যেদিন আমি দূর তারার দেশে চলে যাব ... তারপর হয়ত বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরুবে আমার নামে। দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, বীর বিদ্রোহী--বিশেষণের পর বিশেষণ! টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে--বক্তার পর বক্তা! এই অসুন্দর শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে--বন্ধু! তুমি যেন যেয়ো না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটি কথা স্মরণ করো। তোমার আঙিনায় বা আশে পাশে যদি একটি ঝরা, পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটাকে বুকে চেপে বলো---বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।’
কথাগুলি বাংলার বিপ্লবী কবি, ভারতবর্ষের নবজাগরণের প্রবক্তা কাজী নজরুল ইসলামের। বর্তমানে এই একবিংশ শতকে এসে যখন আমরা এদেশের বরেণ্য মনীষীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছি, বাইরের ক্ষণিক চাকচিক্য আর আধুনিকতায় যখন আমরা জীবনকে মোহময় করে তোলার প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত নিয়োজিত, কবির এই মর্মস্পর্শী কথাগুলি সেই সময় আমাদের সুপ্ত বিবেককে চকিতে জাগ্রত করে তোলে। ১৯৭৬-সালের ২৯-শে আগষ্ট কবির প্রয়াণের বহু আগেই আমরা বাস্তবে তাঁকে হারিয়েছিলাম। হারিয়েছিলাম সেদিন--যেদিন তাঁর কন্ঠ রুদ্ধ হয়। তারপর চৌত্রিশটা বছর তাঁর কেটেছে অনাদরে, অবহেলায়। এ বেদনার ইতিহাস ভোলার নয়।
নবজাগরণের বিকাশের একটি পর্বেই কবির জীবনকাল
আমরা জানি, যে মানুষগুলো তাঁদের জীবনে সৃষ্টির মাধ্যমে একটা যুগে সভ্যতা সংস্কৃতি-মনুষ্যত্বের উচ্চ আধার গড়ে মানব প্রগতির যাত্রাপথে অগণিত মানুষকে মহত্তর জীবনবোধে অনুপ্রাণিত করেন, তাঁদের প্রাণের ধারা নির্ণয় করেই পরবর্তী যুগের সভ্যতাকে পথ চলতে হয়। শৈশবের দুখু মিঞা--পরবর্তী কালের বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুগ-সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। অসহায় পারিবারিক অবস্থা, চূড়ান্ত প্রতিকূলতা, দারিদ্রের জ্বালা দুখু মিঞার জীবনে উত্তরণের পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি। পরাধীন ভারতে তাঁর জন্ম। তখন একদিকে মধ্যযুগীয় অন্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা, অপরদিকে সামন্ততন্ত্র ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণ। দুর্বিসহ এই বন্ধনের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা গভীরভাবে আলোড়িত করেছে সমাজ জীবনকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছে এদেশে--মানবতাবাদের আদর্শ প্রোথিত হয়েছে ক্রমান্বয়ে। রামমোহনের বেদান্ত সংস্কারের পথ ধরে তার সূচনা। পরবর্তী পর্যায়ে নবজাগরণের প্রভাতসূর্য স্বরূপ বিদ্যাসাগরের অভ্যুত্থান। সুনিপুণ বলিষ্ঠতায়, চরিত্র-চিত্রণে পার্থিব মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছিলেন তিনি। বেদনার হলেও সত্য, বিদ্যাসাগর-পরবর্তী অধ্যায়ে বলিষ্ঠভাবে এই সুর সর্বত্র ধারাবাহিকভাবে রক্ষিত হয়নি। পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব, এদেশে এই মানবতাবাদী চেতনার উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছে এমন একটা সময়ে, যখন বিশ্বে মানবতাবাদ তার যৌবনের কাল অতিক্রম করে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। সে তখন হারিয়ে ফেলেছে তার তেজোময় রূপ। তাই আমাদের দেশে নবজাগরণের পুরো ক্ষেত্রটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব তার মধ্যে দুটি স্পষ্ট ধারা। একটি মানবতাবাদের ধারা--যা ধর্ম এবং ঐতিহ্যবাদের সঙ্গে আপোস করে চলতে চাইছে। এটিই ছিল প্রবল। পাশাপাশি অপর ধারাটি ধর্ম এবং ঐতিহ্যবাদের ক্ষেত্রে আপসহীন সংগ্রামের উষ্ণতায় পরিপূর্ণ। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই দুই ধারা সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনে সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এই শেষোক্ত ধারাটির প্রতিনিধি ছিলেন নজরুল।
প্রসঙ্গত: একটি কথা উল্লেখের প্রয়োজন রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামকে বল হয় বিদ্রোহী কবি--কিন্তু বস্তুত বিদ্রোহী নন, তিনি ছিলেন বাংলার বিপ্লবী কবি। কারণ তিনি শুধু ভাঙার কথাই বলেননি, বরং বলেছেন, ‘নতুন করে গড়তে চাই বলেই তো ভাঙি--শুধু ভাঙার জন্যই গান আমার নয়। আর ঐ নতুন করে গড়ার আশাতেই তো যত শীঘ্র পারি ভাঙি, আঘাতের পর নির্মম আঘাত হেনে পুরাতনকে পাতিত করি।’ শিল্পী সাহিত্যিকের তেজোদ্দীপ্ত রচনা বলতে এদেশের কোন কোন সমালোচক মনে করেন--রচনায় থাকতে হবে লড়াই বা সংগ্রামের স্লোগান। কিন্তু তা যথাযথ উপলব্ধি নয়। স্মরণে আসে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের একটি ছোট্ট কথা--‘বিপ্লব সৃষ্টি মানুষের মনে।’ মানুষের জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে কেন্দ্র করে যে জটিল আবর্তে তার পথ চলা--সেখানে কি নেই বিপ্লবের বা বলিষ্ঠতার পদচিহ্ন? এমন কি প্রেম-ভালবাসা, মমতা-ইত্যাদি অনুভূতির গুণগত উপাদানের প্রকাশ ভঙ্গিমার মধ্যেও বিপ্লবাত্মক রসের প্রবাহ থাকতে পারে। মানুষের জীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রকে পরিব্যাপ্ত করেই পুরাতনকে ভেঙে প্রগতির নতুন ধারণা মানুষের মননজগতে যখন তুফান তোলে--সেখানেই তার বলিষ্ঠতা, তার বৈপ্লবিক রূপ। শিল্পে, কাব্যে, সংগীতে, ব্যক্তির নানান অনুভূতিতে তার রূপ প্রকাশ পায়। এটা শুধু স্লোগান নয়।
কবির জীবনালেখ্যের তিনটি পর্যায়
