দিবাকর মা-কে আদর করে ডাকে বুড়ি। স্নেহময়ীর এত্তেলা শুনে সদ্য ত্রিশ পার হওয়া দিবাকর ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলল, কেন বুড়ি, সুখে আছ সেটা ভালো লাগছে না?
—খুব সুখে আছি তাই না? এই বয়েসেও এ বেলা ও বেলা আমাকে রান্না করতে হয়। চাই না এমন সুখ। তোকে যা বললাম তাই কর। স্নেহময়ী স্নেহটা আড়ালে রেখে বলেন কথাগুলো।
—ঠিক আছে আমি তোমার জন্য একজন ভালো রান্না করার লোক দেখে দিচ্ছি। তুমি খুশি তো? দিবাকর কৌতুক করে বলে।
—তুই ভালোই বুঝেছিস আমি কী বলতে চেয়েছি। সব সময় তোর এই ঘুরিয়ে কথা বলা বন্ধ কর। স্নেহময়ী ধমক দেন।
—তুমি কি ভাবলে ঘরে বউ এলে তোমাকে রান্না করে খাওয়াবে। সে গুড়ে বালি। তখন দেখবে বুড়ি, তোমাকে আরও একজনের রান্না বেশি করতে হচ্ছে। দিবাকর মুচকি হেসে বলে।
—সে হোক। সেটা তোকে দেখতে হবে না। মরার আগে অন্তত তোর সংসারটা আমি দেখে যেতে চাই। স্নেহময়ীর গলা ভারি হয়ে আসে কথা বলতে বলতে।
মা’র মুখে এই “মৃত্যু”র কথা শুনলে দিবাকরের মন খারাপ হয়ে যায়। শৈশব থেকে পিতৃহীন দিবাকরের কাছে ওর মা-ই সব। দিবাকর দু’হাত দিয়ে তার “বুড়ি”কে জড়িয়ে ধরে বলল, ঠিক আছে, তোমার যা ভালো মনে হয় তাই কর। তবে পাত্রী দেখতে কিন্তু তোমাকে যেতে হবে।
—তুই সঙ্গে যাবি তো? স্নেহময়ী আরও নিশ্চিন্ত হবার জন্যে প্রশ্নটা করেন।
—হ্যাঁ, যাব।
মা আর এক বিধবা পিসিকে নিয়ে বালিঘাট স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিট পায়ে হাঁটা দূরত্বে দিবাকরের একতলা বাড়িটা পাড়ার আরও অনেক গল্প, উপন্যাসের পাশে মলাটহীন ছোট গল্প সেজে ভালোই দিন কাটাচ্ছিল। এখন সেই ছোট গল্পটার, বোঝাই যাচ্ছে, একটা মলাট চাই, নইলে আর চলছে না। অতএব ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যেও দিবাকরের একটা কাজ বেড়েছে। অফিসিয়াল ট্যুর থেকে বাড়ি ফিরে সময়-সুযোগ পেলেই তাকে স্নেহময়ীর সঙ্গে যেতে হয় পাত্রী দর্শনে। অনেকগুলো পাত্রী দেখার পরও কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় ব্যাপারটা শেষে এমন বিরক্তিকর পর্যায় পৌঁছে যায় যে, স্নেহময়ী দিবাকরকে সটান বলে দেন, তোমার বউ তুমি নিজেই খুঁজে নাও বাপু।
সেই “নিজেই” মলাটের খোঁজ করতে করতে একদিন দিবাকর পৌঁছে যায় বন্যার কাছে। এর মাঝে অবশ্যই দিবাকর বেশ কিছু নদী-নালা, ষ্টেশন, ফেরিঘাটের দর্শন পেয়েছে নিজস্ব নিয়মে। কিন্তু দিবাকর কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না ইদানিং তার স্বপ্নে উঁকি দিয়ে যাওয়া সেই রাতের ট্রেনটাকে, যে ট্রেনের কামরা জোড়া হালকা নীলাভ আলো, বাইরের আধো-অন্ধকারে সরে সরে যাওয়া গাছপালার ভিড়, যা কিনা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে মাঝে-মাঝেই বলে যায়, তোমার সঙ্গে দেখা হবে এক প্রকৃত ফাল্গুনের রাতে।
বন্যার সাথে আলাপ হওয়ার পর দিবাকরের মনে হয়, এ সেই সহযাত্রী যাকে সঙ্গে নিয়ে সে রাতের পর রাত হেঁটে বেড়াতে পারবে স্বপ্নে দেখা সেই ট্রেনের করিডরে।
ট্রাম কন্ডাকটর সত্যেন ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী সাধারণ গৃহবধূ সুনীতা তাঁদের মেয়ে বন্যাকে একদম ছোটবেলা থেকেই প্রচুর কষ্ট করে নামী স্কুলে পড়িয়েছেন। আজ বন্যা কলকাতার একটা নামী কলেজে ফিজিক্স অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনায় অসম্ভব ভালো মেয়েটি সময়-সুযোগ পেলেই কফি হাউসে একবার চক্কর কেটে আসতে ভালোবাসে। সেই কফি হাউসেই বন্ধুর বন্ধু হিসেবে বন্যার পরিচয় হয় দিবাকরের সঙ্গে। প্রথম দিনই দিবাকরের কথা-বার্তা বন্যার ভালো লেগে যায়। উপরন্তু প্রাক্তন ফিজিক্স অনার্স মেধাবী ছাত্র দিবাকরের থেকে পড়াশোনার কিছু টিপস পাওয়া যেতে পারে এ ভাবনাটাও ওদের প্রেমের পথটা প্রশস্ত করে দিয়েছিল।
