হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না!
মহারাজের এককথা। যখন দরবারে প্রজা নালিশ করেছে তখন উনি দু’পক্ষের কথা শুনবেন। তারপর রায় দেবেন—শাস্তি বা খালাস।
রাজ্যজুড়ে এই নিয়ে হৈচৈ। কেন?
আরে নালিশ যে খোদ জামাইরাজার নামে।
দেখবি, কিস্যু হবে না। জামাইরাজাকে কেউ দেখেনি বুড়ির নাতনিকে তুলে নিয়ে যেতে। তবে?
সখীর দল? ওরা তো দেখেছে।
কী দেখেছে? ঘোড়ায় চড়ে ধেয়ে আসা ছয় গবরু জোয়ান ওদের সংগী কাঠকুড়ুনি মেয়েটাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল, এই তো?
তা ওরা যদি ভরা দরবারে ছোঁড়াগুলোকে চিনে ফেলে?
চিনলেই হল? ওদের প্রাণের ভয় নেই?
আরে ওদের বাপ-মা বলবে মরার শখ হয়েছে? চেপে বসে থাক। তোরা কাউকে চিনিস না।
আরে মহারাজ ওদের দরবারে ডাকলে তো? একমাত্তর মেয়ের একটি বর। মেয়ের কথা রাখবে না বাপ? শুনেছি ও নাকি বিস্তর কান্নাকাটি করেছে। বলেছে-–তুমি কেমন বাপ? রাজদরবারে দশটা ইতর লোকের সামনে জামাইকে আসামী সাজিয়ে দাঁড় করাবে? কার কথায়? না, একটা হাঘরে ন্যাতাকানি পরা বুড়ির কথায়! এতে তোমার আর তোমার মেয়ের মান-ইজ্জত বজায় থাকবে? তার চেয়েও বড় কথা। আজ নয় কাল তোমার জামাই এই সিংহাসনেই বসবে। তখন প্রজারা তাকে মানবে তো? ভেবে দেখ বাবা।
তা মেয়ে কী করতে বলছে?
বলছে ঘরের মধ্যেই দু-চারটে চড়চাপড় লাগিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নাও। দরবারে বলে দাও ওর খুব জ্বর। বলে দাও ও খুব লজ্জিত, মাপ চাইছে।
রাজা কী বলছেন?
বেচারা। কী আর বলবে? দেখবি বলবে—বুড়িমা, তোমার ভুল হয়েছে। শুরুতে তো অমন একটা বাক্যি বলেইছে।
যা বলেছিস, গরীবের কথা কে শুনবে? গরীব কী লুগাই, জগৎ ভৌজাই (গরীবের বৌ, দুনিয়ার বৌদি)।
একটি তেতো মুচকি হাসি দিয়ে সবাই বাজারের থলি নিয়ে ঘরে ফিরল।
সেদিন সূয্যি পশ্চিমে উঠেছিল।
ভরা দরবারে রাজার জামাই করজোড়ে বলল—আমি জানি না। আমার এলাকায় কোন মেয়েচুরির খবর নেই। আর আমি তো আমলা একাদশীর দিন দূরের বনে সংগীসাথীদের নিয়ে মৃগয়ায় গিয়েছিলাম। তবু বুড়িমার ক্ষতি দেখে আমি আমার ব্যক্তিগত কোষ থেকে পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা ওকে দেব, সর্বসমক্ষে কথা দিলাম।
রাজা বললেন—কিন্তু সেই কিশোরী মেয়েটি? সে কোথায়? দুই দিবস অতিক্রান্ত। তাকে কেন উদ্ধার করা গেল না? সেনাপতি? মেয়েটিকে খুঁজে পেতে হবে। ওকে আগামীকাল দরবারে দেখতে চাই। ওর মুখ থেকে শুনব কারা ওকে অপহরণ করেছিল। তারপর রায় দেব।
কিন্তু কর্তব্যে অবহেলার জন্যে উক্ত ক্ষেত্রের দায়িত্ব জামাইরাজার থেকে নিয়ে সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিংহকে দেওয়া হল। মনে হচ্ছে জামাইরাজার আরও শিক্ষানবিশীর প্রয়োজন আছে।
পরের দিন যা ঘটল তার জন্যে রাজ্যবাসী আদৌ প্রস্তুত ছিল না।
দরবারে সেনাপতি নিয়ে এলেন কিশোরীর নিষ্প্রাণ দেহখানি। পিঠের দিকটা যেন কোন অরণ্যচারী পশু খুবলে দিয়েছে।
কিন্তু মেয়েটির দেহ পাওয়া গিয়েছে কোন জঙ্গলে নয়, ফেকলুরাজার চ্যালাদের শিবিরের পেছনে, গর্ত খুঁড়ে মাটিতে পোঁতা।
রাজার বিশেষ গুপ্তচর বাহিনী পাকা খবর এনেছিল। প্রধান সেনাপতি রাতেই হানা দিয়ে কাজটা সেরে ফেলেছিলেন।
আর মৃত কিশোরীর দু’জন সখী শনাক্ত করল চারজন অপহরণকারীকে। দেখা গেল ওরা সবাই ছুরিকলাঁ গাঁ থেকে আসা ফেকলুর স্যাঙাৎ। সেই লোকগুলো আবার সর্বসমক্ষে কবুল করল যে ওরা যা করেছে জামাইরাজার নির্দেশেই করেছে।
দরবারে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠেই মিলিয়ে গেল।
একদিন পরে রাজা রায় দিলেন—অপরাধী চারজনের মৃত্যুদণ্ড। হেঁটোয় কন্টক, উপরে কন্টক। আর ফেকলুরাজাকে নির্বাসন। আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ওকে এই রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রধান সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিংহকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে উনি যেন আগামীকাল দশজন অশ্বারোহী সঙ্গে নিয়ে ফেকলুরামকে সূর্য ডোবার আগে রাজ্যের সীমানার বাইরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে কার্য সম্পন্ন হওয়ার পুষ্টি করেন।
