গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পরিবেশের সার্বিক সংকট আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। অরণ্য উচ্ছেদ, প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান অভিযান, জল-বায়ু-মৃত্তিকা দূষণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন সেই সংকটের মূলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যের এক নতুন তত্ত্বের জন্ম হয়। ১৯৭৮ সালে উইলিয়াম রুখার্ট সেই তত্ত্বের নাম দেন: ইকোক্রিটিসিজম। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও মমতা, মানব ও প্রকৃতির অন্তরঙ্গ, নিগূঢ় সম্পর্ক সম্বন্ধে সচেতনতা ইকোক্রিটিসিজমের মূল কথা। চেরিল গ্লটফেল্টির মতে নদ-নদী-মরুভূমি-পর্বত-শহর-প্রযুক্তি-মানবশরীর-সংস্কৃতি সব কিছুই এর অর্ন্তগত [The Ecocriticism Reader]। ইকোক্রিটিকরা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য—বিশেষ করে কালিদাসের শকুন্তলা নাটকটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
মহাভারতের আদিপর্বে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার যে উপাখ্যান আছে সেটি অবলম্বন করে কালিদাস শকুন্তলা নাটক রচনা করেন। বিদ্যাসাগর সঠিকভাবেই বলেছেন: উভয়বিধ শকুন্তলোপাখ্যান পাঠ করিলে বুঝিতে পারা যায়, কালিদাস মহাভারতীয় উপাখ্যানে কি অদ্ভুত কৌশলে অলৌকিক চমৎকারিত্ব সমাবেশিত করিয়াছেন।
সেই অলৌকিক চমৎকারিত্ব হল প্রকৃতি ও মানব জগতের সমন্বয়। কেউ বলতে পারেন এ রচনায় প্রকৃতির কোলে মানবের কাহিনি আছে, কিন্তু বিশুদ্ধ প্রকৃতির কথা নেই। এ অভিযোগ সঠিক নয়। কালিদাস বলতে চেয়েছেন মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সে সুখে থাকে, প্রকৃতিবিযুক্ত হলে তার মানসিক সংকট সৃষ্টি হয়। আরণ্যক সভ্যতা আর নগর সভ্যতার বিভাজন রেখাও চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন কালিদাস।
নগরসভ্যতার প্রতিনিধি রাজা দুষ্মন্ত। শিকার করতে গিয়ে তিনি ঢুকে পড়েছেন কণ্বের তপোবনে। তপোবনের ধারণার মধ্যেই প্রকৃতি ও মানবের নিগূঢ় সম্পর্কের কথা আছে। তপোবনে হিংসার স্থান নেই, রিরংসার জ্বালা নেই, লোভের প্রদাহ নেই। এখানে মানুষ আর প্রকৃতি আর মানবেতর প্রাণীরা নির্বিবাদে বাস করে। তাদের সম্পর্ক খাদ্য-খাদকের নয়, বন্ধুত্বের, সহমর্মিতার। রাজা দুষ্মন্ত সেসব কথা জানেন না, অথবা জানলেও সেসবকে কথার কথা মনে করেন। অরণ্যের কেউ নন তিনি। তিনি তো বহিরাগত। তিনি শিকারের আনন্দে এক হরিণের দিকে তির নিক্ষেপ করতে যাচ্ছেন। তাঁকে নিবৃত্ত করে এক তপস্বী বললেন: মহারাজ, আশ্রমমৃগ বধ করবেন না—রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: মৃদু এ মৃগদেহে মেরো না শর/ আগুন দেবে কেহে ফুলের পর।
কতদিন আগের তপস্বীর এই কাতর অনুরোধ সভ্যতাগর্বী একবিংশশতাব্দীর পরিবেশসচেতন মানুষেরও অনুরোধ। অরণ্যের মতো আরণ্যক প্রাণী ধ্বংস করে আমরা নিজেদের কবর খুঁড়ে চলেছি ক্রমাগত। মানবেতর প্রাণীরাও যে কোন না কোনভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে সে কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। শুধু তাই নয়, দুষ্মন্তের আচরণে প্রতিফলিত হয় সভ্য ও বুদ্ধিমান মানুষের অকারণ প্রাণীহত্যার উল্লাস। তপস্বী রাজাকে আরও বলেছেন: শরাসনে যে শর সংহিত করেছেন আশু তার প্রতিসংহার করুন; আপনার শস্ত্র আর্তের পরিত্রাণের জন্য, নিরপরাধের প্রহারের জন্য নয়। তপস্বীর এই কথাগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় Marwin-এর ভাবনা: The earth is still a very beautiful place. It is seen as an object of exploitation rather than as something of which we are apart…. So when we treat it with contempt and we exploit it, we are despising ourselves [Ecopoetry./ Scott. Bryson].
