রবীন মণ্ডল ২০১৮-র শুরুতে ৯০ বছরে পা রাখলেন। এই মুহূর্তে তিনি প্রবীণতম বাঙালি চিত্রকর। এখনো তিনি প্রতিদিন ছবি আঁকেন এবং সভা-সমিতি ও চিত্রপ্রদর্শনীতে যান। তাঁর এই নিরলস কর্মজীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর ছবি চিরকালের মানবযাত্রার অসামান্য চিত্ররূপ। তার ছবি শুধু ভারতবর্ষে নয়, ভারতবর্ষের বাইরেও বহু চিত্রশালায় স্থান পেয়েছে। তার জীবনের কিছু কথা এই সাক্ষাৎকারে লিপিবদ্ধ করা গেল। এই সংখ্যায় তাঁর সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ মুদ্রিত হল।
পরবাস : আপনার ছবি আঁকার এই দীর্ঘ জীবনের কথা অনেকে জানতে চায়, বিশেষ করে এই জন্য যে আপনার ছবি এতই আলাদা আর ব্যক্তিত্বচিহ্নিত এবং মানবিক যে আপনাকেই এখন সবাই, অন্তত: পশ্চিমবঙ্গে, ভারতবর্ষেও বটে, মাথায় রাখেন। আপনি একজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পী। আপনার কথা একটু শুনতে হবে। প্রথমত আপনার পারিবারিক কথা এবং শৈশবের কথা একটু বলুন।
রবীন মণ্ডল : আমাদের বাড়ি হচ্ছে কারখানাওলা বাড়ি। যদিও খুব লড়াকু ব্যাপার ছিল। লড়তে হয়েছিল সে যুগে। অনেকগুলো ভালো ভালো কারখানার জন্ম দিয়ে শেষপর্যন্ত বাবা একখানা ছোট কারখানা করে ফেলেছিলেন। যেমন একটা নামকরা কারখানা ছিল তখনকার দিনে অ্যাটলাস উইথব্রিজ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। সেটা পারিবারিক সবাই দেখাশোনা করতেন। সেজ জ্যাঠামশাই, বাবা এবং আরো বাইরের দু-চারজন। তারপরে যা হয়, বাবা বোধহয় ওটাতে খুব একটা সন্তুষ্ট হচ্ছিল না, নিজে একটা অন্য ব্যাপার করে — এক বন্ধুর সঙ্গে, পূর্ববঙ্গের এক বাঙালি ভদ্রলোক, তিনি বললেন আমি কিছু ইনভেস্ট করব, আপনি যদি থাকেন। যাইহোক তার কথা শুনে বাবা তাকে একটা কারখানার ব্যবস্থা করে দেন। বাবা ছিলেন সেখানে। তখনকার একটা বড় কারখানা ছিল গঙ্গার ধারে বার্ণ কোম্পানীর পাশে। মেইনলি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ছিল। মানে ব্রিজ এইসব তৈরি করার ব্যাপারে। বাবা সেখানে বোধহয় বছর পাঁচ-ছয় এর একটা অ্যাপ্রেন্টিসশিপ কোর্স করেছিল, যার জন্য বাবার মিস্ত্রী হিসেবে স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রিতে সুনাম ছিল পশ্চিমবঙ্গে তথা ইস্টার্ন রিজিয়নে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরের অনেক লোকও তাঁর কাছে ইনভেস্ট করতে চাইত। বলত, যে গৌরবাবু আপনি থাকলে আমি একটু ইনভেস্ট করব। বাবা অতদূরে যাননি। পূর্ববঙ্গের এক ভদ্রলোক মুখার্জিবাবু বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা কারখানার ব্যবস্থা করেন। হাওড়া স্টেশন থেকে কখনো বি.