
গোবিনরামের মন মানে না। নেবে তো ওই জমিটাই--আদ্দেক টাকা এখন, বাকিটা ছ’মাস পরে; কিন্তু তাঁতিব্যাটা একটু কমসম না করলে! শেষে গাঁয়ের পাঁচমাথা—মোড়ল, মোকরদম, প্যাটেল ইত্যাদি মিলে ফয়সালা করে দিল—তাঁতি একটু নামো, গোবিন একটু ওঠো। ব্যস, গোবিনরাম আনন্দের চোটে সবাইকে বোগরাভাত, মানে খাসির মাংস ভাত, খাইয়ে দিল।
কিন্তু ও হল সেই জাতের লোক, যাদের ‘প্রাণ জায়ে পর বচন না জায়ে।’ ধার শোধ করতে ও উদয়াস্ত খাটতে লাগল।
এসে গেল হেমন্তের দিন, ছ’মাস পূর্ণ হতে আর তিরিশ দিন বাকি। টাকা প্রায় শোধ হয়ে এসেছে। ব্যস, আর ক’টা দিন। ট্যাঁকে আসুক বাকিটা। তারপর পুকুরপারের ওই সোনাফলানো তাঁতির জমিটা হবে কাঠুরে মহল্লার গোবিনরামের। রাত্তিরে ভাল করে ঘুম হয় না স্বামী-স্ত্রীর।
দিনটা ছিল শনিবারের বিকেল। কাঠের সন্ধানে গোবিনরাম এসে পড়েছে বনের গহনে। কখন যে রোদ্দুর মিইয়ে গেছে ওর খেয়াল নেই। এবার যে ফিরতে হয়।
কিন্তু ফিরতে চাইলেই কি ফেরা যায়! ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার, ডেকে উঠল কোলিহার দল—হাজার শেয়াল। এমন অন্ধকার যে হাতের তেলো দেখা যাচ্ছে না। ঘিরে ধরছে কাঁটা ঝোপ। পথ চিনবে কেমন করে? এবার ও ভয় পেল। প্রাণপণে কুড়ুল চালিয়ে রাস্তা করে বেরোতে চাইল। তাতেও ভয় কাটে না। কখনও হোঁচট খাচ্ছে কাটা গাছের গুঁড়িতে, কখনও কাঁটাঝোপে। আটকে যাচ্ছে পাঁচহাত্তি বা হেঁটো ধুতি। কোথা থেকে একটা আঁশটে গন্ধ ওর নাকে আসছে, পচা মাছের গন্ধ।
মাছ! এখানে নদী নালা কোথায়, একটা ডোবাও তো নেই। ওর গলা শুকিয়ে আসছে।
পশ্চিমের জঙ্গল থেকে গোবিনরামের ঘরে ফেরা হল না।
গাঁয়ের লোকে বলল—গোঁয়ারের মরণ।
তাঁতি খুশি; বায়নার টাকাটা-–অব বুড় গইসে!
পকেটে টাকাও রইল, জমিও হাতবদল হল না।
শুধু চোখের জল শুকোয় না বুধবারিন বাঈয়ের। মানুষটা ওকে বড্ড ভালবাসত যে।
হাঁউ মাঁউ খাঁঊ! মানুষের গন্ধ পাঁউ!
বুধবারিনের স্বপ্ন গেছে ভেঙে। একটা মাত্র ছেলে, এমন আলসে! এক ব্যঞ্জন, তাও নুনে কাটা? বাপকে হারিয়েও ওর কোন হেলদোল নেই। সেই কাঁথামুড়ি দিয়ে বেলা অব্দি শুয়ে থাকা। তারপর উঠে একথালা বাসি (পান্তাভাত) খেয়ে সেই যে কোথায় টো টো করতে বেরিয়ে যায় তার টিকি ছোঁয় কার সাধ্যি! হয়ত লুহারপাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে তাসপাশা খেলে পিদিম জ্বললে বাড়ি ফেরে, কোন কোন দিন আবার ফেরেই না।
পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। বুধবারিন বাঈ একবেলা বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ করে, আর এক বেলা অন্য কাঠুরেদের কেটে আনা কাঠের বোঝা মাথায় করে বয়ে বিক্কিরি করে চাল-নুন-তেলের জোগাড় করে। মায়ের এই হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে যদি বা ছেলের মন গলে! কিন্তু ভবি ভোলে না।
বর্ষাকাল। বৃষ্টিতে ভিজে বুধবারিন জ্বরে পড়ল, সাতদিন শুয়ে থেকে ছাড়ল বটে, তবে গায়ে গতরের ব্যথা গেল না। খাটিয়া ছেড়ে ওঠার শক্তি নেই, কাজে যাবে কেমন করে? হাঁড়ি চড়বে কি? অগত্যা ফেকলুরাম বাপের কুড়ুল কাঁধে তুলে ব্যাজারমুখে জঙ্গলমুখো হল।
শ্রাবণমাস। বনের রঙ মায়াবী সবুজ। জংলিঘাস এখন বুকসমান উঁচু। আম-জাম-শাল-পিয়াল-অশত্থ-বয়ড়ার পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ ঢোকে লজ্জা লজ্জা পায়ে। বন-ইমলির গা বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যায় কাঠবেড়ালি। পায়ের পাশ দিয়ে সরসরিয়ে চলে যায় সাপ। আচমকা ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি। জলে ভেজা ঘাসে ছপছপিয়ে এগোতে থাকে ফেকলুরাম।
জঙ্গল যে এত সুন্দর তা এই প্রথম চোখে পড়ল ফেকলুর। ভুলে গেল কাঠ কাটতে হবে, আঁটি বাঁধতে হবে। কাঁধের কুড়ুল রইল কাঁধে, ফেকলু সেঁধিয়ে গেল বনের আরও গভীরে। যখন চৈতন্য হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ক্ষিদে পেয়েছে, মুচড়ে মুচড়ে উঠছে পেট। কুল কুল করে বয়ে চলা এক শীতল জলধারার আঁজলা ভরা জল খেয়ে ওর শরীর খানিকটা জুড়োল।
কাজ হয় নি বিশেষ, কিন্তু এবার না ফিরলেই নয়। কখন যে নেমে এল অন্ধকার, দল বেঁধে ঘরে ফিরল পাখির ঝাঁক। ফেকলু জোরে পা চালায়। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল, জঙ্গল পাতলা হচ্ছে না তো। তবে কি ওকে ভুলোয় পেল? সারারাত্তির গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে হবে? হঠাৎ বড্ড শীত শীত করছে, মনে পড়ছে রোগাভোগা মায়ের কথা। আর বাবা? গাঁয়ের সিয়ানের দল (মাতব্বর, মুরুব্বি) যে বলে পছিমধারে না যেতে? ওখানে নাকি একজোড়া রাক্ষস-রাক্ষসী থাকে? বাবা কথা শুনল না, গেল আর ফিরল না। ও ভুল করবে না পছিমধারে যাবে না। কিন্তু এই ঘুরঘুট্টি আঁধারে কী বা পূব কী বা পছিম!