বন্যার সঙ্গে ক’দিন কাটানোর পরেই দিবাকর এই প্রথম নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অন্য একটা অস্বস্তির খোঁজ পায়। দিবাকর টের পেতে শুরু করে যে, সে ক্রমশ শারীরিক হয়ে ঊঠছে অথবা হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। অথচ ক’দিন আগেও তো তার কাছে ব্যাপারটা এমন ছিল না! সে তো ভেবেছিল যে, তার যা কিছু সঙ্গত, তা পবিত্রে তুলে রাখা আছে কেবল প্রিয় এক রাতের ট্রেনের জন্য। দিবাকর মরীয়া চেষ্টা করে আগের মতোই শরীর সম্বন্ধে নিরুত্তাপ, উদাসীন থাকার। কিন্তু সে বুঝতে পারে যে, বন্যার কাছাকাছি হলেই তার যাবতীয় প্রচেষ্টা হেরে যাচ্ছে শারীরিক আগ্রাসনের কাছে। সে বুঝতে পারে, হঠাৎ করে জেগে ওঠা ক্ষুধার্ত শরীর তার এতদিনের মূল্যবোধকে ক্রমশ হারিয়ে দিচ্ছে।
সেদিন গঙ্গার ধারে বন্যার কাঁধে দিবাকরের হাত। দিবাকর মোহগ্রস্থের মতো বন্যার আরও ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছে, বন্যা সন্তর্পণে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে বারবার। শরীরে ঝড়ের শব্দ, বুকে ধ্বংসের ডাক, দিবাকর আর থাকতে না পেরে বন্যাকে বলেই ফেলল, দেখেছ, এই বসন্তেও শীতকাল কেমন হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়েছে আমাদের শরীরে।
—এ কথা কেন বলছ? বন্যা নিজের পায়ের নখের দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল।
—দূরে নৌকাগুলোকে দেখছ না কেমন উদোম উড়ে চলেছে দৃষ্টি থেকে দৃষ্টির বাইরে। দিবাকর হালকা ছুঁড়ে দিল কথাটা।
—তাতে কী হলো?
—আমরা দেখ কেমন কাঁধে হাত মেহমান ষ্টেশনে পাশাপাশি বসে কৃষ্ণচূড়ার কথা ভুলে যাচ্ছি। দিবাকরের গলা বেয়ে আবেগ ঝরে পড়ে।
—কী করতে চাও তুমি? বন্যার স্পষ্ট প্রশ্ন।
—আমি চাই এ দেশের দীর্ঘতম নদীর কোল ঘেঁষে এ বসন্ত ফুটে থাকুক কৃষ্ণচূড়ার দিন হয়ে।
—তোমার হেঁয়ালির আড়ালে থাকা কথাগুলোর অর্থ আমি বেশ বুঝতে পারছি। তবে কিনা অভিজ্ঞতা বলছে, বসন্ত পেরিয়ে গেলে কৃষ্ণচূড়ার কথা মনে রাখে শুধু কিছু কবি। আফশোস্, তুমি কবি নও। বন্যা এবারের কথাগুলো বলল দিবাকরের চোখে চোখ রেখে।
বন্যার শেষের কথাগুলো দিবাকরকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে যে, সাঁঝবিলাসের আড়ালে থাকা আপাত নিরীহ ঘড়িটি প্রয়োজনে বেজে উঠতে জানে প্রচন্ড। অন্য কেউ হলে, এ সময়ে আলোচনার অভিমুখ বদলে দিত। কিন্তু দিবাকর হলো দিবাকর, যার ভাবনা-চিন্তা ঠিক সাধারণ রীতি-নীতি মেনে চলে না। সে দিব্যি বন্যার কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে গলায় অভিমান এনে বলে ফেলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার মূল্যবোধ নিয়ে থাক, আমি চললাম নিরুদ্দেশের পথে।
এ কথায় বন্যা একটুও বিচলিত না হয়ে বলল, তুমি যাচ্ছ যাও, কিন্তু ভেব না তোমার এই চলে যাওয়াতে অকালবৈশাখি এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই তটে।
বন্যার কাছ থেকে এমনতর কড়া জবাব পেয়ে দিবাকরের নিজেকে হঠাতই কেমন যেন মাস্তুলহীন জাহাজ মনে হতে থাকে। এত সহজে বন্যা তাকে এভাবে রুক্ষ পথে নামিয়ে দেবে, সেটা সে ভাবেনি। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে সে বন্যাকে বলল, তোমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে। আমি কি কাল সন্ধ্যার পর তোমার বাড়ি যেতে পারি?