এন. আর লাইনের গাড়িতে চড়ে যাবার সময় দেখবেন ফাঁকা মাঠে এক প্রাসাদোপম বাড়ি। ঘোষেদের বাড়ি। ঐ ঘোষেরা বাবার ওপর নির্ভর করে কারখানায় অনেক ইনভেস্ট করেছিলেন। বাবা তাদের পরামর্শদাতা ছিলেন কিন্তু টাকাপয়সার কোন ব্যাপার ছিল না। বাবার ইচ্ছে ছিল যে তিনি নিজে একটা আলাদা কারখানা করবেন। ফাইনালি করেওছিলেন। তা আমরা সব সুপুত্র বলে (হাসি) কারখানার লাইনে আমি যাইনি। দাদাও বেরিয়ে গেল। ফলে এক ভাইপো আর বাবা মিলে কারখানাটা চালিয়েছিল বহুদিন। পরবর্তীকালে হিরন্ময় ঘোষাল বলে একজনের নাম শুনেছেন? যিনি পোল্যান্ডে যুদ্ধের সময় ফিরেছিলেন। পোল্যান্ডের লোকজন তাকে বলেছিল আমাদের দেশের একটা মেয়েকে নিয়ে গেলে তবে তোমাকে ছাড়ব। সেই পোল্যান্ডের মেয়েকে বিয়ে করে তিনি কলকাতায় ফিরেছিলেন। মেয়েটি দেখতে ছিল অপরূপা সুন্দরী এবং একটু-আধটু ইংরিজিও বলতে পারত। সেই হিরন্ময় ঘোষালের এক ভাই, জ্যোৎস্নাময় ঘোষাল তিনি ওই মুখার্জিবাবুর তরফ থেকে কারখানা দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। মুখার্জিবাবু বলে দিয়েছিলেন গৌরবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ না করে নিজে থেকে কিছু করব না। উনি সেকথা মান্য করেছিলেন, লোকও ভাল ছিলেন। যা-হোক, সে কারখানা খুব ভালো ব্যবসা করেছিল। বাবাকে বোধহয় ফাইনালি শেয়ারও দিয়েছিলেন। Apart from his service একটা শেয়ার দিয়ে দিয়েছিলেন। ধরুন ১২ হলে তুমি ৪, আমার ৮ এইরকম একটা ব্যাপার হয়েছিল।
পরবাস : আপনার পরিবারের যে একটা সঙ্গীতচর্চার ব্যাপার ছিল আপনি বলতেন, সেইটা নিয়ে একটু বলুন।
রবীন মণ্ডল : সেটা তো আমাদের বাড়িতে একটা ব্যাপার ছিলই। প্রথম হচ্ছে বড়ো জ্যাঠামশাইয়ের একটু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ঝোঁক ছিল। উনি পাখোয়াজ বাজাতেন। মৃদঙ্গমও। সেইসূত্রে বাড়িতে বঙ্গীয় তথা বর্হিবঙ্গের বহু গুণী মানুষ আসতেন। তাঁরা গান-বাজনা করতেন। জ্যাঠামশাইকে লোকে যোগেন মোক্তার নামেই বেশি চিনত। মোক্তার জানেন তো... (হাসি)। তা আমার মনে হয় মোক্তারিতে বিশেষ কিছু হত না। এই গান-বাজনা নিয়েই থাকতেন। ছেলেপুলে ছিল না; আমরা তার ভাগিদার আর কি। তিনি বড়, আর আমরা ছোটকত্তার ছেলে। জ্যাঠামশাইয়ের পুরো সম্পত্তি থেকে শুরু করে সুনাম দুর্নাম সব আমাদেরই ঘাড়ে। যাইহোক গান-বাজনার চর্চাটা আমাদের বাড়িতে ছিল। বাবা কারখানায় কাজ করলে কি হবে বাড়িতে ফিরেই হয় ভায়োলিন নয় ক্ল্যারিওনেট। মেজকত্তা একটু উল্টোপাল্টা লোক ছিলেন। সন্ধেবেলা ড্রিঙ্ক করে পড়ে থাকলেও সেতার নিয়ে বসে যেতেন। একমাত্র সেজকত্তা--তিনি একটু অন্য টাইপের। তিনি ব্যাপারটা বুঝতেন, এসব পাগলামিতে যেতেন না, তিনি কারখানাগুলোকে দেখতেন। আমাদের ফ্যামিলির যে কারখানাটা হয়েছিল তাতে বড় জ্যাঠা গান-বাজনার লোক বলে তাকে না করে জ্যাঠামশাইকে আমরা ডাইরেক্টর করেছিলুম। জ্যাঠাইমা, সেজ জ্যাঠামশাই, বাবা আর একজন বাইরের লোক।
পরবাস : আপনার পরিবারের তো আরো গৌরবময় দিক আছে। আপনার ঠাকুরদাদার নামে রাস্তা আছে। ফকিরদাস মণ্ডল লেন...