তারপর যদি ফেকলুরামকে এই রাজ্যের ত্রিসীমানায় কোথাও দেখা যায় তখন তারও মৃত্যুদণ্ড হবে।
রাজকন্যে লীলাকুমারী কাঁদলেন না। জামাইরাজার যাত্রার জন্যে দাসদাসীদের সাহায্যে সিন্দুক-তোরঙ্গ গুছিয়ে দিতে লাগলেন।
নিকষকালো কৃষ্ণপক্ষের রাত। দীপ জ্বলছে লীলাকুমারীর কক্ষে। আজ যে ওদের এই প্রাসাদে শেষ রাত্তির। রাজা এইটুকু দয়া করেছেন। তবে কক্ষের বাইরে পাহারা বসেছে।
দীপ জ্বলছে আর একটি ঘরে, জেগে আছেন বিক্রমজিৎ। অপরাধী ছয়জনের মধ্যে চারজনের মৃত্যুদনণ্ড, কিন্তু বাকি দু’জন এখনও ধরা পড়েনি। ওরা গা ঢাকা দিয়ে কোথায় আছে? কে ওদের আশ্রয় দিয়েছে? মহারাজের কড়া হুকুম। নির্বাসিত ব্যক্তিকে সীমানার ওপারে ছেড়ে সেনাপতি দ্রুত ফিরে আসুন আর বাকি দুই অপরাধীকে খুঁজে বার করুন।
সকাল হল। আজ আর নহবতখানায় সানাই বাজে নি। মহারাজ ভোর হতেই পুজোয় বসেছেন। একমাত্র জামাইকে নির্বাসনদণ্ড দিয়ে আজ তাঁর মন অশান্ত। তিনি কি ভুল করলেন? ন্যায়ের বিধান? ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন মূল্য নেই? কিন্তু আর কোন উপায় ছিল কি?
এই বিয়েটা? নিজের দেওয়া বচনে নিজেই বাঁধা পড়েছিলেন তাই। লীলাকুমারীও তো চেয়েছিল। মেয়ের মন বুঝতে ভুল করেন নি।
এক অজ্ঞাতকুলশীল পাত্র! ভেবেছিলেন কাঠুরের ছেলে রাজপ্রাসাদে জামাই আদর পেয়ে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। কোথায় কী? উলটে এমন সব ঘটনা! তাঁরই রাজ্যে?
খালি ভুলতে পারছেন না মেয়ের চোখের দৃষ্টি। কাল যখন দরবার শেষে ওর মহলে গিয়ে রাজধর্ম পালনের দায়িত্ব বোঝাতে গেছলেন, তখন মেয়ে চুপ করেছিল। না, একটুও কাঁদে নি, প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু এক অদ্ভুত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল।
‘বিচার তোমার না হয় যেদিন, ততকাল তুমি নহ তো স্বাধীন,
বন্দী রয়েছ অমোঘ কঠিন ন্যায়বিধানের সূত্রে।’
ইতিমধ্যে নির্বাসিত জামাইরাজাকে নিয়ে প্রধান সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিং রাজাদেশ পালনে রওনা হয়ে গেছেন। সূর্যাস্তের আগেই বন্দীকে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দিতে হবে। সঙ্গে কিছু রসদবাহী শকট ও দশজন অশ্বারোহী। সেনাপতি সতর্ক। তাই যাত্রাপথটি একটু বদলে নিয়েছেন। পথটি দুর্গম, কিন্তু সময় নেবে কম।
এই যাত্রাপথ পরিবর্তনের গল্পটি কিন্তু কেউ জানে না, স্বয়ং মহারাজও নয়। পরিকল্পনাটি ছকেছেন প্রধান সেনাপতি নিজে, সাহায্য করেছেন ওঁর মুখ্য সহকারী বীরভদ্র সিং। রাজ্যের এই এলাকা বীরভদ্র চেনেন ভাল। উনিই বলেছেন যে কথাটি মহারাজের থেকেও গোপন রাখতে। কারণ, ওঁর মনের অবস্থা ভাল নয়। যদি কোন দুর্বল মুহূর্তে মেয়েকে বলে ফেলেন। আর যদি সেই মেয়ে--! বলা তো যায় না। যখন বাধাবিপত্তি আসে, দলবেঁধে আসে। কাজেই সাবধানের মার নেই।
সূর্য ডোবে ডোবে। এখনও জঙ্গল বেশ ঘন। কিন্তু বীরভদ্র আশ্বস্ত করলেন--ব্যস, ওই সামনের টিলা পেরলেই। অগত্যা, বীরভদ্র যে এলাকাটা হাতের তালুর মত জানেন।
এমন সময় ঘটল বিপত্তি।
জামাইরাজা ওরফে ফেকলুরাম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খানিক আগে থেকেই ওঁর গা গোলাচ্ছিল। এখন শুরু হল প্রচণ্ড বমি। পেট মুচড়ে মুচড়ে উঠছে জামাইরাজার।
বিক্রমজিৎ সিংয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। আদেশ হল সূর্যাস্তের আগে বন্দীকে সীমান্তপারের প্রতিবেশি রাজ্যে পৌঁছে দিতে হবে। এ বাবদ প্রতিবেশি রাজাকে লেখা মহারাজের পত্রটি একটি রেশমি কাপড়ে মুড়ে ওঁর কোমরবন্দে বাঁধা রয়েছে। কিন্তু বন্দি যদি ভেদবমিতে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে? যদি মারা যায়? সঙ্গে একজন বৈদ্যও নেই যে! বিক্রমজিৎ আর ভাবতে পারছেন না।
বীরভদ্র আশ্বাস দিলেন। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। জামাইরাজার চোখমুখ ভাল করে ধুইয়ে দিয়ে গাছের নীচে একটি রেশমী চাদর বিছিয়ে শুতে দেওয়া হল। বমি বন্ধ হল। ফেকলুরাম বীরভদ্র সিংয়ের দিকে চেয়ে একটু বিষণ্ণ হাসলেন।
কিন্তু দ্রুত নামছে অন্ধকার। আবার অশ্বপৃষ্ঠে যাত্রা শুরু। সীমান্ত পেরোতে হবে, যত শীঘ্র সম্ভব। হ্যাঁ, জঙ্গল শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর ছটা। জনপদ এত কাছে?