দিবাকরের কথায় অন্য ইঙ্গিত পেয়ে বন্যা বলল, না, সন্ধ্যার পর নয়। তুমি কাল সকালে দশটার পর আসতে পারো। সে সময় বাড়িতে কেউ থাকবে না।
বন্যার এবারের উত্তর শুনে দিবাকর আবার ঘেঁটে যায়। অমন সবল প্রত্যাখানের পর এই সাদর আমন্ত্রণ তার বোধবুদ্ধিকে বেশ বেতাল করে দিয়ে যায়। সে বলে, ঠিক আছে, কাল সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ তোমার বাড়ি পৌঁছে যাব।
দিবাকর পরদিন ঠিক সময়ে পৌঁছে যায় বন্যাদের বাড়ি। সত্যিই বাড়িতে কেউ নেই। এমনকি বন্যাও নেই। হতভম্ব দিবাকর বন্যাদের বাড়ির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে জীর্ণ সে বাড়ি তার দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে।
বন্যার এই অভিনব প্রত্যাখ্যান প্রক্রিয়ায় দিবাকর বেশ অবাক হয়ে যায়। খুব ঠান্ডা মাথায় সে ভেবে দেখে যে, এমন প্রত্যাখ্যানের পর বন্যার কাছে ফিরে যাওয়াটা বেশ অপমানজনক। এবং ঘটনাটা দিবাকরকে আরও জেদি ও একরোখা তৈরি করে দেয়। তার মনে হয়, বন্যাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, সে আসলে “কী হারাইল”। ফলশ্রুতি, কিছুদিনের মধ্যেই লোকাল ট্রেন ছেড়ে দিবাকর এবার দূরপাল্লার গাড়ি রাজধানী এক্সপ্রেসের যাত্রী।
দিবাকরের সঙ্গে অন্তরার দেখা হওয়ার ঘটনাটাও বেশ চমকপ্রদ। দিবাকর যে জিনিসটা বিক্রি করার জন্য দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ে বেড়ায় তার পোশাকী নাম “সাউন্ড লেভেল মিটার”। গোদা বাংলায় শব্দ মাপার যন্ত্র। উত্তর দিল্লীর এক অফিসে সেদিন দিবাকর তার মেসিনের ডেমনস্ট্রেশন দিতে দিতে বোঝাচ্ছিল যে, একই অঞ্চলে দিনের পর দিন ৭০ থেকে ৮০ ডেসিবল শব্দের মাত্রা কীভাবে মানুষ-জনকে এক সময় বধির করে দিতে পারে। সঙ্গে ভয় দেখানো কথা, শব্দের মাত্রা যদি ১৪০ ডেসিবলের বেশি হয় তো একেবারে “ইনস্ট্যান্ট কালা”। অফিসের সবাই বেশ মনযোগ দিয়ে শুনছিল। হঠাতই ছন্দপতন। ল্যাপটপের আড়াল থেকে জনৈক সুন্দরী পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, আপনার মেসিন দিয়ে হয়ত শব্দ মাপা যাবে, কিন্তু এই শব্দদূষণ পুরোপুরি নির্মূল করা যায় কী করে, সে-ব্যাপারে আপনার বক্তব্যটা জানতে পারলে আরও ভালো হত।
দিবাকর প্রথমে বেশ হকচকিয়ে যায় কথাগুলো শুনে। তারপরেই তার মনে হয়, বাঙালি যখন, ঠিক সামলে নেওয়া যাবে। তার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে যে, রাজ্যের বাইরে বাঙালিই বাঙালির সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়। তারপর আশেপাশের সবার জন্য প্রথমে “উড়ে আসা” প্রশ্নটা হিন্দীতে অনুবাদ করে সে হিন্দীতে যে উত্তর দেয়, সেটা বাংলা করলে দাঁড়ায় - আসলে শব্দের এই উৎপাত বন্ধ করার জন্য আগে সেই জায়গাগুলো নির্দিষ্ট করতে হবে যেখানে শব্দদূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। কলকাতায় সিধু-কানু ডহর, যাকে আজও কেউ কেউ মজা করে ডাকেন ধর্মঘট স্ট্রীট নামে, ওখানে আজ বন্ধ করা গেছে রাজনৈতিক দলের মিটিঙ। কারণ সেই শব্দদূষণ। এক সময় দিনের পর দিন ওখানে জোরে জোরে মাইক বাজিয়ে মিটিঙের পর মিটিঙ হত। ব্যাপারটা অজান্তেই বহু লোকের বধিরত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এভাবেই কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের সামনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে শব্দদূষণ অনেকটাই রোধ করা গেছে। তবে ম্যাডামের সঙ্গে আমি একমত যে, আমরা নিজেরা উদ্যোগী না হলে এ ব্যাপারে কিছু করা মুশকিল।