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ। সে তো আছে। সে ঠাকুরদার ছেলেপুলেরা হাওয়া দিয়ে বাবাকে তুলে দিয়েছিল আর কী হবে। মেন পঞ্চানন তলা রোড থেকে ঢুকলেই ফকিরদাস মণ্ডল লেন পড়ে যায়।
পরবাস : ফকিরদাস মণ্ডলের কথা বলুন একটু।
রবীন মণ্ডল : ফকিরদাস মণ্ডল মুহুরীর কাজ করেছেন। তা এমন একটা পপুলারিটি ছিল সে যুগে যে নামকরা মুহুরীরাও ছোটখাট কেসগুলো পরিচালনা করত। তার ফলে লোকাল এরিয়াতে আমাদের একটা প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। সেজজ্যাঠামশাই সেটাকে আরো এনহ্যান্স করেছিলেন আর বাবা কারখানার লোক বলে বাবাকে মোটামুটি হাওড়ার তথা কলকাতার স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রির যারা মালিক তারা চিনতেন এবং বিপদে পড়লে ডাকত। ইন্ডাস্ট্রি লেভেলের আলামোহন দাসের মতো লোকও আমাদের বাড়িতে এসে সেজ জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে, বড় জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে গেছেন। বাবা কিন্তু আলামোহন দাসকে খুব পাত্তা দিতেন না। বলত বড্ড মুখে জগৎ জয় করছেন, আসল কাজ খুব কম। যাইহোক তাঁর অনেক গুণ ছিল, বাবা যতই বলুক। সেই যুগে নয় নয় করে বাইশশো লোক কাজ করত তাঁর অফিসে/কারখানায়।
পরবাস : আপনি তার মানে কারখানার দিকে গেলেন না। গানের দিকে গিয়েছিলেন কি?
রবীন মণ্ডল : না, আমি বাড়িতে একটা অ্যাক্সিডেন্টে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলুম। তখন ওই বাড়িতে ভাইবোনদের পয়সা দিয়ে বসাতুম আর ড্রয়িং করতুম। বাড়িতে ড্রয়িং বুক এনে দিয়েছিল, বাবা সেটায় উৎসাহিত করত। তুই কর, আমি ড্রয়িং বই এনে দেব, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে V. R. Foster বলে একটা ড্রয়িং বুক; বিদেশে ছাপা, খুব পারফেক্ট ড্রয়িং--মানে--শেখার পক্ষে ভালো।
পরবাস : আপনার নব্বই বছরের জন্মদিন হল সেটার আহ্বায়ক ছিলেন অশোক মিত্র, শম্ভু ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দেবেশ রায়, যোগেন চৌধুরী সবাই ছিলেন। তা সেইখানে শঙ্খ ঘোষ একটা কথা বললেন যে আপনার ছোটবেলায় বাড়িতে সে সাঙ্গীতিক পরিবেশ সেই সাঙ্গীতিক পরিবেশ থেকে সুর পেয়েছিলেন আপনি। এবং সেই সুর আপনার ছবিতেও এসেছে। এই কথাটা খুবই signficant.
