• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • পুস্তক-সমালোচনা - বেস্কিড পাহাড়ের ভার্জিন মেরি! : শান্তনু চক্রবর্তী


    বেস্কিড পাহাড়ের ভার্জিন মেরি!--নিরুপম চক্রবর্তী; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৮; সৃষ্টিসুখ; কলকাতা; ISBN 978-93-86937-10-0

    ‘প্রথাগতভাবে অশিক্ষিত’ অধ্যাপক-কবির এটি দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।

    প্রথম গ্রন্থটির (নিজস্ব বাতাস বয়ে যায়! --সৃষ্টিসুখ ২০১৪) পরে, বা সমকালেও যে কবির নিজস্ব বাতাস বয়ে চলেছিল, তার নিশ্চিত প্রমাণস্বরূপ হাতে এসে পৌঁছোল কিঞ্চিদধিক একমাস আগে।

    আগের বইটির (যাকে এখন থেকে আমরা সংক্ষিপ্ত রূপে নি.বা.ব.যা বলে উল্লেখ করবো) মত এইটিও প্রথম দর্শনেই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর তন্বী-শ্যামা রূপের সঙ্গে উৎকৃষ্ট কাগজে ও মুদ্রণে গ্রন্থটি মনোহারী! কৃতিত্ব অবশ্যই প্রকাশক রোহন কুদ্দুস ও তাঁর সংস্থা ‘সৃষ্টিসুখ’-এর প্রাপ্য: তবে লেখকেরও যে কিছু ভূমিকা ছিল, তা’ আন্দাজ করা যায়। অতনু দেবের প্রচ্ছদে আংশিক প্রচ্ছন্ন নারীমূর্তিটি খানিকটা পরা-বাস্তবতার আভাস নিয়ে আসে; কালো ক্যানভাস সেই আভাসকে আরও প্রগাঢ়ভাবে ধরে রাখে। বইয়ের শিরোনাম প্রচ্ছদের নিচের ডানদিকে বইয়ের শিরোনাম স্বল্প-পরিচিত অথচ শৈল্পিক এক মাত্রা-বর্জিত হরফে বিধৃত; তার বাঁ-পাশে প্রচলিত হরফে কবির নাম। দু’য়ের মধ্যে উল্লম্ব একটি নাতিদীর্ঘ হলুদ রেখা। সামগ্রিকভাবে অতীব দৃষ্টি-নন্দন একটি প্রচ্ছদ। প্রাথমিকভাবে এই প্রচ্ছদের প্রভাবেই বইটি হাতে তুলে নিতে সাধ হয় এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে পাতা উল্টে যেতে।

    এগারোটি অনূদিত এবং তেত্রিশটি স্বরচিত কবিতা নিয়ে যে ‘পেটিকা’টি পরিবেশিত, তার মধ্য দিয়ে কবি-নিরুপমের মানসের এক নি:সংশয় পরিচয় পাঠকমাত্রেই পাবেন! যে পরিচয়, খুবই আনন্দের অথা, কোনো পৌন:পুনিকতা বা এমনকি গতানুগতিকার গ্রিলে আটকে যায়নি। সা-রে-গা-মা-র সাতটি স্বরের বিভিন্ন বিন্যাসে যেমন ছয় রাগ-ছত্রিশ রাগিণীর সৃষ্টি, তেমনই এই স্বল্প-পরিসর কাব্যগ্রন্থে বিষয়-বৈসাদৃশ্যের বৈচিত্র্যই পাঠককে আনন্দ দেয়। শব্দবন্ধের স্বাতন্ত্র্য, ছন্দের রকমারি ব্যবহার, দেশি-বিদেশি শব্দের আকস্মিক-কিন্ত-অনাড়ম্বর সহাবস্থান, সজ্ঞানকৃত কিছু গুরুচণ্ডালী বাক্যাংশ, এবং কিছু thematic imagery যেমন কবিকে চিনিয়ে দেয়, তেমনি ধ্রুপদী সুধীন্দ্রনাথ কিম্বা নির্জন জীবনানন্দের প্রচ্ছন্ন অস্তিত্বেও মনোযোগী পাঠক এ' কবির অন্তর্জগতে খানিকটা প্রবেশাধিকার পাবেন, এ' আমার বিশ্বাস।

    শব্দ-বন্ধ চয়নে নিরুপমের দক্ষতা আগের মত এখানেও প্রশ্নাতীত। এবং তাদের যথাযথ প্রয়োগে তারা অনিবার্য, কিম্বা অপরিবর্তনীয়। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করা যাক্‌ (বন্ধনীর ভিতরে কবিতার নাম/ পৃষ্ঠাসংখ্যা):--