চাঁদ ডুবে গেছে, জ্বলছে নিভছে অগুনতি জোনাকি। দূরে কোথাও ফেউ ডাকছে। শ্রান্ত ক্লান্ত ফেকলু একটা বটগাছের ঝুরির আড়ালে মোটাসোটা গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুমটা গেছে ভেঙে। হাওয়া বইছে না, তবু নাকে ঝাপটা মারছে একটা আঁশটে পচা গন্ধ, ওর গা গুলিয়ে উঠছে। ফেউয়ের ডাক থেমে গেল। দূর থেকে একটা শব্দ এগিয়ে আসছে, শুকনো পাতার ওপর পা ফেলার মচমচ শব্দ। একজোড়া পা, আসছে এদিকপানেই। ফেকলু ভয় পেয়েছে, ভীষণ ভয়। ও নিঃশ্বাস বন্ধ করে গাছের গাইয়ে সেঁটে যায়, তারপর হুড়মুড়িয়ে উঠে যায় বটগাছের মগডালে।
পায়ের শব্দ কয়েক হাত দূরে থেমেছে। কেউ যেন জোরে জোরে শ্বাস টানছে।
--হাঁউ মাঁউ খাঁউ! মানুষের গন্ধ পাঁউ!
কেউ খলখল করে হেসে উঠল। তারপর এক অদ্ভুত নাকিসুরে বলে উঠলঃ
--ওরে আমার নোলা সপসপ গিন্নি রে! স্বপন দেখছিস নাকি? এই তো সেদিন একটা কাঠুরে কে খেলি, দুটো মাসও পুরোয় নি, এর মধ্যে আবার মানুষ? কত বছর পরে বোকাটা সেদিন আমাদের তল্লাটে ঢুকেছিল, নিঘঘাৎ পথ হারিয়ে।
--আমি কক্ষনো স্বপন দেখি নে, বুঝলে মূলোদাঁতি কত্তা, আমার নাক ভুল করেনি কো। গন্ধটা খুব কাছে।
সঢ়াৎ করে জিভের ঝোলটানার আর নাক টানার শব্দ।
--বুঝেচি, বুঝেচি। গন্ধটা বটগাছের মাথায়। এই, কে রে তুই! নেমে আয় শিগগির, নাম বলচি।
এবার একটা ফ্যাঁসফেঁসে আওয়াজ কথা বলে।
--শোন রে ভালমানুষের পো! রাক্ষসরাণীর কথামত ভালয় ভালয় নেমে আয়। ওর হল দয়ার শরীর। চটপট নেমে এলে তোর মুণ্ডু একটানে ধড় থেকে আলাদা করে ফেলা হবে। বেশি কষ্ট পাবি নে। আর কথা না শুনলে আমরা দুজন তোকে জ্যান্ত রেখে দুদিন ধরে একটু একটু করে খাব। ধর আজ তোর পাছার মাংস খুবলে নিলাম, কাল তোর তলপেট। তিনদিনে ছটফট করে মরবি। তাই বলচি নেমে আয়।
--নাম শিগগির। নইলে আমি ওপরে উঠে আসব, বুঝবি ঠ্যালা!
গাছের মগডাল থেকে ফেকলু প্রায় পড়ে যায় আর কি! এরাই তাহলে ওর বাবাকে খেয়েছে। গাঢ় অন্ধকারেও কোথা থেকে একটা ফিনিক দেয়া আলোর রোশনিতে গাছের গোড়া বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ও কী! ও কী! একজোড়া বিচিত্র জীব, খানিকটা মানুষের মত, আবার পুরোটা নয়। মাথায় জটা, গায়ে বড় বড় কাঁটার মত লোম, হাতে পায়ে তীক্ষ্ণ বাঁকা নখ। গায়ে একটাও সুতো নেই, তবে কোমরে আর গলায় হাড়ের মালা। ওদের একজনের চুল বেশ লম্বা, সেই বোধহয় রাক্ষসী। তার পায়ে রয়েছে একজোড়া মল, আর তার থেকেই ঠিকরে বেরোচ্ছে একরকম আলো, তাতেই গাছের গোড়ায় চারপাশ ঝলমল করছে।
ও বুঝল--উপায় নেই, নামতেই হবে। বুঝলে—ও এবার মরবে, তবে মেরে মরবে। বাবার মৃত্যুর বদলা নেবে। আর এটা ভাবতেই ওর মন থেকে সেই হাড়হিম করা ভয় চলে গেল, ঠিক জ্বর ছেড়ে যাওয়ার মত।
ভারী কুড়ুলখানা? আরে সে তো নীচেই রয়ে গেছে, গাছের গোড়ায়। রাক্ষসীর ভয়ে হাঁচোড় পাঁচোড় করে গাছে চড়ার সময় খেয়াল ছিল না। এখন উপায়? নামতে গিয়ে শেষে রাক্ষসীর সহজ শিকার হবে? কিন্তু এদিকে ও তো গাছে উঠে আসার চেষ্টা করছে। মরিয়া হয়ে যা-থাকে-কপালে ভেবে ঠাকুরদেবের নাম নিয়ে ও সরসরিয়ে নামতেই হাতে পেল কুড়ুলখানা। এদিকে রাক্ষসীও ওকে দেখতে পেয়েছে।
খলখল করে হেসে থাবা বাড়িয়ে ও এগিয়ে আসছে, পেছনে রাক্ষস। ভাঁটার মত জ্বলছে দুজোড়া চোখ। ফেকলু ভয়ে চোখ বোঁজে। রাক্ষসী ওর দিকে ঝাঁপ দিতেই হাঁটুগেড়ে বসে শক্ত মুঠোয় ধরা কুড়ুলটা ঘোরায় প্রাণপণে। একটা গরম কিছু ছিটকে লাগে ওর গায়ে। একটা আর্ত চিৎকার! এবার ও ভয়ে ভয়ে চোখ খোলে।
অবাক কাণ্ড! কুড়ুলের ঘায়ে উড়ে গেছে রাক্ষসীর একটা পা। কাটা পা ফেলে পালাচ্ছে রাক্ষসী, বুড়ো রাক্ষসের হাত ধরে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে। ফেকলু জ্ঞান হারালো।
কতক্ষণ ওভাবে পড়েছিল বলা মুশকিল। যখন চেতনা ফিরল তখন চারদিক নিস্তব্ধ, শুনশান, গাঢ় অন্ধকার।
কিন্তু বটগাছের গোড়ায় এত আলো? উঠে পড়ে ফেকলু। বটগাছের গোড়ায় গিয়ে দেখে রাক্ষসীর কাটা পায়ের মল থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে এক অপার্থিব দ্যুতি। তাতেই জায়গাটা আলোয় আলোময়। আবার কুড়ুল তোলে ফেকলু। কেটে বের করে নেয় সেই জাদুকরী মল। যত্ন করে হাতে তোলে যেন সাঁঝবেলার পিদিম। তারপর সেই আলোয় ধীরে ধীরে পথ চলে। বনের মধ্যে জেগে ওঠে রাস্তা। জঙ্গল ফুরোয়, গাঁয়ের সীমানা দেখা যায়।
ফেকলু যখন ঘরে পৌঁছলো তখন শুকতারা মিলিয়ে যাচ্ছে।
--কোথায় ছিলি বাপ? এ কী চেহারা হয়েছে তোর?