একটা আলো এগিয়ে আসছে। সবার চোখ সেদিকে। সম্ভবতঃ প্রতিবেশি রাজ্যের লোকজন। ওদের কোন টহলদার সৈন্যদল?
আলোর বৃত্তটি ক্রমশঃ বড় হচ্ছে; হতে হতে বিশ্রামরত ফেকলু আর তার সহচর দলটির কাছে এসে থামল। জনা পঁচিশেক সশস্ত্র অশ্বারোহী। কয়েকজনের হাতে জ্বলছে মশাল। এরা কারা?
--কহাঁ হোহি ফেকলুরাজা? কহাঁ হমনকে যুবরাজ?
এগিয়ে এলেন বিক্রমজিৎ সিং, সতর্ক পদক্ষেপে। তোমরা কে? কহাঁ লে আওথ?
--আমরা? আমরা হলাম রাজা ফেকলোয়ার সশস্ত্র দেহরক্ষী। তুই কে বটিস?
--মুখ সামলে! আমি এই রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। আর এই ফেকলুরাম কোন রাজা বা যুবরাজ নয়। এ হল এক বন্দী, রাজা যার ‘দেশ নিকালা’ আদেশ জারী করেছেন।
আগন্তুক দলের আর একজন এগিয়ে আসে।
বাজে কথা। আমাদের একজনই রাজা--রাজা ফেকলুরাম। আর তুই ছুছুন্দর, তুই এখন আমাদের হাতে বন্দী।
বাকিটা আমরা পিপলগাছের ডালে বসা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মুখ থেকে শুনব।
বিক্রমজিৎ-এর মত তলোয়ারবাজ এ রাজ্যে আর ক’জন আছে? তবু তিনি বন্দী হলেন? হ্যাঃ!
শুধু বন্দী? প্রাণটাও খোয়ালেন।
কাবর?
কাকর কাকর নাম লেবো? কা লা কা বাতাবো।
ন্যাকামি রাখ বেঙ্গি! মশালের আলোয় ঘুম গেল চটে, তারপর তলোয়ারে তলোয়ারে ঠন ঠন, মাঝেমধ্যে শিক শিক, ব্যস। এবার ঝেড়ে কাশ দিকি, তারপর ঘুমোবো।
বলার আছেটা কি? ও’রম দশজনের মহড়া নিতে উনি একাই যথেষ্ট, কিন্তু পেছন থেকে বীরভদ্র সিংয়ের বর্শা পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট ফুঁড়ে নাড়িভুড়ি বের করে দিল যে!
বলিস কী রে! বীরভদ্র সিং? ঠিক দেখেছিলি?
বেঙ্গির চোখে তোমার মত ছানি পড়েনি। ভুল দেখবো কেন? ও হ্যাঁ, একবারই ভুল দেখেছিলাম, তোর সঙ্গে মালাবদলের সময়।
ব্যাঙ্গমাবুড়ো শুনেও শুনল না। বলল—তারপর?
মশালের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম বীরভদ্র আর আগন্তুক দলের নেতা কোলাকুলি করছে। আর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়েছে ফেকলুরাম। ওর বমিটমি পেটব্যথা মাথাব্যথা সব ঠিক হয়ে গেছে।
বিক্রমজিতের সংগী ন’জন যোদ্ধা কিছু বোঝার আগেই কচুকাটা হল। অপকম্মের সাক্ষী রাখতে নেই।
আরে আসল ব্যাপারটাই দেখলি না? আগন্তুক দলের দুই নেতা হল ফেকলুর অপকম্মের সেই দুই গা-ঢাকা দেওয়া সংগী যাদের বিক্রমজিৎ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
জানি জানি। ওদের খুঁজে পাবেন কী করে? ওরা তো লুকিয়েছিল যুবরাণীর মহলে।
কিন্তু প্রধান সেনাপতির ডানহাত বীরভদ্র, সে তলে তলে সাঁট করেছে ফেকলুর সঙ্গে। কী কাণ্ড!
