।। ১ ।।
—"কি করছো অভিবাবু? কাজ করছো বুঝি?"
—"হ্যাঁ রে, খুব দরকারি একটা প্রেজেন্টেশন তৈরী করছি। বল কি বলছিস? আর তোর এই অভিবাবু ডাকটা কি আর বদলাবে না? কাকু তো বলতেই পারিস?"
—"কাকু? কেন? তুমি কি কাকু-কাকু দেখতে নাকি? ওসব কাকু-টাকু বলতে পারবো না আমি ব্যাস!"
—"পাগলি মেয়ে! বেশ, যখন আমি কাকু কাকু দেখতে হবো, চুল পাকবে, তখন বলিস কাকু।"
—"তুমি কোনদিনও বুড়ো হবে না!"
—"হ্যাঁ সেই, আমি তো দেবরাজ ইন্দ্র! বয়স বাড়বে না। তোর পড়তে বসা নেই? সামনে টেস্ট, ভুলে গেছিস নাকি? যাহ! পড়তে বস গিয়ে--"
—"আচ্ছা বাবা যাচ্ছি। "
নাকে পোড়া পোড়া গন্ধটা এসে ধাক্কা মারতেই চটক ভাঙে পিহুর। দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে ঢুকেই টের পায় সবটা শেষ। চার-পিস মাছই পুড়ে খাক, চারদিকে ধোঁয়া। ঝুপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল পিহুর ভিতর থেকে। মাছ পুড়লে তো গন্ধ বেরোয়, ধোঁয়া দেখা যায়… আর মন পুড়লে?
আনমনে রান্নাঘরের কাজ কোনরকমে শেষ করে টিভির সামনে বসে পড়ে পিহু। অভির ফেরার সময় হয়েছে। টিভি চলতে থাকে নিজের খেয়ালে। জুঁই-এর মালাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে পিহুর মন পাড়ি দেয় বহু দূর… সন্তর্পণে হিসেব করতে থাকে করণীয় কর্তব্য।
।। ২ ।।
—"আহ! ছাড়ো অভি! এমন করে না। আমাদের এই সম্পর্ক সমাজ কোনদিন মেনে নেবে না। আর তাছাড়া এসবের প্রতি আমার আর কোন অনুভূতি নেই। মেয়েটাও তো বড় হচ্ছে নাকি!"
—"তুমি কেন এত ভাবো বৌদি? হ্যাঁ, আমি তোমার থেকে বয়সে ছোট, হয়তো সমাজের পক্ষে কঠিন হবে আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিতে, কিন্তু অসম্ভব হবে না, দেখো। আমি তোমার মুখে হাসি দেখতে চাই, এভাবে রঙহীন হয়ে তোমায় দেখতে পারছি না আর! তোমার আর তোমার মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার মত ক্ষমতা আমার আছে… একবার বিশ্বাস করে তো দেখো আমায়।"
—"এত অবুঝ তুমি! আর আমিও বারবার তোমার কাছে এসে দুর্বল হয়ে যাই। এর চেয়ে আমার মরণ ভালো। সব দিক বাঁচে!"
—"বৌদি! কি বলছো তুমি এসব? আর একবার মরার কথা বললে কিন্তু--"
—"না অভি, কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে আমি না থাকলে আমার মেয়েটার কি হবে? তুমি ওকে দেখো অভি, তোমার ভরসাতেই..."
দমকা হাওয়ায় যেমন ঝরা-পাতারা ঘূর্ণির সৃষ্টি করে, অভিষেকের মনেও স্মৃতির ঘূর্ণিপাক চলছে অবিরাম। ডুকরে ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দ বারেবারেই তাকে অতীতের কোন মুহূর্তে নিয়ে গিয়ে ফেলছে…
"দুদিন ধরে ক্রমাগত কেঁদে চলেছে মেয়েটা! আপনি বরং ওকে নিজের কাছে কদিন নিয়ে যান। আর এই ফাঁকা ফ্ল্যাটে একা থাকলে ও আরোও বেশি ডিপ্রেসড হয়ে যাবে।"
পিহুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অভিষেকের দিকে তাকিয়ে বলেন মিসেস ঘোষ, পিহুর প্রতিবেশী। অভিষেকও যে কথাটা ভাবেনি তা না। কিন্তু ও একা মানুষ, ওর কাছে গিয়ে থেকেই কি কিছু লাভ হবে পিহুর? একটা ছাব্বিশ বছরের মেয়ের কি ভালো লাগবে চল্লিশোর্ধ একটা মানুষের সাথে সময় কাটাতে?
