মফস্বল শহরে সন্ধে নামে সন্তর্পণে, পা টিপে টিপে। সূর্য ডুবে যাবার পরও পশ্চিমের জানলায় অনেকক্ষণ আলো লেগে থাকে। গড়িমসি করে দু-একটা সাঁঝবাতি জ্বলে ওঠে এ-ঘর ও-ঘর। গেরস্ত বাড়িতে শাঁখে ফুঁ পড়ে। অন্তরার অবশ্য সেসবের বালাই নেই। এই সময়টা সাধারণত সে পাড়া বেড়াতে যায়। একেবারে সন্ধে পার করে ফেরে। সাত্যকি তাই নিজেই চাবি খুলে বাড়ি ঢুকল। গলির মধ্যে দু-কামরার আস্তানা। এর ভাড়া টানতেই নাভিশ্বাস। টিউশন আর স্কলারশিপ মিলিয়ে যে-কটা টাকা হাতে আসে, তাতে গা ঢাকতে পা বেরিয়ে পড়ে। তাও যদি অন্তরা একটু হিসেবী হত! সাত্যকির দৃঢ় ধারণা গলির মোড়ের রূপরেখা বিউটি পার্লার, প্রোঃ-রেখা পালিত, মোটামুটি তার স্কলারশিপের পয়সাতেই বিজনেস করে খাচ্ছে। দেড় বছরের মধ্যে রেখাবৌদি সাইকেল-রিক্সা ছেড়ে এক্টিভা কিনে ফেলল, এদিকে সাত্যকির পিএইচডি ন যযৌ ন তস্থৌ। অঙ্কের মত প্রাচীন বিষয়ে নতুন কাজ করা এমনিতেই মুশকিল। তাও যা কাজ হয়েছে, রাখালি ছেড়ে সেই সব গরু বাছুর তাড়িয়ে গোয়ালে ঢোকাতে পারলে থিসিসটা নেমে যেত। কিন্তু টিউশন করে আর সংসার সামলে সাত্যকি সময় দিতে পারছে না। সুপারভাইজার ডক্টর চৌধুরী আল্টিমেটাম দিয়েছেন ‘আর বছর খানেক! তার মধ্যে থিসিস জমা না করলে, রাস্তা মাপো।’
এমন নয় যে সাত্যকি বিয়ে করার জন্য হেদিয়ে মরছিল। কে যেন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল... দেখে মনে হয়েছিল মেয়েটাকে অনেকদিন চেনে। সাদামাটা চেহারা, কারণে অকারণে খিলখিল হাসি...। বিপরীত হামেসাই কাছে টানে। সে পর্যন্ত ঠিক ছিল। দোষের মধ্যে সস্তার রেস্তোরাঁর পর্দা ঢাকা কেবিনে দু-এক দিন অন্তরার সঙ্গে একটু বেশিই অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েছিল। হুট করে এক বর্ষার রাত্তিরে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে অন্তরা সাত্যকির বাসায় চলে এল। সঙ্গে একখানা রেক্সিনের হাত ব্যাগ। তাতে একটা পাড়-ছেঁড়া সিল্কের শাড়ি, তিন সেট সালোয়ার কুর্তা, দুটো ঘরে পরার ম্যাক্সি, আর দু-চারখানা ইলাস্টিক-আলগা অন্তর্বাস।
মা–মরা মেয়ে, বাপটা মোদো মাতাল। সাত্যকির মায়াই হয়েছিল। এমনিতেই সাত্যকির শেকড় আলগা, নিজের বলতে কেউ নেই। মরে হেজে গেছে সব। যারা আছে তারা না থাকারই মত। কারো কাছে মতামত নেবার দায় নেই। পরের দিন নিজেই গিয়ে রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিস দিয়েছিল। রেজিস্ট্রি বিয়েটা হয়েছিল মাস খানেক পরে, দু-পক্ষের বন্ধুদের সাক্ষী রেখে। তার আগেই লোকাল কালীতলায় নিরঞ্জন পুরুতের সামনে মন্ত্র পড়ে অন্তরার সিঁথিতে সিঁদুর চড়িয়ে দিয়েছিল। ভাড়ার বাসায় সাদা সিঁথির মেয়ের সঙ্গে একত্র থাকলে লোকের চোখ টাটায়। অন্তরার বাপ বিন্দুমাত্র খোঁজখবর করেনি। খবর কি আর পায়নি? তিনটি সোমত্থ মেয়ের একটির অন্তত বিনে পয়সায় হিল্লে হয়েছে! ফুর্তিতে নাচতে নাচতে চুল্লুর ঠেকে গিয়ে বসেছিল নিশ্চয়ই। সে হয়ে গেল প্রায় বছর তিনেক।
ঘরের ভেতরে চাপা অন্ধকার। সাত্যকি স্যুইচ টিপে আলো জ্বালাল। ভাতের মাড়ের মত চটচটে সাদা রঙের আলোয় বসার ঘরটা ভরে গেল। টিউবগুলোর সাইড কালো হয়ে উঠেছে। তার ওপর ঝুল ঝুলছে। অন্তরার পরিষ্কার করার সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। হাসপাতাল মাঠে ফার্নিচারের মেলা বসেছিল। সেখান থেকে দরদাম করে কিস্তিতে গদি আঁটা বেতের সোফাসেট আর কালো কাঁচের সেন্টার-টেবিল কিনে এনেছিল, বিয়ের পর পরই। সোফার গদির আকাচা ওয়াড়ে ময়লা ধরেছে। সেন্টার টেবিলের ওপর পুরু ধুলোর আস্তরণ, বাসি খবরের কাগজ। সব থেকে ওপরের কাগজটার ওপর দুখানা কাপ-তলার বৃত্তচিহ্ন। সকালে বুলা এসেছিল। বাড়িওলার নিষ্কর্মার ধাড়ি সুপুত্তুর। দরজায় দাঁড়িয়ে ন্যাকামি করে বলল, ‘সাত্যকিদা, বেরোচ্ছেন?’
