মোরগের জন্য খাবার কিনে আনতে বলেছিল শোভনের মেজমেয়ে পুচাই। দানা। আঃ! আবদার কত, মোরগকে দানা খাওয়াবে! আস্তাকুঁড়ে ঘেঁটেই মোরগেরা খানা পায় চিরদিন—
একথা মেয়েটাকে বোঝানো হয়নি যদিও। সারাদিন কাজের পরে ঘরে ফিরে অত তাকৎ ছিল না তখন শোভনের শরীর-মনে। ওদের ওরম আবদার তো লেগেই থাকে সারাক্ষণ। বুলটিটাও—
এখন, বাড়ি ফেরার পথে মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিল যদিও। কিনে আনলেই হত...। তারপরেই সেই খুঁতখুঁতুনিটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল শোভন।
আর এখন মোরগের দানা কেনে না! একেই গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা।
গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা।
দু-একদিনের মধ্যে বৃষ্টি না নামলে আর বেঁচে থাকা যাবে না, বেজার মুখে শুকনো চাষের জমির মধ্যিখানের আল ধরে বড় রাস্তার দিকে চলতে চলতে এখন তাই বরং ভাবছিল শোভন। বেজার মুখেই গলা ছেড়ে গান গাইছিল কখনো কখনো। কখনো গুনগুন করছিল মৃদুস্বরে। গলায় জড়ানো ভিজে গামছাটায় কপালের ঘাম মুছছিল ঘন ঘন।
বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছে সেই কখন! এখনও, এই খোলা মাঠের মধ্যে এই আলপথে একবিন্দু ছায়া পড়েনি। এতটুকু কোনও করুণার লেশমাত্র নেই এই ধূ ধূ মাঠের মধ্যিখানে কোনওদিকে কোথাও।
কাল বৃষ্টি হলে ভালই, পরশু বৃষ্টি হলে তারাকাকার বাড়ির দু’তলার ছাদ বানানোটা মাঠে মারা যাবে। জিনিষপত্র নষ্ট, খাটনি অনেক বেশি, ছাদও ভাল হবে না।
আজই যখন ওদের বাড়িতে সারাদিনের কাজ শেষ করার পরে জল চেয়েছিল শোভন, কাকার বছর দশেকের মেয়েটা বলেছিল, “কাকু, ফ্রিজের ঠান্ডা জল খাবে?” প্লাস্টিকের বোতলে ঠান্ডা গরম জল মিশিয়ে শোভনের হাতে দিয়েছিল তার পরে। ওর মা হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন, “ওরে! সারাদিন এই খোলা রোদে কাজ করেছে। ওদের ঠান্ডা জল দিস না!”
শোভন আর কার্তিক হেসেছিল এট্টু। “কাকীমা! পুকুরের জলে নেয়ে এলাম। গা পুরো ঠান্ডা গো এখন। আর আমাদের শরীলে আর—”
কাকীমা ভ্রূকুটি করে বলেছিলেন, “যা ভাল বোঝ করো। তার পর এই কাজের মধ্যে অসুখ বাধিয়ে আমাদের ফ্যাসাদে ফেলো না!”
তারাকাকা এইসময় বাড়িতে এসেছিল। তারাকাকাকে পাড়া সম্পর্কে কাকা ডাকে শোভন। বয়সে শোভনের চেয়ে ছোট, তা বেশ খানিক ছোট।
তারাকাকাকে ঘরে ঢুকতে দেখে কাকীমা শোভনদের কথা ভুলে গিয়েছিল, মেয়েকে হাঁক দিয়েছিল, “মাম! একটু লেবু জল করে দে বাবাকে। নাকি, গ্লুকন ডি খাবে? কী গো?”
তারপর, গজগজ করছিল খানিক আপন মনে, “এই রোদে, গরমে কাজ করলে শরীর থাকে মানুষের? ট্রেনে ভিড় ছিল? ইসস্! ঘেমেনেয়ে একসা!”
