গিবন-যাত্রা
সন্ধ্যাবেলা বোস্টনের চার্লস নদীর পারের এই ঝরাপাতায় ঢাকা পায়ে চলা পথ শাল্মলীর ভীষণ প্রিয়। ছোটবেলায় মায়ের সাথে প্রায়ই আসত এখানে। ওর বিশ্বাস এখানে নদীকে কিছু বললে মা শুনতে পায়। আজ ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে দারুন একটা খুশীর খবর মাকে জানাতে এখানে এসেছে ও। আজই তার রিসার্চ গাইড জানিয়েছে যে ইউনেস্কো স্পন্সরড একটা আন্তর্জাতিক প্রোজেক্টে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি অংশগ্রহণ করবে। হার্ভার্ডের পক্ষ থেকে মূল কাজটি করবে সে অর্থাৎ ডঃ শাল্মলী সেন। বায়োডাইভারসিটি ও জীন-তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইতিমধ্যেই সে বিশ্বে এখন অনেকটাই পরিচিত। হাঁটতে হাঁটতেই টের পেল এই সন্ধ্যায়, নদীর নরম হাওয়া মায়ের মতোই জড়িয়ে ধরছে তাকে।
লুপ্তপ্রায় ‘গিবন’দের উন্নত জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা এবং এপ থেকে মানুষে বিবর্তন ও অভিযোজন নিয়ে এটি একটি বিশ্বজোড়া প্রজেক্ট। কাজটার প্রথমভাগে বেছে নেওয়া হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি ছোট্ট অভয়ারণ্য। ‘হলঙ্গাপার গিবন পার্ক’। গিবন বা ভারতীয় ভাষায় উল্লুকরা এখানে বহুদিন ধরেই বসবাস করে। যদিও এরা বিশেষ দেখা দেয় না, তবু সংখ্যাধিক্যের কারণে এই অরণ্যে এদের দেখা পাওয়া অপেক্ষাকৃ়ত সহজ। ইন্ডিয়ার দিল্লি ইউনিভারসিটির ডক্টর হর্ষ কাপুর সবরকম সাহায্য করবেন এই প্রজেক্টে।
অনেক বছর আগে বোস্টনে শাল্মলীর বাবা এসেছিলেন হার্ভার্ডে পদার্থবিদ্যার পি-এইচ-ডি প্রোগ্রামে। এখনও সেখানকারই ফ্যাকাল্টি উনি। মা এসেছিলেন বিয়ের পর। বাবার বাবা ছিলেন ভারতীয় রেলের উচ্চপদস্থ অফিসার। মা’কে তিনিই পছন্দ করে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। মা ছিলেন সুন্দরী এবং অত্যন্ত সুগায়িকা। বোস্টনেও তার গানের যথেষ্ট কদর ছিল। দুর্ভাগ্যবশত অল্পদিনের কঠিন রোগে ভুগে, কয়েক বছর আগেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। শাল্মলী হার্ভার্ডের এক কৃতি ছাত্রী। পড়াশুনো, গবেষণা ইত্যাদিই তার ধ্যান-জ্ঞান। বিয়ে, সংসার ইত্যাদির কোন সময় নেই আপাতত।
শাল্মলী জেনেছে যে এই গিবন পার্কটি ‘মরিয়ানি’ নামের একটি রেল-জনপদের কাছেই অবস্থিত। সেখানে নাকি তার দাদুরা থাকতেন একসময়। যদিও সেখানকার বাড়ি, দোকান ইত্যাদি বিক্রি করে দাদুরা কলকাতায় চলে গিয়েছেন বহু বছর আগে। তবু মায়ের ছোটবেলার জায়গাটা হয়তো দেখা যেতে পারে। বত্রিশ বছরের জীবনে, শাল্মলী ইন্ডিয়াতে গেছে বার চারেক। আসামে কখনও আসা হয়নি যদিও।
ডঃ কাপুর সব ব্যবস্থা করেছেন। অভয়ারণ্যের গেস্ট হাউসেই তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বোস্টন থেকে দিল্লি ও কলকাতা ছুঁয়ে শীতের এক বিকেলে আসামের গিবন পার্কে এসে পৌঁছল শাল্মলী । ‘গোলাপ বোরা’ নামে একজন মাঝবয়েসি ফরেস্ট বাংলোর কেয়ারটেকারকে তার রাঁধুনি ও জঙ্গলে মালবাহক হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে। বোরা ইংরাজি কিছুটা বোঝে আর বাংলা ভালই বলতে পারে। শাল্মলীও বাংলা বলতে ও কিছুটা পড়তে পারে। বোরার বৌ-বাচ্চাও জঙ্গলের স্টাফ-কোয়াটারেই থাকে। আসার পথে চা-বাগান, সবুজ প্রকৃতি, দূরে নাগাপাহাড় দেখতে দেখতে দারুণ ভাল লেগে গেল জায়গাটা। একটা চা-বাগান আর একটা পরিত্যক্ত রেললাইনের পাশ দিয়েই জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা। পুরনো বন-বাংলো, অনেক পরিষ্কার করার পরেও বেশ স্যাঁতস্যাঁতে একটা গন্ধ রয়ে গেছে ঘরগুলোতে। অবশ্য এখানে এর থেকে ভাল কিছু আশাও করেনি শাল্মলী।