সাত্যকি ইউনিভার্সিটি যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। ডক্টর চৌধুরী বিদেশ থেকে ফিরেছেন মাস দেড়েক পরে। আজ সময় দিয়েছেন, না গেলেই নয়। বলল, ‘আর্জেন্ট কিছু?’
‘বাবা বলছিল সামনের মাস থেকে ভাড়ার টাকাটা একটু বাড়াতে। দু-বছর হয়ে গেল...।’
সাত্যকি প্রমাদ গুনল। আমতা আমতা করে বলল, ‘এখন একটু টানাটানিতে আছি রে ভাই...।’
অন্তরা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘আহা বুলা, দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসে বস না, চা খেয়ে যাও।’
বুলাকে সাত্যকির বিশেষ পছন্দ নয়। ইদানীং শহরে বর্ষাকালের ব্যাঙের ছাতার মত মাল্টিজিম খুলেছে। বুলা প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খেয়ে আর সকাল বিকেল কসরৎ করে ঘাড়ে বুকে মোটা মোটা পেশী গজিয়েছে। কাজকর্ম নেই, সারাদিন ধর্মের ষাঁড়ের মত মহল্লায় ঘুরে বেড়ায়। অন্তরাকে দেখলেই ‘বৌদি বৌদি’ করে গলে পড়ে। সাত্যকির বিরক্ত লাগে। অন্তরার প্রশ্রয় পেয়ে ছেলেটা ভেতরে ঢুকে এল। সোফার ওপর বসে পা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘আচ্ছা, সে না হয় হবেখন। বাবার সঙ্গে আমি কথা বলব। বৌদি ফাস ক্লাস এক কাপ চা খাওয়ান দেখি। একটু আদা দেবেন।’
আর দেরি করলে সাত্যকির দশটা আটান্নর লোকালটা মিস হয়ে যেত। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুজনকে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল।
নীচু হয়ে কাগজের ওপর দাগের দূরত্ব ও গভীরতা জরীপ করে দেখল সাত্যকি। অনুমান করার চেষ্টা করল কতক্ষণ এবং কত নিবিড় আড্ডা চলেছে। ঠিক তখনই ভিতরের ঘর থেকে সিলিং ফ্যান চলার শব্দ পেল। শব্দটা হচ্ছিলই, আগে খেয়াল করেনি। পাড়া বেড়াতে যাবার সময় সম্ভবত অন্তরা বেডরুমের ফ্যান অফ করতে ভুলে গেছে। ইলেকট্রিক বিল তো দিতে হয় না! অসীম বিরক্তি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে সাত্যকি দেখল অন্তরা বিছানার ওপর চিত হয়ে পড়ে আছে। আধো অন্ধকারে তার শোবার ভঙ্গিমা দেখে সাত্যকির বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। অন্তরার মুখ সামান্য হাঁ করা। একটা হাত শরীরের পাশে এলিয়ে পড়ে আছে। অন্য হাতটা বুকের ওপর আলগোছে রাখা। আবছায়ায় বুকের ওঠা পড়ার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে না। পরনের ম্যাক্সিটা প্রায় হাঁটুর কাছ পর্যন্ত উঠে গেছে। অন্তরার শোয়া ভালো নয়। খোলা পায়ের ডিম দেখা যাচ্ছে।
সংসারের মামুলী ছবি, তবু সাত্যকি হঠাৎ ভয় পেল। অকারণ ভয়, যে ভয়ের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। চুপি চুপি এগিয়ে গিয়ে অন্তরার নাকের নীচে আঙ্গুল রাখল। শ্বাসের স্পর্শ পেয়ে আশ্বস্ত হল। অন্তরা ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে। কোথাও বেরিয়েছিল দুপুরবেলা। আলো আঁধারিতে সাত্যকি তার গালের পাউডার প্রলেপ, ঠোঁটের অবশিষ্ট রঙ দেখতে পেল। ফিরে এসে হাত মুখ ধোয়নি, কোনোমতে ম্যাক্সি গলিয়ে শুয়ে পড়েছে। সাত্যকি অবাক হল। দুপুরের ভাতঘুম ছেড়ে অন্তরা সাধারণত কোথাও যায় না। আজ কী এমন কাজ পড়ল? তাছাড়া বিকেলে রেখাবৌদির পার্লারে গিয়ে পিএনপিসি না করলে তার অম্বল হয়। ঢেঁকুর ওঠে, বুক জ্বালা করে। সেসব প্রিয় কাজকর্ম ছেড়ে এই ঘোর অবেলায় অন্তরা ঘুমোচ্ছে?