এবার ল্যাপটপের আড়াল থেকে আবারও বাংলায় উত্তর এল। বক্তৃতাটা ভালোই করেন দেখছি। বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম অন্তরা। আর হ্যাঁ, চালিয়ে যান। আমি আর ডিস্টার্ব করছি না।
অন্তরা কথা রেখেছিল। সে আর ডিস্টার্ব করেনি। বরং অন্তরাদের অফিস তাদের ফ্যাক্টরির জন্য যে দু’টো “সাউন্ড লেভেল মিটার” কিনেছিল, দিবাকর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে, এর পিছনে অন্তরার হাত আছে।
খবরটা জানার পর থেকে দিবাকরের হঠাতই মনে হতে থাকে যে, অন্তরাই সেই সহযাত্রী, যাকে নিয়ে তার স্বপ্নের ট্রেনে চেপে বসা যায়।
এরপর এক দুপুরে অন্তরার উল্টোদিকে রাখা চেয়ারে নিজেকে বিছিয়ে দিয়ে দিবাকর খুব সাধারণ গলায় বলে, অন্তরা, হ্যাঁ, আপনাকে...সরি...তোমাকে অন্তরা বলেই ডাকি।
—ঠিক আছে। অন্তরা তার ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দেয়।
—না, মানে আজ সন্ধ্যাটা কি আমরা চাঁদনী চকের কোনও ভালো দোকানে বিরিয়ানি দিয়ে সেলিব্রেট করতে পারি? দিবাকর থেমে থেমে বলেই ফেলে মনের কথা।
—আমাকে ঘুষ দিতে চাইছেন? অন্তরার নিস্পৃহ গলার স্পষ্ট উচ্চারণ।
—কী যে বলো না। তেমন কোনও ব্যাপার নয়। জাস্ট বন্ধুত্বটা একটু বাড়িয়ে নেওয়া আর কী!
—যে বন্ধুত্ব গড়েই উঠলো না, সেটা বাড়ার কথা আসছে কোথা থেকে - আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে বলে অন্তরা।
দিবাকর এমন ভিজে মাঠ প্রত্যাশা করেনি। অন্তরার উত্তর শুনে সে টের পায় যে, এ মাঠ বড় পিছল। বড় বড় খেলোয়াড়দেরও আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অবস্থা সামলানোর জন্যে সে বলে, ঠিক আছে থাক। সত্যি, আমরা তো বন্ধু নই। তবে কীসের অধিকারে তোমাকে নিয়ে...
দিবাকরের কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্তরা ঠোঁটে একটা আলতো হাসি ঝুলিয়ে বলে, ভালোই তো সেন্টু খাওয়াতে জানেন দেখছি।
—না ঠিক তা নয়। দিবাকর কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলে ফেলে কথাটা।
—ঠিক আছে, ধরা যাক, আজ আপনার কথামতো আমরা আজকের সন্ধ্যাটা বিরিয়ানি দিয়ে সেলিব্রেট করলাম। কিন্তু তারপর?
—তারপর আবার কী। আমরা যে যার বাড়িতে ফিরে যাব। দিবাকর খুব সরলভাবে বলে কথাগুলো।
—ব্যাপারটা অত সরল হলে কোনও কথা ছিল না। কিন্তু আমি জানি এরপর আপনি আরও দু’চার দিন এদিক-সেদিক যাওয়ার অফার দেবেন আর হঠাতই একদিন আমাকে বলবেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি...
অন্তরার কথা শেষ হবার আগেই দিবাকর খুব আবেগী গলায় বলে, নাহ্, আমি তোমাকে ভালোবাসি আমি বলব না। আমি এখনই এখানেই বলতে চাই যে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি রাজি?