শোভন আর কার্তিক মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ঠোঁট চিপে হেসেছিল খানিক, তারাকাকা কলকেতায় চাকরি করে। সারাদিন ঘরে বসে। তাতেই—ইসস্! পিরীত একেবারে—
সেই সময়ই তারাকাকা বলেছিল, “—যে গুমোট! ঢালবে মনে হচ্ছে দু’একদিনের মধ্যে। তা, বৃষ্টি হলে হয়ে যা বাপু। কাজের দিন যেন জ্বালাস না।”
“ওই যেটুকু সময় ছাদ ঢালাই পড়বে। ওটা হয়ে গেলে, হোক না যত খুশি। যত জল হবে তত ভাল। মজবুত হবে ছাদ।” কার্তিক বলেছিল লুঙ্গির কোঁচড় থেকে খৈনি বের করে তালুতে ঘষতে ঘষতে।
কাল বন্ধ থাকবে কাজ। আজ দোতলার একটা ঘরের শেষ গাঁথুনিটুকু হয়ে গেল। পরশুদিন ছাদ ঢালাই পড়ার কথা।
বেশ করে বৃষ্টি হোক। ভেসে যাক শালা হারামজাদা তারার কাজ! এখন এই আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল শোভন। সেদিনকার ছোঁড়া! তার এখন রোয়াব কত! খাটুনি ওর বেশি হবে এট্টু। কিন্তু জল হলে সেটা গায়ে সইবে।
ভেস্তে যাক। ভেস্তে যাক সব!
~~
পালেদের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে যাওয়া সরু একটা গলিই হচ্ছে শোভনের ঘরের সদর রাস্তা। পালেদের দুটো বাথরুমের পিছনের দেওয়ালের গা ঘেঁষে। ওদের পায়খানার চেম্বার আর পাকা ড্রেনের উপর দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয় শোভনদের। এই রাস্তাটুকু পালেদের জমির উপর দিয়ে। সরকারি পয়সায় বাড়ি বানানোর সময় শোভনের খেয়াল ছিল না রাস্তার জন্য এট্টু জমি বাঁচিয়ে রাখার কথা। তা, দয়া করেছে বটে পাল বাবুরা। বাড়ি তৈরির বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে সবই—
সারা চরাচর এখনো আলোয় আলো, রোদে রোদ হয়ে আছে। শোভনদের বাড়িতে ঢোকার রাস্তাটা কিন্তু ঠিকই অন্ধকারে ঢাকা। স্যাঁতস্যাঁতে। নোংরা। সেই রাস্তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে ফোঁপাচ্ছিল পুচাই। দেখেই পা দুটো যেন মাটির সঙ্গে আটকে গিয়েছিল শোভনের। তারপর হুড় হুড় করে একটা ভয়ংকর জল্লাদ রাগ এসে গিয়েছিল শরীরে। এই মেয়েটাকে দেখলেই আজকাল মাঝে মাঝে এরকম রাগ হয়। ইচ্ছা করে একদিন মেয়েটার মুখে কাপড় গুঁজে হাত-পা বেঁধে ফেলে দিয়ে আসে গঙ্গায়। আপদ জুড়ায়।
“এই হতচ্ছাড়ি!” ইয়া এক হাঁক পেড়েছিল শোভন, “অ্যাই, অ্যাই! ভর সনঝে বেলায় কান্না জুড়েছিস কেন?”
“হীরামন ফেরেনি গো বাবা! ও-ও-ও বা-বা!” শোভনকে দেখে ভয়ে (বা হয়তো ঘেন্নায়, মনে মনে ভেবেছে শোভন অনেক সময়ই) কুঁকড়ে যাওয়ার বদলে উলটে আরো জোরে ডুকরে উঠেছিল পুচাই। “সোনাই বলল কালুয়াকে নাকি ধরে নিয়ে যেতে দেখেছে! বাবা গো!” শোভনের মনে হয়েছিল পুচাই ওই নোংরা সরু রাস্তার উপরই লুটিয়ে পড়ে কাঁদবে এবার।
“নে নে!” বলেছিল ও কুৎসিত স্বরে, “আর ন্যাকরা করিস না!” বলেছিল বটে, কিন্তু মনে খুঁতখুঁতুনি লাগছিল একটা। বেশ বড় সাইজের মোরগ হীরামন। কালুয়া নিয়ে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে কেটে সাবাড় করেছে। এলাকার গুন্ডা ও। ওর উপর কথা বলার সাহস নেই কারো। এতদিনের মোরগ পালা বৃথাই গেল!