গিবনরা সমাজবদ্ধ জীব। উঁচু গাছের ওপরের দিকেই তাদের বিচরণ। দরকারে অদরকারে কখনও কখনও তারা নিচে নেমে আসে। এদের লেজ বিলুপ্ত, হাত-দুটি বেশ লম্বা। বনমানুষ বা এপ থেকে মানুষের বিবর্তনের পথে মানুষের কাছাকাছি একটা লিঙ্ক এরা। তাদের সমাজে একজোড়া পুরুষ ও নারীর একসাথে কাটাবার ব্যবস্থা আছে। এদের জীবনযাত্রায় গানের বিশেষ স্থান আছে দিনের বিভিন্ন সময়ে গান গেয়ে এরা অন্য গিবনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। পুরুষ গিবন গান শুনিয়ে নারীদের আকৃষ্ট করে। অল্প কিছুদিনের জন্য সেই পুরুষ ও নারী গিবন একসাথে বিচরণ করে। তারপর তারা একটা সংসারে বা ইউনিটে পরিণত হয়। তাদের সন্তান হয় একটি বা দুটি। সন্তানরাও এভাবেই তাদের নিজস্ব ইউনিট তৈরি করে। তবে শোনা যায় যে ইউনিট তৈরি করার সময় নারী বা তার পরিবার যদি পুরুষ গিবনকে কোনভাবে বাতিল করে তা হলে সেই গিবনটি সমাজ-পরিত্যক্ত হয় এবং একলাই তাকে থাকতে হয় বাকি জীবন। তবে পরিত্যক্ত গিবন বিশেষ দেখা যায় না এখন।
বাঁশি জানে
সপ্তাহ দু-এক গিবনদের আস্তানার কাছাকাছি ওদের সমাজ ও জীবনযাত্রা নিয়ে নানারকম তথ্যসংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাল শাল্মলী। অনেক স্যাম্পেল সংগ্রহ করা হল। একটা গিবনকে ধরে তার রক্ত, লালা ও অন্য প্যাথলজিক্যাল নমুনা সংগ্রহ করে ছেড়ে দেওয়া হল। কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা এবং অন্যান্য স্টাডি সম্বলিত একটা ফিল্ড-রিপোর্ট তৈরি করে একদিন রাতে প্রজেক্ট-লীডারকে বোস্টনে ইমেল করে দিল শাল্মলী। সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখার জন্য গিবনদের নিশ্চয়ই একটা পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপার আছে। শাল্মলীর মনে হয়েছে এরা এমন কিছু শিকড়-বাকড়ের সন্ধান জানে যা এদের গর্ভনিরোধকের কাজ করে। কিছু স্যাম্পল সে নিয়েছে কিন্তু এর জন্য প্রজেক্টের স্কোপ বাড়াতে হবে। এব্যাপারেও সে একটা নোট তৈরি করে পাঠাল বোস্টনে। সব কিছু শেষ করে দেখল রাত গভীর। ঘুমোতে যাবে, ঠিক সেই সময়েই জঙ্গলের নিস্তব্ধতা খান খান করে উঁ-উঁ-উঁ করে একটা করুণ সুর ভেসে এল তার কানে। মনে হল কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। এই জঙ্গলের গভীরে কে বাজাবে বাঁশি? তবে কি এটা কি কোন জীবজন্তুর ডাক? গিবনের কি? ডাক না কান্না? এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতার দ্যোতক, বুক খালি করা সুর। সাধারণত একটা গিবন ডাকলে, অন্য গিবনরা সাড়া দেয়। কিন্তু এই ডাকের কেউ সাড়া দিল না। এক ভারি মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল শাল্মলী।
পরের দিন বোরাকে জিজ্ঞেস করে সে জানতে পারল যে এই সাড়া না পাওয়া ডাক হল সমাজ-পরিত্যক্ত গিবনের। আজকাল এই ডাক বড় শোনা যায় না। তবে কাল রাতে বোরাও শুনেছে জঙ্গলের গভীর থেকে আসা এই ডাক। এইরকম এক একলা গিবনকে ওই গভীরেই মাঝে মাঝে দেখা যায়। অনেক বয়স তার। কিন্তু গিবনসমাজ তার ডাকে কখনও সাড়া দেয় না।
শাল্মলী উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘এই গিবনটা কি দেখা যেতে পারে?’
