ভান নিয়ে বেরোতে পারছে না বলে টাকার চিন্তা হয় না কল্পনার। সমিতি থেকে সপ্তাহে সপ্তাহে মেশিন কেনার ধারের টাকা নিতে আসে। সে কল্পনা জমানো টাকা থেকে দিতে পারবে। নয়তো শ্যামল বিমলকে বললেই টাকা পাঠিয়ে দেবে। এখনতো কম্প্যুটারে নিমেষে টাকা ঢুকে যায়। জানে কল্পনা। ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিলেই হবে। মাস্টারবাবুকে বললে মাস্টারবাবু ব্যাঙ্কের কাগজ ভরে দেয়। কল্পনা ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলে নিতে পারে। তাই টাকার চিন্তা নয়, সুবলের জ্বরের চিন্তাটাই ভাবাচ্ছে কল্পনাকে। রাতেবিরেতে জ্বর বাড়লে কল্পনা একা কি করবে? সুবলকে ঘরে রেখেই কল্পনা মাস্টারবাবুর বাড়ি যায়। দু'টো ভাতে-ভাত অন্তত ফুটিয়ে দিয়ে আসবে। নিজের ঘরে রান্না আর চাপাচ্ছে না কল্পনা। সুবল তো পেটব্যথায় মুচড়ে উঠছে। কিছু খেতে পারছে না। কল্পনা এই অবস্থায় রান্না করবে? চিঁড়ে মুড়ি যা হোক খেয়ে নিচ্ছে।
মাস্টারবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখে মাস্টারবাবুরও জ্বর। বললেন, "আমার তো তেমন জ্বর নয়, ও ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সুবলটাতো ভাবালে! চারদিকে যা জ্বর হচ্ছে! মশারি খাটিয়ে শুস তো? মশা থেকে এই জ্বর হচ্ছে, বুঝলি? খুব সাবধান! বমি-টমি করলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।" অজানা আতঙ্কে কাঁটা হয়ে বাড়ি ফিরে আসে কল্পনা। মশারি টাঙিয়ে শোয় ওরা। শোবে না! শ্যামল আর বিমলের নিজেদের বানানো মশারি যে! শ্যামল আর বিমল সেই চেন্নাইতে মশারি কারখানায় কাজ করে। ইস্কুল পাশ করে পড়াশোনা আর করেনি দুই ভাই। বলল, "কি হবে?" তেলিপাড়ার অতনু প্রথমে শ্যামলকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। পরে শ্যামল আবার ভাইকে টেনে নিল। সবে একটু পয়সাকড়ির মুখ দেখছিল কল্পনা। একটু সুখ! আচ্ছা, সুখ কি পয়সাকড়ি না থাকলে হয় না? তাহলে যখন শ্যামল বিমল ছোট, রোজগারপাতি কম ছিল তখন ডিমের ঝোল ভাত অমন খুশিতে গড়িয়ে পড়ে খেয়েছে কি করে? সুবল ওদের তিনজনকে ভ্যানে করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত, রোল খাওয়াত! কি আনন্দ! কি আনন্দ! সে আনন্দ তো ঘরে জল পড়ে, কিম্বা মাটির মেঝেয় কেঁচো ওঠে--এই কারণে কমে যেত না! এখন তো কল্পনার পাকাবাড়ি। সিমেন্টের মেঝে, করোগেটের ছাদ। তবে সুখ কেন এমন হাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে যেতে চাইছে!
বাড়ি ফিরে ছেলেদের ফোন করে কল্পনা। সুবলের মোবাইল থেকে। সুবলের জ্বরের কথা বলে। খুব কিন্তু কিন্তু করে জানতে চায় ওরা আসতে পারবে কিনা। শ্যামল তো ঠিকরে ওঠে! বলে, "কি বলতিছ মা? এখন ছুটি দেবে ক্যানে মালিক? তাছাড়া কত ধূরের পথ, আসতি ঝেতিই তো চারদিন চলি ঝাবে, তাহলি ঝাব কি করি?" কথাটা ফেলনা নয়। এইজন্যই তো গেলবারে যখন ওরা এসেছিল কল্পনা পেড়েছিল কথাটা--"বলি কি, ইখানেই কোন কামকাজ শুরু কর না বাবারা, ঘরটা বড় খাঁ খাঁ করে! তাছাড়া এত ধূরের পথ, কোন বেপদ-আপদেও তো আসতে পারবেনি!" প্রিয়জনহীন স্বাচ্ছন্দ্যে কল্পনার বুকের মধ্যে হা হা করে। শ্যামল বলেছিল, "কি কাম করব বল? বড় বেবসা করার মত পয়সা কই?" কল্পনা বলে, "মশারি বানাতে তো শিখিছিস বাবা, তবে এখানে ঐ কাজই শুরু কর। কাছে ত থাগবি!" শ্যামল এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "কাছে থাগবি, আর কাছে থাগবি! কাছে থাগলে পয়সা হবে শুনি? এখানে বেবসা করার হাঙ্গাম জানো? একে দাও, তাকে দাও, হ্যান কর ত্যান কর, সব শুনি চলতি হবে! পারব নি বাপু! তাছাড়া আমাদের বানানো মশারি কিনবে কজন? কোম্পানি, তার নাম এসব বেপার বোঝ? ঝা বোঝ না তাই নে প্যাঁচাল পেড়ো না। গেরামের আরো পাঁচ জনা বাইরে থাকে তো! তাদের মায়েরা কি এমন মাথা খুঁড়তিছে?" এর পরে কি আর কোন কথা চলে? আজ সেই কথা মনে করে বুকের মধ্যে যেন পাথর জমে ওঠে। ভাদুরে বেলা ঢলে পড়ে। সামনের অশ্বত্থগাছের তলায় জমে ওঠা আঁধার হঠাৎ করে কল্পনার চারপাশকে জাপটে ধরে। জলার ধার থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক ভেসে আসে। দূরে কুকুরের কান্না শোনা যায়। হিম হয়ে যায় কল্পনা। মার কাছে শুনেছিল কুকুরের কান্না নাকি ভয়ঙ্কর অমঙ্গল বয়ে আনে। তাড়াতাড়ি উঠে কাপড় ছেড়ে সন্ধে দেয় কল্পনা। গলায় আঁচল দিয়ে ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে চটকা ভাঙে কল্পনার। সুবল জ্বরের ঘোরে কিসব বলছে। ছুটে যায় কাছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে ধুম জ্বর। মাথায় জলপটি চাপিয়ে পাখার বাতাস করতে থাকে। সুবল প্রলাপ বকতে থাকে..."কে রে? শ্যামল আলি? আয় বাপ, এখেনে বোস। বিমল এল নি? ছুটি পায় নাই? শোন বাপধন, ইখানে খুব জ্বর হতিছে। সাবধানে থাকবা।" আবার কিছুক্ষন বাদে শুরু করে..."ও কল্পনা...। উলু দ্যাও, শাঁখ বাজাও! দ্যাখো শ্যামলের বিয়া দিয়া আনসি! কেমন রাঙা বউ দ্যাখো!" কল্পনা নাড়া দেয়, "এই এমন করতিসো ক্যান? এই?" সুবল সাড়া দেয় না। রাত বাড়তে থাকে। কুকুরটার চুপ করবার নাম নেই।
রাত দশটা নাগাদ সুবল বমি করে। মাস্টারবাবুর কথা মনে পড়ে কল্পনার। কিন্তু কেমন করে মানুষটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? কে যাবে সঙ্গে? সারা গ্রামেই তো সোমত্থ ছেলেরা বাইরে। শুধু মদোমাতালগুলো আছে। তা তাদের এই রাত্তিরে ডাকাডাকি করেও লাভ নেই! মাথার কাপড়টা টেনে মাস্টারবাবুর বাড়ির দিকে দ্রুত পায়ে চলতে থাকে কল্পনা। গেট খুলে ঢুকে দেখে মাস্টারবাবু বাইরের ঘরের বিছানায় শুয়ে। মাস্টারবাবুরও ধুম জ্বর। বকছে "পাপ! পাপ! পাপ করেছি আমরা। কিছু করতে পারিনি! এখানে রাখার কোন ব্যবস্থাই করতে পারিনি! শুভরে! বাপ! তোকে কত্ত দূরে পড়তে পাঠিয়ে দিলাম!" কল্পনা বলে, "ক্যানে দিলে মাস্টারবাবু? তোমার কলেজি পড়ানো যেত নি? কিম্বা কলকেতায়?" মাস্টারবাবু ঠিকরে ওঠেন, "কলকাতায় জানি না। কিন্তু কিচ্ছু নেই এখেনে, ক'টা ক্লাস নিই আমরা? কারা ভরতি হয়? কেমন করে হয়? আর পরীক্ষা? ছি! ছি! এইভাবে কি শিখবে? কোথায় দাঁড়াবে? না, না, শুভ তুই এখেনে আসিস না। ওখানে মন দিয়ে পড়। শেখ বাবা শেখ। আমি খুব ভাল আছি!" মাস্টারবাবু ফুঁপিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে আবার শুরু করে, "আমারে নিতে এলে শুভর মা?" কল্পনা শিউরে ওঠে। চিৎকার করে "মাস্টারবাবু? মাস্টারবাবু?" মাস্টারবাবু বলে, "জানো তো শুভর মা, আমরা কিচ্ছু করতে পারিনি। গ্রামের ছেলেগুলো সব বাইরে চলে গেছে। হয় পড়তে, নয় রোজগারের ধান্দায়। আমরা ওদের উড়িয়ে দিয়েছি...। হাঃ হাঃ উড়িয়ে দিয়েছি! এখন দেখ কেমন ফাঁকা চারদিক! হাঃ হাঃ"--হাসি করুণ আর্তনাদে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কল্পনা আর সহ্য করতে পারে না। দৌড়তে দৌড়তে বেরিয়ে আসে। মুসলমান পাড়ার দিক থেকে জহুরা বিবির আর্তনাদ ভেসে আসে। "ও জয়নালরে! তোর বিবিরে রাখতে পারলুম না! কি জবাব দেব? ওরে তোর কসি ছাওয়ালডা এট্টু বুকের দুদ পাবে নি! ওরে তুই কি আসতে পারবি রে? বিবিরে দাফন করার আগে?" নিস্তব্ধ রাত্রে জহুরা বিবির কপাল চাপড়ানি চারদিকে দুঃসময়ের পদধ্বনি ছড়িয়ে দেয়। কল্পনা দৌড়তে থাকে। পাড়া ছাড়িয়ে নির্জন মেঠো পথে পড়তেই কল্পনা যেন দেখতে পায় সামনে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘকায়! মশারি ঢাকা! এবার নিঃশব্দে হাঁটছে! দীর্ঘতর হচ্ছে তাদের অবয়ব! মশারি ঢাকা ছায়ামূর্তিরা এবার খাট কাঁধে ছুটছে! খাটেও মশারি ঢাকা! সমস্ত চরাচর যেন স্বচ্ছ মশারি ঢাকা। পরিষ্কার দৃষ্টি চলে না! চেতনার পরিসীমা ছাড়িয়ে যেতে যেতে কল্পনা অনুভব করে তার সমস্ত সত্তা ঢাকা পড়ছে রাশি রাশি মশারিতে!