‘চুক্’ করে একটা শব্দ করেছিল জিভের উপরে।
পুচাইয়ের উপরই রাগটা হচ্ছিল বেশি। ন্যাকামো করে আঁতকে উঠেছিল মেয়েটা প্রথম যেদিন হীরামনকে কাটার কথাটা তুলেছিল শোভন। ওর মা আর ঠাকুমাও অমনি গলে গেল! সেই অন্য কারো পেটে গেল তো অমন নধর মোরগটা।
“অমন মোরগ ছেড়ে রাখলে যাবে না? লোকে ছেড়ে দেবে? মোরগের শোকে একেবারে উথলে উঠেছে! মোরগ খাবে না, আদর করবে লোকে!”
“দিদি ভালবাসত হীরামনকে—” মৃদুস্বরে বলার চেষ্টা করেছিল বোধ হয় পুচাই।
“অ্যা-ই চ্চোপ্!” গর্জন করে উঠেছিল শোভন। এক থাবড়া মারার ইচ্ছা হয়েছিল মেয়েটার কচি গালে। কোনওরকমে সংবরণ করেছিল নিজেকে।
“হ্যাঁ! ওর উপরেই এখন গাজোয়ারি কর। কী আমার মরদ সুপুত্তুর রে! কী করে তোকে আমি পেটে ধরেছিলাম সেই শুদু ভাবি।” ঘরের বারান্দার উপর থেকে শোভনের মায়ের খিনখিনে গলা এসেছিল ভেসে। বয়সের চোটে কথা বেরোয় না ভাল করে, তবু কথা বলা চাই বুড়ির, “বাচ্চাগুলোর অ্যাতো আদরের মোরগটা—”
“অ্যাই চোপ! চোপ বুড়ি মাগী!” আবার গর্জন করেছিল শোভন। গর্জনে তেমন জোর ছিল না যদিও। এই সবে কাজ সেরে এসে আর কাঁহাতক পারা যায়? গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় উঠে এসেছিল ও। ইতি উতি তাকিয়েছিল এদিক সেদিক, তারপর ঘরের দোরের কাছে বসে থাকা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওই তোর মা কোথায়?”
“জানি না।” নিশ্চিত জবাব দিয়েছিল ছেলেটা।
“না। তা আর জানবে কেন—” বলতে বলতে থেমে গিয়েছিল শোভন। চঞ্চলা ঢুকছে সাদা একটা প্লাস্টিক হাতে ঝুলিয়ে। “এসেছ!” শোভনকে দেখে বলেছিল, তারপর রাস্তার উপরে তখনও দাঁড়িয়ে থাকা পুচাইকে চাপা গলায় ধমক দিয়েছিল একটা, “চুপ কর এবার! অনেক হয়েছে!”