ম্যাডাম, ও জঙ্গলের অনেক গভীরে থাকে। সেখানে অন্য জানোয়ার আছে, বিপদ হতে পারে। যাবার পারমিশন পাওয়া যাবে না।’
‘আমার কাজের জন্য তাকে একটু স্টাডি তো করতেই হবে বোরা। আমি জঙ্গলের বড়কর্তাদের সাথে কথা বলছি।’
সেদিনই ডঃ কাপুরকে অনুরোধ করাতে উনি দিল্লিতে কথা বলে সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন।
দিবস গনিয়া গনিয়া বিরলে
পরের দিন খুব ভোরে বন-বিভাগের একটা হুডখোলা মারুতি-জিপসী গাড়িতে সে, বোরা আর একজন বন্দুকধারী গার্ড রওনা হল। বেশি লোকজন দেখলে গিবন দেখাই দেবে না। তবে আপৎকালীন স্থিতিতে সামাল দিতে আরো কিছু বন্দুকধারী জঙ্গলরক্ষী দূরত্ব রেখে লুকিয়ে তাদেরকে অনুসরণ করতে লাগল। মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রাখা, শুধু ওয়াকি-টকির হাল্কা আওয়াজ জঙ্গলের আওয়াজের সাথে মিশে যাচ্ছে। পথ কোথাও সঙ্কীর্ণ পায়ে-চলার, কোথাও নেই-ই। জঙ্গল ভেঙে ঘন্টা দেড়-এক চলার পর উঁচু-উঁচু গাছে-ঘেরা কিছুটা ফাঁকা জায়গায় জীপ দাঁড়াল। ওরা তিনজন নেমে গাছের আড়ালে গেল আর ড্রাইভার জীপ নিয়ে কাছাকাছি লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পরও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল না। কিছু অন্য জানোয়ার দেখা গেলেও গিবন দেখা গেল না। প্যাকড লাঞ্চ ইত্যাদি খাওয়ার পরেও কাটল ঘন্টাখানেক। উঁচু গাছেদের মাঝে এই জায়গাটা একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। গার্ড বলল ‘ম্যাডাম বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। অন্ধকার হবার আগেই বের হতে হবে। এখানে বাঘ আছে আর তাছাড়া বুনো-হাতিরও চলার রাস্তা এটা।’ বাইনাকুলারে চোখ যখন ক্লান্ত, তখনই বোরা বলল ‘ম্যাডাম, দূরের দলটাতে একজন গার্ড আছে সে গিবনের ডাক ডাকতে পারে। তাকে বলব গিবনের ডাক ডাকতে? শুনে যদি এই গিবনটা দেখা দেয়। কিন্তু বিপদ একটা আছে। যদি গিবন একবার বুঝতে পারে যে এটা মানুষ ডাকছে, তাহলে আর সে আসবে না।’
একটু ভেবে নিয়ে শাল্মলী সম্মতি দিল। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। ওয়াকি-টকিতে কথা হয়ে গেল ওই গার্ডের সাথে। কিছুক্ষণ পরেই কাছাকাছি কোন জায়গা থেকে একটা অস্ফুট স্বরে গিবনের ডাক উঠল। জানা না থাকলে বুঝতেই পারত না সে যে গার্ড এই আওয়াজটা করছে। যেন চুপি চুপি কেউ কাউকে ডাকছে। অন্যরা জেনে ফেললেই বিপদ। খুবই সাংকেতিক একটি ডাক এটি। এভাবে দু-তিনবার ডাকের পরেই তাদের কাছাকাছি একটা লম্বা গাছের উঁচু ডাল থেকে ওইরকমই অস্ফুট সাংকেতিক আর একটি ডাক শোনা গেল। বোরা শাল্মলীকে চুপি চুপি তার পেছন-পেছন আসতে বলল। কিছুটা গিয়ে একটি বড় গাছের ওপরে পাতার ফাঁকে একটি একাকী গিবন দেখতে পেল তারা। গিবনটি বেশ বয়স্ক এবং বড়সড়। সেও