অফিস থেকে বেরিয়ে সিটিও বিল্ডিং-এর দিকে হাঁটতে থাকে শ্রুতি। ওইদিকের ফুটপাথে পর পর সার দিয়ে দাঁড়ানো থাকে ওরা। ওরা মানে সন্দীপ, ঋজু, অনন্ত, প্রতীক। সন্দীপ ওর সাথে দুটো ছেলেকে নিয়ে চাওমিন-এর স্টলটা চালায়। খুব ভিড় হয় টিফিন টাইমে ডালহাউসির এই অফিসপাড়ায়। ঋজুর আবার গরম গরম রুটি তরকারি, কিংবা কেউ চাইলে পরোটা তরকারি। এর পরে বসে অনন্ত। কাঁচের বাক্সে নানা ধরনের মিষ্টি সাজানো। ও আসে বনগাঁ থেকে। সব শেষে প্রতীক। মশলা মুড়ি, সাথে বাদাম, ছোলা ইত্যাদির সম্ভার। ওদের সবার কাছ থেকেই কোন না কোন দিন কিছু নিয়েছে শ্রুতি। সবার সাথেই ওর মৌখিক আলাপ আছে। অফিসপাড়ার টিফিন টাইমের ওই ভিড়ের মধ্যেও শ্রুতিকে দেখলে ওরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাড়াতাড়ি ওর খাবারটা তৈরি করে দিতে। ওদের সাথে টুকিটাকি কথাও হত মাঝেমধ্যে, দৈনন্দিনের এই দেওয়া নেওয়ার ফাঁকে। সন্দীপের তিন বছরের মেয়েটার হার্ট-এর দুটো ভাল্ভ অচল। মেজর অপারেশন করাতে হবে। এক মেঘলা দিনে, খদ্দের কম থাকাতে, কিছু সময় ধরে কথাবার্তা হয়েছিল সন্দীপের সাথে। তখনই জানতে পারে শ্রুতি। তিল তিল করে কিভাবে টাকা জমাচ্ছে সন্দীপ মেয়ের চিকিৎসার জন্য। এটা জানার পর শ্রুতি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ওর অফিস থেকে কিছু ডোনেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সন্দীপকে। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসেছিল সন্দীপের। ঋজু একদিন কথায় কথায় জানিয়েছিল ও এইচ.এস পাস, কিন্তু পেটের তাগিদে পড়াশুনোটা চালাতে পারেনি। বাড়িতে অসুস্থ বাবা। অসহায় মা, ছোটো ভাই-বোনেরা ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে বাঁচে। তবু, একবার কোন সুযোগ পেলেই ও পড়াশুনোটা আবার চালু করবে। ‘দেখবেন দিদি, একদিন ঠিক গ্র্যাজুয়েট হয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে নেবই। এই এইখানেই কোন অফিসে, আপনাদের মত।’ চোখের মনি দুটো চিকচিক করে উঠত এইসময় ঋজুর! বনগাঁ থেকে আসা অনন্ত মাঝবয়সি। স্ত্রী কোন এক্সিডেন্ট-এ দৃষ্টিশক্তিহীন। ছেলেদুটো সমাজের চোরা স্রোতে ভেসে যাওয়া অপোগণ্ড। সাত সকালে উঠে ভাতে ভাত রান্না করে স্ত্রীর জন্য গুছিয়ে রেখে বনগাঁ লোকাল ধরে অনন্ত। নিজের জন্য ভাত আনতে পারে না, এই গরমে এতটা পথ। তারপর আবার গরমেই ফুটপাথে বসে থাকা। আজকাল ঋজুই দুপুরে অনন্তকে রুটি তরকারি দেয়। ‘নিজের ছেলেরা তো দেখে না, এই ছেলেটা ...’ বলতে বলতে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ে দু’চোখ বেয়ে। প্রতীক অবশ্য খুব চাপা। নিজে থেকে কোনদিনই কিছু বলেনি। কিন্তু শ্রুতি শুনেছে প্রতীকের স্ত্রী, ছেলে দুজনেই রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এভাবেই শ্রুতির সাথে ওদের কোথায় যেন একটা মানসিক সংযোগ ঘটে যায় ভেতরে ভেতরে, একটা টান অনুভব করে শ্রুতি ওদের জন্য। ওরা শুধুমাত্র কয়েকজন বিক্রেতা নয় শ্রুতির কাছে। এক একজন আলাদা আলাদা মানুষ, যাদের জীবনের চাওয়া-পাওয়ার সাথে কিভাবে যেন মনে মনে কিছুটা হলেও জড়িয়ে যায় শ্রুতি।
বড় রাস্তা ক্রস করে ফুটপাথে উঠেই সন্দীপকে দেখতে পায় শ্রুতি। শ্রুতি অবাক হয়ে যায়। সন্দীপের স্টলের সামনে কোন ভিড় নেই। কিন্তু ওকি! কি দেখছে ও? নুডলগুলো অত লম্বা হল কি করে? সন্দীপের সারা গায়ে নুডল জড়ানো আষ্টেপৃষ্ঠে! চোখে করুণ আর্তি। ‘একি! কী হয়েছে, সন্দীপ?’ চিৎকার করে ওঠে শ্রুতি। ‘এগুলো কি?’ সন্দীপ বোবার মত শুধু চেয়ে থাকে শ্রুতির মুখের দিকে। ‘কী হল, কথা বলছ না কেন?’ ‘আমার মেয়েটাকে বোধহয় আর বাঁচাতে পারলাম না, দিদি!’ ‘সে কি! কেন!’ ‘এই যে, দেখছেন না? এগুলো জড়িয়ে গেছে আমার সারা শরীরে, আমি তো আর বেরোতে পারছি না!’ ‘ কী বলছ!’ আর্তনাদ করে ওঠে শ্রুতি। এর মধ্যেই ওর চোখ চলে গেছে ঋজুর স্টলের দিকে। সেখানে গনগন করে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা! যে গ্যাসের উনুনে ও রান্না করে, সেটাই যেন একটা অগ্নিকুণ্ড! ‘ঋজু, কি করে হল এমন?’ ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে শ্রুতি। ‘দিদি, আমার সব বইখাতা মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট সব ফেলে দিয়েছি তো ওই উনুনে!’ বলেই হা হা করে হেসে ওঠে ঋজু। ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিল অনন্ত। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মরা মাছের মত নিষ্পলক দৃষ্টি। একি, অনন্তদার সব মিষ্টিগুলো একসাথে দলা পাকিয়ে রাস্তার ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে যে! শ্রুতি চিৎকার করতে চাইছে। কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না! প্রতীক দূরে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই দেখছে আর মুঠো মুঠো করে ঝালমুড়ি বাতাসে ওড়াচ্ছে। কি হচ্ছে এসব? শ্রুতি ছুটতে থাকে ফুটপাথের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, পাগলের মত। ওর সারা শরীরে ঝাঁকুনি লাগে জোরে। ‘কি রে, শ্রুতি! কী হয়েছে?’ মায়ের গলা। ‘কী বলছিস তখন থেকে বিড়বিড় করে?’ ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে শ্রুতি। ‘না, মানে অফিস …’ ‘অফিস তো দু’মাস ধরে বন্ধ লকডাউনে, ভুলে গেছিস!’
অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রুতি মায়ের মুখের দিকে।