এতক্ষণ শোভনের চেঁচামেচিতে যা হয়নি ওই চাপা গলার মৃদু ধমকে সে কাজ হয়েছিল। পুচাই পুরোপুরি থামেনি, থেকে থেকে হেঁচকি তুলছিল, কিন্তু কান্না চাপার চেষ্টা করেছিল অন্ততপক্ষে।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত চঞ্চলার এ দাপট ছিল না ছেলেমেয়েদের উপর। মাথায় ঘোমটা টেনে ছায়ার মতই ঘুরঘুর করত এদিক সেদিক। কাজ করত বাড়িময়। সরকারি পয়সায় তৈরি বাড়িটা তখনও হয় নি।
কিন্তু আজকাল—
ঘুপচি রান্নাঘরটার বাইরে দরজার কাছে বসে চঞ্চলার মেখে দেওয়া মুড়ি চানাচুর খেতে খেতে শোভন ঘোমটায় মোড়া চঞ্চলার নড়াচড়া দেখছিল। গা রি-রি করছিল রাগে। আগে ঝগড়াঝাঁটি করত চঞ্চলা। মান-অভিমান করত। শোভন রাগের মাথায় দু’একঘা চড় চাপড় ধরিয়ে দিলে কাঁদত ইনিয়ে বিনিয়ে। তারপর আবার শোভনের বুকের কাছে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আদর খেয়ে শান্ত হত। আবদার করত এটা-ওটার। এখন কতকাল হয়ে গেল কাঁদে নি। এই বাড়ি তৈরি শুরু হয়ে ইস্তক। ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়া ইস্তক। মেয়েছেলের রকম দেখে মাথা গরম হয়ে যায় শোভনের।
চঞ্চলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুড়ি চিবুতে চিবুতে ও ভাবছিল, কোন ছুতোয় কি একেবারেই মারা চলে না মেয়েমানুষটাকে? হাত নিশপিশ করছে। চঞ্চলাকে আর পুচাইকে। দুটোকে মারার জন্য হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু সুযোগ ওরা দেয় না কিছুতেই।
ওদিকে বুড়ি মা-টা বকর বকর লাগিয়েই রেখেছে। কিন্তু গভ্ভধারিণীর উপর তো আর হাত তোলা যায় না! দোরের কাছে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়েই চোখ রাঙিয়েছিল তাই শোভন, “অ্যা-ই! চোখ গেলে দোব একেবারে! একেবারে গেলে দোব! ওরম জুলজুল করে কী দেখচিস অ্যাঁ? যা, যা ঘরে ঢোক! পড়তে বোস!”
বলতে বলতে চঞ্চলার চোখের দিকে চোখ পড়তে মুখ নামিয়ে নিয়ে খাওয়া শুরু করেছিল আবার। চঞ্চলার চোখে কোনও অভিযোগ নেই। কিচ্ছু না!
~~
গাবতলার মাঠে মেলা বসেছে। ছোট মাঠটা। একটা বড় তাঁবু পড়েছে নাগিনিকন্যের, তাতেই মাঠের আদ্ধেক ভর্তি। ওই নাগিনিকন্যের শরীর নাকি অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক সাপের। শুনে মনে হয় বাচ্চাদের শো, আসলে কিন্তু তা নয়। যত উঠতিবয়সী চ্যাংড়ার ভিড় হয় ওই তাঁবুতে। রস বেশি যাদের। কমদামী মোবাইল স্ক্রীনে দেখা শুধু পানুতে যাদের মন ভরে না আর।
পেরায় ন্যাংটো হয়েই মেয়েছেলেটা স্টেজে ওঠে। আলোর চমকে তার নাগিনী শরীল দেখাতে গিয়ে প্রায় সবটাই দেখিয়ে দেওয়া হয়। তাঁবুর পিছনদিকে বাবুদের খুশ করার ব্যবস্থা আছে আলাদা। শোভন শুনেছে। নিজেরও একবার স্বচক্ষে দেখে আসার ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু পাড়ার ব্যাপার। এখানে গোপনে কিছু করতে পারার জো-টি নেই। শোভনকে নাগিনিকন্যের তাঁবুর আশেপাশে দেখলেও খবর চাউর হয়ে যাবে চাদ্দিকে।
শোভন ওই মেলার দিকে যে চলেছিল আজ, তার কারণটা ভিন্ন। ওই বড় তাঁবু ছাড়াও আরো বেশ কটা ছোট ছোট তাঁবু পড়ে ওখানে। মেয়েদের চুড়ির দোকান, ছোটখাটো বাসনকোসন, বঁটি কাটারি নিয়ে বসে কয়েকজন, বাচ্চাদের ছোটখাটো খেলনা, কাঠের পুতুল, প্লাস্টিকের হাত পা নাড়ানো পুতুল, এসবও বসে। কিন্তু সেগুলোও নয়। এছাড়াও যে মূল আকর্ষণ এই মেলার, সেটা হল, জুয়ার ঠেক। প্রচুর লোক আসে এখানে জুয়া খেলতে। সত্যিই জমজমাটি আড্ডা। জিনিষটা বেআইনি সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই বেআইন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এলাকার পুলিশ ফাঁড়ির থেকেও নিয়মিত খেলুড়ে আসে এখানে। এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই বরং ফেঁসে যাওয়ার চান্স আছে।
ওই জুয়ার ঠেকের দিকেই চলেছিল শোভন। রাস্তায় কুটুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কুটু শোভনের সমবয়সী। তা চল্লিশ বছর বয়স তো হয়েছেই! কিন্তু বিয়ে-শাদি করেনি। দিব্য আছে খুশ মেজাজে। ওকে দেখে আফশোষ হয় শোভনের। ও-ও যদি কুড়ি পেরোতে না পেরোতে বিয়েটা না করত—
“অ্যা-ই শালা--!” কুটুকে দেখে সম্ভাষণ করেছিল শোভন এঁটো হাসি হেসে। “মেলার দিকে না গিয়ে এদিকে কোথায় চলেছ বাওয়া?”