কবির জীবন গড়ে উঠেছে বিচিত্র ছন্দে--বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। জীবনের প্রারম্ভে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে রাস্তার লেটোর দল, কবিগানের দলে গান গেয়েছেন নজরুল। সেই সময় ভারতবাসীর অন্তরের আকৃতি, দেশপ্রেমের আঁচ লেগেছিল তাঁর মনে। বিপ্লবী যুগান্তর দলের সংগঠক নিবারণচন্দ্র ঘটকের আদর্শ, কর্মপন্থা, মুরারিপুকুর মামলার আসামী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী সহ বিপ্লবীদের সান্নিধ্য তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনাকে একটু একটু করে গভীর করে তুলেছিল। কিশোর বয়সে একদিন এক বন্ধুর এয়ারগান পেয়ে পেঁপে গাছকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে সফল হয়ে সে কী আনন্দ-উচ্ছাস নজরুলের। বন্ধু শৈলজানন্দ লিখেছেন, ‘প্রথম যেদিন লাগলো পেঁপের গায়ে নজরুলের সে কী আনন্দ। যেন একটা বড় ভূখণ্ড জয় করল। সেই পেঁপে গাছটাই হল বড়লাট। তারপরের গাছটা ছোটলাট। তার পরেরটা ম্যাজিস্ট্রেট, তারপর এস ডি ও। তারপর থানার দারোগা, ছোট দারোগা ইত্যাদি ইত্যাদি। বলেছিলাম, না না থানার দারোগাদের মেরো না। ওরা তো ইংরেজ নয়, ওরা বাঙালি। নজরুল বলেছিলেন, হোক বাঙালি। ওরা বিশ্বাসঘাতক। একদিনে সব চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইংরেজের রাজত্বটাকে অচল করে দিয়ে চলে যাক না।’ এমনই ছিল কৈশোর চেতনায় নজরুলের দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি। বৃটিশের অধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করার মানসিকতা থেকেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধ শিখতে। সুষ্পষ্টভাবে পরে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি করব না তো সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম কেন?’ কবি নজরুলের বহুমুখী প্রতিভা এদেশের নবজাগরণের ইতিহাসকে বহুক্ষেত্রেই সমৃদ্ধ করেছে। তিনি শুধু কবি ছিলেন না। তিনি গল্প লেখক, উপন্যাস রচয়িতা, গীতিকার, নাট্যকার, পত্রিকা পরিচালক, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, সুরকার--এমনি কি অভিনেতাও। মূল তিনটি পর্যায়ে তাঁর জীবন ইতিহাসের। প্রাথমিক স্তরের পরে যখন তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন, সেই সময় থেকে পুত্র বুলবুলের মৃত্যু পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়। সাহিত্য সৃষ্টিতে দ্বিতীয় পর্যায়টিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। মানবতাবাদের জয়গান সেখানে সুস্পষ্ট। যেখানে তিনি মানুষকে করে তুলেছেন এমন, যাদের মাথা ‘ভুলোক দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরস ছেদিয়া’- উঠেছে। কী গভীর প্রত্যয়ে বলেছেন, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দেব পদ চিহ্ন, আমি স্রষ্টাসূদন শোকতাপ হানা বিধির বক্ষ করিব চূর্ণ’--‘আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-- অত্যাচারীর খড়গকৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না’। তাঁর বিদ্রোহ এক গভীর মূল্যবোধের আধারে ছিল প্রোথিত।
তৃতীয় পর্যায়ে সেই মানবতাবাদের বলিষ্ঠতার সাথে কিছুটা অধ্যাত্মবাদী চিন্তার ছায়া পড়েছিল। বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ে তিনি সেই দিনগুলি কাটিয়েছেন। দ্বিতীয় পর্যায়টিতে নারীমুক্তির জয়গান গেয়েছেন তিনি কী বলিষ্ঠতার সাথে! ‘মাথার ঘোমটা’ ছিঁড়ে ফেলে দিতে আহ্বান করেছেন। আহ্বান করেছেন ‘অলংকার’ বর্জন করতে--কারণ
তা দাসত্বের চিহ্নস্বরূপ। বলেছেন--বিশ্বের সব সৃষ্টির অর্দ্ধেক পুরুষ, অর্দ্ধেক স্ত্রী জাতির। একে অস্বীকার করা যাবে না। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে দেশ আচ্ছন্ন সেখানে কবির সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অবশ্য স্মরণীয়। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঐ কথাই তো বলেছেন--হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?--বল ডুবিছে মানুষ, মোর মা’র। ব্যক্তিজীবনেও এই ধর্মীয় ভেদাভেদকে তিনি অস্বীকার করেছেন প্রবল স্পর্ধায়। তাঁর হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধ তো আজও প্রাসঙ্গিক।
সমাজ চেতনার ক্ষেত্রে কবির ভূমিকা ছিল আপসহীন
কবির যৌবনকালে, দেশের রাজনীতি তখন উত্তাল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর বোমা নিক্ষেপ, ফাঁসির মঞ্চে হাসিমুখে ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান, মানিকতলা বোমার মামলা, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রবল আলোড়ন তুলেছিল জনমানসে। এরই ঘাত-প্রতিঘাতে ঘটেছে নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার ক্রম-উত্তরণ। একদিকে আপসপন্থীদের আন্দোলন। অপরদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের ধারা। দেশব্যাপী কংগ্রেসের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে কংগ্রেসের সঙ্গে নজরুলের প্রথম যোগ। লিখেছিলেন ‘চরকার গান’। শৃঙ্খলিত কারাবন্দীদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন অভিনন্দনগীত। কুমিল্লার তরুণ সম্প্রদায়ের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে বেড়িয়েছিলেন--‘আজি রক্ত নিশি ভোরে একী এ শুনি ওরে/মুক্তি কোলাহল বন্দি শৃঙ্খলে/ওই কাহারা কারাবাসে মুক্তি হাসি হাসে/টুটেছে ভয় বাধা স্বাধীন হিয়াতলে’। (সূত্র: নজরুল জীবনী, অরুণ কুমার বসু) কুমিল্লায় গান্ধীজীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখেন, ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে চলে এল বন্দিনী মা’র আঙিনায়’। তবু একথা সত্য, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে আপসপন্থাকে তিনি কখনই সমর্থন করেননি। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, দেশবন্ধু প্রমুখের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকলেও তাদের মতবাদকে নজরুল গ্রহণ করেননি। তিনি বলতেন, ‘আমি সত্যকার প্রাণ থেকে যেটুকু সাড়া পাই রবীন্দ্র, অরবিন্দ বা গান্ধীর বাণীর আহ্বানে ঠিক ততটুকু মানব। তাঁদের বাণী আহ্বান যদি আমার প্রাণে প্রতিধ্বনি না তোলে তবে তাঁদের কথা মানব না। এই ‘মানি না’ কথাটা সকলের কাছে মাথা উঁচু করে স্বীকার করে হবে।... অনেকেই লোভের বা নামের জন্য মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু আত্মপ্রবঞ্চনা নিয়ে নেমেছিলেন ব’লে অন্তর থেকে সত্যের জোর পেলেন না। আপনি সরে পড়লেন। রবীন্দ্র-অরবিন্দ ভক্তদের মধ্যেও ঐ একই প্রবঞ্চনা ফাঁকি এসে পড়েছে। এরা অন্ধ ভক্ত, চোখওয়ালা ভক্ত নয়, এরা বুঝেও বুঝে না যে, পূজার নামে এরা তাঁদের অপমান করছে। বড় কারবার নামে তাঁদের লোক-চক্ষুতে আরো খাটোই করে তুলেছে। এদের এত দু:সাহস নেই যে, যেটুকু বুঝতে পারছে না সেটুকু ‘বুঝতে পারছি না’ বলে বুঝে নিতে, পাছে তার গুরুর কাছে সে কম বুদ্ধিমান হয়ে পড়ে বা গুরুর রোষ দৃষ্টিতে পড়ে। এসব অন্ধ লোক দিয়ে কোন কাজ হবে না।’ স্তাবকতার রুচিহীন পথ নজরুল চিরকালই পরিহার করে চলেছেন তাঁর জীবনে।