অন্তরা এমন গোলাপী বিস্ফোরণের জন্যে আদৌ তৈরি ছিল না। হতবাক সে এরপর বেশ ঝাঁঝাঁলো গলায় বলে, আমার সম্বন্ধে কিছুই জানলেন না, শুনলেন না, দুম করে বলে দিলেন, আমাকে বিয়ে করবেন। বিয়ে কি ছেলেখেলা নাকি? অবশ্য ব্যাপারটা আপনার কাছে ছেলেখেলা হলেও হতে পারে। যাক গে আমি এ নিয়ে আর একটাও কথা বলতে চাই না আর আপনার সঙ্গে বিরিয়ানি খেতেও যেতে পারছি না। আপনি এবার আসতে পারেন।
দিবাকর কি এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল? নইলে সে কেন এক টুকরো সাদা কাগজে নিজের মোবাইল নাম্বারটা লিখে অন্তরার টেবিলে রেখে বলবে, আমার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে গেলাম। নিশ্চিত জেনো, তুমি আমার ভুল মূল্যায়ন করেছ। আমার থাকার বলতে আছে শুধু মা আর এক পিসিমা। আমার মায়ের ইচ্ছা এই যে, আমি আমার পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করে ঘরে বউ করে আনি। তোমাকে দেখে মনে হয়েছিল...থাক সে কথা। যদি কখনও মত বদলাও, আমাকে এই নাম্বারে ফোন কোরো, আমি অপেক্ষায় থাকব।
অন্তরার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে দিবাকর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে টেবিলে রাখা কাগজের টুকরোতে রাখা নাম্বারটা এরপর উঠে আসে অন্তরার মোবাইল ফোনে।
ঠিক এক সপ্তাহ বাদে এলো অন্তরার ফোন। দিবাকর যেন জানতই যে, ফোন আসবে। ফোনের উল্টোদিকে “আমি অন্তরা” শুনে সে বেশ ক্যাজুয়ালি বলল, আরে অন্তরা যে! কেমন আছ বলো?
—আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
—আমিও ভালো।
—দিল্লীতে এবার আর কতদিন আছেন? মানে কলকাতায় ফিরছেন কবে?
—এই দফায় আর দিন সাতেক আছি। কলকাতা ফিরেই আবার দিন দশেকের মধ্যে আবার ফেরৎ আসতে হবে এই দিল্লীতেই। এইসব দৌড়-ঝাঁপের মধ্যে আমি কলকাতা না দিল্লীর সেটাই ভুলে যাচ্ছি। দিবাকর মজা করে বলে।
—হা, হা, হা, আপনি বেশ মজার-মজার কথা বলতে পারেন তো।
—আমার এত কষ্ট, আর এর মধ্যে তুমি মজা দেখলে অন্তরা? খারাপ, খুব খারাপ। দিবাকর আবারও মজা করে বলে।
—ঠিক আছে, এমনটা আর বলব না। এবার আসল কথায় আসি। এর মধ্যে আমাকে একদিন সময় দিতে পারবেন? আপনার সঙ্গে দেখা করে কিছু কথা বলার ছিল।
—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারব। ক’বে দেখা করতে চাও বলো? দিবাকর দ্রুত উত্তর দেয়।
—আপনি আমার বাড়িতে আসতে পারবেন?
—কোথায় তোমার বাড়ি?
—তিমারপুর। আপনি চেনেন তিমারপুর? অন্তরা গলায় আর্তি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল।
—না, চিনি না। কীভাবে ওখানে যাওয়া যাবে বলো।
—আপনি কাশ্মীরি গেট থেকে একটা অটো নিয়ে তিমারপুর বাস স্ট্যান্ডে চলে আসুন। তারপর আমি আপনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব।
—ঠিক আছে, সমস্যা নেই।
—আপনি কি কাল আসতে পারবেন? বিকেল চারটে নাগাদ আসলে অসুবিধা হবে?
—কোনও অসুবিধা নেই। আমি কাল তিমারপুর বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে তোমাকে একটা ফোন করব। তুমি এসে নিয়ে যেও তোমার বাড়ি। দিবাকর নিশ্চিন্ত করে অন্তরাকে।
—ঠিক আছে, ওই কথাই রইল তবে। অন্তরা ফোন কেটে দিল।
পরদিন দিবাকর ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল তিমারপুর। বাস স্ট্যান্ড থেকে অন্তরাদের বাড়ি মিনিট তিনেকের পথ। অন্তরারা যেখানে থাকে সেই তিমারপুর কো-অপারেটিভের আবাসনে ঢুকে দিবাকর অবাক হয়ে গেল। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। দিবাকর ভাবে অন্তরার ডাকে তিমারপুর না এলে সে জানতেও পারত না যে, অমন রুক্ষ চেহারার রাজধানীর বুকে সবুজ বুকে নিয়ে এমন একটা জায়গা এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় গাছ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, খেলার মাঠ, ছোটদের পার্ক সব এক জায়গায় জড় হয়ে দিবাকরের অনুভূতিতে একে একে টোকা মেরে গেল। প্রকৃতির এই অনন্য প্রদর্শনের আঙিনায় দিবাকরের মন-মেজাজ নিজে থেকেই যেন বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল।
অন্তরাদের ছোট একতলা বাড়ি। ঘরে ঢুকেই অন্তরা তার বাবা দীপব্রত আর মা সন্ধ্যার সঙ্গে দিবাকরের পরিচয় করিয়ে দিল। দিবাকর বুঝতে পারছিল না যে, অন্তরা তার বাবা আর মাকে তার সম্বন্ধে ঠিক কী বলেছে, তাই সে একটু যেন সঙ্কুচিত বোধ করছিল। কিন্তু দীপব্রত আর সন্ধ্যা যে ভাবে ঘুরে ফিরে দিবাকরকে দেখছিলেন, এটা-ওটা প্রশ্ন করছিলেন তার চাকরি নিয়ে, তার সংসার নিয়ে, দিবাকরের মনে হচ্ছিল, ওঁরা বোধহয় “গোড়ার গল্প”টা জানেন।
নিয়ম মেনে চা-মিষ্টির পর্ব মিটে যাওয়ার পর অন্তরা তার বাবাকে “আমি দিবাকরবাবুকে আমাদের এলাকাটা একটু ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসি” বলে দিবাকরকে নিয়ে তখন বাইরের রাস্তায়। আবাসনের ভিতরের ঢালাই রাস্তার উপর দিয়ে অন্তরার গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দিবাকর হঠাৎ আবার “শারীরিক খিদে” ব্যাপারটা অনুভব করতে শুরু করল। দিবাকরের মনে হল, তাকে একটা অন্যরকম ঘোর ক্রমশ ঘিরে ধরছে। একই সঙ্গে তার এটাও মনে পড়ল যে, এই শারীরিক খিদে ব্যাপারটাই তাকে বন্যার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সে ভিতরে ভিতরে একটু যেন সংকুচিত বোধ করতে শুরু করল। ভাগ্য ভালো, ব্যাপারটা বেশিদূর এগোনের আগেই অন্তরা দিবাকরকে জিজ্ঞেস করল, আমার বাড়ির লোকজনকে কেমন লাগল?