কুটুও সমান ভালবাসা জানিয়েছিল ওকে, একটা গালি দিয়ে। তারপর ইতস্তত করেছিল যেন একটু, “—ওই...যাচ্ছিলুম এট্টু—ওদিকে।” বলেছিল ও।
“কোনদিকে?” শোভন শুধিয়েছিল।
“ওই, ফিস্টি করছে পাড়ার ছেলেরা।” বলেছিল কুটু।
“ওঃ!” বলেছিল শোভন।
পাড়ার ছেলেরা মাঝেমধ্যেই ফিস্টি করে। পেরাইমারী ইস্কুলের পাশের মাঠটাতে। মাঠটায় ঘাস অল্প। মধ্যিখানের ন্যাড়ামত জায়গা এট্টুখানি। চারিপাশটা আগাছা আর চোরকাঁটা আর ঝোপে ঝাড়ে ভর্তি। মাঝে মধ্যে সাঁওতালেরা ওখান থেকে শিয়াল-টিয়াল, ভাম-টাম মেরে নিয়ে যায়।
ওই মাঠের একপাশে বছর দুয়েক আগে পাওয়া গিয়েছিল শোভনের বড় মেয়ে বুলটির লাশ।
~~
কুটু জিজ্ঞাসা করেছিল, “যাবি নাকি? ফিস্টিতে?”
শোভন ভাবেনি কিছু। চোখ আর কপালের উপর আলতো হাত বুলিয়ে নিয়েছিল শুধু একবার, তারপর বলেছিল, “হ্যাঁঃ!” ডানহাতের তালু দিয়ে নাকটা ঘষে নিয়েছিল জোরে জোরে। বলেছিল, “—চল।”
বুলটিটা খুন হওয়ার পরে খুব সাহায্য করেছিল কুটু ওকে। থানা পুলিশের যত হুজ্জুত, তারপর পুলিশের বড়বাবুকে ধরাধরি করা থেকে শুরু করে এলাকার কাউন্সিলরের হাত পা ধরা পর্যন্ত সবই। নইলে, সেসময় শোভন এমন হাঁদা ভোম্বলরাম মার্কা হয়ে গিয়েছিল যে মাথাই কাজ করছিল না ওর!
বড় মেয়েটা ছিল তো! সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবার বড়। বাপের আদুরে! বাপের আদুরে ছিল মেয়েটা, বলত সবাই। একদম ছোটবেলায় রাত্তিরে শোভনের বুকের উপর জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকত। একটু হাবা ছিল। ছোট ভাইবোনেরা ওর পিছনে লাগলেও বুঝতে পারত না মেয়েটা। সাত চড়ে রা কাড়ত না। ওই স্বভাবটা বিলকুল ওর মায়ের মত পেয়েছিল।
সাত চড়ে রা কাড়ত না, কিন্তু একবার কাঁদতে শুরু করলে থামায় কার সাধ্য? তখন বুকে করে সামলাতে হত শোভনকেই। মরার সময় কেঁদেছিল কিনা কে জানে? ‘বাবা বাবা’ করে ডেকেছিল কি? কাতরেছিল যন্ত্রণায়? সেই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কেমন হাঁদা মত হয়ে গেছিল শোভন।
সন্ধেবেলায় একা কোনদিকে যাচ্ছিল মেয়েটা সে নিয়ে ও ভাবেনি যদিও। থানার বড়বাবু কিন্তু সেটাই জিজ্ঞেস করেছিলেন শোভনকে।
“মেয়ে ভর সন্ধেবেলায় কোথায় যায় জানিস না, আর পুলিশে নালিশ করতে আসিস?”