পিহুর দিকে চোখ পড়তেই দেখে কান্না থামিয়ে জলভরা চোখে মেয়েটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মুহূর্তের জন্য অসহায় বোধ করে অভিষেক। সেই চেনা দৃষ্টি!
।। ৩ ।।
আজ তিনদিন হল দুর্গাপুর এসেছে পিহু অভিষেকের সাথে। অভিষেকের সাথে পিহুদের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। পিহুর যখন ছ'বছর বয়েস তখন মায়ের সাথে অভিষেকদের বাড়িতে ভাড়া এসেছিল পিহুরা। বাবা তখন সদ্য মারা গেছেন। হার্টের অসুখ ছিল। জেঠু, কাকাদের অত্যাচারে প্রাইভেট চাকুরিরতা মা বাইরে থাকারই সিদ্ধান্ত নেয়।
যেদিন প্রথম ছোট্ট পিহু এই বাড়িতে এসে ওঠে, অভিষেক তখন উনিশ-কুড়ি। পিহুর গাল টিপে আদর করেছিল, আর পিহুও স্বচ্ছন্দে অভিষেককে আঁকড়ে ধরেছিল। ওই বাড়িতেই পিহুর অর্ধেক শৈশব, কৈশোর, যৌবন সব কেটেছে... কেটেছে অভিষেকের হাত ধরেই। মা-মরা অভিষেক যেদিন বাবাকেও হারালো সেদিন থেকে অভিষেকের সব দায়িত্ব নিয়েছিল পিহুর মা। পিহু তখন সতেরো বছর, অভিষেক তখন বত্রিশের যুবক। সদ্য চাকরি পেয়েছে। অনাথ অভিষেকের মুখের দিকে তাকিয়ে পিহু ফুঁপিয়ে উঠতো। খাবার জলটা পর্যন্ত পিহু অভিকে নিয়ে খেতে দিত না। সারাক্ষণ পায়ে পায়ে ঘুরে অভিষেকের সব কাজ করে দিয়ে স্বর্গীয় সুখ পেত পিহু।
তারপর এল সেই রাত। মাঝরাতে জল তেষ্টা পেতে ঘুম ভাঙতেই পাশে মাকে পেল না পিহু। দরজা খুলে ঘরের বাইরে পা দিতেই অস্ফুট চিৎকারের শব্দে কেঁপে উঠেছিল অষ্টাদশী পিহু। অভিষেকের ঘরের জানলা দিয়ে মা আর অভিষেকের আদিম খেলা দেখে থমকে গিয়েছিল।
তারপর অবশ্য মা বেশিদিন বাঁচেননি। সেই ঘটনার মাস-তিনেক পরেই ছাদ থেকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে! স্পট ডেড। পিহুও সেই সময় ছাদেই ছিল। হেডফোনে গান শুনছিল তো, তাই মায়ের পড়ে যাওয়ার আর্তনাদ পায়নি সে। মিনিটকয়েক পর প্রতিবেশীদের চিৎকারে নীচে নামে পিহু, ততক্ষনে সব শেষ।
আজ আবার এই বাড়িতে এসে, সেইসব কথা বারবার মনে পড়ছে। অভিষেক অফিসে। ওর ঘরটা ভয়ানক অগোছালো দেখে পিহু কাজে লেগে পড়ে। সব গুছিয়ে ফেলতে হবে তাকে। খুব শিগগিরি।
।। ৪ ।।
ট্রেন থেকে নামতেই পিহুর কথা মাথায় আসে অভির। বাড়িতে সারাদিন মেয়েটা একা। ঠিকে ঝি, রান্নার লোক আর কতক্ষন থাকে! তবু, চারদিকে চেনা পরিচিত মানুষ, এই যা ভালো।
পিহুকে একদম জয়িতাবৌদির মত দেখতে হয়েছে। সেই চোখ, সেই চাহনি, সেই হাসি... জয়িতাবৌদিকে তো অভি বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি, তাই মনে মনে অঙ্গীকারবদ্ধ সে, পিহুর কোন ক্ষতি হতে সে দেবে না। তাই তো পিহুর এমএ কম্পলিট হতেই দেখে শুনে বিয়েটাও সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিল। আবীর গ্রামের ছেলে হলেও, চাকরিসূত্রে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাট নিয়েছিল। নিষ্পাপ সরল মুখটায় সবসময় হাসি লেগেই থাকতো।