চেনা মানুষকে অচেনা লাগলে বড়ো অস্বস্তি হয়। অন্তরার সুষুপ্তির কারণ খুঁজে না পেয়ে সাত্যকি বেশ বিচলিত হয়ে পড়ছিল। এমন সময় বাইরের দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। অন্তরা ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলল, ‘অ্যাঁ, কে?’
ছেলেগুলোর মুখ চেনে সাত্যকি। পাড়াতেই থাকে, বুলার চ্যালা-চামুণ্ডো, ইয়ার-দোস্ত। দরজা খুলে দেবার পরও কেউ কিছু বলল না। থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সাত্যকি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
‘সাত্যকিদা, একবার ওপরে আসতে হবে।’
ওদের মুখ দেখে সাত্যকি বুঝলো একটা বড়সড় অঘটন কিছু ঘটেছে। চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরল। অন্তরাকে গলা উঁচু করে বলল দরজাটা দিয়ে দিতে। একতলার একটা অংশে সাত্যকিরা ভাড়া থাকে। অন্যদিকে বুলাদের রান্নাঘর, চাকর-বাকরদের ব্যবহার করার জন্য কমন কল পায়খানা। মাঝখানে উঠোন। বাড়িওলার পরিবার ওপরে থাকে। পরিবার বলতে বুড়ো বুড়ি আর বুলা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই বুঝল আরও লোক জড়ো হয়েছে। কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। দোতলার বারান্দার এক প্রান্তে বুলার ঘর। সেই ঘরের দরজার সামনে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দাতেও দু-একজন। পাড়ারই লোকজন সব, চেনা জানা। সাত্যকি যখন ঘরে ঢুকল, সাহা ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখছেন। বিছানার ওপর বুলার খালি গা, নীল রঙের লুঙ্গি পরা প্রাণহীন নিথর শরীরটা পড়ে আছে। দুপুরবেলা ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এরেস্টে বুলার মৃত্যু হয়েছে।
অবরে সবরে যখন দেখা হয় বাড়িওলা বিজয়বাবুকে মেসোমশাই বলেই ডাকে সাত্যকি। তিনি বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে ছেলের মৃত শরীরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন। ওনার স্ত্রী ছেলের পাশে বিছানাতেই বসে আছেন। মাঝে মাঝে তার গায়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। দু একজন মাঝবয়সী মহিলা তাঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। কেউ একজন পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘একটা তরতাজা জোয়ান ছেলে, এত ভালো স্বাস্থ্য... হার্ট অ্যাটাকে মরে গেল?’
সাহা ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে সই করে বুক পকেটে পেন গুঁজলেন। মুখ দিয়ে সমবেদনা সূচক চুক চুক শব্দ করলেন। বললেন, ‘কার যে কী নিয়তি কে বলতে পারে? কোনো রোগ-ব্যাধি তো ছিল না বললেন। হাত পায়ের গুলি দেখে... অত্যধিক ব্যায়াম-ট্যায়াম করত কি? সে ক্ষেত্রে অনেক সময় হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। মাত্রা ছাড়া রক্ত পাম্প করতে করতে অসময়ে বুড়িয়ে যায়। সেটাই মনে হচ্ছে মৃত্যুর কারণ।’
বুলার বন্ধুদের মধ্যে একজন বলল, ‘সে তো বুলা রাতদিন জিমেই পড়ে থাকত। তাই বলে এমন দিন দুপুরে, ঘরের মধ্যে...!’
সাহা ডাক্তার বললেন, ‘হার্ট দুর্বল হলে সাময়িক উত্তেজনায় পাম্পিং বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তোমরা যদি চাও, বডি কাটাছেঁড়া করাতে পারো। তাহলে আমি আর... ।’
ডাক্তার সার্টিফিকেটটা ভাঁজ করে নিজের পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছিলেন, বাড়িওলা হাত নেড়ে অসম্মতি জানালেন, ‘না, না...।’
সাত্যকি পাশের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কখন জানতে পারলে?’
ছেলেটা বলল, ‘বিকেল সাড়ে চারটে পাঁচটার মধ্যেই বুলাদা জিমে চলে আসে। আজ আসছে না দেখে ফোন করেছিলাম। ফোন বেজে গেল। এরকম হয় না কখনও। বাচ্চু এসেছিল খবর নিতে। দেখে এই কাণ্ড!’
