বেজায় ভিড় ট্রেনটা থেকে হাঁচোড়পাঁচোড় করে নামলো অপর্ণা। মুখে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম আঁচলে মুছে নিয়ে সবে গেটের দিকে এগোতে যাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলো “ও দিদি – আমিও আছি। একটু দাঁড়িয়ে যাও প্লীজ!”
অপর্ণা দাঁড়িয়ে গেলো। একটু বাদেই লাফাতে লাফাতে পেছন থেকে একগাল হাসি আর দুটো ঝুপো ঝুপো বিনুনি-করা রুনি এসে ওর হাত চেপে ধরলো। ছিপছিপে রোগা মেয়েটা, ছাপা রঙের সালওয়ারে, রংবেরঙ্গের ওড়নায় আর হাসির ছটায় ভীষণ প্রাণবন্ত।
“কলেজ থেকে ফিরলি?” জিগ্যেস করলো অপর্ণা।
“হ্যাঁ দিদি। কলেজ, তারপর টিউশন, তারপর আড্ডা...।”
“কলেজটাও তো আড্ডারই জায়গা,” মুখ টিপে হেসে বললো অপর্ণা।
হি হি করে হেসে মাথা দোলালো রুনি। তারপর সিরিয়াস হয়ে বললো “তবে আজ হিস্ট্রির লেকচার দিচ্ছিলেন একেজি। খুব ভালো ছিলো।”
“তোর ইতিহাস খুব ভালো লাগে, তাই না?”
“ভীষণ। তোমার লাগে না?”
“লাগে বোধহয়।” বললো অপর্ণা আবছাভাবে। অনেকদিন আগেকার কথা – তখন কি ওর ইতিহাস ভালো লাগতো? মনে নেই। কথা ঘোরাতে প্রশ্ন করলো--
“তুই ইতিহাস নিয়ে পড়তে গেলি কেন? তুই অঙ্কে এতো ভালো, ওটা নিলেই তো হতো। ফিউচার প্রস্পেকট...”
রুনি নাক কুঁচকোলো। “তুমি বাবার মতো শুরু করে দিও না তো! অঙ্ক কর, ডাব্লিউ বি সিএস-এ বোস, ব্যাঙ্কে পরীক্ষা দে...ঘ্যান, ঘ্যান, ঘ্যান। মাথার পোকা নড়িয়ে দিলো।”
হেসে ফেললো অপর্ণা। “তোর ভালোর জন্যেই বলেন উনি।”
“ধ্যুত! ভালো না হাতি...খালি ভ্যাজোর, ভ্যাজোর...”
কথা বলতে বলতে রিকশা-স্ট্যান্ডে এসে পড়লো ওরা দুজনে। অপর্ণা রিকশার দিকে এগোতেই রুনি হাঁহাঁ করে উঠলো।
“রিকশা নেবে নাকি? হাঁটবে চলো।”
“হাঁটবি?” বললো অপর্ণা, “অনেকটা রাস্তা তো! চার পাঁচ কিলোমিটার হবে।”
“দুত্তোর তোমার কিলোমিটার। এদিকে দিওয়ানা করে দেওয়া হাওয়া দিচ্ছে, সেটা দেখবে না? চলো!”