কিন্তু সে সংসার টিঁকলো কই! বিয়ের তিন-চার মাস পর থেকেই অসুস্থ হতে শুরু করে আবীর। প্রথম প্রথম নাকি বমি পেত, গা গোলাতো। পরের দিকে পেটের যন্ত্রণাও। গাদা গাদা পেইনকিলার খেত। কেন যে ডাক্তার দেখায়নি কে জানে! পিহুও শুধু ঠাকুরদেবতা করেছে এই পাঁচ-ছ’ মাস, ডাক্তার দেখায়নি। কোথায় কোন এক বাবার থেকে নিয়ে আসতো মন্ত্রপূত কিসব সিঁদুর! ফুল! সেসব খেলেই নাকি ভালো থাকতো আবীর। পরে এই কথাগুলো পিহুর মুখেই শোনা। শেষ মুহূর্তে যখন ডাক্তার দেখে তখন দুটো কিডনিই নষ্ট। অতিরিক্ত পেইনকিলার খাওয়ার ফলেই হয়তো হার্টটাও ঠিক ছিল না। ডায়ালিসিসটা নিতে পারল না।
যাক, যা হবার হয়েছে। পিহু একটু সামলে উঠলেই সে আবার ছেলে দেখবে। বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সে অনেক আগেই নিয়েছিল। অসহায় জয়িতাবৌদির মুখটা যতবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ততবার এই ব্যাপারে সে আরো বদ্ধপরিকর হয়। তবে পিহুর জীবনটা তো এভাবে থেমে যেতে পারে না। পিহুর আবার বিয়ে দেবে সে। ভাবতে ভাবতেই বাড়ির কলিং বেলটা চাপলো অভি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে! ও কে! জয়িতাবৌদি!
।। ৫ ।।
পিহু এখন সবসময় শাড়িই পরে। আলগোছে এলো খোঁপাটা পড়ে থাকে ঘাড়ের একটু নীচে। রান্নাঘরের কাজের ফাঁকে চা নিয়ে এসে দাঁড়ায় অভির সামনে। আলতো হাতে কপালের ঘামটা মুছে নেয়, ঘামে লেপটে থাকে দুটো-একটা চুল! একেবারে জয়িতাবৌদি! এত মিল! বারবার থমকে যায় অভি। তাকিয়েই থাকে পিহুর দিকে।
অক্লান্ত হাতে অভিষেকের সংসার গুছিয়ে যায় পিহু। মুখে সবসময় হাসি। অভির পছন্দমত রান্না হয়, অভির জামাকাপড় গুছোনো থাকে, অভির ফাইলপত্র সবসময় ঠিক জায়গায়। অফিস থেকে ফিরে আজকাল এই সুখী গৃহকোণ অভিষেকের মনে এক অদ্ভুত নেশা তৈরী করে। ভুলতে থাকে পিহুকে নিয়ে ভেবে রাখা তার কর্তব্য। সময় নিজের স্রোতে বয়।
ক্রমে দুই অসমবয়সী মানব মানবী কাছে আসতে থাকে প্রকৃতির নিয়মেই। পরিণত মনের অভিষেকও আটকাতে পারে না নিজেকে।
—"পিহু! তুই?"
—"হুঁ, আমিই তো। কেন? এতক্ষন কার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছিলে তুমি? অন্য কেউ বুঝি?" মজাচ্ছলে চোখ তুলে বলে পিহু।
—"কিন্তু তুই বা কেন? ছি ছি! সব আমার ভুল! আমার দোষ..."
—"এরকম করে কেন বলছো অভিবাবু? যা হবার ছিল, হয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা সমাজের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হলেও, অসম্ভব নয়!" অদ্ভুত মানসিক তৃপ্তির সাথে কথাগুলো বলে পিহু।
চমকে তাকায় অভি পিহুর মুখের দিকে। অতীত কি বুমেরাং হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অভির! এই বর্তমানের ভবিষ্যৎ কি?