--ঠাকুরদেবের বর পেয়েছি মা, দেখ তোর জন্যে কী এনেছি।
এই বলে হতভম্ব মার হাতে রাক্ষসীর কাটা পায়ের মল তুলে দিয়ে বিছানায় লম্বা হয় ফেকলু, কাঁথা টেনে নেয় আর অঘোরে ঘুমোতে থাকে।
রাজকন্যের চোখে জল,
চাই যে ওর দৈবী মল।
রাজা হাঁকেন—কোন সুজন?
আনবে খুঁজে, মরণপণ!
তা সেই এক পায়ের মল ফেকলুর বাড়িতে ভেলকি দেখিয়ে ছাড়ল। বিহানবেলা বুধবারিন বাঈ একপায়ে ওই মল পরে যেই না কুয়োর পাড়ে গেছে, অমনি কুয়োর জল খলবলিয়ে কানায় উঠে এল। ওকে আর দড়ি টেনে বালতি ডোবাতে হল না। চোখ ছানাবড়া! তবে কি ঠাকুরদেব এবার মুখ তুলে চাইলেন?
ফেকলুরও বলিহারি! ওই এক রাতের ঘটনায় ছেলেটা যেন বদলে গেছে। বাপ-ঠাকুদ্দার কাঠুরেপেশা ছেড়ে দিয়ে মুদিদোকান খুলে বসেছে। ও আর জঙ্গলে যাবে না, ও এখন শেঠজি হবে। তার সঙ্গে ধরেছে ধানচালের ব্যবসা। ওর এখন ধূলমুঠো সোনা। যাতে হাত দেয় তাই ফলে। গাঁয়ের মাতব্বররা জানতে চান ব্যবসার পুঁজি এল কোত্থেকে? ও জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে--ঠাকুরদেবের কিরপা!
দেখতে দেখতে ওর বাড়ির ভোল বদলে গেল। আগের অগভীর কাঁচা কুয়ো এখন শানবাঁধানো মিষ্টি জলের পাতকুয়ো। সারা বছর ভরা জল টলটল। ঘরের মাটির দেয়ালের জায়গা নিয়েছে ইঁটের পাকা গাঁথনি। বয়স কম হলে কী হবে, এখন গাঁয়ের কোন বিষয়ের ফয়সালা ফেকলুরামকে বাদ দিয়ে হয় না। ও এখন একজন কেউকেটা। বুধবারিনের বুক গর্বে ফুলে ওঠে। এই ছেলের জন্যে ওকে কম কথা শুনতে হয়েছে? আজ সুযোগ পেলেই পাড়াপড়শীদের শুনিয়ে দেয়—আমি বরাবর বলে এসেছি, ওর বাপ বিশ্বাস করেনি। আহা! আজ যদি মানুষটা থাকত!
সব তো ভালই ছিল, কিন্তু বিধাতাপুরুষ মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
হল কি, রাজ্যের রাজকুমারীর চোখে পড়ল সেই আশ্চর্য মল।
কেমন করে? অতশত জানিনে বাপু! গাঁওবুড়াদের মুখে যা শুনেছি, তাই বলছি। বিশ্বাস করতে হয় কর, নইলে রাত্তিরে দুটো রুটি বেশি খেয়ে নিও।
এ রাজ্যের রাজার একটিই মেয়ে—বাপসোহাগি, আদরখাকি এবং দেমাকি। হবেই তো, রাজামশায় যে তাকে চোখে হারান।
বসন্তকাল। ছত্তিশগড়ে দিনের বেলায় রোদ্দুরের তাপ টের পাওয়া যায়। কিন্তু সূয্যি ঢলতেই হাওয়ায় বিদায়ী শীতের মিঠে আমেজ, গুলাবি জাড়া। বসন্তপঞ্চমী পেরিয়ে গেছে, এসেছে দেবউঠনী একাদশী। এইসময় সূর্যদেব শীতের ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। টিকিওলা পণ্ডিতেরা পুঁথি ঘেঁটে বলবেন—এ হল সূর্যের উত্তরায়ণ।
আমরা তো পণ্ডিত নই, শুধু জানি যে এইদিনে নতুন গন্না বা আখ কেটে তার পুজো করতে হয়। চাষিরা এইদিনে স্থানীয় হাটবাজারে মরসুমের প্রথম গন্না বিক্কিরি করতে নিয়ে আসে। আর বিক্রিবাটা ভাল হলে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার আগে ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে মহুয়ার রস নিয়ে একটু আচমন সেরে নেয়। তা আমাদের ফেকলুও আজ ছুরিগাঁয়ের হাটে গণেশরামের ঠেকে জমিয়ে বসেছে।
এদিকে রাজকুমারীর পালকি আসছে। আগে পিছে পাইক-বরকন্দাজ, ঘোড়সোয়ারের দল। লোকে ভয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়।
কোথা থেকে আসছেন রাজকুমারী? কোসগাই পাহাড়ের দেবীমন্দির থেকে।
কেন? কেন আবার কি! পুজো দিতে।
যাবেন কোথা? ফের বোকার মত কথা।
কাজ ফুরোলে রাজপরিবারের লোকজন কোথায় যায়? রাজপ্রাসাদে। ফেরে।
কিন্তু পালকি যে থেমে গেল। বেহারাগুলো দাঁড়িয়ে পড়েছে, গামছা দিয়ে ঘাম মুচছে।
রাজকুমারীকে দেখতে পেলে?