সত্যের এই পথ অবলম্বনে অনেকেই সে সময়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবেছেন। সময় নিয়েছেন এগিয়ে আসতে। কিন্তু নজরুলের সে-সবের বালাই ছিল না। ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে কবি লিখলেন, ‘...ভারতের অদৃষ্টে অলক্ষ্যে হয়তো সত্যসত্যই ধূমকেতুর উদয় হয়েছে। তা না হলে আর এ বুকের পর দিয়ে এত অমঙ্গল উপদ্রব আর অশান্তির রক্ত-সাইক্লোন বয়ে যেত না। ... তিমির রাত্রির অবসানে যখন অরুণরাগে তরুণ সূর্যের উদয় হবে, তখন তোমার এই ধূমকেতু আলোর সেতু হয়ে আঁধারের পারে নিয়ে যাবে।’ নজরুলের এই নতুন প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একের পর এক নজরুলের মুক্তিকামী লেখা প্রকাশিত হয়েছে ধূমকেতুর প্রতিটি সংখ্যায়। স্মৃতিচারণায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলছেন, ‘সপ্তাহান্তে বিকেলবেলায় আরো অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। হকার কতক্ষণে ‘ধূমকেতু’র বান্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা এই সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ।’ (সূত্র: নজরুল জীবনী, অরুণ কুমার বসু) স্বাধীনতার দৃপ্ত চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য কলম ধরেছেন--বিপ্লবপন্থাকে মহীয়ান করে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাই তাঁর ‘ধূমকেতু’ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। বিচারের জবানবন্দীতে সত্যসাধক নজরুল বললেন, ‘সত্য স্বয়ংপ্রকাশ। তাহাকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না।....আমি মরব, রাজাও মরবে, কেননা আমার মতন অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে, কিন্তু কোন কালে কোন কারণেই সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হয়নি--তার বাণী মরেনি। সে আজ তেমনি করেই নিজেকে প্রকাশ করেছে এবং চিরকাল ধরে করবে। আমার এই শাসন-বিরুদ্ধ বাণী আবার অন্যের কণ্ঠে ফুটে উঠবে। ...বিচারক জানে আমি যা বলেছি সত্যের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য।’ এই ‘ধূমকেতু’কে শুভেচ্ছা জানিয়ে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘তোমার কাগজের দীর্ঘ জীবন কামনা করিয়া একটিমাত্র আশীর্বাদ করি, যেন শত্রু মিত্র নির্বিশেষে নির্ভয়ে সত্য কথা বলিতে পার।’ (সূত্র: নজরুল জীবনী, অরুণ কুমার বসু) এই সত্যনিষ্ঠাই নজরুলকে আপসহীন করেছে--মহৎ করেছে।
কবির সত্যাশ্রয়ী চেতনা বাংলার যৌবনকে প্রাণচঞ্চল করে তুলেছিল
যখনই স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসকামী নেতৃত্ব আন্দোলনের রাশ টেনে ধরতে চেয়েছেন, তাকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন নজরুল। তিনি কোন রকম ‘রাখ ঢাক, গুড় গুড়’ না করেই বলেছেন,
“বুকের ভিতর ছ-পাই ন-পাই, মুখে বলিস স্বরাজ চাই
স্বরাজ কথার মানে তোদের ক্রমেই হচ্ছে দরাজ তাই।
“ভারত হবে ভারতবাসীর’--এই কথাটাও বলতে ভয়!
সেই বুড়োদের বলিস নেতা--তাদের কথায় চলতে হয়!
...কর্ত্তা হওয়ার সখ সবারই, স্বরাজ-ফরাজ ছল কেবল!
ফাঁকা প্রেমের ফুস-মন্তর, মুখ সরল আর মন গরল”।
চরকা দিয়ে কি আসতে পারে স্বাধীনতা? বিপ্লবীরা ছিলেন তার বিরুদ্ধে। বাংলা এবং পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, চরকা-কাটা দিয়েই স্বাধীনতা আসবে, একথা মেনে নেননি। তারা ‘ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান’ গেয়েছেন। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, মাকড়শার জাল বুনে স্বাধীনতা আসবে না, তার জন্য চাই সেনাবাহিনী। নজরুল তাঁর কবিতায় বলেছেন,
“সূতা দিয়া মোর স্বাধীনতা চাই বসে বসে কাল গুনি
জাগরে জোয়ান বাত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি।”
আপসহীন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া দেশের স্বাধীনতা যে সম্ভব নয় একথা সাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্র-নজরুল বার বারই তুলে ধরেছেন। তাই মহাত্মা গান্ধীর এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনবার প্রতিশ্রুতির নির্মম পরিহাস নজরুলের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। আপস ও সমঝোতার বিরুদ্ধে নজরুল লিখেছেন, ‘কানপুরের ছুটিতে অল ইন্ডিয়া পলিটিক্যাল তুবড়ি কম্পিটিশন হয়ে গেল। জাতির সমস্যা সমাধানের জন্য ৩০টি কনফারেন্স বসেছিল।’ সংগ্রামের পরিবর্তে যে-কোনোভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার স্বার্থকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছিলেন--
‘পণ্ডিত মতিলালের মতলব দেশের লোককে চমক লাগিয়ে দিয়ে ফিরে ইলেকশনে আবার দল বেঁধে কাউন্সিলে প্রবেশ করা। কিন্তু তারপর? মহাত্মার এক বছরের স্বরাজের ধাক্কা এখনও আমরা সামলাতে পারিনি, আর চমক লাগাবার দরকার কি?’ স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসকামী নেতৃত্বের ভূমিকা সেদিন যে ক্ষতি করেছিল, তদানীন্তন কংগ্রেসের নেতৃত্বের যে রূপ প্রকাশ পেয়েছিল তাকে কবি নজরুল সমালোচনা করেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। ব্যঙ্গভরে তিনি বলেছেন, ‘বৎসরান্তে...আমাদের পলিটিক্যাল চড়ক পূজা শেষ হল। ফিরে এসে দু’একজন বাদে নেতারা ওকালতি, ডাক্তারী, ব্যারিস্টারি এবং অন্যান্য ব্যবসায়ে মন দিবেন এবং যিনি বড় দয়ালু তিনি সপ্তাহান্তে হয়ত একবার দেশ উদ্ধারে মনোযোগ দিবেন। কই দেশবন্ধুর মত সর্বগ্রাসী দেশপ্রেম, কই সে জ্বালা? ...আজ রাজনীতির ক্ষেত্রে কেবল ফাঁকিবাজী, সঞ্চিত ধনের গাদায় বসে অথবা পাবলিক ফান্ডের অপহরণে অথবা প্রজার রক্ত শোষণ করে যে নিশ্চিন্তে আছে, আজ তারই নেতাগিরির দিন। ...স্বরাজ সাধনার শক্তিবলে আয়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান সমূহ আজ লোভীর মধুচক্রে পরিণত। পোলিটিক্যাল মোহন্তের দল রাজনীতির পুণ্যতীর্থে যথেচ্ছভাবে দীপ্তমান। নন্দীভৃঙ্গীর দল তাদের শিঙা বাজিয়ে আকাশ ফাটিয়ে দিচ্ছে”।
বৃটিশ শাসনমুক্ত ভারতের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন কবি নজরুল
স্বাধীনতার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর লেখনীতে। প্রকাশ পেয়েছিল দৃঢ় প্রত্যয়ও। বলেছেন, ‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর--উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার’। তাই স্বাধীনতার প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে। বাংলার বিপ্লবীরা দলে দলে আপসপন্থার পথকে পরিত্যাগ করে জীবন দিতে এগিয়ে এসেছে বারবার। কোন ভাবেই তাদের গতিপথ রুদ্ধ করা যায়নি। নজরুল লিখলেন সেই সত্য কথাটি
‘যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল
মেরে মেরে তারে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল!