    • বিষাদ-দগ্ধ বায়ু (আয়না/১৫)
    • হিংস্র বৈভব (বসন্তবিলাপ/১৪)
    • অনুগত কুয়াশা (কুয়াশা/১৭)
    • অলৌকিক অন্ধকার (স্বেদবিন্দু/২২)
    • হন্তারক ঢেউ (বাল্টিক সমুদ্র/৬০)
    • নিরাসক্ত বল্মীক (লীলাবতী/৩৩)

    ছন্দ-ব্যবহারে সম্ভবত: কবি এই গ্রন্থে অপেক্ষাকৃত বেশি সচল বা বৈচিত্র্যবিলাসী। বেশ কয়েকটি কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে মসৃণ প্রচেষ্টা চোখে পড়ে, তাতে চিত্তের প্রসন্নতা বাড়ে বই কমে না! ১৫-পৃষ্ঠায় আয়না কবিতায় ছড়ার ছন্দে চলা শুরু হয়:

    “সবার হাতে একই রকম / মন দ্যাখানো আয়না
    কেউ দেখতে চায় / কেউ চায় না”। প> আর তার ঠিক পরেই গুরুগম্ভীর কিন্তু গতিমান্‌ ছন্দে তিনটি পঙ্‌ক্তি পাঠককে অবাক করে:--

    “আহা আজ তার বাসনাবাহিত বায়ু
    জুড়াবে যে তার বিষাদ-দগ্ধ স্নায়ু/চেয়ে নিরাময় রোদ্দুরে রোদ্দুরে”।

    অপ্রাসঙ্গিক হলেও মনে পড়ে যায় দক্ষিণী রাগসঙ্গীতের ঢঙে সুরারোপিত সেই কালজয়ী গান ‘বাসন্তী হে’! ভুবনমোহিনী’র মধ্যে আকস্মিক তাল/ চলনের পরিবর্তনের কথা।

    অন্ত-উপান্ত ধ্বনিতে মিল মিলিয়ে যে প্রাচীন প্রথাসিদ্ধ কবিতার ছন্দ, অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রায় তার বিপরীত মেরুতে। কিন্তু সেখানেও নিয়মনিষ্ঠ মাত্রাভাগ আছে, আছে মিলহীন সুনির্দিষ্ট ছন্দ সেটা অনায়াস নৈপুণ্যে আবারও (নি.বা.ব.যা-র পরে) করে দেখালেন এই প্রযুক্তিবিদ্‌ কবি।

    “অথবা নিশ্চিত জানি     পথপ্রান্তে আছে এক তমিস্র বিবর,
    আমি জানি     সেইখানে ধৈর্যবান ঊর্ণনাভ    আজও তার প্রতীক্ষায় আছে--
    আহা দ্যাখো   সারারাত্রি নিশীথ সূর্যের দেশে    চনমনে রৌদ্র ফুটিয়াছে।’
    (ঊর্ণনাভ/ ৫৯) কিম্বা,

    "কত যে গান লিখিত তারে ঘিরি;
    তাহারা যারা জানিত তারা জানে
    তাহার জিভ চিরকালীন চেরা
    ছোবলে বুঝি তীব্র বিষ ছিল!" (পুরাতনী/ ২৪)

    'বেস্কিড পাহাড়ে’র পরতে পরতে এমন অসংখ্য পদাবলী।

    শব্দ-বন্ধ মুগ্ধ করে, ছন্দ-বৈচিত্র্য আনন্দ দেয়, কিন্তু আমার মুগ্ধতায় আর আনন্দে ছায়া ফেলে এক শঙ্কা! জীবনানন্দের রূপকল্প, কিম্বা সুধীন্দ্রনাথের তৎসম শব্দ-সম্ভারের যে স্পর্শে নিরুপমের নিজস্বতা নিরুপম, যদিও তা’ সানন্দে অনিয়মিতভাবে, তার মধ্যে এবারে কেন বারেবারে উঁকি মারে শ্বাপদের দাঁত, তীব্র বিষ, তীক্ষ্ণ নখ? অন্তত: ৭/৮টি কবিতায় কেন জেগে থাকে হিংস্র কৃষ্ণ-গহ্বর?

    আয়না (১৫)তে পাই হিংস্র অন্ধকার, নীরবতা (১৮)য় পাই ‘হিংস্র হাত’, ভাসান (২৯) বলে ‘হিংস্র ঘূর্ণি ঢেউ’-এর কথা, সুর্যক্ষত (২৩) করে ‘হিংস্র স্তব’, পৃষ্ঠায় (৩২) জেগে থাকে ‘হিংস্র কন্ঠস্বর’! এ’ছাড়াও নখ, দাঁত, বিষ, অন্ধকার ঘুরে ফিরে আসে উড়ান (২১), পুরাতনী (২৪), প্রস্থান (৩৪), শৃগাল (৪৬), বিচ্ছিন্ন শব্দের গল্প (৪৭) কবিতায়। তবে কি ঋদ্ধ এই কবিমানসের Johari জানালায় প্রষুপ্ত রয়ে গেছে বা জন্ম নিয়েছে কোনও ঘৃণা, বা ক্রোধ সমসাময়িক কবি, কবিতা বা সাহিত্যের প্রতি? কী জানি!

    তবে একই সঙ্গে আশার কথা এই যে, এই সব মেঘ সরিয়েও কবি স্বপ্ন দেখতে থাকেন, চলে যেতে, ভেসে যেতে ভালোবাসেন, স্বরে-সুরে-শব্দে ও সঙ্গীতের প্রেমে বেঁচে থাকেন এবং অনুভব করেন “নিসর্গে নিহিত আছে অনাবিল কবিতার ঘ্রাণ” (৬১)। কিম্বা আশা করেন:--

    “একদিন আলোর শহরে/ আলোকিত আনন্দেতে নিজেকে রিক্ত করে, নি:স্ব করে নিজেই হেসে উঠবে সেই মুখ..../ অজস্র আলোর দেশে নির্বাসিত দু:খী মুখ/ আলোকিত কৃতান্ত-নগরে।” (৫??) যদিও অধিকাংশ কবিতাতেই (ভ্রামণিক বা অনূদিতগুলি ছাড়া) বিষাদের করুণ রেখাব থেকে থেকেই ফুটে ওঠে:--

    • সব শব্দ নিরুদ্দেশ, তাহাদের পরিত্যক্ত প্রতিধ্বনিগুলি/ বাজিছে, কাহারে খুঁজে (প্রতিবিম্ব/১৩)
    • সমস্ত কবিতার তার নিজস্ব ভাসানে ভেসে যায় (ভাসান/২৯)
    • কে যেন.... বলেছে শুধু 'চলে যেতে বড় ভয় করে' (তালা/১৬)
    • কবিতাবিহীন এই রাত আজ আমার অধীন (ভাসান/২৯)
    • মৃত পাখি উড়ে যাবে/ ঠোঁটে নিয়ে কবিতার শতচ্ছিন্ন জন্মান্ধ অক্ষর (পৃষ্ঠা/৩২)

    তবে এই সব কিছু নিয়েই বোধহয় কবির ক্যানভাস জীবন্ত হয়ে ওঠে: আর পাঠক পূর্বাহ্নে ভাবতেও পারেন না পরবর্তী পৃষ্ঠায় তাঁর জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছে কোন্‌ গান, কী তার রাগ, কেমন তার বাণী!

    যেমন এই গ্রন্থে রাবীন্দ্রিক নামক অধ্যায়টি (৩৭): দুটি মাত্র কবিতা আছে তিন পৃষ্ঠায়: রবীন্দ্রনাথ এবং রাবীন্দ্রিক। প্রথমটি শব্দ-ঝঙ্কারে, ছন্দের অনবদ্য চলনে যেমন অতুলনীয়, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ও কবিমানসের কেমিস্ট্রির বিবরণে অনবদ্য। দ্বিতীয়টির কুল-গোত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আটটি ছোটোছোটো (২/৩/৪/৫ পঙ্‌ক্তি) কবিতা নিয়ে এটি একটি আধুনিক কোলাজ। বরং অণু-কবিতা নিয়ে বলাই ভালো। প্রথমটির চার পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করি:--

    “...তার বিবর্ণ স্মৃতি, মৃত অনুভূতি/ যেখানে কবিতা স্পন্দিত,
    তার স্তিমিত বাসনাধৃত উপাসনা হিম জ্বালামুখে বন্দিত..."

    আর দ্বিতীয়টির থেকে আমার-মতে-সর্বোৎকৃষ্টটি--আবারও আমারই মতে, নিরুপম সম্ভবত: শ্রী সুধীর চক্রবর্তী মহাশয় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নকে সুসংহত করে তিন পঙ্‌ক্তিতে প্রকাশ করেছেন:--

    “রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে কিছু নেই, শুধু আছে/ আনন্দ ও যন্ত্রণার একরাশ বয়ে যাওয়া
    যা তোমাকে বারবার মারে ও বাঁচায়।” (৩৭)..... এ যেন এক অমোঘ বিশ্বজনীন ঘোষণা!