ওঁদের কি কখনো দেখা যায়?
ওই তো ! চিকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে, পানপাতার মত মুখ।
দূর বোকা! ও তো রাজকুমারীর সখি, থুড়ি সহচরী। দেখ না, একটা ঘোড়সোয়ারকে ডেকে কীসব বলছে।
এবার রাজকুমারীজি কী সওয়ারি ফের চলতে শুরু করেছে, জয় রামজী কী।
কিন্তু মাঝের রাস্তাটা ছেড়ে কাঠুরে পাড়ার দিকে ঘুরল যেন?
বুঝেছি, রাজকুমারীর তেষ্টা পেয়েছে। আর এ তল্লাটে ফেকলুরামের পাতকুয়োর মত মিষ্টি জল আর কোথায় আছে?
তাই তো দেখছি।
রাজকুমারী সাঁঝবেলায় পালকি থেকে নেমে কুয়োর পাড়ে দাঁড়ালেন, সঙ্গে পঞ্চসখী।
বুধবারিন বাঈয়ের বুকে ঢেঁকির পাড় পড়ছে।
হে বাবা ঠাকুরদেব! হেই গো বাররাজা, বাররাণী! অপরাধ নিও না গো! তোমাদের থানে প্রত্যেক একাদশীতে দশটি করে পিদিম জ্বালাবো। আজ যেন রাজকুমারীর সামনে আমাদের মুখরক্ষা হয়! কোন খ্যানত না হয়। উনি রুষ্ট হলে ধনেপ্রাণে যাব।
ডানপায়ে রাক্ষসী-মল পরে ও রাজকুমারীকে জল ঢেলে দিল—আঁজলা আঁজলা। আহা কি জল! মিষ্টি জল, শীতল জল। শরীর জুড়িয়ে গেল। এমন জল তো রাজপ্রাসাদেও পায় নি। এবার রাজকুমারী ভাল করে চেয়ে দেখল বুধবারিনকে। সাদামাটা গেঁয়ো মাঝবয়সি মেয়েমানুষ। কিন্তু ওর পায়ে ঝকমক করছে একটি মল আর তার থেকে ফুটে বেরোচ্ছে এক আশ্চর্য আলো।
সসংকোচে জানাল–-এটি ওর ছেলে কুড়িয়ে পেয়েছে, ঠাকুরদেবের দয়ায়। তারপর থেকেই ওদের দুঃখ ঘুচে গেছে।
ফিরে এলেন রাজকুমারী; সপ্তাহ কেটে গেল—চোখে ঘুম নেই।
রাজা ব্যাকুল। জানতে চাইলেন চোখের কোণে কালি কেন?
--দেখেছি এক পায়ের মল, অদ্ভুত বটে!
--স্যাকরার নাম বল, দশজোড়া গড়িয়ে দেব।
-না না; স্যাকরা নয়, দৈবীমল। কোসগাই পাহাড়ের কাছে অজগরবাহার বনের ধারে হসদেও নদীর পারে আছে এক গাঁও, নাম ছোটকি ছুরি। সেখানে এক কাঠুরের ঘরে জ্বলছে এক আশ্চর্য মানিক। সেটা আমার চাই।
এই কথা!
পরেরদিন সাতসকালে মোরগডাকার আগে ছুরিগাঁয়ের লোক জেগে উঠলো ঘোড়ার খুরের শব্দে। ঢাল-তলোয়ার-বল্লমধারী দশজন সেপাই ঘুম থেকে তুলেছে ফেকলুরামকে। ওদের সঙ্গে এসেছেন একজন বুড়ো মুন্সীজি, তিনি হাসিমুখে ফেকলুরামের হাতে একটি পত্র ধরিয়ে দিয়ে বললেন—ছোটকি ছুরি গ্রাম নিবাসী রাজভক্ত প্রজা ফেকলুরাম লকড়হারা (কাঠুরে)-কে রাজামহাশয়ের বিনীত অনুরোধ, উনি যেন ওনার মায়ের পায়ের আশ্চর্য মলটি রাজামহাশয়কে দেবার জন্যে পত্রবাহকের হাতে প্রদান করেন। এমন মল কাঠুরেবাড়ির থেকে রাজকুমারীর পায়ে মানাবে ভালো।
ওর মায়ের মুখে কথা সরে না। সদ্য ঘুমভাঙা ফেকলু রেগে কাঁই। এঃ! মামাবাড়ির আবদার! এ জিনিস আমাদের পরিবারে ঠাকুরদেবের কৃপায় এসেছে। চাইলেই দেওয়া যায় নাকি?
মুন্সীজির ভুরু কোঁচকাল, কিন্তু হাসিটি আরও চওড়া হল।
--শ্রীমান বোধহয় সমগ্র পত্রটি মন দিয়ে পড়েন নি। শুনুন, আমাদের রাজা অত্যন্ত উদার ও ন্যায়বান। উনি প্রজারঞ্জক, পীড়ক নন। মিনিমাগনা কিছু নেন না। এই মলের বদলে উনি আপনাকে একশ’ স্বর্ণমুদ্রা আর দুটি গ্রাম দিতে রাজি।
ফেকলু একটু অবাক হল। তবে ভেতরে ভেতরে ভাঙলেও মচকাল না।
--রাজামহাশয়ের অসীম কিরপা। হ্যাঁ, আমি লিখতে পড়তে জানিনা। পাঠশালে যাইনি। আপনাদের ফিরিয়ে দিতে আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু হাতজোড় করে বলছি দেবতার কিরপায় পাওয়া এই মল আমি বিক্কিরি করব না।
--এই তবে তোমার শেষ কথা?