অস্ফুট আওয়াজ করে ডাকছে কাউকে। গার্ডের ডাকটা দূর থেকে আর একবার এল। হঠাৎই গিবনটি এদিক ওদিক কিছু খুঁজল, তারপর উঁচু ডাল থেকে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। তার নিস্তরঙ্গ জীবনে যেন তরঙ্গ দোল লেগেছে। চলতে তার খুব কষ্ট, তবু যেন একটা অদৃশ্য শক্তি তার স্থবিরতা ভুলিয়ে দিয়েছে। নিচের ডালে এসেই গাছের আড়ালে দাঁড়ানো শাল্মলীকে দেখে ফেলল সে। খানিকক্ষণ দুজনের কেউই চোখ সরাল না। শাল্মলী কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখল, কি বিষাদমাখা সেই চোখ। কি ভীষণ একাকীত্ব ঘনিয়ে রয়েছে তাতে। কিছুটা থমকে থাকার পর অবসন্ন পায়ে নিজের ভারি শরীরটা বয়ে বয়ে ওপরে উঠে আবার ডালপালার মধ্যে মিলিয়ে গেল। অসম্ভব আশাভঙ্গের যন্ত্রণা চলার ভঙ্গিতে ছড়িয়ে দিয়ে গেল। অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া কাউকে দেখার আশা করেছিল কি সে? শাল্মলীর মনের মধ্যে গেঁথে রইল তার বেদনা-বিধুর চাহনি আর আশাহত চলে যওয়ার ভঙ্গি। একটা ভীষণ মনখারাপ নিয়ে সে নিজের বাংলোতে ফিরল।
সে রাতেই তার প্রজেক্ট লিডারের কাছ থেকে ইমেইল এল। কাজ খুব ভালই এগিয়েছে। পরের ভাগের কাজ হবে বোর্নিওর বৃষ্টি-অরণ্যে। তবে গিবনদের পরিবার-পরিকল্পনার ও শিকড়বাকড়ের ব্যাপারে একটা ছোট ফিসিবিলিটি রিপোর্ট শাল্মলী যেন তৈরি করে। আরও কি-কি এখানে করতে হবে তারও একটা ফিরিস্তি উনি ইমেইল-এই পাঠিয়েছেন।
দুজনে দেখা হল
শাল্মলীর কাজ ভালভাবে শেষ হয়ে গেল আরও সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। ফিরে যেতে যখন মাত্র দু-দিন বাকি তখন বাবার ফোন পেল। ‘কাজ তো শেষ হয়েই গেছে, এতদূর গেলে এবার দাদুর বাড়ির জায়গাটা একবার দেখে নাও’। আরে তাই তো কাজের উৎসাহে একদম ভুলেই গিয়েছিল। কলকাতায় দাদুকে ফোন করে সঠিক জায়গাটা জেনে নিল সে। ‘ঘোষ ভাণ্ডার’ নামে তাদের একটা মুদীর দোকান ছিল। সেটা খুঁজতে সুবিধে হবে হয়ত।
ফেরার আগের দিন সকালে বোরাকে নিয়ে সে এল মরিয়ানি স্টেশনের পাশের রাস্তায় দাদুর পুরনো বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে। অনেক চেষ্টা করেও ‘ঘোষ ভাণ্ডার’ দোকানটা কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে অনেক দোকানের মাঝে খুব ছোট্ট একফালি ঝাঁপবন্ধ অনেক পুরনো দোকান দেখতে পেল সে। আশেপাশের নতুন দোকানগুলোর মাঝে এ যেন নিতান্তই মুখলুকোনো ও অনাবশ্যক।
আজ সে একটা তাঁতের শাড়ি পরে এসেছে। আকাশনীল শাড়িটা তাকে মামাবাড়ির উপহার। বোস্টনে বিশেষ পরা হবে না তাই আজ পরেছে। চুলে করেছে একটা পনিটেল। মেঘলা দিনে একরাশ রোদ্দুর যেন ঘিরে ধরেছে তাকে।