সোমতীর্থ থেকে ফিরে আসার পর কণ্ব শকুন্তলা-দুষ্মন্ত বৃত্তান্ত এবং শকুন্তলার গর্ভসঞ্চার বৃত্তান্ত শ্রবণ করলেন; অতঃপর তিনি শকুন্তলাকে পতিগৃহে প্রেরণের জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। তপোবন তরুদের সম্বোধন করে তিনি বললেন: হে সন্নিহিত তরুগণ! যিনি তোমাদের জলসেচন না করে কদাচ জলপান করতেন না, ভূষণপ্রিয়া হয়েও কদাচ যিনি তোমাদের পল্লবভঙ্গ করতেন না, তোমাদের কুসুমপ্রসবের সময় উপস্থিত হলে যাঁর আনন্দের সীমা থাকত না, সেই শকুন্তলা আজ পতিগৃহে যাচ্ছেন, তোমরা সকলে অনুমোদন করো।
এই উক্তি থেকে শকুন্তলার সঙ্গে অরণ্য ও বৃক্ষলতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক প্রতিভাত হয়। তোমরা সকলে অনুমোদন করো--অর্থাৎ এখানে উদ্ভিদজগতকে প্রাণবান পদার্থ বলে মনে করা হচ্ছে। আধুনিককালে বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু এবং ফরাসি বিজ্ঞানী টেইলহার্ড শার্ডিন উদ্ভিদের প্রাণের স্পন্দন ও সংবেদনশীলতা প্রমাণ করেছেন। মহর্ষি কণ্ব শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার ব্যাপারে যাদের অনুমোদন প্রার্থনা করেছেন, তাদের জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ অবগত ছিলেন শকুন্তলা। এইতো জীবনে জীবন যোগ করা।
বৃক্ষলতার মতো আরণ্যক প্রাণীরাও যেন আশ্রম থেকে শকুন্তলার বিদায়গ্রহণে শোকমগ্ন। এক পূর্ণগর্ভা হরিণীকে দেখে শকুন্তলা কণ্বকে বলেন: এই হরিণী নির্বিঘ্নে প্রসব হইলে আমায় সংবাদ দেবে, ভুলবে না। তারপর কিছুটা অগ্রসর হলে তিনি বুঝতে পারলেন কে যেন তাঁর অঞ্চল আকর্ষণ করছে। কণ্ব বললেন: বৎসে! যার মাতৃবিয়োগ হলে তুমি জননীর মতো প্রতিপালন করেছিলে, যার আহারের জন্য তুমি সর্বদা শ্যামাক আহরণ করতে, যার মুখ কুশের অগ্রভাগ দ্বারা বিক্ষত হলে তুমি ইংগুদিতেল দিয়ে ব্রণশোষণ করে দিতে, সেই মাতৃহীন হরিণশিশু তোমার গতিরোধ করছে।
দুষ্মন্তের স্মৃতিকে জাগ্রত করার জন্য শকুন্তলা যে পূর্বকথা তুলে ধরেছিলেন তার মধ্যেও প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর অর্ন্তগূঢ় সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে। শকুন্তলা বলছেন: একদিন তুমি ও আমি নবমালিকামণ্ডপে বসে ছিলাম। তোমার হাতে একটি জলপূর্ণ পদ্মপত্রের ঠোঙা ছিল। সেই সময় আমার কৃতপুত্র দীর্ঘাপাঙ্গ নামে মৃগশাবক সেখানে উপস্থিত হল। তুমি তাকে জলপান করতে আহ্বান করলে সে সেই ডাকে সাড়া দিল না। তারপর আমার ডাকে সাড়া দিয়ে জলপান করল। তুমি পরিহাস করে বললে, সকলেই স্বজাতীয়ে বিশ্বাস করে; তোমরা দুজনেই বুনো তাই সে তোমার কাছে গেল।
পরিহাস করতে গিয়ে দুষ্মন্ত সত্য কথাই বলেছিলেন। শকুন্তলা অরণ্যের অঙ্গ, দুষ্মন্ত বহিরাগত। আবার শকুন্তলা যখন দুষ্মন্তের রাজসভায় গেলেন তখন তিনি সেখানে বহিরাগত। Natural habitat ছেড়ে আসায় শকুন্তলা বিচ্ছিন্নতা বোধ করছেন, অস্থির হয়ে উঠছেন। বাসস্থানগত ও সংস্কৃতিগত এই বিচ্ছিন্নতা বোধ করে পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ, যখন নগরায়ন ও শিল্পায়নের জন্য মানুষকে তার natural habitat ছেড়ে আসতে হয়।
রাজা দুষ্মন্ত কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবার পরে শকুন্তলা জীবনত্যাগের সিদ্ধান্ত করেন। তখন এক মৎস্যকন্যা তাঁকে নিয়ে যান মারীচের আশ্রমে। নগরসভ্যতা থেকে শকুন্তলা ফিরে আসেন প্রকৃতির মধ্যে। শান্ত হয় তাঁর মন। এই আশ্রমেই দুষ্মন্তের সঙ্গে তাঁর পুর্নমিলন হল। এ শুধু দুটি নরনারীর মিলন নয়, এ যেন অর্ন্তসত্তা ও বর্হিসত্তার মিলন। ড. বাসুদেব কৃষ্ণচর্তুবেদী দুষ্মন্ত-শকুন্তলার মিলনের নতুন ব্যাখ্যা দি্যেছেন: Basically this union is not the union of two separated lovers but the re-establishment of the perpetual unification of the inner self and the external environment.