অপর্ণা একবার ঘড়ি দেখলো। মনে মনে একটু হিসেব করে নিয়ে তারপর বললো “চল তবে, হেঁটেই যাই।” সত্যিই হেঁটে বাড়ি ফেরা হয় নি অনেককাল। আর আজকের বিকেলটাও বেশ মোহময়। রোদহীন আকাশে সাদা-কালো মেঘ; মাঝে মাঝে শনশন করা হাওয়া কখনো মুখে এসে পড়ছে, কখনো বা বেয়াড়া ছেলেদের মতো আঁচল ধরে আচমকা টান লাগাচ্ছে। হাঁটার মতোই দিন বটে।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে স্টেশন রোড ধরে একটু এগিয়েই বাঁদিকের সরু রাস্তায় নেমে পড়লো দুজনে। রাস্তাটা কাঁচা, আশেপাশে খোলা উদার মাঠ আর থেকে থেকে এক দঙ্গল সুউচ্চ বৃক্ষশ্রেণী পাশাপাশি জটলা পাকিয়ে গা ঠেলাঠেলি করছে। পথে যেতে বাঁহাতে পড়ে একটা ছোট ডোবা-পুকুর, যার ওপর একটি বিশাল বটগাছ ছায়া ফেলে চুপটি করে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের মুখ দেখে। মেঠো পথ বলে গাড়ি-ঘোড়া তেমন নেই, দু চারটে সাইকেল বা সাইকেল-রিকশা ইতস্তত কিড়িং-কিড়িং শব্দ করে চলে যায়।
রুনি গান গাইছিলো গুনগুন করে।
“জোরে গা না,” বললো অপর্ণা।
রুনি মাথা নাড়লো। কিন্তু আপনা থেকেই একটু জোরে গাইতে লাগলো--
“গোধূলি সন্ধ্যা দিল উদাসী দিন, পায়ে পায়ে আলপনা হল রঙিন...”
গানটা এদিক ওদিক শুনেছে অপর্ণা। জিগ্যেস করলো “কার গাওয়া রে?”
“এটা জানো না? অন্তহীনের গান। অন্তরা চৌধুরীর গাওয়া। আর শ্রীকান্ত আচার্য। তুমি কি গো!!”
মাথা নাড়লো অপর্ণা। সিনেমা দেখা হয়ে ওঠে না ওর। গান শোনাও ঠিক সেভাবে হয় না। অনেককাল।
“সবে রিলিজ করেছে সিনেমাটা। কি ভীষণ ভালো। আর কি ভীষণ কাব্যিক সব শট সিনেমাটাতে। অপূর্ব। আর গানের তো কথাই নেই।” বললো রুনি।
এর মধ্যে আকাশ কালো হয়ে এসেছে। ভিজে গন্ধমাখা বাদলা বাতাসে গাছগুলোর এলোমেলোভাবে মাথা নাড়া শুরু হয়েছে। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে ব্যাঙেদের একটানা গলা-সাধার আওয়াজ ভেসে আসছে। অপর্ণা আকাশের দিকে মুখ তুলে বললো “মুস্কিল হলো। বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে রে!”
“কি মজা!” রুনি লাফিয়ে উঠলো। “শোন দিদি – একটা বৃষ্টির কবিতা শোন--
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠান পানে একাকার লেখা বলো তো?”
দৌড়ে গিয়ে, ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে--অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
অপর্ণার আবছা মনে পড়লো এটা বোধহয় পড়েছিলো একসময়। নাকি আবৃত্তি শুনেছিলো কোথাও। আন্দাজে বললো “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নাকি রে?”
“না, না, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কবিতাটার নাম ‘যখন বৃষ্টি নামলো’। মনে পড়েছে?”
“পা চালা রুনি। বৃষ্টি হলে ভিজে যাবি। তোর আমার দুজনেরই টনসিল।” শাড়িটা টেনে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললো অপর্ণা।
“বেশ হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে আমার দারুণ লাগে। তারপর বাড়ি গিয়ে বারান্দায় বসে চা আর মুড়ি – ডালমুট মিশিয়ে। কি বলো?”
“ইয়ার্কি মারিস না রুনি। গলা ব্যথা হবে। চল তাড়াতাড়ি।”
হঠাৎ রুনির ব্যাগ থেকে পিক করে একটা শব্দ হলো। তড়িঘড়ি রুনা মোবাইলটা বের করে একঝলক স্ক্রিনটা দেখেই এদিকওদিক তাকালো। মেসেজ এসেছে।
অপর্ণা খেয়াল করলো যে মেঠো পথটা যেখানে আবার পাকা রাস্তায় উঠেছে, তার পাশে একটা ছেলে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে এইদিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কলেজের ছাত্র মনে হয়, হাতে একটা বইও আছে। অপর্ণা ওর দিকে তাকাতেই ছেলেটা সট করে দোকানের পাশের গলিতে ঢুকে গেল। অপর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো রুনি প্রবল মনোযোগ সহকারে তার মোবাইলে খুব দ্রুত একটা মেসেজ টাইপ করছে।
হাসি চেপে অপর্ণা জিগ্যেস করলো “কে রে ছেলেটা?”