--হ্যাঁ।
--ভেবে দেখ, ভাল করছ কি না।
--নতুন করে ভাবার কিছু নেই।
রাজা অবাক। এক ব্যাটা জংলী গাঁয়ের লকড়হারা! সে কি না--!
মন্ত্রী বললেন—বেঁধে আনি ব্যাটাকে?
কোটাল বললেন—মুণ্ডুটা ধড় থেকে আলাদা করে দিই?
--না, আমি ওসব পছন্দ করি নে। বরং ভেবে দেখ, আর একটা অমন নকল মল বানিয়ে দিলে মেয়ে আমার মেনে নেবে কি না!
রাজস্যাকরার ডাক পড়ল। তাকে নিয়ে আবার পাইক-বরকন্দাজের দল ছুটল ছুরিগাঁয়ে। ফেকলুর বাড়িতে। মল নেড়েচেড়ে দেখে স্যাকরা মাথা নাড়ল। না, ও নকল একটি বানিয়ে দিতে পারবে বটে, কিন্তু অমন দ্যুতি ঠিকরে বেরনো? সেটা ওর কম্মো নয়। না, এ হয় না। রাজকুমারী নিঘঘাৎ ধরে ফেলবেন আসল আর নকল। রাজার লোকজন ফিরে এল।
রাজা হার মানলেন, মেয়ে শয্যা নিল। কেটে গেল পক্ষকাল। সোনার বরণ শুকিয়ে কালি।
এলেন রাজবৈদ্য; নাড়ি ধরে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন—ব্যামোর নাম হাড়মড়মড়ি--শয্যাকন্টকি। এ অসুখ হয় মনের রোগ থেকে। অতৃপ্ত ইচ্ছার পূরণ বিনা এর কোন চিকিচ্ছে নেই।
রাজার বাড়ির ঘরজামাই,
খাই-দাই আর বগল বাজাই।
খবর গেল গাঁয়ে গায়ে, খবর ছড়িয়ে পড়ল হাটেবাজারে। ঢ্যাঁড়া পিটে জানানো হচ্ছে যে রাজামশাই পুরস্কার ঘোষণা করেছেন।
কী সেই পুরস্কার? না, যে রাজকুমারীর অসুখ সারিয়ে মুখে হাসি ফোটাতে পারবে তাকে রাজা জামাই করবেন, একেবারে ঘর-জামাই। কিন্তু তাকে খুঁজে আনতে হবে এমন একটা মল যার থেকে আলো ঠিকরে পড়ে।
রাজা যে অপুত্রক!
তাতে তোর কী?
আমার অনেক কিছু। রাজামশাই গত হলে সিংহাসনে বসবে কে?
কেন, রাণীমা!
দূর বোকা, বসবে রাজার সন্তান-সন্ততি, অর্থাৎ রাজকুমারী স্বয়ং।
তাই বুঝি! আর যদি রাজকুমারীর বিয়ে হয়?
তাতে কী? রাজকুমারী নিশ্চয়ই তাঁর সোয়ামীকে সিংহাসনে বসতে দেবেন? হিন্দুনারী বলে কতা!
বেশ বলেছ; তবে তো ঘরজামাই হওয়া ভারি মজার। ওই হাল্লারাজা শুণ্ডিরাজার গল্পের মত?
আর যদি হীরকরাজার মত হয়?
কুকথা বলিস নে! আমি যাব।
ফের বোকার মত কথা! তোর গিন্নির পায়ে অমন আলো ঠিকরে পরা মল আছে? নেই তো? চেপে বোস।
কিন্তু সবাই তো আর তোর আমার বা রামাশ্যামার মত নয়। ফেকলুরামকে ওর ইয়ারদোস্তের দল বোঝালো যে ঢের নখরা হয়েছে। এবার গিয়ে দিয়ে আয় তোর মায়ের পায়ের ওই ঝিকিমিকি মল। পাবি আদ্দেক নয়, গোটা একটা রাজত্ব আর রাজকন্যে।
ফেকলু ইত:স্তত করছিল—মাকে কী বলে বোঝাবে?
দোস্তলোগ বলল—আরে ইয়ার, তোর মা বিয়ের পর তোর সঙ্গে রাজপ্রাসাদে থাকবে। এই হাড়ভাঙ্গা খাটনি থেকে মুক্তি পাবে, পায়ের ওপর পা তুলে বসে দাসদাসীদের হুকুম করবে। আর মলটা তো তুই জঙ্গলে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছিস; তোর বাবা মাকে গড়িয়ে দেয় নি।
সেয়ানা বটে ফেকলুরাম, যেমন ভাবা তেমন কাম।
ঝিকিমিকি মল দেখে রাজকন্যের মুখে হাসি ফুটল; সব অসুখ সেরে গেল।
রাজামশাই বললেন—আমার শর্ত ভুলে যাই নি। তোমার সঙ্গেই আমার বুকের ধন লীলাকুমারীর বিয়ে দেব। আর তুমি হবে এবাড়ির ঘর-জামাই, এ রাজ্যের জামাইরাজা! তবে তোমার কোন দাবি দাওয়া থাকলে বলে ফেল।
--আমার দুটো শর্তঃ
এক, আপনার সমধিন (বেয়ান) মানে আমার মা থাকবেন রাজপ্রাসাদে, তবে অন্য মহলে।
দুই, আমার ছোটবেলার ইয়ারদোস্ত বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নয়, এই জনা কুড়ি। ওরাও থাকবে রাজপ্রাসাদে, তবে বারমহলে। আর ওদের থাকা-খাওয়ার খরচ রাজকোষ থেকে মেটাতে হবে।
তথাস্তু, এবার তাহলে দিনক্ষণ দেখে বিয়ের আয়োজন হোক।
এই ফাঁকে আমরা ইতরজন হুঁকোয় দুটো টান দিয়ে নেই।
মিটে গেল বিয়ে; উৎসব চলল প্রায় একমাস। হ্যাঁ, দশগাঁয়ের লোক কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে ধন্য ধন্য করল। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল রাজকুমারী লীলাবতী ও জামাইরাজা ফেকলুরামের গল্প। রাজা জামাই পেয়েছেন বটে! ঘরজামাই। কেমন সাদাসিদে সভ্যভব্য মাটির মানুষ। একটুও গুমোর নেই কো।
রাজা কথা রেখেছেন।
ফেকলু ও তার মায়ের স্থান হয়েছে রাজপ্রাসাদে। আর জনাবিশেক ইয়ারদোস্ত?