“লজ্জা করে না? মেয়ে একা একা রাতে বিরেতে ঘোরাফেরা করে? হেঁ হেঁ হেঁ? রেপড হবে না? খুন হবে না?”
ন্যাংটো লাশ হয়ে যাবে না তোর চোদ্দ বছরের মেয়ে?
চারদিক থেকে কথাগুলো ভিড় করে গুঞ্জন করে আসছিল মাথায়।
“মেয়ে কি রঙ্গিলা কাজ করে বেড়াচ্ছে তার খবর রাখিস?” বিরক্তমুখে চেপে চেপে, হেসে হেসে বলেছিলেন ইন্সপেক্টর সায়েব।
সেই হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম একচোখ থেকে একফোঁটা জল পড়েছিল শোভনের।
তাতে এক ধমক মেরেছিলেন ইন্সপেক্টরবাবু। ওইসব প্যানপ্যানে কান্নাকাটি একদম পছন্দ নয় ওঁর।
দমকে গিয়ে কান্না গিলে নিয়েছিল তখন শোভন। মাথার মধ্যেটা ফাঁকা লাগছিল ওর। শুয়ে পড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল।
“ওই! ওই! শালা ন্যাকরা করে ফিট হবে নাকি এখন? এই! হারামজাদা! শুবি না এখানে!”
সেই তখনই হাল ধরেছিল কুটু। “ক্ষমাঘেন্না করে দেন বাবু। সবে আঘাতটা লেগেছে কিনা? মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে মাঠে দেখে ওই কাণ্ড—মাথাটা একদম ছেঁচে দিয়েছে বাবু! পাশে জামার টুকরোটা পড়েছিল তাই—নইলে কী বলব বাবু, মেয়েটাকে চেনা যাচ্ছে না!” কুটুরও গলা ধরে এসেছিল, ছোটবেলা থেকে দেখেছে বুলটিকে। একটু ফুঁপিয়ে উঠতে যাচ্ছিল ও-ও। বড়বাবুর নির্বিকার কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিয়েছিল নিজেকে জলদি জলদি।
বড়বাবু কানে কাঠি গুঁজে মুখ বিকৃত করে বলেছিলেন, “তা, আমি কী করব?”
করতে অবশ্য হয়েছিল কিছু তাঁকে। খবরটা ছড়িয়ে গিয়েছিল। ভোটের আগে আগে ছিল কিনা?
স্বয়ং কাউন্সিলর সায়েব এসেছিলেন শোভনের বাড়িতে। শোভনের বাড়িটা তখনও কাউন্সিলর সায়েবের পায়ের ধুলো পড়ার উপযুক্ত ছিল না।
পাশের বাড়ির পালেরা ভার নিয়েছিল তাঁর আদর আপ্যায়নের।
“ভাল সুযোগ পেয়েছিস, বাবুর কাছে বাড়ির কথাটা—” শোভনের চোখের দিকে তাকিয়ে একটু থতমত খেয়ে চুপ করে গেছিল ওদের বড়ভাই, তারপর বিড়বিড় করে বলেছিল, “তোদের ভালর জন্যই বলছি…বাবু যান না এরম যার তার বাড়ি—”
সরকারি পয়সায় গরীবদের বাড়ির প্রোজেক্টে কিছুতেই অ্যাদ্দিন বাড়িটা হচ্ছিল না শোভনদের। আগে চেষ্টা করেছিল ও। বেশ অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিল। বুলটিটা হামেশাই বায়না করত একটা ছাদের জন্য! ওর ইস্কুলের বন্ধু দীপিকাদের ছাদআঁটা বাড়ি ছিল। শরিকি বাড়ি, বহুদিনের পুরোনো, তবু তো ছাদঅলা? মাঝেমধ্যেই মেয়েটা হিসেব করত, একটা ছাদ হলে, টবে গাছ বসাবে। “ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, জানো বাবা! দীপিকার জেঠু কী সুন্দর বাগান করেছে ছাদে!”