—খুব ভালো। বাবা-মা আর এক মেয়ে - বেশ গোছানো আর সুখী সংসার তোমাদের। কথাগুলো বলতে গিয়ে দিবাকরের গলা যেন একটু কেঁপে গেল।
—হুম্ম্ম্, বাইরে থেকে দেখলে অমনটাই ভাবা স্বাভাবিক। দেখুন, আমি দীর্ঘ ভূমিকা না করে কয়েকটা কথা সরাসরি বলব বলেই আপনাকে ডেকে এনেছি।
—বলে ফেল। আমিও শোনবার জন্যে তৈরি।
—দেখুন, আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান। আমিই ওঁদের ছেলে আর আমিই ওঁদের মেয়ে। বাবা-মা দু’জনেরই যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। ওঁদের অবলম্বন বলতে আমি এবং আমি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাকে বিয়ে করা মানে সমস্যা অনেক। অন্তরা মাথা নিচু করে বলে।
—বুঝতে পারছি। দিবাকর গলা নামিয়ে বলে।
—পরিষ্কার বলে ফেলা ভালো যে, আমি বিয়ের পরেও চাকরি ছাড়তে পারব না, দিল্লী ছাড়তে পারব না। একইসঙ্গে সংসার চালানোর জন্যে বিয়ের পরেও আমাকে বাড়িতে কিছু পয়সা-কড়ি দিতে হবে। এবার বলুন, এতসব সমস্যার কথা জেনেও কি আপনি আমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী?
সাজানো প্যান্ডেলের পিছনে চটের ঘনঘটা দেখে দিবাকর প্রথমে কিছুটা থমকে যায়। তার মনে পড়ে বাড়িতে দুই “বুড়ি” ঘরে বউ আনবে বলে বসে আছে। সে বুঝতে পারে অন্তরা যদি দিল্লী ছাড়তে না পারে তো তাঁরা এ বিয়ে মন থেকে মেনে নেবেন না। একই সঙ্গে তার মনে হলো অন্তরার অমন সরল এবং বাস্তবমুখী স্বীকারোক্তি তো আসলে দিবাকরের ভালোর জন্যেই বলা আর সবচেয়ে বড় কথা সে নিজেও তো তার এই ব্যস্ত ফেরিওয়ালার জীবন টানতে গিয়ে বউকে তেমন সময় দিতে পারবে না। তার নিজেরও তো ক’দিন পরপরই অফিসিয়াল ট্যুর লেগেই আছে। দিবাকরের মনে হল, সে দিক থেকে ভাবলে এই বিয়েটা বোধহয় ভালোই হবে।
কিছুক্ষণ দু’পক্ষই চুপচাপ। এরপর নীরবতা ভেঙে দিবাকর দার্শনিকের মতো বলে ফেলে, তোমার বাস্তববোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু কিছু সত্যি কথা আমাকেও বলতে হবে, বলতেই হবে। দেখ, আমার বাড়িতে বুড়ি মা আর এক বুড়ি পিসি রোজই দিন গোনে, কবে ঘরে আসবে তাঁদের প্রিয় বউ। কিন্তু সেটাই সব নয়। আমি নিজেও অফিসের কাজে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়নোর ফাঁকে বাড়িতে খুব কম সময় দিতে পারি। বুড়ি মা আর পিসিকে না হয় আমি সব বুঝিয়ে বলব। অন্যদিকে তোমাকেও তেমনি মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে দিন কয়েকের জন্য থেকে আসতে হবে। কিন্তু আমার এই ফেরিওয়ালা জীবন তুমি মেনে নিতে পারবে তো?