তারা বারবাড়িতে।
ফেকলুও অকৃতজ্ঞ নয়। রাক্ষসীপায়ের সেই মল এখন শোভা পাচ্ছে ওর বৌ লীলাকুমারীর পায়ে। অন্দরমহল ঝলমল ঝলমল, ঝকমক ঝকমক। বারমহলে গেলে ফেকলু ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে সহজ হয়ে যায়। ঠিক যেন ছোটকি ছুরি গাঁয়ের ফেকলু লকড়হারা।
রাজার খেয়াল হয় যে বয়স হয়েছে। রাণী গত হয়েছেন। এখন জামাতাবাবাজী একটু একটু করে রাজকাজ বুঝে নিলে মেয়েজামাইয়ের হাতে রাজপাট ছেড়ে দিয়ে বানপ্রস্থে গেলে কেমন হয়?
রাজা ভাবতে থাকেন।
দেখা গেল ফেকলুরাম গেঁয়ো, কিন্তু মাটো নয়; বেশ বুদ্ধি ধরে। অল্পদিনেই শিখে নিল রাজ্যের আমদানি ও খরচের হিসেব। রাজা ওকে রাজ্যের একটি অঞ্চলের দায়িত্বভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। একদিন রাজা তাঁর বিশ্বস্ত চরের মুখে খবর পেলেন যে ওই এলাকার প্রজারা ফেকলুকে ওই এলাকার রাজা বা ‘ফেকলুরাজা ’ বলে ডাকে। রাজার কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর ভাবলেন যে আজ নয় কাল তো ওই গোটা রাজ্যের রাজা হবে, ঠিকই আছে। তবে একটু তাড়াহুড়ো করছে আর কি!
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগল যে রাজা মহাশয়ের রাত্তিরের ঘুম কর্পূর হয়ে গেল।
দিনটি ছিল শ্রাবণমাসের পহেলা সোমবার। আগের দিন গেছে ‘আঁওলা একাদশী’ বাঃ আমলকি-একাদশীর পরব। সেদিন ছত্তিশগড়ের গাঁয়ের মেয়েরা সবাই মিলে আমলকি গাছের নীচে জড়ো হয়ে গাছের পুজো করে আর সেখানেই রান্না করে খায়। রান্না হয় ভাত-ডাল-ভাজা-শাক-আচার ও ঘরে তৈরি স্থানীয় মিষ্টি। একরকম বনভোজন আর কি। এতে ঘরের পুরুষেরা বাদ পড়ে।
লীলাকুমারীও ওর সখী এবং দাসদাসীদের নিয়ে রাজার নিজস্ব উদ্যানে গিয়ে আমলকি পুজো ও বনভোজন করে এসেছে।
আর জামাইরাজা? ও কি শুদুমুদু ঘরে বসে থাকবে? ফেকলুরাম সে বান্দাই নয়। ও গেছল ওর দোস্তদের সঙ্গে আখেট বা মৃগয়া করতে।
এবছর বিষ্টিবাদলা ভালই হয়েছে। মাঠে মাঠে ধানের চারা লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে। মেয়েদের খেতের কাজকম্মো প্রায় শেষ। এখন পালাপার্বণের সময়। চারদিকে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। আবার শাওন-সোমবার পরবে মেয়েরা সবুজ শাড়ি ও সবুজ কাঁচের চুড়ি পরে দোলনায় দোলে। তাই রাজদরবারেও আজ কারো কাজে মন নেই। বেশ একটা ছুটি ছুটি ভাব। দরবারে লোকগায়কের দল সুর তুলেছে—‘রিমির ঝিমির বরষে পানি।’
সভাসদেরা ভাবছে আজ মহারাজ একটু তাড়াতাড়ি দরবার থেকে উঠে অন্দরমহলে গেলে পাশা ও চৌরসের ঘুঁটি সাজিয়ে বসবে।
এমন সময় দরবারের বাইরে একটা হট্টগোল। দুই দ্বারপাল আটকানোর চেষ্টা করছে একটি শণচুলো বুড়িকে।
--কী ব্যাপার?
--ও একটা পাগলি হুজুর।
কিন্তু এলোমেলো চেঁচামেচির মধ্যেও রাজার কানে গেল একটা কাকুতিমিনতির স্বর।
--বাবারা! আমাকে একবারটি ভেতরে যেতে দাও। আমি হুজুরের পায়ে পড়ব। উনি আমার নাতনিকে ফিরিয়ে দেবেন। আমার নাতনি চাই।
--আসতে দাও ওকে। আমি শুনবো বুড়িমা কী বলতে চায়।
--অপরাধ নিও না মহারাজ! তঁয় হমর দাঈ-দদা, তঁয় মোর ভগবান, হমন গরীবকে মাঈ-বাপ। হমন ডরাওথন, মাফি দেব সরকার।
--ভয় নেই, যা বলার খুলে বল। কী হয়েছে?
--আমার তিন কুলে কেউ নেই, শুধু ওই একটা নাতনি। আকালের সময় হয়েছিল বলে নাম দুকলহীন বাঈ। সবে এগারোয় পা দিয়েছে। জঙ্গলের শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে, তাই বেচে দুজনের পেট চালাই। দুদিন ধরে গায়ে জ্বর। তবু কাল দিনের বেলা জঙ্গলে গেছল, বিকেলেও ফেরেনি। লোকে বলছে বনের পথে রাজার সেপাইরা ওকে ধরে নিয়ে গেছে। মহারাজ গো, ওকে ছেড়ে দাও।
রাজার মুখ রক্তবর্ণ, সভায় মৃদু গুঞ্জন।
--শোন বুড়িমা, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার সেপাইরা এমন কাজ করোতে পারে না। গাঁয়ের লোকেরা হয়ত না বুঝে কিছু মনগড়ন্ত উল্টোপাল্টা গুজব ছড়াচ্ছে। তোমার নাতনি ওর সখিদের সঙ্গে ভিনগাঁয়ে বেড়াতে যায় নি তো? তুমি হয়তো ভুলে গেছ, মনে করে দেখ।
--নাহি মহারাজ, মাফি দেব। ওদের সঙ্গে যে মেয়েরা ছিল তারাই দেখেছে। ছয়জন ঘোড়সোয়ার, তাদের ঘোড়ার মাথায় পালক। ওর মুখ চেপে তুলে নিয়ে গেছে। অন্য মেয়েরা পালিয়ে এসেছে।
রাজার মুখ গম্ভীর। কোটালের দিকে তাকালেন।
--না হুজুর! আমার অধীন কোন চৌকিতে এমন কোন ঘটনা ঘটে নি। হলে আমি জানতে পারতাম।
--শুনলে তো বুড়িমা। যাকগে, কাল কোথাও নালিশ কর নি? কোন চৌকিতে?