অফিস পার্টিতে সামান্যই এলকোহল পেটে পড়েছিল। অনভ্যাসের দরুন শরীর খারাপ লাগতেই বাড়ি ফিরে আসে অভি এবং সে-রাতেই নিজেকে চরম মুহূর্তে আবিষ্কার করে পিহুর নিরাবরণ দেহের উপর।
হঠাৎ করেই স্মৃতি ফিরে আসার মতই এক ঝটকায় মনে পড়ে যায় সব! জয়িতাবৌদি... পিহু... নিজেকে সামলাতে পারে না অভি। ডুকরে কেঁদে ওঠে।
সে-দিনের পর থেকেই অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ হয়ে গেছে অভিষেক। পিহুর মনখারাপ লাগে। সে তো আর মদ্যপ ছিল না। সে যা দিয়েছে, তা মন থেকেই দিয়েছে। অবশ্যম্ভাবী ছিল বলেই আজ এত বাধা পেরিয়ে সে অভিষেককে পেয়েছে! আর সেই অভি কি না ওই ঘটনাটাকে মাত্র এক রাতের ভুল বলে এড়িয়ে যেতে চাইছে? উপরন্তু তার জন্য নাকি ছেলে দেখাও চলছে ভিতর ভিতর... আর ভাবতে পারে না পিহু। চোখ উপচে জল আসে। এত বছরের জমে থাকা যন্ত্রণা যেন বেরিয়ে আসতে চায় চোখ, বুক ফেটে...
।। ৬ ।।
খোঁপার জুঁইটাতে ক্লিপ লাগাতে লাগাতে নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখে পিহু। লাল বেনারসি, কপালে লাল টিপ, এক গা গহনা! সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে তাকে। নিজেই নিজের রূপে বিভোর হয়ে থাকে সে কিছুক্ষন।
আর মাত্র কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। অভির সমস্ত ইচ্ছে পূরণের.. সারা জীবনের জন্য, অভি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। আর জীবনের পরেও যদি কিছু থেকে থাকে?
কলিং বেলটা বাজার অপেক্ষায় আছে পিহু। অস্থির লাগছে... অন্যদিন তো চলে আসে অভি এতক্ষন। আজই কেন দেরি করছে এত!
অফিস থেকে ফিরে বাথটবে আধ ঘন্টা কাটানো অভির চিরকালের অভ্যেস। পায়ে পায়ে বাথরুমে গিয়ে বাথটবটা ভরতে থাকে পিহু। এক্ষুনি হয়তো চলে আসবে অভি!
ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলের শব্দে চমকে ওঠে পিহু। দৌড়ে গিয়ে খুলে দেয় দরজা। পিহুকে ওই সাজে দেখে অবাক হলেও কিছু বলে না অভিষেক। রোজকার মত জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে যায় সে। বাথটবে নামার আওয়াজ পায় পিহু। দ্রুতপায়ে বাইরের সুইচবোর্ডের একটা সুইচে চাপ দেয়। বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে লক করতে করতেই ভিতরে বীভৎস গোঙানির আওয়াজ পায় সে... মনে পড়ে যায় আট বছর আগের সেই রাতের চিৎকার! তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে পিহুর মুখে। অভিষেক যখন এতই ভালবাসে তার মাকে, তবে তাই হোক।
পরবর্তী কর্তব্য ভাবতে বসে পিহু। সহজ সরল আবীরকে রোজ একটু একটু করে খাওয়ানোর পরও চার প্যাকেট ভাগ্যবতী সিঁদুর এখনও তার ব্যাগে রয়েছে... এছাড়াও রয়েছে এ-বাড়ির দোতলার ছাদ। মাকে সেদিন পিছন থেকে ঠেলে দেবার পর উচ্চতার আন্দাজ টা মেপে নিয়েছিল ভালো করেই...
কোন পথে গেলে আবীরের কাছে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছবে ভাবতে থাকে পিহু। হিসেবের গরমিলগুলো খুব দ্রুত তাকে শুধরে নিতে হবে। আজ যে তাদের মিলনের রাত...