মানিল না রবি-গান্ধীরে’।
‘ধূমকেতু’র মামলায় জবানবন্দীতে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এতো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। ...এই শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? তিনি আরও বললেন, ‘ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে।।..যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা, আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।’ (সূত্র: নজরুল জীবনী, অরুণ কুমার বসু)
এই সত্যভাষণ বৃটিশরা মেনে নেয়নি। ‘নবযুগ’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধগুলিকে ‘যুগবাণী’ নাম দিয়ে প্রকাশিত বইকে বৃটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। সেই সময়েই নজরুল তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা’ বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করেন। এরই প্রায় সমসাময়িক কালে ‘নবযুগ’ কর্তৃপক্ষ নজরুলকে নরম সম্পাদকীয় লেখার জন্য চাপ দিলে বিরক্ত হয়ে তিনি নবযুগের কাজ ছেড়ে দেন। ধূমকেতুর পৃষ্ঠায় যখন কবি নজরুল পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করেছিলেন, কংগ্রেসনেতৃত্ব তখনও তা করেন নি। গান্ধীপন্থীরা ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাসের কথাই চিন্তাভাবনা করে চলেছেন। বৃটিশ রাজের কাছে এই আবেদনের পথকে প্রত্যাখ্যান করেছেন নজরুল। বলেছেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন’; ‘আমরা তো জানি স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস।’ ধূমকেতু পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামে কবিতাটি প্রকাশ হওয়ার পরে নজরুলকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। তাঁর ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’ কবিতা-গ্রন্থ দুটিও বৃটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ধর্মীয় পরিচয় নয়,--‘মহামানুষের মহা-ভারত’--এই ছিল তাঁর স্বদেশ চেতনা
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রশ্নে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা অন্যতম গভীর সমস্যা হিসাবে বর্তমান ছিল। সেই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা এবং বিপ্লবাত্মক আন্দোলনের মানসিকতার সংমিশ্রণে রচিত ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে তিনি বলেছেন, ‘আমার ভারত এই মানচিত্রের ভারতবর্ষ নয়... আমার ভারতবর্ষ, ভারতের এই মূক, দরিদ্র নিরন্ন, পর-পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ। ...এই ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানদের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়;--এ আমার মানুষের মহামানুষের মহা-ভারত।’ এই উপন্যাসের নায়ক জাহাঙ্গীর নামের যুবক সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিতে চায়। তার আবেদন গৃহীত হয়—ছদ্মনাম হয় স্বদেশ কুমার। স্বদেশ প্রেমে উদ্ভাসিত সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক সংগঠনই যে দেশের ভবিষ্যৎ সেকথাই এই উপন্যাসে নজরুল তুলে ধরেছেন।
নজরুলের এই আপসহীন চিন্তার সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে আপসকামী নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বাধে। তাঁর কবিতায়, প্রবন্ধে তার অসংখ্য প্রতিফলন পাওয়া যায়। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের সমর্থন করেননি। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের বসুর প্রতি তাঁর মমতা থাকলেও বিপ্লবপন্থার মূলত বিরোধিতাই তিনি করেছেন। এ নিয়ে তদানীন্তন সময়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একসময় দু:খ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই স্বদেশী উগ্র কর্মস্রোত হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া বুঝিলেন, কবি কেবল জাগরণী গান গাইতে পারেন, বিপুল কর্মতরীর কাণ্ডারী হওয়া তাঁহার সাধ্য নহে।’ এ প্রশ্নে শরৎচন্দ্র, নজরুল এবং বাঙলার বিপ্লবীদের প্রবল দু:খ ছিল। নজরুলের কবিতার মধ্যেও আমরা তা দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা নিয়েই তিনি বললেন, ‘রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে, সে কর শুধু পশল না মা অন্ধ কারার বন্ধ দ্বারে।’
শুধু তাই নয়, গভীর বেদনাবোধ থেকে নজরুল এও বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ-অরবিন্দ-প্রফুল্ল বাঙলার দেবতা, তাঁদের পূজার জন্য বাঙলার চোখের জল চিরনিবেদিত থাকবে। কিন্তু সেনাপতি কই? সৈনিক কোথায়? ...সে পুরুষ বিবেকানন্দ, সে সেনাপতির পৌরুষ হুঙ্কার গর্জে উঠেছিল বিবেকানন্দের কন্ঠে।’ আমাদের দেশের নবজাগরণের ইতিহাসে বিবেকানন্দের যে অবিস্মরণীয় ভূমিকার ফলে স্বাধীনতা আন্দোলন, এমনকি বিপ্লবী আন্দোলনও অনেকখানি প্রভাবিত হয়েছিল, নজরুলের এই কথার মধ্যেও সেই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যথার্থই বিবেকানন্দ আমাদের দেশে যে জাতীয় সম্মানবোধের জন্ম দিয়েছিলেন (যদিও তা তিনি দিয়েছেন হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতেই) তার মধ্যে দেবসাধনার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাই দেশসাধনা, দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম গুরুত্ব পেয়েছিল। ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত না হলেও এবং মূলত হিন্দুধর্মের সীমায় সীমায়িত হলেও অনেক বিপ্লবী তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিবেকানন্দকে তাই নজরুল সেনাপতির মতই মনে করেছেন। প্রায় সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই কবি নজরুল তাঁর চিন্তাভাবনার সত্যকে বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি এও দেখেছি, দেশপ্রেমের বলিষ্ঠতা তাঁর কবিতাতে তো বটেই, সঙ্গীতেও প্রকাশিত। বিদ্রোহী কবি সে সময় তুফান তুলেছিল। অন্যান্য অনেক কবিতাই যৌবন প্রাণচঞ্চল তরুণদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবপন্থাকে জীবনে বরণ করে নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘শিকল পরা ছল’ ইত্যাদি গান সংগ্রামী মানুষকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল। সংগীত সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ পদের সঙ্গে ছন্দ ও সুরকে মিলিয়ে অনবদ্য মূর্চ্ছনা সৃষ্টি করেছেন তিনি। এদেশের সংগীতের বিভিন্ন ধারা--একদিকে রাগসংগীত ও লোকসংগীত অপরদিকে ইউরোপ, মিশর আরবের সংগীত ধারার সংমিশ্রণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সংগীত সৃষ্টি। মানুষের কামনা বাসনা সেখানে মূর্ত হয়েছে। এমনকি ভক্তিসংগীতও তাঁর অনবদ্য এক সৃষ্টি। জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি নবরসে আপ্লুত হয়েছে। আবার কখনও ব্যবসায়িক পথে তিনি পা ফেলেননি।নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘”দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার”-এর মত প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।’ নজরুল যখন গাইতেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যার জীবনের জয়গান...’, তখন সুভাষচন্দ্রের মুখখানি আবেগে রাঙা হয়ে উঠত। সুভাষচন্দ্র আরও বলেছেন, ‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকেও বলে এসেছি তাঁকে এবার বলিষ্ঠতার সুর আনতে হবে।’ বলেছেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব, সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে।’ বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক চেতনার উত্তাপ নেতাজী সহ বিপ্লবীদের অনুভূতিতে ধরা পড়েছিল সে যুগের জীবন্ত সত্যের নিদর্শন হিসাবে। তাই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলতেন, ‘কবিরা সাধারণত কোমল ও ভীরু। কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারের শৃঙ্খল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন, তা বাঙালীর প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।’
আর বিপিনচন্দ্র পাল বলেছেন, ‘তাঁর কবিতায় গ্রামের ছন্দ, মাটির গন্ধ পাই। দেশে যে নতুন গান জন্মাচ্ছে তার সুর তা-ই। তাতে পালিশ বেশী নেই, আছে লাঙলের গান কৃষকের গান।’ কবি মনে করতেন—ত্যাগ স্বীকার না করে মহৎ কিছু পাওয়া যায় না।
আমরা জানি, বিপ্লবপন্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘স্নেহের হাত বুলিয়ে এ পচা সমাজের কিছু ভালো করা যাবে না’। এই বলিষ্ঠতাকে তিনি তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন—নিজেও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি—বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে—যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। হয়ত আমি সব কথা মোলায়েম করে বলতে পারিনি, তলোয়ার লুকিয়ে তার রূপার খাপের ঝকমকানিটাই দেখাইনি, এই তো আমার অপরাধ! এরই জন্যই তো আমি বিদ্রোহী! আমি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, সমাজে সকল কিছু কুসংস্কারের বিধিনিষেধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙিয়ে গিয়েছি, এর দরকার মনে করেই।’ এভাবেই তিনি যথার্থ সত্যকে ভালবেসেছিলেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে সত্য তাই প্রতিফলিত হয়েছে।
পুরাতনকে ভেঙে নতুন সৃষ্টির পথে চলতে গিয়ে কবির উপর ‘আঘাত, নিন্দা, বিদ্রূপ, লাঞ্ছনা বর্ষিত হয়েছে।’ তবু তিনি এ ব্যাপারে অবিচল থেকেছেন। তদানীন্তন সমাজে ‘বিদ্রোহী’ বলে যে বিশেষণে তিনি বিশেষিত হয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন, ‘বিদ্রোহীর জয়তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালবাসায়। একে অনেকেই কলঙ্কতিলক বলে ভুল করেছে, কিন্তু আমি করিনি।’ তিনি দৃঢ় প্রত্যয়েই বলেছেন, ‘কারুর পান থেকে এতটুকু চুন খসবে না, গায়ে আঁচড়টি লাগবে না, তেল কুচকুচ ভুঁড়িও বাড়বে এবং সমাজও সাথে সাথে জাগতে থাকবে--এ আশা আলেম সমাজ করতে পারেন, আমরা অবিশ্বাসীর দল করিনে।’ বর্তমানে একদল হিসেবী মানুষ সযত্নে দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন। তাঁরা অনেকেই নিজেদের সত্য-স্বীকারের কঠিন বাস্তবকে এড়িয়ে যেতে চান তথাকথিত নিরপেক্ষতার কারণে। কিন্তু সত্য-মিথ্যার মাঝে নিরপেক্ষতার কোন স্থান থাকতে পারে কি?