--মহারাজ, ওই হুজুরের লোকজনই আমায় ভাগিয়ে দিয়েছে, নালিশ নেয় নি।
--ভাগিয়ে দিয়েছে? কে? নাম বল।
--হুজুর, করমন সিং।
মহারাজ উত্তেজিত; কড়া চোখে কোতোয়ালের দিকে তাকালেন।
--তোমার লোক ওকে ভাগিয়ে দিল, নালিশ নিল না। কারণটা জানতে পারি কি?
--মহারাজ,ওই জঙ্গল এলাকার শান্তিরক্ষা আমার এক্তিয়ারের বাইরে।
--তবে কার এলাকা ওটা?
--জামাইরাজার।
গোটা দরবার নিস্তব্ধ।
--বুড়িমা, তুমি তোমার গাঁয়ের পাশের চৌকি ছেড়ে এতদূরে রাজধানীর কাছের চৌকিতে এখন নালিশ করোতে এসেছিলে? কেন আমার জামাইরাজার কাছে যাও নি?
থরথর করে কেঁপে ওঠে বুড়ি। হেঁচকি তুলে কাঁদে। বারবার হাত জোড় করে কপালে ঠেকায় কোন অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে—মোলা মাফি দেব সরকার। নারাজ ঝন হবে। আমার ভুল হয়ে গেছে।
তারপর বাঁকাচোরা লাঠিটা তুলে নিয়ে ঠুকঠুক করতে করতে থেকে বেরিয়ে যায়।
রাজা অবাক। দরবারের গুনগুনানি থেমে গেছে। উৎসবের সুর কেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে একটা চাপা ভয়।
রাজা এবার মহামন্ত্রীর দিকে ফেরেন।
--একটা কথা বুঝতে পেরেও পারছি না। যেন চোখের উপরে কালো পট্টি বাঁধা রয়েছে। ঘটনাটি যে ঘটেছে তা আপনারা সবাই জানতেন? ঠিক তো?
মহামন্ত্রী নিরুত্তর।
--বুড়ির নাতনিকে কারা তুলে নিয়ে গেছে আপনি জানেন?
মহামন্ত্রী নতমুখ।
--মেয়েটি বেঁচে আছে?
মহামন্ত্রী উসখুস করতে লাগলেন।
--অপরাধীর নাম?
মহামন্ত্রী অসহায় ভাবে সেনাপতির দিকে তাকালেন।
--বুঝলাম; আপনারা জানেন কিন্তু বলবেন না। ভয়? কাকে? আমাকে তো নয়, অন্য কাউকে। কে সে?
দরবারের মেঝেতে পিঁপড়ে চলার শব্দ শোনা যায় বুঝি।
গর্জে উঠেছেন মহারাজ।
--কে সে? কে এই রাজ্যে আমার চেয়েও শক্তিধর অমিতবিক্রম? রাজাদেশের চেয়েও যার ইশারার দাম বেশি?
বিদূষকের দন্তরুচিকৌমুদী বেরিয়ে পড়ে—ফেকলুরাজা! জামাইরাজা!
ও যে আমার নাটের গুরু, আমি যে ওর কেলে হাঁড়ি।
হাসিমুখে তাই সয়ে যাই গুরুমশায়ের বেতের বাড়ি।
সেদিনের দরবারের ঘটনাটি বিদূষক ঘরে ফিরে বৌয়ের কাছে ফলাও করে বলছিল আর কপালের ফেরে আমিও তখন সেখানে হাজির ছিলাম। আসলে রোজ সন্ধেবেলা আমাকে ওর বাড়ি যেতে হয়, আমি যে ওর মিতান।
কবে থেকে? সেই পাঠশালায় যাবার দিন থেকে। ও ছিল বিটলে বামুন, গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি; ও ছিল আমাদের নাটের গুরু, আর আমি ওর কেলে হাঁড়ি, মানে চেলা আর কি! ওর বুদ্ধির জোরে কতবার গুরুমশায়ের বেত খেতে খেতে বেঁচে গেছি।
আজ আমি নরসুন্দর, গোটা গাঁয়ের ক্ষৌরি করি আর দু’বিঘে নিষ্কর জমি চষি। ও কিন্তু দরবারের বিদূষক, মহারাজের বয়স্য। এক নম্বরের ফাজিল, বিটলে বুদ্ধিতে মাথা গজগজ করছে। যে কথা অনেকে মুখে আনতে সাহস করে না, তা ওর জিভের আগায়। ভাগ্যিস মহারাজ ওকে পছন্দ করেন, আশকারা দেন।
তবে ওর ঘরের হাল ফেরেনি। সেই খাপরার চাল, মাটির দেয়াল আর কাঁচা পাড়ের পাতকো। ওর বামনি, মানে আমার ভৌজি কপাল চাপড়ায়।
--দেবরজি, আপনার বন্ধুর নাকি খুব বুদ্ধি? নমুনা দেখুন। হোলির দিনে মহারাজ কল্পতরু, খুব দানধ্যান করছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন সব ভাল তো? আমাদের ইনি ইশারা বুঝেও বুঝলেন না। হেসে বললেন সব ভাল। আর এদিকে দেখুন, দু’বছর ধরে চালে খাপরা বদলানো হয় নি। এবারের বর্ষায় অনেকগুলো ফুটো দিয়ে জল পড়েছে। হাঁড়িকুড়ি সরা ধরে ধরে লাগাতে হয়েছে।
--আরে সুকালুর মা, ভগবান তোমার জলের কষ্ট দেখে ঘরে জল পৌঁছে দিলেন সেটা বুঝলে না? বুঝলে মিতান, ভরা গ্রীষ্মে পাতকো গেছে শুকিয়ে। তা উনি রোজ দুটো কলসী-–একটা মাথায়, একটা কাঁখে—নিয়ে সেই নদী থেকে জল ভরে আনতেন। দেখে কানহাইয়ালালের বড় কষ্ট হল। এই বর্ষায় ছাদ ফুটো করে ঘরের মধ্যে যত হাঁড়িকুড়ি, জালা, পাতিল, ঘড়া সব ভরে দিলেন।
--পণ্ডিতজি, তোমার এ সব ফক্কুড়ি ওই রাজদরবারেই শুনিয়ে এস, তাও যদি ঘরে দুটো পয়সা আসতো! তীজ-পরবের সময় প্রত্যেকবার ভাই এসে আমায় বাপের বাড়ি নিয়ে যায়, আমার অন্য দু’বোনও আসে। তাদের সঙ্গে বাড়ি থেকে আসে মিষ্টি, জামাকাপড় আর পিঠেপুলি। হায় আমার কপাল!