রবীন মণ্ডল : সেটা হয়ত তিনি বলেছেন ঠিকই। বাড়ির সাঙ্গীতিক একটা ব্যাপার ছিল। আর আসর জমাবার জন্য সেইসময় বঙ্গীয় শিল্পীরা আসতেন, তখন ঘটি-বাঙাল কথাটা অত চালু ছিল না। তারা এসে বাজিয়ে, গান গেয়ে চলে যেতেন। তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে হেল্প করার জন্য কিছু ধনী ব্যক্তি ছিলেন। যাবার সময় তাঁকে পাঁচশো টাকা দিয়ে দিলেন। মকু মুখুজ্জে বলে একজনের বাড়ি ছিল রাস্তার ধারে, জ্যাঠামশায়কে খুব ভালোবাসত। সে বলে আমার বাড়িতে আপনি অনুষ্ঠান/আসর বসান আমার কোন আপত্তি নেই।
পরবাস : কালীপদ পাঠক তো আপনার জ্যাঠামশায়ের বন্ধু ছিলেন?
রবীন মণ্ডল : কালীপদ পাঠক আমাদের বাড়িতে খুবই আসতেন। আমাদের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। বাড়িতে এসেই জ্যাঠামশাইকে বলতেন হারমোনিয়ামটা বার করতে বলো দাদা। জ্যাঠামশাই বলতেন, আরে বৌ তো তোমায় বাজার করতে পাঠিয়েছেন, তুমি...! ও বাজার পরে যাবখন, তুমি হারমোনিয়াম তবলাটা নামাও। জ্যাঠামশাই অমনি 'কে আছিস রে' করে হাঁক পাড়তেন। আমি বা দাদা হারমোনিয়াম তবলা বার করে দিতাম। জ্যাঠামশাই বলতেন তোর জেঠিমাকে বল কালীবাবু এসেছেন। জেঠিমা একটু লুচিটুচি ভেজে, আলুরদম করে চা-টা খাইয়ে অতিথি সৎকার করতেন। আর সেই খাওয়ার পর থেকেই কালীবাবু আমার জেঠিমাকে বলতেন বৌদি আমি আবার সামনের রবিবার আসছি। আমার বৌ রান্না করতে জানে না। হঠাৎ একদিন তারাপদবাবু এসে জ্যাঠামশাইকে বললেন দাদা একজন গুণী লোককে এনেছি। তিনি কে? না ভীমসেন যোশী! তারাপদবাবু বললেন একটু গান-বাজনা হবে না! জ্যাঠামশাই বললেন ওরে হারমোনিয়াম তবলাটা বার করে দিতে বল। দুটো একটা গান তিনি গাইলেন। জ্যাঠাইমা তাঁকে ও কালীবাবুকে একটু লুচিটুচি ভেজে খাইয়ে অতিথিসেবা করলেন।
আর একটা ব্যাপার হল আমাদের বাড়িতে, আমার মামা খুব বড় প্লেয়ার ছিলেন। অলইন্ডিয়া ফেমাস। Both ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল খেলেছিল। ঝগড়া করে ইস্টবেঙ্গলে চলে যান।
পরবাস : আপনার মামার নাম কি ছিল?
রবীন মণ্ডল : মনি দাস। আরেকজন ছিলেন মনা দাস। মনা দাসও খুব নাম করা প্লেয়ার ছিলেন একসময়। মনি দাস ও মনা দাসের মধ্যে বারো-চোদ্দ বছরের তফাত।
পরবাস : আপনি যে শৈশবে অনেকদিন গৃহবন্দী ছিলেন সে ব্যাপারে একটু বলুন...