সাত্যকির মনটা খারাপ হয়ে গেল। সকালবেলা বেরোবার সময়ই ছেলেটাকে আদা-চায়ের ফরমায়েস করতে দেখে গেছে। অন্তরার সঙ্গে সব সময় ইয়ার্কি মস্করা করে বলে মনে মনে দুটো গালিও দিয়েছে। এখন ছেলেটা মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। হাজার গালি দিলেও উঠবে না। খাটের ছত্রীতে ঝুলিয়ে রাখা টি-শার্টে এখনও তার গায়ের ঘাম-গন্ধ লেগে আছে, ছেলেটা নেই। সাত্যকি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই একটা রিডিং টেবিল। দু একটা ফিল্ম ম্যাগাজিন। একটা ডালা-খোলা ল্যাপটপ কম্প্যুটার। কয়েক ঘন্টা আগেও ওই কী-বোর্ডে আঙ্গুল রেখেছে বুলা। কম্প্যুটারটা কতক্ষণ ওইভাবে খোলা পড়ে আছে কে জানে? স্ক্রীনটা অন্ধকার, স্লিপ মোডে চলে গেছে। নিতান্ত অভ্যাসের বশে ল্যাপটপের ঢাকনাটা বন্ধ করার জন্য হাত ওঠাল সাত্যকি। অসাবধানে হাতের ছোঁয়া লেগে কম্প্যুটারটা জেগে উঠল।
না জাগলেই ভালো ছিল। আচমকা একটা পর্নগ্রাফিক সাইট খুলে নারী পুরুষের উলঙ্গ অন্তরঙ্গতার ছবি ভেসে উঠল। তাড়াতাড়ি কেউ দেখার আগেই ল্যাপটপের ঢাকনাটা বন্ধ করে দিল সাত্যকি। ছেলেটার বদ গুণের অভাব ছিল না। ঘরের একটা দেওয়াল জুড়ে ওয়াড্রোব। জানলার পাশে ড্রেসিং টেবিল। তার আয়নার সামনে পারফিউম, ডিওডোরান্ট, ক্রীমের কৌটোর সারি। শৌখিন ছেলে ছিল বুলা। ছেলেরা ফুল, মালা এনে রাখছে রিডিং টেবিলের ওপর। শ্মশানে যাক না যাক, যতক্ষণ না ওরা বুলাকে নিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ অন্তত থাকা উচিত।
আজকের টিউশনটা কামাই হবে। স্মিতা ওর জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে। মেয়েটা পড়াশুনোয় ভালো। চেষ্টা করলে মাধ্যমিকে স্টার পেতে পারে। ওকে একটা ফোন করে দেওয়া দরকার। সাত্যকি সরে গেল জানলার কাছে। ফোন করার জন্য নেটওয়ার্ক দরকার এবং শোকের পরিবেশ থেকে সামান্য আড়াল। বাইরে অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। দোতলার ঘর বলে খোলামেলা। রুজু রুজু হাওয়া দিচ্ছে। কংক্রিটের নজর এড়িয়ে এখনও এই অঞ্চলে কিছু গাছপালা রয়ে গেছে। কাছাকাছি কোথাও কামিনী ফুলের ঝোপ আছে। মৃদু গন্ধ ভেসে আসছে হাওয়ায়। সাত্যকি মোবাইল বের করে, নাম খুঁজে ডায়াল করল। স্মিতাদের ল্যান্ডলাইন নাম্বার। রিং হচ্ছে। স্মিতা নেই, স্মিতার মা ফোন ধরলেন, ‘হ্যালো কে সাত্যকি? আজ আসবে না? কেন?’
ভদ্রমহিলা যেন নিরাশ হলেন। ফোনে কথা বলতে বলতে সাত্যকির চোখে পড়লো আয়নার গায়ে একটা পুরোন সিকির সাইজের লাল রঙের টিপ আটকানো। তার মানে বুলার ঘরে মেয়েদের আনাগোনা ছিল। আশ্চর্য কিছু নয়। একেবারে ক্যাসানোভা চরিত্র। ডেসিং টেবিলের আয়নার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক মহিলা বুলার কপালে চন্দন পরিয়ে দিচ্ছেন। মৃত্যু মানুষের সব দোষ লাঘব করে দেয়। সাত্যকির মনে হল আয়নার ওপর ওই রঙ আর সাইজের টিপ লেগে থাকতে আগেও সে দেখেছে কোথাও।
‘কে মারা গেছে বললে? বাড়িওলার ছেলে?’
কোথায় দেখেছে সাত্যকি? গলায় চুনো মাছের কাঁটা বিঁধে থাকলে যেমন খচ খচ করে লাগে তেমন অস্বস্তি হচ্ছে সাত্যকির। মনে করাটা খুব জরুরি।
‘আহা গো! ওইটুকু ছেলে! এই কি মরার বয়েস?’
আচমকা সাত্যকির মনে হল কেউ তার রগের ওপর সপাটে চড় কষিয়েছে।
‘কী হয়েছিল? হার্ট অ্যাটাক? এত অল্প বয়সে?’