আজ এই সত্যকে স্বীকৃতি দিতেই হবে যে, নজরুল তাঁর জীবনে কখনও পেছন ফিরে তাকাননি। চেয়েছেন সত্যকারের একদল তরুণ যুবক আসুক যারা সমাজে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসবে। দ্বিধাদ্বন্দ্বকে তিনি ঘৃণা করার আহ্বানই জানিয়েছিলেন; আজও সে কথাগুলি নবীনতর প্রজন্মের কাছে সমানভাবে সত্য। তখন যারা সংগ্রামের পথকে নানা অজুহাতে এড়িয়ে চলত, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘দাসত্ব গোলামী ছাড়িয়া দিলে খাইব কি করিয়া--কি নীচ প্রশ্ন? যেন আমাদের শুধু কুকুর বেরালের মতো উদর পূর্তির জন্যই জন্ম। অনেকে আবার বলেন যে, অন্যে কে কি করিতেছে আগে দেখাও, তাহার পর বলিও। এসব ফাঁকিবাজীর প্রশ্ন। দেশমাতা সকলকে আহ্বান করিয়াছেন। যার বিবেক আছে, কর্তব্যজ্ঞান আছে, মনুষ্যত্ব আছে, সে বুক বাড়াইয়া যাইবে।’ বলেছিলেন--‘বল কারুর অধীনতা মানি না, স্বদেশীর না বিদেশীরও না। যে অপমান করে তার চেয়ে কাপুরুষ হীন সে-ই, যে অপমান সয়। তোমার আত্মশক্তি যদি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে তবে বিশ্বে এত বড় দানব শক্তি নেই যা তোমাকে পায়ের তলায় ফেলে রাখে।’ তারুণ্যের প্রতীক হিসাবে তিনি বলেছেন, ‘তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহার, যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝর্ণার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়-মধ্যাহ্নের মার্তণ্ড-প্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অতল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুঈনের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসমরের সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-জগলুল-সানইয়াৎ-লেনিনের শক্তিতে।’ নিজেকে মানুষের মত মানুষ করে তোলার প্রশ্নে, বিবেকের দ্বারা পরিচালিত করবার জন্য, তিনি বলেছেন, ‘নেতা কে? বিবেকই তো তোমার নেতা, তোমার কর্তব্য-জ্ঞানই তো তোমার নেতা! দেশনায়ক যাঁহারা, তাঁহারা তো তোমার বিবেকেরই প্রতিধ্বনি করেন। কর্তব্যজ্ঞানের কাছে, ত্যাগের কাছে সম্ভব-অসম্ভব কিছুই নাই। সুতরাং ইহা সম্ভব, ইহা অসম্ভব বলিয়া, ছেলেমানুষী করা আর এক বোকামী। যাহা সম্ভব তাহা করিবার জন্য তোমার ডাক পড়িত কি জন্য? অসম্ভব বলিয়াই তো দেশ তোমার বলিদান চাহিয়াছে।’ কবি নজরুল শহীদ ক্ষুদিরামকে সে যুগেও যেভাবে স্মরণ করেছেন আজও সে কথা আমাদের বুকে আঁচড় কেটে যায়--
‘আঠার মাসের পরে
জনম নেব মাসির ঘরে মাগো,
চিনতে যদি না পারো মা
দেখবে গলায় ফাঁসি--
সেই হারা ক্রন্দনের আশ্বাস গান শুনে আজো অতি বড় পাষাণী মেয়েরও চোখে জল আসে, গা শিউরে ওঠে। আমাদের মত কাপালিকেরও রক্তআঁখি আঁখির সলিলে টলটল ক’রে ওঠে। কিন্তু বলতে পার কি দেশের জননীরা, আমাদের সেই হারা ক্ষুদিরাম তোমাদের কার ঘরে এসেছে? তোমরা একবার তোমাদের আপন আপন ছেলের কন্ঠের পানে তাকাও, দেখবে তাদের প্রত্যেকের গলায় ক্ষুদিরামের ফাঁসির নীল দাগ। ক্ষুদিরাম ছিল মাতৃহারা। সে কোন মাকে ডেকে আসব বলে কথা দিয়ে গেছে, কেঁদে গেছে তা যদি বুঝতে বাংলার মায়েরা তাহলে তোমাদের প্রত্যেকটি ছেলে আজ ক্ষুদিরাম হত।’ আজ নতুন যুগসত্যে, নতুন বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত আমরা। আজ এই সত্যকে ভালবাসতে গেলে নজরুল-ক্ষুদিরামদের জীবন থেকে নিতে হবে নির্যাস।
নিপীড়িত মানুষের প্রতি অসীম মমত্ববোধই কবির জীবনের অন্যতম মহৎ
দিক
নজরুলের জীবনসাধনাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, তাঁর আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিপীড়িত জাতির মুক্তির প্রশ্নটিও প্রতিফলিত হয়েছে বারে বারে। চাষী মজুরের উপর নির্মম শোষণ তাঁকে ব্যথিত ও পীড়িত করেছে, সেই শোষণযন্ত্রণা ফুটে উঠেছে তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে। লিখেছেন, ‘...চাষী সমস্ত বৎসর ধরিয়া হাড় ভাঙা মেহনত করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়াও দু-বেলা পেট ভরিয়া মাড়ভাত খাইতে পায় না; হাঁটুর উপর পর্যন্ত একটা টেনা বা নেঙটি ছাড়া তাহার আর ভাল কাপড় পরা সারাজীবনেও ঘটিয়া উঠে না, ছেলেমেয়ের সাধ-আহলাদ মিটাইতে পায় না, অথচ তাহারই ধান-চাল লইয়া মহাজনরা পায়ের উপর পা দিয়া বার মাসে তেত্রিশ পার্বণ করিয়া নওয়াবী চালে দিন কাটাইয়া দেন।’ কাব্যের ছন্দেও এই নির্মম সত্যকে তিনি প্রকাশ করেছেন--
‘জনগণে যারা জোঁকসম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান-সম পালে যারা জমি তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ
মাটির মালিক তাঁহারাই হন’...।
বেদনাহত নজরুল সে সময়ের সমাজে গ্রামীণ জীবনের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রয়োজনে শহরের সৃষ্টি হয়ে পল্লিভূমিতে বাংলার সভ্যতা ও সাধনা লোপ পেতে বসেছে। শাসন এবং শোষণের সহায়তায় যন্ত্রস্বরূপে ভদ্র সম্প্রদায় আত্মবিক্রয় করে শহরে উঠে এসেছেন। গ্রামের আনন্দ উৎসব রোগ শোকের চাপে লুপ্ত হয়ে গেছে। শহরের বেকার বাঙালী আজ বুঝেছে গ্রাম ছেড়ে এসে তার কি নিরুপায় অবস্থাই হয়েছে। ...মহাজনের হাতে জমির স্বত্ব চলে যাচ্ছে। গৃহহীন ভূমিহীন লক্ষ লোক সমাজের অভিশাপ নিয়ে শহরের দিকে ছুটছে, কলকারখানায় কতক ঢুকে নিজেদের সর্বনাশ করছে, আর কতক নানা হীন উপায়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছে। দেশে চুরি ডাকাতি বলাৎকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ...জমিতে চাষীর স্বত্ব নাই। যন্ত্রের অভাবে ভূমির উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হয়েছে। উৎপন্নে প্রজার পূর্ণ অংশ নাই। আমরা গোড়া কেটে আগায় জল দিচ্ছি...।’ মনে হয় যেন নজরুল এ দেশের স্বাধীনতার সত্তর বৎসর উদ্যাপনের সময়কার দৃশ্যকেই বর্ণনা করেছেন।