রবীন মণ্ডল : সে তো আমি অসুস্থ বলে। আমার হাঁটুতে এমন একটা অসুখ করেছিল চারবছর আমাকে শয্যাশায়ী করে রেখেছিল। সেইসময় ছবি আঁকাটা পেয়ে বসে। হাত ধরে ধরে বারান্দায় গিয়ে বসে ছোট ছোট ভাইবোনদের বলতুম তোকে এক আনা পয়সা দেব তুই একটু বোস। দুমিনিট বসেই চলে যাবে। আমি বলতুম তাহলে এক আনা দেবনা, এক পয়সা দেব। কেউ কেউ বসত। তখন আঁকতুম, দেখতাম একটা মোটা মুখের মতো হয়েছে। এই করে ড্রয়িংটা আমি লাইফ থেকে আয়ত্ত করতে পেরেছিলুম।
পরবাস : এই অসুস্থতার ব্যাপারটা আপনার কত বছর বয়স থেকে...
রবীন মণ্ডল : তা প্রায় ১৪ – ১৬ বছর বয়স থেকে। বারো বছর বয়সে রোগটা হল আমি ষোলো বছর বয়সে ঠিক হলাম। পূর্ববঙ্গের এক নামকরা চাঁদসীর ডাক্তার আমার পা-টাকে অপারেশন করে ঠিক করে দিয়েছিল।
পরবাস : তাহলে আপনার এই গৃহবন্দী অবস্থাটাই সময় কাটানোর জন্য আপনাকে ছবি আঁকার দিকে নিয়ে আসে--
রবীন মণ্ডল : দুটো কারণে, বাবা বসে বসে যন্ত্রের ছবি আঁকত, আর সেইসময় আমি এঁকে ধরে নিয়ে বাবাকে দেখিয়ে দিতুম। বাবার যন্ত্রের ছবি, কারখানার ছবি। কোন বন্ধু কারখানা করবে, কী হবে? কোথায় কী বসাব? সেই ছবিও করতেন।
পরবাস : তার মানে আপনার পরিবারে একই সঙ্গে ক্রিয়েটিভ লোক আপনারা ছিলেন সঙ্গীতের দিক থেকে এবং আঁকার দিক থেকেও। কারখানার মেশিন আঁকাও তো আঁকা। এগুলো তো অ্যানাটমি আঁকার মতোই ব্যাপার, আর আপনি শুরু করেছিলেন হিউম্যান ফিগার ড্রয়িং দিয়ে। এইটা একটা ব্যাপার যার ফলে আপনি চিরকাল হিউম্যান ফিগার এঁকে গেছেন এবং আশ্চর্যরকম ভাবে।
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ, হ্যাঁ। তখন আমি আঁকতাম, বাবা বলল যে তোর পা-টা ঠিক হয়ে গেছে। এখন আর্ট কলেজে ভর্তি হবার চেষ্টা করতে পারিস। বাবা কারখানার ড্রয়িং করত তো। আমাকে উৎসাহ দিত, কখনও হতাশ করেননি।
পরবাস : তা আর্ট কলেজে আপনি ভর্তি হতে পারলেন?
রবীন মণ্ডল : আর্ট কলেজে প্রথম গিয়েছিলুম, বলল টু লেট। হল না। তারপর দু’বছর কেটে যাওয়ার পর ভর্তি হয়েছিলুম। দেড় বছর নাম ছিল খাতায়, আর যাইনি।
পরবাস : গেলেন না কেন?
রবীন মণ্ডল : আবার আটকে থাকবো। তখন বাড়ির থেকেও প্রেশার আসছে বসে না খেয়ে কিছু কর, এই আর কী। হয় কারখানার দিকে যাও, কারণ কারখানা তো একটা চলছে তাতে বাইরের লোক দিয়ে দেখতে হয়। সেখানে তাকে সরিয়ে নিজের বাড়ির ছেলে দেখলে খরচ কম হবে। তবে বাবা এসব আমাকে কোনোদিন বলেনি।
পরবাস : আপনি তো পড়াশোনাও করেছেন...