সাত্যকির মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। তার পরিষ্কার মনে পড়ে গেছে কোথায় দেখেছে ওই লাল টিপ। অন্তরা রাত্তিরে শুতে আসার সময় রোজ সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে নাইট ক্রীম মাখে। কপাল থেকে টিপ খুলে বেসিনের ওপরের দেওয়াল-আয়নার কাঁচে লাগিয়ে রাখে।
‘আমার মামাতো দাদার হার্টে ফুটো ছিল, জন্ম থেকেই। সেই নিয়েই বেঁচে ছিল কতদিন... শেষে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল।’
বেসিনের ওপরের আয়নাটা টিপের আঠায় ধুলো জমে হতকুচ্ছিত হয়ে আছে। দাড়ি কামানোর সময় সাত্যকির চোখে লাগে। কতবার বারণ করেছে অন্তরাকে আয়নায় টিপ লাগাতে। অন্তরা শোনে না।
আপাতত সাত্যকির আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। স্মিতার মা ফোন ছাড়ছেন না এখনও, ‘কাল আসবে তো? আচ্ছা, আমি স্মিতাকে বলে দেব।’
কথার মাঝখানে খানিকটা অভদ্রর মতই ফোনটা কেটে দিল সাত্যকি। ভদ্রমহিলা আরও একটু কথা বলতে চাইছিলেন হয়তো। ফোন বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই অন্তরাকে দেখতে পেল। খবর পেয়ে ওপরে উঠে এসেছে। এলোমেলো পায়ে হেঁটে বিছানার কাছে এসে বুলার মায়ের পিঠে হাত রাখল অন্তরা। সাত্যকি কাছে এগোল। খর চোখে তাকিয়ে দেখল তার চোখ লাল, টুবু টুবু জলে ভারী... দুই ভ্রূর মাঝখানে গোল সাদা দাগ।
‘তোমার কী হয়েছে সাত্যকি? তোমাকে খুব ডিপ্রেসড লাগছে।’
‘না, না, কিছু না।’
আজকেও স্মিতা নেই। সাত্যকি লিভিং রুমের সোফায় বসে অপেক্ষা করছে। এই সোফাটায় সে পারতপক্ষে বসতে চায় না। কারণ বসলে গদির এত গভীরে ঢুকে যায় যে উঠতে মুশকিল হয়। স্মিতার মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিএইচডির ব্যাপারে কোনো সমস্যা?’
সাত্যকি আবার ঘাড় নাড়ল। ভদ্রমহিলার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক হতে পারে না সে। কথাবার্তায় মনে হয় উনি সাত্যকিকে সত্যিই স্নেহ করেন। আসলে ছোট থেকে একা একা মানুষ হয়েছে বলে সাত্যকির স্নেহ পাবার অভ্যেস চলে গেছে। তাই হয়তো অস্বস্তি হয়। বরং স্মিতার সঙ্গে সে অনেক সহজ। পড়া হয়ে গেলে স্মিতা টুকটাক গল্প করে। কাল যেমন পড়িয়ে ওঠার সময় বলল, ‘সাত্যকিদা, আপনাকে একটা ছবি দেখাবো। আপনি বলবেন কী কী জিনিষ দেখতে পেলেন।’
সাত্যকি বলল, যা যা দেখতে পাচ্ছে, একটা ভাঙা কলসী, পোড়ো বাড়ি, পাতা-খসা গাছ...। স্মিতা বলল, ‘ব্যাস! আর কিছু নয়? দূরের নদীটা দেখতে পেলেন না?’
সাত্যকি একটু কষ্ট করেই হাসল, ‘তুমি কি আমার সাইকোলজিক্যাল টেস্ট নিচ্ছ?’
স্মিতা আবার বলল, ‘আচ্ছা, আমি তিনটে ওয়ার্ড বলব। সেগুলো শুনে আপনিও তিনটে ওয়ার্ড বলবেন। চট করে, শুনেই যা মনে আসে। বেশিক্ষণ ভাবতে পাবেন না কিন্তু, বলে দিচ্ছি।’
আজকাল মাথার মধ্যে সর্বদা বাঘ-নখের আঁচড় টের পায় সাত্যকি। ভাবল খেলাই তো! আর কিছু নয়। অল্প সময়ের জন্য হলেও রেহাই পাবে। বলল, ‘বল।’
‘স্কাই।’... ‘ব্লু।’
‘ফরেস্ট।’... ‘ডার্ক।’
‘লাভ।’... ‘পেইন।’
বলেই ভাবল, স্মিতা কী মনে করল? শেষের রেস্পন্সটা আচমকা বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই। স্মিতা কিছু বলল না। অদ্ভুত মায়াভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।
স্মিতার বাবাকে দু’একবারই মাত্র দেখেছে সাত্যকি। ভদ্রলোক মার্চেন্ট নেভিতে কাজ করেন। ন’মাসে ছ’মাসে বাড়ি ফেরেন। কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আবার জাহাজে ফিরে যান। যখন আসেন বাড়িটায় খুব হুল্লোড় হয়। স্মিতা ফোন করে বলে, ‘সাত্যকিদা, আমরা ক’দিনের জন্য ছুটিতে যাচ্ছি। এসে ফোন করব।’ ভদ্রলোক চলে গেলে মা-মেয়ের সংসার আবার ঝিমিয়ে পড়ে। স্মিতাকে পড়ানোর সময় কখনও কখনও ওর মা চা জলখাবার নিয়ে আসেন। একটা চেয়ার টেনে বসেন। জিজ্ঞেস করেন, কেমন চলছে পড়াশুনো। পড়ার সময় মায়ের উপস্থিতি স্মিতা ঠিক পছন্দ করে না। বলে, ‘তুমি আবার এখানে বসলে কেন? তোমার সিরিয়াল মিস হয়ে যাবে না?’