    ‘রাবীন্দ্রিক’ কবিতাগুচ্ছেই আরও সংবেদনশীল কবিতা রয়েছে ব্লাইন্ডস্কুলের রবীন্দ্রনাথ, তেমনই তির্যক পঙ্‌ক্তিতে বিদ্ধ হয়েছে ট্রাফিক সিগন্যালে বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীত (হিসেবি রবীন্দ্রনাথ/৩৭)

    'বিচ্ছিন্ন শব্দের গল্প' নামের পঞ্চম অধ্যায়ে পাঁচটি বিভিন্ন স্বাদের পরিবেশনার মধ্যে আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে একটি ডিটেকটিভ কবিতা, যার শেষ পঙ্‌ক্তিতে কবির ঘোষণা “কখনও হবে না লেখা এরকম দু-একটি কবিতা”। আমি সম্পূর্ণ একমত; সম্ভবত: পূর্বেও হয় নি!

    ছয় নম্বর অধ্যায়ের নামেই বইটি নামাঙ্কিত: অর্থাৎ ‘বেস্কিড পাহাড়ের ভার্জিন মেরি!’ এখানে সঙ্কলিত নয়টি মোটামুটিভাবে ভ্রমণ-ভিত্তিক কবিতা। পোল্যান্ড, ব্রাজিল, কলোরাডো, বাল্টিক সমুদ্র, নিউ মেকসিকো--নানান দেশে পরিব্রাজনরত (সম্ভবত: কার্যসূত্রেই) নিরুপম লিপিবদ্ধ করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে/ শহর বা দেশের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নিজস্ব মানসের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার বিবরণ, অবশ্যই নিসর্গের প্রেক্ষিতে। নি.বা.ব.যা-তেও ১৫টি কবিতা ছিল এই গোত্রের। এবারের সংযোজনে পোল্যান্ড বাদে পশ্চিমতর দেশেরই আধিক্য; গত-টিতে যেখানে পদচারণা ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়া এওং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশে। এখানেও কবির স্বাক্ষর পরিষ্কার দৃশ্যমান। দেশি-বিদেশি শব্দের স্বচ্ছন্দ সংকরায়ণে তিনি বিশ্বাসী: ভূগর্ভস্থ ডাঞ্জেন (৫৪), অর্থোডক্‌স্‌ চার্চ (৫৫), ঈশ্বরের সলিলকি (৫৮), অ্যান্টিক্লক গতি (৫৬) তাদের মধ্যে কয়েকটি মাত্র। শব্দ-নির্বাচনের এই অসাম্প্রদায়িকতা সাধারণভাবে কবিতাকে সমৃদ্ধ করে। এই অধ্যায়ের একটি কবিতা সোকোরো, নিউমেক্‌সিকো ১৯৭৭ (৫২) (কবে রচিত, জানা নেই) আমায় বিশেষ করে মুগ্ধ করে। Circumstantial evidence বলে কবিতাটিতে লেখকের ছাত্রাবস্থায় বিদেশে পৌঁছোবার ছায়াপাত আছে; এবং গভীরভাবেই। ত্রস্ত-বিপন্ন সত্তর দশক, পকেটে সম্বল মাত্র চার ডলার, ভারত হতে আসা এক নওল-কিশোর, আর পটভূমিতে ‘অগ্নিদগ্ধক্ষত’ তার সাক্ষ্য বহন করে।

    তবে এই ভাবেইতো গড়ে ওঠে সাহিত্য, গড়ে ওঠে শিল্প--তা সে কবিতা হোক, বা ভাস্কর্য, হোক গল্প বা পটচিত্র। ঘটনা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি আর কল্পনার মিশ্রণের কোনও আনুপাতিক অনুশাসন নেই, থাকা আকাঙ্ক্ষিতও নয়। লেখক লিখে তৃপ্ত হলেন, পাঠক পড়ে সন্তষ্ট--এই পরোক্ষ মেলবন্ধনই সাহিত্য-শিল্পকে স্তর থেকে স্তরান্তরে উত্তীর্ণ করে।

    অনূদিত কবিতার অধ্যায়ে ঢুকবার আগে দু’য়েকটি অকিঞ্চিৎকর প্রসঙ্গ:--

    ক. বইয়ের শিরোনামে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন(!)টি কেন? কবিতায় যথাযথ যতিচিহ্ন ব্যবহারে কবি কিঞ্চিৎ কৃপণ আমরা জানি, কিন্তু 'বেস্কিড পাহাড়ে ভার্জিন মেরি’ কি একটি বিস্ময়কর ঘটনা? ‘নিজস্ব বাতাস বয়ে যায়'ও কিন্তু থেমে ছিল ঐ চিহ্নেই!