যা শুনেছিল তার তুলনায় মরিয়ানি ষ্টেশনটা এখন অনেক বড়। জায়গাটা একটা ছোট্ট শহরে পরিণত হয়েছে। ঠিকানা অনুযায়ী পাওয়া সেই পুরনো ছোট্ট বন্ধ দোকানের ঠিক পাশের একটা ঝাঁ-চকচকে সাজান-গোছান মোবাইলের দোকানে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে তারা ‘ঘোষ-ভাণ্ডার’ বলে কোন দোকানের কথা জানে না। পাশের পুরনো দোকানটা একজন বয়স্ক মানুষের। তিনি একাই থাকেন ভেতরের একটা ঘরে। সব-দিন দোকান খোলেনও না। আজ উনি অসুস্থ। বোধ হয় জ্বর হয়েছে। একলা মানুষ তাই ওনার চলে যায় কোনরকম। অনেক আগে উনি এখানেই ছিলেন। পরে বৃদ্ধ বয়সে ফিরে এসে এই দোকান আর পেছনের ঘর এক মারোয়াড়ি পরিবারের থেকে কিনে বসবাস করছেন। আপনজনও ওনার বিশেষ কেউ নেই। একটা ঘরে একজন রেলের গ্যাংম্যান-কে থাকতে দিয়েছেন। সে-ই ওনাকে দেখে আর দোকান চালাতে সাহায্য করে।
‘একবার ওনার সাথে দেখা হতে পারে? এই বাড়িতে আমার দাদুরা অনেক বছর আগে থাকতেন। আমি একটু ভেতরটা দেখতে চাই। মিনিট পাঁচেক লাগবে। অবশ্যই যদি ওনার কোন অসুবিধা না থাকে।’
মোবাইলের দোকানের ছেলেটি ওকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ওই পুরনো দোকানটার পাশের দরজা খুলে ওকে ভেতরে আসতে বলল। বোরাকে জীপ-এ অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেল শাল্মলী। ভেতরে ঢুকেই একচিলতে চৌকো খোলা জায়গায় এসে পড়ল। বেশ এলোমেলো জায়গাটা। চারপাশে কয়েকটা ঘর। একটা খোলা দরজা দেখিয়ে ছেলেটি তাকে ভেতরে যেতে বলল। আধ-অন্ধকারে যেন একফালি আকাশ হয়ে ঘরটাতে ঢুকল সে। অসুস্থ একজন বৃদ্ধ কাশতে কাশতে মলিন বিছানায় উঠে বসলেন। তাকে দেখে বয়স্ক মানুষটির চোখ যেন বিস্ময় ও মুগ্ধতায় বিস্ফারিত হয়ে গেল। সেও দেখল, বৃদ্ধ মানুষটি বেশ রোগা, তামাটে গায়ের রঙ, মাথার চুল পাতলা। আধ-ময়লা একটা চাদর কোনরকমে গায়ে জড়িয়ে উনি বললেন,
‘এসো মা এসো। আমি জানতাম তোমরা কেউ না কেউ একদিন নিশ্চয়ই এখানে আসবে। আমি অনেক লড়াইয়ের পর এখানে ফিরে এসেছি। অনেকদিন অরুণাচল, নাগাল্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছি। সন্ত্রাসবাদীদের হাতেও বন্দী হয়ে ছিলাম বহুদিন। কি করে বেঁচে রইলাম আমিই জানি। হয়তো মৃত্যুর সাথে এখানেই আমার দেখা হবে বলে।’
বেশ অবাক হল শাল্মলী। তাকে এভাবে ফিরে আসার গল্প কেন শোনাচ্ছে মানুষটি।
‘আমি আমার দাদুর বাড়ি আর মায়ের ছোটবেলার জায়গাটা শুধু একবার দেখতে এসেছি। তবে মনে হচ্ছে আপনি আমদের পরিবারেরই একজন ছিলেন।’
‘তোমাদের দোকানটা আমিই চালাতাম। একজন কর্মচারি বলতে পার।’
‘আমরা আমেরিকাতে থাকি। আপনার কথা আমি কখনও শুনিনি। মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বছর পাঁচেক আগে। এখানে একটা রিসার্চের কাজে এসেছিলাম। বাবা, দাদুরা বললেন একবার দেখে যেতে পুরনো জায়গাটা। ভাবিনি বাড়িটাও দেখতে পাব।’