স্মিতা ফিরতে দেরি করছে। কোনো বন্ধুর বাড়ি গেছে নোটস আনতে। সাত্যকি সেন্টার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল। স্মিতার মা একটা ট্রের ওপর চা-কেক-চানাচুর নিয়ে এলেন। ঝুঁকে পড়ে ট্রে নামিয়ে রাখার সময় চোখ সরিয়ে নিল সাত্যকি। ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের এদিক ওদিক। কিন্তু দেখে বোঝা যায় শরীরের অযত্ন করেন না। আজ মেয়ের শাসন নেই। অসঙ্কোচে সাত্যকির পাশেই বসলেন সোফার ওপর। বললেন, ‘কেকটা খাও। ফ্লুরিজের। নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম গত শনিবার। তখনই নিয়ে এসেছি।’
সাত্যকির খিদে পেয়েছিল। মানসিক ভাবে ক্লান্ত মানুষের কি বেশি খিদে পায়? স্মিতার মা তৃপ্ত মুখে ওর কেক খাওয়া দেখছিলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ক’দিন ধরেই দেখছি তোমার চোখের নীচে কালি। শরীর-টরীর খারাপ নয় তো?’
ঠিক এই প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যেতে চাইছিল সাত্যকি। কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও না হয় কথা ছিল। কী বলবে ছাত্রীর মাকে? ওনার কাঁধে মাথা রেখে কান্নাকাটি করবে? বলবে, আমার বউ আমায় কোনদিন একটুও ভালোবাসেনি, জানেন? সে আমায় লুকিয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে সহবাস করেছে। আমি যখন বাড়ির বাইরে, ভর দুপুরে সে আমারই আঙ্গিনা দিয়ে অভিসারে গেছে। বিকেলবেলা যখন ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতাম তখন তার প্রেমিক সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে টানতে আমায় দেখে মুচকি হাসত। আমি একটুও বুঝতে পারিনি। ছেলেটা মরে যাবার পরে ওদের অসৈরনের কথা জানতে পেরেছি। এমনকি সেই ছেলেটার মৃত্যুর জন্যও আমার বৌ খানিকটা দায়ী! সে নাকি অতি উত্তেজনায় ধড়ফড় করে মরেছে। আহা রে, বেচারা! আমার বৌ তার পাশ থেকে উঠে এসে সুখের ঘুম ঘুমিয়েছে। কে মরল কে বাঁচল তাতে তার কিছু যায় আসে না।
এখন আমি কী করি? কার কাছে যাই? বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারি না। পোড়া কাঠের মত শক্ত হয়ে তার পাশে শুয়ে থাকি। তাকে ঘুণাক্ষরে ছুঁই না। সে আমায় ছুঁলে, আমার সমস্ত শরীর চিড়বিড় করে জ্বলে। কাঠকয়লা যেমন জ্বলে জ্বলে ফুরিয়ে যায় আমার সেই দশা। আজ দশ দিন হয়ে গেল দুচোখের পাতা এক করিনি। চোখ বুজলেই মনে হয় সাত তলার ছাদ থেকে পড়ে যাচ্ছি। কানের মধ্যে হাওয়া কাটার সাঁই সাঁই শব্দ শুনতে পাই। এসব কথা কি কাউকে বলা যায়?
ভদ্রমহিলা তার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছেন। মুখ দেখে মনে হয় যথার্থই জানতে চান তার কী হয়েছে। ভদ্রমহিলা হাতের কাপ সাবধানে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। সাত্যকির হাত টেনে নিয়ে অন্তর্যামীর মত বললেন, ‘আমাকে বলতে পার সাত্যকি!’
ওনার হাতের পাতা মাংসল। সাত্যকি যে সোফাটায় বসে আছে তার গদির মত নরম। ভদ্রমহিলা সরে এসেছেন। পা মুড়ে বসেছেন সোফার ওপর। কাছ থেকে ওনার মুখের সুচারু ডৌলটি দেখতে পাচ্ছে সাত্যকি। ত্বকের মসৃণতার নীচে দু-একটা ব্রণকূপ, নীল শিরা ফুটে আছে। একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ আসছে সাত্যকির নাকে। কোনো বিদেশী পারফিউমের, নাকি ওনার শরীরের? এই মুহূর্তে ইচ্ছা করলে অন্তরাকে খুব শাস্তি দিতে পারে সাত্যকি। তার ওপর ঘটে যাওয়া সমস্ত অপরাধের কড়ায় গণ্ডায় শোধ তুলতে পারে। মনে হয় না ভদ্রমহিলা তেমন আপত্তি করবেন। অভুক্ত, উপোসী শরীরের একটা চাহিদা থাকেই। তাকে অস্বীকার করা সহজ নয়। তাছাড়া অজুহাত তো একটা আছেই। একজন মানসিক ভাবে নিঃস্ব মানুষের শুশ্রূষা করা। তার অন্তর্গত অবসাদের উপশম করা। কে না জানে কোনো কোনো অবসাদ অন্তহীন। মানুষকে শেষ করে দেয়। একটা মানুষকে বাঁচিয়ে দেওয়ার থেকে মহান কাজ কিছু আছে নাকি?
কিন্তু লম্পট হবার জন্যও মানসিক জোর থাকা প্রয়োজন। সাত্যকি পারল না। তার মনে হল – এভাবে হয় না। এটা নেহাতই একটা ট্রিভিয়াল সল্যুশন। আদতে কারো কোনো কাজে আসবে না। মাঝখান থেকে প্রকৃত সমাধান খোঁজাটা বেমালুম বন্ধ হয়ে যাবে। একরকম জোর করেই সে হাত ছাড়িয়ে নিল। কাঁপা হাতে চায়ের কাপ তুলে নিয়ে বলল, ‘নাহ, তেমন কিছু নয়। রাত জেগে থিসিসের কাজ করি, তাই হয়তো... আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
ঠিক তখনই কলিং বেল বাজল। স্মিতা ফিরে এসেছে। ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘মাম্মা, এতবার ফোন করছি, ধরছিলে না কেন?’