“কোন ছেলে?”
“ন্যাকামি করিস না। সাইকেলধারী বনমালীটি কে?” জিগ্যেস করলো অপর্ণা।
“ও কেউ না – এমনি আলাপ। আমার সঙ্গে বই দেওয়া নেওয়া হয় মাঝে মাঝে। ব্যাস।”
বিকেলের মিহিন রোদ্দুরে রুনির মুখখানা একটু রাঙ্গিয়ে উঠলো। ওর লজ্জা দেখে অপর্ণার হাসি পেয়ে গেলো। একটু পেছনে লাগবার জন্যে বললো “শুধুই বই? নাকি আরো কিছু?”
“যাহ, দিদি – তুমি না – ওসব কিছু নয়।”
কথা বলতে বলতে ওরা পাকা রাস্তায় উঠে এসেছে। কালো মেঘের অকালসন্ধ্যায় কয়েকটা দোকান আলো জ্বেলে দিয়েছে। রাস্তায় তাই আলোআঁধারির চিকিরমিকির।
কথা ঘোরাবার জন্যে রুনি বললো, “তুমি ইতিহাস নিয়ে পড়ার কথা জিগ্যেস করছিলে না? আমি কি নিয়ে মাস্টার্স করবো জানো?”
“বল তুই।”
“আর্ট হিস্ট্রি নিয়ে। চিত্রশিল্পের বিবর্তন নিয়ে। দারুণ, না?”
অপর্ণা এই সাবজেক্টের নাম শোনেনি। “আর্ট হিস্ট্রি?”
“আর্ট হিস্ট্রি। ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের ছবির ইতিহাস। রেনেসাঁ, ইম্প্রেশনিজম, পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম – এদিকে আমাদের বেঙ্গল আর্ট, কালীঘাট পটচিত্র – এই সব নিয়ে পড়বো। দেশ-বিদেশ ঘুরবো। ভালো না?”
অপর্ণা হকচকিয়ে গেলো। ওর উত্তরপাড়ার বাড়ির পাশের গলিতে থাকা ব্যাঙ্ক কেরানির পুঁচকে মেয়ে এরকম প্যানোরামা সাইজের স্বপ্ন দেখছে, সেটা ও ঠিক ভাবতে পারে নি।
“বিদেশ যাবি?”
“আলবাত। অ্যামস্টারডাম যাবো – সেখানে ভ্যানগগ-এর মিউজিয়াম আছে না? প্যারিসে তো যেতেই হবে – ল্যুভরে, মুসি ডি ওরসে, ল্যাটিন কোয়াটার্স। তারপর স্পেনে যেতে হবে – আলতামিরার বাইসনের ছবি দেখতে। নিউইয়র্কে মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট। এসব দেখবো গো দিদি।”
“হ্যাঁ রে – এতে তো অনেক টাকা লাগবে। পাবি কোথায়?” অপর্ণা বললো।
“ওসব ঠিক হয়ে যাবে।”
অপর্ণার বাড়ির গলি এসে পড়লো। রুনিকে আরেকটু এগোতে হবে।
হাওয়ায় “আসি দিদি” ছুঁড়ে দিয়ে রুনি এগিয়ে চললো। অপর্ণা ওর চেনা গলিতে ঢুকে পড়লো।
দু পা যেতে না যেতে গলির প্রথম বাড়ির জানলা খুলে গেল। গলির বড়মাসীমা হাঁক পারলেন “ও অপু, একবার সময় করে আসিস তো! তোর মেসোমশাই কি সব ফিক্সড ডিপোজিট নিয়ে কি সব করবে বলছিলো...।”
“আসবো মাসী – আজ দেরি হয়ে গেছে, কাল আসি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ – তোর যেমন সুবিধে।”
বাড়িতে ঢোকার আগে সুধন্যকাকা এসে পড়লেন। কাকিমার চোখটা কাটাতে হবে, অপর্ণা না নিয়ে গেলে কেই বা এসব করে। তাছাড়া কাকার ছেলে কিচ্ছু কাজকম্ম করে না – “ওকে তুই একটু বুঝিয়ে বল তো মা। চিরকাল কি আমরা থাকবো?”