ডানহাত না, বাঁহাত—যা দিয়ে মানুষজন নিত্যি অপকম্ম করে।
দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহানো হল ভার।
হল পূণ্যিমেতে অমাবস্যা চারিচক্ষু অন্ধকার।
এ রাজ্যে অমঙ্গলের ছায়া। কার যে কুনজর লেগেছে বোঝা দায়। নইলে যা কখনও ঘটেনি তা ঘটে? একটা বাচ্চা মেয়েকে কিছু নররাক্ষস খুবলে খায় আর সেই দলের দুটো দামড়া উধাও হয়ে যায়! লোকে বলছে—দিনের বেলা প্যাঁচা ডাকছে। হঠাৎ করে শুকিয়ে যাচ্ছে কুয়োর জল আর মায়ের বুকের দুধ।
ফেকলুরামকে সীমান্তপারে রেখে আসতে রওনা দিয়েছিলেন প্রধান সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিং। দু’দিন হয়ে গেল এখনও ফেরেন নি, কোনও খবর নেই। মহারাজ দরবারে বসে বৃথাই অপেক্ষা করেন। আর লীলাকুমারী! খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে ক্রমাগতঃ পায়চারি করে যাচ্ছেন। কঠিন মুখ, শক্ত চোয়াল, চোখ দুটো জ্বলছে।
এই ধাক্কা সামলাতে পারে নি রাজার বেয়ান—সেই ছোটকি ছুরি গাঁয়ের ছুতোর গিন্নি বুধবারিন বাঈ।
শেষকালে বেয়াইমশাই আমার ছেলেকে নির্বাসনে পাঠালেন? আমার একমাত্র ছেলেকে? আমার দিকটা একবারটি ভাবলেন না? কেন? পুরুষেরা ওমনিই হয়। ওদের তো আর পেটে ধরতে হয় না! কী করে বুঝবে ছেলে কী জিনিস? সারারাত ধরে এইসব সাতপাঁচ ভেবে বেয়াই মশাইয়ের এমনতরো ব্যাভারের নিজের মত করে মানে খুঁজে পেয়ে ভোরের দিকে সে নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজল, আর খুলল না।
তৃতীয়দিন নগর সীমান্তের কোতোয়াল দূত মুখে আগাম খবর পেয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুট লাগাল দরবারের দিকে। জনাকয়েক সৈন্য নিয়ে রাজার ছোট দলটি ফিরে আসছেন, নেতৃত্বে বীরভদ্র সিং। কিন্তু বিক্রমজিৎ কোথায়?
গজব রে গজব! কহাঁ গইস হমর সেনাপতি?
ওহি তো হ্যায়! পালকওলা সাফা সর পে ঘোড়ে পর সওয়ার।
রোঘা! বেররা! মরুটে পাজি বদমাস! তোর আঁখি লা ফুটে! চোখের মাথা খেলি নাকি? আমাদের সেনাপতিকেও চিনিস না?
আররে! উ দেখ, উ দেখ! উহো কৌন হাবে কালী ঘোড়ি পর সওয়ার?
হমনকে জামাইরাজা ফেকলুরাম নো হে?
হউ জি।
তবে কি মহারাজ জামাইয়ের শাস্তি মকুব করে দিলেন?
কিংকর্তব্যবিমুঢ় রাজদরবারে হাঁটু মুড়ে মাথা নত করে বসে আছেন বীরভদ্র সিং।
--আমাকে শাস্তি দিন মহারাজ! সেনাপতিকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। উনি বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন।
সীমান্ত এলাকায় আদিবাসী ডাকাতদের একটি দল আমাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে--উদেশ্য জামাইরাজাকে অপহরণ করা। আমরা প্রাণপণে লড়েছি। দস্যুরা সব নিকেশ হল। অল্প ক’জন পালাতে পারল। আমাদের অধিকাংশ সাথী নিহত। জামাইরাজাকে রক্ষা করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আহত বিক্রমজিৎ অত্যধিক রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান। দেহ নিয়ে এসেছি। তাই আমাদের ফিরতে দেরি হল। ওঁর শেষ ইচ্ছা--এখানে আহিরণ নদীর পাড়ে একটি পিপল গাছের তলায় সমাধিস্থ করা হোক।
শোন রে বেঙ্গি! বিক্রমজিতের শেষের কাজকম্ম বেশ ধূমধাম করেই হল, দেখলি তো?
ধ্যাৎ, এ কী বিয়ে না অন্নপ্রাশন? ধূমধাম করে? বলতে হয় ‘রাজকীয় সমারোহে’; তাও গলার আওয়াজ মোটা করে, চোখ নামিয়ে!
তুই কত কী যে জানিস বেঙ্গি! এই দেখ আওয়াজ বদলে চোখ নামিয়ে বলছি—এখন রাজ্যের নতুন প্রধান সেনাপতি বীরভদ্র সিং।
বীরভদ্র? ঠিক জানিস? তাহলে আমরা যা দেখেছিলাম?
চুপ, নইলে গাছের ঊপর আমাদের বাস উঠবে।
কেন চুপ করব? ওই লোকটাই তো—আমিই তো স্পষ্ট দেখেছিলাম।
এক্কেবারে চুপ। আমরা গরীবগুর্বো, আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজে কি দরকার?
আর মহারাজ? উনি তো লোক ভালো।
কিন্তু ওঁর এখন সময় খারাপ যাচ্ছে। কথায় আছে না—‘পুরুষ বলী নহি হোতে, সময় হোত বলবান।’
হ্যাঁ, হ্যাঁ। বেশি শোলোক ঝাড়িস না। পুরুষকার নয়, সময় হল আসল শক্তিমান।
ব্যস, সময় ভাল নয়। এখন মুখ খুলতে নেই। খুলব, তবে মওকা দেখে।
কিন্তু মহারাজ যে ধর্মসংকটে পড়েছেন।
ফের বড় বড় কতা! ধর্মসংকট আবার কী?
মানে ফিরে এসেছে জামাই। কিন্তু কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই? ঘরে না কারাগারে? ও যে রাজার ঘরজামাই।
সে কি! শাস্তি তো একবার ঘোষণা হয়ে গেছে। বীরভদ্র যাক, ব্যাটা ফেকলুকে সীমান্তপার করে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসুক। কাঠুরের ব্যাটা কাঠ কেটে পেট চালাক গে।
না, না। কোন কোন সভাসদ বলছেন যে যারা ওই কিশোরীর ওপর অত্যাচার করেছিল তাদের তো প্রাণদণ্ড হয়েই গেছে। তাহলে ফেকলুকে নিয়ে আর টানাটানি কেন? ও তো জঙ্গলে শিকারে ব্যস্ত ছিল।
বাঃ, খুনিগুলো যে বলল সব ফেকলুর কথায় হয়েছে?
দূর! ও তো নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা। খুনিদের কথায় বিশ্বাস করে কি রাজার জামাইকে অমন কড়া সাজা দেওয়া যায়?