    খ. কবি যদি সত্যি বর্ণপরিচয় শেষ করে থাকেন, তাহলে বিজ্ঞপ্তি অংশে ইতোমধ্যে হেরে গেল কেন ‘ইতিমধ্যে’র কাছে?

    গ. অনুজ্ঞাসূচক রূপে 'দেখা' ক্রিয়াপদ যদি দ্যাখো লেখা যুক্তিসঙ্গত হয়, তাহলে বিক্রি করা অর্থে 'বেচা' (৪৪) কেন ব্যাচা হবেনা? কিম্বা অনুজ্ঞায় ‘ভাবা’ কেন হবেনা ভাবো (৭৪)?

    ঘ. ‘বিজ্ঞপ্তি' বিভাগেই ‘অলমিতি বিস্তরেন’ বাক্যবন্ধে শেষ অক্ষরটি (ণ) মূর্ধা থেকে দন্তে নেমে এসেছে মুদ্রণ প্রমাদে; আর সম্ভবত এই বাক্যাংশটির পাঠান্তর রয়েছে; 'অলমতি বিস্তারেণ'! দুটির অর্থ কাছাকাছি হয়েও সম্পূর্ণ সমার্থক নয়; বৈয়াকরণেরা কোনটিকে অধিক মর্যাদা দিয়ে থাকেন জানবার বাসনা রইলো।

    গ্রন্থটির সপ্তম তথা শেষ সর্গের সম্পদ ফিনদেশি ও ভিনদেশি কবি সিরক্কা সেলিয়ার কিছু কবিতা। ফিনিশ ভাষার এই অধুনা প্রয়াত বিশিষ্ট কবির পরিচিতি থেকে উদ্ধৃত করি- “সিরক্কা সেলিয়ার কবিতা বিচরণ করে স্বপ্ন আর জাগরণের অন্তরঙ্গ মিশ্রণে নির্মিত এক নিজস্ব জগতে, সুরম্য পরিহাসে সেখানে তিনি উপহিত করেন তাঁর অতি গভীর বীক্ষণগুলি।' এখানে মুদ্রিত এগারোটি কবিতা দ্বি-স্তরীয় অনুবাদ: প্রথমে ফিনিশ থেকে ইংরিজি এবং তার পরে ইংরিজি থেকে বাংলায়। ফলে মূল কবিতার সম্পূর্ণ রসাস্বাদন সম্ভব নয়, কেননা অনুবাদ--বিশেষ করে কবিতার--প্রায়শই "হন্তারক”! তবু ভালো লাগে প্রাপ্তি (৬৯), স্মৃতি-জাগানিয়া গাছেরা (৭৩), বা পপলার গাছেরা (৭৪)। কবিমানসের কম্পাঙ্ক মিলে যায় এই ‘চিনা-দোকানে-ষণ্ড-সদৃশ’ সমালোচকের কম্পাঙ্কের সঙ্গে! কিন্তু বইয়ের দোকানের ভেড়া, ফটোগ্রাফারের বিড়ম্বনা, বা আশ্চর্য পিতৃত্ব কবিতায় ঐ স্বপ্ন+জাগরণের পরাবাস্তব মিশ্রণ কবিতাগুলির অন্তর্নিহিত মাধুর্য বা সৌন্দর্য আস্বাদনে আমার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। মূল কবি ও অনুবাদকদ্বয় আমাকে মার্জনা করবেন। কবিতাগুলি হয়তো ভাবায়, ধাঁধায় ফেলে দেয়, অবাকও করে--কিন্তু সৃষ্টি হয়না কোনও “ক্ষণস্থায়ী এক আশ্চর্য মুহূর্ত!” (৭৫) প> ৭৯ পৃষ্ঠার বই এখানেই শেষ: পেছনের কালো প্রচ্ছদে লেখা কবির স্বীকৃতিই যেন বিচলিত-চিন্তিত-তৃপ্ত পাঠকের স্বীকারোক্তি হয়ঃ--

    “আমি এই অন্ধকারে আকাশের মতো ভরহীন/.../
    জেগে আছি, বেঁচে আছি/ কোথায় যাবার ছিল ভুলে গেছি
    তবু দ্যাখো ভালো আছি বেশ”।

    এই বই হতে নিয়ে যেন সবাই অনুভব করি--নিসর্গে নিহিত আছে অনাবিল কবিতার ঘ্রাণ। বিশ্ব-কবিতা দিবসে (২১শে মার্চ) সমালোচকেরও একই প্রার্থনা।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)