স্মিতার মা টেবিলে রাখা মোবাইলটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘দেখেছিস, কখন সাইলেন্ট মোডে চলে গেছে, দেখিইনি।’
আজকাল মাঝে মাঝেই ঘরের দেওয়াল টলে যায়। নেশাগ্রস্তর মত টলোমলো পায়ে হাঁটে সাত্যকি। অন্তরা দৌড়ে আসে, ‘কী হয়েছে?’
তার হাত ছাড়িয়ে কোথাও একটা বসে পড়ে সাত্যকি। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। ‘কী হয়েছে তুমি জানো না?’
‘না, জানি না। ক’দিন ধরেই দেখছি তুমি এমন করছ।’
‘জানো না, নাকি না জানার ভান কর?’
অন্তরা মুখ কালো করে সরে যায়। কিছু বলে না। সাত্যকি ভাবে কোনটা বেশি সত্যি? তার মাথা টলে যাওয়া নাকি ঘরের দেওয়ালের আবর্তন। অবশ্য যুক্তি দিয়ে দেখলে ব্যাপারটা আপেক্ষিক। বোধ হয় দুটোই সমান সত্যি। ক’দিন ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে না। ডক্টর চৌধুরী ফোন করেছিলেন। দায়সারা জবাব দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল। বিকেলের দিকে শ্যামলী এল। অন্তরার পরের বোন। সাত্যকি জানে মাঝেমধ্যে শ্যামলী আসে। অন্তরা লুকিয়ে তার হাতে দু-দশ টাকা দেয়। কিচেনে দুই বোনে কিছুক্ষণ গুজগুজ চলল। সাত্যকি সোফায় বসে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল। পড়ছিল না কিছুই। শ্যামলী এক কাপ চা এনে দিল। কাপ প্লেট রেখে চলে যাচ্ছিল। সাত্যকি ডাকল, ‘শোন, গত শনিবার তোকে শ্রীরামপুর ষ্টেশনে দেখলাম। কোথায় গিয়েছিলি?’
শ্যামলীর গায়ের রঙ মাজামাজা। কিন্তু মুখখানি মিষ্টি। সে হঠাৎ এমন জেরার মুখে পড়ে ঘাবড়ে গেল। কোনমতে বলল, ‘ওই... বন্ধুর বাড়ি।’
সাত্যকি বলল, ‘বন্ধু মানে? যে ছেলেটার হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলি?’
শ্যামলী জবাব না দিয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইল।
কথাবার্তা শুনে অন্তরা এসে দাঁড়িয়েছিল। তাড়াতাড়ি বলল, ‘হাতে হাত রেখে আবার কার সঙ্গে দাঁড়াবে? কী দেখতে কী দেখেছ। শ্রীরামপুরে মণিকাকা থাকে। ওর ছেলে হবে। ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল বোধয়।’
‘নিজে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বল। বোনটাকেও শেখাচ্ছ।’
‘আমি কোথায় মিথ্যে বললাম?’
‘বলনি? যাওনি তুমি সেদিন ওপরে?’
শ্যামলী অবাক হয়ে দেখছিল দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে। অন্তরা তাকে বলল, ‘সন্ধে হয়ে আসছে। তুই এখন বাড়ি যা।’
শ্যামলীকে দরজা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে অন্তরা আবার কিচেনে ঢুকে গেল।
সাত্যকির ভালো লাগছিল না বাড়িতে বসে থাকতে। বাড়ি মানে আশ্রয়। যেখানে রোদে পুড়ে ঢুকলে কেউ ঠান্ডা জল এগিয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ভিজে এলে মাথা মোছার শুকনো গামছা, চায়ের পেয়ালা। বিশ্বাস করে যেখানে বার বার ফিরে আসা যায়। উঠে পোষাক বদলে বেরল। অন্তরা পিছন ডাকল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘জানি না।’
সাত্যকি আর পিছন ফিরে তাকালো না। বাইরে রোদ পড়ে এসেছে। উঠোনের চারদিকে সিমেন্টের বাঁধানো রোয়াক, দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির মুখে কাঠের চেয়ারের ওপর একটা বিড়াল কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হয় অনন্তকাল একই মুদ্রায় সমারূঢ়। দু একটা ছাতারে পাখির ওড়াউড়ি, নিঃশব্দ চৌকাঠ পার হয়ে ইট বাঁধানো গলি, দুপাশের বাড়ির খড়খড়ি-টানা বন্ধ জানলা। মোড়ের মাথায় পৌঁছোতেই সাত্যকি দেখল রেখাবৌদির বিউটি পার্লারের সামনে ভিড়ে ভিড়াক্কার। একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পার্লারের দরজার কাঁচ ভাঙ্গা, পাল্লা দু-হাট করে খোলা। পাড়ার লোক উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। চুরি টুরি হল নাকি? পোঁ পোঁ করে সাইরেন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো। সাত্যকি