আরে খুনিগুলোকে রাজবাড়ির আঙিনায় তো উনিই এনেছেন। ছোটলোকদের মাথায় তুললে যা হয়! আর দু-দুটো খুনি যে এখনও ধরা পড়ে নি তার কী হবে?
অঃ ,ওরা? ওরা ভিনরাজ্যে পালিয়ে গেছে।
কিন্তু আমি যে দেখলাম জামাইরাজা ফিরে আসার সময় ওদের কালোঘোড়ার আগে আগে যেতে?
অ্যাই! তুই ওদের চিনিস? তুই কিচ্ছু দেখিস নি, আমরা কিচ্ছু দেখি নি।
‘জঙ্গল জঙ্গল ঘুম কে দেখা,
বস্তি বস্তি ঘুমকে দেখা।
হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়।‘
ধীরে ধীরে আবহাওয়া শান্ত হয়ে এল। বাতাসে শীতের আমেজ। টুপ টাপ করে খসে পড়ছে জীর্ণ পাতা। একটু একটু করে জীবন আবার পুরনো ছন্দে ফিরছে।
মানে? এর মানে হলঃ
ফুলগাছ ফুল দিচ্ছে,
ফলগাছ ফল দিচ্ছে।
গাভীরা দুধ দিচ্ছে,
মহাজনকে খাতক সুদ দিচ্ছে।
চাষী ক্ষেতে হাল দিচ্ছে,
কামার ঘোড়ার পায়ে নাল দিচ্ছে।
বৌ দুধ জ্বাল দিচ্ছে,
শাশুড়ি তাকে গাল দিচ্ছে।
কুমোর ভায়া বানায় হাঁড়ি,
নাপিতভায়া কামায় দাড়ি।
অ্যাই অ্যাই, এবার থাম তো! আমার জাতধম্মো তুলে ছড়া কাটতে হবে না। আমি তোকে বিনিপয়সায় কামিয়ে না দিলে তোকে আর রাজসভায় ভাঁড়ামো করে খেতে হত না।
মানে?
ফের মানে? এর মানে তোমার সিদ্ধির নেশা মাথায় চড়েছে। দেবরজি বলছেন উনি বিনিপয়সায় তোমার চুলদাড়ি না কাটলে কপালে দুঃখু ছিল। মহারাজ হলেন কেতাপসন্দ মানুষ। রাজসভায় গোঁফদাড়ি চুলের জট নিয়ে ঢুকলে তোমার বিদূষকের পদটি কবেই ফুরুৎ হয়ে যেত।
আর এক গেলাস দাও দিকি গিন্নি!
আর না, তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
ধ্যাৎ, আমার নেশাটেশা হয় নি। এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি।
কিন্তু কিছু একটা হয়েছে। আজ একটু বেশি বকবক করছ।
বলছি তো আজকে আমার মনমেজাজ ভাল নেই।
--অ্যাই বিটলে বামুন! বৌকে না বলিস আমাকে বল। নিঘঘাৎ আজ রাজসভায় কিছু হয়েছে। আরে প্যাঁচে পড়লে আমি বেরিয়ে আসার উপায় বাতলে দেব।
হ্যাঁ, কথায় বলে না কাক ধূর্ত আর নাপিত ধূর্ত।
--আমায় রাগালে ভাল হবে না। আসল কথাটা বল তো! আজ কি আবার তোর জিভে দুষ্ট সরস্বতী ভর করেছিলেন?
নরসুন্দর বন্ধুর কথায় বিদূষক মাথা হেলিয়ে সায় দেয়। তারপর গুম হয়ে বসে থাকে। ভর সন্ধেয় ওর আঙিনায় নিত্যিকার সিদ্ধির আসর। সদস্য মাত্র ওরা দুজন। আর রান্নাঘরের থেকে ব্রাহ্মণী জোগান দিচ্ছেন বেগুনভাজা, পলতাপাতার বড়া আর ধনেপাতার চাটনি।
বিদূষক আস্তে আস্তে মুখ খোলে।
হয়েছে কি, আজ দরবারে সবাই প্রশংসা করছিল—সুশাসনের, সুখশান্তির। এবার ফসল ভাল হয়েছে। গোলায় ধান উপচে পড়ছে, কোষাগারে খাজনা। এরমধ্যে একজন আবার জামাইরাজার তারিফ করে বলল--মহারাজ, আপনি নির্দোষ জামাইরাজাকে শাস্তি না দিয়ে বড়সড় পাপের হাত থেকে বেঁচে গেলেন। তাই কোসগাই পাহাড়ের দেবী প্রসন্ন হয়েছেন। এবার আপনার রাজ্যে ফসলের বন্যা।
এমন সময় মহারাজ আমার দিকে তাকালেন। বললাম--আমি একটি গান বেঁধেছি। অনুমতি হলে শোনাই।
উনি হাসিমুখে অনুমতি দিলেন।
--সে কি রে! তুই আবার গান বেঁধেছিস? এসব ব্যামো কবে ধরল?
আঃ, শোন না।
‘জঙ্গল জঙ্গল ঘুম কে দেখা,
বস্তি বস্তি ঘুমকে দেখা।
হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়।‘
(দেখেছি দেখেছি বনপ্রান্তর,
গেছি জনপদ মানুষের ঘর।
ক্ষেতভরা ধান, সবুজ শ্যামল
তবুও শূন্য অক্ষিকোটর।)
--তারপর?