কাউন্সিলরের ডানহাত ছেনার ভায়রাভাইয়ের তিন-নম্বর বাড়িটা না হয়ে শেষটায় শোভনের বাড়িটাই স্যাংশন করেছিলেন কাউন্সিলর সায়েব দয়া করে। পালেদের ধরাধরিতে কী করে যেন দু’লাখ টাকাও পেয়েছিল শোভন। তার মধ্যে পঁচাত্তর হাজার মত ও পেয়েছিল। বাকিটা পার্টি ডোনেশন আর খানিকটা পালেদের—
তা পার্টি না থাকলে পয়সাটা পেত না শোভন, আর পালেরা রাস্তা না দিলেও—
“ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর করিস! ঝামেলা বাড়াস না আর!” বলেছিল পালেদের মেজছেলে। “মেয়ে কী তোর ফিরে আসবে আর? আসবে না তো? এখন দয়া করে বাবু অ্যাতোসব কচ্ছেন--” বলেছিল কে যেন।
মদ খাওয়া লাল চোখ সরু করে ফিসফিসিয়ে বলেছিল পালেদের সেজভাই।
“আরও একটা মেয়ে আছে তোর! বৌ আছে!”
চঞ্চলার মুখ চেপে ধরেছিল সেদিন শোভন রাত্রে। কী করবে? উথালপাথাল খেয়ে কাঁদছিল যে বৌটা। ক্ষেপে উঠেছিল রীতিমতো।
“চুপ! চুপ!” বলেছিল শোভন। “কাঁদিস না! আর কত চাস? আর কত করব? কী করব আমি?”
কে শোনে কার কথা, “বুলটি রে! বুলটি রে!” বুক চাপড়ে বৌটা একটা কথাই বলছিল শুধু। “বুলটি রে!”
কিন্তু ছাদআঁটা বাড়ি হয়েছে ওদের। দুটো ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম পায়খানা। ছাদে টবে গাছ হয়নি যদিও।
আর টাকাও আছে ব্যাঙ্কে।
~~
পেরাইমারি ইস্কুলের মাঠে ফিস্টি চলছিল ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ বাজিয়ে। একটা হ্যালোজেন লাইটও জ্বলছে। উদ্দাম নাচ চলছে তিনজনের।
যে কারণে আজকের এই হঠাৎ ফিস্টি, সেটা রান্নার জায়গার পাশেই পড়েছিল। একটা মোরগের পালক, পায়ের পাতাগুলো আর মুণ্ডুটা। হীরামন। একপলক দেখেই বুঝতে পেরেছিল শোভন।
“মাংস নিয়ে যা একবাটি। তোর ছেলেপুলেদের দিবি।” বলেছিল কালুয়া। প্রচুর মদ গিলেছে। লাল চোখে জুলজুল করে তাকিয়েছিল শোভনের দিকে।
থার্মোকলের বড় বাটিতে করে লাল তেল-চুপচুপে মাংসের বড় বড় পিস চারটে আর ঝোল ধরিয়ে দিয়েছিল তারপর শোভনের হাতে।
খানিকটা মদ খেয়ে নেশা জমিয়েছিল শোভন। তারপর চলেছিল ঘরের দিকে। আঃ! ভাগ্যিস কুটুর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, তাই তো মাংসটুকু জুটল ফিরি ফিরি।
ভাল রান্না করেছে ব্যাটারা। মুখে লেগে আছে এখনও।
অন্ধকারের মধ্যে শোভনদের বাড়িটাকে দেখাচ্ছিল ভূতের মত। অন্ধকারে ঘুপটি মেরে বসে থাকা কালো ভয়ানক জন্তু একটা। মদের ঝোঁকে চোখ পিটপিট করছিল শোভন। ঢোঁক গিলেছিল একবার। কালো বাড়িটা অলুক্ষুণে, এখুনি ওর ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল।
সাহস ভরে দরজায় কড়া নাড়া দিতেই দরজাটা খুলে দিয়েছিল চঞ্চলা। অপেক্ষায় বসে ছিল মনে হয়।
বারান্দা পেরিয়ে যে ঘরটা, বাইরের ঘর, সেটাতেই থাকে শোভন আর চঞ্চলা। ভিতরের দিকের ঘরটায় শোভনের মা নাতি নাতনিদের নিয়ে শোয়।
এ ঘরে চঞ্চলা একা জেগে বসে ছিল। শোভনের মুখের দিকে তাকিয়েছিল ভাবলেশহীন মুখে। টিউবলাইটের ম্রিয়মান ফ্যাকাশে আলোয় সেই নিরুত্তাপ মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শোভনের থিতিয়ে পড়া রাগটা জেগে উঠতে চাইছিল। নেশাটাও বেশি হয়েছে আজকে মনে হয়।
“এ-এ-ই, কোথায় গেল পুচাই সোনাই, অ্যাঁ? তাতাই কই?” বলেছিল শোভন। “মাংস এনেচি। অ্যাঁ, মাংস! ডাক, ডাক ওদের। কই গেল? মুরগির, না না, মোরগের মাংস এনেছি।” হেসে উঠেছিল হো হো করে মাতালের হাসি।
মোরগের মাংস! হ্যাঁ, হ্যাঁ! হীরামনের মাংস!