এগিয়ে গিয়ে ভিড়ের পিছনে কান পাতল। সবাই সবার সঙ্গে কথা বলছে। উৎকর্ণ হয়ে শুনেও কিছু আন্দাজ করতে পারল না। পানের দোকানের তিওয়ারি ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। বেশিক্ষণ দোকান খালি রেখে গেলে পাড়ার ছেলেরা ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেট ঝেড়ে দেবে। সেই সাত্যকিকে খবর দিল। রেখাভাবি স্যুসাইড এটেম্পট করেছেন। পার্লারের ঘষা কাঁচের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে আরামকেদারায় কাত হয়ে শুয়ে ঘুমের ট্যাবলেট গিলেছেন, গুনে গুনে বিশটা। তিওয়ারি কী করে জানল? কেন ফয়েল পড়ে ছিল যে কাউন্টারের ওপর। সব্বাই দেখেছে। আসলে ক’দিন পার্লার বন্ধ ছিল। কেউ বুঝতে পারেনি ভাবি ভিতরে আছেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাইরে পার্ক করা রেখা ভাবির এক্টিভা দেখে সবার সন্দেহ হয়।
সাত্যকির কানের কাছে মুখ এনে তিওয়ারি জানালো বুলাবাবু মারা যাবার পর থেকেই ভাবি দুকান খুলছিলেন না। খুব নাকি রোনাধোনা করছিলেন। বুলাবাবুর সাথে ভাবির আসনাই চলছিল যে। হাজব্যান্ডের সঙ্গে সেই নিয়েই কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি। তিওয়ারি কী করে...? আরে বাবুয়া, এসব খবর তো মহল্লার সবাই জানে। বুলাবাবু হররোজ তিওয়ারির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একখানা সিগারেট ধরিয়ে রেখাভাবিকে ফোন করতেন। রেখাভাবি পার্লার থেকে বেরিয়ে আসতেন। তারপর দুজনে বুলাবাবুর মোটর বাইকে চড়ে সাঁ হয়ে যেতেন।
সাত্যকি এগিয়ে গেলো। রেখাবৌদিকে স্ট্রেচারে শুইয়ে বার করছে। এখনও প্রাণ আছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পেট সাফ সাফাই করলে বেঁচেও যেতে পারে। কাঁচের ভাঙ্গা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রেখাবৌদির স্বামী মাথা নিচু করে বসে আছেন। পাশে দুজন পুলিশ... কিছু জিজ্ঞেস-পত্তর করছে। ছেলেদের কাছে লেডিস পার্লার নিষিদ্ধ এলাকা। এই প্রথম কোনো লেডিস পার্লারের ভিতরে চোখ ফেলল সাত্যকি। দেওয়াল জোড়া বড় বড় আয়না। তাতে সামনের মানুষদের অসংখ্য প্রতিবিম্ব। আর... বিস্ফারিত চোখে সাত্যকি দেখল আয়নার কিনার ঘেঁষে অগুনতি টিপ..। যেন ফুল ফুটে আছে... নানান রঙের, নানান সাইজের... যেমন বুলার ঘরের আয়নায় লাগানো ছিল... যেমন অন্তরা লাগিয়ে রাখে বেসিনের ওপরের আয়নায়। সাত্যকি ঘাড় ঝাঁকাল। বাড়ি ফিরে ডিডাকশানটা নিয়ে আবার বসতে হবে। গত কয়েকদিন যে এজাম্পশানগুলো ধ্রুব সত্য ধরে এগোচ্ছিল, আচমকা বুঝতে পারল সেগুলোর মধ্যে কোথাও ফাঁকি আছে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। খুব যে হতাশ হল তা নয়। বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আগের সল্যুশনটা তার আদৌ পছন্দ হচ্ছিল না।
সাত্যকি দেখল বেডরুম অন্ধকার করে অন্তরা শুয়ে আছে। স্যুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই চোখে হাত চাপা দিল, বলল, ‘চোখে লাগছে। নিভিয়ে দাও।’ তাই করলো সাত্যকি। তারপর অন্তরার পাশে এসে বসল। কাছে টানল তাকে। অন্তরা সংকুচিত হয়ে রইল। সাত্যকি তাকে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার বুকে মুখ ডোবাল। যেখানে প্রতিটি সতী বা অসতী মেয়ে মধু জমিয়ে রাখে সেইখানে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগল তার হারিয়ে যাওয়া আশ্রয়। যেন সে অন্তরার স্বামী নয়, গর্ভজ সন্তান। অন্তরার হাতের আঙ্গুল তার চুলের মধ্যে বিলি কাটছে। সৃষ্টির আদি থেকে সমস্ত সন্দিহান পুরুষ এভাবেই আশ্রয় খুঁজে বসতি পেতেছে। কর্ষণ করে জমির দখল নিয়েছে। শস্য খেতের ওপর হাওয়ার আন্দোলন-দৃশ্য বড়ো মনোরম। ফসলের ঘ্রাণের থেকে সম্মোহক সুগন্ধ বিশ্ব-চরাচরে নেই। হয়তো ভুলবশত, তবু যাযাবর মেষপালকের জীবন ছেড়ে সংসার পাততে ইচ্ছা হল সাত্যকির।