দরবার চুপ, কেউ কোন কথা বলছে না। মহারাজ হঠাৎ উঠে ভেতরে চলে গেলেন।
--বুঝলাম; এ রাজ্যে তোর বাস উঠলো বলে।
প্রকৃতির নিয়মে কিছুই স্থায়ী নয়। আজ গ্রীষ্মের দাবদাহ পোড়ায় তো কাল টানা বৃষ্টির চোটে নদীতে বান ডাকে। শরতের কাশফুলের দিন ফুরোতে না ফুরোতে জেঁকে বসে শীত। তেমনি ক্ষেতের ধান ঘরে উঠে নবান্নের গন্ধ ছড়ানোর আগেই এল দুঃসংবাদ।
রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে প্রজারা বিদ্রোহ করেছে। শুধু তাই নয়, ওদের দমন করতে পাঠানো একটি ছোট বাহিনীকে পরাজিত করে কিছু সৈন্যকে বন্দী করেছে।
মহারাজের রক্তচাপ বেড়ে গেল।
মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্য সবাই একযোগে বললেন—ওদের আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। এখনই কিছু করতে হবে।
তাই এবারের অভিযানে বীরভদ্র সিং একশ’ অশ্বারোহীর একটি বাহিনী পাঠাবেন ঠিক হল।
কিন্তু মহারাজ বললেন—না, এবারের অভিযানের নেতৃত্ব করব আমি।
ওঁর আদেশ—উনি ফিরে না আসা পর্যন্ত বীরভদ্র রাজধানী ছেড়ে এক পা নড়বেন না। রাজকুমারী ও জামাইরাজার ভালোমন্দের ভার ওঁর ওপর। আপাততঃ রাজমহলের এক প্রকোষ্ঠে উনি থাকবেন।
মহারাজের মন আজ কুডাক ডাকছিল। টের পাচ্ছিলেন বয়েস হয়েছে। মেয়ের থেকে বিদায় নেবার সময় বললেন—শরীরটা ভাল নয়। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আজ যদি আমার একটি পুত্রসন্তান থাকত, তবে হয়ত এই সময় সব সামলে নিত।
লীলাকুমারী কিছু বললেন না। কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
তিনদিন পর গোটা রাজ্য জুড়ে যেন ঝড় বয়ে গেল।
বিদ্রোহ দমিত, রাজ্য শান্ত, কিন্তু রাজা ফেরেন নি। বয়সের ভারে ক্লান্ত শরীর এত উত্তেজনা এত ধকল নিতে পারে নি। সৎকারের আগে রাজবৈদ্য মৃতদেহের শরীরে কিছু অস্বাভাবিক চিহ্ন দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিশেষ করে নীলচে ঠোঁট ও বিস্ফারিত চোখের মণি। কিন্তু লীলাকুমারী সেসব বুড়োবদ্যির চোখের ভুল ও বয়সকালের ভীমরতি বলে উড়িয়ে দিলেন।
দেখলি বেঙ্গি, দেখলি? এ রাজ্যের লোকজন কেমন বেয়াক্কেলে দেখলি? শেষকালে সিংহাসনে বসাল সেই কাঠুরের ব্যাটা লকড়হারা ফেকলুরামকে!
তো কী করবে? তোকে বসাবে?
ইয়ার্কি না; আর কেউ ছিল না?
আরে, অপুত্রক রাজা। একমাত্র কন্যাটি আদরিণী। তাই ফেকলু হল ঘরজামাই। মহারাজ নিজেই তো একসময় মেয়েজামাইয়ের হাতে রাজ্যপাট সঁপে দিয়ে বানপ্রস্থে যেতে চেয়েছিলেন, তবে?
তাহলে ভালই হল বলছিস?
দেখা যাক, বাকি ভালমন্দ সময় বলবে।
ফেকলুরাম। নামটা বড্ড হালকা। মানে যে মহা ফালতু অথবা যে বড় বড় ডিং হাঁকে, চাল মারে। চালবাজ তো আর সিংহাসনে বসা রাজার নাম হতে পারে না, তাই রাজপুরোহিত পাঁজিপুঁথি ঘেঁটে গণনা করে জানালেন নাম হবে ‘রাজা ফোকলোয়া।’
এখন এই রাজ্যের নতুন রাজা হলেন জামাইরাজা--‘রাজা ফোকলোয়া।’
দরবারে উনি একা নন, সঙ্গে বসেন রাণী লীলাকুমারী। ওঁদের যুগলে দেখে প্রজারাও বিগলিত।
দেখ গা, বিলকুল রামসীতা জইসন লাগথে?
হহৌ হহৌ, বরোবর!
নতুন রাজা কিছু কিছু নতুন নিয়ম করেছেন। যেমন বিদূষকের ভাঁড়ামো ওঁর পছন্দ নয়। এইসব হালকা ঠাট্টা তামাশায় মেতেই তো গোটা রাজ্য উচ্ছন্নে গেছে। ওসব চলবে না।তাই বিটলে বামুনকে বিদেয় করে দেওয়া হল।
কোথায়? জিজ্ঞেস করতে নেই।
রাণীমার গান-টান পছন্দ নয়। আরে লোকজন খালি গান বাঁধবে গান গাইবে তো কাজ করবে কখন?
কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন? দাঁড়াও বাপু, এদিক ওদিক ভাল করে দেখে নিই। সেই যে বলে না--দেয়ালেরও কান আছে?
হ্যাঁ, সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল দরবারে কোন নালিশ নিয়ে আসা চলবে না।
মানে? তাহলে প্রজারা ওদের দুঃখের কথা বলতে যাবে কোথায়? কার কাছে ফরিয়াদ করবে?
কেন? ওরা যাবে ওদের গাঁয়ের মোড়ল-মোকর্দম-পটেল-গুণাইত বা কোতোয়ারের কাছে।
সেখানে সুরাহা না হলে?
আরে, জেলায় যত রাজকর্মচারি আছে তাদের কাছে।
সেখানেও সমিস্যের নিদান না পেলে?