পেলে পুষে বড় করব আমরা! আর খাবে শুধু ওরা!
“ডাক, ডাক ওদের! ওরাও খাক। মোরগের মাংস! হীরামনের মাংস!”
এগিয়ে গিয়েছিল বাটি হাতে ওঘরের দিকে। এক লাথি মারবে, খুলে যাবে দরজা।
“না!” চঞ্চলার ডাকে পিছন ফিরে দেখেছিল, চঞ্চলা তাকিয়ে আছে শোভনের হাতে ধরা বাটিটার দিকে। “না,” বলেছিল চঞ্চলা আবার। ভাবলেশহীন মুখে ভাব ফুটি ফুটি করেছিল যেন ওর, তাই দেখে পৈশাচিক একটা অনুভূতি হচ্ছিল শোভনের বুকে।
“ওদের ডেকো না।” চঞ্চলা বলেছিল মাংসের বাটির থেকে চোখ তুলে শোভনের মুখের দিকে তাকিয়ে। আবার ভাবলেশহীন হয়ে গেছে ওর মুখ। “আমায় দাও। আমি খাব। ওদের বোলো না!”
“ওরা কষ্ট পাবে। ওদের বোলো না কিছু। ওদের খাইয়ো না।” বলেছিল চঞ্চলা।
তারপর লাল তেল-চুপচুপে মাংসে কামড় বসিয়েছিল একটা। মুখের আশপাশটা লালে লাল হয়ে গিয়েছিল। কী রঙ দিয়েছে ওরা রান্নায় কে জানে? পুরো লালে লাল! রক্তের মত দেখাচ্ছে। যেন রক্ত খাচ্ছে চঞ্চলা। তা খাক, তা খাক, ভেবেছিল শোভন, ও নিজে খেলো যখন, চঞ্চলাই বা খাবে না কেন?
রক্তের রং কিন্তু মোরগেরও যা মানুষেরও তা। বুলটির লাশটা যখন প্রথম আবিষ্কার করেছিল শোভন সেটাও এমন লালে লাল হয়েই ছিল। থেঁতলানো মুখটা আর যোনিটা।
সকালবেলাতেও জ্যান্ত ছিল মোরগটা অ্যাঁ? ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক ওদিক।
কোঁকড় কঁক করে ঘুম ভাঙিয়েছিল শোভনের।
ব্যাটা, মাংস হয়ে গেছে এখন!
হঠাৎ, বমি পেয়ে গিয়েছিল শোভনের ভীষণ!
কোনওমতে নিজের মুখ চেপে ধরে গিলে নিয়েছিল সেটাকে। বমি করা যাবে না।
চঞ্চলা খাওয়া থামিয়ে লালে লাল ঠোঁটে বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিল শোভনের মুখের দিকে। ওর চোখে জল নেই। আগুনও না।
বাড়িটা নিজের টবহীন ছাদ শুদ্ধ গিলতে আসছিল যেন শোভনকে।
বাচ্চাদের কতদিন মোরগের মাংস খাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে চঞ্চলা?
বাইরে বৃষ্টি নামল কি?
ভেস্তে যাক। সব ভেস্তে যাক!