—হ্যাঁ, পারব। অন্তরা খুব নিচু গলায় বলে।
—ভালো করে ভেবে বলো কিন্তু। মনে রেখ বিয়ের পর কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়ই এ পাড়ায় ঢাক, ও পাড়ায় কাঠি। দিবাকর মজা করে বলে।
—ধ্যাৎ, কি যে বলেন না।
—উঁহু, আর আপনি-আজ্ঞে নয়। এবার থেকে তুমি। মনে থাকে যেন।
কথা বলতে বলতে দিবাকর আবার সেই শরীরী অভিঘাতটা টের পেতে থাকে। তার খুব ইচ্ছে করে বন্যাকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। সে সময়ই বন্যা হঠাৎ বলে, চলুন... স্যরি, চলো তোমাকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছনোর পথে বার কয়েক অন্তরার নরম শরীর ছুঁয়ে গেল দিবাকরের ক্ষুধার্ত শরীরকে। দিবাকর মনে মনে নিজেকেই বলল, ওই বুঝি দেখা যায় ফাল্গুনের মুখ।
অন্তরার কাছ বিদায় নিয়ে আসার পরদিন থেকেই দিল্লীতে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হলো। চারদিকে প্রায় বন্যা পরিস্থিতি। দিবাকরের কেন জানি না ফের মনে পড়ল বন্যার কথা, মনে পড়ল তার প্রত্যাখ্যানের কথা। তার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, বন্যা, তুমি এখন কোথায়...
কলকাতায় ফিরে দিবাকর তার মা এবং পিসিকে বুঝিয়ে বলল সব কথা। প্রচুর তর্ক-বিতর্কের পর দিবাকরের “বুড়ি” মন থেকে সবটা মেনে নিতে না পারলেও, ছেলের সুখের কথা ভেবে তিনিও রাজি হয়ে গেলেন এ বিয়েতে। শর্ত একটাই, ফুলশয্যা হবে তাঁদের বালিঘাটের বাড়িতে এবং তারপর অন্তত পনের দিন অন্তরাকে এই বালিঘাটেই কাটিয়ে যেতে হবে। অন্তরা এবং তার পরিবার মেনে নিল এ শর্ত।
কয়েক দিন পর দিল্লীতে এসে ক’দিনের মধ্যেই ফুরফুরে দিবাকর বুঝতে পারল যে, অন্তরা আর যাই হোক, বন্যা নয়। আর মাসখানেক পরেই ওদের বিয়ে। সে কথা ভেবেই কিনা জানা নেই, দিবাকরকে এবার অন্তরা বেশ কয়েকটা সম্পূর্ণ দুপুর উপহার দিল। “প্রায়” সবকটা দুপুরেই দিবাকর নারকেল পাতার শিমশিম শব্দে এক দুরন্ত নদীর ফুলে-ফেঁপে ওঠা দেখেছিল, কান পেতে শুনেছিল জলের গভীরে লুকিয়ে থাকা আবেগের উচ্ছ্বাসশব্দ। আপাত নিষিদ্ধ বাতাবরণে প্রথম নারী-শরীর স্পর্শ দিবাকরকে এক অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শারীরিক আনন্দে ভেসে যেতে যেতেও কী আশ্চর্য, দিবাকরের মনের গভীরে বুদবুদের মতো ভেসে উঠতে লাগল তাদের আগত ফুলশয্যার রাতের কথা, তার স্বপ্নে দেখা রাতের ট্রেনের কথা। আসলে সে বিশ্বাস করে তার প্রকৃত উচ্ছ্বাস, নিবিড় রোমান্টিকতা সবই অনন্ত বাঁধা পড়ে আছে অন্ধকারের কড়ে আঙুলে।
দিবাকরের এই অন্ধকারপ্রীতি, রাতের ট্রেনপ্রীতির কথা শুনে অন্তরা এক দুপুরে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে দিবাকরের নাক টিপে দিয়ে আদুরে গলায় বলেছিল, তুমি দুপুরকানা। দিবাকর নিজের তর্জনীকে কলমের ভঙ্গিতে অন্তরার নাভিতে রেখে ফিসফিস করে উত্তর দিয়েছিল, দেখ, এই দুপুরে সব ভাসিয়ে দেবার পরেও কেমন চর জেগে আছে। মনে রেখ, চর আছে বলেই এখনও স্বপ্ন, এখনও অপেক্ষা। নইলে...