তখন ভগবানের কাছে। আ মোলো যা! দেখিস নি, নতুন রাজ্যে এমন ভাল ব্যবস্থা যে আজ অবধি কেউ নালিশ জানাতে গিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসে নি।
ফলে দরবারে রোজ রোজ বাজে লোকের ঘ্যানঘ্যানানি নেই। তাই রাজা-মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্য সবার হাতে অঢেল সময়। ওঁরা সেই সময়ে দেশের উন্নয়নের জন্যে মাথা ঘামিয়ে অনেক ভালো ভালো নতুন নতুন চিন্তা করছেন।
আর রাজার সেই সব ইয়ারদোস্ত? সেই ছোটকি ছুরি গাঁয়ের ছেলেগুলো?
আরে ওরাই তো এখন জেলায় জেলায় রাজকর্মচারি, শান্তিরক্ষার দায়িত্বে আছে।
রাজ্যে শান্তি ফিরেছে।
তাই সকালে কাক-চিল ওড়ে আর সন্ধেয় শেয়াল ডাকে।
কিন্তু একটা গান, মাত্তর কয়েক কলি, ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। লোকে গুনগুন করছেঃ
‘জঙ্গল জঙ্গল ঘুম কে দেখা,
বস্তি বস্তি ঘুমকে দেখা।
হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়।’
রাজা মাঝে মাঝেই মৃগয়ায় বেরিয়ে পড়েন। তবে আগের মত ইয়ারদোস্তের সঙ্গে নয়। দেহরক্ষী বাহিনী ও রাণী লীলাকুমারী সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। আজকাল জঙ্গলের ধারে শিবির করে রাত কাটানোর কথা শুনলেই লীলাকুমারী কেন জানি অস্থির হয়ে পড়েন। রাজা ফোকলোয়াকে একলা ছাড়তেই চান না।
এমনি এক বকুলফুলের গন্ধে ম’ম করা শ্রাবণরাতে শিবির পড়েছে কোসগাই পাহাড়ের কাছে, ছোটকি ছুরি গাঁয়ের পাশের জঙ্গলের ধারে।
সন্ধেয় শ্রীকমল চালের ভাত আর হরিণের মাংস খেয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে। কাল সকালে রাণীমা পুজো দিতে যাবেন কোসগাই পাহাড়ের উপর দেবীর থানে।
রাত্তির দো-পহর, শেয়াল ডেকে উঠল। প্রহরী ঘুমে ঢুলছে। রাজা ফোকলোয়ার চোখে ঘুম নেই। পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন।
বনের দিকে এগিয়ে চলেছেন রাজা।
না, ভুল হবার কথা নয়। এই তো সেই পায়ে-চলা পথ, যেখান দিয়ে কাঠুরের দল জঙ্গলে ঢোকে কাঠ কাটতে।
এই তো সেদিন, মাত্তর দু-আড়াই বছর আগের কথা। তখন উনি ছিলেন পাশের গাঁয়ের গোবিনরাম কাঠুরের ব্যাটা ফেলুরাম। এত তাড়াতাড়ি ভোলার তো কথা নয়! এই পথ দিয়েই তো—
সেই নিকষকালো রাত, ঠিক আজকের মত। রাক্ষস-রাক্ষসী; এক পায়ের মল। সেই মল থেকেই তো দিন ফিরল। আজ উনি রাজা। উত্তেজনায় বুকে হাতুড়ির বাড়ি।
ব্যস, এই শিমূলগাছটা পেরোলেই আসল জঙ্গল শুরু।
পেছনে পায়ের শব্দ।
ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন রাজা, হাতে খোলা তলোয়ার।
--এ কী, মহারাণী তুমি? কী চাও? আমার পেছনে পেছনে কেন?
চাপা হাসির আওয়াজ।
--তুমি যে জন্যে মাঝরাতে গহন বনে ঢুকছ!
--তুমি জানো আমি কি চাই?
--আমি তোমাকে খোলা পুঁথির মত পড়তে পারি রাজন। তুমি চাও সেই মলজোড়ার আরেকটি, নইলে তোমার ঘুম হচ্ছে না।
--ঠিক ধরেছ গো! দেখ, এই একটি মল আমাকে কাঠুরে থেকে রাজা করেছে। জোড়ার অন্যটি পেলে কী যে হবে--!
--একটু ভুল হচ্ছে তোমার ফোকলোয়া। মল নয়, তোমায় রাজা করেছি আমি। তোমার কাঠুরে বুদ্ধিতে চললে--। ওই মল তো এখন আমার পায়ে। এর বাকি জোড়াটি পেলে আমাকেই দেবে। অন্য পায়ে বেশ মানাবে। আজ অবধি আমার অবাধ্য হও নি, আজকেও হয়ো না।
রাণী এবার তাকালেন রাজার দিকে, এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে, সেই দৃষ্টি যা একসময় বৃদ্ধ মহারাজ দেখেছিলেন রাজপ্রাসাদে, লীলাকুমারীর চোখে। দেখেছিলেন আর শিউরে উঠেছিলেন।
ফোকলোয়া চোখ নামিয়ে নিলেন।
--বেশ, চল। কিন্তু এতে বিপদ আছে।
--তুমি তো জান আমি বিপদ নিয়ে খেলতে ভালবাসি, নইলে তোমায় বিয়ে করতুম না। আমিও তো তলোয়ার ধরতে জানি। আর ওরা দু’জন, সে ভেবেই বলা।
শিমূলগাছের বাঁক ওঁরা অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছেন। জঙ্গল এখন গভীর। হাওয়া নেই। সেই কৃষ্ণপক্ষের রাত। রাজা ফোকলোয়া ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনায় ভুগছেন। তলোয়ারের বাঁটে চেপে বসেছে হাতের আঙুল। অন্ধকার বটে! এবার লীলাকুমারী নিজের মেখলার আড়াল থেকে বের করে ফেলেছেন সেই মায়াবী মলের একটি। তার দীপ্তিতে পথ দেখে ওঁরা এগিয়ে চলেছেন। কোথায় সেই কোসম গাছ? আর রাক্ষস দম্পতি? বেঁচে আছে? ওরা যদি মরে হেজে গিয়ে থাকে তবে জোড়ার বাকি মলটা? সেটা এখন কার কাছে?