‘কি বললে, তোমার মা আর নেই?’ যেন হঠাৎ প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ পেলেন। ‘কি বলব, তোমার মা, মামা এই উঠোনেই বড় হয়েছে। এক সময় কোন কারণে তোমার দাদুদের বিরাগভাজন হয়েছিলাম আমি। তোমার মা-ই আমাকে সেইসময় চুপি চুপি বলেছিলেন অন্য জায়গায় চলে যেতে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে। আমি চলে গিয়েছিলাম কিন্তু সময়মতো ফেরা আর হয়ে ওঠেনি। তোমার দাদুরা যখন এখান থেকে চলে গেলেন, তখন আমি ভাগ্যের ফেরে এক সন্ত্রাসবাদী দলের হাতে বন্দী। তারা তাদের সাথে আমাকে বার্মাতে নিয়ে গিয়েছিল জামিন বন্দী হিসেবে। বহুদিন বাদে ছাড়া পেয়েছিলাম। দেখা হয় নি আর কারও সাথে।’ বলতে বলতেই লক্ষ্য করল মানুষটির চোখদুটো ভিজে এসেছে। ঠোঁট কাঁপছে। একটা তোলপাড়কে ভেতরে আটকে রাখতে চাইছেন উনি। অনেকক্ষণ পরে নিজেকে সংযত করে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন--
‘তোমাকে একদম তোমার মায়ের মতই দেখতে। ভগবান যেন তার সাথেই আমার দেখা করিয়ে দিলেন আজ। এটুকুর জন্যই আমি পরমেশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি কি একটু বসবে মা, ওই কাঠের চেয়ারটায়?’ কেন কে-জানে বৃদ্ধকে বড় আপন মনে হল তার। হয়ত নিজের ইমোশনকে তার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। ঘরটা মোটামুটি খালি। শুধু একপাশে কতগুলো পুরোনো টিনের তোরঙ্গ রয়েছে। অশক্ত পায়ে বিছানা থেকে নেমে উনি কোন তোরঙ্গ থেকে একটা কাঠের বাক্স বার করলেন।
‘এটা তোমাকে দিতে চাই। তোমার মায়ের ছোটবেলার হারমোনিয়াম। এখানে অন্যান্য ফেলে যাওয়া জিনিসের মধ্যে কিভাবে যেন রয়ে গিয়েছিল এতবছর। আমি আগলে রেখেছি। এখন যেন তাকেই ফেরত দিচ্ছি মনে হচ্ছে। তুমি নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করো মা।’ বাড়িটা, দোকানটা ঘুরিয়ে দেখালেন বৃদ্ধ। কয়েকটা ছবি তুলল শাল্মলী। বাইরে তখন মেঘ-ভাঙা রোদ্দুর।
ফেরার সময় বোরাকে দিয়ে হারমোনিয়ামটাকে গাড়িতে রাখা হোল। গাড়িতে তার একটা গলফ-ক্যাপ রাখা ছিল। সেটাই দরজায় দাঁড়ান বৃদ্ধের মাথায় পরিয়ে দিল সে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। বৃদ্ধের চোখের কোনে তখন জল চিকচিক করছে। হাত জোড় করে প্রণাম করে সে বলল, ‘আপনি ভাল থাকবেন। আর কখনও দেখা হবে কিনা জানি না। তবে মনে থাকবে এখানকার কথা।’
‘না না, মনে রাখার দরকার নেই। স্মৃতির কারবার শুধুই আমার। আশীর্বাদ করি তুমি আরও বড় হও। জীবনে সব ক্ষেত্রে সফল হও।’ আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বললেন বৃদ্ধ।