রবীন মণ্ডল : ওই তো ইস্কুল ফাইনাল পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিলুম। কোনরকমে টেরিয়ে টেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেতুম। তারপর একটু গ্যাপ দিয়ে কোনরকমে বি. কম. পাশ করে গেলুম। উপায় নেই তখন ইভনিং-এ বি.এ. বা বি.এস.সি. ছিল না। ওনলি কমার্স। তা আমি বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়েছিলুম।
পরবাস : আর আপনি আর্ট কলেজ ছেড়ে দিয়ে কী করলেন?
রবীন মণ্ডল : গর্ভমেন্ট আর্ট কলেজে ঢুকে তো হল না, আমি তো অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ইভনিং-এ একটা ফাইন আর্টসের ক্লাস হোত। সেটা আমি কমপ্লিট করেছিলুম।
পরবাস : তাহলে আপনি যাকে স্বশিক্ষিত শিল্পী বলে তা নন?
রবীন মণ্ডল : না, যা হবার হয়েছিল আগেই। আমি ওখানে গিয়ে খুব যে অর্জন করেছি তা নয়। তবে ওই ন্যুড ফিগার তো বাড়িতে বসে করা যায় না, বাবা নয় বাড়িতে বসে মুখটা দেখিয়ে দিত।
পরবাস : আপনি কি ন্যুড স্টাডি করেছেন?
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ। ন্যুড স্টাডি না করলে ড্রয়িং শেখা যায় নাকি!
পরবাস : ন্যুড স্টাডি কোথায় করতেন?
রবীন মণ্ডল : ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। আর হ্যাঁ, তার আগে আমরা দু-চারজন বন্ধু মিলে একটা জায়গা ঠিক করেছিলুম, যেখানে বোধহয় পার হেড কুড়ি না কত টাকা লাগবে পার মান্থ। একটা লোক ছিল, সে একটা জায়গায় ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানে ন্যুডের স্টাডি হোত।
পরবাস : তারপরে তো আপনি চাকরি নিলেন...
রবীন মণ্ডল : ম্যাট্রিক পাশ করার পর টরেটক্কা করে বি.কম. পাশ করে তারপরে চাকরি। মাঝখানে বছরখানেক ইস্কুল মাস্টারি করলুম। তারপরে একটা অ্যাপ্লিকেশন করে রেলের চাকরি পেলুম। ওরা বলল বিলাসপুর যেতে হবে। আমি বললুম বিলাসপুর যাব না। সেইসময় আমার এক মাস্তুতো দাদা বি.এন.আর-এ চাকরি করতেন। একটু ইউনিয়নবাজিও করতেন, তাকে বললুম আমি যাব না। সে বলল তুমি আগে জয়েন কর তারপর আমি দেখছি। ওর কথায় আমি বিলাসপুরে জয়েন করলুম। পরে কি প্যাঁচপোঁচ করে জানি না, আমাকে কলকাতার খিদিরপুরে একটা বি.এন.আর অফিস আছে ওখানে পোস্টিং দিল।
পরবাস : সেই থেকে আপনি সারাজীবন রেলেই চাকরি করেছেন?
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ, হ্যাঁ। আরে রেলের চাকরি বলেই ছবি করতে পেরেছি। অন্য জায়গায় মার্চেন্ট অফিসে বেশি মাইনে দিলে মুখে জুতো মেরে আমার লেবার আদায় করত। অফিসে আমি কাজ করছি, আমার একজন আর্টিস্ট বন্ধু ঢুকছে, সুপারভাইজার বললেন যান আপনি যান, এসে গেছে সব। আমি কোথায় যাব, ওখান থেকে রিলায়েন্স বলে একটা সুইটসের দোকান ছিল, যার চা খুব ফেমাস। ঠিক হেয়ার স্ট্রীটের মুখটাতে, সেখানে আমরা বসতুম। ওই বাড়িরই একটি ইয়ং লেখাপড়া জানা ছেলে ছিল, সে বুঝতে পারত যে এদের আড্ডায় তো ভালো ভালো লোক আসছে। প্রকাশ কর্মকার আসছে, বিজন চৌধুরী আসছে। দিল্লী-বোম্বে থেকে লোক আসছে।