—নইলে কী? অন্তরার গলায় উদ্বেগ ধরা পড়েছিল সেদিন।
—নইলে বন্যায় ভেসে যাওয়া এক পুরন্ত দুপুর ডাঙার খোঁজ করতে করতেই হারিয়ে যেত আর অন্ধকারে কেঁদে মরত তার যাবতীয় অনুভূতির নিজস্ব আলপনা।
—সে অনুভূতি কি রাতের অন্ধকারেই বেশি সচল দিবাকর? অন্তরার গলাও খাদে নেমে এসেছিল।
—হ্যাঁ, অন্তরা। রাত মানে আমার কাছে অনুভবের খেলা, স্পর্শসুখের প্রকৃত খেলা।
—তাতে বাড়তি লাভ কিছু আছে নাকি? অন্তরা গলায় রোমান্টিকতা এনে কথাটা বলেছিল।
—আছে তো বটেই। স্বাভাবিক কথা যেখানে শেষ, সেখান থেকেই আসে কবিতা-ভাবনা। আর চোখ যেখানে কাজ করে না, সেখানে অনুভব তার অদেখা চাদরে একটার পর একটা নক্ষত্রের চোখ ফুটিয়ে তোলে অবিকল।
দিবাকরের এমনতরো কথায় অন্তরা আরও রোমান্টিক, আরও উদ্দাম হয়ে উঠতে চেয়েছিল। দিবাকর সে উদ্দামতায় ভেসে যেতে যেতেও বিশ্বাস করেছিল যে, এ সবই আসলে শুধু আলগা সাঁতারের মহড়া।
অবশেষে এল সে রাত। দিবাকর তার ফুলশয্যার জন্যে বরাদ্দ ঘরটাকে প্রাণপণে তার স্বপ্নে দেখা রাতের ট্রেনের রূপ দেবার চেষ্টা করল। হালকা নীলাভ আলো, জানালায় লতিয়ে ওঠা মানিপ্ল্যান্ট, খুব কম ভল্যুমে চালানো “নবারুণ রাগে” ভীষ্মদেব, সব মিলিয়ে এক অপার্থিব অনুভূতির জগত।
সে রাতে অজস্র হাসিঠাট্টার আওয়াজের মধ্যে দিবাকর ফুলশয্যার ঘরের দরজা বন্ধ করে ধীর পায়ে অন্তরার কাছে পৌঁছে গিয়ে দু’হাত দিয়ে তার চিবুক তুলে বলল, আজ আমাদের স্বপ্ন পূরণের রাত। আমাদের চারদিকে আজ আর কোনও নিষেধের বেড়াজাল নেই। তুমি ভেবে নাও যে, তুমি আর আমি এক অপার্থিব রাতের ট্রেনের যাত্রী। এই হালকা নীলাভ আলোর নিচে কেবল তুমি আর আমি। বাইরে সরে সরে যাওয়া জোনাকি-ঘেরা গাছ, খুব নিঝুম শুনতে পাওয়া দুয়েক কলি ভীষ্মদেব আর এই কামরায় শুধু তুমি আর আমি।
—বুঝতে পারছি আমার বর বেজায় রকম রোমান্টিক। অন্তরা নিচু গলায় বলে।
—অন্তরা, তুমি এ রাতে প্রজাপতির মতো ডানা মেলো, আমি বৃষ্টি হয়ে সে ডানায় ঝরে পড়তে চাই। দিবাকর অন্তরার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে।
অন্তরার শরীরও দিবাকরের এই আহ্বানে সাড়া দেয়। আধো অন্ধকারে দু’টো শরীর এক হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে হঠাতই দিবাকর আবিষ্কার করে যে, তার স্বপ্নে দেখা রাতের ট্রেন তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, অনেক দূরে। অন্তরার সঙ্গে ফেলে আসা দুপুরগুলোর নিষিদ্ধ বাতাবরণে নারীদেহের প্রথম স্পর্শ তার শরীরকে যে শিহরণ দিয়েছিল, যে ভালোলাগা উপহার দিয়েছিল, তা আজ এই নিষেধহীন পরিমণ্ডলে কেমন করে যেন ক্রমশ স্বাদহীন, গন্ধহীন হয়ে যাচ্ছে। যে শারীরিক অভিঘাতের অন্য প্রকাশ একদা তাকে বন্যার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, তা আজ ক্রমশ নিস্তেজ আর নিস্প্রভ হয়ে পড়ছে। এই আতঙ্কিত পরিমণ্ডলে দিবাকরের চীৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে। সে বুঝতে পারে কোথাও একটা বড় ভুল হয়ে গেছে।
অন্য দিকে অন্তরা দিবাকরের এই পরিবর্তনের কথা কিছু টের পায় না। সে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে দিবাকরকে। অন্তরার সেই প্রবল আলিঙ্গনের মধ্য থেকেই প্রবল হতাশাগ্রস্থ দিবাকরের চোখ যায় জানালা বেয়ে ওঠা মানিপ্ল্যান্ট গাছগুলোর দিকে। মানিপ্ল্যান্টের পাতা থেকে তখন পিছলে পড়ছে হালকা নীলাভ আলো।
দিবাকরের কেন জানি না মনে হয়, সে গাছের শরীরে মিশে গিয়ে বন্যা, আবছায়া শরীর, দিবাকরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে আর মৃদু ডাকে বলছে, বলেছিলাম না, কৃষ্ণচূড়ার প্রকৃত সান্নিধ্য পাবার জন্যে বসন্তদিন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।