• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | গল্প
    Share
  • সংলাপ : সৌমেন ভট্টাচার্য


    সেপাই— চুপ মেরে গেলে কেন? ভাবছো নাকি কিছু?

    বুড়ো— নাআআহ্‌, কী ভাববো আর?

    সেপাই— কিছু তো ভাবছো, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

    বুড়ো— ভাবনাচিন্তার সময় পেরিয়ে গেছে। সময় থাকতে ভাবলে কাজে দিত।

    সেপাই— কিছু তো একটা ভাবছো। মুখ তো সেরকমই বলছে।

    বুড়ো— ও কিছু না।

    সেপাই— আরে বলে ফেল, বলে ফেল। এখন আর লুকিয়ে কী লাভ।

    বুড়ো— ভাবছিলাম, তুমি কেন যেচে কথা বল আমার সঙ্গে মাঝেসাঝে। তোমার আগে যে ছিল, সে তো হুলো-বিড়ালের মতো মুখ করে হাঁটত খালি। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসত একটা। তুমি তো সেরকম নয়!

    সেপাই— সবাই একরকম হয়না।

    বুড়ো— তা ঠিক। তুমি বোধহয় আড্ডা দিতে ভালবাসো?

    সেপাই— তুমি বাসো না?

    বুড়ো— বাসি তো। তুমিও তো বাসো।

    সেপাই— কী মনে হয়।

    বুড়ো— মনে তো হয় বাসো।

    সেপাই— তোমায় দেখেও আমার সেরকম লেগেছিল।

    বুড়ো— তা ঠিক। আড্ডাবাজ লোক দেখলেই বোঝা যায়।

    সেপাই— তাই?

    বুড়ো— যারা কথা বলতে ভালবাসে তারাই আড্ডাবাজ হয়।

    সেপাই— লেখা আছে বইয়ে?

    বুড়ো— বইয়ে লেখা থাকবে কেন, আমি জানি।

    সেপাই— আর কী জানো তুমি?

    বুড়ো— এটা জানি, রোজ এই একই জায়গায় বন্দুক কাঁধে বোবার মতো একটাও কথা না বলে এতক্ষণ পায়চারি করলে মানুষ পাগল হয়ে যেতে বাধ্য। আর কাজটা কী? খালি হাঁটো আর হাঁটো – এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক!

    সেপাই— তা ঠিক। এখানে একা একা এতক্ষণ কাটানো কোনও কথাটথা ছাড়া — সত্যিই মানুষ পাগল হয়ে যেতে পারে।

    বুড়ো— অন্যদের কথা জানি না, আমি হলে পাগল হয়ে যেতাম। বন্দুকটন্দুক ফেলে সোজা বাড়ি, রইলো শালার চাকরি। পাগল হয়ে গেলে চাকরি করে কী লাভ?

    হেসে ওঠে দুজনে, জোরে নয় অবশ্যই – নীচু স্বরে। একটু বেশিই যেন হাসে সেপাই। কথাবার্তা এগিয়ে চলে।

    -------------

    -------------

    সেপাই— তোমার কোনও আফসোস হয়না? কোনও আক্ষেপ-টাক্ষেপ?

    বুড়ো— ওসব ভেবে আর কী লাভ?

    সেপাই— আরে লাভ লোকসান দিয়ে কী হবে, বলে ফেল।

    বুড়ো— (দীর্ঘশ্বাস)

    সেপাই— বলে ফেল, বলে ফেল; বললে অনেকটা হালকা লাগবে। যা হওয়ার তো হয়েই গেছে, এখন বেকার মনের ওজন বাড়িয়ে কী লাভ আর?

    বুড়ো— হয় না আবার, সবসময় হয়। গোটা জীবনটাই তো শুধু আফসোস আর আফসোস।

    সেপাই— হুঁ।

    বুড়ো— মনে হয়, যদি আবার শুরু করতে পারতাম একদম প্রথম থেকে!

    সেপাই— হুঁ।

    সেপাই— একদম প্রথম থেকে যদি নিজের মতো করে চালাতে পারতাম জীবনটা তাহলে হয়তো এই পরিণতি হয় না।

    সেপাই— হুঁ।

    বুড়ো— তোমার কোনও আক্ষেপ নেই?

    সেপাই— হুঁ।

    বুড়ো— কী হুঁ?

    সেপাই— শুনলাম তো, নতুন করে জীবন শুরু করতে ইচ্ছে করে তোমার।

    বুড়ো— সে তো বললাম। তোমাকেও তো কিছু জিজ্ঞেস করেছি।

    সেপাই— কী?

    বুড়ো— কোথায় হারিয়ে গেলে?

    সেপাই— কোথায় আবার? বল কী জিজ্ঞেস করছ।

    বুড়ো— আরে জিজ্ঞেস করছি কোনও আক্ষেপ-টাক্ষেপ কি আছে তোমার লাইফে, নাকি ওসব ব্যাপারে একদম ক্লিয়ার?

    সেপাই— অনেকক্ষণ কথা হল আজ, ভেতরে গিয়ে বসো। যদি জানাজানি হয় ডিউটির সময় আমি গেঁজাই তোমার সঙ্গে, তাহলে তোমার যা হওয়ার তা তো হবেই, আমারও পুরো বাঁশ। চাকরি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়ে যাবে।



    মুচকি হাসে বুড়ো। গারদের সামনে থেকে সরে যায় সেপাই। পেন্সিলের মতো লম্বা, দুদিক ঘেরা জায়গাটার ওই মাথায় মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে একরত্তি জানলাটা দিয়ে রোদ আসছিল এক ফালি। সেদিকে তাকিয়ে পায়চারি শুরু করে সে। মেঝেয় বুটের শব্দ ওঠে – টক্‌ টক্‌। প্রতিধ্বনি হয় টক্‌ টক্‌ শব্দের। মুখে মুচকি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বুড়ো গারদের দরজায় মাথা সেঁটে আর দেখতে থাকে তাকে।

    বুড়ো নিশ্চিত, সেপাইয়ের দীর্ঘশ্বাস শুনেছে সে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)