পাশের বাড়ির অমলের ক্লাস টেনের পরীক্ষা। তার একটা বই আনতে বলেছিলো অপর্ণাকে। এনেছে, কিন্তু সেটা রাতের দিকে দিয়ে আসবে, ভাবলো অপর্ণা। এখন বাড়ি যাওয়াটা দরকার।
বাড়িতে ঢুকে অপর্ণা দেখলো ভারতীদি তৈরি হয়ে বসে আছে। অপর্ণাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। “সব ঠিক আছে, ভারতীদি?”
“সব ঠিক। খাইয়ে দিয়েছি। ঠিকমতোই খেয়েছেন। এখন টিভি দেখছেন।”
“আচ্ছা। তাহলে শুতে যাবার আগে দুধ খাওয়ালেই হবে।”
“আজ হয়তো নাও খেতে পারেন। রাতে একখানা রুটি বেশি খেয়েছেন। তোমাকে চা করে দেবো?”
“না থাক, আমি করে নেবো। তুমি বেরিয়ে পড়ো, নইলে ট্রেন পাবে না।”
ভারতীদি বেরিয়ে গেলো। মায়ের সারাদিনের নার্স, তবে এখন প্রায় পরিবারের অংশ হয়ে গেছে। অপর্ণা এলে তবে ওর ছুটি হয়। অপর্ণার মা একেবারেই অথর্ব হয়ে গেছেন, তাছাড়া মাথাটাও আর আগের মতন নেই। কেমন জবুথবু হয়ে টিভির সামনে বসে থাকেন। কি দেখেন, কি বোঝেন বা বোঝেন না, ভগবান জানে। একলা মানুষটার দায়িত্ব ওই ভারতীদির হাতেই।
একবার টিভির ঘরে উঁকি মেরে অপর্ণা রান্নাঘরে চলে গেল। চা না হলে আর চলছে না ওর। এই একটাই অপর্ণার নেশা।
চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো অপর্ণা। সঙ্গে দুখানা ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কুট। বাইরে অন্ধকার নেমেছে তখন। বৃষ্টিটা শেষ অব্দি হলো না। মেঘ কেটে গিয়ে ভুবনজোড়া চাঁদের আলোয় অপর্ণাদের এঁদো পচা গলিটা ধুয়ে যাচ্ছে।
অপর্ণা রুনির কথা ভাবছিলো। মেয়েটা কি সত্যিই দেশবিদেশে যেতে পারবে ছবির ইতিহাস খুঁজতে? কোন আসন্ন বর্ষার অকালসন্ধ্যায় মাঠের রাস্তায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় আবৃত্তি করতে পারবে? কিম্বা গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠতে পারবে অকারণে, কোন এক আচমকা দিনে? ওই সাইকেলওয়ালা ছেলেটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আঙুলে আঙুল ঠেকে গেলে কি ওর বুকের ভিতর দ্রিমি দ্রিমি করে মাদল বেজে উঠবে? কে জানে উঠবে কিনা।
চা শেষ করে অপর্ণা উঠে পড়লো। রুনা পারবে না এসব কিছুই, ও জানে। আসলে তো রুনা রক্তমাংসের কেউ নয়। ও তো শুধু অপর্ণার যৌবন – অপর্ণার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন। যার সঙ্গে আজ অনেকদিন বাদে দেখা হলো।
পায়ের কাছে বিস্কুটের একটা টুকরো ভেঙে পড়ে গিয়েছিলো। সেটা তুলে নিতে গিয়ে অপর্ণা দেখলো ওর পায়ের গোড়ালিতে একটু মাটি লেগে আছে। ওই মেঠো পথের চিহ্ন আর কি।
নিঃশ্বাস ফেললো অপর্ণা। ধুয়ে ফেলতে হবে।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'ইমতিয়াজ মিয়াঁর ফ্যাশান')