--দেখ, তোমার বড়দি, মানে আমার দেড়শাস (শাশুড়ি)কে আমি ভাল করে চিনি। তোমার বড় জামাইবাবু হল দশগাঁয়ের বৈগা বা পুরুতঠাকুর। বোকা চাষীদের ঝাড়ফুঁক তন্ত্রমন্ত্র করে পয়সা কামাচ্ছে। ওসব আমার কম্মো নয়—যতসব লোকঠকানোর ধান্দা।
--দেখা আপনে! আমার বাপের বাড়ির সবাই ঠগ, উনি একা ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। আরে দরবারে যাও, রাজার বয়স্য; চাইলেই কলাটা মুলোটা পোঁটলা বেঁধে দেবে। না, এসব হল উৎকোচ, কোন এক শাস্তরে নাকি লেখা আছে। আর উৎকোচ মানে নাকি পাপ? আরে যে শাস্তর পড়লে হেঁসেলে হাঁড়ি চড়ে না, তেমন সব পুঁথি না পড়লেই হয়!
আমি বিপদ বুঝে কথা ঘোরাই। জিজ্ঞেস করি--আজ দরবারে কিছু নাকি হয়েছে ?
--কে বলল?
--কে আর বলবে? হাটেবাজারে পথেঘাটে লোকজনের গুজগুজ ফুসফুস।
--মিনি মাগনা কিছু হবে না। আগে ভাঙ ঘোঁট, শরবত বানিয়ে দে! নানহী দাঊয়ের মা (ছোট খোকার মা) যখন আমায় এত কথা শোনাল তখন আমিও ছাড়ছি নে। আজ থেকে আমি ঘুষ খাব। বিনা উপঢৌকন নিয়ে যদি কারও আর্জি শুনি, তবে আমিও আর দরবারের বিদূষক নই। নে শ্যালক, ভাঙের শরবত তরিবত করে দু’গ্লাস বানিয়ে নিয়ে আয়। তারপর শোনাব আজকের দরবারের বিশেষ কিসসা আর তাতে এই শর্মার বিশেষ ভূমিকা।
আমার হাতের ভাঙের শরবত, কী তার স্বাদ! যে না খেয়েছে তাকে কী আর বলব? মহাশিবরাত্তির হোক কি হোলির দিন, বন্ধুবান্ধবের মান রাখতে আমিই বানাই। এই বিটলে বামুন বলে যে সেই শরবত যদি ধানের ক্ষেতে দাঁড় করিয়ে রাখা খড় আর মাটির হাঁড়ি দিয়ে গড়া কাকতাড়ুয়ার ঠোঁটেও দু-এক ঢোক ঢেলে দেওয়া যায় তাহলে সে একটু পরে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসবে।
সে যাকগে, মোদ্দা কথাটা হল বিদূষক মশাই ডেকে নিলেন গিন্নিকে। তারপর দু’গেলাস সিদ্ধির শরবত খেয়ে গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে আজকের দরবারের ঘটনাটি রসিয়ে রসিয়ে শোনালেন।
আমাদের চোখ গোলগোল, গায়ে কাঁটা! ব্যাটা বলে কি!
জামাই রাজা! ফেকলু রাজা! তার নামে মহারাজের কাছে নালিশ?
হ্যাঁ রে, বললে পেত্যয় যাবি নে। বুড়ির সাহস আছে। আর আমি যখন ভরা দরবারে টুক করে অপরাধীর নামটা বলে দিলাম তখন মহারাজের শ্বাস আটকে যায় আর কি! আর মহামন্ত্রীর যেন ‘সাঁপ সুঁধ গয়ে’! আর কোতোয়ালের তো ‘পুঁ সরিক গইস।’
--কে বলেছিল মুখ খুলতে তোমায়? খোকাখুকুদের কথা একবারটি ভেবেছ? সবাই যখন মুখ বুজে ছিল, তুমিও না হয়—
ভৌজির কথা শেষ হয় না, দু’হাত জোড় করে বারংবার কপালে ঠেকায় আর বিড়বিড় করে।
--শেষে কী হল বলবি তো? হেসেই ম’লি।
হবে আর কি? মহারাজ বললেন জামাইরাজাকে এত্তেলা দাও, বল দরবারে আসতে।
সান্ত্রী ফিরে এসে বলল যে উনি প্রাসাদে নেই, মৃগয়া থেকে ফেরেন নি। যুবরাণীজি বলেছেন যে আজ রাতে ফিরলে কাল অবশ্যই দরবারে পাঠিয়ে দেবেন।
কী হল, হাসছিস কেন?
কই, হাসছি না তো! আসলে একটা ব্যাপার আছে। খুব গোপন। শুধু আমি জানি আর যুবরাণীজি জানেন। তাই কাউকে বলব না। আমি না খুব দুষ্টু।
আচ্ছা ফ্যাসাদ! সিদ্ধি বোধহয় বামুনব্যাটার ব্রহ্মতালুতে গিয়ে ঠেকেছে।
ঠিক আছে, শুধু সুকালুর মাকে বলব, কানে কানে। নইলে মিতানব্যাটা শুনে ফেলবে। আর ও শুনলে গোটা বাজারের লোক জেনে যাবে। রাজদরবার জানবে, মহারাজ জানবেন। তারপর আমার মুণ্ডু ঘ্যাচাং!
--আচ্ছা সুকালুর বাপ, বলো। আমাকেই বল আর বলেটলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
--বলি? বলছি কি জামাইরাজাও খুব দুষ্টু। ও না কাল রাত্তিরেই ফিরে এসেছে। যুবরাণীর মহলে মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চোখ খুব লাল। বোধহয় ফেকলুরামও মিতানের হাতে তৈরি ভাঙ খেয়েছে। হি-হি-হি!