গাড়ীতে ওঠার সময় পেছনে তাকিয়ে শাল্মলী দেখল বৃদ্ধ ভেজা দুই চোখে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। গাড়ী স্টার্ট হতেই বৃদ্ধ পেছন ফিরলেন, অবসন্ন পায়ে ভেতরের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল এই ব্যথাভরা দৃষ্টিপাত এবং এই অবসন্ন পায়ে চলে যাওয়ার ভঙ্গি তার চেনা। কদিন আগেই কোথাও দেখেছে সে। খুব অদ্ভুত মনে হলেও এই মুহূর্তে একটি পরিত্যক্ত বৃদ্ধ গিবন এবং একজন বয়স্ক মানুষের ব্যথাতুর চাহনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
লিখন তোমার
এই নি:সঙ্গ মানুষটির কথা সে কোনদিন কারো কাছে শোনেনি। কৌতুহলবশত সন্ধ্যায় দাদুকে ফোন করে জানতে চাইল মানুষটির কথা। শুনে দাদু অবাক আর কিছুটা যেন বিরক্তও হলেন। বললেন--‘আরে এখন খোকন থাকে নাকি ওই বাড়ীতে? আমাদের দোকানে ও কাজ করত। বোধহয় চুরি বা ওইরকম কিছু করাতে ওকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।’ দিদিমা অবশ্য একটু অন্যরকম বললেন--‘ওই সময় তোমার মা বড় হচ্ছে, তখন আমাদের ছোট বাড়ীর মধ্যে একটা অনাত্মীয় ছেলেকে রাখারও অসুবিধে ছিল। ছোট জায়গা, পাঁচজনে পাঁচকথা বলবে। তাই ওকে ছাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। তুমি ঠিক বুঝবেনা হয়ত।’ এক পুরোনো কর্মচারীর তাদের দোকান ও পরিবারের প্রতি এতটা টান কেন সেটা কিন্তু উত্তরে বোঝা গেল না।
সে-রাতে হারমোনিয়াম-টা প্যাক করার সময়, মায়ের কথা মনে পড়ল। বেলো-টা খুলে একটু বাজাতে গিয়ে বেলোর ভেতরের দিকে একটা ডট-পেনের প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া একটা বাংলা লেখা চোখে পড়ল। অনেক চেষ্টা করে পড়ল সে লেখাটা। লেখা আছে ‘তোমার আসন শূন্য আজি’। গানটা মা খুব গাইতেন। শাল্মলীকেও শিখিয়েছিলেন। কিন্তু এটা কার হাতের লেখা? মায়ের কি? কার আসন? খোকন নামের মানুষটি কি তাহলে সত্যি চোর। কি চুরি করেছিলেন তিনি? এক কিশোরী মন? হয়ত নিজেরই অজান্তে। তবে বড় বেশী দাম দিতে হল তাকে। চুরির ধন আগলাতে আগলাতে একটা গোটা জীবন নিঃসঙ্গ কেটে গেল তার। হারমোনিয়ামের ভেতরের আবছা লেখাটা বড় গোপন কিছু বলে গেল তাকে। এ কথা জানল শুধু সে আর জানবে চার্লস নদীর পারের সেই মায়াময় বাতাস। ভাবতে-ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল সে। এখন অনেক রাত। কাল ভোরে ট্যাক্সি আসবে তাকে গৌহাটি এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার জন্য। সেখান থেকে মুম্বাই হয়ে বোস্টন একটা অনেক লম্বা আকাশপাড়ি। একটু ঘুমিয়ে নেবার তোড়জোড় করছে সে, ঠিক তখনই, মাঝরাতের জঙ্গলের নিস্তব্ধতা খান-খান করে বড় উদাসী সুরে ডেকে উঠল সেই একলা গিবন--‘উঁ-উঁ-উঁ-উঁ’। যেন বাঁশির মন ভার করা সুর। মনে হল, সকরুণ এই বাঁশির উত্তরাধিকার জঙ্গলের আদিম পিতামহের কাছ থেকে নিয়ে মানুষ আজও বহন করে চলেছে। এর কোন বিবর্তন নেই।
রাতের পৃথিবীতে নেমে এল প্রগাঢ় ঘুম। বাঁশিটি জেগে রইল শুধু।