শ্রমিকদের সম্পর্কে তাঁর কবিতা ও নানান লেখার কথা সর্বজন বিদিত। ‘কুলি মজুর’ কবিতায় বলেছেন, ‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ প্রতি ইঁটে আছে লিখা’। আবার ডাক দিয়েছিলেন ‘রুদ্রমঙ্গল’-এ--‘হে আমার অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক, আমার মুটে মজুর ভাইয়েরা। তোমার হাতের এ লাঙল আজ বলরাম স্কন্ধের হলের মত ক্ষিপ্র তেজে গগনের মাঝে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক। এই অত্যাচারীর বিশ্ব উপড়ে ফেলুক। আনো তোমার হাতুড়ি, ভাঙো ঐ উৎপীড়কের প্রাসাদ--ধূলায় লুটাও অর্থপিশাচ যক্ষগুলোকে’...। (সূত্র: নজরুল জীবনী, অরুণ কুমার বসু) শ্রমিকদের বীভৎস জীবনযন্ত্রণা দেখে বলেছেন, ‘কয়লার খনির কুলিদিগকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি....তাহারা দিবারাত্রি খনির নীচে পাতালপুরীতে আলো-বাতাস হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়া কয়লার গাদায় কেরোসিনের ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করিয়া শরীর মাটি করিয়া ফেলে।...এই কুলিদিগের চেহারার দিকে তাকাইয়া কেহ কখনো চিনিতে পারিবেনা যে, ইহারা মানুষ কি প্রেত-লোক ফেরত বীভৎস নরকঙ্কাল। দোষ কাহাদের?...কারণ পেট বড়ই ‘মুদ্দই’ এবং পেটের জন্যই ইহারা এমন করিয়া আত্মহত্যা করে।...দেশের সমস্ত কলকারখানায়, আড়তে গুদামে ‘ভাবিয়া চিন্তিয়া মানুষ হত্যার’ এইরূপ শত শত বীভৎস নমুনা দেখিতে পাইবেন।’ আজও কৃষক-শ্রমিকের অবস্থা তথৈবচ। বরং দিন দিন শোষণ নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
নবীন যুগের সাহিত্যিকদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের দিকে একটু ভাল করে দেখলে সর্বাগ্রে চোখে পড়ে তার দুটি রূপ। এক রূপে সে... পৃথিবীর উর্ধে উঠে স্বর্গের সন্ধান করে। আর এক রূপে সে এই মাটির পৃথিবীকে অপার মমতায় আঁকড়ে ধরে থাকে। ধূলিমলিন পৃথিবীর এই কর্দমাক্ত শিশু যে সুন্দরের স্বর্গলোকে যেতে চায় না। সে বলে স্বর্গ যদি থাকেই তাকে আমাদের সাধনা দিয়ে এই ধূলির ধরাতে নামিয়ে আনব। আমাদের পৃথিবী চিরদিন তার দাসীপনা করেছে। আজ তাকেই এনে আমাদের মাটির মায়ের দাসী করব।’ জনসাহিত্য প্রসঙ্গে তিনি এও বলেছেন, ‘জনসাহিত্যের উদ্দেশ্য হল জনগণের মতবাদ সৃষ্টি করা এবং তাদের জন্য রসের পরিবেশন করা। বক্তৃতা প্রবন্ধ তাদের প্রাণে দাগ কাটতে পারে না...যা বলবার বলতে হবে কিন্তু যেন মাস্টারীভাবে ধরা না পড়ে।....তাদেরই একজন হতে হবে। তাদের কাছে টর্চলাইট হাতে নিয়ে গেলে তারা সরে দাঁড়াবে। --কেরোসিনের ডিবে হাতে করে নিয়ে গেলে তার থেকে যত ধোঁয়াই বের হোক না কেন তাদের আকর্ষণ করবেই।’ সেই সময়ের একদল সাহিত্যিক যারা জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটির সাথে সম্পর্কহীন তত্ত্বের চর্চা করেছেন তাদের প্রতি তিনি বলেছেন, ‘আজকাল আমাদের সাহিত্য বা সমাজনীতি সবই টবের গাছ। মাটির সাথে সংস্পর্শ নেই। কিন্তু জনসাহিত্যের জন্য জনগণের সাথে যোগ থাকা চাই। যাদের সাহিত্য সৃষ্টি করব তাঁদের সম্বন্ধে না জানলে কি করে চলে?’ সাম্যবাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিলে আবেগমুখর।
সমাজতন্ত্রবাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণও আমরা জানি। বিশ্বে প্রথম শোষণমুক্ত সোভিয়েত সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং গণমুক্তির বাস্তবতার তরঙ্গ মানবতাবাদী নজরুলের মধ্যেও আলোড়ন তুলেছিল। বর্তমান বিশ্বসাহিত্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি তাই বলেছিলেন, ‘দূর সিন্ধু তীরে বসে ঋষি কার্ল মার্কস যে মারণমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন তা এতদিনে তক্ষকের বেশে এসে প্রাসাদে লুক্কায়িত শত্রুকে দংশন করলে। জার গেল, জারের রাজ্য গেল—ধনতান্ত্রিক প্রাসাদ হাতুড়ি শাবলের ঘায়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।...কার্ল মার্কসের ইকনমিক্সের অঙ্ক এই যাদুকরের হাতে পড়ে আজ বিশ্বের অঙ্কলক্ষ্মী হয়ে উঠেছে। পাথরের স্তূপ সুন্দর তাজমহলে পরিণত হয়েছে। ভোরের পাণ্ডুর জ্যোৎস্নালোকের মত এর করুণ মাধুরী বিশ্বকে পরিব্যাপ্ত করে ফেলেছে। রাশিয়া দিয়েছে রেভোলিউশনের মর্মান্তিক বেদনার অসহ্য জ্বালা। ...রাশিয়া বলে, এ বেদনাকে পুরুষশক্তিতে অতিক্রম করব, ভুজবলে ভাঙব এ দু:খের অন্ধ কারা।’ কোথাও কোথাও এই শক্তির সাথে একাত্ম হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর কবিতায়--
‘.....আয়ারল্যান্ড, আরব, মিশর, কোরিয়া চীন
নরওয়ে স্পেন, রাশিয়া, সবার ধারিগো ঋণ
তাদের রক্তে মোদের লহুর আভাস পাই
এক বেদনার কমরেড ভাই মোরা সবাই’
শ্রমিকস্বার্থ রক্ষার জন্য নজরুল ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘দি লেবার স্বরাজ পার্টি অব ন্যাশানাল কংগ্রেস’ গঠন করে। তার মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’। এই পত্রিকাতে সমাজতন্ত্রবাদের সপক্ষে লেখা থাকত। মার্কস, লেনিন, সোভিয়েত রাশিয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে লেখা থাকত। এমনকি এই পত্রিকার একটি সংখ্যায় সাম্যবাদের প্রতীক কাস্তে হাতুড়িও ছাপা হয়েছিল। এই উপমহাদেশে প্রথম এরকম পত্রিকা ছিল এটিই। প্রথম সংখ্যায় প্রথম কবিতাই ছিল ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ। দ্বিতীয় সম্মেলনে অবশ্য এই দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বঙ্গীয় কৃষক শ্রমিক দল—দি বেঙ্গল পেজান্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি। লাঙল বন্ধ হওয়ার কয়েক মাস পরে নাম পরিবর্তন করে গণবাণী নামে প্রকাশিত হয় আবার। তার প্রথম পৃষ্ঠাতেই থাকত ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। এই পত্রিকাতেই আন্তর্জাতিক সংগীত তার ভাবধারাকে ছড়িয়ে দিল সারা বিশ্বে। এবং তা আজও যে কোনো কিছুর চেয়ে জীবন্ত’—তার বাংলা অনুবাদ করেন নজরুল ইসলাম—‘অন্তর ন্যাশানাল সংগীত’ নাম দিয়ে।