আচমকা একটা দমকা হাওয়ার বেগ, নড়ে উঠল গাছের পাতা। তারপর একটা বোটকা গন্ধ। কাছে, বেশ কাছে। আর শুকনো পাতা খড়মড়িয়ে উঠল। আসছে, কেউ আসছে। এলোমেলো জোড়া পদক্ষেপ।
ফোকলোয়া ফিসফিস করে বললেন—হাঁটু গেড়ে বস। ওরা যেই ঝাঁপ দেবে আমরা কোমর লক্ষ্য করে চালিয়ে দেব, তাতেই কাজ হবে।
পায়ের শব্দ থেমে গেল।
খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফোকলোয়ার হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে যাবে।
আবার পায়ের শব্দ।
কিন্তু এ কী? পিছিয়ে যাচ্ছে কেন? দূরে সরে যাচ্ছে? টের পেয়েছে? পালাচ্ছে?
হতাশ লীলাকুমারী ধাওয়া করার উপক্রম করতেই রাজা ওর হাত চেপে ধরেছেন।
না; দু’জোড়া পায়ের আওয়াজ, আলাদা আলাদা। এবার আওয়াজ আলাদা দুটো দিক থেকে আসছে।
রাণী বুঝতে পারলেন। ওরা গাছটাকে বেড় দিয়ে দু’দিক থেকে চুপিচুপি এগিয়ে আসছে। হামলা হবে অতর্কিতে, দুপাশ দিয়ে।
এরাও প্রস্তুত হলেন। বসেছেন উবু হয়ে এক হাঁটু মাটিতে ঠেকিয়ে। পিঠে পিঠ বিপরীত মুখ, দুজনেরই শক্ত মুঠোয় শাণিত তরবারি।
আচমকা আক্রমণ। খিলখিল হাসির সঙ্গে দু’পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাক্ষস ও রাক্ষসী। সঙ্গে চলল তলোয়ার। ওরা লাফিয়ে এড়িয়ে গেল। বেড়ে গেছে হাসির তোড়।
ফাটা বাঁশের মত আওয়াজে রাক্ষসী বলছে—আয়, আয়। এবার খেলা দেখবি, মজা টের পাবি। নেংচে নেংচে এগিয়ে আসছে রাক্ষসী, ঝাঁপ দিল। এবার দুজনেই একটু দেরি করে হাত চালালেন।
লেগেছে! লেগেছে! তরোয়ালের কোপ লেগেছে রাক্ষস রাক্ষসীর পায়ে।
আবার! আবার! কিন্তু রক্ত কই? ফিনকি দিয়ে কালচে রক্ত বেরোল কই?
এই আঘাত কি যথেষ্ট নয়?
শেষ চেষ্টা। দুজনে মরিয়া হয়ে প্রাণপণে তলোয়ার ঘোরালেন। কিন্তু তলোয়ার হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল।
কোথায় রাক্ষস রাক্ষসীর জোড়া?
হাউইয়ের মত আলোকরেখা মিলিয়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। শোনা গেল আকাশবাণীঃ
--অনেক অনেক ধন্যবাদ রে! তোদের জন্যে কতদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম! কত দিন! কত মাস! কত বছর? আজ আমরা শাপমুক্ত হলাম। এবার তোদের পালা। অপেক্ষায় থাক, যতদিন না তোদের থেকেও লোভী, নীচ, বেইমান, খুনে জোড়া এসে তোদের দায় নিয়ে নেয়।
অবাক কাণ্ড। হতভম্ব লীলাকুমারী দেখলেন রাজা ফোকলোয়ার চামড়া কুঁকড়ে যাচ্ছে, গায়ের লোম পোশাক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কাঁটার মত।
এ কী রাজন! তোমার চোখ, তোমার শণের মত চুল আর ছুঁচলো দাঁতের পাটি? তোমাকে চিনতে পারছি নে, তোমার দিকে তাকাতে পারছি নে! এ কী রূপ তোমার?
লীলাকুমারীর গলা চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে—রাজা! রাজা ফোকলোয়া!
কিন্তু এই ভাঙা ভাঙা খোনা খোনা আওয়াজ? এ কার কন্ঠস্বর? লীলাকুমারীর?
হেসে ওঠে রাজা। সব হারানোর হাসি।
--সখি, নিজের দিকে তাকাও একবার। তুমি আমি যে রাজযোটক। তবু মলটা যদি পেতাম!
আবার আকাশবাণীঃ
এই নে, এই নে সেই মল।
আকাশ থেকে উল্কার মত নেমে আসছে এক আলোর টুকরো—তীব্রবেগে পাক খেতে খেতে। মাটি ছোঁয়ার আগে সেই আলোকবৃত্ত এক আশ্চর্য মল হয়ে জড়িয়ে যায় লীলাকুমারীর পায়ে।
আনন্দে নেচে ওঠে সে, রাজার হাত ধরে দুটো পাক খেয়ে নেয়।
না, আফশোস করে লাভ নেই। এই অরণ্যে গড়ে তুলতে হবে নতুন রাজ্য। সে হবে এক শক্তিশালী রাক্ষসরাজ। রোজ সূয্যি ডুবলে শেয়াল ও হায়নার হাসিতে মুখরিত হবে রাজার দরবার।
হুক্কা হুয়া! হুক্কা হুয়া!
রাজা ফোকলোয়া! ফোকলোয়া!
(শেষ)