জীবনের মর্মান্তিক বেদনাময় অন্তিমকাল
অথচ এরকম একজন আপসহীন কবির শেষ জীবন বড়ই মর্মান্তিক। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর বেঁচেছিলেন চূড়ান্ত অবহেলায়। পুরোপুরি অসুস্থ হওয়ার আগেও তিনি জীবন-যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তাঁরই এক লেখায় তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ের সে দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছিল। পুত্রশোকাতুর নজরুল গভীর বেদনায় বলেছেন, ‘আমার সুন্দর পৃথিবীর আলো এক নিমেষে নিভে গেল। আমার আনন্দ, আমার কবিতা, হাসি, গান যেন কোথায় পালিয়ে গেল, আমার বিরহ আমার বেদনা সইতে না পেরে। এই প্রথম আমার প্রশ্ন জাগল—কোন নিষ্ঠুর এই সৃষ্টি করে, কেন সে শিশু সুন্দরকে কেড়ে নেয়? ...গোপনে পড়তে লাগলাম বেদান্ত, কোরান। আমার পৃথিবীর আকাশ কোন বজ্রনাদে ও তড়িৎলেখা্র তলোয়ারে বিদীর্ণ হয়ে গেল।’ আবার এর বিপরীতে তিনি ভেবেছেন, ‘আমি ব্রহ্ম চাই না, আল্লাহ চাই না, ভগবান চাই না। এসব নামের কেউ যদি থাকেন তিনি নিজে এসে দেখা দিবেন। আমার বন্দিনী মাকে অসুরের অত্যাচার থেকে উদ্ধার করে আবার পূর্বশ্রীসুন্দর, আনন্দসুন্দর না করা পর্যন্ত আমার মুক্তি নেই, আমার শান্তি নেই।’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের নিরসন হয়নি সেদিন তাঁর জীবনে। যাঁরা সাম্যবাদী বলে পরিচয় বহন করতেন সেদিন, তাঁরা যেহেতু যথার্থ সাম্যবাদী ছিলেন না, তাই তাঁরা খুবই ঘনিষ্ঠসংস্পর্শে পেয়েও কবিকে পথ নির্দেশ করতে পারেন নি। বার বার মনে হয়, সেই উজ্জ্বল দিনগুলিতে অমূল্য রত্নের মত ভারতের আকাশে ছায়াপথ সৃষ্টি করেছিল যে মহান মনীষীরা, সাম্যবাদী দর্শনের তদানীন্তন ধারক-বাহক বা দাবীদার যাঁরা, তাঁরা সেদিন তাঁকে বুঝতে পারেননি—পথ দেখাতে পারেননি। মানবতাবাদী গোর্কী দার্শনিক লেনিনের সান্নিধ্যে সাম্যবাদী সাহিত্যিক হিসাবে তার ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ এদেশের দুভার্গ্য যে, যথার্থ সাম্যবাদী আদর্শের অভাব কবি নজরুলকে অগ্রবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে ব্যর্থ করেছে। যদিও এই দায়িত্ববোধটুকুও তাদের পরিলক্ষিত হয়নি। ‘নজরুল অধ্যাত্মবাদী’ হয়ে গিয়েছিলেন, ‘সে যে নিজেকে বারে বারে নাস্তিক বলে ঘোষণা করেছিল তা ছিল তার আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতত্ত্বের হাত থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা’, এইরূপ দু’একটি মন্তব্যের দ্বারা তারা তাদের অপরাধ স্খালন করেছেন। কিন্তু তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও কেন এমন মর্মান্তিক পরিণতি ঘটতে পারল, তার জ্বালা, অনুশোচনা বিন্দুমাত্রও তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।
আজ আমরা নতুন সমাজে বাস করছি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সাত দশক আগে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। এদেশের আপসহীন বিপ্লবীদের স্বপ্ন আজও অপূর্ণ। অপূর্ণ নজরুলের শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এ যুগ প্রতীক্ষা করে আছে আর একটি সমাজ পরিবর্তনের। সেইটাই এ যুগের সত্য। যতদিন সুস্থ ছিলেন ততদিন কবি নজরুল ছিলেন বিগত যুগ-সত্যের আপসহীন সাধক—আমরা বর্তমান যুগ-সত্যকে কঠিন হলেও যথার্থভাবে আমাদের জীবনে ভালবাসতে পারব কি? কবি হিসাবে সাহিত্য-সংগীত-শিল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের সৌন্দর্য্যক্ষুধা থেকেই কাব্যের সৃষ্টি, কবির জন্ম।...এই সৌন্দর্য্যের অমৃত পরিবেশনের ভার কবি ও সাহিত্যিকদের হাতে। এ পথে হয়ত সাহিত্যিকদের দু:খ কষ্ট আছে অনেক, কিন্তু তাদের ভীত হলে চলবে না।’ তিনি আরও বলতেন, ‘বেদনা সুন্দরের গান গেয়েছি বলেই কি আমি সত্য সুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি?’ এ প্রশ্ন মানুষের শুভবুদ্ধির কাছেই উত্থাপিত। তিনি অসীম প্রত্যয়ে বলেছেন, ‘এই বেদনার গান গেয়েই আমাদের নবীন সাহিত্যস্রষ্টাদের নতুন সিংহাসন গড়ে তুলতে হবে। তারা যদি কালিদাস, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি রূপস্রষ্টাদের পাশে বসতে নাই পায়—পুশকিন, দস্তায়ভস্কি, হুইটম্যান, গোর্কি, যোহান বোয়াবের পাশে ধূলির আসনে বসবার অধিকার তারা পাবেই। এই ধূলির আসনই একদিন সোনার সিংহাসনকে লজ্জা দেবে; এই তো আমাদের সাধনা।’
সমাজ চেতনা থেকে দূরে গিয়ে কাব্যসাধনার পথকে তিনি চিরকালই পরিহাস করেছেন। তিনি বলতেন--‘ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি হাত আমার হাতে বোঝা। কিন্তু তাই বলে আমি ফেলে দিইনি। সুর আমার সুন্দরের জন্য, আর তরবারি সুন্দরের অবমাননা করে যে--সেই অসুরের জন্য। এরকম প্রাণচঞ্চল সত্যসুন্দরের সাধক আর এক কবির অভ্যুত্থানের প্রতীক্ষায় রয়েছি আমরা। যৌবনের কাছে তাঁর আবেদন আজও অনুরণিত হয়--‘জরাগ্রস্ত পুরাতন পৃথিবী চেয়ে থাকে যুগে যুগে তোমাদের এই কিশোরদের এই তরুণদের পানে। ...কত কাজ তোমাদের--ধরণীর দশদিক ভরে কত ধূলি, কত আবর্জনা, কত পাপ, কত বেদনা--তোমরা ছাড়া কে তার প্রতিকার করবে? কে তার এলাজ করবে? তোমাদের আত্মদানে, তোমাদের আয়ুর বিনিময়ে হবে তার মুক্তি। শত বিধিনিষেধের, অনাচারের জিঞ্জীরে বন্দিনী এই পৃথিবী আজাদীর আশায় ফরিয়াদ করছে, তোমাদের প্রাণের দরবারে--তার এ আর্জি কি বিফল হবে?’ প